বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০১৩

রাজনীতিক : আর কত দূর ?


রাজনীতিক : আর কত দূর ?

 

সংলাপ ॥

 

জাতীয় রাজনীতির অস্থিরময় পরিস্থিতি, শিল্প ও শ্রমের বিরোধের প্রেক্ষিতে ধারাবাহিক অসন্তোষ, চরম অর্থনৈতিক সংকটে ঘণীভূত সামাজিক, সংকটের ফলে উদ্ভুত জাতীয় পরিস্থিতির এক সংকটকালীন সময় অতিবাহিত করছে বাংলাদেশ। আমাদের সামনে তাই আজ জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।

সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের গভীর সাধারণ সংকটের এ যুগে বিশ্বব্যাপী চলছে দ্বন্দ্বময় অস্থির পরিস্থিতি। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাধারণ সংকট লক্ষ্য করলে আমরা দেখি আমেরিকা, ইউরোপে গড়ে ১২% লোক বেকার। বেকারত্ব, ছাটাই, বেতন হ্রাস ও সমাজকল্যাণ খাতে ব্যয় ক্রমাগত কমিয়ে সংকটের বোঝা শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। ফলে শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব ক্রমান্বয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শিল্প উন্নত দেশগুলোতে একের পর এক শ্রমিক অসন্তোষ ধর্মঘট-বিক্ষোভ প্রতিবাদ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাজার প্রভাব বলয় পুনঃ বিভাজন নিয়ে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের বীজ বৃদ্ধি করে চলেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো তাদের সংকটের বোঝা ক্রমাগত আমাদের মত নয়া উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশগুলোর জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক আইএমএফ গ্যাট সংস্থার মাধ্যমে তথাকথিত অবাধ মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুর মাধ্যমে আমাদের মত দেশগুলোর উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ শোষণ ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদীদের সংকটের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে আমাদের ঘাড়ে।

যেখানেই সে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নূন্যতম বাধা পাচ্ছে সেখানেই সে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে জাতিসংঘকে বহু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করছে। কোথায়ও সামরিক অভিযান, কোথায়ও অর্থনৈতিক অবরোধ, কোথায়ও মধ্যস্থতার নামে মোড়লীপনা চালিয়ে যাচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পরস্পরের বাজার দখলের বিরোধ থাকলেও আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী তার আধিপত্য চালাতে যেয়ে আমাদের মত দেশগুলোর  প্রক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যবহার করছে নির্বিঘ্নে। ফলে আজকে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা তাদের প্রভুর সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন এবং সহযোগিতা করেই চলেছে। যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রেরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন করতে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো আসছে। দেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা তৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছে। জোরে সোরে খোলাবাজার অর্থনীতির জয়গান গাচ্ছে-বিশ্বব্যাংক আই.এম.এফ এর ব্যবস্থাপত্রানুযায়ী বাংলাদেশের শিল্প-অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

যার ফলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে ওরা বলছেন ভর্তুকী প্রত্যাহার কর। অমনি প্রত্যাহার হলো সার, ডিজেল, কীটনাশকের উপর থেকে ভর্তুকী। কৃষক ও কৃষির উপর হানা হচ্ছে আঘাত। কৃষি উৎপাদন হচ্ছে ব্যাহত। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কল কারখানাগুলো পানির দামে বিক্রি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ লাভজনক রাষ্ট্রীয় খাতগুলোকে ও মালিকানা (বিদেশী) হস্তান্তরের পায়তারা আজও চলছে। শিল্পের ছাটাই, লেঅফ-লকআউট চলছে অবাধে। ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প কারখানায় ন্যূনতম মজুরী কার্যকরী হচ্ছে না।  শ্রমিক নেতা ছাটাই বদলীর মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার অবাধ তৎপরতা চলছে। ৯০ এর গণ আন্দোলনে শ্রমিক, ছাত্র, জনতার রক্তক্ষয়, তার পরিণতিতে যেতে পারেনি আমাদের দেশের সাম্রাজ্যবাদের দালাল রাজনৈতিক দল ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের ক্ষমতা লিপ্সার কারণে। আজও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি, ফলে শোষক গোষ্ঠীর এক হাত থেকে অন্য হাতে ক্ষমতার হাত বদল হলেও জনতার ভাগ্যের, শ্রমিকের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। আজকের জাতীয় রাজনীতিতে এ জিনিসটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়েছে যে কোন সরকার আন্দোলনের সময় দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কোন অধিকারই পূরণ হচ্ছে না। জাতীয় অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। গুটি কতক ধনিক-বনিক জোতদার মহাজন ছাড়া সমাজের আর সকল মানুষই আজ চরম অর্থ কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ নেই, বই কাগজ কলমের মাত্রাতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি যথা শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, সরকারের শিক্ষা নীতির পরও যে সমস্ত ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে তার অধিকাংশ আজ বেকার হয়ে পড়লেও কর্ম সংস্থানের কোন ব্যবস্থা নেই। শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে না, কৃষি উৎপাদন খরচ অনুযায়ী কৃষক পণ্যের মূল্য পাচ্ছে না। কৃষক জমি হারাচ্ছে। বাঁচার জন্য পাচ্ছে না কোন কাজ। ক্রমাগত অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করছে রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিক সংকট আর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনতা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে চাইলেও পরিকল্পিত ভাবে শিক্ষাঙ্গন থেকে শিল্পাঞ্চল, নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সন্ত্রাস সৃষ্টি করে প্রকৃত আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হচ্ছে। সামাজিক বিশৃঙ্খলা দিয়ে জনতার ঐক্য নষ্ট করা হচ্ছে। সমাজে অনাচার অবিচার বেড়েই চলছে। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের কোন ব্যবস্থা রাজনীতিকরা করছে না। রাজনৈতিক দলগুলো কেবল বিদেশী মহাজন আর দেশীয় শোষক গোষ্ঠির স্বার্থরক্ষা করে চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে চাল, ডাল, তৈল সহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের দাম  বেড়েই চলেছে। মানুষ ক্রমেই অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এ দিকে কর্মসংস্থানের অভাব, কর্মরত শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত, কৃষক হচ্ছে ভূমিহীন। শ্রমজীবী জনগণের জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। রাজনৈতিক দলগুলোর এই জনস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপে আজ সমাজের সর্বপেশার মানুষ তথা সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষুব্ধ ও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আজ বিরোধীদল জনতার দাবী, জনতার প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে আন্দোলন গড়ে না তুলে তারা প্রচলিত সমাজ, রাষ্ট্র ও সংবিধান বলবৎ রেখে কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের স্লোগান সামনে নিয়ে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে। ধর্মীয় সুবিধাবাদী রাজনীতিকরাও কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ তৈরি করছে। জনতাকে নিয়ে জনতার প্রয়োজনে আন্দোলন গড়ে তুলে ব্যাপক জনতার স্বার্থে অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র ও সংবিধান গড়ে তোলার প্রশ্নে রাজনীতিকদের মাথাব্যথা নেই। আজকের প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাপক জনতার স্বার্থ যে দেশে রক্ষিত হয় না সে দেশে নির্বাচন পদ্ধতি আর নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন করলে জনতার কি লাভ হবে? শিল্প কি গড়ে উঠবে? শ্রমিক কি ন্যায্য মজুরী পাবে? কৃষক কি কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে ছাত্র কি শিক্ষার সুযোগ পাবে? বেকার কি চাকুরী পাবে? নারীরা কি পাবে তাদের অধিকার? সমাজের মেহনতকারী মানুষ কি পাবে তাদের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা?  অভিজ্ঞতা বলে যতই আমরা দিন পার করছি ততই আমাদের সংকট বাড়ছে -এ থেকে পরিত্রাণের জন্য জনতার স্বার্থের সরকার ও নতুন করে সামাজিক স্তরবিন্যাস ছাড়া বিকল্প নাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন