বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৫

কর্মই ধর্ম হোক

কর্মই ধর্ম হোক

সংলাপ ॥ বাংলার মানুষ থাকতে চায় সার্বিক অঙ্গনে মুক্ত। বাঁধন থেকে মুক্তি। সবধরনের বন্ধন অবসান। সকল রাজনীতিক দুর্বৃত্তের-দুশ্চরিত্রের-দুঃশাসনের-দুর্নীতির আকাশচাপা অবরোধ দূর হোক - এই হচ্ছে বাংলার মানুষের প্রার্থনা।
একপ্রকার প্রবল অনিশ্চয়তা, ব্যাখ্যাতীত ভীতির ছায়া ক্রমশই  গ্রাস করে চলেছে সমাজজীবন, নাগরিক, এমনকী ব্যক্তি-জীবনকেও। এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রায়ণে এমনই এক ইঙ্গিত। ইশারায় নয়, স্পষ্ট অভিব্যক্তিতে। হয়তো এ ভাবনার সমীচীনতা সকলে স্বীকার না করতেও পারেন, তবুও সন্দেহ নেই যে, বিপন্নতা বাড়ছে। না; এ কোনও বিষাদের বিলাপ নয়, বরং রাজনৈতিক সংকটের পূর্বাভাসে আগাম সতর্কতা।
সরকার আছে। শুধু একে দুষে কোন লাভ নেই। কারণ অনেক কিছুরই যে অভাব সেখানে। প্রাজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা, অধ্যবসায়, সাংগঠনিক পরম্পরা-দলীয় এবং প্রশাসনিক  সব প্রয়োজনীয় উপাদানে পুষ্ট হওয়ার পূর্বেই ভূমিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ আজ ৪৪ বছরের কীর্তিমান। কারও চেষ্টায় নয়, পরিকল্পিত পন্থাতেও নয়, কেবল পূর্বতন অজ্ঞ শাসকদের ভুলের ফলে ঘটেছে পূর্বান্তর। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব চেপেছে মহাজোট সরকারের কাঁধে। কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই। কারণ মানুষ এমনটাই চেয়েছিলেন। পরিবর্তনের হাওয়া দিন বদলের পালা। সুতরাং এখন কর্মই ধর্ম হোক। অক্ষমতা স্বাভাবিক, তাকে দূর করে স্ব-নির্ভর হতে হবে। নিছক আবেগের বশে একটি অনৈতিহাসিক ঘটনাকে ঐতিহাসিক বলে চালানো নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের পরিবর্তন বিরাট কিছু নয়। বরং খুবই মামুলি ব্যাপার। এমনকী ওই পরিবর্তনের পিছনে যন্ত্রণার বিস্তৃত বিবরণ থাকলেও নয়। অতীতে এ দেশেও তো এমন ঘটনা কম ঘটেনি! অথচ দুর্ঘটনা, লোভ বা অজ্ঞাত এমন একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে হইহই করাটা বিরোধী রাজনীতিকদের নেহাত বাড়াবাড়ি। সংবাদমাধ্যমের একটি অংশের অতিশয়োক্তির প্রতি অতিবিশ্বাসও শাসকদলের বা বিরোধীদলের পক্ষে বাস্তবানুগ হচ্ছে না। যতটা বিবৃত হল ততটা রূপায়িত হল না। এ সুযোগ চতুরেরা ছাড়ে না। কোমরে গামছা বেঁধে তারাও এখন আসছে। বিতর্ক-বিবাদে ক্রমশ অশান্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গন। মন্ত্রিসভা, কিংবা সরকারি বা বিরোধীদলের কাজের পক্ষে এমন পরিবেশ মোটেই শুভ নয়! দুষ্টজনের মুখেও মিষ্ট কথা আরম্ভ হয়েছে। শাসক-নেতৃত্বকেই এটা প্রাধান্য দিয়ে ভাবতে হবে।
কেবলবৈষয়িক উন্নতিই নয়, উন্মুক্ত হোক মুক্তির আদিগন্ত আকাশ। শহরে-গ্রামে-গঞ্জে, গণমানুষ গণতন্ত্র ফিরে পাক। পথঘাট-কলকারখানা-চাষবাস-বিদ্যালয়-শুশ্রুষাকেন্দ্র; এ-সব তো থাকছেই, তবে তার চেয়েও যা জরুরি তা হল অধিকার-যা কিনা ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল চারদলীয় জোটের হাতে। তাই শান্তি-শৃঙ্খলা-সন্তোষ-স্নিগ্ধতা-সন্তানের জীবন; এগুলোই চায় মানুষ। এ চাওয়ার বোধ তার কাছে সবচেয়ে বড় চাহিদা। অথচ এ চাওয়া, এ প্রাপ্তি এখনও অধরা। যত ছোটই হোক, অশান্তির চরিত্র যে অশনির দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে তা সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে।
বাংলাদেশে শোষণ এবং জীবন সমার্থক। কাজেই এ দেশের গড়পড়তা মানুষের কাছে উন্নয়ন মানে দু’বেলার দু’মুঠো ভাত। আর এরই সঙ্গে অন্যসব প্রয়োজনের কিছুটাও মেটে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। উন্নয়নের বান ডাকালেই যে সার্থকনামা, এ সিদ্ধান্তও সঠিক নয়। যেটুকু যা, তার সবটুকুই তো বড়লোকের ভাগে। গরিবের ভরসা কী?
গোলমালটা মূলেই রয়েছে। একদিকে বিশ্বায়ন এবং আর্থিক সংস্কারের জেরে সাধারণ মানুষ জেরবার। অন্যদিকে ধনবৈষম্যের বাড়বাড়ন্তে ঈর্ষার বৃদ্ধি। সমাজে আর্থিকভাবে ভারাক্রান্ত শ্রীহীন অংশটি ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, সংখ্যাগুরু মানুষের মরিয়াভাব বাড়ছে। ফলে সামাজিক ভারসাম্যের স্তরচ্যুতি, মূল্যবোধের ক্রম-অবলুপ্তি, শৃঙ্খল ভাঙার আওয়াজ তুলে শৃঙ্খলাতেই আঘাত। সমাজের প্রায় সব ঘটনাতেই এই প্রবণতার প্রাদুর্ভাব। আপাতদৃষ্টে একেই এখন আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা নয়। আসলে এটি সর্বনাশা ঝোঁক, ক্রোধের অনর্থ, ভাঙনের ভীষণ্নতা। এ প্রবণতার প্রাবল্য গোটা দেশ জুড়ে। বিশ্বায়নের হাত ধরে পুঁজিবাদী উন্নয়নই আর্থিক অগ্রগতির একমাত্র পথ, এতেই অশান্তির অবসান, সব সমস্যার সমাধান; এই বিশ্বাসই অনর্থের জন্য দায়ী। সবই অনৈতিক রাজনীতির কুফল। প্রশাসনিকভাবে কোনও সরকারের পক্ষেই এ অঘটনের স্থায়ী নিরসন করা অসম্ভব। এমনকী আয়ত্তে রাখাও আয়াসসাধ্য ব্যাপার। আবার প্রথাগত পুঁজিবাদী উন্নয়নও এর সমাধান নয়।
বৈষম্যের সঙ্গে বিরতিহীন বিরোধ এবং দুই সমাজের শিক্ষাগত সংস্কার-ভাবনায়-ভাষণে-লেখনীতে-শিল্পে-সাহিত্যে সর্বত্র, অশান্তির মূল কারণ অনুসন্ধানের বিশ্লেষণে। উনবিংশের উদাহরণে একবিংশর পুনর্জাগরণ। জীবনেই যখন পচন তখন সংস্কারের প্রয়োজন। দেশবাসীর জীবনাভিমুখ এখন সেদিকেই তাকিয়ে। উনবিংশে সমাজের সংস্কার, আর একবিংশে মনুষ্যবিমুখ পচাগলা রাজনীতির ঢালাও সংস্কার। আদর্শহীন রাজনীতিকদের বহিষ্কার। ঢেলে সাজানোর চেষ্টা। পারবেন কি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ পথে হাঁটতে? মানুষকে হাঁটাতে? পারলে ইতিহাসও তাঁর পায়ে-পায়ে হাঁটবে এবং একইসঙ্গে মানুষও।

সম্মানিত প্রধানমন্ত্রী! মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করেছে। এখনও সে বিশ্বাস অটুট। তাই ডাক দিন। ঘরে ঘরে ডাক পাঠান। দলতন্ত্র নিকেশ হোক, দলবাজি নিপাত যাক, ধর্মের নামে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি দূর হোক, ধর্মান্ধতা দূর হোক প্রশাসন নিরপেক্ষ হোক-কঠোরতম নিরপেক্ষতা শাসনের ধর্ম হোক, স্বচ্ছতা সর্বাঙ্গের ভূষণ হোক। প্রমাণ করুণ কেবল একটি দেশের-একটি দলের মামুলি প্রধানমন্ত্রীই নন, আপনি তার চেয়ে অনেক বড়; মহৎ কোনও উদ্দেশ্যের অভিযাত্রী! দল আছে, থাকবেও; কিন্তু প্রমাণ করুন দলের চেয়ে দেশ বড়, মা হিসাবে মানুষের প্রতি দায় আরও বড়। সময়ও লাগবে অনেক। তা লাগে তো লাগুক। কত সময়ই তো নষ্ট করেছি আমরা। আমাদের মতো সাধারণ যারা তারা তো অপেক্ষাতেই আছে। সেই কতকাল, কতযুগ ধরে। 

টকশো

সময়ের সাফকথা ....
টকশো

ইশতিয়াক ॥ টিভি টকশোতে এত এত তার্কিক তর্ক করে, সভা-সমিতিতে এত বক্তব্য বিবৃতি চিৎকার হজম করতে হয় তবু নির্মমতা থামে না, পেট্রোলবোমায় পুড়ে মারা যায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, দূর্নীতি কমে না, ন্যায় প্রতিষ্ঠা পায় না, আলোর বিপরীতে অন্ধকারে মূখ চাওয়া চাওয়ীর অবসান ঘটে না। এক্ষেত্রে টকশো বিশেষজ্ঞরা হয়ত বলবেন পরিবর্তন একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। মানুষের বাক ও বিবেকের স্বাধীনতার জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণের হয়ে সত্য-ন্যায়-শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তারা কথা বলেন। কিন্তু এটাই কি শেষ কথা। টিভি টকশোতে অর্ধ সত্য, কৌশলী সত্য, জটিল সত্য, দলকানা সত্য, চাপিয়ে দেয়া সত্য, মানুষকে বোকা বানানোর সত্য, সর্বপরি প্রক্রিয়াজাত সত্য প্রচার করা হয়। যার যার সত্য তার তার মত হলেও স্বাভাবিক চেনা একটি সত্য ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে রয়েছে। জনগনমনস্তাত্ত্বিক সেই সত্য সমাজ কাঠামোর অভ্যন্তরে সহজ সরল প্রাণে অহরহ বাজতেই থাকে। সেই অর্ন্তনিহিত সুর অসুরকে, কালোকে, অন্ধকারকে সহজেই চিহ্নিত করে। এটি মানবিক শান্তি সাম্যতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যাপিত জীবন চর্চার অর্ন্তনিহিত স্বকীয় বৈশিষ্টকে বহন করে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীকে তুলে ধরে এমন একটি পর্যবেক্ষন ক্যামেরা সার্বক্ষনিক কাজ করে। ফলে সাধারণ জনগণের কাছে গণতন্ত্রের স্বঘোষিত শিক্ষকদের এসব আস্ফালন হাসির উদ্রেক সৃষ্টি করে মাত্র। তাইতো লালন সাঁইজী বলেছেন- পন্ডিত কানা অহংকারে/সাধু কানা অন বিচারে।
বেশ জোরে সোরে বলা হয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমের একটি সম্পাদকীয় নীতি রয়েছে। টিভি টকশোতে মধ্যরাতে এসব মিথ্যাচার নিয়ে তথ্য প্রাপ্তি/ব্যাখ্যা তো সম্পাদকীয় নীতিমালা অনুযায়ী বলার এবং জনগণের পাবার অধিকার রয়েছে। সুষ্পষ্টভাবে তথ্য বিকৃতি, গায়ের জোরের যুক্তি ও অতি কৌশল বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের দায়িত্ব ও মর্যাদাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কাগজ কলমে গণমাধ্যম কে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় কিন্তু এটি যে বাস্তবিক অর্থে সব সময় ঠিক নয় তা উপলব্ধি করা কঠিন নয়। প্রক্রিয়াজাত সংবাদ, সম্পাদকীয় নীতির নামে ব্যক্তি বা কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির সংবাদ, অশুভ উদ্দেশ্য প্রণোদিত টকশো হরহামেশাই হচ্ছে। টেলিভিশন টকশো পরিণত হয়েছে বিশেষ লক্ষ্য পুরনের হাতিয়ার। কতিপয় গণমাধ্যম কতিপয় ব্যক্তির খেয়াল খুশির বাহনে পরিনত হয়েছে।
স্বার্থের জন্য অন্ধ উম্মাদ গণমাধ্যম ব্যক্তির তালিকা বেশ লম্বা। প্লট ফ্ল্যাট, মালেয়েশিয়া-অ্যামেরিকায় বিত্ত বৈভবের লম্বা ফিরিস্তি কম বেশী সবার জানা। বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টির গুঞ্জন উঠলেই টকশোতে কারো কারো সোচ্চার উপস্থিতি পরে আত্মগোপন করার সংবাদ অজানা নয়। 
শাহবাগ গণ জাগরণের সময় সব নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে একটার পর একটা ফর্মুলেটেড সংবাদ সীমাহীন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে গোটা গণমাধ্যম সংস্কৃতিকে। সাতক্ষীরায় জঙ্গী দমনে ভারতীয় বাহিনীকে জড়িয়ে কাল্পনিক সংবাদ প্রচারের কথা অনেকেই জানি।
বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশ্বজিৎ হত্যা, নারায়নগঞ্জে ৭ খুন, আগুনে পোড়া নিরীহ মুখগুলোর ভিডিও ফুটেজ বারবার দেখানো হয়েছে। এটি গণমাধ্যম কে ব্যবহার করার একটি পরিস্কার অপকৌশল। বেশ কয়েকটি টেলিভিশন মধ্য রাতের নিউজ ম্যানুপুলেট করে প্রচার করে।
সমস্ত নীতি নৈতিকতা অমান্য করে দলীয় অন্ধ আনুগত্যের প্রয়োজনে বিশেষ সংবাদ তৈরী করা হয়। ফেরারী আসামীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের অসহায় উপস্থিতি প্রমাণ করে এদেশে গণমাধ্যমের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। 

পত্র পত্রিকায় প্রতিদিনই প্রবন্ধ ছাপা হয়, সাম্য সমতা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে নানা পরামর্শ যারা দেন তাদের অনেকরই তো পাহাড় সমান সম্পদ, ৫/৭ টি গাড়ি বাড়ী। দেশী-বিদেশে বিস্তৃত ভুতুড়ে নেটওয়ার্ক। কি হাহাকার তাদের কন্ঠে, কি দারুন প্রতিবাদের ভাষা তাদের। কত চমৎকার বৈপরিত্যের শহরে নাগরিক সব আয়োজনে বুক উচু করে বেমালুম কথার ফুলঝুরি হাকান নাগরিক উৎসবের এই সব অতিথীরা। মেরুদন্ডহীন অনেক উম্মাদ শুধু বলেই যান একবারও খোঁজ খবর   নিয়ে জানতে চান না তাদের এসব ভদ্রচিত খিস্তি খেউর জনগণ গ্রহণ করেন না। নিজের জীবনের বিত্ত বৈভবের ঝুড়ি থেকে উৎসরিত মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর পরামর্শের পর পরামর্শ অপাংতেয়,  বুমেরাং হয়ে বারবার তাদের দিকেই ফিরে আসে। সীলমোহর মারা এসব তথাকথিত সুশীল সজ্জনেরা এই সহজ সত্য পুরস্কারের মাহাত্ম্য অনুধাবনে অক্ষম। হাল আমলের সুদের ব্যাপারীর সৌখিন দেশপ্রেম একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তামাশা। নির্বাচন কমিশনে হলফ নামার তথ্য নিয়ে সোচ্চার সুশীলরা যদি নিজেদের সম্পদের বিবরন জাতিকে দিতো তবে ঢের বেশী কৃতজ্ঞতা ধন্যবাদ তারা পেতে পারতেন। যারা কেবল রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পারার কারণে তথাকথিত সুশীল হয়েছেন, তারা আগে বলুক আমাদের অতীত কর্মকান্ড ভুল ছিল। যারা পেশাগত কারণে বিবেকের তাড়নায় তথাকথিত সুশীল সমাজের হয়ে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চান তারা জনগণকে সাক্ষী রেখে বলুক কোন পরিস্থিতিতেই পুত্র পরিজন এবং নিজের জন্য দলীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করবেন না। এটাও যদি সম্ভব না হয় তবে প্রকাশ্যে বলুক আমি দলীয় আনুগত্যশীল। জনগণকে ধোকা দিয়ে বোকা বানানোর এই মোনাফেকি সমাজে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। আর তা না হলে অধিকতর দেশপ্রেমের স্বার্থে স্বঘোষিত সুশীলরা নিজেরা মিলে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ফ্রন্ট গড়ে তাদের কর্মসুচী নিয়ে জনগণের মুখোমুখি হোক। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ গ্রহন করুক। তবেই তাদের চিন্তা শুভ না অশুভ জনগণ বিচার করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে সব মানুষের কথা বলার অধিকার রয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক দলের শত ব্যর্থতা সত্বেও রাজনীতির বাইরে দেশ পরিচালনার বিকল্প কোন সুযোগ থাকতে পারে না। সুশীল নয় বুদ্ধিজীবি নয় আদর্শিক রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষ সত্যের জন্য শান্তির জন্য অগ্রগতির জন্য কাজ করেছে সেই নজীর স্বাধীকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সব পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে অহরহ রয়েছে।  

প্রতিনিয়ত নতুন উদ্যমে পথ চলা শ্রেয়

প্রতিনিয়ত নতুন উদ্যমে পথ চলা শ্রেয়

সংলাপ ॥ সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণের স্বার্থই তার সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার। কিন' বর্তমানে দেশের জনগণের অগ্রাধিকার কোন্‌টি সে কথা কি প্রধানমন্ত্রী এখন জানতে পারছেন? বা জানার চেষ্টা করেছেন?
আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে জনগণের দূরত্ব তৈরি হবে, অর্থাৎ তারা জনগণের অগ্রাধিকার কোন্‌টি তা তারা বুঝতে অক্ষম হয়ে উঠবেন-সে কথা বাহ্যিক দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এখন যেন তাই হচ্ছে। যদিও ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’-এ মনোভাব পোষণ করেন এমন নেতাকর্মীর সংখ্যা এ দলটিতেই এখন আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। দিন বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আদর্শিক দৃঢ়তা এবং কর্মক্ষমতা দেখে  স্বভাবতই হতাশ হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিক, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিদেশী চাটুকাররা, কিন্তু আওয়ামী রাজনীতিকদের এখনও টনক নড়েনি।
জনগণের চাওয়া-পাওয়া অর্থাৎ জনগণ প্রকৃত অর্থেই কী চায় তা একটি সরকার বুঝতে না পারলে তবে ধরে নেয়া যায় যে, সরকারের ভেতরে বা ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোথাও না কোথাও একটি গলদ আছে। যে-গলদের কারণে সরকার দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বা জনগণের অগ্রাধিকার কোনটি তা বুঝতে পারছেন না বা দল হতে সেই পরিস্থিতি বুঝতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে জনগণ ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছে সরকারের ওপর। আর মহাজোট সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি বহমান আস্থায় ভাটা পড়ছে বলে দেখা যাচ্ছে, যা দেশের বেশ কয়েকটি জনমত জরীপে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
অবশ্য বিরোধী দলীয় সকল রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকান্ডে যে জনগণ খুশী তাও কিন্তু নয়। জনমত জরীপগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি দলের জনপ্রিয়তা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সেখানে তাদের কৃতিত্বের কিছু নেই। আমাদের দেশের রাজনীতির চরিত্রগত একটি দিকই হচ্ছে, ক্ষমতায় থাকলে জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।
এ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজের সুফল জনগণ পাচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক অংশের জনগণের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে-এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কৃষকদের মধ্যে সার বিতরণ সরকারের  আরও একটি বড় অর্জন। খাদ্য উৎপাদনেও সরকারের কৃতিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ জনগণের স্বার্থ সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত হয়ে সেগুলো বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ হয়েছে সেখানে সরকারের সফলতা ঠিকই এসেছে। জনগণও তার সুফল ভোগ করেছে। তবে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সার্বিক অঙ্গনে সাধারণ মানুষ এখনো জিম্মি হয়ে আছে তা সরকারকে বুঝতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, জনগণের স্বার্থ ও অগ্রাধিকার কোন্‌টি তা বুঝতে হলে বৃহত্তর স্বার্থে সরকারকে আরও অনেক আন্তরিক ও সজাগ হতে হবে। সবজান্তা গণমাধ্যমে উঠে আসা সমস্যাগুলো অহেতুক না ষড়যন্ত্রমূলক না প্রকৃত জরুরি তা চিহ্নিত করে সঠিক সমাধানে আরও অনেক তৎপর হতে হবে। অযোগ্য ও অদক্ষ মন্ত্রীদের সরিয়ে যোগ্যদেরকে কাজের জায়গা করে দিতে হবে। সমালোচনাকে ভয় ও উপেক্ষা না করে তা থেকে সমাধানের উপায় বের করে আনতে হবে। সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার মান আরও উন্নত করতে নতুন উদ্যোমে প্রতিনিয়ত কাজ করার এখনই সময়। 

ঘুণে ধরা রাজনৈতিক অঙ্গন!

ঘুণে ধরা রাজনৈতিক অঙ্গন!

সংলাপ ॥ কাঁচা বাঁশে ঘুণ ধরে না। এটাই প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম। কাঁচা বাঁশের শুকনা ছালের নিচে যে রস থাকে, তাতে ঘুণপোকাদের বাঁশ খেতে অসুবিধা হয়। খটখটে না হলে তারা খেতে পারে না। তবে প্রকৃতিতে অঘটনও ঘটে। কাঁচা বাঁশেও ঘুণে ধরে। সে বড়অলক্ষুণে। ঘুণে ধরা বাঁশদাঁড়িয়ে থেকে বাঁশঝাড় শেষকরে দেয়।
প্রকৃতির সেই অলক্ষুণে অঘটনটা রাজনীতিতে একটা সরকারের ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। কাঁচা বয়সের সরকারে ও বিরোধীদলেঘুণে ধরছে ভুলের জন্য। কুর কুর শব্দ করে খাচ্ছে। যারা সে শব্দ শুনছেআর মানুষকে শোনাচ্ছে, তাদের  ভয়ভাবনা হচ্ছে।  যারা ঘুণের শব্দ শুনেও শুনতে চায় না, তারা বাঁশটার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘুণ কথাটার তিনটা অর্থ। একটি হলো ওই ঘুণপোকা। এরা রসহীন শুকনো খটখটে বাঁশে ধরে, কাঠে ধরে, মরাগাছের গিটে ধরে, গুঁড়িতে ধরে। খেয়ে খেয়ে অক্ষরের মত ক্ষততৈরি করে। তাকেই বলে ঘুণাক্ষর। ঘুণ কথাটার আরেক অর্থ ছলাকলায়, গোঁজামিলে, নিপুণ, ওস্তাদ। তৃতীয় অর্থটি - ঈপ্সিত, আভাস। ঘুণের এই তিন অর্থই দেশের কাঁচা বাঁশ সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ফুটে উঠেছে।
ঘুণে ধরার প্রথম অর্থ ফুটেছেঃ বাঁশে যেটা রসের জোর, সরকারের ক্ষেত্রে সেটা হলো সাধারণ মানুষ দরদী -নীতির জোর। কাঁচা বাঁশ যখন মাটি থেকে রস নেবার শক্তি হারায়, ভেতরে দুর্বল হয়ে, খটখটে হয়ে পড়ে, তাকে ঘুণে ধরে। কাঁচা বাঁশের শুকনো হবার লক্ষণ ফুটে ওঠে।
ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বাঁশের মতো সরকারও যখন সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্যাণকর নীতি ও তার রূপায়নের শক্তির জোর হারাতে থাকে বিরোধীদলীয় ষড়যন্ত্রের জন্য তখন ভেতরে সঙ্কটতৈরি হয়। সরকার খটখটে হয়ে পড়ে। তাকে ঘুণে ধরে। তাদের কাজে-কথায় ফুটে ওঠে ব্যর্থতা, অনিয়ম, বেনিয়ম, মুখে বড়াই। হ-য-ব-র-ল সৃষ্টি হয়। অপরদিকে বিরোধী রাজনীতিকরা ঢিলেঢালা, অগ্রাধিকার, জ্ঞানহীন, অস্থির, দিশাহারা হয়ে পড়ে। হলো না, মুখে আস্ফালন, মিথ্যা আশ্বাস, ধর্ম গেল দেশ গেল বলে মিথ্যাচার করে। কাজে ও কথায় ফারাক দেখা দেয়। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সঙ্কট সমাধানে তারা পথ খোঁজে না।
ছড়ায় আছে - পানের ভিতর ফোপরা। কাঁচা বাঁশ সরকারের ভিতর ফোপরা। স্বাস্থ্যক্ষেত্র, শিক্ষাক্ষেত্র, কৃষিক্ষেত্র, আইনশৃঙ্খলাক্ষেত্র, বিদ্যুৎক্ষেত্র, অর্থক্ষেত্র - এমন একটি ক্ষেত্র নেই যেখানে সঠিক ব্যবস্থাপনার নীতি গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য ঘুণে ধরেনি এবং তা হতে উত্তরণের জন্য নানা যুক্তি, দাবি, তর্কতুলছে সরকার।
অপরদিকে বিরোধী শক্তির মিথ্যাচারে জেলায় জেলায় সাধারণ মানুষ রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। ক্ষেতমজুরের মজুরি কমছে। বন্টনবিলি ঠিক চলছে না। লুটতরাজের সন্ত্রাস সৃষ্টিতে দুর্বৃত্তরা প্রশ্রয় পাচ্ছে। প্রভাব খাটিয়ে  বিরোধী শক্তি  অভিযুক্তকে আড়াল করছে, থানা থেকে ছাড়িয়ে - ছিনিয়েনিচ্ছে। গণতন্ত্রের মাথায় কদর্য পা রেখে শিক্ষাঙ্গনে দলতন্ত্র বাড়াচ্ছে। জোট ও গোষ্ঠীর সংঘর্ষে এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে মারছে। শরিক দলের নেতাকর্মী আক্রান্ত হচ্ছে। এলাকায় মানুষ ভয়ে, অশান্তিতে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকছে। প্রতিহিংসা, আক্রমণ চলছে। খুন করা হচ্ছে।স্কুল-কলেজে ছাত্র পেটাচ্ছে। প্রতিবাদের মিটিং মিছিলে সন্ত্রাস করছে। মুখে গণতন্ত্রের কাঠামো রক্ষার কথা, গণতন্ত্রপ্রিয়তার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু কাজে বিপরীতটা করা হচ্ছে। প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে আমলাতন্ত্রকে কাছে টানার পথ করছে। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, বিজ্ঞপ্তি বদল করে বিভ্রান্তি, ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়াচ্ছে বিরোধী শক্তি, অধিকারের মাত্রাবোধ হারাচ্ছে।জনগণতন্ত্রেরনীতিরীতি অনুসরণ না করে জনগণের কাছে নিজেদেরকে হাস্যস্পদ করে তুলছেন। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা অগ্রাহ্য হচ্ছে। প্রতিশ্রুতির যত ফানুস একে একে ফাটছে।
প্রবাদ আছে, সকাল দেখেদিন কেমন যাবে বোঝা যায়।সরকারের ঢিলেঢালা নীতি তাকে ঘুণে ধরিয়েছে। ঘুণে ধরা কাঁচাবাঁশ সরকারটা সময়ের তালে তালে কঠোর ব্যবস্থা প্রতি অঙ্গনে না নিলে কখন দেশবাসীর মাথায় ভেঙে পড়ে এই আশঙ্কায় জাতি দোদুল্যমান!
ঘুণে ধরার দ্বিতীয় অর্থ ফুটেছেঃ ঘুণ ধরার কথা আড়াল করতে, দেশবাসীর সব মৌলিক ও জরুরি জীবন-যন্ত্রণার সমস্যা সমাধানে সরকারের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নতুন সরকার গড়তে যে জনমর্থন ছিল তা ধরে রাখতে সরকার নতুন নতুন কৌশল নিচ্ছে। ইতোমধ্যে আমলাদের দপ্তর বার বার বদলি করা হয়েছে। অপেক্ষায় আছেন অনেক মন্ত্রী। সরকারের নীতি জনস্বার্থমুখী হলেও ঘুণে ধরায়  দোষ অপদার্থ কিছু মন্ত্রীর।
বিরোধী রাজনীতিকদের আরেক দক্ষ কৌশল হলো - বাঙালির অন্তরে যে দিকে টান বেশি, ভাবাবেগ বেশি, যে আবেগ যে বিষয়ে তাদের মধ্যে খেলে বেশি, সে সব ভাঙিয়ে খাও। সে সব নিয়ে নতুন নতুন ঘোষণা, হইচই, কাজের জিগির ও কর্মব্যবস্ততা তোলায় সুযোগ খুঁজতে থাকো। বরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্বকে, বিদ্রোহী  কর্মাত্মাকে, বিপ্লবী ঐতিহ্যকে ভাঙিয়ে খাও। ঘুণে খাওয়ার কুর কুর শব্দ চাপা দিয়েবিরোধীদল যে সবুজ  আছে, তার প্রমাণ করো। পাশাপাশি কৌশল নিয়েছে সরকারের ব্যর্থতা, বিরোধিতা ও বিদ্বেষ বাড়ানোর।  উদ্দেশ্য একটাই, পিছিয়ে থাকা মানুষদের মনকে সরকার সম্পর্কে বিষাক্ত করা। এরপর হয়তো বলা হবে সরকার চক্রান্ত করেছে। ছলাকলা চমক ভঙ্গি। ঘুণধরা থেকে মানুষের চোখ সরাতে যতই বাঁশের গিটে গিটে চমক ও প্রতিশ্রুতির নতুন পাতা ও কঞ্চি পোঁতা হোক আর তাকে সজিব প্রমাণের চেষ্টা করা হোক, ঘুণ বিরোধীদের ছাড়ছে না। হ-য-ব-র-ল-ব খট খটে বিরোধীদের বড় সুখ। কুরকুর শব্দে তারা বাঁশ খায়, কাঠ খায়, মরাগাছের গিট খায়, সরকারও খায়। ইতিহাসে শোনা যায়, একদল পন্ডিত মানুষের মাথাতেও ঘুণ ধরে। মস্তিষ্ক কুরে কুরে খায়। সেখানে ঘুণাক্ষরতৈরি করে। তখন প্রভু তাদের যা নির্দেশ দেয়, তারা সে মতো চলে, বলে, কাজ করে সেটাও চলছে বর্তমানে।
ঘুণেধরার তৃতীয় অর্থ ফুটেছেঃঘুণে খাওয়ার কুরকুর শব্দের মধ্যে, আর ঘুণাক্ষর পড়ে সরকার  আশঙ্কার ইঙ্গিত, আভাস, আঁচ করছে। সরকারের যত হিতাকাঙ্খীরা যারা কাঁচা বাঁশ - সরকারটিকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এনেছে, তারা কাঁচা বাঁশেএখন ঘুণের কথা দেখিয়ে সরকারকে সতর্ক করছে। পরামর্শ দিচ্ছে, সরকার কাঁচা নবীন সবুজ থাকে যদি তার শেকড়ে শেকড়ে, প্রশাসনিক দক্ষতা, সমন্বয় ও সফলতায় রসের যোগান যাতে থাকে। তা না হলে মেঠো বক্তৃতা আর মনোরঞ্জনী প্রচারে চিঁড়ে ভেজে না। বিরোধী অবস্থানে যা চলে, সরকারের অবস্থান থেকে তা চলে না। গোঁজামিলে প্রশাসন দুর্বল হয়। মরা বাঁশে চমক ও প্রতিশ্রুতির ডালপালা সাজিয়ে মরাকে জীবিত বলে ভ্রম সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু ঘুণপোকাকে ফাঁকি দেয়া যায় না।
জোট-শরিক সম্পর্ক তাদের অসন্তোষের বিষয়েসজাগ করছে। প্রতিরোধের চেহারা, জনমত সৃষ্টির সাফল্য, শুনিয়ে সতর্ক করছে। ঘুণপোকা মারার কৃৎকৌশল সম্পর্কে ইঙ্গিত, আভাসও দিচ্ছে। সরকারের কাছে তাদের বিপুল প্রত্যাশায়, প্রতিশ্রুতি পূরণের কার্যকর ভবিষ্যৎ দিশা পাচ্ছেনা - এসব কথা সরকার হিতাকাঙ্খীরা নানাভাবে শোনাচ্ছে। সরকার ঠিক ঠিক নজর দিচ্ছে না বলে ক্ষোভও প্রকাশ করছে। কমিটি গঠনে আধিক্য, অনিয়ম-বেনিয়ম সম্পর্কে সতর্ক করছে।
অপরদিকে মিথ্যাচার আর ষড়যন্ত্র করে বিরোধীদলীয় শক্তিতে ঘুণতার সব অর্থেই কাঁচা বাঁশ রাজনীতিতে আগাগোড়ায়ধরেছে। ঘুণাক্ষরে ফুটে উঠছে - বিরোধী শক্তির ভিতর ফোপরা।

ঘুণে ধরা বাঁশের রাজনৈতিক ইতিহাস হলো - ভেতরে ফোপরা নিয়েও সে দাঁড়িয়েথাকতে পারে অনেকদিন। কিন' সময় বুঝে, দেশবাসীর হাত জড়ো করে, সরকারের জোর সাহসী ধাক্কা বিরোধী শক্তির মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে দেয়া হলে, ঘুণে ধরা বাঁশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে বাধ্য। বিপদ কাটে। সাধারণ মানুষ বাঁচে। স্বস্তি শান্তি ফিরে আসে দেশে। 

শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৫

সাধের বাঙালি

সাধের বাঙালি

সংলাপ ॥ স্বাধীন দেশে বাস করে যেমন আমরা বলতে পারি না ‘আমরা মুক্ত’, তেমনি বাংলাদেশে বাসও করে সগর্বে বলতে পারি না ‘আমরা বাঙালি’।
সময় বড় নির্মম। গতিতেই করে তোলে জীবনময়। আসা-যাওয়ার মাঝে কোন নিষ্ঠুরতাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে না তার। চলার ধর্মেই আরো একটা বছর চলে গেল বাংলাদেশের জীবন থেকে। সংখ্যায় আরো ‘এক’ যুক্ত হয়ে বাংলা সন হলো ১৪২২। নতুন বছর। নতুন বছরের কাছে আমরা নিবেদন করি। আবেদন জানাই। আবেদনে নিবেদনে আশার তরঙ্গে আমাদের নিত্য সাঁতার। ১৪২১ চলে গেছে যেভাবে যাওয়ার। আমাদের স্মৃতিতে এ সালের হিসাবে কিছু গরমিল থাকতেই পারে প্রত্যেকেরই। থাকবেই। এ নিয়ম লঙ্ঘনের নয়। আশা থাকলে আশাহত হতে হবে। কর্মেও হতে পারে ভুল। ভুল তো কর্মীর জীবনে উত্তরণের সিঁড়ি।প্রগতিতে ১৪২১ বাঙালি হতে পেরেছিল কি? হতে কি পারবে ১৪২২-তে ? বাঙালির ঘরে জন্ম বলেই বাংলা নববর্ষ এলেই আমাদের উৎসব মুখরতা তীব্র হয়ে ওঠে। উৎসবের উদ্দামতায় নিজের চেতনায় কতটা বাঙালি হতে পারলাম - এই চিন্তার স্থান দিই ক’জনা আমাদের মস্তিষ্কে? বাঙালির ঘরে জন্মালেই বাঙালি হওয়া যায় না। নিজেকে বাঙালি রূপে গড়ে তুলতে হয়। বাঙালি জাতীয়তাবোধ নিজের ভিতরে জাগ্রত রাখতে হবে সর্বক্ষণ। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ থাকতে হবে। স্বদেশ ও স্বভাষার প্রতি মমত্ববোধ অটুট থাকতে হবে। তবেই নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করবার অধিকার জন্মে। কার্যত আমরা কি তা পারছি ?
বলতে দ্বিধা নেই, প্রবাসী জীবন যাপন যারা করেন তাদের অনেকেই নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেন। তারা ভাবেন বাঙালি পরিচয় দিলেই তিনি চিহ্নিত হবেন একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একজন হিসেবে। ভিখিরী, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিগ্রস্ত জাত হিসেবে। যত দ্রুত সম্ভব তারা সম্পর্ক ছেদ করেন স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বভাষার সাথে। কেন এই সংকীর্ণতা? কোনভাবেই কি তারা লুকাতে পারবে তাদের বাঙালি আকৃতি ও প্রকৃতি? পোশাক-পরিচ্ছেদ, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, উৎসবে-আয়োজনে যতই তারা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করুক না কেন, সে কোনদিনই পাশ্চাত্যের একজন হতে পারবে না। এ দেশে বসবাস করেও অনেকে একই ভাবধারা পোষণ করেন। কথায় কথায় তারা অবজ্ঞার সুরে প্রায় বলে থাকেন - ‘দেখতে হবে না, এতো বাঙালি জাত’। অথবা ‘বাঙালিরে হাইকোর্ট দেখান’ অথবা ‘এই দেশে কি মানুষ থাকে?’ বাঙালি হয়ে জন্মানোটাই যেন তাদের কাছে আজন্মের পাপ বলে মনে হয়। অজ্ঞাতে ছুঁড়ে দেয়া থুথু তারপর তারা যে নিজেরাই নিজেদের মুখে লেপ্টে দিচ্ছে এই বোধ কি কোন কালেই জাগবে না?
চেতনার ঘরে যতই তালা মারা থাকুক না কেন, তারা কিন' ঠিকই বিচরণ করছে ধর্মান্ধতা, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি নিয়ে পর্দার অন্তরালে অন্ধকার রাজত্বে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের  হাতে বেজে উঠছে বিভেদের ঘন্টা ধ্বনি। অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যে অথবা স্বার্থবাদী ধর্মের কলে অথবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বাঙালি বিরোধে জড়ায় বাঙালির সাথে। জাতীয়তাবোধে ফাটল ধরলে মানবিকতা সেখানে অনুপসি'ত থাকবেই। ভৌগলিকভাবে স্বাধীন দেশে বাস করে যেমন আমরা বলতে পারি না ‘আমরা মুক্ত’, তেমনি বাংলাদেশে বাসও করে সগর্বে বলতে পারি না ‘আমরা বাঙালি’। ‘আমরা বাঙালি’ না ‘আমরা বাংলাদেশী’-এই রাজনৈতিক বিতর্কে আমাদের বাঙালি জাতিকে জড়িয়ে ফেলেছে বাংলাদেশীর প্রবক্তরা পড়শী রাষ্ট্রের ধমক খেয়ে। কারণ দিল্লীরও ভয় ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকলে পশ্চিমবঙ্গকে হারাতে হতে পারে।  উত্তপ্ত রাজনীতির কেন্দ্রীয় লক্ষ্য যেহেতু ক্ষমতা দখল, সেহেতু দেশপ্রেমের প্রশ্নটা এখানে অবান্তর। ক্ষমতার গর্ত থেকে চোখ তুলে ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা সময় পায় না জাতির বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকাবার। কর্তা ব্যক্তির পদলেহনে এরা ব্যস্ত। ক্ষমতা-অর্থ-সম্পত্তি-প্রতিপত্তির পূজা-অর্চনা করতে গিয়ে এরা কখনো সচেতনভাবে কখনো অচেতনভাবে উপেক্ষা করে নিজের ভেতরকার জাতিসত্তাকে, নিজের অস্তিত্বকে, নিজের ধর্মকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের স্বীকৃতি পেতেও তাই আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। কিন' বাংলা সনের সরকারী ব্যবহার এখনো সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সরকারী মসনদে যারা এসেছেন এবং যারা আছেন, তারা কি বাঙালি নন? কোন্‌ কারণে তবে সরকারিভাবে সর্বত্র বাংলা সনের ব্যবহার এতো উপেক্ষিত?

প্রতি বছরই ১লা বৈশাখকে বরণ করে নিচ্ছি বাহারী উৎসবে। এই একদিনে আমরা আপাদমস্তক বাঙালি সাজবার দুর্নিবার সাধনায় মত্ত হয়ে উঠি। পোশাকে, খাবারে, গানে, বক্তৃতায় তথা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আমরা এদিন পুরোদস্তুর বাঙালি। ১ বৈশাখ এলেই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, গ্রামে-গঞ্জে বর্ষবরণ উৎসব জমে ওঠে। বৈশাখী মেলায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলার গ্রাম ও শহরগুলো। সামর্থ বিশেষে সকলেই অন্তরে লুকায়িত বাঙালিত্বে আলোড়িত হয়। কিন্তু দিন ফুরোলেই আবার ফিরে যায় পুরাতন বৃত্তে। এই যে পহেলা বৈশাখে ‘বাঙালি’ সাজবার হুলস্থুল কান্ড। একবার সাজ গ্রহণ আবার খুলে ফেলা। এ যেন সাধ করে বাঙালি সাজা। সাধের এই সাজ মানেই কৃত্রিমতা। ‘আসল’ বা ‘মৌলিক’ তথা ‘মূলসত্তা’কে আড়াল করে দিয়ে যে ‘সাজ-সজ্জা’ সে তো আরো ভয়ংকর। ‘সাজসজ্জা অজান্তে জাগায় অহংকার। ওই অহংকার তখন কারণ হয় ধ্বংসের। একজন বাঙালি হয়ে কীভাবে নিজ জাতির ধ্বংস কামনা করতে পারি আমরা? নতুন বর্ষে কোনো নতুন বৈশাখী ঝড় আমাদের চেতনার ভিতর কেন জাতীয়তাবোধকে জাগাতে পারছে না? কি লাভ শুধু একদিনে বর্ষবরণের উৎসবে মেতে থাকা? কি লাভ একদিনের কৃত্রিম বাঙালি সেজে? শিক্ষিত সমাজের কি ভেবে দেখার সময় এখনো হয়নি? তবুও শেষে বলতে হয় ‘মন্দের ভালো’। 

নববর্ষ ১৪২২ এর ভাবনাঃ কি করি

নববর্ষ১৪২২ এর ভাবনাঃ কি করি

·        বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘চেতনার বিপ্লব-আমরা বাঙালি।’
·        একজন খাঁটি বাঙালি কখনো মিথ্যা বলে না।
·        একজন খাঁটি বাঙালি একজন কুরআনিক মুসলিম।
·        স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদের পড়-য়ারা অনেকেই টাকা-পয়সার মোহে সমাজের সর্বস্তরে ষড়যন্ত্র ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য মিথ্যাচার, সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিপনার কাজে লিপ্ত রয়েছে - এইসব বিভ্রান্তদের তালিকা তৈরি ও ভালমানুষ করার জন্য সমাজের সবাই এগিয়ে আসি।
·        বর্তমানে শিক্ষার নামে ইংরেজি, ধর্মের নামে আরবী আর সংস্কৃতির নামে হিন্দী ভাষার আগ্রাসনের কবলে পড়ে পাঁচ হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্য ধ্বংসের মুখে। তাই প্রতিটি বাঙালির জীবনে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে ধারণ, লালন ও পালন করি।
·        অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ শিক্ষার নামে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এই কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে একে দেশের আপামর জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করতে রাষ্ট্র ও সরকারকে সহযোগিতা করি।
·        সকল শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত লোকদের জন্ম গ্রামে। দেশকে সমৃদ্ধ করতে জন্মস্থান গ্রামের সাথে শহর-নগরের ব্যবধান  কমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি।
·        ব্রিটিশ আমলের পন্ডিতদের করা ‘পলিটিক্স’ এর বাংলা অনুবাদ ‘রাজনীতি’ শব্দটির পরিবর্তে দিন বদলের পালায়  ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করি। জননীতি-অর্থাৎ শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগী, সৎ ও মুক্তচিন্তার যোগ্য ব্যক্তিত্বদেরকে কাজের সুযোগ করে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।
·        ‘সত্য বলি, সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হই, নিজে বাঁচি-দেশ ও জাতিকে বাঁচাই।’
·        ধৈর্যশীল হয়ে, অন্যের দোষ ক্ষমা করে আল্লাহ্‌র দরবারে ক্ষমা পাওয়ার প্রার্থী হই।
·        কর্ম ও চিন্তায় সমন্বয় ঘটিয়ে নিজের পরিচয় দিই। প্রতিটি কর্মের বিশ্লেষণ করি এবং আত্মিক উন্নতি করি।
·        ভোগের আনন্দ সাময়িক, ত্যাগের আনন্দ চিরন্তন। তাই কর্ম করি সৃষ্টির সেবাতেই।

·        সেই ফুল হই - যে ফুল প্রস্ফুটিত হয় কিন্তু ঝরে যায় না। 

চেতনায় পহেলা বৈশাখ

চেতনায়পহেলা বৈশাখ

সংলাপ ॥ দুঃখজনক হলেও সত্যি জাতীয় অগ্রগতির ধারায় যখনই কোন ব্যক্তি বা চক্র সুকৌশলে চক্রান্তমূলক ভাবেই জাতীয় চেতনার মূলে আঘাত হেনেছে, তাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় স্থান দিয়ে কখনো সমর্থন, কখনো বা উপেক্ষা করা হয়েছে। জাতীয় চেতনার পরিপন্থী ওই চক্র বার বার পেয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়।
পহেলা বৈশাখে বাঙালির নববর্ষ উৎসব উদ্‌যাপনকে নিয়ে ধর্মব্যবসায়ী উগ্রবাদী শ্রেণীর চক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। পাকিস্তান শাসনামলেও এই চক্রান্ত চলেছিল। ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব শাহীর শত নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এদেশের বাঙালি চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্র-জনতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল এ উৎসব পালনের অধিকার। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে যারা মনগড়া ধর্মের অপব্যাখ্যায় জাতীয় চেতনায় বিভাজন রেখা টানতে চান, তাদের স্মরণ রাখা জরুরি বাঙালি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী মানুষের অটুট ঐক্য ও প্রতিরোধের কথা।
বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির উৎসব। এ উৎসব বাঙালির প্রাণের উৎসব। এ উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধ্যান ধারণা, আবেগ-অনুভূতির সতত প্রকাশ। এ উৎসব বাঙালি তথা আমাদের গর্ব, আমাদের জাতীয়তা বোধের পরিচিতি। এর সাথে ধর্মের কোন বিরোধ নেই, থাকতে পারে না। ইসলাম ধর্মে তো নয়ই।
ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম, সাম্যের ধর্ম, সার্বজনীন ও সুশীল চিন্তার দীক্ষা পাওয়া যায় এ ধর্মে। বিভেদ নয় ঐক্যের আহবান রয়েছে কুরআনে।
দেশ, জাতি, জাতীয়তাবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার লালন-পালনের শিক্ষা কুরআনেই আছে। কিন্তু তারপরও ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে জাতীয়তাবোধের সাথে ধর্মের বিরোধ ঘটাতে চান কতিপয় ধর্মবেত্তা ও ধর্মব্যবসায়ী যারা তথাকথিত ধর্মীয়বোধ এবং ফতোয়াবাজির মাধ্যমে বিতর্ক ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়।
সঙ্গত কারণেই শান্তিকামী মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে - সামপ্রদায়িকতার উর্ধ্বে সাম্য ও ঐক্যের যে বাঙালি জাতীয়তা, তাকে কোন স্বার্থে তথাকথিত ধর্মের অপব্যাখ্যায় আক্রমণ করতে চায় সংকীর্ণ চিন্তাবিলাসী উগ্রধর্মবাদী চক্র? এরা ‘মুসলমানের’ কোন্‌ সংজ্ঞায় ‘বাঙালি জাতি’কে অস্বীকার করতে চায়? মুসলমান ও বাঙালির মাঝে তফাত কি? একজন বাঙালি কি মুসলমান হতে পারেন না? মুসলমান হতে গেলে কি ত্যাগ করতে হবে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য? ইসলাম কি তবে মানবজাতির কোন খন্ডাংশের জন্য? এসব প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর ধর্ম-চিন্তাবিদদের কাছে আশা করে জাতি।

জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি বিষোদগার করে যারা প্রজন্মকে ভুল পথে চালিত করে ফাটল ধরাতে চায় জাতীয় ঐক্যতানে, ভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা-সংস্কৃতির অনুরাগী হয়ে গড়ে তুলতে চায় জাতিভেদ-বর্ণবৈষম্য, তাদের এই ফতোয়াবাজি স্বাধীনতা বিরোধী একটি গোষ্ঠীর কাটা ঘায়ে প্রলেপ দিয়ে বৈধ করবার অপপ্রয়াস সাময়িক জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরাতে হয়তো সক্ষম হবে কিন্তু জাতীয় চেতনায় কোন আঘাত হানতে পারবে কি? বরং এই আঘাতের পুনরাবৃত্তি জাতীয় ঐক্যকেই আরো অটুট ও সুদৃঢ় করে তুলবে। 

১৪২২: উৎস সন্ধানে

১৪২২: উৎস সন্ধানে

সংলাপ ॥ ‘বিপুলা এ পৃথিবী’। অন্তহীন কালের প্রবাহ অসীমকে সীমার মাঝে, অস্পৃশ্যকে স্পর্শের ভিতরে মানুষই টেনে আনে তার নিজের তাগিদে। আর এই তাগিদ ক্রমশ একদিন আবেগকে আশ্রয় করে, হয়ে ওঠে তার চেতনার প্রতীক। তার সত্তাভূত। এ কারণেই সে সীমানা টেনে খাটো করে নিয়েছে ব্যক্তিমাপে; কাল্‌কে আয়ত্তে এনেছে কাল্‌ পরিমাণে। এই কাল্‌ পরিমাপের ক্ষেত্রেও সে এড়িয়ে যেতে পারেনি তার জাতীয়তাবোধ। পারা যায় না। কাল্‌ সাক্ষী। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকেই কাল্‌ পরিমাপের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ষ গণনার প্রচলন ঘটেছে বিভিন্ন রূপে। মূলত এ পর্যন্ত তিনটি রীতি অনুসরণ করেই বর্ষ গণনা হয়েছে। যথা - (১) সৌর বর্ষ (২) চন্দ্র বর্ষ ও (৩) নাক্ষত্র বর্ষ।
সৌর বর্ষ নির্নীত হয়েছে সূর্যের বার্ষিক গতি অনুসারে। এক সৌর বর্ষ সমান ৩৬৫ দিন। চন্দ্রের গতি অনুসারে চন্দ্র বর্ষ গণনা করা হয়। এক চন্দ্র বর্ষ ধরা হয় চন্দ্রের সংক্রমণ প্রাতঃকালে হলে ৩৫৪ দিনে এবং রাত্রিকালে সংক্রমণ হলে ৩৫৫ দিনে। নাক্ষত্র বর্ষ গণনা করা হয় নক্ষত্র অনুসারে। ৩৬০ নক্ষত্র দিনে এক নাক্ষত্র বর্ষ। আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অব্দ প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে কয়েকটির প্রচলন এখনো অব্যাহত থাকলেও কোন কোন অব্দ হারিয়ে গেছে কালের অতলে। আমাদের দেশে প্রচলিত অব্দের মধ্যে খ্রীষ্টাব্দ, হিজরী অব্দ, শকাব্দ, বঙ্গাব্দ উল্লেখযোগ্য। খ্রিষ্টাব্দ সৌর বর্ষ। যীশু খ্রীষ্টের জন্মের তিন বছর পর থেকে খ্রীষ্টাব্দ গণনা করা হয়। খ্রিষ্টাব্দ একটি আন্তর্জাতিক অব্দ। হিজরী অব্দ চন্দ্র বর্ষ অনুসারে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাস (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে এই অব্দ গণনা করা হয়। হযরত ওমর (রাঃ) হিজরী সন প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশে মুসলিম বিজয়ের পর হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয়। শকাব্দ প্রচলন কে করেন সে সম্পর্কে কোন সি'র সিদ্ধান্ত নেই। অনেকের মতে শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর পর থেকে শকাব্দের সূচনা হয়। বঙ্গাব্দ গণনা করা হয় সৌর বর্ষ অনুসারে। সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তখন ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সন প্রচলিত ছিল। যার অধিকাংশ ছিল চন্দ্র বর্ষ অনুসারে। শাহী লেনদেন এবং প্রজা সাধারণের সুবিধার্থ তিনি সৌর সন প্রবর্তনের প্রয়োজনেই এই নতুন অব্দের ফরমান জারি করেন। মোগল সমাজের আর্যাবর্তে ও দাক্ষিণাত্যে নতুন সনটি ‘ফসলী সন’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে এটি বঙ্গাব্দ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। বঙ্গাব্দ বা ফসলী সনের মূল ভিত্তি হিজরী সাল। সম্রাট আকবরের সিংহাসনের আরোহণের বছর ৯৬৩ হিজরী থেকেই বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। হিজরী ৯৬৩ সনই বঙ্গাব্দের ৯৬৩ সন বলে নির্দেশিত হয়। মজার ব্যাপার বাংলা সনের শুরুতে ১ বৈশাখ, ১ বঙ্গাব্দ বলে কোন বছর ছিল না। এর মূল পরিকল্পনায় ছিলেন সম্রাট আকবরের অন্যতম পরামর্শক ও সভা জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ পন্ডিত আমির ফতে উল্লাহ সিরাজী। বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের সময় ও প্রবর্তক নিয়ে মতভেদান্তরে পাই বাংলার প্রথম স্বাধীন নরপতি শশাঙ্ক (৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ-৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দ), আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্‌ (১৪৯৩-  ১৫১৯) ; বল্লাল সেনকে। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের অভাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
বঙ্গাব্দ বা ফসলী সন প্রবর্তনের সাথে সাথে তৎকালে প্রচলিত স্থানীয় চন্দ্র মাস গুলোকেও সৌর মাসে পরিণত করা হয়। ফলে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি নামও বঙ্গাব্দের বিভিন্ন মাসের নামরূপে গৃহীত হয়। এই উপমহাদেশের অন্যান্য অনেক সনে আজ পর্যন্ত এ সকল মাসের নাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মাসের এই নামগুলোর নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রের নামে। নক্ষত্র - বিশাখা>বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠা>জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া>আষাঢ়, শ্রবণা>শ্রাবণ, চিত্রা-চৈত্র প্রভৃতি। এক সময় অগ্রহায়ণ {অগ্র+হায়ন (বৎসর)} ছিল বছর শুরুর মাস।
সঙ্গত কারণেই অতীত ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করা এবং ভবিষ্যতের জন্য তারিখ গননার উপলক্ষে দিনের নাম দেওয়ার বাস্তব উদ্দেশ্যে সময়ের হিসেব রাখার পদ্ধতি, বিষ্ণুব ও অয়নসহ বিভিন্ন ঋতুর মধ্য দিয়ে সূর্যের কালচক্র এবং চন্দ্রকলার হ্রাস বৃদ্ধির পৌনঃপুনিক ঘটনা প্রভৃতি সাধারণ ও সহজে লক্ষণীয় প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর ভিত্তিতে প্রস'ত হলো পঞ্জিকা। বর্তমানে পশ্চিমা খ্রীষ্টান জগতে পঞ্জিকা রচনার যে পদ্ধতি, তা মিসরীয়দের কাছে থেকে পাওয়া। জুলিয়াস সিজার যখন পনটিফেক্‌স্‌ ম্যাকসিমসি হন তখন পঞ্জিকা এতোই অবনত হয় যে, জানুয়ারি পড়ে শরৎকালে। এ অবস্থায় রোমানদের জন্য মিসরীয় পঞ্জিকা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। জুলিয়ান বৎসর (৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা) সৌর বৎসরের চাইতে কিছু বেশি দীর্ঘ হওয়ায় পোপ ১৩ গ্রেগরি এর সংশোধন করেন এবং বর্তমানে এটিই চালু রয়েছে। ইহুদিদের পঞ্জিকা চন্দ্র ও সৌর বৎসরের সামঞ্জস্য করে রচিত। মুসলিম পঞ্জিকাই একমাত্র বিশুদ্ধ চান্দ্র পঞ্জিকা। এর বৎসর ৩৫৪ থেকে ৩৫৫ দিনে হয়। এই জন্য ঋতু ও মাসের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। প্রায় ৩৩টি মুসলিম বৎসরের সমান ৩২টি গ্রেগরিয়ান বৎসর। অন্যান্য পঞ্জিকার মধ্যে ফরাসী বিপ্লবের পঞ্জিকাই সমধিক প্রসিদ্ধ।
বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের পঞ্জিকা সৌরবর্ষ অনুসারে গননা করে প্রতি বর্ষের জন্য আলাদাভাবে নির্নীত হয়। ইংরেজি সনের গননা পদ্ধতির মত প্রচলিত বাংলা সনের প্রতি মাসের দিন সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য কোন নির্ধারিত নিয়ম-পদ্ধতি নেই, অর্থাৎ বাংলা মাসের দিন সংখ্যা কোনো মাসের জন্যই সকল বর্ষের জন্য সাধারণত একই রূপ হয় না। এই অসুবিধা দূর করবার জন্য বাংলা একাডেমীর একটি উপসংঘ সহজ পদ্ধতিতে বাংলা সনের বিভিন্ন মাসের দিন সংখ্যা নির্ধারণের নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো পেশ করেনঃ
(১) মোগল আমলে বাদশাহ আকবরের সময়ে হিজরী সনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে যে বঙ্গাব্দ প্রচলিত হয় (যা আজও প্রচলিত) তা থেকেই বৎসর গননা করা হবে (বাংলা সনের সাথে ৫৯৩ বা ৫৯৪ যোগ দিলেই ইংরেজি সন পাওয়া যায়।
(২) ইংরেজি মাস ২৮, ৩০ কিংবা ৩১ দিনে হয় ; কিন্তু উপসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা মাস গননার সুবিধার জন্য বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এই পাঁচ মাসের প্রতি মাস ৩১ দিন হিসেবে এবং আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র - এই বাকি সাত মাসের প্রতি মাস ৩০ দিন হিসেবে গননা করা হবে।
(৩) অতিবর্ষে চৈত্র মাস ৩১ দিনে হবে। ৪ দ্বারা যে সাল বিভাজ্য তা’ই অতিবর্ষ বলে পরিগণিত হবে। এই সুপারিশ অনুযায়ী বাংলা একাডেমী জনসাধারণের বিবেচনা ও মতামতের জন্য ১৩৭৩ সাল থেকে বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে চলেছে।

নতুন বর্ষের নতুন পঞ্জিকা নতুন সাজে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে বারে বারে ঘুরে ঘুরে কড়া নাড়ে প্রতিটি দরজায়। ১৪২১ পেরিয়ে ১৪২২ এলো জাতীয় জীবনের নব নির্মণের পরিণত ইঙ্গিত নিয়ে। বিগত দিনের অর্জিত ব্যর্থতার গ্লানি ভোলাতে ১৪২২ সময়ের হিসেবে সময়ের বিকাশে পা রাখলো গুচ্ছ গুচ্ছ নাক্ষত্রিক সুষমায়। খেরো খাতায় উৎসবের ঢেউ তুলে। এই ১৪২২ কি শুধু কাগুজে সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেয়েই স্তুতি গাইবে মানুষের তথা জাতির? আপামর জনসাধারণের সচেতন শৈল্পিকতায় সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ার প্রয়াসে একটি রক্ত-পুজহীন ঝকঝকে, বর্ষ উপহার দিতে পারে না ইতিহাসের পাতায়? উদ্দীপ্ত করতে পারে না প্রজন্মের অগ্রযাত্রায় স্বচ্ছ বোধে? 

বাংলা দিনপঞ্জি আজোও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো না!

বাংলা দিনপঞ্জি আজোও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো না!

সংলাপ ॥ বাংলা দিনপঞ্জি নিজ দেশেই পরবাসী। এর কোন ব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই পরিত্যাজ্য। পত্র-পত্রিকাগুলোতে হিজরী ও খৃষ্টীয় সন-তারিখের পাশাপাশি বাংলা মাস ও তারিখের নাম লেখা না থাকলে শহরের মানুষ হয়তো ভুলেও এর অস্তিত্ব স্মরণ করতে পারতো না। অথচ ইংরেজ আমলে তাদের শাসন-শোষণের মধ্যে থেকেও বাঙালি তাদের স্বকীয় অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়নি। ইংরেজি সনের নামে প্রচলিত খৃষ্টীয় সন বা রোমান বর্ষপঞ্জি বাঙালি সমাজ গ্রহণ করেনি। অথচ তখনও মঘী, হিজরী, শকাব্দ এবং খৃষ্টীয় সনের প্রচলন ছিল।
শকাব্দ প্রচলন কে করেন সে সম্পর্কে কোন স্থির সিদ্ধান্ত নেই। অনেকের মতে শকরাজা শালিবাহনের মৃত্যুর পর থেকে শকাব্দের সূচনা হয়।
সন গণনার মধ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগ, গোঁড়ামি, কুসংস্কার অথবা সাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন থাকতে পারে না। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই দিন, ক্ষণ, মাস ঘটনার প্রচলন ঘটায়। বর্ষ গণনার তথ্যপুঞ্জির নির্দিষ্ট তারিখ বলা দুরূহ হলে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় যে, প্রাচীন রোম, মিশরীয় সভ্যতা, সুমেরু সভ্যতা এবং ব্যাবিলয়ন সভ্যতাই প্রথম এর উদ্ভব এবং ব্যবহার শুরু করে। সেই শুরু চিন্তা ও গবেষণার বিভিন্ন ধাপ ও পর্যায় অতিক্রম করে আজকের আধুনিক পঞ্জিকা এবং ক্যালেন্ডারের উজ্জ্বল অস্তিত্ব।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, প্রাচীনকাল থেকেই এই গণনা দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে। একটি সূর্য, অপরটি চন্দ্র। সৌরবর্ষ এবং চন্দ্রবর্ষ। সৌর গণনাই আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত। প্রকৃতির সাথেও এর অপূর্ব মিল রয়েছে। সৌর গণনার এই হিসাবটি প্রথম চালু করে মিশরীয়রা। পরবর্তীতে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিশরীয় পঞ্জিকার সংস্কার সাধন করে রোমে চালু করেন। তিনি সবগুলো মাসেরদৈর্ঘ্য পরিবর্তন করেন এবং প্রতি চার বছর অন্তর একদিন যুক্ত করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন অর্থাৎ লিপ-ইয়ার চালু করেন। তার নাম অনুসারে একটি মাসের নামকরণ হয় জুলাই। জুলিয়াস সিজার কর্তৃক প্রবর্তিত পঞ্জিকার নামকরণ হয় জুলিয়াস পঞ্জিকা। মিশরীয়রা ৩৬৫ দিনে বছর ধরতো আর জুলিয়াস পঞ্জিকার বছর ছিল সাড়ে ৩৬৫ দিনে।
আজকের প্রচলিত ইংরেজি সন আসলে খৃষ্টীয় সনও নয় এবং ইংরেজি সনও নয়। এটা ইংরেজ জাতির প্রবর্তিত অথবা তাদের স্বকীয়তার প্রতীক নয় কিছুতেই। অপরদিকে নবী হযরত ঈসা (আঃ)-এঁর জন্মের বহু পূর্ব থেকে সন গণনা শুরু হয় এবং তিনি কোনো সনের প্রবর্তকও নন। এমনকি তিনি খৃষ্টান সমপ্রদায়েরও জনক নন যে, তাঁকে খৃষ্টানদের নবী বলা হবে। যারা এ ধরনের প্রচারণায় অংশ নেয়, তারা নিঃসন্দেহে ভ্রান্তির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে অথবা প্রতারণায় নিমজ্জিত হয়ে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের আশ্রয় নিচ্ছে।
মানবতার মুক্তিদূত মহামানব হযরত ঈসা (আঃ)-এঁর মৃত্যুর ৫৩২ বছর পর ডাইওনিসিয়াম এক্সিওয়াম নামক এক পাদ্রী ঈসা নবীর জন্ম বছরের হিসেবে বর্ষ গণনা পদ্ধতি সংস্কার করেন। তখন থেকেই এটা খৃষ্টীয় সন নামে সামপ্রদায়িক পরিচিতি লাভ করে যেমন পরিচিত খৃষ্টান সমপ্রদায়। অনুরূপভাবে রহমাতাল্লিল আল্‌-আমীন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)ও কোন সনের প্রবর্তক নন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবনের ‘হিজরত’ নামক অধ্যায়টিকে সুযোগ-সন্ধানী স্বার্থান্বেষী সাহাবারা লজ্জাকর ও কলঙ্কজনকভাবে স্মরণীয় করে রাখতে অভিশপ্ত কুরায়েশদের মদদে হযরত ওমরের মাধ্যমে এবং তার পরামর্শক্রমে চন্দ্র গণনার সংস্কার করে হিজরী সনের উদ্ভব ঘটায়। এটাই এখন সামপ্রদায়িক মুসলমানী সন হিসেবে হিজরী সনের পরিচিতি নিয়ে মুসলমান সমপ্রদায়কে চাঁদের ফাঁদে আটকিয়ে রেখেছে।
৬টি ঘটনাকে স্মরণ করে ৬টি প্রস্তাব এসেছিলো মুসলমানদের নিজস্ব একটি সাল এবং বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করতে -
১। মুহাম্মদ (সঃ)-এর ওফাত দিবস
২। মুহাম্মদ (সঃ)-এর জন্ম দিবস
৩। নব্যুয়ত প্রকাশ বা ‘এলানে নবুওত’ এর দিন
৪। বদর যুদ্ধের বিজয় দিবস
৫। মক্কা বিজয় দিবস এবং
৬। হিজরত।
হিজরতের দিনটি কুরায়েশদের কাছে বিজয়ের প্রতীক হিসেবে সদা হাস্যোজ্জ্বল আনন্দঘন একটি ঘটনা!
উপরের ৫টি প্রস্তাব একে একে নাকচ করে ৬ নম্বর প্রস্তাবটি গ্রহণ করে হযরত ওমর (রাঃ) হিজরত দিবস স্মরণে রাখার জন্য হিজরী সনের প্রবর্তন করেন।
অথচ সময়ের নিখুঁত ও সুঠাম ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টার অন্ত নেই। ১৫৮২ খৃষ্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী জ্যোতির্বিদদের পরামর্শ এবং এক্সিওয়ামের সংস্কার সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে বর্ষপঞ্জির সংস্কার করেন। তারা ১৫৮২ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে দশ দিন বাদ দেয়ার নির্দেশ দেন। ফলে ঐ বছর অক্টোবরের ৫ তারিখকে ১৫ তারিখ ধরা হয়। রোমের পোপ গ্রেগরী ঘোষণা দেন যে সব শতবর্ষীয় সন ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য হবে সে সব শতবর্ষই লিপইয়ার বলে গণ্য হবে। গ্রেগরীয়ান সংস্কারকৃত বর্ষপঞ্জিই অদ্যাবধি সারা পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত। বিভিন্ন দেশ এই পঞ্জিকাকে কেন্দ্র করেই দিন, ক্ষণ, মাস, ঋতু গণনা করে থাকে তাদের দেশের আবহাওয়া-জলবায়ু অনুসারে। এই সৌর পঞ্জিকাটি অত্যন্ত সহজসাধ্য, মোটামুটি নির্ভুল এবং প্রকৃতির সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বঙ্গাব্দ গণনা করা হয় সৌরবর্ষ অনুসারে। সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে ১০ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন।
ন্যায় বিচারের প্রবক্তা মানবতাবাদী সম্রাট আকবর মানবতার কল্যাণের জন্য এ উপমহাদেশে সার্বজনীন ধর্ম দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তনকালে ইলাহী সনও চালু করেছিলেন। নতুন ধান ওঠার সময়কাল অগ্রহায়ণ মাস থেকেই এ সনের গণনারীতি চালু ছিল। গ্রাম বাংলার প্রতিটি মানুষই জাতি-ধর্ম এবং ধনী-গরীব নির্বিশেষে নবান্নের উৎসব পালন করতো ঘরে ঘরে। এই সার্বজনীন সংস্কৃতি কিছুদিন আগ পর্যন্তও চালু ছিল বাংলার আনাচে-কানাচে নতুন ধান কাটার লগ্নে, যা আজ বিস্মৃত প্রায়।
ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ফতোয়াবাজির কালো ছায়ায় দ্বীন-ই-ইলাহী’র আলোক ছটা ঝাপসা হয়ে গেলেও আকবরের প্রবর্তিত সৌর গণনার রীতি মেনে খাজনা তোলা ও হিসাব-নিকাশ ঠিক ঠিক রাখতে বাংলা সন কিন্তু বাঙালি জাতির স্বাতন্ত্র অস্তিত্বের প্রতীক ছিল এবং এখনো আছে যদিও তা আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে আরো অনেক কিছুর মতই। হিন্দু সমপ্রদায় তাদের ধর্মীয় পর্বগুলো বাংলা সনের নিরিখে পালন করে থাকে। মুসলমান সমপ্রদায়ের সূফী মতবাদের বিশ্বাসীরাও তাদের ধর্মানুষ্ঠান বাংলা সন অনুসারে করে থাকে। সামপ্রদায়িক উগ্র ধর্মান্ধরা একে হিন্দু কালচার বলে উপেক্ষা করেছে এতদিন। কিন্তু প্রগতিশীল দাবিদার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ যখন নববর্ষের সকালে পান্তা আর ইলিশ ভোজনের প্রতিযোগিতা সেরে বিচিত্র সব মুখোশ পরে মিছিলের সমারোহ করেন এবং বিকালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের গীতি অনুষ্ঠান ভোগ-উপভোগের মাধ্যমে নববর্ষের চেতনা বিকাশের মহড়া পর্বের সমাপ্তি টানার রেওয়াজ চালু করেছেন তখন এই ধর্মান্ধ কূপমন্ডুকরাও নববর্ষের ইতিহাস চর্চা শুরু করে দেয় এবং একে মুসলমানদের ঐতিহ্য বলে জাহির করতে কসুর করে না মোটেই। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের কোথাও এর সামান্যতম প্রভাব চোখে পড়ে না। সামপ্রদায়িক বাগাড়ম্বর এবং ছায়ার সাথে কায়ার যুদ্ধ শেষ হলেই সবকিছু আগের মতই। কোনো পরিবর্তন নেই।

এভাবে সমাজ ও জাতির মগজ পচনের প্রতিকার কি? কে দেবে এর সমাধান? সবই কি এভাবে অনুষ্ঠান সর্বস্বতায় পর্যবসিত হতে থাকবে? 

প্রবীণ

তারিফ হোসেনের সত্য....
প্রবীণ

প্রবীণের আরেকটি প্রতিশব্দ হতে পারে দূরবীণ। একথা শুনে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন লোকটা কী অর্বাচীন- কীসে আর কীসে ধান আর তুষে, আমি বলি কেন নয়, তলিয়ে দেখলে সবই হয়। দূর ও সুদূর অতীতের চলচ্চিত্রের বর্তমান চালচিত্র ধারণ করে থাকে যে শারীরিক ও মানসিক সত্তাটি তার অপর নাম প্রবীণ। নবীনের দল গতকালের এই আয়নায় চোখ রেখে নিরাপদ আগামীকাল তৈরি করতে পারে। তবে কিছু ছেলে-ছোকড়া ভাবে প্রবীণেরা জঞ্জাল ও ছোবড়া; এদের স্থান হওয়া উচিত আঁস্তাকুড়ে। আরে ইয়ার রোসো অভিধান খুলে প্রবীণ শব্দটির ওপর একটু চোখ বোলাও দেখি। কী হে চোখ যে  একেবারে ছানাবড়া। প্রচলিত অর্থ বুড়ো-হাবড়া যে ভাবার্থে দক্ষ, অভিজ্ঞ, জ্ঞানী, নিপুণ হতে পারে তা দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। চোখ রোদচশমায় কান এয়ারফোন ক্যারিশমায় বন্ধ থাকলে শব্দবহর ঢুকবে কোন পথে? তবুও খোকাবাবুদের অবগতি এবং অপ্রতুল শব্দভাণ্ডার জনিত দুর্গতির হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে কিছু টিপস দিচ্ছি। বয়স বাড়ার ব্যাপারটি চোখে পড়ে বলেই বয়োবৃদ্ধ শব্দটি খুব পরিচিত। অথচ জ্ঞানে-গুণে-কর্মে বৃদ্ধ-ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ হয়ে বর্ষীয়ানরা যে জ্ঞানবৃদ্ধ, গুণসিদ্ধ, কর্মভিজ্ঞ হতে পারে সে কথা কিশোর-যুবারা বেমালুম ভুলে যায়। নবতনরা মনে করে প্রবীণ বা পুরাতন মানেই হল সেকেলে সাবেকি। তাই পুরানা ঘরানা চিন্তাভাবনা  করে হবে কী ? নয়া আদমি সর্বগুণধর তাদের কপালেই জোটা উচিত সব আদর-কদর। কিন্তু বাংলা প্রবাদ বলে অন্য কথা - নয়ার নয় গুণ, পুরানোর আঠারো গুণ। ‘অতীত হলেই পতিত নয়, নয়া হলেই পয়া নয়’। ‘পুরানো চালে ভাতে বাড়ে, পুরানো ঘিয়ে মাথা ছাড়ে’।‘ টক হলেও পুরানো তেতুলের দাম বেশি।’লোকসাহিত্যের জনপ্রিয় চরিত্রে যেমন আছেন রাজা-উজির তেমনি সমান-রালে বুড়িরাও হাজির। বিশেষ করে ধাঁধা সৃষ্টিতে এরা বাধাস্বরূপ। ‘এক বুড়ি হাটে যায়; গালে-মুখে চড় খায়’-এই বুড়ি যে হাড়ি-পাতিল তা একটু মাথা খাটালেই করি ফিল। কিংবা ‘মাটির নীচ থাইকা আইল বুড়ি/ বুড়ি বড় সুন্দরী।’ উনরসের এই ধলাবুড়ি ধাঁধা-দুনিয়ায় রসুন হয়ে আছে। গল্প ফাঁদতেও শেষ ভরসা ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। চাঁদে চরকা কাটতে গল্পকার ছুঁড়ির পরিবর্তে বুড়িকেই বেছে নেয়। কারণ ছুঁড়িরা আনাড়ি আর বুড়িরা খেলাড়ি। লোকক্রীড়ায় আনাড়ি বুড়ি নির্ভর খেলাতে বুড়িকে নিয়েই যত হুড়োহুড়ি। শৈশবে কোন কন্যাসন্তান দুষ্টুর শিরোমনি হয়ে উঠলে তাকে ডাকা হয় পাকাবুড়ি।

নবীন বৈদ্য একটি রোগ সারাতে বিশ রকম দাওয়াই প্রয়োগ করে; পক্ষান-রে প্রবীণ বৈদ্য বিশটি রোগ সারায় একটি দাওয়া দিয়ে। তবে একটি বিষয়ে জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ দুজনেই এককাট্টা। উভয়েই দাওয়া অর্থাৎ ঔষুধ লিখতে যতখন উচ্চকিত, রোগীর প্রতি দয়া বা দোওয়ার ক্ষেত্রে তারা ততখানি সংকুচিত। পরিশেষে বুড়ো আঙ্গুল থুড়ি বুড়ো আঙ্গুলের গুরুত্ব দেখিয়ে আলোচনা শেষ করব। আকারে ছোট হলেও সৎকারে বুড়ো আঙ্গুলের ভূমিকা রীতিমত বড়। বিবর্তনের ধাপেধাপে কবজির অগ্রভাগে যেদিন বুড়ো আঙ্গুলের কার্যকারিতা প্রকাশ পেল সেদিন থেকে সভ্যতা অবিশ্বাস্য গতি লাভ করল। কনিষ্ঠ না থাকলেও সংসারে খুব একটা অনিষ্ট হয় না। কিন' বৃদ্ধাঙ্গুলের গরহাজিরায় আমাদের হস্ত রীতিমত বিধ্বস্ত। 

বৈশাখ তুমি নেমে এসো মাঠে

বৈশাখতুমি নেমে এসো মাঠে

সংলাপ ॥ নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে একটা মধ্যপন্থায় আমরা আছি, আমরা ছিলাম এবং আরো বহুদিন হয়তো আমরা থাকবো। ধারাবাহিকতায় আমাদের জন্ম বাংলার মাটিতে, আমরা কথা বলি বাংলায়, নামাজ পড়ি আরবীতে আর পোশাকে ইংরেজ সাহেব, নয়তো আরাবিয়ান। একি অসঙ্গতি না কি বৈচিত্র্যতা? জবাব দেবে ভবিষ্যৎ। যে কোন জাতিসত্তারই একটা শিকড় আছে। অতীতের গৌরব গাঁথা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই নির্মাণ করতে হয় ভবিষ্যৎ। কিন' আমাদেরটা দ্বিমুখী। একদিকে আমরা অতীত তুলে ধরার নামে শিকড়ের সন্ধান করার নামে আদিতে ফিরে যাওয়ার নামে ক্রমশ আদিম হয়ে যাচ্ছি। স্মরণ রাখতেই হবে যে নিশ্চয়ই আদিম হয়ে যাওয়া সভ্যতার দাবি হতে পারে না। অন্য একটি অংশ অতীত বিচ্ছিন্ন এক পরগাছা মানসিক কাঠামো থেকে উগ্র আধুনিকতার নামে ভিন্নরূপের আদিমতার চর্চা করছি। এই দুটোই অনেক সমাজবিজ্ঞানীর মতে বর্বরতা। বাঙালি ললনাদের তাই বোরখাধারা এবং স্লীভলেস ব্লাউজধারা দুই’ই পরিত্যাজ্য।
গ্রাম বাংলার মাটির ঘরের মধ্যে বা টিনের মধ্যে, কাঁথার মধ্যে নানাবিধ নকশী অংকিত অবস্থা আজো দৃশ্যমান। আমাদের ওই নকশী থেকে আমাদের শিল্প কর্মের আঙ্গিক তৈরি করতে হবে এটা ঠিক কিন্তু ওই নকশী সম্বলিত জীবন চর্চায় লীন হওয়া যাবে না। আবার যারা ওই নকশী এবং স্থাপত্য কলার দিকে মনোযোগ না দিয়ে পাশ্চাত্য থেকে ধার করা স্থাপত্য কলায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও আশপাশের ভবন নির্মাণ করলেন তাদের ফলটা দেখা গেল বর্ষায় বৃষ্টির তোড় তাদের স্থাপত্যকে এফোড় ওফোড় করে দিল। ওরাও ছিন্নমূল। পাশ্চাত্যের ধার করা সংস্কৃতি ও স্থাপত্যকলায় বহুদূর যাওয়া যাবে না।
বাংলা সঙ্গীতের কথা যদি বলা যায় তবে আমরা দেখবো পুঁথি থেকে ভাটিয়ালী পর্যন্ত আমাদের সঙ্গীতের যে ধারা যে ধারার ভিত্তিভূমি রচনা করেছে এবং লালন করে চলেছে তাকে বারে বারে ধ্বংস করার জন্য হায়েনার ছোবল এসেছে। প্রাক স্বাধীনতা সময়ে ওই ধারার মধ্যে হাম্‌দ এবং নাত্‌ চাপিয়ে দেয়া হলো; কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং ধারাটির সাবলীল বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আবার গত কয়েক যুগ যাবৎ আধুনিকতা এবং গণসঙ্গীতের নামে ওই ধারার মধ্যে ভাবলেশহীন কিছু বক্তব্য চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারা মনে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে যে সঙ্গীত শুধু কতকগুলো প্রচারপত্রের মত কথা নয়। তার মধ্যে আছে প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্রের গভীরতম অখন্ড ভাব। সেই ভাবের ভেদ বোঝারও চেষ্টা করেনি তথাকথিত উগ্র আধুনিকতা বন্দিরা। ফল যা হবার তাই হয়েছে। নদী যখন আপন স্বচ্ছন্দ গতি হারায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তখন তা নানা বাঁকা পথ অবলম্বন করে এগিয়ে যায়। সংস্কৃতি হলো স্রোতস্বিনী। একে চাপাতে গেলে আটকাতে গেলে নিজের সত্ত্বা হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে। সে ভুলের খেসারত আজ আমাদের দিতে হচ্ছে। আমাদের যুবসমাজকে দিতে হচ্ছে। আমাদের নেতৃত্ব মরমী লালন জালালদের নিয়ে চিন্তা চর্চা না করে হাই সাহেবদের দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনার চেষ্টা করেছিলেন বলেই এখানে হাম্‌দ কিংবা নাত্‌ কিংবা তাদের ডিজাইনের অন্যকিছু বিকাশ লাভ না করে আমাদের যুব সমাজ চলে গিয়েছে পপ্‌ নামক সঙ্গীতে।
সমস্ত দেশ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই আমরা আমাদের ঘরানার অমূল্য সম্পদ ত্যাগ করে তথাকথিত পপ্‌ কালচারে ঢুকে গেলাম। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার পরও আমাদের নেতৃত্ব নিজেদের নিয়ে এতো বেশি ব্যস্ত থাকলো যে আমাদের সঙ্গীতের যারা দিকপাল মানুষ তাদের চেতনা, তাদের লোকজ দৃষ্টিভঙ্গি এগুলোকে তুলে ধরা দরকার বোধ করলো না।  আমরা শ্লোগান দিলাম এক নেতার এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। ওই এক নেতা যে শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হানদেরও যোগফল, আবার তারা যে কাজী নজরুল ইসলাম থেকে গোবিন্দদাস পর্যন্ত সকলের যোগফল তা কিন্তু কোন আলোচনায় আচার অনুষ্ঠানে এলো না। দেখা গেল নজরুল যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন গান লিখে উঠতে পারেননি তাই তার সঙ্গীতের কদর না পেয়ে কদর পেল প্রচারপত্র ধর্মী কতক সঙ্গীত।
লোবান-আতরের গন্ধ বিশিষ্ট পোশাক পরিহিত লোকেরা শিল্পকলার ইজারা নিয়ে নিল। তারা একবারও কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে সাঁইজীর স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন কিনা সন্দেহ। আব্বাস আলী থেকে আঃ আলিম পর্যন্ত যে ধারা তা বিকশিত না হয়ে সঙ্গীত কতকগুলো লাগামহীন মধ্যবিত্ত তরুণের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। তারা কালক্রমে তথাকথিত পপ্‌ সঙ্গীতের বিকাশ ঘটাতে ঘটাতে পুরো পাশ্চাত্য ঢং এর এ্যাবা, বনিয়াম কিংবা মাইকেল জ্যাকসন সংস্কৃতির চর্চার লীলাভূমিতে পরিণত করছে দেশকে। এখন যে ডিস সংস্কৃতি, এখন যে মেট্রোপলিটান সংস্কৃতি তার সারকথা হলো পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে যাও। ফ্রিজ থেকে বার করা পান্তা ভাত খাও। কাঁচা মরিচ না থাকলে প্রাইভেট কারের ড্রাইভার পাঠিয়ে আমিন বাজার থেকে ২০০ টাকার অকটেন পুড়িয়ে দুই টাকার কাঁচা মরিচ নিয়ে এসো। ব্যাস পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে গেলাম। পরদিন থেকে সবকিছু পাশ্চাত্যের আদলে করবো, কনসার্ট করবো সব ঠিক থাকবে তবুও বাঙালি হবো। এ এক নিরবিচ্ছিন্ন বেহায়াপনা। এ পসরা সাজানোর কি দরকার। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের জন্য তাই ছায়ানটের মত মধ্যবিত্ত বেহায়াপনার বৃত্ত থেকে বের হয়ে গ্রামের কৃষকের মধ্যে সঙ্গীত খুঁজতে হবে। ধান লাগানো বা ধান কাঁটার সময় তারা যে বদুর গান জারি গান করে তার মধ্যে থেকে বাঙালির সঙ্গীতের আঙ্গিক তৈরি হতে হবে।

কলকাতার বাবুদের মত ঢাকায় একটা বাবু ক্লাসের তৈরি কালচার কনসার্ট সংস্কৃতি থেকে দেশ বাঁচতে পারবে না। নাটক মহিলা সমিতি থেকে রাস্তায় নামাতে হবে যা কিনা ইতিমধ্যে কিছুটা নেমেছে। অনুরূপ বর্ষবরণকে বটমূল থেকে বস্তিতে যেতে হবে, গ্রামে যেতে হবে। নদীর মাঝির জীবনের সুর থেকে সঙ্গীত খুঁজে পেতে হবে। এটাই হোক বাংলা নববর্ষের প্রত্যাশা। 

বৈশাখী মেলায় বেহিসেবি আয়োজন


বৈশাখী মেলায় বেহিসেবি আয়োজন

সংলাপ ॥ শুভ নববর্ষ, স্বাগত ১৪২২ সাল। এক রাশ আশা আকাঙ্খার স্বপ্ন নিয়ে আসে একটা নতুন বছর। গত বছরের ঘটমান ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে যায়। পহেলা বৈশাখ আনন্দ উৎফুল্লতার মাঝ পথে খানিকটা সময় নিয়ে আমরা গত বছরের স্মৃতিচারণের বিলাসিতায় মেতে উঠি। চোখের রেটিনায় ভেসে ওঠে পাওয়া, না পাওয়া আর টানাপোড়েনের চড়াই উৎরাই। প্রবীণরা বলেন, ‘যাই বলো বাবা, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ প্রবীণদের নেতিবাচকতা আর খারাপ সময়কে উৎরিয়ে আমরা নবীণরা দেখি সামনে ঝলমলে দিন, ক্যালেন্ডারে নতুন পাতা, সুদিনের ছোঁয়া, মেঘের মাঝখানে আলোর রূপালী রেখা। জীবনবোধে অনীহাকে ঝেড়ে ফেলে, নতুনকে নতুন করে উপভোগের আকাঙ্খা আর নেশা আমাদের পেয়ে বসে। বলি, পুরনো যা গেছে বিদায়, সামনে নতুন দিন স্বাগতম।
নগর জীবনে ব্যস্ততার কাঁথায় মোড়া থাকি উদয়াস্ত। জীবনবোধে, জীবনযুদ্ধে লড়াকু মেজাজ নিয়ে আমরা আবার ক্রিজে ফিরি। মহাকালের বুকে বিলীন হয়ে যাওয়া একটা বছর কিছু না। গত বছরে সংসারে অসুখ-বিসুখ ছিলো, প্রাপ্তির মানচিত্রে ছিলো অঢেল মানহীন চিত্র, আবার গেলো চৈত্রে অষ্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপে আন্তর্জাতিকতায় বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা পত্‌পত্‌ করে উড়েছে, আমরা বাঙালিরা পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি। জঙ্গীপনায় সারা দুনিয়ার সংবাদে শিরোনাম হয়েছি, চিন্তা হয়েছে কেন এই মৃত্যু? কেন এই বিভীষিকা? প্রকৃতিতে বর্ষ শুরুর দিন, আর বর্ষ শেষের দিনে তফাৎ খুব একটা নেই। পারিপার্শ্বিকতা ভুলে নিশ্চিন্তপুরের মেঘলা আকাশ দেখি, দেখি বোশেখের রুদ্র ঝড়, বাতাসে এক অন্যরকম গন্ধ, এক অপরূপ অনুভব। ঝরাপাতা পায়ে দলে, নতুন পাতার শিহরণে সবুজ হয়ে ওঠে গাছপালা, চরণে পায়েলা রুমুঝুমু রুমুঝুমু আর মধুপের গুঞ্জরণ শেষে গুনগুন করে আমরা গেয়ে উঠি,
‘এসো এসো হে নতুন উদ্দন্ত বৈশাখ ঋতু রূপী রুদ্রের পিনাক
বসন্ত বিদায় মুখে ধরণীর বুকে জাগিয়াছে তব আহবান।
মর্মরিত শুষ্কপত্রে গাহিয়া চিরন্তর আগমনী গান।’
সাজ সাজ রব শহরে, গ্রামে। শুকনো চৈতী পেছনে ফেলে এসেছে বোশেখের আভা। আমের বোল, সবুজ ধানের পাতায় পাতায় পাক মেরে যায় উদাসী ধুলো, ইরি-বোরোর সমারোহে গ্রামের কচিকচি ছেলেমেয়েরা দৌঁড়ে যায় দল বেধে, বলে - ‘ধানকুড়ালি আইয়্যে’ উতলা ধুলো ঝাপসে দেয় বিস্তীর্ণ সবুজের মধ্যমাঠ। কৃষকের ঘর ভরবে ফসলে আর ছেলেমেয়েরা বায়না ধরবে টাকার মেলায় যাওয়ার জন্য। কোনো কোনো অঞ্চলে বান্মি, কোথাও গাছতলা নামে পরিচিত বৈশাখী মেলা। গেল বছরে আমাদের সাধারণদের জীবিকার পরিসর হয়ে গিয়েছিলো বেহাল। ব্যক্তি হিসেবে, সমাজসভ্য হিসেবে, রাষ্ট্রের একজন সচেতন ও সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে বিশ্ব পল্লীর অন্যসব সদস্যের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছিলাম, চিন্তায় ক্রমশঃ অসুস' হয়ে যাচ্ছিলাম, ঝিম মেরে থাকতো, দিনবদলের পালায় দিন পাল্টেছে। এখনো যা হয়নি সামনের সময়ে তা হবে এমনি একটা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে।

স্টেরিওটাইপড নববর্ষ

প্রতিবছরেই শহরে বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, মাথা মাথারা আশার বাণী শুনান, দেন বড় বড় প্রতিশ্রুতি। বোশেখের দ্বিতীয় দিন থেকে চৈত্রের শেষ দিনতক, আমরা দেখি কিভাবে প্রতিশ্রুতির মালা ছিঁড়ছে। উন্নয়নের চ্যাম্পিয়ন হই, ভাঙ্গা বুকের ভিতর বেজে ওঠে গেল বছরের স্মৃতির সানাই।

সহনীয় জীবন

দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতিসহ সামাজিক আচার-আচরণে আমরা সহনীয় জীবন চাই। ঘুম থেকে উঠে পাউরুটি দুধ কিনতে গেলে দোকানী বলে গতকাল দুটো আইটেম, দুই টাকা করে বেড়েছে। রিক্সয় বাচ্চাকে স্কুলে নেয়ার সময় বাস স্টপেজে দেখা যায় ১০টা বাস বাঁকা হয়ে আছে, ডানে বায়ে রিক্স পথ বন্ধ, কায়ক্লেশে স্কুলে পৌঁছলাম। ২০ টাকার নোট থেকে রিক্সওয়ালা দুইটাকা বেশি রেখে দিলো, তারপর কাজের দিন এলাকার মাস্তান মাথা ফাটিয়ে আসলো সাথে ১০-১২ জন শুভাকাঙ্খী, স্টাফ ডাক্তারের সাথে বাজে ব্যবহার করে টাকা না দিয়ে চলে গেলো। নিয়ম নীতির জন্যে পুলিশে খবর দিলে ‘বাঘে ছুলে ১৮ ঘা, পুলিশ আসলে ২০ ঘা’-এর জীবন। বাসকন্ডাক্টর বিশ্রী ভাষায় গাল দিলো ১ টাকার ভাড়ায় ১০ টাকা দিয়েছি বলে। ছোট ছোট কষ্টের ব্যাপারগুলো আজ বড় করে দেখি আমি আজকের মতো কোনো বিশেষ দিন এলোই। নিজের বুকের ভেতরে ভাংচুর হয় যখন দেখি বুড়ো ভদ্রলোককে বাস থেকে নামার সময় না দিয়ে ড্রাইভার টান দিলো। ফসকে পড়লেন মুরুব্বী, ছাল উঠে গেলো পায়ের, ফাটলো মাথা, সবাই নীরব দর্শক। আমরা আর কষ্ট পেতে চাই না। প্রতিদিনই ছুরি পেটে ঢুকার সম্ভাবনা থাকে, গুলি হতে পারে বুকে। স্কুল ফেরত মায়ের সাথে রিক্সয় বাড়ি ফিরতি শিশুটা সিএনজির ধাক্কা খেয়ে হাত ভেঙ্গে আসতে পারে আচমকা। এসব অসহনীয় অবস্থা আমরা উৎরাতে চাই। কিছু কিছু দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক ভালো থাকার, ভালো কিছু করার, নেতির বিপ্রতীপে ইতিকে জেতাবার আর তাই চাই সহনীয় জীবন।

নববর্ষ শহরে

ঢাকার রমনার বটমূলে নতুন সূর্যোদয়ে ছায়ানটের শিল্পীরা ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ডুলিতে দাও’, সুরের মূর্ছনা দিয়ে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। বাংলা একাডেমি থেকে শুরু হয় মঙ্গল শোভা যাত্রা রংবেরং এর পোষাক আর ফুলের অলঙ্কারে বোশাখী সাজে অপরূপা হয়ে ওঠে বাঙালি নারীর চিরায়ত রূপ। গালে উল্কি, খোপায় গাদা আর বকুলের মালা। কবির ভাষায়, ‘চলে নীল শাড়ি নিংয়াড়ি নিংয়াড়ি, পরান সহিত মোর।’
নবীণ প্রবীণের মিলন মেলায় উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, রমনার বটমূল সহ প্রতিটি বাঙালি ঘর -
‘ভৈরব তুমি কি বেশে এসেছো
ললাটে ফুসিছে নাগিনী।
রুদ্র বীনায় একি বাজিলো সুপ্রভাতের রাগিনী।’

শিল্পকলায় বাউল, লালন, হাসন মাইজভান্ডারী বাতাসে ভাসে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠে বছরের পয়লা দিনটিকে বরণ করে নিতে। তাইতো পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। 

বৃহস্পতিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৫

অজ্ঞতাই সকল ভুলের মূল

অজ্ঞতাই সকলভুলের মূল

সংলাপ ॥ অজ্ঞতার জন্য ধর্ম নিয়ে তর্কের শেষ নেই। ভুল বুঝাবুঝির শেষ নেই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক সকল ক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব অপরিসীম। ধর্ম মানুষের জীবন চলার পথে এক প্রক্রিয়ার নাম। ধর্মে বিশ্বাস যেমন খুব গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ধর্মচর্চা ও চর্যা করেনা এমন মানুষের জন্যেও ধর্ম সমানভাবে গুরুত্ব বহন করে। ধর্মে বিশ্বাসী এবং ধর্মচর্চায় একনিষ্ঠ মানুষ অন্য মানুষের শুভ কামনা করে, অন্যের প্রতি ভদ্র আচরণ করে এবং নিজে সবদিক থেকে পবিত্র থাকে। রাজনৈতিক ধর্ম ও উগ্রবাদিতা অন্য মানুষের ক্ষতি করে এবং নিজেকে অপবিত্র রাখে। ওই ধর্মাবলম্বীরা মানুষকে ভালোবাসে না এবং অন্য মানুষের ক্ষতি করে।
পৃথিবীতে ভাল-মন্দের বিচার করা কঠিন নয়। এক দেশের আইনে মন্দ বলে যা বলা আছে, তা অন্য দেশের আইনেও মন্দ বলা হয়েছে। মানুষকে হত্যা করা কোন দেশেই ভাল কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়নি। যা ভাল তা সকল দেশেই ভাল আর যা মন্দ তা সকল দেশেই মন্দ। ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের দেশগুলোতে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।এসব দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একসময় ধর্মের যে বিশেষ ভূমিকা ছিল তা আজ আর নেই এখন আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোটি কোটি মানুষ আজ এসব দেশে প্রকাশ্যে ধর্মের উগ্রবাদী ভূমিকাকে ঘৃণা করে। এসব মানুষ ধর্মের উগ্রবাদিতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করছে এবং প্রকাশ্যে তা ঘোষণা করছে। এদের সংখ্যাই বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে বেশি।
উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষকেই সমাজে পাওয়া যায় পরোপকারী মানুষ হিসেবে। আইন মান্য করা, সত্য বলা, মানুষের ক্ষতি না করা, মানুষ ও জীবকে ভালবাসা, মানবতার এই গুণাবলী উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। ধর্মের বাঁধনে বা শাসনে নয় বরং সামাজিক দায়িত্ব হিসেবেইনৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে এসব দেশের মানুষ  কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ ও প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসাবে এই মানুষগুলো সামাজিক বিচারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দাবি করার উপযোগিতা লাভ করেছে। মানুষ ও জীবের সেবা করে এরা ধর্মের মূল কাজটিই সম্পাদন করছে উগ্রবাদী ধর্মকে অস্বীকার করেও। আফ্রিকা, এশিয়া, এবং মধ্যপ্রাচ্যে অনুন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে  উগ্রবাদী ধর্মের প্রভাব অনেক বেশি। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, এবং ব্যক্তিগত জীবন এখানে পরিচালিত হয় ধর্মীয় মূল্যবোধ ছেড়ে ধর্মের বিধানের অনুকরণে। বেশ কয়েকটি দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় সকল কাজে ইসলাম ধর্মের নামে গোত্রীয় বাদশাহী ধর্মসমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা রাখছে। উন্নত দেশে না হলেও এসব উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীর জন্য দেশের আইন ও বিধি-বিধানও রচিত হয় বাদশাহী ধর্মেরঅনুশাসনের উপর লক্ষ্য রেখে। এসব দেশের মূল অংশই ধর্মে অন্ধ বিশ্বাসী, গোঁড়া এবং আনুষ্ঠানিকতায় নিবেদিত। এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অংশে মূলতঃ মানুষ এবং রাষ্ট্র, পরিবার এবং সমাজ সবকিছুই আবর্তিত হয় রাজনৈতিক ধর্মের অনুপ্রেরণায় এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায়।
রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতার ধর্ম সফলতার পরিবর্তে বর্তমান বিশ্বে বিফলতার পরিচয় দিচ্ছে। ওই ধর্ম মানুষকে একত্রিত করার পরিবর্তে বিভক্ত করছে। অন্যদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুসারীরা মানবতার বাণীতে ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ এই শ্লোগানে সকলে এক জায়গায় একত্রিত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকতা ও রাজনৈতিক ধর্মের চাপে অজ্ঞতার কারণে মুসলমান খুঁজছে মুসলমানকে, হিন্দু খুঁজে হিন্দুকে, খ্রীষ্টান সাহায্য করছে খ্রীষ্টানকে এবং বৌদ্ধ এগিয়ে যাচ্ছে বৌদ্ধের অনুসারীদের পাশে। সকল মানুষ এক ও অভিন্ন এবং ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই জীবনাদর্শ শ্রেণীধর্মের আঘাতে হুমকির মুখে। অজ্ঞতার কারণে উগ্রবাদী ধর্মের কাছে বিশ্ব মানবতা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। সকল ধর্মেই উপদেশ, নির্দেশ ও নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক উগ্রবাদী শ্রেণীধর্ম মানুষকে বিশালত্বের পরিবর্তে ধর্মীয় মূল্যবোধহীন ধর্মীয় গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টায় রত।
সকল ধর্মে স্রষ্টার বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলেও ধর্মীয় মূল্যবোধহীন শ্রেণীধর্মের মানুষ নিজ নিজ ভঙ্গিতে স্রষ্টাকে স্বীকার করছে ও চিহ্নিত করছে। বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করছে। মূল্যবোধের ধর্ম তাই সকল মানুষকে তার ধর্মীয় চেতনায় এক পতাকাতলে আনয়ন করতে পারছে না। অন্যদিকে দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা মানুষকে ধর্মের বিভিন্নতায় বিভক্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছে। ধর্মীয় মানবতার পতাকাতলে পৃথিবীর সকল চৈতন্যশীল মানুষ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
ধর্মে বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, আস্থাশীল সকল মানুষেরই শুধু একটি পরিচয়ে পৃথিবীতে চিহ্নিত হওয়ার সময় এসেছে এবং সেই পরিচয় হচ্ছে মানুষ-মানবতা। মানবতা মানুষকে নিয়ে, কোন বিশেষ শ্রেণী ধর্মকে নিয়ে নয়। বিশ্ব মানবতায় সকল ধর্মের স্থান সমান।
ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মের বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী কারও জন্যেই মানবতার পতাকাতলে অবস্থান নিতে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয় না। পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে সকল মানুষের কল্যাণে, সকল মানুষকে একত্রিত করার জন্যে এবং সকল মানুষকে শৃঙ্খলার জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যে। হাজার হাজার বছর অতিক্রমের পর আজ অনুধাবনের সময় এসেছে রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতার উগ্রবাদী ধর্ম বৃহত্তর মানুষের কল্যাণে সঠিক ভূমিকা রাখতে কতটুকু সমর্থ হচ্ছে তাই নিয়ে।
বর্তমানে উগ্রবাদীরা মানুষকে বিভক্ত করার ভূমিকা গ্রহণ করছে, তাই ধর্মের কারণে মনুষের অখন্ডতা নীতি হুমকির মুখে পড়ছে। ধর্মের মূল্যবোধ বিষয়ে মানুষের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিশ্বে ধর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যা আরও হ্রাস পেতে থাকবে। অন্ধভাবে নয়, ধর্মকে জানতে হবে মূল্যবোধের চর্চা ও চর্যা করে সত্যের ভিত্তিতে। মানুষকে সেবা করার মধ্যেই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। বিশ্ব মানবতার স্বার্থে ধর্মের মূল্যবোধগুলোতে আমাদেরকে প্রভাবিত করার জন্য রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতার উগ্রবাদী ধর্মের কবল হতে বের হয়ে আসার বিশ্বজুড়ে এখনই সময় নচেৎ মূল্যবোধের ধর্ম-মানবতার ধর্মের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে এবং আরো হবে।
ধর্মের অন্যতম কাজ তার অনুসারীদের সত্যের পথে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। মানুষে মানুষে হানাহানি, উচ্ছৃংখল জীবনযাপন এবং মানুষের বিভক্তিকরণ রোধ করতেই মানুষ একদিন ধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল। অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতেই আজ সময় এসেছে মূল্যবোধ অনুধাবনের, সময় এসেছে আত্মবিশ্লেষণের-ধর্ম মানবতার জন্য প্রমাণ করতে। রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতায় ব্যক্তি স্বার্থের বা গোষ্ঠী স্বার্থের বা উগ্রবাদীতার ধর্ম নয়।

ধর্ম অন্ধ বিশ্বাস নয় বরং আধুনিকবৈজ্ঞানিক সত্যের দিসারী এবং মানবতার সেবায় নিবেদিত প্রাণ হিসেবে সকলের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে সামনের দিকে অগ্রসরমান। ধর্ম মানুষের জীবন চলার পথে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং ধর্মপরায়ন মানুষ ধর্মকে ব্যক্তি জীবনেরদৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সত্যপ্রতিষ্ঠার অস্ত্র হিসাবে গণ্য করুক এটাই সময়ের দাবী। 

সময়ের সাফ কথা ....গণতন্ত্রের এপিঠ-ওপিঠ

সময়ের সাফকথা ....
গণতন্ত্রের এপিঠ-ওপিঠ

সংলাপ ॥ বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক দু’টি মাত্রাতেই এখন ইউরোপে জার্মানি আর সুইজারল্যান্ডের অবস্থান শীর্ষে। সামগ্রিকভাবে আমেরিকা এখন ইউরোপের নিচে চলে এসেছে। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এশিয়া ও আফ্রিকায়। বিশেষ করে এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়।
ইউরোপের বড় ও সমৃদ্ধ দেশ জার্মানির গণতন্ত্র বা জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারক-বাহক রাজনীতিকরা ও জনপ্রতিনিধিরা ওই দেশ থেকে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা নিজ দেশের কাজে লাগাতে পারেন।
দুঃশাসন, গণতন্ত্রের চর্চার অভাব ও উগ্র রাজনীতির শিকার বাংলাদেশের সিংহভাগ সাধারণ মানুষ। যে কোন একজন পেশাদার কর্মজীবী বা সাংবাদিক বা মুক্তমনা এই অন্ধকার দিকটির শিকার হতে পারে। অনেক যন্ত্রণা আর নিপীড়নের পর তারা বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূল তিনটি ভিত্তি। এগুলো হলো আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ আর প্রশাসন। একটি আরেকটির ওপর নির্ভরশীল। পরস্পর পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করেই গণতন্ত্র সচল থাকে। তিন বিভাগকেই একই উদ্দেশ্যে, একই লৰ্যে কাজ করে যেতে হয়। সেটি হল, জনকল্যাণ এবং জনসেবা। একটি বিভাগ আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর এই তিনটি উপাদানকে যথাযথ ভাবে চালানোর মূল দায়িত্বটি থাকে, রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিকদের ওপর। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাজনীতিকরাই গণতন্ত্রের ধারক, বাহক ও রক্ষক।
গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণ তখনই পাবেন যখন উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতি সঠিকভাবে চলবে বা কার্যকর থাকবে। কিন্তু এই উপমহাদেশে বিশেষত: বাংলাদেশে এর একটিও যথাযথ কার্যকর আছে বলে জনগণ বুঝতে পারছেন না। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের জন্য এখনও মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। রাজনৈতিক হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ রয়েছে।
জনগণের স্বার্থ ও দেশের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখতে শেখেনি সব রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা।
জার্মান বা ইউরোপে একজন রাজনীতিক নেতা, মন্ত্রী এবং একজন সাধারণ মানুষ, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ওখানে রাজনীতিকদের মধ্যে বা সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে ক্ষমতার কোন বাহাদুরী নেই। জনগণকে ওখানে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। জনগণের চাওয়া-পাওয়া বা সুবিধা-অসুবিধার প্রতি রাজনীতিকদের থাকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি। বাংলাদেশে ঠিক তার উল্টো। কখনই জনগণের কোন মতামতের তোয়াক্কা করেন না শুধুমাত্র ভোটের সময় ছাড়া।
আইন প্রণেতা বা এমপিদের কাজ বাংলাদেশ, জার্মানি বা অন্যান্য দেশে সর্বত্রই মোটামুটি এক। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ নির্মাণ, জনকল্যাণ, সামাজিক কাজকর্ম, উন্নয়ন, সংস্কার, আইন প্রণয়ন এসবই এমপিদের মূলত: প্রধান কাজ। জার্মানিতে কোন আইন পাশের আগে জনগণের মতামত অপরিহার্য্য। সংসদে কোন আইন প্রণয়ন বিষয়ে আলোচনা উঠলে সাথে সাথে এমপি তার নির্বাচনী এলাকায় চলে যান। আইনটি সম্পর্কে সভা সমিতি ও দেখা সাক্ষাত করে তার ভোটারদের ব্যক্তিগত ভাবে বিস্তারিত জানান।
জনগণ যখন বলেন যে আইনটি ভাল বা মঙ্গলজনক, তখন তারা তার পক্ষে মত দেন। আর যদি মনে করেন এই আইনটি জনকল্যাণমূলক (অন্তত: তাদের এলাকার জন্য) নয় তাহলে তারা বিপরীতে মতামত জানান। জনগণ না চাইলে একজন এমপি তার পার্টির সিদ্ধান্তের বিপক্ষেও দাঁড়িয়ে যান।
পার্লামেন্টে তিনি তার এলাকার ভোটারদের দাবির কথা মনে রেখে নিজের দলের বিরুদ্ধে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ভোটদান করেন বা নিরপেক্ষ থাকেন। এটাই পাশ্চাত্যের রাজনীতির সংস্কৃতি। এর জন্য দলীয়ভাবে তাকে কোন জবাবদিহি করতে হয় না। তার দায়বদ্ধতা আগে জনগণের কাছে, পরে আসে তার রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে আদর্শিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি কবে গড়ে উঠবে তা নিয়ে চিন্তাবিদদের ভাবনার শেষ নেই। জার্মান পার্লামেন্টে বিভিন্ন কমিশন আছে। এই ধরনের কমিশন বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই আছে। জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কমিশন হলো সংসদ সদস্যদের আর্থিক বিষয়াদি যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত, দেশরক্ষা এবং গোয়েন্দা বিভাগ। ওইসব কমিশনের প্রধান বা সভাপতি নির্বাচন করা হয় বিরোধী দল থেকে। ফলে সরকারি দলের নয় ছয় করার কোন সুযোগ নেই। অবশ্য ওখানে কেউ নয় ছয় করেনও না। বাংলাদেশে এমনটা লক্ষ্য করা যায় না। বাংলাদেশে বিরোধী দলের সংসদ সদস্য কোন কমিশনের প্রধান হলেও দুর্নীতি বা অনিয়মের বেলায় শুধুমাত্র একজন অপরজনের গা চাটছে। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ এবং জনকল্যাণ ও নীতি, এ দুটি বিষয়ের মধ্যে রাজনীতিকরা কখনই পার্থক্য করতে পারছেন না। জার্মানে একজন দাগী অপরাধীকে আপনি করে বলা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভদ্রভাবে ও শান্ত মসিৱষ্কে প্রশ্ন করা হয়। ডিটেনশনকালে তার ব্যক্তিগত চাহিদাগুলোও যথাসম্ভব মিটানো হয়। নির্যাতনের তো প্রশ্নই উঠে না। বাংলাদেশে এই চিত্রটি দুঃসহ এবং ভয়াবহ। এটা বাঙালি মাত্রেই ভালভাবে জানেন। জার্মানির জনপ্রতিনিধিরা মানবাধিকার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন এবং জ্ঞান রাখেন। এ বিষয়ে তাদের আছে অনেক পড়াশোনাও। বাংলাদেশের ক’জন জনপ্রতিনিধির মানবাধিকার জানা আছে তা বলা মুশ্‌কিল। আবার মানবাধিকার জানা থাকলেও ক’জনই বা তার বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন? এর জবাব জনগণ জানেন।
সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন সর্বত্রই বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের জন্য আছে এক অসহনীয় অবস্থা। অথচ মন্ত্রি, কূটনৈতিক বা এমপি পাড়ায় কিন্তু বিদ্যুৎ থাকছে ২৪ ঘণ্টাই। ইউরোপ বা জার্মানিতে এমনটা ভাবাও যায় না। ওখানে কোনবৈষম্য লক্ষ্য করা যায় না। একজন এমপি আর একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে কেন পার্থক্য থাকবে? মন্ত্রীরাই বা জনগণ থেকে স্বতন্ত্র থাকবেন কেন? ওখানকার মন্ত্রীরা অনেকেই সাধারণ আবাসিক এলাকায় বাড়ি নিয়ে থাকেন। গেট পার হবার সময় ভেতরে দু’একজন সাদা পোশাকের নিরাপত্তা বিভাগের লোক দেখা যায়। আর আমাদের দেশে একটি মন্ত্রীভবনকে পাঁচশ/হাজার গজ দূর থেকেই নানা বাধা নিষেধের বেড়াজালে জনগণ থেকে আলাদা করে রাখা হয়।

সপ্তাহান্তে বেশিরভাগ মন্ত্রী নিয়মিত তাদের (প্রদেশের) রাজধানীর প্রাদেশিক মন্ত্রীভবন থেকে নিজস্ব শহরে তাদের নিজস্ব বাড়িতে যান সপরিবারে। মূল উদ্দেশ্য, ভোটারদের সাথে নিয়মিত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখা। মন্ত্রীরা প্রায়ই একাই যান। দেহরৰী সাথে নিয়ে কখনো কখনো তাদের শহরে কোথাও যান। মাঝে মাঝে সাথে তাদের স্ত্রী বা সন্তান থাকে। এলাকার কোন লোকের অসুখের কথা শুনলে এক ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রী মহোদয় ফুলের তোড়া নিয়ে সপরিবারে হন হাজির। দ্রুত আরোগ্য - কামনাটি ব্যক্তিগতভাবে জানানোর জন্য। বাংলাদেশে মন্ত্রী তো আকাশের চাঁদ, দেখা যায়, ধরা যায় না! বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে জনগণই হলো দেশের মালিক। আবার বলা হয়, জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস। তাহলে জনগণ কেন এত দুর্ভোগ, কষ্ট পেয়ে জীবন যাপন করছেন। এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? গণমানুষের জানা নেই।