বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫

আধিপত্যবাদী হাতিয়ার যুগে যুগে পাল্টাচ্ছে !

আধিপত্যবাদীহাতিয়ার
যুগে যুগে পাল্টাচ্ছে !

সংলাপ ॥ প্রচারমাধ্যমে আধিপত্যবাদী কলাকৌশল যে অনেক ফলপ্রসূ সেটি স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে লজ্জার ও দোষের কিছু নেই বরং চিন্তাবিদদের জন্য সেখান থেকে সত্যটা অন্বেষণ করা সহজ হয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুঁজিবাদী  মিথ্যাচার ও শোষণের ধরন যেমন পাল্টে পাল্টে অব্যাহত থেকেছে, ঠিক তেমনিভাবে পুঁজিবাদী প্রচার পদ্ধতিও পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়ে আধিপত্যবাদী প্রচার এসেছে। যদিও এই প্রচারের উদ্দেশ্য একই থেকেছে এবং আছে। একবিংশ শতকের প্রচারের পদ্ধতিটা তো আর পুরনো দিনের মতো হতে পারে না। উদ্দেশ্যর সহজ কথাটা লুকিয়ে রেখে বলার কথাটি জটিল করে উপস্থাপিত না করলে আজকের পোস্ট মডার্ন যুগের মানুষের কাছে আধিপত্যবাদী মিথ্যা প্রচারের আকর্ষণ যে থাকবে না সে কথা আজকের বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ ভাল করেই জানে। অনেক শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে পুঁজিবাদী প্রচারের এই ক্রমপরিবর্তনের ধারাটিকে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু তাতে পাঠকেরধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কা থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘মিথ্যে কথা গুছিয়ে বলাটাই’ ছিল আধিপত্যবাদী প্রচারের মূল কায়দা যার ছোঁয়ায় বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল অসুস্থ।বিংশ শতকের প্রথমার্ধের পুঁজিবাদী প্রচার পদ্ধতির প্রধান পুরোহিত ছিল গোয়েবলস। তার বক্তব্য ছিল, মিথ্যে কথা শুধু গুছিয়ে বললেই হবে না, সেটি বারে বারে বলতে হবে - বলে যেতেই হবে - বলে যেতেই হবে। গোয়েবলস এর কথা লোকে কেন যে এত বলে কে জানে! আমাদের রাজনৈতিক কথামালায় জনগণের নামে মিথ্যাকে সত্য বলে তুলে ধরার (যেমন ভারত বিদ্বেষ) বানানোর গল্পগুলো এমন কিছু খারাপ নয়। ক্রমাগত অসত্য কথা বলার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেন যে বস্তাপঁচা গোয়েবলসীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে! জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা অথচ একেবারে আবে জমজমের পানিতে ধোয়া সত্য কথার মতো শোনাবে এখন আরও কত নতুন টেকনিক বেরিয়েছে। সেগুলো এখনও জেনে নিতে না পারার দায়টা অবশ্যই আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের খামতি ও বর্তমান ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যেতেই পারে।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রচারের বিষয়টি কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিশেষজ্ঞদের হাতে চলে যায়।এই বিশেষজ্ঞদের মতে প্রচারের বিষয়টি, ওপর থেকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দিলে আর চলবে না। তাদের মতে মিথ্যা প্রচারের বিষয়টি গণ মানুষকে জড়িয়ে নিয়ে মানুষের ভেতর থেকে তুলে আনতে হবে। তাই আর প্রোপাগান্ডা বা পাবলিসিটি নয়, যা করতে হবে তার নাম মার্কেটিং। পণ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন ধ্যানধারণারও মার্কেটিং। এ সম্পর্কে হাজার কাহিনী কাছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক জুতোর কোম্পানি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ব্যাপক প্রচারও চালিয়েও যখন জুতোর ব্যবসা বাড়াতে পারছিল না তখন তারা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে একজন মার্কেটিং ম্যানেজার পাঠাল। দায়িত্ব নিয়েই মার্কেটিং ম্যানেজার প্রথমে জুতোর যত অ্যাডভার্টাইজমেন্ট আর পাবলিসিটি  মেটিরিয়াল ছিল সব বাজার থেকে তুলে নিল। তার তরফ থেকে  নির্দেশ দেয়া হল কোম্পানির জুতোর প্রচারে আর একটিও কথা নয়। পরিবর্তে তৃতীয় বিশ্বের অস্বাস্থ্যকর দেশগুলিতে মানুষের কেন সব সময় জুতো পরে থাকা উচিত, জুতো না পরলে স্বাস্থ্যের, সৌন্দর্যের কি কি  হানি হতে পারে ইত্যাদি নিয়ে সেমিনার, গ্রুপ মিটিং, ছোট-বড় জনসভা শুরু করে দিল। এর কিছুদিনের মধ্যে উক্ত কোম্পানির জুতো বিক্রির বহর আকাশছোঁয়া হয়ে গেল। তা এই হল গণমানুষকে জড়িয়ে নিয়ে মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা মিথ্যা প্রচারের মাহাত্ম্য। বাংলাদেশে সার্বিক দুর্দশা ও দুর্গতি নিরসনের ও সর্ববিধ উন্নতির জন্য ‘পরিবর্তনের’ বর্তমান ধারাটি ভারতমুখী বলে বিরোধী দলের পন্ডিত তথা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের এবং রাজনীতিকদের একটি বিশেষ ‘ধারণা’-র মার্কেটিং। এর জন্য বিভিন্ন চ্যানেলে টকশো, সেমিনার আর বহুল প্রচারিত পত্রপত্রিকার লেখালেখি কম হচ্ছে না। যাই হোক, এই প্রচার পদ্ধতিগুলোও পুরনো হয়ে যাচ্ছে বা গেছেই বলা যায়।সাধারণ মানুষ এখন এই ধরনের প্রচারে ক্লান্ত বোধ করে, বিরক্ত হয়। একবিংশ শতকে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের প্রচারে তাই নতুন পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটেছে। বহুবিধ উপাদানের মিশ্রণে প্রচারের বিষয়বস্থটিতৈরি। তবে এটি কখনও সম্পূর্ণভাবে একসঙ্গে লিখিত-পড়িত আকারে কোথাও পাওয়া যাবে না। এর বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করলেই শরীরে-মনে কেমন যেন শিহরন জাগে! প্রচারের বিষয়টির মধ্যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের সওয়াল আছে, সমাজের সকলের উন্নয়নের দাবি আছে, সামাজিক অচলায়তন ভেঙে ফেলার কথা আছে,দৈনন্দিন জীবনের চলে আসা রীতিনীতি, অনুশাসন অগ্রাহ্য করার পরামর্শ আছে, আছে ব্যাপক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, এমনকি মানব মুক্তির কথাও। ‘না পড়লে, না দেখলে পিছিয়ে পড়তে হয়’ এমন সব প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে এই বিষয়গুলি থেকে থেকে, কিছুদিন বাদে বাদে উপস্থাপিত করা হয়। ব্যাপক সাধারণ মানুষকে কখনও জানানো হয় যে ইচ্ছে করলেই প্রতিটি মানুষ এখন পৃথিবীর যাবতীয় খোঁজখবর জ্ঞানগম্যি উন্নততর নানাধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে জোগাড় করে সমৃদ্ধ হতে পারে, পরিচয়ের পরিধি বাড়িয়ে অন্য মানুষদের সঙ্গে, বিভিন্ন চিন্তাভাবনার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে এবং এইভাবে হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব নাগরিক (এই কথাগুলো নিয়ে অবশ্য দ্বিমতের কোনও সুযোগ নেই)। আবার একইভাবে অন্য কোনও সময় বলা হয় যে পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য প্রত্যেককে তার পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত এবং সর্বোপরি শ্রেণীগত পরিচয় গ্রাহ্য করে নিরপেক্ষএকক মানুষ হিসাবে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। একমাত্র তা হলেই রাজনীতির কলুষমুক্ত দলহীন গণতন্ত্রের নাগরিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। একইভাবে গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে আবার কখনও কোথাও ব্যবস্থাপত্র দেয়া হচ্ছে যে, কি কি খাবার খেলে, কি ধরনের পরিধেয় পরলে, কি প্রসাধনী মাখলে, কিভাবে ঘরবাড়ি সাজালে, কি ভাবে চুল-দাড়ি কাটলে, কি ধরনের গাড়িতে চড়লে নিজের আলাদা পরিচিতি ও ব্যক্তিত্ব মুসলমানের মতো প্রকাশ পাবে। কখনও জানানো হয় যে মূল্যবোধ দিয়ে কিছু হয় না।
জীবনে সবই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার বিনিময়মূল্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। কখনও ফিসফিসিয়ে শোনানো হয় ব্যক্তি জীবনে নরনারীর কামনা-বাসনা যেহেতু ক্ষুধাতৃষ্ণার মতোই স্বাভাবিক সেই হেতু তাকে সারা জীবনের জন্য পবিত্রতার পূর্বশর্তে জড়িয়ে ফেলার প্রবণতা। এমন আরও অনেক বক্তব্য, উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায়। কিন' তার প্রয়োজন নেই। এখন মানুষের মস্তিষ্ক  বিভিন্ন সূত্র থেকে আহৃত, সাদৃশ্য আছে এমন বা অনুরূপ, তথ্য নিজের মতো করে সংশ্লেষ ঘটিয়ে একটা চেতনার জন্ম দেয়। আহৃত উপাদানগুলো যেখানে যে রকম, সংশ্লেষিত চেতনা সেখানে সে রকম হতে পারে সেটি সহজেই অনুমেয়। এমন চেতনায়সমৃদ্ধ হয়ে মানুষ হয়ে ওঠে নিরালম্ব, অসংবেদনশীল, উগ্র, স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর। বিশ্বায়িত আধিপত্যবাদ মুনাফা এবং একমাত্র মুনাফার স্বার্থে ঠিক এটাই চায়। একবিংশ শতকের আধিপত্যবাদী মিথ্যা প্রচার এই লক্ষ্য নিয়েই ঘোরাফেরা করে চলেছে বিশ্বজুড়ে।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত গণমাধ্যম বলতে বোঝাত সংবাদপত্র ও বিভিন্ন গোত্রের পত্রপত্রিকা (তখনও টেলিভিশন ও আনুষঙ্গিক প্রযুক্তির এত প্রসার ঘটেনি)। সে সময় পর্যন্ত বড় বড় সংবাদপত্র (ফোর্থ স্টেট হিসাবে) সাধারণ মানুষের কাছে সম্ভ্রম আদায় করতে সক্ষম হত। তখনও পর্যন্ত অনুসন্ধানী, সাংবাদিকতা, সংবাদভাষ্য ইত্যাদির আলাদা একটা মর্যাদা ছিল - সেগুলিকে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির সহায়ক বলে মনে করা হত। তার পরে হঠাৎ করেই সবকিছু পাল্টে গেল। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে বিশ্বব্যাপী  লগ্নিপুঁজির দৌরাত্ম্য শুরু হল। আর পাঁচটা দেশের মতো আমাদের দেশের বেশিরভাগ বড় বড় সংবাদপত্র ও আনুষঙ্গিক পত্রপত্রিকা স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে নির্দিষ্ট লগ্নিপুঁজির স্বার্থরক্ষায় মিথ্যাচারে নিজেদের নিয়োজিত করে ফেলল। এতদিন পর্যন্ত যেগুলি ছিল প্রচারের মাধ্যম, এ বারে সেগুলিই বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর মুখপত্রের ভূমিকায় আসরে অবতীর্ণ হল। প্রচার মাধ্যমের আদর্শ ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে শুরু হল মাধ্যমের প্রচার - কিছু পরে ইলেকট্রনিক মিডিয়া  তার সঙ্গে যুক্ত হল। সেই প্রচারের তীব্রতা ও ব্যাপকতা আজ এমনি যে বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র ও চ্যানেল কোন কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচার চালাচ্ছে সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। প্রচারিত বক্তব্যের ক্ষেত্রে সত্য, অর্ধসত্য ও মিথ্যা সংবাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বিপদের কথা হল এই যে, আধিপত্যবাদী প্রচার পদ্ধতি এই কাজ করতে গিয়ে গণ-মানুষের বিশ্বাস করার স্বাভাবিক প্রবণতাটি নষ্ট করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। মানুষ আজ কী বিশ্বাস করবে আর কোনটা করবে না  তার ভিত্তিটাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। বিচার বিবেচনার জন্য ব্যাপক মানুষকে কিছু জানানোর প্রক্রিয়াটিকেই অবাস্তব করে তুলেছে। প্রচার পদ্ধতি আজ শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের সমর্থনে সহমত গড়ে তোলার একটি আধিপত্যবাদী হাতিয়ার মাত্র।

ব্যাপক সাধারণ মানুষের কাছে বর্তমান সরকারের সার্বিক বক্তব্য আজকের প্রেক্ষিতে নিয়ে যাওয়া  কতখানি দুরূহ করে তুলেছে বিরোধীদলগুলো সেটা দেখানোর উদ্দেশ্যেই প্রচার পদ্ধতির এই আলোচনা। বর্তমান সরকারের তরফে অবশ্য পাল্টা প্রচারের এই কাজটি সুসম্পন্ন করার  কোনও গত্যন্তর নেই বলে দূরদর্শী চিন্তাবিদদের অভিমত। 

বাঙালির বাংলা

বাঙালির বাংলা
 
‘এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির - আমাদের।
দিয়া ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’
তাড়াব আমরা, করি না ভয়
যত পরদেশী দস্যু ডাকাত
‘রামা’দের ‘গামা’দের ॥’

বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে - ‘বাঙালির বাঙলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। বাঙালির মতো জ্ঞান-শক্তি ও প্রেম-শক্তি (ব্রেন সেন্টার ও হার্ট সেন্টার) এশিয়ায় কেন, বুঝি পৃথিবীতে আর কোন জাতির নেই। কিন্তু কর্ম-শক্তি একেবারে নেই বলেই তাদের এই দিব্যশক্তি তমসাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাদের কর্মবিমুখতা, জড়ত্ব, মৃত্যুভয়, আলস্য, তন্দ্রা, নিদ্রা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিচ্ছার কারণ। তারা তামসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে চেতনা-শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে। এই তম, এই তিমির, এই জড়ত্বই অবিদ্যা। অবিদ্যা কেবল অন্ধকার পথে ভ্রান্তির পথে নিয়ে যায়; দিব্যশক্তিকে নিস্তেজ, মৃতপ্রায় করে রাখে। যারা যত সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন, এই অবিদ্যা তাদেরই ততো বাধা দেয় বিঘ্ন আনে। এই জড়তা মানবকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যায়। কিছুতেই অমৃতের পানে আনন্দের পথে যেতে দেয় না। এই তমকে শাসন করতে পারে একমাত্র রজগুণ, অর্থাৎ ক্ষাত্র-শক্তি। এই ক্ষাত্রশক্তিকে না জাগালে মানুষের মাঝে যে  বিশ্ব-বিজয়ী 
ব্রহ্ম-শক্তি আছে তা তাকে তম-গুণের নরকে টেনে এনে প্রায় সংহার করে ফেলে। বাঙালি আজন্ম দিব্যশক্তি সম্পন্ন। তাদের ক্ষাত্রশক্তি জাগলো না বলে দিব্যশক্তি কোন কাজে লাগলো না - বাঙালির চন্দ্রনাথের আগ্নেয়গিরি অগ্নি উদ্‌গিরণ করলো না। এই ক্ষাত্রশক্তিই দিব্য তেজ। প্রত্যেক মানুষেই ত্রিগুণান্বিত। সত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ। সত্বগুণ, ঐশীশক্তি অর্থাৎ সৎশক্তি সর্ব অসৎ শক্তিকে পরাজিত করে পূর্ণতার পথে নিয়ে যায়।
এই সত্ব গুণের প্রধান শত্রু তম গুণকে প্রবল ক্ষাত্রশক্তি দমন করে। অর্থাৎ আলস্য, কর্মবিমুখতা, পঙ্গুত্ব আসতে দেয় না। দেহ ও মনকে কর্মসুন্দর করে। জীবনশক্তিকে চিরজাগ্রত রাখে, যৌবনকে নিত্য তেজ-প্রদীপ্ত করে রাখে। নৈরাশ্য অবিশ্বাস, জরা ও ক্লৈব্যকে আসতে দেয় না। বাঙালির মস্তিষ্ক ও হৃদয় ব্রহ্মময় কিন্তু দেহ ও মন পাষাণময়। কাজেই এই বাংলার অন্তরে-বাহিরে যে ঐশ্বর্য পরম দাতা আমাদের দিয়েছেন, আমরা তাকে অবহেলা করে ঋণে, ব্যাধিতে, অভাবে, দৈণ্যে, দুর্দশায় জড়িয়ে পড়েছি। বাংলার শিয়রে প্রহরীর মতো জেগে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম গিরি হিমালয়। এই হিমালয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুনি-ঋষি-যোগীরা সাধনা করেছেন। এই হিমালয়কে তাঁরা সর্ব দৈবশক্তির লীলা-নিকেতন বলেছেন। এই হিমালয়ের গভীর হৃদ-গুহার অনন্ত স্নেহধারা বাংলার শত শত নদ-নদী রূপে আমাদের মাঠে-ঘাটে ঝরে পড়েছে। বাংলার সূর্য অতি তীব্র দহনে দাহন করে না। বাংলার চাঁদ নিত্য স্নিগ্ধ। বাংলার আকাশ নিত্য প্রসন্ন, বাংলার বায়ুতে চিরবসন্ত ও শরতের নিত্য মাধুর্য ও শ্রী। বাংলার জল নিত্য প্রাচুর্যে ও শুদ্ধতায় পূর্ণ। বাংলার মাটি নিত্য উর্বর। এই মাটিতে সোনা ফলে। এত ধার আর কোন দেশে ফলে না। পাট শুধু একা বাংলার। পৃথিবীর আর কোন দেশে পাট উৎপন্ন হয় না। এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তাবোধ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ - আল্লাহ্‌, ভগবানের উপাসনা, উপবাস-উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাংলার কয়লা অপরিমাণ, তা কখনো ফুরাবে না। বাংলার সুবর্ণ-রেখার বালিতে পানিতে স্বর্ণরেণু। বাংলার অভাব কোথায়? বাংলার মাঠে মাঠে ধেনু, ছাগ, মহিষ। নদীতে ঝিলে বিলে পুকুরে ডোবায় প্রয়োজনের অধিক মাছ। আমাদের মাতৃভূমি পৃথিবীর স্বর্গ, নিত্য সবৈশ্বর্যময়ী। আমাদের অভাব কোথায়? অতি প্রাচুর্য আমাদের বিলাসী, ভোগী করে শেষে অলস, কর্মবিমুখ জাতিতে পরিণত করেছে। আমাদের মাছ, ধান, পাট, আমাদের ঐশ্বর্য শত বিদেশী লুটে নিয়ে যায়, আমরা তার প্রতিবাদ তো করি না, উল্টো তাদের দাসত্ব করি; এ লুন্ঠনে তাদের সাহায্য করি। বাঙালি শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগেও তার স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে চেষ্টা করেছে। আজো বাংলার ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যে আত্মদান করেছে, যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, ইতিহাসে তা থাকবে স্বর্ণ-লিখায় লিখিত। বাংলা সর্ব ঐশীশক্তির পীঠস্থান। হেথায় লক্ষ লক্ষ যোগী মুনি ঋষি তপস্বীর পীঠস্থান, সমাধি; সহস্র সহস্র ফকির-দরবেশ ওলী-গাজীর দর্গা পরম পবিত্র।
হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খ ঘন্টার ধ্বনি। এখানে যে শাসনকর্তা হয়ে এসেছে সেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলার আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি। আমাদের বাংলা নিত্য মহিমাময়ী, নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র। আজ আমাদের আলস্যের, কর্মবিমুখতার পৌরুষের অভাবেই আমরা হয়ে আছি সকলের চেয়ে দীন। যে বাঙালি সারা পৃথিবীর লোককে দিনের পর দিন নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারে তারাই আজ হচ্ছে সকলের দ্বারে ভিখারি। যারা ঘরের পাশে পাহাড়ের অজগর বনের বাঘ নিয়ে বাস করে তারা আজ নিরক্ষর বিদেশীর দাসত্ব করে। শুনে ভীষন ক্রোধে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে, সারা দেহমনে আসে প্রলয়ের কম্পন, সারা বক্ষ মন্থন করে আসে অশ্রুজল। যাদের মাথায় নিত্য স্নিগ্ধ মেঘ ছায়া হয়ে সঞ্চরণ করে ফিরে, ঐশী আশীর্বাদ অজস্র বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ে, শ্যামায়মান অরণ্য যাকে দেয় স্লিগ্ধ শান্তশ্রী, বজ্রের বিদ্যুৎ দেখে যারা নেচে ওঠে - হায় তারা এই অপমান এই দাসত্ব বিদেশী দস্যুদের এই উপদ্রব নির্যাতনকে কি করে সহ্য করে? ঐশী ঐশ্বর্য - যা আমাদের পথে ঘাটে মাঠে ছড়িয়ে পড়ে আছে তাকে বিসর্জন করে অর্জন করেছি এই দৈন্য, দারিদ্র্য, অভাব, লাঞ্চনা। বাঙালি সৈনিক হতে পারলো না। ক্ষাত্রশক্তিকে অবহেলা করলো বলে তার এই দুর্গতি তার অভিশপ্তের জীবন। তার মাঠের ধান পাট রবি ফসল তার সোনা তামা লোহা কয়লা - তার সর্ব ঐশ্বর্য বিদেশী দস্যু বাটপাড়ি করে ডাকাতি করে নিয়ে যায়, সে বসে বসে দেখে। বলতে পারে না ‘এ আমাদের ভগবানের দান, এ আমাদের মাতৃ-ঐশ্বর্য! খবরদার, যে রাক্ষস একে গ্রাস করতে আসবে, যে দস্যু এ ঐশ্বর্য স্পর্শ করবে - তাকে ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’ দিয়ে বিনাশ করবো, সংহার করবো।’
বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক। 

- সাধক কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশে চলমান বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি!


বাংলাদেশে চলমান বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি!

সংলাপ ॥ আন্তঃদেশীয় পরিস্থিতিতে ও বহির্বিশ্বের নজরে বাংলাদেশ নিকট অতীতে যেভাবে দুর্নীতিতে পুনঃ পুনঃ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং যে মাধ্যম ও মিথ্যাচারের সংমিশ্রণে দেশ ও জাতিকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র বারবার করা হয়েছে এবং হচ্ছে এবং জাতিকে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী হবার সূক্ষ্ম কারিগর শিক্ষিত সমপ্রদায়ের ও রাজনীতিকদের একাংশের কার্যকরী বিদ্যার নাম ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’! একজন চোরকে ধরতে স্বয়ং চোরই যখন আমজনতার কাতারে মিশে দৌঁড়ায় তখন কে চোর আর কে সাধু দিনরাত খুঁজলেও তার কুল-কিনারা যেমন মিলবে না ঠিক তেমনি  বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়নে পড়ে জাতি দিশেহারা। উত্তরণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
পুকুরচুরি কিংবা অন্যের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করার পর যখন তা ঘরে এনে গচ্ছিত করা হয় তখন তা হয় দুর্নীতি। আর এই অর্থ সম্পত্তিই যখন বুদ্ধি খাটিয়ে কলমের খোঁচায় দেশ-বিদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে পাচার করা হয়, তখন তা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত! একটি দেশের আপাদমস্তক যখন এই ধরনের মানসম্পন্ন দুর্নীতির চক্রজালে ফেঁসে যায়, তখন অতি দ্রুত ওই দেশ দারিদ্র দশায় উপনীত হয়।
সরকারী আর্থিক অব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম, অদক্ষ ও দুর্বল জনপ্রশাসন এবং নিরক্ষরতার কারণে সর্বোপরি রাজনীতিকদের অসচেতনতাই এর পেছনের মূল কারণ বলে চিন্তাবিদরা চিহ্নিত করেন।
গণতন্ত্র একটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে জাতির চলমান প্রক্রিয়া যার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো এই বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বিক অঙ্গনে যখন অর্থনৈতিক দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক আন্দোলন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কাজেই এইরকম বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিসমূহ চিহ্নিত করার কৌশল ও দমন পদ্ধতি রাজনীতিকদের সাধারণ জনতাকেই সঙ্গে নিয়ে করার জন্য বুদ্ধিমান হতে হবে। নয়তো ওইসব দুর্নীতিবাজদের নিষ্পেশনে তারাই হবেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের দরিদ্র জনগণের শ্রম ও ঘামের টাকায় একটি দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন এ দেশের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে আসছে (তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাঘববোয়ালদের নয়, বরং চুনোপুটি গোছের দুর্নীতিবাজদের) এবং আইনজীবী ও আদালত খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে যেভাবে এক একটি মামলা দায়ের করেছে অতঃপর সেসব মামলার প্রায় সবই যখন উচ্চ আদালতের  নির্দেশে স্থগিত হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিবাজ খুঁজে বের করা কি সরকারের কাছেখুব কঠিন?
বর্তমানে অধিকাংশ সচিবালয়ের ছোট বড়ো সচিব সাহেবরা দুর্নীতিতে আকন্ঠ ডুবে আছেন বলেই দুর্নীতির সংজ্ঞা, অর্থ সব পাল্টে ফেলছেন। এখানে তাদের ‘নিয়ম বহির্ভূত’ বা ‘অনিয়ম’ কথাটিই বাংলাদেশে এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ নীতি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ওপেন সিক্রেট কি বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আওতাভুক্ত নয়?
দপ্তরে একজন কর্মচারী যখন ১০ টাকা ঘুষ নেয় এবং তার বড় কর্মকর্তা নেয় ১০০ টাকা, তখন ওই কর্মচারীই তার বড় সাহেবকে বলে সৎ। এ দেশের জনপ্রশাসনে নিয়োজিত অধিকাংশ কর্মকর্তারাই এমনিভাবে সৎ-অসৎ এর দুর্নীতি লালনে কৌশলী।
এ দেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসের রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিকরা অধিকাংশই ছিলেন সৎ ও মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমপ্রদায়ভুক্ত। তাদের কেউ কেউ ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী বিশেষ করে আইনজীবী। এখন বিত্তশালীরাই সমাজের নেতা ও রাজনীতিক। তাদের কার্যক্রমের আড়ালে আছে সীমাহীন দুর্নীতি এবং তা হজম করার অসামান্য শক্তিই হচ্ছে ধর্মকে হাতিয়ার করা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞ হলেন তথাকথিত ইসলামপন্থী রাজনীতিকরা এবং ধর্মজীবী ধর্মবেত্তারা।
দীর্ঘকাল যাবৎ এ দেশের পশু চিকিৎসা খাতে বিনামূল্যে বিতরণের নামে দুর্মূল্যের ঔষধ এবং চিকিৎসা সেবা পান না খামারীরা। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির ভেলকিবাজিতে সব পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য কোনো দেশে যেখানে দুর্নীতিবাজদের পরবর্তী বংশধরেরা পুনর্বাসিত হচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা দেশে রাজনীতি করছে অদৃশ্য দুর্নীতির কালো থাবা আরো সমপ্রসারিত করতে। জনগণকে সম্মিলিতভাবে তাদের এই কূটচাল প্রতিহত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

সময় এসেছে এ দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী, বুদ্ধিবৃত্তিক সকল দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দিয়ে দেশ ও জাতিকে প্রগতিশীল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার। রাজনীতিকরা অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে সামনে সত্যের পথ ধরে এগিয়ে চলুক এটাই জনগণের প্রত্যাশা। 

আন্দোলনের পথ ধরে সরকারকে হাটতে হবে

আন্দোলনের পথ ধরে
সরকারকে হাটতে হবে

সংলাপ ॥ মুসলিম লীগ নামক দলটির নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু এর মাত্র ৭ বছর পর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে মুসলিম লীগের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।
এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে অসংখ্য গণআন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ- সেকথাটি অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশে স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার একটি বিখ্যাত উক্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যার মূল কথা হচ্ছে এই যে, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় যায় তখন সমাজের নগণ্য সংখ্যক লোক আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়, আর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন দুর্যোগ নেমে আসে সাধারণ মানুষের জীবনে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানীরা সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে চোরগুলোকে’। ‘যে দিকে তাকাই, দেখি শুধু চোর’। ‘আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি, আর চাটার দলেরা সব খেয়ে ফেলে’।
এই চোর আর চাটার দলের কারণেই  আজকে দেশের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ওই চোর আর চাটার দলেরা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তৈরি করেছে ভয়াবহ রকমের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। তারা ধর্মান্ধদের সাথেহাত মিলিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান তৈরি করে বর্তমানে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকেও বেকায়দার মধ্যে ফেলার চেষ্টায় রত। যা থেকে উত্তরণঘটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের অপপ্রচারে নিরুৎসাহিত না হয়ে এবং ভেদাভেদ ও অন্তঃকলহ ভুলে জনগণের আস্থা অর্জনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও এখন জনগণের চিন্তার কথা বুঝতে পারছেন কিনা তা সময়বলে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থাকলেও এই মহাজোট সরকারের  প্রতি সাধারণ মানুষের চিন্তার অবস্থানটা বের করার চেষ্টা চলছেও বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এত জনপ্রিয় হয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে সরকারের অবস্থাটি আজ কেমন তা খতিয়ে দেখে উত্তরণের পথ খোঁজার কাজটি করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতা ও আন্তরিকতার সাথে। বঙ্গবন্ধু এক বিদেশী সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমার যোগ্যতা হচ্ছে এই যে, আমি এদেশের মানুষকে ভালোবাসি।’ এ কথা ভুলে যাওয়া সমীচীন নয় যে, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুররা ৭৫-এর ১৫ আগষ্টের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অতি কাছেই অবস্থান করতো। বর্তমানেও আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ করার জন্য এই ধরনের ষড়যন্ত্রকারীর অভাব নেই এবং তারা বেশ সফলভাবেই সক্রিয় রয়েছে। দলটি বর্তমানে যেভাবে চলছে তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এখনই। জাতির বিবেকবান ও সচেতন মহল চাইছে, আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে এর নীতি-নির্ধারকদেরকে এখন জরুরি ভিত্তিতে নিম্নলিখিত কর্মপন্থাগুলো বাস্তবায়ন করা দরকারঃ
বর্তমানে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে যে নব্য রাজাকাররা জায়গা করে নিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে সরকার ও দল থেকে বের করে দিতে হবে।
সরকার ও দলে সততা ও দক্ষতার মূল্যায়ন করে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের স্থান করে দিতে হবে যাতে তারা দেশ ও সমাজের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মপন্থা তৈরি করতে পারেন।
দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সারা দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য সত্যের আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে।

স্মরণ রাখা দরকার যে, ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জয়লাভের পেছনে একটি বড় ধরনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তখন ষড়যন্ত্রকারীরা গুজব ছড়িয়েছিল এইভাবে যে, জাহানারা ইমাম আন্দোলনে সফল হলে এদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব চলে যাবে, ঠিক তেমনি এখনকার নব্য রাজাকাররা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে যে, জোট সফল হলে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নেতৃত্বও চলে যাবে।  যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য হেফাজত ইসলামের মত বিভিন্ন ইসলামী নামে যে সংগঠনগুলো বাংলার বুকে গজিয়ে উঠছে সেটি নতুন কিছু নয়, জামাতেরই সহোদর সংগঠন মাত্র। বহুদিন আগে থেকেই এইসব নামের সংগঠনগুলো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদ্রাসা-মসজিদ ভিত্তিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। বর্তমানে শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে আগের চাইতে আরও অনেক বেশি অর্থ-সম্পদে পুষ্ট হয়ে ধর্মের নামে মাঠে নেমেছে। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে বিভ্রান্ত করে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু থেকে তাদের দৃষ্টি সরানোর জন্যই তারা এখন ব্লগার-নাস্তিক প্রসঙ্গ তুলেছে। একাত্তরের রাজাকারসহ পাকিস্তানী বাহিনীর সকল দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যে ‘দুস্কৃতিকারী, ‘দুর্বৃত্ত’, ‘ভারতের অনুচর’, ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলতো সে কথাটিও আজ স্মরণ রাখা দরকার। একটা কথা আজ স্বতঃসিদ্ধই যে, আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের শত্রু। আর সে আওয়ামী লীগে আজ নব্য রাজাকাররা যেভাবে ঘাপটি মেরে বসেছে তা থেকে দলটিকে সাফ করতে না পারলে দেশে আবারও বিপর্যয় নেমে আসবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর পরে হলেও মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি তাকিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি এদেশের জনগণের নাড়ীর টান। এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণেই তারা আজ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। 

বৃহস্পতিবার, ৭ মে, ২০১৫

ধনী গরীবের বৈষম্য কমানো সময়ের দাবি

ধনী গরীবেরবৈষম্য কমানো সময়ের দাবি

·        তার (আবু লাহাবের) ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসবে না। - ১১১: ২
·        ধন-সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। - ১০২: ১।
·        আর অবশ্যই সে (মানুষ) তো ধন-সম্পদের লালসায় উন্মত্ত। - ১০০: ৮
·        (দুর্ভোগ প্রত্যেকের) যে অর্থ জমা করে ও তা বারবার গোণে; তার ধারণা, তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে। - ১০৪: ২-৩।
·        যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না, সেদিন  উপকৃত হবে সে যে আল্লাহর কাছে পবিত্র মন নিয়ে আসবে।  - ২৬: ৮৮-৮৯।
·        তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা, তোমাদের জন্য আল্লাহ্‌রই কাছে রয়েছে বড় পুরস্কার। - ৬৪: ১৫।
সংলাপ ॥ বাংলা ও বাঙালির মূল্যবোধ চর্চায় এক সময় বলা হতো, ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন’? আর বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা সমাজের সর্বস্তরে যে বৈষম্য আজ বর্তমান তা দেখে হয়তো ধনীদের বলার ইচ্ছা জাগে, ‘তুমি এতো গরীব, তাই আমি এতো ধনী হইবো না কেন?’ দেশে মুষ্টিমেয় লোক বেশি ধনী হয়ে গেছে বলেই  তার বিপরীতে সৃষ্টি হয়েছে এতো গরীব মানুষ। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে আজ বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে বসবাসরত নাগরিকদের অধিকাংশকে এক-দিকে দেখা যাচ্ছে, নানা রঙের বিলাস বহুল গাড়ি, বাড়ি, কোটি টাকা, শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। অপরদিকে রাস্তার দু’ধারে, বস্তিতে কত মানুষ বাস করছে খোলা আকাশের নিচে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা তাদের দিতে পারেনি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। অপরদিকে রিক্সাওয়ালা, ঠেলাগাড়ি চালক, দিনমজুর, গৃহকর্মী, শ্রমিক যারা দিনভর পরিশ্রম করছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো চিন্তা নেই, প্রতিদিনের সংস্থান যাদের হলেই হল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ভীষণ সুখী। কিন্তু কথিত বিশ্বায়ন ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিনির্ভর সমাজের যে দুষ্টচক্রে তারা আজ আবর্তিত, তা থেকে তারা কীভাবে নিজেদের উত্তরণ ঘটাবেন সে চিন্তাটিও কেউ করছে না। ফলে ধনী আরও ধনী হওয়া, দরিদ্র আরও দরিদ্র হওয়ার যে ধারাটি ১৯৭৫’এর পট-পরিবর্তনের পর থেকে চলে আসছিল তা দিনকে দিন আরও প্রকটতর হচ্ছে। কেউ কেউ ধর্মের নামে, আবার কেউ রাজনৈতিক ও সরকারি দলের সুবিধা নিয়ে বিগত কয়েক বছরে অঢল অর্থবিত্তের মালিক বনেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবুল বারকাতের একটি বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘অর্থনীতির বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। এদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন জনকল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্রের-যে রাষ্ট্রে নিশ্চিত হবে চয়নের স্বাধীনতা (ফ্রিডম অব চয়েস): অবারিত হবে অর্থনৈতিক সুযোগ, উন্মেষিত হবে সামাজিক সুবিধাদি, পাওয়া যাবে রাজনৈতিক মুক্তি, থাকবে স্বচ্ছতা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা, পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ, প্রস্ফুটিত হবে ধর্মরিপেক্ষ আচরণ। স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান এসবের অঙ্গীকার করে, মৌলিক চাহিদা মেটানো থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমানাধিকারের অঙ্গীকারও। কিন' প্রকৃত অর্থে এ অঙ্গীকার, আর বাস্তবের ফারাক এতই বেশি যার ভিতরে মৌলবাদের অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট রাজনীতির বিস্তৃতি সম্ভব’।
তিনি আরও বলেছেন ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ক্ষয় হয়েছে, কিন' একদিকে যেমন, চিরাচরিত মানস কাঠামো বিলুপ্ত হয়নি, তেমনি অন্যদিকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কও বিকশিত হয়নি; বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিকৃষ্ট পুঁজি, যা উৎপাদনশীল বিনিয়োগে ভূমিকা রাখে না। ‘ব্রিফকেশ পুঁজিবাদ’ বিকাশে শিল্পভিত্তিক চিরায়ত পুঁজিবাদের তুলনায় ‘শকুন পুঁজিবাদ’ (ভালচার কেপিটালিজম) অনেক বেশি অনুকূল। এই পুঁজিবাদ উৎপাদনশীল শিল্পনির্ভর অর্থনীতির চেয়ে নগর-কেন্দ্রিক ভূমি ব্যবসা এবং দোকানদারি অর্থনীতি বিকাশে অনেক বেশি উৎসাহী। অর্থাৎ কাঠামোগত ভাবেই এই পদ্ধতি উদ্বৃত্ত শ্রমের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। হচ্ছে না দারিদ্র্য বিমোচন। অবশ্য এ ধরনের মুক্তবাজার কখনই দারিদ্র্য বান্ধব নয়। একচেটিয়া পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের মুক্তবাজার এদেশের জাতীয় পুঁজিভিত্তিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বদলে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তাও মৌলবাদ - সাম্প্রদায়িকতা পুষ্টিতে সহায়ক’।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের ভাষায় তাই বলা যায়, ‘শকুন পুঁজিবাদ’ আজ এদেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করছে। এখানে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিতদের অবস্থা দিনকে দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে এবং এদের সংখ্যাটিও দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাকিস্তান আমলে বলা হতো ২২ পরিবারের কথা। আজ বলা হচ্ছে, কয়েক হাজার পরিবারের কাছে দেশের সকল সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্য ও অশিক্ষা-কুশিক্ষার ফসল হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাকে সমাজ ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ উদ্বেগজনক বললে হয়তো কমই বলা হবে। দেশে বর্তমানে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। অথচ ক্রমবর্ধমান এ শিশুদের কল্যাণে নেই কোন নীতিমালা। সরকার ঘোষিত ভিশন ২০২১ অর্জন করতে হলে এখনই এ শিশুদের কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি প্রয়োজন। পথশিশুদের প্রায় ৪৪ ভাগ ধুমপান করে এবং রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ ভাগ শিশুর কোন বিছানা নেই। পথশিশুদের প্রায় ৪০ ভাগ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না ও ৩৫ ভাগ শিশু খোলা জায়গায় পায়খানা করে। কোন মতে খাবার যোগাড়ের জন্য ৮০ ভাগ পথশিশু বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। ৮৪ ভাগের কোনও শীত বস্ত্র নেই। অসুস্থ হলে প্রায় ৫৪ ভাগের দেখাশোনার কেউ নেই। অর্থের অভাবে পথশিশুদের ৭৫ ভাগ ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না।
দেশের শিশুদের বিরাট অংশের এই চরম দুরাবস্থার চিত্র ব্যথিত করবে সমাজের যেকোন বিবেকবান মানুষকে। প্রশ্ন করতে হয় তাদেরকে, যারা দেশের সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন স্বাধীনতার ৪৪ বছর ধরে। এ পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী? এই দুরাবস্থা কী আমাদের সকলের লজ্জার বিষয় নয়? নাকি যারা স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের আমলে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন তারাই কেবল এ জন্য দায়ী? কিছু লোকের হাতে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অপর অংশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্য এবং এর অনুষঙ্গ হিসেবে অশিক্ষা-কুশিক্ষা ছড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ করছে এবং এই নির্মাণের কারণে প্রকৃতির রুদ্র-রুষে পতিত হয়ে জীবনহানি ঘটছে।

এদেশের মানুষ দরিদ্র নয়, তাদেরকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থার মূলে আছে  নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি। সমাজ জীবনের শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য ধনী-গরীবের বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ আজ সময়ের দাবি। 

ভাবের ঘরে চুরি না থাকলে.......

সময়ের সাফকথা ....
ভাবের ঘরে চুরি না থাকলে.......

·        আমরা বেঁচে আছি। পতিত জাতির উন্নতি হচ্ছে - আরো হবে, বিষ যন্ত্রণা কমছে - আরো কমবে।
·        জাতীয় ধমনীর ভিতর নতুন বিদ্যুদাগ্নি সঞ্চারিত করতে দৃঢ়চিত্ত হয়ে মনেপ্রাণে জাতি অকপট হচ্ছে।
·        দু’টি যুগের কঠোর চেষ্টার ফলে একটি চরিত্র গঠিত হয়। যার পূর্ণতা আজো হয়নি তবে গঠিত হচ্ছে।
·        সত্য আত্মপ্রকাশ করছে। সত্য অবিনশ্বর - ধর্ম অবিনশ্বর - পবিত্রতা অবিনশ্বর। তাই জাতি একটা আদর্শিক খাঁটি  নেতৃত্ব চাচ্ছে।

সংলাপ ॥ বিভিন্ন মহলে শুনা যায়, সরকারপ্রধান মুসলমান হওয়ার কারণেই নাকি সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যুক্ত হয়েছে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার অধিকার দেয়া হয়েছে! রাষ্ট্র সব মানুষের। সরকারপ্রধানদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য কি রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টে যাবে? বীর বাঙালির আক্ষেপ এখানেই। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুনসুর আলী, কামরুজ্জামানের মতো ব্যক্তিত্ব যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন তখন কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি ‘সংবিধানে’ ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহ’ যুক্ত হবে! এরপর যখন বলা হয় মহাজোট সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে; তখন তাকে বাঙালি জাতি আর কি বলবে? বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তাদের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা থেকে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত ‘সংবিধানে’ ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ দেশ, জাতি ও জনগণের আকাঙক্ষাকে সর্বোচ্চ বলে বিবেচনা করত। ’৭২ সালটা এরকমই ছিল, যে জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার ওপরে কোন ব্যক্তির ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া ছিল অসম্ভব। শেখ হাসিনাকে শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি মানুষসমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা’ ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন' তিনি কোন ‘ইচ্ছাকে’ প্রাধান্য দিলেন!
জানা গেছে, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’কে ‘ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল’ হিসাবে বিবেচনা করে। দুনিয়াজুড়ে ইসলামপন্থী রাজনীতি বিষয়ে আমেরিকার কোনো একক অবস্থান না থাকলেও একানব্বইয়ের নির্বাচনের পর থেকে দেশের তথাকথিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াত প্রশ্নে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির অবস্থান ছিল ‘অনুমোদন’মূলক।
বিশেষ করে আমেরিকার ‘রিপাবলিকান’ দলীয় বিগত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বাংলাদেশের ওই দলটিকে (মডারেট) ‘মধ্যপন্থি'’ বলে প্রায়শই উল্লেখ করতেন যা বাংলাদেশে অনেক রাজনীতিক এখনও বলতে পুলক অনুভব করেন! ১৯৯৩ সাল থেকেই বাংলাদেশ সফররত সব আমেরিকার কর্মকর্তাই জনগণ প্রত্যাখাত ওই দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে সাক্ষাত করতেন।
জামাতের নাম ও দলীয় লক্ষ্য পরিবর্তনেরও পরও আগের অবস্থান থেকে আমেরিকার সরে আসা বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামপন্থি রাজনীতির প্রশ্নে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য পরবর্তন হচ্ছে বলে চিন্তাবিদরা ধারণা করছেন।
কিন্তু বর্তমান সরকার কি করছেন তা উপলব্ধি করে চিন্তাবিদগণ মুখে কলুপ আঁটছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক দূর্নীতিবাজ বুদ্ধিজীবীরা সুযোগ নিয়ে মাঠে লাফালাফি করা শুরু করেছেন। একই সঙ্গে সুযোগ বুঝে সংবিধানের বর্তমান সরকারের আনা পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে প্রণীত নতুন নির্বাচনী আইনের সঙ্গে মিল রেখেসম্প্রতি তথাকথিত ইসলামী ওই দলটি নিজেদের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ রাখে। একইসঙ্গে দলীয় গঠনতন্ত্র থেকে ‘আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন প্রতিষ্ঠা’র অংশটি নাকি বাদ দিয়েছে।

তাই দেশবাসীর চিন্তা জগতে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে - ধর্ম কি? 

রাজনীতির উদ্দেশ্য ক্ষমতা না মমতাবোধ?

রাজনীতির উদ্দেশ্য ক্ষমতা না মমতাবোধ?

সংলাপ ॥ আমাদের দেশে রাজনীতিকরা ভোটের আগে জনগণের কাছে আবেদন জানান যেন তাকে ভোট দিয়ে দেশ ও দশের সেবা করার সুযোগ দেয়া হয়। যে রাজনীতিক ভোটে প্রার্থী হয়েছেন তার আসল উদ্দেশ্যটা কি? সেটা কি দেশ ও দশের সেবা না-কি ক্ষমতা? দেশ ও দশের সেবা করার জন্য কি ক্ষমতা অপরিহার্য? ক্ষমতায় না গেলে কি মানুষের সেবা করা যায় না? ক্ষমতা কি মানুষকে সেবাপরায়ণ করে? ক্ষমতার সাথে সেবার সম্পর্ক কি? ‘ক্ষম তাড়িত যাহাতে’ সে ক্ষমতাবান। যার ক্ষমতা আছে সে ইচ্ছে করলে ক্ষমা করতে পারে আবার ইচ্ছে করলে শাস্তিও দিতে পারে। ক্ষমা করার যোগ্যতা যার নেই সে অক্ষম। অন্যদিকে, আমি থেকে ‘সে’- কে যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তিনি সেবক। সুতরাং সেবার সাথে ক্ষমতার কোন সম্পর্ক নাই। ‘সে’ অস্তিত্ব দিশাগ্রস্ত থাকে যাহাতে। যারা জনসেবার নাম করে জনগণের ভোট চায় আসলে তাদের উদ্দেশ্য জনসেবা নয়। তাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা। তুমি আমাকে ভোট দিয়ে এমন ক্ষমতা দাও যেন আমি তোমাকে শাস্তি দিতে পারি। এটাই মূল কথা। তোমার ভোটটা আমার প্রয়োজন দেশ ও দশের সেবা করার জন্য নয়, সেটা উপলক্ষ মাত্র; আসল লক্ষ্য হচ্ছে নিজের বিত্ত ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তি বাড়ানো।
সেবার জন্য ক্ষমতা নয় মমতার প্রয়োজন। মমতা কি? মম মানে আমার, মমতা হচ্ছে মম তারণের আধার। মমতা হচ্ছে একটা বোধ।
এ বোধের প্রথম পর্যায় হচ্ছে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট হিসেবে উপলব্ধি। এ উপলব্ধি থেকে যখন কষ্টবোধটি আমিত্ববোধের অন্তর্গত হয় তখন তাকে মমতা বলে। মমতার মধ্যে ‘আমার আমার’ বোধ থাকে না। থাকে ‘আমি আমি’ বোধ। কোন ব্যক্তি, জীব বা বস্তুর প্রতি আমার বোধ যখন প্রত্যাশাহীনভাবে প্রকাশিত হয় তখন তাকে বলে মমতা। ক্ষমতা এবং মমতার অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। যার মধ্যে মমতাবোধ জাগ্রত হয়েছে সে ক্ষমতার দিকে যাবে না আর যার মধ্যে ক্ষমতার লোভ ক্রিয়ারত আছে তার মধ্যে মমতাবোধ থাকবে না।
রাজনীতিকদের মমতা থাকলে চলে না। তাদেরকে শৃগালের মতো ধূর্ত এবং সিংহের মতো হিংস্র হতে হয়। সুতরাং, ‘দেশ ও দশের সেবা করার সুযোগ দিন’, ‘আমাকে ভোট দিয়ে জনসেবার সুযোগ দিন’ - বলে ভোটারদের হাত-পা ধরা, পা ছুঁয়ে দোয়া নেয়া, বিনয়ে অবনত হওয়া ইত্যাদি ভোট আদায়ের কৌশল মাত্র। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ইত্যাদি অধিকাংশ রাজনীতিকদের বাহিরের আবরণ মাত্র আসলে এরা ভেতরে ভেতরে লালন করেন ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, অধৈর্য, লোভ। রাজনীতি এখন হয়ে উঠেছে ক্ষমতা ও বিত্তের আধার। রাজনীতির আশ্রয়ে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিত্ত ও প্রতিপত্তির সম্প্রসারণ সহজ হচ্ছে তাই সুযোগ সন্ধানীরা নামছে রাজনীতির মাঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ধনী ব্যবসায়ী, প্রাক্তন সেনাপতি, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, উপাচার্য, ব্যাংকার সবাই এখন রাজনীতির মাঠে খেলোয়াড়।

রাজনীতি এখন নীতি ও মূল্যবোধের সংকটে। ফলে দেশ ও দশের মধ্যে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা এবং অশ্রদ্ধার চর্চা। দেশ পতিত হচ্ছে গভীর  থেকে গভীরতর সংকটে। রাজনীতিতে চলছে নীতি লালন-পালনের আকাল। এর থেকে উত্তরণের  পথ ক্ষমতা নয় মমতাবোধের জাগরণ।

স্বাস্থ্য আর মাদক নিয়ে সরকারের দৃঢ়তা জরুরি

জাতির স্বার্থে -
স্বাস্থ্য আর মাদক নিয়ে
সরকারের দৃঢ়তা জরুরি

সংলাপ ॥ স্বাস্থ্য আর মাদক দুটি বিপরীতমুখী শব্দ। স্বাস্থ্যের সর্বজনীন সংজ্ঞায় শারীরিক, মানসিক আর আত্মিক সুস্থতার কথা বলা হয়েছে। যে কোন মাদক গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্যের এই তিনটি প্রস্তাবনা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। প্রতিবছর ২৬ জুনকে বিশ্বজুড়ে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী দিবস বলে পালিত হয়। বাংলাদেশেও এ দিবস পালনে কয়েকবছর আগে ভাবনা ছিল ‘স্বাস্থ্যের কথা ভাবুন-মাদক নয়’। কিন্তু এমন কিছু মাদকদ্রব্য (মরফিন, পেথিড্রিন) আছে যার পরিমিত ব্যবহার শুধুবৈধ নয় রোগ তাড়াতেও অপরিহার্য। আবার এগুলোর অপব্যবহার মানুষকে নিয়ে যায় অন্ধকারের পথে। এ ছাড়া অনেক মাদক রয়েছে যার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়বৈধতাই নেই। সেগুলো আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কাজকে ব্যাহত করে দেয়। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যে কোনো ধরনের মাদক বারবার নিলে তা আমাদের মস্তিষ্কের ‘পুরস্কারকেন্দ্র’ বা রিওয়ার্ড সেন্টারকে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলে একটা সাময়িক ভালো লাগার অনুভূতিতৈরি হয়। এই ভালো লাগা থেকেইতৈরি হয় শারীরিক এবং মানসিক নির্ভরশীলতা। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের (রাসায়নিক পদার্থ) তারতম্যের কারণে শরীর চায় বারবার ওই মাদক নিতে। অন্যদিকে অবচেতন মন চায় ওই মাদক নিয়ে আরো ভালো করে থাকতে। এ কারণে একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হয়ে গেলে তিনি বারবার মাদক নিতে চান। এই ভালো লাগার অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মাদক স্বরূপ প্রকাশ পায়। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত দেহযন্ত্রের সব অংশ বিকল হতে থাকে। পাশাপাশি শুরু হয় নানান মানসিক সমস্যা। চিন্তা আর আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ মাদকাসক্তিকে মস্তিষ্কের রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অফ ডিজিজের দশম সংস্করণ যা আইসিডি-১০ নামে বেশি পরিচিত তাতে মাদক ব্যবহারজনিত রোগগুলোকে কোড নম্বরে এফ ১০ থেকে এফ ১৯ পর্যন্ত রাখা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পুনরাসক্তির হার অনেক বেশি হলেও চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন মাদকাসক্তি একটি নিরাময়যোগ্য রোগ।
মাদকাসক্তি নিয়ে ভারত তো বটেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে নানা ধরনের ভুল ধারণা রয়েছে। এসব ভ্রান্তধারণা বেশির ভাগটাই না জানার জন্য। বাকিটা মাদক ব্যবসায়ীদের প্রচার। বলা হয় যে, মাদকাসক্তি কখনো ভাল হয় না এবং এর কোনো চিকিৎসা নেই। কিন' এই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা আছে।
‌অন্যদিকে এমনটাও বলা হয় - মাদকাসক্ত’র চিকিৎসায় কোন ওষুধের প্রয়োজন হয় না। এটা ঠিক নয়। ডি-টক্সিফিকেশনের সময়, উইথড্রয়াল সিম্পটম দূর করতে এবং মাদকের ওপর নির্ভরতা কমাতে সারা বিশ্বে প্রচুর ব্যবহৃত হয় নানা ধরনের ওষুধ। পাশাপাশি কাউন্সিলিং এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সবকিছুই মাদকাসক্তির চিকিৎসা করতে কাজে আসে।
আরেকটি বড় ভুল ধারণা হচ্ছে, সিগারেট কোনো মাদক নয়। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সিগারেট (নিকোটিন) এক ধরনের মাদক। গবেষণাতেও এটা প্রমাণিত। দেখা গেছে, মাদকাসক্তি শুরুর প্রথম ধাপ শুরু হয় সিগারেট দিয়ে।
মাদক ব্যবসায়ীরাও অনেক মিথ্যা প্রচার করে থাকেন। যেমন মাদক সেবনে সৃষ্টিশীল কাজ যেমন গান গাওয়া, কবিতা লেখা, অভিনয়ের দক্ষতা বাড়ে। অথচ বাস্তবক্ষেত্রে তা হয় উল্টোটা। মাদক গ্রহণের পরপরই সাময়িকভাবে ভালো লাগার অনুভূতি হয় বটে কিন্তু পরবর্তী সময়ে বুদ্ধিবৃত্তি কমে যায়, কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়। অনেকেই মনে করেন মাদকাসক্ত ব্যক্তি একজন অপরাধী। তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে অপরাধী নয়, বরং সে অপরাধের শিকার। শাস্তির বদলে তার চিকিৎসাই প্রথম পাওয়া উচিত।
আমাদের দেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে একটা ভুল ধারণা আছে যে বিদেশে পাঠিয়ে দিলে বা বিয়ে দিলে মাদকাসক্ত দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এসব করে বাস্তবে মাদকাসক্তি দূর তো হয়ই না, বরং আরো বাড়ে।
মাদকাসক্তি চিকিৎসার রয়েছে কয়েকটি ধাপ - প্রথম পর্যায়ে কোন মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদকাসক্তির ধরন নির্ণয় করে শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা করা হয়। এরপর তার মধ্যে মোটিভেশনতৈরি করার চেষ্টা করা হয়। ‘উইথড্রয়াল’ সিনড্রম ও মাদকজনিত শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। এরপর তার শরীর থেকে মাদকের ক্ষতিকর রাসায়নিক অংশগুলো বের করে দেয়া হয়। এই ধাপটিকে বলা হয় ‘ডিটক্সিফিকেশন’। এ সময় রোগীর পুষ্টি নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হয়। মাদকমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন স্বীকৃত ওষুধ নির্দিষ্ট নিয়মে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করতে হয়।

পরবর্তী ধাপে তাকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মাদকমুক্ত থাকার প্রেরণা দেয়া হয়। আবার পরবর্তী সময়ে সে যাতে মাদক গ্রহণ না করে সেই বিষয়ে উপযুক্ত পরামর্শ দেয়া হয়। আবার আসক্ত হওয়ার জন্য যেসব ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ রয়েছে, সেগুলো থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। পরে তাকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করা হয়। পুনর্বাসনমূলক কাজ দেয়া হয়। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। প্রয়োজনে তাকে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত করা হয়। ধাপগুলো যত সহজে বলা হলো, বাস্তবে এতটা সহজ নয়। প্রতিটি ধাপে থাকে নানা জটিলতা। আবার পুনরাসক্তির ঝুঁকি তো রয়েছেই। কিন্তু স্বাস্থ্যবান জাতি গঠন করতে গেলে অবশ্যই মাদকমুক্ত তরুণসমাজ প্রয়োজন। তাই নিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। 

বাংলাদেশ ‘জনগণতন্ত্রী’ না ‘জনপ্রজাতন্ত্রী’

বাংলাদেশ ‘জনগণতন্ত্রী’না ‘জনপ্রজাতন্ত্রী’

আল্লামা মোহাম্মদ সাদেক নূরী ॥ অধুনা কয়েকটি সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে বার বার শোনা যায়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মালিক জনগণ’। ‘বাংলাদেশের মালিক জনগণ’ এটা শতসিদ্ধ; তারপরও দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে তা বার বার উচ্চারণ অবশ্যই আলাদা তাৎপর্যবহ। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক সাধুবাদ।
প্রশ্ন হলো, যে বাংলাদেশের মালিক জনগণ, সে বাংলাদেশ ‘জনগণতন্ত্রী’ না হয়ে ‘প্রজাতন্ত্রী’ হলো কেন? এক সময়ে দেশটা বৃটিশ রাজের অধীনই ছিল এবং জনগণও প্রজা-ই ছিলেন বটে; কিন' এখন তো আর তা নেই; এখন দেশটি স্বাধীন জনগণও কারো প্রজা নন। অতএব, এ স্বাধীন দেশটির বিশেষণ হিসাবে ‘প্রজাতন্ত্রী’ শব্দটি বেমানানই শুধু নয়, অস্বস্তিকরও বটে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বিশেষণটি সংযোজনের যৌক্তিকতা ও সচেতনতা নিয়ে যতই প্রশ্ন থাক, শব্দটি প্রথম থেকেই সংবিধানে রয়েছে; অতএব প্রধানমন্ত্রী তো তা-ই আওড়াবেন, তবে শব্দটি সাধারণ্যে প্রায় অনুচ্চারিত বলেই বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। অধুনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘন ঘন উচ্চারিত হওয়ার কারণে বিষয়টি চাউর হয়; কেবলই নিজের মধ্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন চারা দিয়ে ওঠে, তা হলে আমরা এখনও কারো প্রজা? রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ ‘কমনওয়েলথ এর সদস্য মানে কি আমরা জনগণ এখনও বৃটিশ রাজের প্রজা? আমি এবং আমরা জনগণ তা মানে কি? বাংলার মানুষ নিজেদেরকে কারো প্রজা মনে করলে ক্ষোভ এবং লজ্জা বোধ  করে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ এবং সংসদ সদস্যগণেরও তা-ই হয় বলে চিন্তাবিদদের দৃঢ় ধারণা।

অতএব, সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট জনগণের মানবিক দাবী, অনতিবিলম্বে সংবিধানে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ শব্দের স'লে ‘জনগণতন্ত্রী’ প্রতিস্থাপন করে জাতিকে ক্ষোভ ও লজ্জা থেকে বাঁচান।

দুঃখিত বলার অভ্যাস শান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক

দুঃখিত বলার অভ্যাস শান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক

সংলাপ ॥ ‘মানুষেরই ভুল হয়’-বাংলা ভাষার এই সহজ, সরল কথাটি সহজভাবে মেনে নিতে জানলে সমাজ জীবনের অনেক সমস্যার সমাধানই সহজে হয়ে যেতো। কিন্তু আমাদের সমাজে এ সহজ সরল কথাটির চর্চা হয় না বললেই চলে। অথচ সমাজ জীবনের যাবতীয় অশান্তির জন্য এটি একটি বড় কারণ তা বলাই বাহুল্য। এ প্রসঙ্গে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর একটি উপদেশমূলক বাণী হচ্ছে-‘ভুল করলে এমনকি অন্যায় করলেও দুঃখিত বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন’।
বস্তুত একজন নাগরিকের প্রতি সরকারের বা কোন রাজনীতিকের দুঃখপ্রকাশের ঘটনা এদেশে বিরল। কারণ, সমাজের উঁচু স্তরে প্রতিদিন কতই না ভুল হচ্ছে, অন্যায় হচ্ছে, কিন্তু এর জন্য দুঃখপ্রকাশের ঘটনা খুব একটা দেখা যায়না। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষদের মধ্যে ভুল ও অন্যায় হয় বলেই দেশের এত বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অনাচার, অবিচার, হিংসা-বিদ্বেষ ও সংঘাতময় অবস্থা বিরাজ করছে। নিচু স্তরের মানুষদের মধ্যে ভুল ও অন্যায় হয়ে থাকলেও সমাজে তেমন প্রভাব পড়ে না বলে তাদের দায়-দায়িত্বও স্বভাবতই কম। 

সমাজের প্রতিটি স্তরে সচরাচরই দেখা যায়, যে মানুষটি ভুল করছে, অন্যায় করছে সে তার সেই ভুল ও অন্যায়কে স্বীকার না করে তা ঢেকে রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলে সেখানে সমস্যা আরও বাড়ছে। অথচ সে তার ভুল ও অন্যায় স্বীকার করে নিলে এবং এজন্য দুঃখ ও ক্ষমা চাইলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেতো। এমনকি যে ভুল ও অন্যায় করেছে সে নিজেকে শুধরিয়ে নিয়ে আরও উত্তোরণ ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারতো। সুতরাং সকল প্রকার ভুল ও অন্যায়ের জন্য দুঃখ প্রকাশের অভ্যাস গড়ে সমাজ জীবনের সর্বস্তরে সকলের মধ্যে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব গড়ে উঠবে - এই প্রত্যাশাই আজ বিবেকবান মহলের। 

লাঠি-কাঠি

তারিফ হোসেনের সত্য....
লাঠি-কাঠি

লাঠি শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নানা অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ এসে যায়। স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর উপস্থিতি, অবস্থিতি ও পরিস্থিতির বিষয়টি একাধারে যেমন নৈমিত্তিক তেমনি অনৈমিত্তিকও বটে। কোথায় নেই লাঠি? এ নিয়ে কথা কাটাকাটির পাশাপাশি লাঠালাঠি হলেও প্রশ্নটি কিন্তু খাঁটি। পুরান থেকে কুরআন, শ্মশান থেকে ময়দান অব্দি লাঠির অবদান। লাঠির ব্যবহারের বিষয়টি যদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় তবে আপনার চক্ষু হতে পারে চড়কগাছ, ছানাবড়া, স্থির বা অস্থির। লাঠি আপনি ব্যবহার করতে পারেন আবার আপনার ওপরও ব্যবহৃত হতে পারে। আক্রমণে-প্রতিরক্ষায়, প্রহারে-সংহারে, বাঁচতে-বাঁচাতে, হাঁটতে-হটাতে, রাখতে-রুখতে, আহারে-বিহারে, গালি ঠেকাতে, খুলি ফাটাতে, পেটাতে-পটাতে এইভাবে নানা কর্মকাণ্ডে আমরা লাঠির ব্যবহার দেখে আসছি। লাঠির ব্যবহার যেমন বিচিত্র এর ব্যবহারকারীদের মধ্যেও তেমন বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। মজুর-মেজোর, মহাজন-দুর্জন, মন্ত্রী-সান্ত্রী, পতি-নৃপতি, বুড়া-খোঁড়া, দৃষ্টিহীন-শক্তিহীন ইত্যাদি শ্রেণীর কাছে হাতির চেয়েও বিশ্বস- হাতিয়ার হাতের লাঠি। লাঠি তার নিজস্ব ধারে-ভারে-ব্যবহারে পৌঁছে গেছে আমজনতার ঘরে ঘরে। এর প্রতীকি ব্যঞ্জনা আনতে তাই অবস্থা-ব্যবস্থা-সংস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশব্দ ব্যবহার করি। ছন্নছাড়াকে ঠিক করতে তার মাথার ওপর ঘোরানো হয় ছড়ি। নবজাতকের যষ্টি তার মাতা; আর সেটা যে লাঠি ছাড়া ছুটতে পারে না তা তো বাংলাভাষী মাত্রই জানেন। ‘তেরে মেরে ডাণ্ডা করে দেব ঠাণ্ডা’- সুকুমার রায়ের এই ডাণ্ডা ছড়া সাহিত্যে অনন-কাল ঝাণ্ডা তুলে যাবে। দণ্ডধারী পেয়াদার আধুনিক সংস্করণ অস্ত্রধারী সৈনিক। শব্দতত্ত্বের ভাঙচুরের খেলায় লাঠি সামান্য দুমড়ে-মুচড়ে প্রথমে লড়ি তারপর নড়ি। ইংরেজ নিয়ে এল বেটন, ব্রিটিশ উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী করতে ভারতবাসীকে দিল পেটন। ব্যাটেলিয়ান, বেটন নিয়ে ইংরেজ চলে গেলেও দুশো বছরের রাজত্বকালে তারা পেটানোর সংস্কৃতি পাকাপোক্ত করে যায়। পাকিস্তানি আমলের মতো স্বাধীন বাংলাদেশেও পুলিশের হাতের লাঠি সাধারণ নাগরিকের পরিচর্যার চেয়ে তাদের চার্জ করার কাজে বেশি ব্যস্ত থাকে। তাই বলতে পারি পেটুক ধন্য আহারে, পুলিশ ধন্য প্রহারে। প্রচলিত-অপ্রচলিত বিভিন্ন ধারায় লাঠির ব্যবহারকে আরও সমৃদ্ধ করেছে বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচনের ক্ষেত্র। লোড যদি হয় ফ্লেঙি তবে তা বলবৎ রাখতে বাবাজিরা বাজি ধরতেও রাজি। এ জন্যই মোবাইল কোম্পানির ফ্লেঙিলোড অপশনটি হালে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শর্ত যত আঁটা গ্রাহক তত ঠ্যাটা অন্যদিকে শর্ত যত নমনীয় গ্রাহক তত কমনীয়। দাতা-গ্রহীতার চিরকালীন চাওয়া-পাওয়ার গড়মিল থেকেই তৈরি হয়েছে এই অন্যমিল প্রবচনটি-‘আঁটাআঁটি হলেই লাঠালাঠি’। ‘দশের লাঠি একের বোঝা’-কথাটি শুনতে বুঝতে কান-মন খুবই অভ্যস্ত। কিন্তু যদি বলা হয় ‘একের লাঠি দশের বোঝা’-তবে তা বোঝা কি সোজা? কথাটি বুঝতে একটু বিশেষ আখ্যা অর্থাৎ ব্যাখ্যার প্রয়োজন। দুনিয়ার শীর্ষধনীদের অন্যতম বিলগেটস একলক্ষ ডলার  খাওয়ার বিল দিলে তার তবিলে কোনো টান পড়েনা, কিন্তু সমপরিমাণ অর্থ যোগান দিতে গেলে আমাদের দেশের সত্তরজন মাঝারি চাকুরিজীবীর গোটা বছরের আয় এক জাগায় করতে হবে। তাহলে বিলগেটসের কাছে যা লাঠি তিনকুড়ি দশজনের কাছে তা কী বোঝা হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। ওজর-আপত্তি তুলতে দক্ষ বলিয়েদের লক্ষও থাকে লাঠির ওপর। বাকযুদ্ধে প্রতিপক্ষকে নির্বাক করে দিয়ে বাগ্মীরা যেমন নিষ্প্রাণে প্রাণসঞ্চার করতে পারদর্শী তেমনি সজীবকে নির্জীব করাটাও ওদের কাছে শুধুই নস্যি।
অবস্থা বিশেষে কখন করতে হবে যোজন আর কখনই বা বিয়োজন সে ব্যাপারে তারা নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞজন। এজন্যই তৈরি হয়েছে এই বিশেষ প্রবচন- ‘কাকা আর আমি একা, চোর আর লাঠি দুজন।’
এবারে ধাঁধার আসরে ঘাপটিমেরে-থাকা লাট্‌ঠি নিয়ে কথা বলব দুচারটি। আধা পরিমাণ ধাঁধাবলা দাদারাও যে ধাঁধাটি বলে অন্যকে গাধা বানাতে গিয়ে নিজেরাই গর্দভ সেজে পায়না পালানোর পথ সেটি হল- ‘আল্লাহর কী কুদরত লাঠির ভেতর শরবত।’ একই হেঁয়ালি আমরা অন্যভাবে বলি এবং উত্তরটা ভালই জানি- ‘আল্লাহর কী মেহেরবানী লাঠির ভিতর মিঠাপানি।’ উক্ত লাঠি আমাদের চোখে আখের ছবি এঁকে দিতে সময় নেয়না যেহেতু এই ধাঁধা আপাদমস্তক সাদাসিধা। ‘খুললে ঘর বন্ধ করলে লাঠি-’ এই ধাঁধাটি ধন্দ সৃষ্টি করার জন্য মন্দ নয়। উত্তর খুঁজতে গিয়ে মাতাল হতে হতে দেখবেন এক সময় ধান্ধার লাঠিটি আপনার মাথায় প্রায় মাথাল হয়ে বসে মুখরক্ষার পাশাপাশি আপনার ঊর্ধ্বাঙ্গও রোদবৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে। যত্রতত্র ছত্রের পর ছত্র লিখে যে ছাতাকেই বোঝাচ্ছি তা এতক্ষণে ছাত্র-অছাত্র নির্বিশেষে সবারই বোধগম্য হয়েছে আশা করি।
আপাতত লাঠিকে লাটে তুলে কাঠির খুঁটিনাটি দেখে নিই। কাষ্ঠিকা মেদ হারিয়ে কাঠি আবার লাঠি রোগা হয়ে কাঠি হতে পারে।

লাঠির প্রকার-আকার যদি হয় কতক তবে কাঠির ক্ষেত্রে তা শতক। কৃষিসভ্যতার সূচনায় যখন কোনও কৃষিযন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়নি তখন মজলুম মানুষেরা জুম চাষ করে কিছু খাদ্যশস্য ফলাত আর একাজে কাঠিই ছিল তাদের সবেধন নীলমনি। কাঠির উন্নত সংস্করণ লাঙল, হাল, ট্রাক্টর হলেও ব্যবহার উপযোগিতায় কাঠি আজ অব্দি একটা ফ্যাক্টর। নিবারণ- নিয়ন্ত্রণে কলকাঠি, চাবিকাঠি। বয়নে ক্রুশকাঠি, ভোজনে জোড়াকাঠি (চপষ্টিক), খননে সিঁদকাঠি। অচেতন করতে মরণকাঠি, সচেতন করতে জীবনকাঠি, জাগাতে সোনারকাঠি, ঘুমপাড়াতে  রূপারকাঠি, ভেলকি লাগাতে জাদুকাঠি, পরিমাপে গজকাঠি, জ্বালানি হিসাবে পাঠকাঠি, খুলনা অঞ্চলে যা ফোলাকাঠি সাজতে গুঁজিকাঠি, সৌরভ বিলাতে ধূপকাঠি। এছাড়া আছে দেশলাই বা ম্যাচের কাঠি যা ফসকাঠি নামেও পরিচতি। ব্যক্তি যখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে তখন সে আড়কাঠি। আর তিনি যদি একানন্তই হাড়জিরজিরে হয় তবে সে খ্যাংড়াকাঠি। উচু শক্তজমিতে ধানের চারা রোপণের জন্য গর্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয় ভূঁইকাঠি। আরও এক ধরনের কাঠি আছে যা হুঁকোর মধ্যম অংশের নল উত্তমরূপে সাফাই করার কাজটির শুলুক সন্ধান করে বলে এটির নাম শুলুক কাঠি। প্রসঙ্গটা এখন হুঁকো থেকে ঢেঁকিমুখো করছি। এ থেকে আঁচ করা যায় কাঠি কীভাবে ঢেকির  ভেতরে ঢুকে আছে। যে শলাকা দারুণ মমতা দিয়ে ঢেকির সমতা রক্ষা করে তার নাম অক্ষশলা। স্থাননামেও কাঠির অবস্থান বেশ পরিপাটি-স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি, চূড়ামনকাঠি তার জ্বলন্ত  উদাহরণ। 

উচ্চ শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ভালো মানুষ ও দেশপ্রেমিক


উচ্চ শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ভালো মানুষ ও দেশপ্রেমিক

সংলাপ ॥ উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত হওয়াই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ভালো মানুষ ও দেশপ্রেমিক হওয়া। আর এই শ্রেণীর শিক্ষিতদের দিয়েই দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন হবে। সোনার বাংলায় পরিণত হবে দেশ। তাই তরুণদের মেধার বিকাশ ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। সরকার দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি করতে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ইত্যাদি খাতে অর্থ বরাদ্দ এবং আওতা বৃদ্ধি করেছে। এ অর্থ যাতে স্বচ্ছতার সঙ্গে ভাতাভোগীদের কাছে পৌঁছায় সেজন্যে তাদের প্রত্যেককে মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলে দেয়ারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
দেশে নতুন ধারার ব্যাংকিং শুরু হয়েছে। হতদরিদ্রদের মাঝে ঋণ প্রদান করতে পারলে অভাবনীয় সাফল্য আসবে। বর্তমান সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মসৃজনে সহায়ক কর্মসূচিগুলোতে সহায়তার পাশাপাশি একটি মানবিক ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।  এ লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে অবহেলিত উৎপাদনমুখী খাত - বিশেষ করে কৃষক, খুদে উদ্যোক্তা, নারী উদ্যোক্তা ও শ্রমিক শ্রেণীসহ আর্থিক সেবাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সার্বিকভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্দেশে উচ্চ প্রত্যক্ষ ব্যয় ছাড়াও অবহেলিত, সুযোগবঞ্চিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং অর্থনৈতিক খাতসমূহের সামাজিক ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিসহ পরিবেশগত সচেতনতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতা বাড়াচ্ছে। দারিদ্র্যের কারণে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় না। তারা শিক্ষা গ্রহণের কোনো একটি পর্যায়ে ঝরে পড়ে। দরিদ্র অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের এ ঝরে পড়া রোধ করতে হবে।

জীবনে বড় হওয়ার অদম্য উৎসাহ নিয়ে যারা দারিদ্র্যকে জয় করে ভবিষ্যতের অনিশ্চিত পথ পাড়ি দিতে সংকল্প বদ্ধ তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে ব্যাংকের উদ্যোগ অনন্য ভূমিকা নিতে পারে।