বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৫

বাঙালি মানসিকভাবে দারিদ্র্র্যের মধ্যে আছে!


বাঙালি মানসিকভাবে দারিদ্র্র্যের মধ্যে আছে!
শেখ উল্লাস ॥ ‘মান’ শব্দের সাথে ‘হুশ’ শব্দের মিলনে গঠিত শব্দ ‘মানুষ’। এ প্রসঙ্গে হাক্কানী সাধকের অমূল্য বাণী- ‘মানুষ নামের মান-হুশটাকে মরতে দিও না’। স্বাধীনতা ও প্রযুক্তির আশীর্বাদ হিসেবে আজ দেশের মানুষদের একটি অংশ বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে, কিন্তু সেই সব মানুষের চিত্ত কতটুকু বড় হয়েছে, দেশে প্রকৃত মানুষ কত জন আছেন তা নিয়ে চিন্তা ক্রমেই বাড়ছে। গত ২২শে আগষ্ট শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত লিখিত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে দারিদ্র্র্যের মধ্যে আছি। আমাদের মানস কাঠামোয় যে দারিদ্র্য আছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা এখনো সাদা চামড়ার মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় সোজা হয়ে কথা বলতে পারি না, মানসিকভাবে যেন কিছুটা ভেঙ্গে পড়ি।... ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগার একেবারে খালি থাকা অবস্থায়ও বিশ্বব্যাংকের অনৈতিক শর্তের ঋণের প্রস্তাব অসম সাহসিকতার সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু’। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান তিনি বাঙালির আত্মপরিচয় দিয়েছেন’। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিষ্টার এম আমিরুল ইসলাম বলেন,‘বঙ্গবন্ধু সশরীরে বেঁচে না থাকলেও তাঁর মতাদর্শ রয়েছে। সেটার বাস্তবায়ন হলেও বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত। দেশে এখন জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু প্রকৃত মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে’। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘যারা শোকসভায় বক্তব্য দেন শুধু তাদেরই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যাদের জন্য জীবন দিয়েছেন সেই গরীব মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। বিদেশি প্রভুদের যোগসাজশে এদেশের তথাকথিত শিক্ষিত তথা কাপুরুষেরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু নামটিকেই নিষিদ্ধ করে রেখেছিল দীর্ঘ একুশ বছর । সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের পর তাঁর সরকার বা দলের  কত জন মানুষ সেই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করেছিলেন? আজ যখন বঙ্গবন্ধুর দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, বঙ্গবন্ধু ক্রমেই হয়ে উঠছেন সার্বজনীন, সরকারি-বেসরকারি সর্বস্তরেই বঙ্গবন্ধুর নামকে ব্যবহার করে অনেককেই দেখা যাচ্ছে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির চেষ্টায় লিপ্ত তখন বঙ্গবন্ধুর ওই বাণীটিই স্মরণ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে’। সেই শোষিতের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সমুন্নত রেখেছিলেন যা আজ কারো কারো কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতে পারে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আজো যখন এদেশের জনসংখ্যার বিরাট অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, রাজধানীতে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনী সংস্থার ভাস্কর্যের চাপায় প্রাণ দিতে হয় ভ্যানচালককে এবং এর জন্য কাউকেই জবাবদিহি করতে হয় না বা ক্ষতিপূরণও দিতে হয় না, তখন সেই এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দেয়, দেশে প্রকৃত মানুষের সংখ্যা কত? এই অবস্থাটিকে দুঃখজনক ছাড়া আর কি বলা যায়?  তাই বাঙালি সাধকের ‘মানুষ হ, মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ’, বিশ্বমানব হবি যদি তুই কায়মনোবাক্যে বাঙালি হ’-এই বাণীর তাৎপর্যটুকু আবারো নতুন করে উপলদ্ধির সময় এসেছে। সমাজে মানুষ অর্থাৎ প্রকৃত মানুষের সংখ্যা যাতে বৃদ্ধি পায় সেই চেষ্টায় সকলকে নিয়োজিত হওয়ার সময় বয়ে যাচ্ছে।

অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী


অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
শাহ্‌ সারফুল ইসলাম মাহমুদ ॥ বিশ্বে কোন দেশের ক্ষমতাসীন কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে তার অন্তেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করে থাকেন প্রতিবেশী বা অপর কোন দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান। ক্ষেত্র বিশেষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি কুড়ানো কোন সাবেক রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতেও অপরাপর রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানদের যোগ দিতে দেখা যায় তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়ায়। যেমনটি ঘটেছিল দক্ষিন আফ্রিকার প্রয়াত নেতা জন-নন্দিত নেলসন ম্যান্ডেলার ক্ষেত্রে। কিন্তু একজন রাষ্ট্রপতির পত্নী বিয়োগ ঘটলে তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় কোন রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান, সে প্রতিবেশী রাষ্ট্রই  হোক বা দূরদেশি রাষ্ট্র হোক, এমন নজীর নিকট বা দূর অতীতে পাওয়া যাবে না একটিও। অথচ এমনি একটি উদার নজীর স্থাপন করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জীর পত্নী শুভ্রা মুখার্জীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তাৎক্ষনিক শোক বার্তা পাঠানোর শিষ্টাচার প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের বাইরে গিয়ে ছুটে গেলেন নয়াদিল্লী ভারতপতির পত্নীর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। সংবাদ মাধ্যমে এর পেছনে কারণ হিসাবে যা  উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বপরিবার হত্যার সময় বিদেশে অবস্থান করায় প্রানে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে কয়েক বছর রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। সে সময় পিতৃ-মাতৃ পরিজনহীন এই দুই বোনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালিন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা বাঙালি প্রনব মুখার্জী এবং তার স্ত্রী বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে শুভ্রা দেবী। তাঁদের বাড়ীতে ছিলেন শেখ হাসিনা ঘরের মেয়ের মত। ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাঙালির কৃতজ্ঞতাবোধের অনন্য নজীর দেখালেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে থাকা শেখ হাসিনা। ভারত দেখলো বিশ্ব দেখলো বাঙালির উপলব্ধি এবং অনন্য কৃতজ্ঞতাবোধ। শুধু কি তাই? কেবল ব্যক্তিগত পারিবারিক কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ দেখালেন শেখ হাসিনা? ব্যক্তিমানুষের আবেগ অনুভূতিরই শুধু প্রকাশ ছিল তাঁর এই অকস্মিক দিল্লী ছুটে যাওয়ায়?
মোটেই তা নয়। ছিল রাষ্ট্রনায়কোচিত দুর্লভ বিবেচনাবোধ এবং দূরদর্শিতাও। শেখ হাসিনা জানেন কেবল শেখ পরিবার নয় শুভ্রা দেবীর মাঝে প্রবল ছিল জন্মভূমি প্রেম। প্রনব মুখার্জীর মাঝেও সততবিরাজমান বাঙালি ভ্রাতৃত্ববোধ, বাংলা ও বাঙালি প্রেম। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য এই দম্পত্তির মাঝে ঐকান্তিক কামনাই কেবল জাগরিত ছিল না, ছিল বাস্তব ভূমিকাও। ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নে গত প্রায় চার দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ এমন কি কখনও কখনও বা আনেক ক্ষেত্রেই নিয়ামক ভূমিকায় ছিলেন প্রনব মুখার্জী। বাংলাদেশ বিরোধী, বাঙালি বিদ্বেষী শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে, এদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে অকার্যকর করে দিতে তিনি দিল্লীর ভূমিকা-প্রভাবকে কাজে লাগিয়েছেন নানাভাবে। ভারতের পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে তার দায়িত্ব পালনের সময়গুলোতে প্রনব মুখার্জীকে দেখা গেছে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় সদা সক্রিয়। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের মেয়ে শুভ্রা দেবীর তাতে ছিল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান।
ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের বাংলাদেশ-বান্ধব নীতি প্রণয়নে বলা যায় একক প্রভাবক শক্তিরূপে প্রনব মুখার্জী ভূমিকা রেখেছিলেন প্রয়োজনে যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত। জঙ্গী-ধর্মান্ধতা-সন্ত্রাস মুক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আজকের অবস্থায় উঠিয়ে আনার ক্ষেত্রে ব্যক্তি প্রনব মুখার্জীর অবদান হিমালয়সম। শুভ্রা মুখার্জীর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়ে নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের দূরদর্শী নেত্রী শেখ হাসিনা। গোটা বিশ্বে এই বার্তাও পৌঁছে গিয়েছে যে বাংলাদেশ- বাঙালি উপকারীর উপকারের মর্যাদা দিতে জানে।
শুভ্রাদেবীর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় বাঙালি প্রীতি, বাঙালি সংস্কৃতি এবং চিরায়ত বাঙালি লোকাচারে নজীর প্রদর্শন করছেন ভারতের বঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায়। প্রনব পত্নীর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় মূখ্যমন্ত্রী মমতাও ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লী।

ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে


সময়ের সাফ কথা....
ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে
সংলাপ ॥ বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস-এর বিশদ বিবরণ আর লেখার প্রয়োজন নেই। আসল ইতিহাসের সত্যতা এখন এখন সবাই জানে। সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুসংগঠিত হয়ে এক শ্রেণীর জাতীয় শত্রু এই ইতিহাসকে বিকৃত করে দেয়ার  ষড়যন্ত্রে আজও লিপ্ত। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সমাজে কলঙ্কিত করতেও আজও তারা বদ্ধ পরিকর। এক পৈশাচিক ও বর্বরতায় তারা উন্মাদ হয়ে উঠছে। এরা মানুষ নয়, এরা মানুষরূপী দু-পেয়ে জন্তু। এদেরকে দেশবাসী ধীরে ধীরে চিনতে পারছে। বাঙালিরা এদেরকে ঘৃণা করে মনেপ্রাণে। এদের নাম ঘৃণিত নাম। বিবেকবানদের  কলম দিয়ে, মুখ দিয়ে তাদের নাম উচ্চারণ করাও উচিত নয়। এমনকি বাংলা ভাষার অক্ষর দিয়ে এসব বিশ্বাসঘাতকদের নাম লিখে সমালোচনা করাও উচিত নয়। প্রবাদ আছে ‘যাকে ঘৃণা করো, তাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করো’। কাগজে ফলাও করে ছবি ছাপিয়ে (হোক সে ছবি বিকৃত আকারের) বারবার পবিত্র কলমের কালি দিয়ে এদের নাম লিখে সমালোচনা করাও সঠিক কিনা তা বিবেকবানদের ভাববার বিষয়। তাই মনেপ্রাণে ঘৃণার সাথে সাথে বিবেকবানরা তাদেরকে কাগজে কলমে শুধু ঘৃণা করা নয় সব মুদ্রন ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে সার্বিক অঙ্গনে তাদের বয়কট করা উচিত বলে চিন্তাবিদরা দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা জোটের একটা অংশ হিসেবে কাজ করছে। স্বাধীনতা উত্তর বিভিন্নভাবে কারো রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে, কারো অবৈধভাবে জোগাড় করা ক্ষমতাকে সংগঠিত করার কারণে, কারো বা ক্ষমতারোহনের সহায়ক শক্তি হিসাবে সমর্থন আদায়ের কারণে আজ তারা সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনে চলা-ফেরা করার অধিকার পেয়েছে। ধর্মের লেবাস পরে ধর্মভীরু মানুষের মাঝে আজ তারা বিস্তৃত। তারা আজও এ দেশকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও গণতন্ত্রকে মেনে নিতে পারেনি, পারেনি স্বাধীনতাকে মেনে নিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নাখোশ ভাব আজও তারা তাদের চিনৱা থেকে অপসারণ করতে পারেনি। স্বাধীনতাকে নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আজও কটুক্তি করার দুঃসাহস দেখায় তারা।
অপরদিকে নির্লজ্জ দেশপ্রেমিক নামধারী রাজনীতিকরা কেউ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, কেউ জাতির জনকের নাম ভাঙ্গিয়ে,  মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ সেজে গলাবাজি করে সর্বদা দুর্নীতি-লুন্ঠনের কাজে নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখে দিন কাটাচ্ছে ক্ষমতার জন্য। তারা কিভাবে দেশপ্রেমের মর্যাদা দেবে এবং কিভাবে জবান বন্ধ করবে ঘৃণিত সেই ধর্মের নামে রাজনৈতিক তথাকথিত ইসলামী দলের। ’৭১-এ এদের চরিত্র আর কার্যক্রম আজ কার কাছে অজানা নয়। ওইসব নরপশুদের বিচার করা হয়নি। বরং ওইসব নরপশুদের নাগরিকত্বসহ রাজনীতি করার অধিকারও ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। আজ তারা নিজেদেরকে নিরাপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছে। তাদের কথা, অপরাধই যদি আমরা করে থাকি তাহলে আমরা পুনঃরাজনীতির সুযোগ পাই কি করে এবং নাগরিকত্বই বা ফিরে পাই কি করে? এসব শুনে নতুন প্রজন্মরা হতবাক। সচেতন দেশপ্রেমিকগণ দিশেহারা। মুক্তিযোদ্ধারা লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। প্রশ্ন হলো আইনের ফাঁক গলিয়ে নাগরিকত্ব পেলেই কি এরা নিরাপরাধ এটা প্রমাণিত হয়ে যাবে? মানবিক আইন বা প্রত্যক্ষদর্শিতার কোনো মূল্য নেই!
সচেতন পাঠক ও নতুন প্রজন্ম ১৯৭১ সনের তৎকালীন পত্রিকার পাতাগুলোতে একটু চোখ বুলালেই দেখতে পাবেন আজকের নাগরিকত্ব ও রাজনৈতিক অধিকার ফেরত পাওয়া ওইসব দু-পেয়ে জন্তুর আসল চেহারা। সংরক্ষণশালাগুলোতে সংরক্ষিত এসব প্রামাণিক দলিল আজকে মুক্তিকামী নতুন প্রজন্মের জন্যই মারণাস্ত্র হাতিয়ার।
নাগরিকত্ব, রাজনৈতিক অধিকার আইনের মাধ্যমে ফিরে পেলেও এরা ভীরু কাপুরুষ। পিছন থেকে ছুরি চালিয়ে অন্ধকারে খুন করে। সামনাসামনি আসতে সাহস পায় না। সচেতনরা কোনোভাবেই এদের দল বা এদের সহযোগিতা করতে পারেন না। ’৭১ এর স্বাধীনতা বিরোধী তথাকথিত ধর্মীয় দলগুলোর নেতারা দেশ স্বাধীন হবার পর একবার জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতো বা বলতো আমরা ভুল করেছি, আমরা জাতির নিকট ক্ষমাপ্রার্থী এবং আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমাপ্রার্থী অথবা আজও যখন তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে মিশে সমাবেশে বক্তব্য রাখছে এবং সেই সব সমাবেশে ’৭১ এর ভূমিকার জন্য লজ্জিত হয়ে হাতজোড় করে জাতির নিকট নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতো তাহলে হয়তো জাতি আজ তাদের নিয়ে অন্যরকম চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ পেতো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে আজও পর্যন্ত এদের নিকট থেকে জাতির কাছে এমন কোনো আহ্বান আসেনি। নির্লজ্জের মতো এই দেশের পতাকা উড়িয়ে গাড়ি চড়েছে। এরা যে ইসলাম পালন করে তার স্বরূপই এটা যা মুহম্মদী ইসলামের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
আজও ’৭১ এর ন্যায় তারা ষড়যন্ত্রীর ভূমিকাই পালন করছে। প্রশ্নঃ কেন এদেরকে সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে উৎখাত করা হচ্ছে না? কেন প্রয়োজনে আর একটি একাত্তরের পুনরুত্থান হচ্ছে না? কতটুকু স্পর্ধা থাকলে আজ তারা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর উপর কটাক্ষ করে বক্তব্য রাখতে পারে। এই স্পর্ধার ভিত্তি কোথায়? চিন্তাবিদ মহলের একটাই ধারণা তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ক্ষমতার লোভ’ তাদেরকে জিইয়ে রাখছে। একমাত্র ক্ষমতা লোভের কারণেই স্বাধীনতার শত্রু ও প্রথম শ্রেণীর রাজাকাররা ক্ষমতাকে সংহত করেছে। পরবর্তীতে এসব রাজাকারদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন এবং বর্তমান চলমান অবস্থায় এদেরকে নিয়ে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করার পরিকল্পনা জাতিকে রাজনীতিকদের উপর বিতশ্রদ্ধ করে তুলছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পাশাপাশি সহাবস্থান করছে রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য, বাংলাদেশকে তথাকথিত রাজনৈতিক ইসলামের আওতায় আনার জন্য এবং তাদের কসাই চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলার মাটিতে, তারা ছলে-বলে-কৌশলে সার্বিক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সুদীর্ঘ পরিকল্পনার নীল নক্সা যে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে তা ক্ষমতালোভী অন্য রাজনীতিকরা ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে থাকার কারণে দেখার সুযোগ পাচ্ছে না। নতুন প্রজন্মের কাছে  নিরীহ ধর্মভীরু জাতি একটাই আবেদন করছে সাময়িক ভোগ, ব্যক্তি স্বার্থ ও সম্পদ বৃদ্ধি করার জন্য বর্তমানে সময় ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সংস্কারহীন সমাজ ব্যবস্থায় ও রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামোর মধ্য দিয়ে রাজনীতিকরা দেশটাকে যে জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে সেখানে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে হবে যাতে অগ্রসরমান নতুন প্রজন্ম একশ’ বছর পিছিয়ে পড়তে না পারে। দেশবাসীর কাছে আহ্বান, স্বাধীন সার্বভৌমত্বের জন্য যে দেশপ্রেমিকরা খুনীদের হাতে বুকের তাজা রক্ত এ মাটিতে ঢেলে দিয়েছে সেই খুনী গোষ্ঠীর সাথে সামিল হবেন না।

বাংলা এবং বাঙালির স্বপ্ন


বাংলা এবং বাঙালির স্বপ্ন
সংলাপ ॥ পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতো বাঙালি একটি জাতি। রয়েছে পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস। সে ইতিহাস নিখুঁতভাবে আমরা আজও গবেষণা করে বের করতে পারিনি। তা সত্ত্বেও যে ইতিহাস আমরা পেয়েছি তাতে করে এই জাতির ভাষা, নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এবং ভৌগলিক অবস্থান অনেক গৌরবময়। বহু জাতির সংমিশ্রণের ফলে বাঙালি জাতি একটি শংকর জাতিতে পরিণত হয়েছে যুগ এবং শতাব্দির ধাপে ধাপে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অনেক জাতির সংমিশ্রণ হলেও এই জাতি নিজেদের বাঙালি অস্তিত্বকে বিলুপ্ত হতে দেয়নি। স্বাধীনতা ও পরাধীনতার অনেক উত্থান পতনের মধ্যে কোনো অর্থনৈতিক মুক্তিও আসেনি।
বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসামের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তথা মেঘালয়, উত্তরবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ সহ বাঙালির ভৌগলিক পরিচয় নিয়ে এই জাতির আদিকাল থেকেই বসবাস। যে সমস্ত বাঙালি বিজ্ঞ রাজনীতিকরা বৃটিশ আমলে একটি স্বাধীন বৃহৎ বাংলা গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা বৃটিশ এবং তৎকালীন দিল্লী কেন্দ্রিক রাজনীতিকদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করতে পারেননি। এটা বাঙালির সবচেয়ে বড়  দৈনতা। তা না হলে এতদিনে হয়তো বাঙালিরা বিশ্বের বুকে তাদের শিক্ষা দীক্ষা ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অনেক দূর এগিয়ে যেত। ভারতস্থ আজকের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, উত্তরবঙ্গ, মেঘালয় রাজ্যসমূহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। মাথাপিছু আয় কিংবা বাংলা ভাষাভাষী এলাকার জাতীয় গড় আয়ের হিসাব কষলে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তা মোটেই সুখকর নয়। দারিদ্র্যের চরম কষাঘাত শতকরা ৭০টি পরিবারে। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সকল সরকার যেভাবে মাথাপিছু আয়, জাতীয় উৎপাদন কিংবা অন্যান্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হিসাব কিংবা পরিসংখ্যানাদি নথিভূক্ত করে তা লোক ভুলানো ব্যাপার। এ হিসাব রাষ্ট্রীয় আত্মরক্ষার হিসাব। যে কোনো রাজ্যের কিংবা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বাজেট ঘাটতি, কর্পোরেশন ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহ যখন প্রতিনিয়ত লোকসানের দায়ে মুখ থুবড়ে পড়ে তখন একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে সক্ষম হয় দেশের অর্থনীতি কোন পর্যায়ে আছে।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, চাকুরির সংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং যে কোনো শ্রমের মূল্যায়ণ থেকে অতি সহজেই অনুমান করা যায় একটি জাতির দারিদ্র্যতার মাপ কতটুকু। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপরে উল্লিখিত বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল সমূহের যে বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় তা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় বাঙালি জাতি যে অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো সেই অন্ধকারে আজও নিমজ্জিত। সব অঞ্চল সমূহের বাঙালিরা স্বদেশী বেনিয়াদের শোষণে জর্জরিত এবং পণ্যের ক্রেতা হিসেবে তারা লুটেরা ও কালোবাজারীদের পুঁজির যোগানদাতা। শুধু তাই নয়, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চরমভাবে বিকৃত ইংলিশ ও বিদেশী সংস্কৃতির উগ্র থাবায়। কিছু সংখ্যক ধনী লোক কিংবা উন্নত পেশাজীবীদের উন্নয়ন, একটি জাতির উন্নয়নের কোনো মাপকাঠি নয়। ঝলমলে বিপনী বিতান, পাশ্চাত্যের অনুকরণে লেফাফা দুরস্ত টেলিভিশন প্রোগ্রাম আর  নাটকে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে অভিজাতদের ঘর-দুয়ার এবং বিলাসবহুল আসবাবপত্র সমূহ বারবার দেখানো উন্নয়নের কোনো পরিচয় নয়।
আজ বিশ্বের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কাঁচামাল থেকে তৈরি পণ্যদ্রব্য, বৈদ্যুতিক, ইলেক্ট্রনিক, ডিজিটাল কিংবা কুটির শিল্পের উন্নত পণ্য সামগ্রী, হাল্কা কিংবা ভারী যন্ত্র ও যান্ত্রিক শিল্পদ্রব্য কিছুই বাঙালি জাতির আয়ত্বাধীন নয়। কৃষি, সরকারী চাকুরী ও দৈহিক পরিশ্রম ব্যতীত বাঙালির কোনো জাতীয় পুঁজি নেই। একটি মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাবার কোনো উপকরণ কিংবা পুঁজি কিছুই বাঙালির আয়ত্বে নেই। খাদ্য এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যে জাতি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না সে জাতি যতই বিত্ত-বৈভবের বড়াই করুক না কেন তার সে বড়াই ঠুনকো এবং বালির বাঁধের মতো তুচ্ছ। আমরা অতি নিকটবর্তী ইতিহাস আওড়ালে স্পষ্টই দেখতে পাবো ভারত রাষ্ট্র ভারতস্থ বাঙালি অঞ্চলসমূহকে বাজার কলোনী হিসেবেই দেখছে।
সুজলা সুফলা নদ-নদী প্রবাহিত বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল সমূহের উজানে কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণের কারণে বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সাথে জড়িত যে কৃষি ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থা এখন দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে ভগ্নস্তুপের মতো। অদূর ভবিষ্যতে রাজনৈতিক গোলযোগ ও দারিদ্র্যতার মধ্য দিয়ে যাতে বাঙালির অস্তিত্বের বিলুপ্তি হয়ে যায় এটা তার একটা সুদূরপ্রসারী নীল নক্সা বলে চিন্তাবিদরা মনে করছেন। প্রতিটি নদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে বহু উপনদী সমূহের। সেই উপনদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে ছোট বড় অনেক ধরনের খাল এবং নালার। এভাবেই জালের মতো দেশের আনাচে কানাচে বিস্তৃতি লাভ করেছে বাঙালির কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার এক প্রাকৃতিক পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিকে তছনছ করে দিচ্ছে রাজনীতির জঘন্য কারসাজি। বিদ্যুৎ উৎপাদন আর সেচ ব্যবস্থার অজুহাতে আধিপত্যবাদীরা যেভাবে একের পর এক আগ্রাসনী ভূমিকা নিচ্ছে তাতে সহজেই অনুমেয় দেশের ভবিষ্যত কোন পথে।
গণতন্ত্রের দাবিদার ভারতের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা টেনে আনলে দেখা যাবে ভারতে গণতন্ত্রের ভিতরে ওত পেতে বসে আছে একদল শক্তিশালী পুঁজিপতি, বুদ্ধিদাতা আমলা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী। তাদের বাহ্যিক বেশভূষা অতি সাধারণ। তারাই ভারত সরকারের গণতন্ত্রের হর্তাকর্তা। তারা কোটি কোটি ভারতীয় নাগরিকের শিক্ষা, চিকিৎসা ও চরম দারিদ্র্যতাকে উপেক্ষা করে সুপার পাওয়ার হওয়ার কামনায় দিনরাত রঙিন স্বপ্ন দেখছে। ভারতে দু’এক জাতির বসবাস নয়। ডজন ডজন জাতির বসবাস। নদীতে বাঁধ মানেই বাঙালি জাতির মুন্ডুপাত, একটি নীরব সর্বনাশী আগ্রাসন। বাঙালির জীবনে নদী নেই, পানি নেই এটা বিশ্বাস করতে চরম কষ্ট হয়। হাজার হাজার বৎসরের ইতিহাসকে ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলেও বাঙালি জীবনের সাথে নদীর সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। এটা একটা প্রাকৃতিক বন্ধন। পলিবাহিত খরস্রোতা নদী দু’কূল ভেঙ্গে নিয়ে মানুষের জীবনকে বার বার নতুন সাজে সাজালেও বাঙালিরা এই নদীকে ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। এক অবিশ্বাস্য মায়ার বন্ধনে এই নদনদী সকলের নাড়ির সাথে মিশে আছে। সুতরাং নদীকে সচল ও উজ্জ্বীবিত রাখার দায়-দায়িত্ব সমস্ত বাঙালি জাতির। নদী-বিহীন বাঙালি জীবন মানেই হচ্ছে বাঙালির অস্তিত্বের সংকট। ফারাক্কা বাঁধের নির্মমতায় বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা সকলের জানা। আগামীতে টিপাইমুখ সহ বিভিন্ন নদীর পানি ও বাঁধ নিয়ে ভারতের যে আগ্রাসনী মনোভাব রয়েছে তাতে করে বাঙালি জাতি চিরতরে খাদ্য এবং অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রায় তিন শতাধিক  উল্লেখযোগ্য নদী ও উপনদীর অস্তিত্ব শেষ হতে চলেছে। বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো শুধু তাদের চিহ্ন বুকে ধারণ করে বেঁচে আছে।
প্রায় চার যুগ ধরে নদীর তীরে তীরে ভারত বিভিন্ন কর্পোরেশনকে লাইসেন্স দিয়েছে কেমিক্যাল জাতীয় কারখানা তৈরির। সেই কারখানাসমূহ থেকে বিষাক্ত বর্জ্য ও তরল পদার্থ নদীর পানিতে মিশে গিয়ে এক চরম দুর্গতির সৃষ্টি হয়েছে বাঙালির জীবনে। নদীর পানি এখন আর সুপেয় নয়। নদীর মাছে আজ স্বাদ নেই, নেই মাছের বংশবিস্তারের কোনো সুযোগ। সেই নদীর পানি যেসকল তৃণ শস্যাদি শুষে নেয় তাতেও রয়েছে কেমিক্যালের প্রভাব। এভাবে এক নীরব নিঃশব্দ এবং লক্ষণহীন ক্ষয়রোগের শিকারে পরিণত হয়েছে বাঙালির জীবন এবং তার কৃষি। অপরদিকে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত কীটনাশক ঔষধ এবং সারসমূহ অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের ফলে তা মাটিতে মিশে গিয়ে বৃষ্টি জলের সাথে ভূগর্ভের নিচে চলে যাওয়াতে ভূগর্ভের পানি দূষিত হচ্ছে। ভূগর্ভের নিচে, মাটির স্তরে স্তরে ভেজা ভেজা নমুনায় আটকে থাকে যে পানি সেই পানির যোগানদার হচ্ছে নদীর প্রবাহ, আদ্র জলবায়ু এব বৃষ্টি। একটি এলাকায় যখন নদী, উপনদী, খাল, নালা ইত্যাদিতে জলের ধারণ ক্ষমতা কিংবা জলের প্রবাহ কমে যায় তখন ভূগর্ভের পানিও কমে যেতে বাধ্য। এমতাবস্থায় সহজেই পানির স্তরে ঘাটতি শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে পানি আরো অধিক নিচে নেমে যায়।
ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৪৬ মিটার নিচে নেমে গেছে। এটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার যে পানি নিচে নেমে যাবার প্রাক্কালে মাটির  স্তরের বিভিন্ন কেমিক্যাল জাতীয় পদার্থ দ্রবীভূত হয়ে তা পানির সাথে থিতিয়ে পড়ে। সেই ভূগর্ভের পানি চাপকলের সাহায্যে উপরে উঠিয়ে পান করা হচ্ছে এবং দৈনন্দিন জীবনে এর বহুল ব্যবহারও হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতি আজ আর্সেনিক নামে এক ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত। ভারতের নদীতে বাঁধ দিয়ে জলের প্রাকৃতিক গতিকে রোধ করার কারণে বাংলাদেশকে বহু অদৃশ্য দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিভিন্ন নদীর উৎসমুখে ভারত সরকার বিবেকহীন ভাবে যে সমস্ত বাঁধ দিয়ে চলেছে তা বাঙালি জাতিকে গলাটিপে হত্যা করার মতোই এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। নদীর স্রোতের প্রবাহ ঠিক না থাকার কারণে নদীর তলদেশে পলিমাটি জমে তা ভরাট হয়ে গেছে। এজন্য বর্ষা মৌসুমে এই পানি দ্রুত সাগরে পতিত হতে পারে না। যার ফলে প্রতি বৎসর বাংলাদেশ সহ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে। নদীর পানিতে লবণ নেই, তাই সাগরের নোনা জল নদীর জলের স্থান দখল করে নিচ্ছে যার ফলশ্রুতিতে সুন্দরবন সহ উপকূলীয় এলাকায় গাছপালা, মাছ এবং পশুপাখীদের জীবন আজ অকাল-মৃত্যুর দাপটে বিলীন। এভাবে চারিদিকে বাঙালি জাতির জন্য সৃষ্টি হয়েছে এক চরম বিপর্যয়। সময়ের ধাপে ধাপে মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে, অভাব অনটনে বাঙালিরা বিপর্যস্ত। অদূর ভবিষ্যতে যারা বেঁচে থাকবে তারা হবে মেধাহীন, শিক্ষাহীন, পঙ্গু, অলস, দুর্বল, জ্বরাজীর্ণ, শীর্ণ কায়া এবং বিশ্বের কাছে অবহেলিত ও চির লাঞ্ছিত। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক জ্ঞানী গুণী খ্যাতিমান দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে। সমাজ এবং বিশ্ব তাদের দ্বারা অনেক উপকৃত হয়েছে সন্দেহ নেই। জ্ঞান, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতায় এই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মতো আজও কেউ কোনো বাস্তবসম্মত ফর্মূলা আবিষ্কার করতে পারেনি। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনশক্তি থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা আজ শুধুই অবহেলিত শ্রমিক। রাজনৈতিক ভাবে বাঙালিরা সরকারের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে মুক্তির জন্য। অভাবের তাড়নায় কে কত সহ্য করতে পারে এই যেন তাদের প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশের বাঙালিরা কিছু সংখ্যক ধর্ম ব্যবসায়ী, অস্ত্র ব্যবসায়ী, চোরা কারবারী, খুনী লুটেরা ও তাদেরকে সহায়তা দানকারী সৈন্য ও পুলিশ বাহিনীর কাছে জিম্মি এবং চরমভাবে পর্যুদস্ত। অভাবের তাড়নায় কে কত বড় মিথ্যুক, ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসী হতে পারে এরই চলছে প্রতিযোগিতা। ঠান্ডা এবং স্থির মস্তিষ্কে চলছে মেধার নিধন।  চলছে অবাধ সম্পদ পাচার এবং নিজ সন্তানদের নিরাপদ স্থান হিসেবে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হিড়িক। আজকে সারা বিশ্বে বাঙালি জাতির পরিচয় খরা এবং দুর্ভিক্ষ পীড়িত একটি জাতি হিসাবে। খুনী, লুটেরা এবং দুর্নীতিতে বারবার অভিশপ্ত বাংলাদেশ প্রবল জনসংখ্যার চাপ, ভবিষ্যতে পানিবিহীন শহর হওয়ার আশঙ্কা এবং বস্তি, আর্সেনিকের দাপট, খরা ও বন্যার ছোবল, বনজ সম্পদ উজাড় এবং অগণিত মানুষের সৃষ্ট আবর্জনায় জর্জরিত। ন্যায়বিচার বঞ্চিত সমাজ, দুর্নীতি এবং অনিয়মের বেড়ি পরা বাঙালি জাতিকে কে বাঁচাবে? কে রক্ষা করবে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব?
জাতিকে ভাবতে হবে সে কোন জাতি? তার ভাষা ও অতীত ইতিহাস কি? তার ভৌগলিক সীমারেখা কতটুকু? আজ বাঙালি জাতিকে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলার ইস্পাত কঠিন শপথ নিতে হবে বর্তমান সরকারকে। ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালির মধ্যে সবসময় একটা হানাহানি ও শত্রুতা যাতে লেগে থাকে। বাংলাদেশের বাজারে মাঝে মধ্যে ছাড়া হয় নকল টাকার নোট।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ভারতের কাছে যতটুকু ঋণী তারচেয়ে শতগুণে বেশি ঋণী আমাদের প্রতিবেশী বাঙালিদের কাছে। বাঙালি হিসেবে আমরা বাঙালির কাছে আশ্রয় পেয়েছি। সেদিন প্রশ্ন ছিলো না আমরা মুসলমান না হিন্দু। আমরা সে সময় অনুভব করেছি বৃটিশপূর্ব বাঙালি। আমরা ছিলাম এক মাতৃভূমির সনৱান, এক ভাষার সন্তান। বৃটিশ আমাদের বিভক্ত করে দিয়ে গেছে বাঙালি জাতিকে চিরকাল দুর্বল ও পঙ্গু করে রাখার উদ্দেশ্যে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় সত্তর লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে প্রতিবেশী বাঙালি। অস্ত্র, খাদ্য, ট্রেনিং তাদেরই বদৌলতে হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য ভারতের হাত দিয়ে এসেছে। বাঙালির জন্য বাঙালির দরদ ছিলো, স্নেহ এবং সহানুভূতি ছিলো, যার ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সুযোগ হয়েছিলো তাড়াতাড়ি। কিন্তু আজ বাঙালির সেই জাতীয়তাবোধ ও মমত্ববোধ কোথায় গেলো? আজ এই সত্য হারিয়ে গেছে কুচক্রী বাংলাদেশ ও ভারতের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে। তারা ধর্মের নামে রাজনীতির মুখোশ পরে বাঙালি জাতিকে চিরতরে পঙ্গু ও নিঃস্ব করার পায়তারা করছে। বাঙালিদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলমান এই দুই জাতির ধর্মীয় পার্থক্য দেখিয়ে সবসময় নানাবিধ অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা চায় না বাঙালিরা একতাবদ্ধ হোক। অপপ্রচারকারীরা তলে তলে ভারতের সাথে অবাধ গুপ্ত বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় ব্যবসা ছাড়াও চাল ডাল থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি কাপড় চিনি ইত্যাদির ব্যবসা গোপনে করে যাচ্ছে আর বাংলাদেশের তৈরি পণ্যদ্রব্য অবিক্রিত অবস্থায় নষ্ট হচ্ছে। বাঙালি বিরোধী ধর্মীয় মুখোশ পরা দ্বিচারীরা ভারতের গরু দিয়ে ঈদের উৎসব পালন করে আর হোটেল রেষ্টুরেন্টে গোমাংশের চালান দেয়। এভাবেই জনগণকে ধোঁকা দিয়ে রাজনীতি করে তথাকথিত ইসলামপন্থীরা।
দেশবাসী চায় নতুন যুবশক্তি আর দীর্ঘদিন থেকে যারা সততা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা দেখেছে তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করে যারা স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে তারা তাদের এলাকায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে কিছুটা উন্নয়ন ঘটায় তবে সেই এলাকার জনগণ সেই লোকটিকে অবশ্যই বারবার ভোট দেবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। সে টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসী লালন করছে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বোমাবাজ ও সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিচ্ছে। এখন সম্পদ এবং ক্ষমতা - দুটোই সকল অপরাধের জন্য দায়ী। জনগণ শুধু চেয়ে চেয়ে এসব দেখছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিকার ও প্রতিবাদ করার কোনো বিশ্বস্ত রাজনৈতিক দল নেই। নেই আত্মরক্ষার কোনো হাতিয়ার। পুলিশ এসবের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী পর্দার অন্তরালে  লুটপাট সম্পদের ভাগীদার হচ্ছে। বখরা এবং চাঁদা আদায়ের জন্য প্রকাশ্য এবং নেপথ্য উভয় রাসৱাই তারা অনুসরণ করছে বলে জনগণের মধ্যে অবিশ্বাসের দানা বেঁধে উঠছে। আজকের বাঙালি জাতিকে বাঁচতে হলে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সত্য সুন্দর সমৃদ্ধশালী দেশ উপহার দিতে হলে জাতির ঐক্য এবং নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসা ছাড়া কোনো বিকল্প রাজনীতি নেই। বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবং বহুমুখী শোষণের নাগপাশ থেকে বাঁচতে হলে বাঙালিকে অবশ্যই বিভিন্ন অঙ্গনে সংস্কার এবং কৌশলগত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
বাঙালি জাতিকে সঠিকভাবে কিছু করতে হলে ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বকে ভুলতে হবে। ভুলতে হবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে। অগ্রসর হতে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে। কোন দলকে রাজনীতির নেতৃত্বে যাবার আগে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও পরিকল্পনাকে একটি দায়বদ্ধতার কাঠামোতে আনতে হবে। থাকতে হবে একটি দিক নির্দেশনা ও লক্ষ্য পূরণের পূর্ণাঙ্গ ও প্রকাশ্য দলিল এবং দৃঢ় প্রত্যয় সত্যের পথে পথচলার জন্য। অতএব দেশকে  উত্তরণের জন্য দ্রুত পথ চলতে (১) বাঙালি জাতীয়তা (২) মানবতা (৩) নিজ নিজ ধর্মীয় স্বাধীনতা (৪) গডফাদারহীন গণতন্ত্র এবং (৫) প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণকে রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে সর্বাগ্রে।