মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০১৩

মুক্তিপাগল চেতনায় বিভ্রান্ত পদচারণা!


মুক্তিপাগল চেতনায়
বিভ্রান্ত পদচারণা!
 

সংলাপ ॥ সারা বিশ্বে বাঙালি জাতি অত্যুজ্জ্বল তার গৌরবময় স্বাতন্ত্রে। প্রত্যেক জাতিরই আছে নির্দিষ্ট সংস্কৃতি যার পুস্প্রিত শাখায় প্রস্ফুটিত হয় সে জাতির স্বকীয় চিন্তা, চেতনা, ধ্যান-ধারণা অর্থাৎ তার স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। তার ভাষাতেই প্রবাহিত হয় সত্ত্বার সলিল ধারা। স্বভাবতঃ তাই সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জাতির প্রাণের সম্পদ, অচ্ছেদ্য হৃদ-স্পন্দন। আর তাই কখনও যদি কেউ সে হৃদ-স্পন্দনে ধর্মের নামে যমের কালো থাবা বসাতে চায় কিংবা প্রাণের সম্পদ জবর দখল করে ফলাতে চায় স্ব-ইচ্ছার ফসল তখনই সোচ্চার হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, অস্তিত্বের ভিত্তি রাখতে সুদৃঢ় হয়ে ওঠে উৎসর্গিত প্রাণ। এই সত্য প্রমাণ করেছে একমাত্র বাঙালি জাতি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে। নিঃসঙ্কোচে দূরন্ত সাহসে বুকের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে সুরক্ষিত করেছে বাঙালি জাতি, অমূল্য মানিক-বাংলা ভাষা। শুধু ইতিহাসের ধূলিধূসর কালো অক্ষরে নয়, সমস্ত বাঙালির সতেজ বুকে'২১ তাই এক অমর অমলিন রক্তাক্ত পোষ্টার।'২১ আসে। '২১ যায় না। প্রতিনিয়ত '২১ আমাদের বন্ধ দরজার কড়া নেড়ে আমাদের জাগায়। '২১ তার রাঙা বুকের আলিঙ্গনে আমাদেরও রাঙিয়ে তুলে নিত্য নতুন চেতনায়। প্রতিবারের মত এবারও '২১ এসেছিল সততঃ নিয়মে। কিন্তু এবারের যাত্রা সূক্ষ্ম কৌশলী। বাঙালি জাতির চরম পরীক্ষার।

মুখোশধারী বাঙালিদেরকে চিনিয়ে দিয়ে গেছে নীরব অভিমানে। রেখে গেছে কয়েকটি প্রশ্ন। অমীমাংসিত একটি প্রশ্নের (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার) পুনরুত্থানের মাধ্যমে।

'২১ জানিয়ে গেল, দেখিয়ে দিল সত্যিকার বাঙালির রূপ। প্রশ্ন হলো- 'ধর্মীয় চেতনা, না-কি জাতীয় চেতনা, কোনটা বড়? এ দুয়ের কোন সরোবরে স্নান করে সত্ত্বাকে পূত সজীব রাখতে হবে? '২১- এলেই মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের যে আন্তরিক ও আনুষ্ঠানিক কর্মতৎপরতা তা কি একে বারেই মূল্যহীন? 'সারিবদ্ধ বাঙালি উন্মুক্ত পায়ে ধীর লয়ে হেটে চলে। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। হাতে ফুল। মুখে অমর '২১-এর গান। বিভিন্ন নিবেদিত সংগঠনের বিচিত্র আল্পনা পথে পথে। অসংখ্য বাঙালির সমাবেশ শহীদ মিনার চত্বরে। বক্তৃতা, সেমিনার, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখরিত চতুর্দিক।' এমনই হয়ে থাকে, হয় প্রতি '২১-এ। কিন্তু প্রতিবারের মত এবারে বাঙালি তার নতুন রূপ দেখতে পেয়েছে? চির পরিচিত হৃদয়গ্রাহী সেই দৃশ্যের নতুন চিত্রায়ণ ঘটেছে। সমস্ত পথ জুড়ে 'জয়বাংলা' ধ্বনি। প্রবাহমান হৃদয় স্ফুরিত সুরের কম্পন। বিনীত পায়ের ধীর লয়। ভীড় পুষপার্ঘের বেদীমূলে। এবারের '২১-এর প্রতি সেই আবেগাপ্লুত বাঙালির হঠাৎ এ দৃঢ়ভাব কেন?

নির্বাচনের জন্য আনন্দ উৎসব আর ঘাতক-দালাল নির্মূল দৃঢ় প্রত্যয়ের মাঝে এবারের '২১ এর আবির্ভাব। দ্বিমুখী এই পথের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে বাঙালি হয়ে উঠছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রত্যয়ী। যে যার চিন্তার স্তর নিয়ে চলছে তার নির্দিষ্ট পথে।

অপরদিকে নির্বাচনের জন্য ক্ষমতার নির্লজ্জ লড়াই জনজীবনে প্রভাব ফেলেছে। পক্ষ-বিপক্ষের ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় সাধারণ বাঙালি হয়ে পড়ছে আতঙ্কিত। কিন্তু এই বিভ্রান্তকর পরিবেশ কি বাঙালির জীবনে নতুন? এর চেয়ে ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির মধ্যে '২১ এর সাথে একাত্ম হতে বাঙালি ছিল অকুন্ঠ স্বতঃস্ফূর্ত। আন্দোলনে হয়ে ওঠে আরো বেশী দীপ্তিময় আরো বেশী প্রাণোজ্জ্বল। '৫২র পর থেকে বাঙালির জীবনে এসেছে একের পর এক আন্দোলন। বাঙালির জীবন প্রবাহ বরাবরই বন্ধুর। আন্দোলন মুখর বাঙালি '২১-এর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েই এবারেও জয় করবে কাঙ্খিত মুক্তির সোনালী সূর্য। পরাধীনতার সেই নিগুঢ়ে বাঙালি যে কুঠারাঘাত হেনেছিল তা '২১রই শাশ্বত বিদ্রোহী মুক্তিপাগল চেতনারই চরম প্রকাশ।

বাকী আছে ধর্মান্ধমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। জাতীয় চেতনাকে ছাপিয়ে ধর্মীয় চেতনা কখনই প্রাধান্য বিস্তার লাভ করতে পারে না। আজ সমগ্র বিশ্বের মানচিত্রে একবার চোখ ফিরালেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। পূর্ব জার্মান ও পশ্চিম জার্মান তার বড় প্রমাণ। এই দুই দেশ জাতীয় সত্ত্বার অভিন্নতার কারণেই দীর্ঘদিন পরে হলেও উপড়ে ফেলেছে বিভক্তির দুর্ভোগ্য প্রাচীর। আগামীতে দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়াও যে একত্রীভূত হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কেননা, যে জাতির মধ্যে। তার জাতীয়বাদ প্রবলভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, সে জাতি কখনই বিভক্ত থাকতে পারে না। এর সত্যতা পাওয়া যায় ১৯৮৪ সালে সাংবাদিক সম্মেলনে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলে ছিলেন ‌'First we are Arab, Second Muslim'.

পাক ভারতে দ্বিজাতি তত্ত্বের মূলে ছিল ধর্মীয় জাত তত্ত্বের ঠুন্‌কো দ্বন্দ্ব। এই তত্ত্বকে পুঁজি করেই ভারত পাকিস্তানের সৃষ্টি। কিন্তু এই ঠুন্‌কো বন্ধনে বেশী দিন আবদ্ধ থাকলো না বাঙালি জাতি। দুই ভিন্ন জাতি সত্ত্বার একত্রে অবস্থান কোনদিনই সম্ভবপর নয়। ফলে স্বকীয় জাতীয় সত্ত্বাকে অক্ষুন্ন রাখার তাগিদেই অবধারিতভাবে বাঙালি ছিনিয়ে নিল স্বাধীনতা। এর পরে আর জাতীয়বাদী চেতনা ও ধর্মীয় চেতনার মাঝে বিতর্কের অবকাশ থাকে না, থাকা উচিত নয়। ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে নিজেকে চিনতে শেখায়। কিন্তু মানুষের জীবন চলার পথে অন্য কেহ ধর্মান্ধতায় মানুষের সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তার স্বজাতীয়তাবোধ তাকে উজ্জীবিত করবেই। পৃথিবীতে কোথাও ধর্মীয় জাততত্ত্বের বন্ধনে কোন জাতিই সৃষ্টি হয়নি হবেও না। তাহলে পৃথিবীর সমগ্র মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, হিন্দু এক একটি ধর্মাবলম্বী জাতিতে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করতো। মুসলমান- মুসলমানে থাকতো না কোন যুদ্ধ, হানাহানি, বিরোধ। বরং এক দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নির্বিঘ্নে বসবাস করছে তাদের নিজস্ব জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে। চীন ও জাপানে একই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বাস করলেও তারা বিভক্ত জাতীয়তার ভিত্তিতেই। চীনের বৌদ্ধরা চীনা এবং জাপানী বৌদ্ধরা 'জাপানী' ভাবতেই গর্ববোধ করে। ভারতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাস করে। অথচ তারা নিজেদের ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়, জাতীয় ভিত্তিতেই ভারতীয় হিসেবে পরিচিত লাভ করে থাকে। সুতরাং সব কিছুর উর্ধ্বে অর্থাৎ সর্বপ্রথমে জাতীয়তা তারপর  সার্বিক অঙ্গনে ব্যপ্তি, এই সহজ বোধ কি সর্বসাধারণের মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত? হলে কেন বাঙালি জাতি এই পরীক্ষায় উতরাতে পারছে না? বর্তমানে দেশের সংঘাতময় ম্লান চিত্র তো সে কথাই প্রমাণ করে দিচ্ছে। কাদের দায়িত্ব এই বোধ সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলা? নিঃসন্দেহে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি মহলের কিন্তু এই বুদ্ধিজীবি মহলেও যে একই দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ। নিজেরাই যখন কাদাজলে হাবুডুবু খেয়ে চলেছে তখন অন্যকে পরিত্রাণের পথ তারা কি করে বাতলে দেবে?

নিজেদের উৎসর্গিত করে যারা রেখে গেলেন অমূল্য মানিক বাংলা ভাষা, তারা কি চিরস্মরণীয়, চিরপূঁজনীয় নয়? আর এ প্রাণের সম্পদ বাংলা ভাষার যথার্থ প্রয়োগও বাঙালির জীবনে বির্তকের উর্ধ্বে নয়। মহান ভাষা শহীদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশে যে দ্বিধাগ্রস্থ বা উদাসীন সে কি সত্যিকার ভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ? না অন্য কিছু? অকৃতজ্ঞ জন্তুর মত কি ভুলে যাওয়া যায় আজন্মের ঋণ? তাই '২১-এর চেতনা দীপ্ত মহান দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিকে হয়ে উঠতে হবে যথাযথ বাঙালি সর্বাগ্রে। নতুবা সত্যিকার মূল্যবোধ বিকাশ কোনদিনই সম্ভব নয়। যার অভাবেই আজ বাঙালির এই চরম দুরাবস্থা। আবারও যে কোন সময় হানা দিতে পারে তথাকথিত ধর্মজীবী ধর্মান্ধ পূর্ণসর্বস্ব সত্তদাগরের সর্বগ্রাসী দল। সময় থাকতে তাই সতর্ক হতে হবে। এবং সক্রিয়ভাবে জরুরী তৎপর হতে হবে জাতীয় মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত এক মহান বাঙালি জাতি গঠনে।

ধনী-গরীবের বৈষম্য কমাতে হবে


ধনী-গরীবের বৈষম্য কমাতে হবে

 

* তার ( আবু লাহাবের) ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসবে না।-১১১:

* ধন-সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে।-১০২:১।

* আর অবশ্যই সে (মানুষ) তো ধন-সম্পদের লালসায় উন্মত্ত।-১০০:

* (দুর্ভোগ প্রত্যেকের) যে অর্থ জমা করে ও তা বারবার গোণে; তার ধারণা, তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে।-১০৪:২-৩।

* যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে সে যে আল্লাহর কাছে পবিত্র মন নিয়ে আসবে।-২৬: ৮৮-৮৯।

* তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো তোমাদের জন্য পরীক্ষা, তোমাদের জন্য আল্লাহ্‌রই কাছে রয়েছে বড় পুরস্কার।-৬৪:১৫।

 
আরিফীন হক ॥ বাংলা ও বাঙালির মূল্যবোধ চর্চায় এক সময় বলা হতো, 'তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন' ? আর বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা সমাজের সর্বস্তরে যে বৈষম্য আজ ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে তা দেখে হয়তো ধনীদের বলার ইচছা জাগে, 'তুমি এতো গরীব, তাই আমি এতো ধনী হইবো না কেন?'। দেশে মুষ্টিমেয় লোক বেশি ধনী হয়ে গেছে বলেই তার বিপরীতে সৃষ্টি হয়েছে এতো গরীব মানুষ। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এসে আজ বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে একদিকে দেখা যাচ্ছে, নানা রঙের বিলাস বহুল কত গাড়ি, বাড়ি, কোটি টাকা, শত কোটি টাকার মালিক তারা হয়েছেন বা হওয়ার স্বপ্ন দেখে চলেছেন। অপরদিকে রাস্তার দু'ধারে, বস্তিতে কত মানুষ বাস করে খোলা আকাশের নিচে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি কোনো কিছুরই নিশ্চয়তা তাদের দিতে পারেনি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। অপরদিকে রিঙাওয়ালা, ঠেলাগাড়ি চালক, দিনমজুর, গৃহকর্মী, শ্রমিক যারা দিনভর পরিশ্রম করে যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো চিন্তা নেই, প্রতিদিনের সংস্থান যাদের হলেই হল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ভীষণ সুখী। কিন্তু কথিত বিশ্বায়ন ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিনির্ভর সমাজের যে দুষ্টচক্রে তারা আজ আবর্তিত হচ্ছেন, তা থেকে তারা কীভাবে নিজেদের উত্তরণ ঘটাবেন সে চিন্তাটিও কেউ করছে না। ফলে ধনী আরও ধনী হওয়া, দরিদ্র আরও দরিদ্র হওয়ার যে ধারা দিন দিন আরও প্রকটতর হচ্ছে। কেউ কেউ ধর্মের নামে, আবার কেউ রাজনৈতিক ও সরকারি দলের সুবিধা নিয়ে বিগত কয়েক বছরে অঢল অর্থবিত্তের মালিক বনেছেন। অর্থনীতির বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধনিতা ঘোষণা করা হয়েছিল। এদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন জনকল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্রের-যে রাষ্ট্রে অবারিত হবে অর্থনৈতিক সুযোগ, উন্মেষিত হবে সামাজিক সুবিধাদি, পাওয়া যাবে রাজনৈতিক মুক্তি, থাকবে স্বচ্ছতা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা, পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ, প্রস্ফুটিত হবে ধর্মরিপেক্ষ আচরণ। স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান এসবের অঙ্গীকার করে, প্রকাশ্যে: করে মৌালিক চাহিদা মেটানো থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমানাধিকারের অঙ্গীকারও। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ অঙ্গীকার, আর বাস্তবের ফারাক এতই বেশি যার ভিতরে মৌলবাদের অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট রাজনীতির বিস্তৃতি সম্ভব'

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ক্ষয় হয়েছে, কিন্তু একদিকে যেমন চিরাচরিত মানস কাঠামো বিলুপ্ত হয়নি, তেমনি অন্যদিকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কও বিকশিত হয়নি; বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিকৃষ্ট পুঁজি, যা উৎপাদনশীল বিনিয়োগে ভূমিকা রাখে না। 'ব্রিফকেশ পুঁজিবাদ' বিকাশে শিল্পভিত্তিক চিরায়ত পুঁজিবাদের তুলনায় 'শকুন পুঁজিবাদ' (ভালচার কেপিটালিজম) অনেক বেশি অনুকূল। এই পুঁজিবাদ উৎপাদনশীল শিল্পনির্ভর অর্থনীতির চেয়ে নগর-কেন্দ্রিক ভূমি ব্যবসা এবং দোকানদারি অর্থনীতি বিকাশে অনেক বেশি উৎসাহী। অর্থাৎ কাঠামোগতভাবেই এই পদ্ধতি উদ্বৃত্ত শ্রমের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। হচ্ছে না দারিদ্র্য বিমোচন। অবশ্য এ ধরনের মুক্তবাজার কখনই দারিদ্র্যবান্ধব নয়। একচেটিয়া পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের মুক্তবাজার এদেশের জাতীয় পুঁজিভিত্তিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার বদলে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে তাও মৌলবাদ -সাম্প্রদায়িকতা পুষ্টিতে সহায়ক।

শকুন পুঁজিবাদ' আজ এদেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করছে। এখানে অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিতদের অবস্থা দিনকে দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে এবং এদের সংখ্যাটিও দিন দিন বেড়েই চলেছে। পাকিস্তান আমলে বলা হতো ২২ পরিবারের কথা। আজ বলা হচ্ছে, কয়েক হাজার পরিবারের কাছে দেশের সকল সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। দারিদ্র্য ও অশিক্ষা-কুশিক্ষার ফসল হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাকে সমাজ ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ উদ্বেগজনক বললে হয়তো কমই বলা হবে। দেশে বর্তমানে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখ। পথশিশু বৃদ্ধির এ হার বজায় থাকলে ২০১৪ সাল নাগাদ সংখ্যাটি ১২ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। অথচ ক্রমবর্ধমান এ শিশুদের কল্যাণে নেই কোন নীতিমালা। সরকার ঘোষিত ভিশন ২০২১ অর্জন করতে হলে এখনই এ শিশুদের কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি প্রয়োজন। পথশিশুদের প্রায় ৪৪ ভাগ ধুমপান করে এবং রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ ভাগ শিশুর কোন বিছানা নেই। পথশিশুদের প্রায় ৪০ ভাগ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না ও ৩৫ ভাগ শিশু খোলা জায়গায় পায়খানা করে। কোন মতে খাবার যোগাড়ের জন্য ৮০ ভাগ পথশিশু বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। ৮৪ ভাগের কোনও শীত বস্ত্র নেই। অসুস্থ হলে প্রায় ৫৪ ভাগের দেখাশোনার কেউ নেই। অর্থের অভাবে পথশিশুদের ৭৫ ভাগ ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না। দেশের শিশুদের বিরাট অংশের এই চরম দুরাবস্থার চিত্র ব্যথিত করে সমাজের যেকোন বিবেকবান মানুষকে। প্রশ্ন করতে হয় তাদেরকে, যারা দেশের সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন স্বাধীনতার ৪০ বছর ধরে। এর পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী? এই দূরাবস্থা কী আমাদের সকলের লজ্জ্বার বিষয় নয়? নাকি যারা স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের আমলে নিজেদেরে আখের গুছিয়েছেন তারাই কেবল এ জন্য দায়ী? কিছু লোকের হাতে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অপর অংশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র্য এবং এর অনুসঙ্গ হিসেবে অশিক্ষা-কুশিক্ষা ছড়িয়ে পড়ছে। আসলে, এদেশের মানুষ দরিদ্র নয়, তাদেরকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থার মূলে আছে  নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি। সমাজ জীবনের শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য ধনী-গরীবের বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ আজ জরুরি হয়ে উঠেছে।

মাদ্রাসা শিক্ষা কি ধর্ম শিক্ষা !


মাদ্রাসা শিক্ষা কি ধর্ম শিক্ষা !

 

সংলাপ ॥ এদেশে মুসলমানের ছেলেদের ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য রয়েছে বিশেষ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসা শিক্ষা বলে পরিচিত রকমারী এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ত্ব রয়েছে দেশ জুড়ে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে এর সংখ্যা ১৫ হাজার ৫শ ৪১টি। এর মধ্যে এবতেদায়ী মাদ্রাসা (প্রাথমিক, শিক্ষাকাল ৫ বছর) মোট ৯ হাজার ৫শ ৬১টি, দাখিল (মাধ্যমিক, শিক্ষাকাল ৫ বছর) মাদ্রাসা রয়েছে ৪ হাজার ১শ ২১টি, আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক, শিক্ষাকাল ২ বছর) মাদ্রাসার সংখ্যা ৮শ ৮১টি এবং কামিল (স্নাতকোত্তর, শিক্ষাকাল ২ বছর) মাদ্রাসার সংখ্যা ১শ ৭টি। বর্তমানে সব মিলিয়ে প্রায় দুই লক্ষাধিক।

দেশে এই বিপুল পরিমাণ মাদ্রাসার অস্তিত্ব দেখে কারো মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, এই পূণ্য(!) উদ্যোগটি এদেশে কে বা কারা নিয়েছিল? এই বিপুল পরিমাণ মাদ্রাসা সৃষ্টির জাগরণটিই বা কখন হলো? ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি থেকে শুরু করে শত শত বছরে কয়েক'শ মুসলিম নৃপতি, ভূপতি তথা রাজা-বাদশা এই বঙ্গভূমি শাসন করে গেলেও কেউ মুসলমানের সন্তানকে 'জবরদস্ত' মুসলমান বানানোর জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ভারতবর্ষ দখলের পর 'খ্রীষ্টান'(!) ইংরেজরাই কেবল মুসলমানদের ইসলাম শিক্ষার জন্য 'মাদ্রাসা' স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো! আর 'ইসলাম দরদী' (?) ইংরেজ শাসক লর্ড হেস্টিংস তাই ১৭৮০ সালে কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসলাম শিক্ষা দেয়ার মহান (!) ব্রত নিয়ে এই আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর তার প্রথম অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন একজন ইংরেজ (নও মুসলিম নয় !)। শুধু তাই নয় এর পরিচালনা পরিষদের ঈমানদার (?) ইংরেজদের রাখা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯  সালে ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয় এবং সে বছরই মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালে এই বোর্ডকে নতুন করে গঠন করা হলেও ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন প্রদান করেন এবং জিয়া ১৯৮০ মাদ্রসা শিক্ষকদের জন্য বেতন কাঠামো প্রদান করেন।

এর ফলে সরাসরি রাষ্ট্রীয় অর্থানুকূল্যে দেশ জুড়ে হু হু করে গড়ে উঠতে থাকে রকমারী মাদ্রাসা। এসময়ই মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান জমিয়েতুল মুদাররেছিন রাজাকার মান্নানের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে উঠে। হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে সাধারণ শিক্ষার সমান্তরাল হয়ে ওঠে দেশজুড়ে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সরকারী অর্থ আত্মসাৎ আর লুটপাটের তাড়না থেকে ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লারা গড়ে তোলে ভুয়া মাদ্রাসা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার সরকারী মঞ্জুরী প্রাপ্ত মাদ্রাসা রয়েছে ৫৬টি। ১শ ৬৪ বর্গকিলোমিটার এই থানাতে ১৯৯১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী মোট লোকসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬শ ৫৯ জন। ওই থানায় প্রতিটি মাদ্রাসায় গড়ে কমপক্ষে ১শ করে ছাত্র ধরলেও মোট ছাত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার। অনুরূপভাবে, একটি জেলায় ১টি করে কামিল মাদ্রাসা থাকায় নিয়ম থাকলেও উল্লেখিত তদন্তে শুধু চট্টগ্রাম জেলাতেই ১৪টি কামিল মাদ্রাসা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, দিনাজপুর ও সিলেট জেলায় ৫টি করে এবং নোয়াখালিতে ৭টি ও ঢাকা জেলায় ৪টি কামিল মাদ্রাসা রয়েছে। এমনকি ১৯৯৬ সালেও প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরো ১০টি কামিল মাদ্রাসার অনুমোদন দেয়।

তদন্তে দেখা গেছে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ায় জনৈক ডাঃ শামসুল হকেরই ৪টি এবতেদায়ী মাদ্রাসা রয়েছে। স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে এসব মাদ্রাসার শিক্ষক দেখিয়ে ডাঃ শামসুল সরকারী অনুদানের টাকা আত্মাসাৎ করে।

ভুয়া মাদ্রাসার মত ভুয়া সার্টিফিকেটধারী মাদ্রাসা শিক্ষকও রয়েছে বিস্তর। রয়েছে একই শিক্ষক একই সঙ্গে একাধিক মাদ্রাসায় কর্মরত দেখিয়ে সরকারী অনুদান আত্মসাৎ এর ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার মাকরাইল ছালেহা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ভুয়া সার্টিফিকেট জমা দিয়ে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালনের ঘটনা ধরা পড়ে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা দপ্তরের তদন্তে দেখা যায় উল্লিখিত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা (?) আলতাফ হোসেন ৩য় শ্রেণীতে কামিল পাস করা সত্ত্বেও ২য় বিভাগের ভুয়া সার্টিফিকেট জমা দিয়ে মাদ্রাসাটিতে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন।

অপরদিকে জনৈক আব্দুল ওয়াদুদ ১৯৮০ সালে একই মাদ্রাসায় যোগ দিয়ে ১৯৮৮ সালে পরিচয় গোপন করে একই সঙ্গে মাগুরা জেলার সদর থানার উত্তর বীরপুর কাদের মুন্সী দাখিল মাদ্রাসার সুপার হিসাবে যোগ দেয় এবং উভয় মাদ্রাসা থেকে সরকারী ভাতা গ্রহণ করতে থাকে।   

দেশের মাদ্রাসা শিক্ষার উল্লিখিত প্রতীকি চিত্রের পাশাপাশি আঁতকে উঠার মতও চিত্র রয়েছে। তা হলো শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের প্রায় এক তৃতীয়াংশ গড়ে প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে মাদ্রাসা খাতে। সরকারী পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ১৯৯৬-৯৭ অর্থ বছরে রাজস্ব বাজেটে বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে ব্যয় হয় মোট ৬শ ৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ হাজার ৩শ ৭০টি বেসরকারী সেকেন্ডারী স্কুলের জন্য ব্যয় হয় ৩৫৪ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫২.৮২ শতাংশ। এবং ৯৯৬টি বেসরকারী কলেজের জন্য ব্যয় হয় ৮৮কোটি টাকা এবং ১২.৭৭ শতাংশ।

অপরপক্ষে মাত্র ৫ হাজার ৭শ ৮৫টি বেসরকারী মাদ্রাসার পেছনে সরকারী ব্যয় হয় ২শ ২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৩২.৯৫ শতাংশ। এতে দেখা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার বিচারে বেসরকারী মাদ্রসার ব্যয়ের পরিমাণ বেসরকারী স্কুল ও কলেজের চেয়ে বেশি ছিল।

একইভাবে ছাত্র প্রতি মাথাপিছু ব্যয় সাধারণ শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় বেশি। দেখা গেছে, সরকারী মাদ্রাসায় একজন ছাত্রের মাথাপিছু ব্যয় যেখানে ৭হাজার ৬শ ৩ টাকা সেখানে সরকারী স্কুলের একজন ছাত্রের জন্য ব্যয় হয় ২ হাজার ৮শ ১৩ টাকা এবং সরকারী কলেজে ২ হাজার ৯শ ৫৯ টাকা।

অনুরূপভাবে, বেসরকারী মাদ্রাসায় একজন ছাত্রের পেছনে সরকারের ব্যয় যখন ১ হাজার ২শ ১১ টাকা তখন বেসরকারী স্কুলে তা মাত্র ৬শ ৭৮ টাকা এবং বেসরকারী কলেজে এর পরিমাণ ১ হাজার ৮৯ টাকা।

মাদ্রাসা শিক্ষার উল্লিখিত চিত্র থেকে সঙ্গত কারণেই কিছু প্রশ্ন জাগে। ইংরেজ প্রবর্তিত এই মাদ্রাসা শিক্ষা ইসলাম ধর্ম শিক্ষায় কি নূন্যতম ভূমিকাটুকু রাখছে? প্রতিবছর যে হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থী এসব মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে তারা কি আদৌ তাদের জীবনে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে? নাকি মতলববাজ ধর্ম ব্যবসায়ী তথাকথিত মোল্লাদের স্বার্থ হাসিলের উপায়-উপকরণ হিসাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে? কষ্টার্জিত এই স্বাধীন দেশে জনগণের ট্যাক্সে কোটি কোটি টাকা কি প্রকৃত মানুষ গড়ায় ব্যয় হবে নাকি ধর্মান্ধ, ধর্মগোড়াঁ একদল ফতোয়াবাজ, কর্মবিমুখ মোল্লা গোষ্ঠী তৈরির পেছনে অপচয় হবে?

ভারতবর্ষকে চিরদিন গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার ঘৃণ্য মতলব নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে ইংরেজরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলো। স্বাধীন জাতি কেন তা বয়ে বেড়াবে? কেন এর পেছনে ব্যয় করবে কোটি কোটি টাকা?

সংবিধানে রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম অথচ ধর্মের নামে সন্ত্রাস দুর্নীতি মিথ্যাচার চলছেই !


সংবিধানে রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম

অথচ ধর্মের নামে সন্ত্রাস দুর্নীতি মিথ্যাচার চলছেই !

 

শাহ্‌ আব্দুল বাতেন ॥ বিশ্বের কোন ভূ-খন্ড বা রাষ্ট্র নামক ভৌগলিক সীমারেখার নামে নিজস্ব কোন ধর্ম থাকতে হবে, ধর্ম সচেতন গুণীজনের কাছে এটা শুধু বিস্ময়কর নয়, হাস্যকরও বটে। অথচ এধরনের অদ্ভুত বিষয় ভিত্তিক অবস্থার মধ্যে আমাদের রাষ্ট্র ও আমরা দিব্যি অবস্থান করছি। ধর্ম কেবল মানুষের জন্য। আর সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য  রাষ্ট্র। রাষ্ট্র এমন কোন প্রাণ-প্রজাতি নয় যে, তার আহার-বিহার ধর্মকর্ম, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভ্রমন বিলাস ইত্যাদির প্রয়োজন বা বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। এই সহজ সরল বিষয়টি জানে না, বুঝে না বা বুঝতে পারে না, এমন একজন মানুষও এদেশে

খুঁজে পাওয়া যাবে কি? তারপরও ক্ষমতা লোভীদের ক্ষমতার জন্য ধর্মের কৌশলগত ব্যবহার, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবাসীকে দুঃখজনকভাবে ধর্মের নামে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাও আবার ইসলাম ধর্মের নামে। বলাবাহুল্য যে, অবশ্যই 'ইসলাম' শান্তির ধর্ম। মানবতার ধর্ম।

নীতি নৈতিকতার ধর্ম। 'সত্য'কে ধারন, লালন ও পালনের ধর্ম। অর্থবিত্ত ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগী-লোভী, আত্ম-প্রবঞ্চক, ঘুমন্ত চিত্তের শ্রেণী ব্যতিরেখে কোন শান্তিকামী-শান্তিপ্রিয়, আত্মসচেতন, সৎসাহসী, মানবতাবাদী, দেশ প্রেমিক মানুষ ইসলামের এই বিশ্বজনীনতাকে অস্বীকার করতে পারে না। কারণ এসবের মধ্যেই প্রকৃত অর্থে ইসলাম বা শান্তি নিহিত রয়েছে। যা কিনা মানুষ ব্যতিত কোন সীমারেখা বেষ্টিত রাষ্ট্র বা ভূখন্ড কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কেননা, রাষ্ট্র বা ভূখন্ড প্রাণশীল নয়। তারপরও সীমারেখা নামক একটি রাষ্ট্রের কপালে যারা মনগড়া 'ইসলাম' এর নামফলক লাগিয়ে সস্তা দামে রাষ্ট্রের ধর্মজীবী ও ধর্মান্ধদের নিয়ে ধর্মভীরু গণমানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের অপচেষ্টা করেছে এবং পরবর্তীতেও যারা নানা বাহানায় করে আসছে, তারা আর যা-ই হোক না কেন শান্তির ধর্ম ইসলামের ধারক-বাহক হতে পারে না। এবং মোহাম্মদী ইসলাম তাদের দ্বারা নিরাপদও নয়। 'ইসলাম' অনুসারী তারাই যারা শান্তির মূল উৎস সাম্য ও মৈত্রীময় পরম 'সত্য'কে ধারন, লালন ও পালন করতে জানে। তারাই দেশ প্রেমিক ও পরার্থে পরমেশ্বরের বন্ধু।

এ পর্যায়ে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের সহাবস্থান এই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নামকরনের প্রবর্তক বা কারিগর কে? উত্তরে উল্লেখ্য যে, ১৯৮০’র দশকের কথা। সেনা ছাউনী থেকে বেরিয়ে আসা দেশের স্বঘোষিত স্বৈরশাসকদের ক্ষমতা দখল। জাতির ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এই সামরিক স্বৈরশাসকদের অজানা-অপরিচিত নেতৃত্বের ভয়ভীতি ও নানা অপকৌশল মিশ্রিত তথাকথিত জনপ্রিয়তা যখন শূন্যের কোঠায়, তখনও ক্ষমতায় টিকে থাকার লালসায় তাদের সর্বশেষ ধুর্ততার হাতিয়ার 'ইসলাম'কে রাষ্ট্রধর্ম করার ঘোষণা দিয়ে জনমত সৃষ্টির অপচেষ্টা। তাদের ধারণা ছিল, দেশের শতকরা প্রায় নব্বইভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী বিধায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সহজ পন্থায় ধর্মজীবী ও ধর্মান্ধদের নিয়ে জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে দেশবাসীর  আনুকূল্য পাবেন। কিন্তু সত্যের সাথে প্রহসন ও সময়ের কঠিন বিচারে শেষ রক্ষা আর হয়নি। ক্ষমতা ছেড়ে বিদায় তাদের নিতেই হল। অসাম্প্রদায়িক দেশের সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করে গেল বিকৃত চিন্তার ফসল রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এখন প্রশ্ন হল, ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তনকারী অগণতান্ত্রিক ঐ?স্বৈরশাসকদের শাসনামল কি ইসলাম পরিপন্থী সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মিথ্যাচার ও নৈরাজ্যমুক্ত ছিল? নিঃসন্দেহে বলতে হবে, ছিল না। তার পরবর্তীতে আরও বিস্ময়কর বিষয় হল যে, আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সব মিলিয়ে পাঁচ সরকারের শাসনামল জুড়ে কি এই ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলাম তথা শান্তি বিরোধী সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুটপাট, মিথ্যাচার, সুদ-ঘুষ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর, মানুষ হত্যা, মানুষ গুম ইত্যাদি নির্মূল করা তো দূরের কথা ন্যূনতম হারে নিয়ন্ত্রন করাও কি সম্ভব হয়েছে বা হচ্ছে? হয়নি! বরং আনুপাতিক হারে বেড়েই চলেছে। তাহলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকারী ও তা অনুসরণকারীরা কেমন ইসলাম প্রেমিক? বর্তমান মহাজোট সরকার, বিগত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন সংখ্যা অর্জন করেও '৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবার কথা বলেও তা করতে পারেনি। বরং এই সরকারের আমলেই ইসলামের নামে ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মজীবী ও রাজনৈতিক ইসলাম পন্থীদের ইসলাম ধর্ম হেফাজতকারী (!) নামক বিভিন্ন দল সৃষ্টি হয়ে 'ইসলাম ভান্ডার' পবিত্র কুরআন পোড়ানোর মহোৎসবের দৃশ্য দেখালো গোটা জাতি ও বিশ্ববাসীকে। কুরআন পোড়ানো, গাছকাটা, মানুষ হত্যা, দোকান-পাট, সরকারী-বেসরকারী সম্পদ ধ্বংস কি ইসলাম সম্মত? বর্তমান সরকারের শেষ বছরে এখনও সময় আছে যে, এসবের মূলউৎস রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাজনীতি, ধর্মান্ধতা, হরতাল, অবরোধ সংসদের মাধ্যমে আইনী পন্থায় বন্ধ করে রাষ্ট্রের কাঁধ থেকে ক্ষমতালোভী সংস্কৃতির বোঝা নামিয়ে শান্তির পথকে মসৃণ করার সুযোগ করে দিক এই সরকার, এটাই জাতির প্রত্যাশা। সময়ের ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে এবং স্মরণ করবে চিরকাল।