মুক্তিপাগল চেতনায়
বিভ্রান্ত পদচারণা!
সংলাপ ॥ সারা বিশ্বে বাঙালি জাতি অত্যুজ্জ্বল তার
গৌরবময় স্বাতন্ত্রে। প্রত্যেক জাতিরই আছে নির্দিষ্ট সংস্কৃতি যার পুস্প্রিত শাখায়
প্রস্ফুটিত হয় সে জাতির স্বকীয় চিন্তা, চেতনা,
ধ্যান-ধারণা অর্থাৎ তার স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। তার ভাষাতেই প্রবাহিত হয় সত্ত্বার
সলিল ধারা। স্বভাবতঃ তাই সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জাতির প্রাণের সম্পদ,
অচ্ছেদ্য হৃদ-স্পন্দন। আর তাই কখনও যদি কেউ সে হৃদ-স্পন্দনে ধর্মের নামে যমের
কালো থাবা বসাতে চায় কিংবা প্রাণের সম্পদ জবর দখল করে ফলাতে চায় স্ব-ইচ্ছার ফসল
তখনই সোচ্চার হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, অস্তিত্বের ভিত্তি রাখতে
সুদৃঢ় হয়ে ওঠে উৎসর্গিত প্রাণ। এই সত্য প্রমাণ করেছে একমাত্র বাঙালি জাতি সমগ্র
বিশ্বের মধ্যে। নিঃসঙ্কোচে দূরন্ত সাহসে বুকের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে সুরক্ষিত
করেছে বাঙালি জাতি, অমূল্য মানিক-বাংলা ভাষা। শুধু ইতিহাসের ধূলিধূসর
কালো অক্ষরে নয়, সমস্ত বাঙালির সতেজ বুকে'২১ তাই এক অমর অমলিন রক্তাক্ত পোষ্টার।'২১ আসে। '২১ যায় না।
প্রতিনিয়ত '২১ আমাদের বন্ধ দরজার কড়া নেড়ে আমাদের জাগায়। '২১ তার রাঙা বুকের আলিঙ্গনে আমাদেরও রাঙিয়ে তুলে
নিত্য নতুন চেতনায়। প্রতিবারের মত এবারও
'২১ এসেছিল সততঃ নিয়মে। কিন্তু এবারের যাত্রা সূক্ষ্ম কৌশলী। বাঙালি জাতির চরম
পরীক্ষার।
মুখোশধারী বাঙালিদেরকে চিনিয়ে দিয়ে গেছে নীরব
অভিমানে। রেখে গেছে কয়েকটি প্রশ্ন। অমীমাংসিত একটি প্রশ্নের (যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার) পুনরুত্থানের মাধ্যমে।
'২১ জানিয়ে গেল,
দেখিয়ে দিল সত্যিকার বাঙালির রূপ। প্রশ্ন হলো- 'ধর্মীয় চেতনা, না-কি জাতীয় চেতনা, কোনটা বড়? এ দুয়ের কোন সরোবরে স্নান করে সত্ত্বাকে পূত সজীব রাখতে হবে?
'২১- এলেই মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের যে আন্তরিক ও আনুষ্ঠানিক
কর্মতৎপরতা তা কি একে বারেই মূল্যহীন? 'সারিবদ্ধ বাঙালি
উন্মুক্ত পায়ে ধীর লয়ে হেটে চলে। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। হাতে ফুল। মুখে অমর '২১-এর গান। বিভিন্ন নিবেদিত সংগঠনের বিচিত্র
আল্পনা পথে পথে। অসংখ্য বাঙালির সমাবেশ শহীদ মিনার চত্বরে। বক্তৃতা,
সেমিনার, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানে মুখরিত চতুর্দিক।' এমনই হয়ে থাকে,
হয় প্রতি '২১-এ। কিন্তু প্রতিবারের
মত এবারে বাঙালি তার নতুন রূপ দেখতে পেয়েছে? চির পরিচিত
হৃদয়গ্রাহী সেই দৃশ্যের নতুন চিত্রায়ণ ঘটেছে। সমস্ত পথ জুড়ে 'জয়বাংলা' ধ্বনি।
প্রবাহমান হৃদয় স্ফুরিত সুরের কম্পন। বিনীত পায়ের ধীর লয়। ভীড় পুষপার্ঘের
বেদীমূলে। এবারের '২১-এর প্রতি সেই আবেগাপ্লুত বাঙালির হঠাৎ এ দৃঢ়ভাব কেন?
নির্বাচনের জন্য আনন্দ উৎসব আর ঘাতক-দালাল
নির্মূল দৃঢ় প্রত্যয়ের মাঝে এবারের
'২১ এর আবির্ভাব। দ্বিমুখী এই পথের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে বাঙালি হয়ে উঠছে
সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রত্যয়ী। যে যার চিন্তার স্তর নিয়ে চলছে তার নির্দিষ্ট পথে।
অপরদিকে নির্বাচনের জন্য ক্ষমতার নির্লজ্জ লড়াই
জনজীবনে প্রভাব ফেলেছে। পক্ষ-বিপক্ষের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় সাধারণ বাঙালি হয়ে
পড়ছে আতঙ্কিত। কিন্তু এই বিভ্রান্তকর পরিবেশ কি বাঙালির জীবনে নতুন?
এর চেয়ে ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির মধ্যে
'২১ এর সাথে একাত্ম হতে বাঙালি ছিল অকুন্ঠ স্বতঃস্ফূর্ত। আন্দোলনে হয়ে ওঠে আরো
বেশী দীপ্তিময় আরো বেশী প্রাণোজ্জ্বল।
'৫২র পর থেকে বাঙালির জীবনে এসেছে একের পর এক আন্দোলন। বাঙালির জীবন প্রবাহ
বরাবরই বন্ধুর। আন্দোলন মুখর বাঙালি
'২১-এর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েই এবারেও জয় করবে কাঙ্খিত মুক্তির সোনালী সূর্য।
পরাধীনতার সেই নিগুঢ়ে বাঙালি যে কুঠারাঘাত হেনেছিল তা '২১রই শাশ্বত বিদ্রোহী মুক্তিপাগল চেতনারই চরম
প্রকাশ।
বাকী আছে ধর্মান্ধমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। জাতীয়
চেতনাকে ছাপিয়ে ধর্মীয় চেতনা কখনই প্রাধান্য বিস্তার লাভ করতে পারে না। আজ সমগ্র
বিশ্বের মানচিত্রে একবার চোখ ফিরালেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। পূর্ব জার্মান ও
পশ্চিম জার্মান তার বড় প্রমাণ। এই দুই দেশ জাতীয় সত্ত্বার অভিন্নতার কারণেই
দীর্ঘদিন পরে হলেও উপড়ে ফেলেছে বিভক্তির দুর্ভোগ্য প্রাচীর। আগামীতে দক্ষিণ কোরিয়া
এবং উত্তর কোরিয়াও যে একত্রীভূত হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কেননা,
যে জাতির মধ্যে। তার জাতীয়বাদ প্রবলভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত,
সে জাতি কখনই বিভক্ত থাকতে পারে না। এর সত্যতা পাওয়া যায় ১৯৮৪ সালে সাংবাদিক
সম্মেলনে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি
সাংবাদিকদের বলে ছিলেন 'First we are Arab, Second Muslim'.
পাক ভারতে দ্বিজাতি তত্ত্বের মূলে ছিল ধর্মীয় জাত
তত্ত্বের ঠুন্কো দ্বন্দ্ব। এই তত্ত্বকে পুঁজি করেই ভারত পাকিস্তানের সৃষ্টি। কিন্তু এই ঠুন্কো
বন্ধনে বেশী দিন আবদ্ধ থাকলো না বাঙালি জাতি। দুই ভিন্ন জাতি সত্ত্বার একত্রে অবস্থান
কোনদিনই সম্ভবপর নয়। ফলে স্বকীয় জাতীয় সত্ত্বাকে অক্ষুন্ন রাখার তাগিদেই
অবধারিতভাবে বাঙালি ছিনিয়ে নিল স্বাধীনতা। এর পরে আর জাতীয়বাদী চেতনা ও ধর্মীয়
চেতনার মাঝে বিতর্কের অবকাশ থাকে না, থাকা উচিত নয়।
ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে নিজেকে চিনতে শেখায়। কিন্তু মানুষের জীবন চলার পথে অন্য
কেহ ধর্মান্ধতায় মানুষের সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে
তার স্বজাতীয়তাবোধ তাকে উজ্জীবিত করবেই। পৃথিবীতে কোথাও ধর্মীয় জাততত্ত্বের বন্ধনে
কোন জাতিই সৃষ্টি হয়নি হবেও না। তাহলে পৃথিবীর সমগ্র মুসলমান,
বৌদ্ধ, খৃষ্টান, হিন্দু এক একটি ধর্মাবলম্বী জাতিতে বিভক্ত হয়ে
অবস্থান করতো। মুসলমান- মুসলমানে থাকতো না কোন যুদ্ধ,
হানাহানি, বিরোধ। বরং এক দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী
নির্বিঘ্নে বসবাস করছে তাদের নিজস্ব জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। চীন ও জাপানে একই
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাস করলেও তারা বিভক্ত জাতীয়তার ভিত্তিতেই। চীনের বৌদ্ধরা চীনা
এবং জাপানী বৌদ্ধরা 'জাপানী'
ভাবতেই গর্ববোধ করে। ভারতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাস করে। অথচ তারা নিজেদের
ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়, জাতীয় ভিত্তিতেই ভারতীয় হিসেবে পরিচিত লাভ করে
থাকে। সুতরাং সব কিছুর উর্ধ্বে অর্থাৎ সর্বপ্রথমে জাতীয়তা তারপর সার্বিক অঙ্গনে ব্যপ্তি,
এই সহজ বোধ কি সর্বসাধারণের মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত? হলে কেন বাঙালি
জাতি এই পরীক্ষায় উতরাতে পারছে না? বর্তমানে দেশের
সংঘাতময় ম্লান চিত্র তো সে কথাই প্রমাণ করে দিচ্ছে। কাদের দায়িত্ব এই বোধ সম্পর্কে
সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলা? নিঃসন্দেহে স্বশিক্ষায়
শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি মহলের কিন্তু এই বুদ্ধিজীবি মহলেও যে একই দ্বন্দ্বের
ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ। নিজেরাই যখন কাদাজলে হাবুডুবু খেয়ে চলেছে তখন অন্যকে পরিত্রাণের
পথ তারা কি করে বাতলে দেবে?
নিজেদের উৎসর্গিত করে যারা রেখে গেলেন অমূল্য মানিক
বাংলা ভাষা, তারা কি চিরস্মরণীয়,
চিরপূঁজনীয় নয়? আর এ প্রাণের সম্পদ বাংলা ভাষার যথার্থ প্রয়োগও
বাঙালির জীবনে বির্তকের উর্ধ্বে নয়। মহান ভাষা শহীদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও
চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশে যে দ্বিধাগ্রস্থ বা উদাসীন সে কি সত্যিকার ভাবে বাঙালি
জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ? না অন্য কিছু? অকৃতজ্ঞ জন্তুর
মত কি ভুলে যাওয়া যায় আজন্মের ঋণ? তাই '২১-এর চেতনা দীপ্ত মহান দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে
বাঙালিকে হয়ে উঠতে হবে যথাযথ বাঙালি সর্বাগ্রে। নতুবা সত্যিকার মূল্যবোধ বিকাশ
কোনদিনই সম্ভব নয়। যার অভাবেই আজ বাঙালির এই চরম দুরাবস্থা। আবারও যে কোন সময় হানা
দিতে পারে তথাকথিত ধর্মজীবী ধর্মান্ধ পূর্ণসর্বস্ব সত্তদাগরের সর্বগ্রাসী দল। সময়
থাকতে তাই সতর্ক হতে হবে। এবং সক্রিয়ভাবে জরুরী তৎপর হতে হবে জাতীয় মূল্যবোধে
উদ্দীপ্ত এক মহান বাঙালি জাতি গঠনে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন