বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫

বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি!

বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি!

সংলাপ ॥ আন্তঃদেশীয় পরিস্থিতিতে ও বহির্বিশ্বের নেক নজরে বাংলাদেশ নিকট অতীতে যেভাবে দুর্নীতিতে পুনঃ পুনঃ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং যে মাধ্যম ও মিথ্যাচার বিদ্যার সংমিশ্রণে ষোলকলা পূর্ণ করে দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বারবার করা হয়েছে এবং হচ্ছে এবং জাতিকে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী হবার সূক্ষ্ম কারিগর শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশের কার্যকরী বিদ্যার নাম ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি’! একজন চোরকে ধরতে স্বয়ং চোরই যখন আমজনতার কাতারে মিশে দৌঁড়ায় তখন কে চোর আর কে সাধু দিনরাত খুঁজলেও তার কুল-কিনারা যেমন মিলবে না ঠিক তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়নে পড়ে জাতি দিশেহারা। উত্তরণের পথ পেয়েও হাটতে পারছে না।
পুকুরচুরি কিংবা অন্যের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করার পর যখন তা ঘরে এনে গচ্ছিত করা হয় তখন তা হয় দুর্নীতি। আর এই অর্থ সম্পত্তিই যখন বুদ্ধি খাটিয়ে কলমের খোঁচায় দেশ-বিদেশে লোকচক্ষুর অন্তরালে পাচার করা হয়, তখন তা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত! একটি দেশের আপাদমস্তক যখন এই ধরনের মানসম্পন্ন দুর্নীতির চক্রজালে ফেঁসে যায়, তখন অতি দ্রুত ওই দেশ স্থবির দশায় উপনীত হয়।
সরকারী আর্থিক অব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম, অদক্ষ ও দুর্বল জনপ্রশাসন এবং নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্যের কারণে সর্বোপরি রাজনীতিকদের অসচেতনতাই এর পেছনের মূল কারণ বলে অভিজ্ঞ মহল চিহ্নিত করে।
গণতন্ত্র একটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে জাতির চলমান প্রক্রিয়া যার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো এই বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের  সার্বিক অঙ্গনে যখন অর্থনৈতিক দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক আন্দোলন ছাড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কাজেই এইরকম বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিসমূহ চিহ্নিত করার কৌশল ও দমন পদ্ধতি রাজনীতিকদের সাধারণ জনতাকেই সঙ্গে নিয়ে করার জন্য বুদ্ধিমান হতে হবে। নয়তো ওইসব দুর্নীতিবাজদের নিষ্পেশনে তারাই হবেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের দরিদ্র জনগণের শ্রম ও ঘামের টাকায় একটি দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন এ দেশের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে আসছে (তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাঘববোয়ালদের নয়, বরং চুনোপুটি গোছের দুর্নীতিবাজদের) এবং আইনজীবী ও আদালত খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে যেভাবে এক একটি মামলা দায়ের করেছে অতঃপর সেসব মামলার প্রায় সবই যখন উচ্চ আদালতের  নির্দেশে স্থগিত হয়ে যাচ্ছে, তখন প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিবাজ খুঁজে বের করা সরকারের কাছে খুব কঠিন।
বর্তমানে অধিকাংশ সচিবালয়ের ছোট বড়ো সচিব সাহেবরা দুর্নীতির সংজ্ঞা, অর্থ সব পাল্টে ফেলছেন। এখানে তাদের ‘নিয়ম বহির্ভূত’ বা ‘অনিয়ম’ কথাটিই বাংলাদেশে এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ নীতি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ওপেন সিক্রেট কি বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আওতাভুক্ত নয়?
এ দেশের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাসের রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিকরা অধিকাংশই ছিলেন সৎ ও মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের কেউ কেউ ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী বিশেষ করে আইনজীবী। এখন বিত্তশালীরাই সমাজের নেতা ও রাজনীতিক। তাদের কার্যক্রমের আড়ালে আছে সীমাহীন দুর্নীতি এবং তা হজম করার অসামান্য শক্তিই হচ্ছে ধর্মকে হাতিয়ার করা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞ হলেন তথাকথিত ইসলামপন্থী রাজনীতিকরা এবং ধর্মজীবী ধর্মবেত্তারা।
সাম্প্রতিক কালে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির সবচেয়ে ভয়াবহ আখড়া হচ্ছে বিভিন্ন অঙ্গনে রাজনৈতিক দলীয় দালালরা। ক্ষমতা কুক্ষীগত করে পাহাড় পরিমাণ সম্পত্তি আত্মসাত করার জন্য এইসব দালালরা যেন এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড অথচ এ দেশে বর্তমানে সবচেয়ে নীতিবর্জিত উপেক্ষিত খাত হচ্ছে শিক্ষাখাত। দেশের মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠলে কাদের ক্ষতি তা বর্তমান সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। ইতোমধ্যে  শিক্ষা খাত সংস্কারের নামে বিপুল অর্থ লুটপাটের খবর ফাঁস হয়েছে। তারপর আছে গোদের উপর বিষফোঁড়া যেখানে দেশে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর উন্নয়নে ও কল্যাণখাতে ব্যয় নেই বললেই চলে, সেখানে তথাকথিত প্রকল্প পরামর্শকদের ফি বাবদ কোটি কোটি এবং শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের নামে ব্যয়বহুল বিদেশ ভ্রমণেই কোটি কোটি টাকার উপরে খরচ করা হয়েছে।
দীর্ঘকাল যাবৎ এ দেশের পশু চিকিৎসা খাতে বিনামূল্যে বিতরণের নামে দুর্মূল্যের ঔষধ এবং চিকিৎসা সেবা পান না খামারীরা। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির ভেলকিবাজিতে সব পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য কোনো দেশে যেখানে দুর্নীতিবাজদের পরবর্তী বংশধরেরা পুনর্বাসিত হচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা দেশে রাজনীতি করছে অদৃশ্য দুর্নীতির কালো থাবা আরো সম্প্রসারিত করতে। জনগণ ও সরকারকে সম্মিলিতভাবে তাদের এই কূটচাল প্রতিহত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

সময় এসেছে এ দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী, বুদ্ধিবৃত্তিক সকল দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দিয়ে দেশ ও জাতিকে প্রগতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেয়া। বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকরা অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে সামনে সত্যের পথ ধরে এগিয়ে চলুক এটাই জনগণের প্রত্যাশা। 

টকশো

সময়ের সাফ কথা....
টকশো

সংলাপ ॥ বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুম কুমারী দাশ। যিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন, সেই কবে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ তখন ছিল ব্রিটিশ আমল। পরাধীন বাংলা তথা ভারতবর্ষে তখন মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক যেমন ছিল তেমনি ব্রিটিশদের চাটুকার, তোষামোদকারীদের সংখ্যাও নিশ্চয়ই কম ছিল না যারা খয়ের খাঁ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর তা না হলে কুসুম কুমারী দাশের মুখ দিয়ে এমন কথা বের হতো না। আবার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (ডিএল রায়) ‘নন্দলাল’ চরিত্রটিও আমাদেরকে ভীরু-কাপুরুষদের সম্পর্কে সচেতন রাখে সব সময়। ডিএল রায়ের কবিতার অংশটুকু ছিল অনেকটা এরকম-‘নন্দের ভাই কলেরায় মরে দেখিবে তাহারে কেবা/সকলে বলিল ‘যাও না নন্দ কর না ভাইয়ের সেবা/নন্দ বলিল, ভাইয়ের জন্য জীবনটা যদি দেই অভাগা দেশের হইবে কি/তখন সকলে বলিল বাহ্‌বা বাহ্‌বা ঠিক।’
দেখা যাচ্ছে, ভাই কলেরায় মারা গেলেও তার সেবায় এগিয়ে আসতে নন্দলালের অনেক যুক্তি ও ওজর আপত্তি। আজকের দিনে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে (ইলেক্‌ট্রনিক মিডিয়ায়) ‘টক শো’ নামের নতুন ধরনের অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে সাধারণ ও সচেতন দর্শক-শ্রোতার কাছেও কোন কোন সময় নন্দলালের চেহারাটিই ভেসে উঠে। দর্শক-শ্রোতার মনে প্রশ্ন জাগে, যারা গণমাধ্যমের পর্দায় নিজের চেহারাটুকু প্রদর্শনের সুযোগ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে থাকেন তাদের মধ্যে কয়জন নিজের ব্যক্তি জীবন ও কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ কথায় না হলেও কাজে বড়ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন? নাকি তারা নিজের জীবনে বড়ত্বের প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে শুধুমাত্র মিডিয়ার পর্দার ওপর ভরসা করে সর্ব ব্যর্থতার মাশুল দিয়ে যাচ্ছেন - নিরীহ নিরুপায় সাধারণ দর্শক-শ্রোতার ওপর চড়াও হয়ে। ভাবখানা এরকমই যে, বোকা দর্শক টিভির পর্দা খুলে আমাদের কথা না শুনে যাবে কোথায়? অবশ্য জনগণকে যারা বোকা ভাবেন, নিজেদেরকে বিশেষজ্ঞ, পণ্ডিত বা বিদ্বান মনে করে অনবরত কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের মনে হয় থামবার সময় এসেছে।
বর্তমানে দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে এসব ‘টক শো’র আবেদন দিন দিন ভয়াবহভাবে কমে যেতে শুরু করেছে। দর্শক-শ্রোতাদেরও তো একটা চিন্তা-চেতনার স্তর নিশ্চয়ই আছে। জরুরি অবস্থার সময়, মানুষের তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন থাকার সময় এই অনুষ্ঠানটিতে কত বিশিষ্টজনকেই কত বড় বড় কথা বলতে শোনা গেছে। আর ওই সময়টাই সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে। এত এত ‘টক শো’ এসব সমস্যার কোন সমাধানই দিতে পারেনি। সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক, কামাল লোহানী ও ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বা ড. আরেফিন সিদ্দিকের মতো বিবেকবান ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গকে এতসব ‘টক শোতে’ ওই সময় দেখা যায়নি বললেই চলে। তবে তারা ঠিকই ছিলেন এবং আছেন জনতার চিন্তাচেতনার সাথে, মানুষের মুক্তির মিছিলে। ‘টক শো’র জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক তো বলেই ফেলেছিলেন ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না’ - বাণিজ্যিক গণমাধ্যম বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলো ওয়াহিদুল হককে একদিনের জন্যও তাদের ‘টক শো’তে উপসি'ত করাতে পারেননি।

ওয়াহিদুল হক আজ আর নেই। তিনি এখন বেঁচে থাকলে কী লিখতেন জানি না। তবে সাধারণ দর্শক-শ্রোতারা এখন ‘টক শো’ সম্পর্কে তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না। তবু ‘টক শো’ চলছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফ ইসলাম ‘টক শো’ সম্পর্কে দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ‘টক শো’তে কে কি বলছেন সে সম্পর্কে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না, আগ্রহটা শুধু কে বা কারা ‘টক শো’তে এসেছেন এবং তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই ঔৎসুক্য সবার। তাই সময় এসেছে ‘টক শো’ থেকে সাবধান থাকার। কথায় যেমন চিড়া ভিজে না মুখে বড় বড় কথা বলে সাধারণ মানুষের ভালবাসা-শ্রদ্ধা পাওয়ার দিনও যে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আর সৎ চিন্তা ও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ‘টক শো’তে যারা যান টিভির পর্দায় তাদেরও সাবধান হওয়া উচিত তাদেরকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করছে কিনা, কোন অশুভ শক্তির ক্রীড়নক হয়ে যাচ্ছেন কি না। দর্শক-শ্রোতা মানুষ যে এখন আগের চাইতে অনেক সচেতন! 

সত্য উপলব্ধি জাগরনের এই তো সময়

সত্য উপলব্ধি জাগরনের এই তো সময়

সাগর সগীর ॥ জুলাই ২০১৩ পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০৯ কোটি ৫২ লাখ। উইকিপিডিয়া প্রদত্ত তথ্যমতে এই জনসংখ্যার ১১.৬৬ শতাংশই আল্লাহ বিশ্বাস করেনা বা নাস্তিক, অথবা কোন ধর্মেই বিশ্বাস করেনা। অর্থাৎ পৃথিবীর ৮২ কোটি ৮০ লাখ মানুষই নাস্তিক অথবা কোনরূপ ধর্ম বিশ্বাসের বাইরে অবস্থান করছে। তথ্যমতে, এদের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি ২৬ লাখ নাস্তিক। আর প্রায় ৬৮ কোটি ৫৪ লাখ যারা কোন ধরনের ধর্মে বিশ্বাস করেনা।
পরিসংখ্যান মতে, জুলাই ২০১৩ পর্যন্ত বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৩.২ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ মুসলমান, মোট জনসংখ্যা হিসাবে যা দাঁড়ায় ১৬৪ কোটি ৬১ লাখ। বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক অর্থাৎ সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বী হচ্ছে খ্রিষ্টান, শতকরা হিসেবে যা ৩১.২ শতাংশ। মোট হিসেবে ২২৩ কোটি ৫০ লক্ষ প্রায়। অপর দুইটি প্রধান ধর্ম হিন্দু ও বৌদ্ধের শতকরা হার যথাক্রমে ১৩.৮ শতাংশ এবং ৬.৭৭ শতাংশ। মোট হিসেবে হিন্দু জনসংখ্যা ৯৭ কোটি ৯১ লাখ এবং বৌদ্ধ জনসংখ্যা ৪৮ কোটি ৩ লাখ। উল্লেখিত পরিসংখানে দেখা যায় ইসলাম ছাড়া বিশ্ব জনসংখ্যার ৫২.০৭ শতাংশই খ্রিষ্টান, হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
আঁতকে উঠার মতন পরিসংখানটি হচ্ছে ধর্মবিশ্বাসহীন আর স্রষ্টা বিশ্বাসহীন মানুষদের সংখ্যাটি। ইসলামসহ সকল ধর্মমতে আল্লাহ্‌ তথা স্রষ্টায় বিশ্বাস আর নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সেই বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় অনুশাসনগুলো মেনে চলা বাধ্যতামূলক। আর তার বাইরে থাকা অর্থাৎ স্রষ্টা ও ধর্ম বিশ্বাসহীনতায় পৃথিবীর প্রায় ৮৩ কোটি মানুষ ডুবে আছে! অথচ আল্লাহ্‌, ঈশ্বরের বা ভগবানের দৃশ্যমান কোন গজব তুলনামূলক অর্থে তাদের উপর নেমে আসতে দেখা যায় না; নেমে আসেনা সচরাচর সমষ্টিগতভাবে।
আরো চিন্তিত হওয়ার মত তথ্য হচ্ছে এই ৮৩ কোটি মানুষ আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ পীড়িত কোন দেশে কিংবা ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মত কোন দেশে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ নয়। এই মানুষগুলো বসবাস করছে জাপান, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, নরওয়ে, চায়না, নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বেলজিয়াম, নিউজিল্যান্ড, ইউকে, দক্ষিণ কোরিয়া ও বুলগেরিয়ার মত দেশে! অর্থাৎ উন্নত, সমৃদ্ধ, অগ্রসর জীবন-যাপনকারী দেশে! তার মানে বিশ্ব জনসংখ্যার ৮৮.৩৩ শতাংশ মানুষের কঠিন বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের স্রষ্টাকে, তাদের স্রষ্টা প্রদত্ত ধর্মবিশ্বাসকে অস্বীকারকারী ১১.৬৭ শতাংশ মানুষের বিরুদ্ধে অস্বীকার করার অপরাধে! অন্তত ইহকালে? কোনই ব্যবস্থা নিচ্ছেন না তাদের স্রষ্টা। এমনকি ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম বলে বিশ্বাসী ২৩.২ শতাংশ মুসলমান ধর্মাবলম্বীর একমাত্র উপাস্য আল্লাহ্‌ এবং একমাত্র ধর্ম ইসলাম - এর বাইরে থাকা, একে সরাসরি অস্বীকার করে ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে থাকা ৬৫.১৩ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৪৬২ কোটি ১১ লাখ ভিন্নধর্মাবলম্বীর বিরুদ্ধেও সামষ্টিক কোন কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়না আল্লাহ্‌কে! অথচ গোটা পৃথিবী জুড়ে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করতে দেখলেই হিংস্রতা হাতিয়ার করে তেড়ে আসতে দেখা যায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী দাবিদার কিছু মুসলমানদের!

এই বাংলাদেশেও বিরুদ্ধমত তো দূরের কথা নূন্যতম ভিন্নমতকেও মানতে, সহ্য করতে প্রস'ত নয় ইসলামের বরকন্দাজ বলে দাবিদার ধর্মবেত্তারা। ঝাঁপিয়ে পড়ে আদিম হিংস্রতায়। আল্লাহ্‌র স্বভাব বিরুদ্ধ, আল্লাহ্‌র ধর্ম বিরুদ্ধ এইসব ধর্মীয় মতলববাজ ধর্মব্যবসায়ীদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে, হয়ে থাকতে দেখা যায় প্রায়শ:ই সাধারণ ধর্মভীরু মুসলমানদের। জাতীয় কবি বলে অভিহিত সাধক নজরুল এই ঘোর বিভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করার সাহসী প্রচেষ্টায় তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন-“আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু / আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করনি প্রভু”। একুশ শতকের মহা স্রোতধারায় ভাসছে পৃথিবী, ভাসছি আমরা। সত্য উপলব্ধিবোধে জেগে উঠার এই তো সময়।

লড়াইটা সামনে চলে আসছে

লড়াইটা সামনে চলে আসছে

শাহ্‌ সারফুল ইসলাম মাহমুদ ॥ ধর্মীয় ঐতিহাসিক ধাপ্পার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিসৱান নামক উদ্ভট রাষ্ট্র ফাঁকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে শান্তি, সাম্য ও মানবতার ধর্ম ইসলামকে বিকৃত করায় হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় শোষণ, বঞ্চনা আর প্রতারণার মোক্ষম হাতিয়ার। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা বন্ধ হওয়ার যে রক্তার্জিত সুযোগটি এসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তা হাতছাড়া হয়ে যায় দুর্ভাগ্যক্রমে। পাকিস্তানির বাংলা সংস্করণ হিসেবে অঘোষিতভাবে তাই দেশটাকে বাংলাস্তানে রূপান্তরিত করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন চলে সুনিপুণভাবে বিগত কয়েক দশক ধরে। ধর্মের অপব্যবহারে পাকিস্তানি ঘৃণিত ধারাটি ফুলে ফেঁপে উঠে নানান উপধারায় বিস্তৃত হয়ে হয়ে পরিবার প্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্র সর্বত্র আজ সয়লাব হয়ে আছে। আর তারই উর্বর জমিনে নিরন্তর গজিয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতার বিষচারা এখানে সেখানে সারাদেশে পরিকল্পিত, সুপরিকল্পিত বা কখনো অপরিকল্পিতভাবে। একই সঙ্গে বিগত দশকগুলোতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নিয়ে ধর্ম হয়ে উঠেছে প্রায় পুঁজি ছাড়া অতি মুনাফার রমরমা ব্যবসা। সমাজের সর্বস্তরে অর্থনীতির সর্বখাতে জেঁকে বসা চতুর এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষায় তৎপর তটস্থ থাকে সারাৰণ। থরে থরে মিথ্যার যে পসরা সাজিয়ে অধর্মের ব্যবসা তারা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে সত্যের আঘাত আসতে দেখলে এরা মরিয়া হয়ে উঠে, খসে পড়ে এদের ধর্ম মুখোশ, স্বরূপ নিয়ে মারমুখী হয়ে উঠে আদিম হিংস্রতা। সত্যকে এরা ভয় পায়। সত্যকণ্ঠের টুটি চেপে ধরতে চায় কিন্তু সত্যের মুখোমুখি হতে চায়না। তাই তো একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্টের উচ্চারিত সত্যের মুখোমুখি তারা হলনা। উল্টো তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল, তাঁর বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইছে তাঁর উচ্চারিত সত্যকে। তিনি বলেছিলেন, আবু হুরায়রা নামের অর্থ বিড়ালের বাবা। এরা বলতে পারেনি যে তিনি ভুল বলেছেন, মিথ্যা বলেছেন। আবার তার এই সত্যটুকু মানুষ জেনে যাক এটা ওরা মানতে চায়না। কারণ এ সত্যটা এরূপ ঢেকে থাকা চাপা দিয়ে রাখা সত্যগুলো প্রকাশ হয়ে পড়লে উদ্ভট আরবি শব্দে নাম রাখতে আর যাবেনা কেউ।
বাঙালির সন্তান বাংলা শব্দে নাম রাখার তাগিদ উঠে আসবে সামনে। এরা মানুষকে সত্য জানতে দিতে চায়না। সত্য নিয়ে ভাবতে দিতেও চায়না। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান রাষ্ট্রপতির নাম হয় মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী অর্থাৎ তার নিজের মাতৃভাষায়। ডাকাত সৌদি রাজবংশের নামে পবিত্রভূমি আরবের নাম কেন হল সৌদি আরব, কেন এর নাম হবেনা মোহাম্মদী আরব এ প্রশ্ন সমগ্র পৃথিবীজুড়ে। প্রশ্ন উঠছে কাবাশরীফের দরজাগুলোর নাম বাদশাহ্‌দের নামে দেয়া হয়েছে কোন সাহাবীদের নামে নয়। রাষ্ট্রীয় ধর্ম ব্যবসায়ী  সৌদি বাদশাহ্‌দের বিরুদ্ধে যেতে পারে না এরা। কারণ তারাও যে ধর্মব্যবসায়ী। আরবীয় সংস্কৃতির পোশাক হিজাবকে ইসলামী সংস্কৃতির পোশাক বলে চালিয়ে দেয়ার চাতুরিপনা ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন হিজাব একটি আরবীয় সংস্কৃতির পোশাক, বাঙালির নয়। ধর্মান্ধতার লেবাসে মানুষকে ঢেকে দিতে পারলেই তার মুক্তচিন্তার দুয়ার বন্ধ থাকবে, অন্ধ হয়ে থাকা মানুষদের ধর্ম ব্যবসার শিকার করা তখন সহজ হয়ে উঠে।
ব্যক্তি আব্দুল গাফফার চৌধুরী নয় আব্দুল গাফফার চৌধুরী যে সত্যকে ধারণ করেছেন তাদের আক্রোশ ওই সত্যটার উপর। আব্দুল গাফফার চৌধুরী  ‘একুশ’- কে ধারণ করেছিলেন তাই লিখেছিলেন একুশ নিয়ে অমর গাঁথা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো............’। ‘একুশ’ মানে মাতৃভাষা, একুশ মানে শহীদ মিনার, মাতৃভাষা সত্য, বাঙালির মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা সত্য। একুশে ফেব্রুয়ারি সত্য। আর সত্য একুশে ফেব্রুয়ারির অমর স্মৃতি, অবিনাশী চেতনা - একুশে চেতনার প্রতীক অমর শহীদ মিনার। এই সত্যকে এরা মানতে চায়না মন থেকে। তাই ছয় দশক পার হয়ে গেলেও এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৪ বছরেও এদেশের কোন মাদ্রাসায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতে দেখা যায়না, দেখা যায়না মাদ্রাসায় কোন শহীদ মিনার। এরা সত্যোদ্রোহী, এরা বাঙালিদ্রোহী, এরা রাষ্ট্রদোহী। তাই এরা সংবিধান মানেনা। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের ১(১)-এর ক-অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া আছে “প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।” আব্দুল গাফফার চৌধুরী সত্য ধর্ম ইসলামকে ধারণ করেন তাই সত্য প্রচার তার সাংবিধানিক অধিকার। এই অনুচ্ছেদের প্রথমে বলা আছে আইন, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে......। গাফফার চৌধুরী কোন আইন ভঙ্গ করেননি।
ফৌজদারি কার্যবিধি ধর্মসংক্রান্ত আপরাধসমূহ সম্পর্কিত ধারা ২৯৫-এ অপরাধের বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে “কোন কোন বিশেষ ধর্মবোধে অবমাননা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে উপাসনালয়ের ক্ষতিসাধন করা বা অপবিত্র করা।” তিনি তা করেননি। ধারা ২৯৬-এ বলা হয়েছে - “ধর্মীয় সমাবেশে গোলমাল সৃষ্টি” , ধারা ২৯৭- এ বলা হয়েছে - “সমাধিস্থান ইত্যাদিতে অনাধিকার প্রবেশ”- তিনি তাও করেননি। ধারা ২৯৮-এ বলা হয়েছে - “ধর্মীয় অনুভূতি

আহত করিবার উদ্দেশ্যমূলক অভিসন্ধিক্রমে শব্দ ইত্যাদি উচ্চারণ করা।” গাফফার চৌধুরী ৩ রা জুলাই ২০১৫ স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ বালাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত “বাংলাদেশ-অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ” শীর্ষক বক্তৃতায় প্রাসঙ্গিক আলোচনা কতগুলো সত্য উচ্চারণ করেন। ধর্মীয় অনুভূতি আহত করার উদ্দেশ্যে নয় সত্য অনুভূতি জাগিয়ে তোলাই ছিল তার উদ্দেশ্য। বিড়ালের বাবা আর ছাগলের বাবার সাথে ধর্মীয় অনুভূতির কোন সম্পর্ক থাকতে পারেনা। পার্শিয়ানদের সাথে খোদা শব্দ, নামাজ শব্দ না রোজা শব্দের সাথে ধর্মীয় অনুভূতি জড়াতে পারে না। আরবি শব্দ আল্লাহ্‌,  আরবি শব্দ সালাত, আরবি শব্দ সিয়াম-কুরআন বর্ণিত, তার সাথেও ধর্মীয় অনুভূতির কোন সম্পর্ক থাকার কথা নয়। থাকলে তো অগ্নি পূজারী পার্শিয়ানদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে তাদের মাতৃভাষায় আল্লাহ্‌ কে খোদা, সালাত কে নামাজ আর সিয়ামকে রোজা বানিয়ে ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিকে (!!!) চরম আহত করে রেখেছে কয়েক’শ বছর ধরে এবং এ দেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা পার্শিয়ানদের খোদা, নামাজ এবং রোজার পরম্পরা ধরে রেখে ওই ধর্মীয় অনুভূতিকে একেবারেই নিহত-ই করে বসে আছে। তারা ওই ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত নিহত করে থাকলে অন্ততপক্ষে এ দেশীয়দের ফৌজদারি কার্যবিধি ২৯৮ ধারায় আগে সোপর্দ করা দরকার। সংবিধান বর্ণিত আইন তাই গাফফার চৌধুরী নয় তাকে কালিমালিপ্ত করতে, তার সত্যের টুটি চেপে ধরতে গিয়ে এদেশের ধর্মব্যবসায়ীরাই ভেঙে চলছে দেশের আইন। একইভাবে জনশৃঙ্খলা ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিবৃতিবাজরা। গাফফার চৌধুরীর সত্য উচ্চারণে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠা ধর্মব্যবসায়ীরা। সংবিধানের ৪১ (১) অনুচ্ছেদে অপর যে শব্দটি  ব্যবহৃত হয়েছে নৈতিকতা। গাফফার চৌধুরী ধর্মের নামে জগদ্দল পাথরের মতন গণমানুষের  বদ্ধমূল হয়ে থাকা কতক অসত্যের মূল ধরে টান দিয়েছিলেন নৈতিক অবস্থান থেকে যুক্তি উপস্থাপন করে। অপরদিকে তার উচ্চারিত যুক্তিগুলোকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের পরিবর্তে ধর্মব্যবসায়ীরা ও বিবৃতিবাজরা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির নামে অনৈতিকতার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। লঙ্ঘন করেছে সংবিধান, লিপ্ত হয়েছে ফৌজদারি অপরাধে। গাফফার চৌধুরী নয় অবিলম্বে ফৌজদারি অপরাধে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা দরকার। গাফফার চৌধুরী নয় এদের নাগরিকত্ব বাতিল করে জাহাজ ভর্তি করে এদের পাঠিয়ে দেয়ার সময় এসেছে এদের জন্ম উৎসভূমি পাকিস্তানে। সত্যকে কিছুদিন ঢেকে রাখা যায়, কিছু বছর, বড় জোর কিছু যুগ তার বেশি নয়। ১৪০০ বছর ধরে ইসলাম ধর্মের নামে চাপিয়ে দেয়া মিথ্যার মুখোমুখি এখন সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। মিথ্যার মুখোমুখি সত্য, লড়াইটা সামনে চলে আসছে।

মাদ্রাসায় জঙ্গিঃ বাংলার গ্রামে ধর্মের চেহারা

মাদ্রাসায় জঙ্গিঃ বাংলার গ্রামে ধর্মের চেহারা

সংলাপ ॥ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আজকের বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরের প্রতিটি জনপদই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস্‌ ও শান্তি কমিটির দুর্বৃত্তরা ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে কায়েমী স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে এক প্রকারের রাজত্ব কায়েম করে রাখলেও সাধারণ মানুষের কাছে ছিল তারা ঘৃণিত। তারা সদা তটস্থ থাকতো মুক্তিবাহিনীর ভয়ে। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও এই সব রাজাকার ও গণধিকৃত মানুষ বিনা বিচারে বেঁচে আছে, হয়ত এটা তাদের কাছেই রীতিমত বিস্ময়কর ব্যাপার।
’৭১ এবং এর আগে বাংলাদেশের মাটি, গ্রাম-গঞ্জ,শহর-বন্দরের কোনো জনপদে জঙ্গী বলতে কোনো কিছু ছিল না। অভাব অনটন থাকলেও ধর্মীয় মূল্যবোধটা ছিল যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে। কোনো গ্রামে সুদখোর থাকলেও সে যতই অর্থ সম্পত্তির মালিক হোক না কেন, সুদখোরের  সাথে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতেও অনেকের দ্বিধা থাকতো, রীতিমত ঘৃণার পাত্র ছিল সুদখোরেরা। আর ঘুষখোর চাকরিজীবিদেরকেও এড়িয়ে  চলতো সাধারণ মানুষেরা। অথচ আজকাল সুদখোর, ঘুষখোরদের সেই দুর্দিন আর নেই। এই সুদখোর, ঘুষখোরদের টাকাতেই তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে অনেক মাদ্রাসা, মসজিদ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজও। ধর্মব্যবসায়ী স্বাধীনতা বিরোধী এজিদপন্থী ইসলামী দলগুলোর নেতারাই আবার সেখানে সমাজপতি সেজে বসেছেন। এই নেতারা বা তাদের দোসররাই আবার কখনো কখনো জনপ্রতিনিধি মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমপি-মন্ত্রীও হয়েছেন। ফলে ’৭১ এ বাংলার যে জনপদ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়ারণ্য সেখানে আজ দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসার নামে জঙ্গী উৎপাদনের আঁখড়া।
জঙ্গীর পরিচয়, তার ছদ্মবেশ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে দেশের ধর্ম-ব্যবসায়ীদের তৎপরতা আঁচ করা যায়। শুধু টুপি-দাঁড়ি-পাঞ্জাবী এবং মুখে আরবী কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত হতে দেখলেই তাদেরকে আদর-যত্ন করে দান-খয়রাত করার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে না পারলে এই জঙ্গীদের খপ্পড় থেকে রক্ষা পাবে না  কেউই। আর আমাদের দেশের বাণিজ্যিক মিডিয়াগুলোতে এই জঙ্গীদের ছবি যেভাবে ছাপা শুরু হয়েছে তাতে সাধারণ জনগণ আরো বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে মিডিয়ার পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদেরও ভেবে দেখা দরকার।
আরো ভয়াবহ হচ্ছে বাংলার গ্রামগুলোতে এখন আর কোনো কথিত প্রতিষ্ঠিত ও শিক্ষিত ব্যক্তিকে বাস করতে দেখা যায় না, অথচ এই ব্যক্তিদের অধিকাংশেরই জন্ম ও প্রাথমিক বেড়ে উঠা এই গ্রামগঞ্জের অলিগলিতে। আজ তারাই ফ্ল্যাটে বা অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গিয়ে গ্রাম-গঞ্জকে অবজ্ঞার চোখে দেখে, যদিও জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেশী-বিদেশী সকল সুযোগ সুবিধা নেয়ার জন্য গ্রাম-গঞ্জের ভোটারদের দারস্থ হতে তাদের বিন্দু পরিমাণ দ্বিধাও হয় না। এসব পরিস্থিতির আড়ালে গ্রামে আসৱানা গড়ে তুলছে ধর্মের নামে সৌদি-ওহাবী-পাকিসৱানি তথা ব্রিটিশ-আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় এজিদী ইসলামের ধারক-বাহকরা। ধর্মের নামে অশান্তি, অনাচার, ধর্মান্ধতা, বর্বরতার উর্বর স্থান তৈরি করে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামগুলোতে ধর্মভীরুদের মাঝে আনছে অশান্তি আর দারিদ্র্য। ফায়দা লুটছে ধর্মব্যবসায়ীরা। হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-মক্তবে লাখো লাখো নতুন প্রজন্মকে জানতে দেয়া হয় না নিজের দেশ, সমাজ ও মানবধর্মের আসল পরিচয়। এতকিছুর পরেও ধর্মব্যবসায়ীরা বাংলার মানুষের ভালবাসা পাচ্ছে না, বাংলার মাটিকে মরুভূমি বানাতে আজো তারা সফল হয়ে উঠতে পারেনি। জনতার বিজয়ের প্রতিফলন ও পুরষ্কার গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে সরকার তার ভূমিকা পালন করছে কিন্তু কতটুকু করছে তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। কেননা বিশ্বাস ভঙ্গকারীদেরকে কেউ ক্ষমা করে না। তাই দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার গ্রাম-বাংলার মানুষকে ভালবেসে ধর্মের সত্য ও আসল কথাটুকু জানিয়ে দেয়া। গ্রাম বাংলা তথা দেশের সার্বিক অগ্রগতির স্বার্থে বর্তমান সরকারের জন্য একাজটুকু আজকের দিনে জরুরি দায়িত্ব ও কর্তব্য। 

বুধবার, ২২ জুলাই, ২০১৫

সত্য-উপলব্ধি কি আমরা হারাতে বসেছি?


সত্য-উপলব্ধি কি আমরা হারাতে বসেছি?

সে নিজের ধর্ম, রাসূল আল্লাহকে চিনতে পারবে যে নিজের মা, মাতৃভাষা মাতৃভূমিকে ভালবাসতে শ্রদ্ধা করতে শিখেছে

সংলাপ? একজন সাধকের এই আপ্তবাক্যের মর্মার্থ উপলব্ধির সময় এসেছে আজ ধর্মীয় অনুভূতির আবর্তে আমরা সবাই আবর্তিত আবেগ তাড়িত তথাকথিত ধর্মীয় বিশ্বাসে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না সত্যের দর্শন নিজের অন্যের কল্যাণিক চিন্তা-চেতনায় ধারণ করতে চাই সত্যকে কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? এই মাটিতে কোন্সত্যে প্রতিষ্ঠিত করবো নিজেকে?
মাশব্দটি স্বর ব্যঞ্জন বর্ণের এক অপূর্ব অনন্য সুষমা মন্ডিত সমন্বিত রূপ সঙ্গীতে স্বরগ্রামে মধ্যমের সংক্ষেপাক্ষরও বটে আভিধানিক অর্থের সীমানা ডিঙিয়েমাএক শাশ্বত চেতনার উৎস কেবল জন্মের কৃতজ্ঞতায় নয়, অস্তিত্বের প্রগাঢ় বন্ধনে মন্থনেমামানেই দুর্বার অঙ্গীকার শ্রদ্ধাবনত চিত্তে লালিত এক স্বপ্নগুচ্ছমাথেকেই অস্তিত্বের প্রকাশমায়েতেই অস্তিত্বের লালনমায়েই অস্তিত্বের বিকাশ
আক্ষরিক গঠনেমাযত ছোটই হোক না কেন, চেতনায় এর  বিস্তৃতি ব্যাপক, বিশাল তাইমাকেবল ঘরের চার দেয়ালে আদর্শ গৃহিনীর আঙ্গিক নিয়েই আবদ্ধ থাকেনি ছড়িয়ে পড়েছে কালিক বোধের উত্তরণে মর্মে মর্মে, জীবনে জীবনে একমাত্র ঠিকুজী রূপে সৃষ্টির মহত্তর আনন্দে অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে যেমাআমাদের এনে দেন পৃথিবীর আলোয় আগলে রাখেন স্নেহের সুশীতল আঁচলে দেহে দেন পুষ্টি আর মুখে দেন বুলি বুলি মানে কথা কথা মানে ভাষা ভাষা মায়ের ভাষা মাতৃভাষা মায়ের কোল থেকে আত্মনির্ভর হওয়ার আকাঙ্খায় পা রাখি যে ভূমিতে সেও আমার মায়ের ভূমি মাতৃভূমি সুতরাং সূত্রের অবিচ্ছিন্ন অনিবার্য সত্যে মা, মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি এক চেতনায় গাঁথা অস্তিত্বের স্তর  বিন্যাসমাত্রা
জীবনের সফল উত্তরণেমাএক অবিকল্প সোপান-বেদী যে সন্তান তার জন্মদাত্রীমা’-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল কর্তব্যপরায়ণ, তার সাফল্য অনিবার্য কিন্তু যে তার নিজ মায়ের প্রতি অনুরক্ত নয়, নিজের মাকে যে শ্রদ্ধা করতে বা ভালবাসতে জানেনি বা শেখেনি, সে কখনো আদর্শিক সন্তান হতে পারে না অনাদর্শিক জীবনের যাত্রায় সে তখন নিজ ভাষা, নিজ জন্মভূমির প্রতি উদাসীন বা বিরাগী হওয়া খুবই স্বাভাবিক
দেশ চায় আদর্শ নাগরিক কিন্তু কোথায় সে আদর্শ নাগরিক? কীভাবেই বা হওয়া যায় আদর্শ নাগরিক? একজন নাগরিক একজন সন্তানও দেশ মা’-তুল্য বা আখ্যায়িত বলা হয়, ‘জননী, জন্মভূমি স্বর্গদপী গরিয়সীমা, মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে যিনি আসীন, সেইমাকেমন আদর্শের প্রতীক এবং কতটুকু শ্রদ্ধাভাজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে নামা’-এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই রাজনৈতিক অঙ্গনে এসেছে, ‘আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি সুন্দর জাতি দিবসুতরাং একটি সুন্দর দেশ একটি সুন্দর জাতি গড়বার ক্ষেত্রেমাকতটা গুরুত্ব বহন করে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায় সেইমা’-কে উপেক্ষা করে কোনভাবেই কি কেউ দেশ জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে?
মায়ের কাছে শেখা বুলি তথা মাতৃভাষার প্রতি তখনই শ্রদ্ধা প্রীতি জন্মাবে এবং প্রগাঢ় হবে যখন মায়ের প্রতি গভীর সুদৃঢ় আনৱরিক বন্ধন থাকে কেননা মা-বোধ তখন আদর্শিক চেতনায় তাকে অনুপ্রাণিত করবেমাতথাআত্মবিকাশে ভাষাই সেই বিকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যম তাই মাতৃভাষার চর্চা শ্রীবৃদ্ধিতে তার জাগে আন্তরিকতা নতুবা ভিন্ন ভাষার প্রতি মোহ দিন দিন বাড়তেই থাকবে আন্তর্জাতিক বিলাসিতায় রুচির বিকৃত ধারায় সে ছুঁতে উদগ্রীব হবে ভিন্ন ভাষা ভিন্ন ভাষীকে গ্রাস হবে অন্যের ছিন্ন হবে আপন বলয় থেকে উপড়ে যাবে মূল শিকড় টবে রাখা গাছের মত সে তখন প্রোথিত হবে ভিন্ন ভূমিতে অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের সীমারেখায় হবে বন্দি শোষিত নিজস্ব ভুবনের অনন্ত আলো-বাতাস এবং মুক্ত দিগন্ত যাবে হারিয়ে ভয়ংকর সেই পতনের কথা আমরা কি স্মরণে রাখি?
ভিন্ন ভাষা প্রীতি, ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা করে যারা নিজেদের আন্তর্জাতিক করতে চায় তারা কি প্রথমেই তার মা-মাতৃভূমি, মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত? ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন সংস্কৃতির আবর্তে নিজেকে চালিত করে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না জীবনের ভিত্তি পতিত ব্যক্তির সমষ্টিতে জাতির জীবনেও নেমে আসে বিপর্যয় এই সত্য - উপলব্ধি কি আমরা হারাতে বসেছি?
নববর্ষের শুভাগমনে আমরা বাঙালি জাগ্রত হই নিজস্ব সত্তা আর চিন্তা চেতনায় এই চাওয়া সার্থক হবে যখন আমরা ভালোবাসতে শিখব আপনমা’-কে, ভালোবাসতে পারব মাতৃভাষা বাংলা-কে, ভালোবাসতে জানব মাতৃভূমি বাংলাদেশ-কে
ভালোবাসার এই ক্রমধারা অটুট অকৃত্রিম রেখে আবার আমরা হই জাগ্রত চিত্ত বাঙালি - দেশ জাতিকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করি আদর্শ হিসাবে