বুধবার, ৮ মে, ২০১৩


ক্ষমতার চাটুকারিতায় রুদ্ধ হচ্ছে শান্তির পথ

 

আরিফীন হক ॥

 

সারা বিশ্বে এখন চলছে ক্ষমতার চাটুকারিতা। তবে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় ক্ষমতার চাটুকারিতায় অগ্রগামী। যে দেশে যত বেশি দুর্নীতি হয়, যে দেশে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও দারিদ্র্য যত বেশি, যে দেশের রাস্তাঘাট অনিরাপদ, পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়মের আওতাধীন নয় সে দেশের মানুষ তত বেশি ক্ষমতার চাটুকারিতা করে। দুর্নীতির সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক নিবিড়। যেখানে দুর্নীতি বেশি সেখানে ক্ষমতার চাটুকারিতাও বেশি। দুর্নীতি প্রবণ দেশে ক্ষমতার উচ্চাসনে আসীন হতে পারে কেবল সেরা দুর্নীতিবাজ। ছোট ছোট দুর্নীতিবাজরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে আশ্রিত হয় প্রধান দুর্নীতিবাজের ছায়াতলে। ইংরেজিতে বলে - ‘power corrupts’। ক্ষমতাহীনদের দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। দুর্নীতি করতে হলে কম-বেশি ক্ষমতা থাকতেই হবে। অন্যদিকে ক্ষমতাকে করায়ত্ত করতে হলেও কম-বেশি দুর্নীতিবাজ হতে হয়। ক্ষমতায় গিয়েই হঠাৎ কেউ দুর্নীতিবাজ হয়ে যায় না। যারা দুর্নীতিবাজ মূলত তারাই ক্ষমতায় যেতে চায় এবং ক্ষমতায় আশ্রয়ে নিরাপত্তা চায়। ক্ষমতার অপব্যবহার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এর কারণ হচ্ছে ক্ষমতাবান যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে না ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি এটা প্রমাণই করতে পারেন না যে তিনি ক্ষমতাবান। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা ক্ষমতাবানরা দুর্বলতা মনে করে। যে আইন অমান্য করতে পারে না লোকেও তার চাটুকারীতা করে না। আইন কেবল ক্ষমতাহীনদের জন্য। আইন সকল মানুষের জন্য সমান নয়। এটা তো আমরা রাস্তায় বের হলেই দেখি। ক্ষমতাবানরা ট্রাফিক আইন মেনে চলাফেরা করেন না। তারা হাজার হাজার মানুষকে অপেক্ষায় রেখে দ্রুত গতিতে চলেন গাড়ি হাকিয়ে। তাদের জরুরী কাজ আছে। সাধারণ মানুষের কোন জরুরী কাজ থাকতে পারে না।

নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে ক্ষমতালোভীরা দেশ-দশের সেবা করার জন্য জনগণের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ক্ষমতা প্রার্থী হয়। তাদের মতে ক্ষমতা ব্যতীত জনসেবা করা যায় না। কিন্তু এটা ধোঁকাবাজদের একটা কৌশল। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যারা প্রকৃত অর্থেই মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন তাদের কেউ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন না। দেখা গেছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা সেসব মানবসেবকদের কাছে ছুটে গেছেন পায়ের ধুলো নিতে।

মানুষ ক্ষমতা চায় কেন? কি সেই অন্তর্নিহীত তাগিদ যা মানুষকে ক্ষমতার দিকে ধাবিত করে? মানুষ যখন নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করতে চায়, যখন অন্যকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চায়, যখন অন্যকে শোষণ করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায় তখনই সে ক্ষমতার দিকে ধাবিত হয়। তা না হলে ক্ষমতার কি প্রয়োজন? ভালো মানুষ হতে গেলে কি ক্ষমতার দরকার হয়? ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য বা ধার্মিক হবার জন্য কি ক্ষমতার দরকার বা জনসেবার জন্য?

মানুষ হয়ে মানুষের উপর প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা এবং প্রচেষ্টা আল্লাহদ্রোহীতা। মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে। প্রতিটি মানুষ অনন্য। কিন্তু কেউ কারো থেকে শ্রেষ্ঠও নয় নিকৃষ্টও নয়। কিন্তু তাই বলে সকল মানুষ সমানও নয়। হাতের পাঁচটি আঙ্গুল সমান নয়, একটি লম্বা একটা খাট, একটা চিকন একটা মোটা, অন্যটা মাঝারি কিন্তু তাই বলে একটা অন্যটা থেকে শ্রেষ্ঠ নয়। যদি বলা হয় পাঁচটি আঙ্গুল থেকে যে কোন একটা আঙ্গুল ত্যাগ করতে হবে তাহলে কোন মানুষের পক্ষে তা নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। মানুষের জন্য তাদের হাতের পাঁচটি আঙ্গুল যেমন পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সমান মর্যাদাবান ঠিক তেমনি আল্লাহর কাছে প্রতিটি মানুষ মর্যাদাবান।

ভালো, ভদ্র, সৎ ও সাহসী মানুষের ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। সত্য বলতে এবং সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাগে না। কারণ সত্য নিজেই শক্তিমান। সকল শক্তির আধার। সত্যবানের সত্যের কাছে বিশ্বের সকল ক্ষমতাকে মাথা নত হয়ে কুর্ণিশ জানাতেই হবে। মিথ্যার কোন নিজস্ব শক্তি নেই। তাই সে চারিদিকে খুঁজে ফিরে শক্তির ঠিকানা। একবার বামে একবার ডানে যাওয়া-আসা  করে। যারা ক্ষমতা চায় তারা ক্ষমতাপন্থী। এখানে বাম-ডানের কোন পার্থক্য নেই।

ভদ্র, বিনয়ী, নম্র, মানুষ কখনো অনুভব করেন না যে তার ক্ষমতার প্রয়োজন। ক্ষমতার কুৎসিত রাজনীতি করে কেউ সত্য-সুন্দরের আরাধনা করতে পারে না। যিনি সত্য-সুন্দরের আরাধনা করেন তিনি তার সংস্কৃতির মধ্যে ডুবে থাকেন কিন্তু কখনো রাজনীতি এবং ক্ষমতার দিকে যান না।

মানুষের অশান্তির মূল কারণ - ক্ষমতা। যখন একে অন্যের উপর নিজের ক্ষমতা  প্রয়োগ করে তখনই সৃষ্টি হয় অশান্তির। যে যত বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ করে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে সে ততবেশি ক্ষমতাবান। তাই শান্তিপ্রিয় মানুষ ক্ষমতাকে ভয় পায়। এই ভয় থেকে তারা লোকদেখানো ক্ষমতার চাটুকারিতা করে। ভোটও দেয়, কারণ এর কোন বিকল্প আজো তৈরি হয় নি।

প্রত্যেক মানুষেরই ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা ব্যতীত কোন মানুষ নাই, থাকতেই পারে না। কিন্তু আমরা নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে ওয়াকীবহাল নয় তাই সঠিকভাবে কাজে লাগাই না। আমরা অন্যের ক্ষমতা দেখে হয় ঈর্ষান্বিত হই না হয় চাটুকারিতা করি।  মানুষ যদি অন্যের ক্ষমতার কাছে মাথা নত না করে প্রত্যেকে তার নিজের ক্ষমতার পরিচর্যা করে তবে নিজেকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করে শান্তি পেতে পারে। পরম করুণাময় প্রত্যেককে যে ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সে ক্ষমতাকে ব্যবহার ও পরিচর্যা করতে পারলে প্রতিটি মানুষ নিজেই নিজেকে বদলে দিতে পারে। প্রতিটি মানুষ যা চায় তা পাবার ক্ষমতাও তার আছে। মহান প্রভু আল্লাহতায়ালা এই ঘোষণাই দিয়েছেন কুরআনে - মানুষ যা চায়, তা-ই পায়। যা চাই তা পাবার জন্য ক্ষমতার চাটুকারিতা বন্ধ করে নিজের ক্ষমতাকে নিজের উপর প্রয়োগ করতে হয়। যারা তা করতে পারেন তারাই সফলকাম, আল্লাহর আশীর্বাদপুষ্ট। নিজের ক্ষমতা নিজের উপর প্রয়োগ না করে অন্যের উপর প্রয়োগ করাই মিথ্যাচার, দুর্নীতি বা ক্ষমতার রাজনীতি। যা পরিণামে অশান্তি ও কলহ সৃষ্টি করে। ক্ষমতার চাটুকারীতায় আজ বিপর্যস্ত হয়েছে মানবতা, পীড়িত ও অসহায় মানুষ তবু চায় নিরাপত্তা, ছুটে যায় ক্ষমতার কাছে, মাথা নত করে। ক্ষমতার চাটুকারিতায় বাংলাদেশ এখন ইহলৌকিক নরক।

আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে যিনি মাবুদ হিসেবে মানেন না, আল্লাহ ব্যতীত আর কারো কাছে যিনি মাথা নত করেন না তিনিই মুসলিম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন