বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫

লড়াইটা সামনে চলে আসছে

লড়াইটা সামনে চলে আসছে

শাহ্‌ সারফুল ইসলাম মাহমুদ ॥ ধর্মীয় ঐতিহাসিক ধাপ্পার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিসৱান নামক উদ্ভট রাষ্ট্র ফাঁকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে শান্তি, সাম্য ও মানবতার ধর্ম ইসলামকে বিকৃত করায় হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় শোষণ, বঞ্চনা আর প্রতারণার মোক্ষম হাতিয়ার। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা বন্ধ হওয়ার যে রক্তার্জিত সুযোগটি এসেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তা হাতছাড়া হয়ে যায় দুর্ভাগ্যক্রমে। পাকিস্তানির বাংলা সংস্করণ হিসেবে অঘোষিতভাবে তাই দেশটাকে বাংলাস্তানে রূপান্তরিত করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন চলে সুনিপুণভাবে বিগত কয়েক দশক ধরে। ধর্মের অপব্যবহারে পাকিস্তানি ঘৃণিত ধারাটি ফুলে ফেঁপে উঠে নানান উপধারায় বিস্তৃত হয়ে হয়ে পরিবার প্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্র সর্বত্র আজ সয়লাব হয়ে আছে। আর তারই উর্বর জমিনে নিরন্তর গজিয়ে উঠেছে ধর্মান্ধতার বিষচারা এখানে সেখানে সারাদেশে পরিকল্পিত, সুপরিকল্পিত বা কখনো অপরিকল্পিতভাবে। একই সঙ্গে বিগত দশকগুলোতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নিয়ে ধর্ম হয়ে উঠেছে প্রায় পুঁজি ছাড়া অতি মুনাফার রমরমা ব্যবসা। সমাজের সর্বস্তরে অর্থনীতির সর্বখাতে জেঁকে বসা চতুর এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাদের কায়েমী স্বার্থ রক্ষায় তৎপর তটস্থ থাকে সারাৰণ। থরে থরে মিথ্যার যে পসরা সাজিয়ে অধর্মের ব্যবসা তারা চালিয়ে যাচ্ছে তাতে সত্যের আঘাত আসতে দেখলে এরা মরিয়া হয়ে উঠে, খসে পড়ে এদের ধর্ম মুখোশ, স্বরূপ নিয়ে মারমুখী হয়ে উঠে আদিম হিংস্রতা। সত্যকে এরা ভয় পায়। সত্যকণ্ঠের টুটি চেপে ধরতে চায় কিন্তু সত্যের মুখোমুখি হতে চায়না। তাই তো একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্টের উচ্চারিত সত্যের মুখোমুখি তারা হলনা। উল্টো তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল, তাঁর বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইছে তাঁর উচ্চারিত সত্যকে। তিনি বলেছিলেন, আবু হুরায়রা নামের অর্থ বিড়ালের বাবা। এরা বলতে পারেনি যে তিনি ভুল বলেছেন, মিথ্যা বলেছেন। আবার তার এই সত্যটুকু মানুষ জেনে যাক এটা ওরা মানতে চায়না। কারণ এ সত্যটা এরূপ ঢেকে থাকা চাপা দিয়ে রাখা সত্যগুলো প্রকাশ হয়ে পড়লে উদ্ভট আরবি শব্দে নাম রাখতে আর যাবেনা কেউ।
বাঙালির সন্তান বাংলা শব্দে নাম রাখার তাগিদ উঠে আসবে সামনে। এরা মানুষকে সত্য জানতে দিতে চায়না। সত্য নিয়ে ভাবতে দিতেও চায়না। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ার মুসলমান রাষ্ট্রপতির নাম হয় মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী অর্থাৎ তার নিজের মাতৃভাষায়। ডাকাত সৌদি রাজবংশের নামে পবিত্রভূমি আরবের নাম কেন হল সৌদি আরব, কেন এর নাম হবেনা মোহাম্মদী আরব এ প্রশ্ন সমগ্র পৃথিবীজুড়ে। প্রশ্ন উঠছে কাবাশরীফের দরজাগুলোর নাম বাদশাহ্‌দের নামে দেয়া হয়েছে কোন সাহাবীদের নামে নয়। রাষ্ট্রীয় ধর্ম ব্যবসায়ী  সৌদি বাদশাহ্‌দের বিরুদ্ধে যেতে পারে না এরা। কারণ তারাও যে ধর্মব্যবসায়ী। আরবীয় সংস্কৃতির পোশাক হিজাবকে ইসলামী সংস্কৃতির পোশাক বলে চালিয়ে দেয়ার চাতুরিপনা ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন হিজাব একটি আরবীয় সংস্কৃতির পোশাক, বাঙালির নয়। ধর্মান্ধতার লেবাসে মানুষকে ঢেকে দিতে পারলেই তার মুক্তচিন্তার দুয়ার বন্ধ থাকবে, অন্ধ হয়ে থাকা মানুষদের ধর্ম ব্যবসার শিকার করা তখন সহজ হয়ে উঠে।
ব্যক্তি আব্দুল গাফফার চৌধুরী নয় আব্দুল গাফফার চৌধুরী যে সত্যকে ধারণ করেছেন তাদের আক্রোশ ওই সত্যটার উপর। আব্দুল গাফফার চৌধুরী  ‘একুশ’- কে ধারণ করেছিলেন তাই লিখেছিলেন একুশ নিয়ে অমর গাঁথা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো............’। ‘একুশ’ মানে মাতৃভাষা, একুশ মানে শহীদ মিনার, মাতৃভাষা সত্য, বাঙালির মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা সত্য। একুশে ফেব্রুয়ারি সত্য। আর সত্য একুশে ফেব্রুয়ারির অমর স্মৃতি, অবিনাশী চেতনা - একুশে চেতনার প্রতীক অমর শহীদ মিনার। এই সত্যকে এরা মানতে চায়না মন থেকে। তাই ছয় দশক পার হয়ে গেলেও এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৪ বছরেও এদেশের কোন মাদ্রাসায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতে দেখা যায়না, দেখা যায়না মাদ্রাসায় কোন শহীদ মিনার। এরা সত্যোদ্রোহী, এরা বাঙালিদ্রোহী, এরা রাষ্ট্রদোহী। তাই এরা সংবিধান মানেনা। বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের ১(১)-এর ক-অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া আছে “প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে।” আব্দুল গাফফার চৌধুরী সত্য ধর্ম ইসলামকে ধারণ করেন তাই সত্য প্রচার তার সাংবিধানিক অধিকার। এই অনুচ্ছেদের প্রথমে বলা আছে আইন, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে......। গাফফার চৌধুরী কোন আইন ভঙ্গ করেননি।
ফৌজদারি কার্যবিধি ধর্মসংক্রান্ত আপরাধসমূহ সম্পর্কিত ধারা ২৯৫-এ অপরাধের বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে “কোন কোন বিশেষ ধর্মবোধে অবমাননা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে উপাসনালয়ের ক্ষতিসাধন করা বা অপবিত্র করা।” তিনি তা করেননি। ধারা ২৯৬-এ বলা হয়েছে - “ধর্মীয় সমাবেশে গোলমাল সৃষ্টি” , ধারা ২৯৭- এ বলা হয়েছে - “সমাধিস্থান ইত্যাদিতে অনাধিকার প্রবেশ”- তিনি তাও করেননি। ধারা ২৯৮-এ বলা হয়েছে - “ধর্মীয় অনুভূতি

আহত করিবার উদ্দেশ্যমূলক অভিসন্ধিক্রমে শব্দ ইত্যাদি উচ্চারণ করা।” গাফফার চৌধুরী ৩ রা জুলাই ২০১৫ স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ বালাদেশ স্থায়ী মিশন আয়োজিত “বাংলাদেশ-অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ” শীর্ষক বক্তৃতায় প্রাসঙ্গিক আলোচনা কতগুলো সত্য উচ্চারণ করেন। ধর্মীয় অনুভূতি আহত করার উদ্দেশ্যে নয় সত্য অনুভূতি জাগিয়ে তোলাই ছিল তার উদ্দেশ্য। বিড়ালের বাবা আর ছাগলের বাবার সাথে ধর্মীয় অনুভূতির কোন সম্পর্ক থাকতে পারেনা। পার্শিয়ানদের সাথে খোদা শব্দ, নামাজ শব্দ না রোজা শব্দের সাথে ধর্মীয় অনুভূতি জড়াতে পারে না। আরবি শব্দ আল্লাহ্‌,  আরবি শব্দ সালাত, আরবি শব্দ সিয়াম-কুরআন বর্ণিত, তার সাথেও ধর্মীয় অনুভূতির কোন সম্পর্ক থাকার কথা নয়। থাকলে তো অগ্নি পূজারী পার্শিয়ানদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে তাদের মাতৃভাষায় আল্লাহ্‌ কে খোদা, সালাত কে নামাজ আর সিয়ামকে রোজা বানিয়ে ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিকে (!!!) চরম আহত করে রেখেছে কয়েক’শ বছর ধরে এবং এ দেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা পার্শিয়ানদের খোদা, নামাজ এবং রোজার পরম্পরা ধরে রেখে ওই ধর্মীয় অনুভূতিকে একেবারেই নিহত-ই করে বসে আছে। তারা ওই ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত নিহত করে থাকলে অন্ততপক্ষে এ দেশীয়দের ফৌজদারি কার্যবিধি ২৯৮ ধারায় আগে সোপর্দ করা দরকার। সংবিধান বর্ণিত আইন তাই গাফফার চৌধুরী নয় তাকে কালিমালিপ্ত করতে, তার সত্যের টুটি চেপে ধরতে গিয়ে এদেশের ধর্মব্যবসায়ীরাই ভেঙে চলছে দেশের আইন। একইভাবে জনশৃঙ্খলা ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে গাফফার চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিবৃতিবাজরা। গাফফার চৌধুরীর সত্য উচ্চারণে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠা ধর্মব্যবসায়ীরা। সংবিধানের ৪১ (১) অনুচ্ছেদে অপর যে শব্দটি  ব্যবহৃত হয়েছে নৈতিকতা। গাফফার চৌধুরী ধর্মের নামে জগদ্দল পাথরের মতন গণমানুষের  বদ্ধমূল হয়ে থাকা কতক অসত্যের মূল ধরে টান দিয়েছিলেন নৈতিক অবস্থান থেকে যুক্তি উপস্থাপন করে। অপরদিকে তার উচ্চারিত যুক্তিগুলোকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে খণ্ডনের পরিবর্তে ধর্মব্যবসায়ীরা ও বিবৃতিবাজরা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির নামে অনৈতিকতার আশ্রয় গ্রহণ করেছে। লঙ্ঘন করেছে সংবিধান, লিপ্ত হয়েছে ফৌজদারি অপরাধে। গাফফার চৌধুরী নয় অবিলম্বে ফৌজদারি অপরাধে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা দরকার। গাফফার চৌধুরী নয় এদের নাগরিকত্ব বাতিল করে জাহাজ ভর্তি করে এদের পাঠিয়ে দেয়ার সময় এসেছে এদের জন্ম উৎসভূমি পাকিস্তানে। সত্যকে কিছুদিন ঢেকে রাখা যায়, কিছু বছর, বড় জোর কিছু যুগ তার বেশি নয়। ১৪০০ বছর ধরে ইসলাম ধর্মের নামে চাপিয়ে দেয়া মিথ্যার মুখোমুখি এখন সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। মিথ্যার মুখোমুখি সত্য, লড়াইটা সামনে চলে আসছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন