হরতালের রাজনীতি প্রত্যাখান
করছে জাতি
আফরোজা রত্না ॥ লাশ নিয়ে রাজনীতি অথবা লাশের রাজনীতি
বন্ধ করুন। এদেশের মানুষ আর এ ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক কর্মসূচী মেনে নেবে না। হরতালের
নামে সংঘাতের সহিংসতার রাজনীতি কেউ চায় না। দেশের সম্পদ ধ্বংস,
ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, গুম,
হত্যা আর বোমাবাজির কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে দেশবাসী এবার মুক্তি চায়। ক্ষমতার মসনদে
থাকার জন্য কিংবা আরোহন করার জন্য এখন গার্মেন্টস শ্রমিক এর লাশ নিয়ে রাজনীতি করবেন
না যেন। এদেশের মানুষ টাকার পাহাড়ে আকন্ঠ নিমজ্জিত ভোগবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আস্ফালন
আর দেখতে চায় না। ব্যবসায়ী শিল্পপতি এবং সুবিধাবাদী শ্রেণী দ্বারা গর্জিয়ে উঠা বর্তমান
সময়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পুরনো ধাচের হরতাল অর্থাৎ লাশ নিয়ে হরতাল বা লাশের রাজনীতি
বন্ধ করার আহবান আজ সারা দেশবাসীর। এদেশের শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ হরতাল সমর্থন করেনা।
শ্রমিকের মজুরী দিতে গাড়ীর চাকা সচল রাখতেই হবে। গাড়ী ভাংচুর করে দেশের সম্পদ নষ্ট
করা বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি মালিক পক্ষের অবহেলায় শ্রমিকদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা
এদেশে আর যেন সংগঠিত না হয়। দেশের বর্তমান চলমান অবস্থায় সরকার ও বিরোধীদের রাজনৈতিক
কর্মসূচী, হরতালের রাজনীতিতে অর্থনৈতিক ক্ষতির নানা কর্মসূচী কি করে সম্ভব?
এ বোধোদয় জাগ্রত হোক এবার! দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম প্রধান শ্রমিক
শ্রেণী, স্বল্প আয়ের মানুষদের রোজগারের পথ রুদ্ধ না করে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সকল ধ্বংসাত্মক
রাজনীতি বন্ধ করে বর্তমান সময়ের ঘটে যাওয়া নবমতলা বিল্ডিং ধ্বসে প্রাণহানি হয়ে যাওয়া
শ্রমিকদের এবং আহত ও বিপর্যস্ত শ্রমিকের ন্যূনতম মানবিক মৌলিক চাহিদা ও অধিকার রক্ষায়
এগিয়ে আসুন।
রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক গালাগাল,
বিষোধগার, দোষারোপ ও মিথ্যাচার বন্ধ করুন। মিথ্যাচারের রাজনীতির
সংলাপ এদেশের সহজ-সরল মানুষও বুঝতে পারে। অতএব সাবধান থাকুন। ভুল কথা বললে অজানা কথা
বললে, জ্ঞানহীন কথা বললে ক্ষমা চেয়ে নিতে অসুবিধা কোথায়?
মাথা ঠান্ডা রেখে পরিবর্তন আনুন আপনাদের মাঝে। দেশের যুব সমাজকে সংঘাতের দিকে ঠেলে
দিবেন না। যুবশক্তিকে ভালবেসে তাদের উন্নয়নের ধারায় কাজে লাগান। মানবিক মূল্যবোধের
চর্চায় এগিয়ে আছে যে যুব শক্তি তাদের নিয়ে উন্নয়ন নীতি অনুসরণ করা কি অপরিহার্য নয়?
ক্ষমতার মসনদ কেবল অবৈধ টাকা উপার্জনের মাধ্যম এবং সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হতে পারে
না। এদেশের তরুণরা আজ বাংলা মায়ের জাগ্রত সন্তান। তরুণরা জেগেছে তাদের হাতে নতুন কর্মশক্তিকে
ধারণ করে সত্যের পথ ধরে নতুন দিগন্তে পরিবর্তন আসবে। সে বিশ্বাস জাতি রাখে ও প্রত্যাশা
করে। সন্ত্রাসী লালন-পালন ও সন্ত্রাসী তৈরি করা থেকে বিরত থেকে দেশের সোনার ছেলেদের
জন্য সন্ত্রাস মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ করে দিন।
হরতাল করে কি এসময়ের ভয়াবহ বিল্ডিং ধ্বস এর গার্মেন্টস
শ্রমিকদের প্রাণ ফিরে পাওয়া যাবে? নারী শ্রমিক শাহীনা কিনা বিল্ডিং
ধ্বসের ছয়দিন পরও জীবিত ছিল তাকে ধ্বংসস্তুপের ভিতর আটকে পড়া শত শত প্রাণহীন শাহীনা
অথবা ইমানরা জীবিত হয়ে যাবে? আহত শ্রমিকের পাশে দাঁড়ানো
আজ খুব জরুরি। শ্রমিকের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে তার শিশু সন্তানটি। তার অনাগত ভবিষ্যত
বা কি হবে? এ অমানবিক অবস্থার জন্য দায়ী কারা? এর স্থায়ী সমাধানের
জন্য সকল রাজনৈতিক দলসহ দেশবাসীর একসাথে মানবিকতার মহানব্রত নিতে হবে। ক্ষমতার মসনদে
বসার জন্য এখন সময় নয় পুরানো সেই হরতাল কর্মসূচীর। যাতে কিনা দেশের অর্থনীতির বিপর্যয়
ঘটে সে পদ্ধতি ও কর্মসূচী কি বন্ধ করা যায় না? নতুন ভাবে শপথ নেয়া
যায় না দেশের ৯০ শতাংশ দরিদ্র অসহায় মানুষের ভাগ্যে উন্নয়নের জন্য?
শ্রমিকের মজুরী তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগে দিয়ে দেয়া
উচিত' এ প্রবাদটি মুখে মুখে প্রচলিত বাংলার ঘরে ঘরে, অথচ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে
বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্প কারখানায় শোনা যায় এই নিয়মের ব্যতিক্রমী নানা অনিয়ম দুর্ভোগ।
সেখানের নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটিও নেই? ধ্বংসস্তুপের ভিতর
দুটি শিশুও ভূমিষ্ট হয়েছিল কেমন করে?
মাতৃত্বকালীন সকল সুবিধা নারী শ্রমিককে দেয়া হয় কি?
গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের প্রয়োজন মানসিকতা বদলানো। চারিপাশে লাশের গন্ধ। বাতাসে
লাশের গন্ধ, শাহীনা, রুবীনা,
জামাল, কামাল নাম না জানা শত শত শ্রমিকের মৃতদেহ। বেঁচে যাওয়া শত শত শ্রমিক পঙ্গুত্বের
অভিশাপে কিভাবে দিন কাটাবে? কে পাশে এসে দাঁড়াবেন অসহায় ছোট্ট শিশুদের?
এতিম শিশুদের? যাদের জীবনের চলার গতিতে হঠাৎ করে যেন মোর বদলে গেছে।
ঠেলে দিয়েছে তাদের অজানা অন্ধকার গহবরে। অনিশ্চয়তায় ভরা যন্ত্রণাময় জীবনের দিকে। স্তব্ধ
হয়ে গেছে হাজার শ্রমিকের পথচলা। সারা জীবন পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকেরা বহন করে চলবে
ভয়াবহ দুঃসহ দুঃখের স্মৃতি। কথায় আছে জন্মিলে মরিতে হবে। মূলত একটা নির্দিষ্ট সময়ের
মাঝে সকলের এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। এটাই অকাট্য সত্য। কিন্তু তা যদি হয় শোষণের,
বঞ্চনার অপমৃত্যুর ? এ দায়ভার কে নেবে? রানা প্লাজা ভবনটি
কেঁপে উঠেছিল, ভবনে ফাটল ধরেছিল, সর্বপরি নবম তলার
বিশাল ভবনটি কয়েক হাজার শ্রমিক সহ ধ্বসে গিয়েছে। জীবিতদের মুখে শোনা যায় মালিকপক্ষ
জোর করে কাজ করাচ্ছিল শ্রমিকদের। বেতনের লোভে দরিদ্র শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছিল। এতগুলো
নিষ্ঠুর অপমৃত্যু চোখের সামনে দেখে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী কিংবা ক্ষমতালোভীদের হরতাল
আহবান কোন মানবিকতাকে ধারণ করে?
মানুষের সব আমল বা কর্ম অবিরত লিখে চলেন- কিরামন কাতিবীন
নামক ফেরেশতাগণ। তারা অবস্থান নেন ব্যক্তির স্কন্ধদেশে। বাম কাঁধের ফেরেশতা সব মন্দ
কর্মের আর ডান কাঁধের ফেরেস্তা লিপিবদ্ধ করেন সৎকর্মের ফিরিস্তি। পবিত্র কুরআনের সূরা
কামা (আয়াতঃ৭) এ উল্লেখ আছে 'স্মরণ রেখো,
দুই গ্রহণকারী ফেরেস্তা তার দক্ষিণে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে।' বিবেকের জাগ্রত অবস্থানে থেকে
তার নিজ কর্মটি করবেন মানবিকতার সাথে এবং হরতালের রাজনীতির সংস্কার বন্ধ হোক চিরদিনের
জন্য এটাই আজ জাতির প্রত্যাশা।
চারিদিকে রব শোনা যাচ্ছে পরিবর্তনের। মিডিয়র বদৌলতে
দেখা যায় চারিদিকের নতুন, পরিবর্তনের জোয়ার। কিন্তু সেই পরিবর্তন কতটুকু?
তার মানই বা কি? নিজেকে বদলে দিয়ে পরিবেশ কতটুকু বদলিয়েছে ?
মিডিয়ায় দেখানো স্বল্প সংখ্যক মানুষ ভোগ করে চরম উন্নাসিক ভোগবাদী জীবন। অন্যদিকে
সাধারণ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসনসহ দেশের দরিদ্র
শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা বড় নিষ্ঠুর ও অমানবিক। বিত্ত-বৈভবের অপরদিকে কালো-অন্ধকারময়
শ্রেণী বৈষম্যের তীব্র যন্ত্রণা।
নিজেকে বদলানো আর পরিবর্তিত করার কাজ রয়ে গেছে কেবল
রাজনীতিক দলগুলোর দলীয়করণ দলতন্ত্রের সংস্কৃতির বেড়াজালের মধ্যেই। পরিবর্তনের জোয়ার
দৃশ্যত কিন্তু অন্তর কি পরিবর্তন হয়েছে? অন্তর পরিবর্তন না
হলে সব সদিচ্ছা বৃথা যাবে। পরিবর্তন হতে হবে মৌলিক। যার ফলাফল হবে শুভ এবং দীর্ঘস্থায়ী।
বর্তমান সরকার এবং বিরোধীদল দেশের উন্নয়ন বলতে বুঝেন,
কেবল দলীয়করণ। দলীয়করণ এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে বর্তমান সরকার প্রধানকেও দুঃখিত
হতে হচ্ছে।
বিগত সরকারি আমলে সবচেয়ে বেশি দলীয়করণ হয়েছে প্রশাসন
ব্যবস্থায়। এ সরকার তার রেশ ধরেই তাদের দলীয়করণ কর্মসূচী অব্যাহত রেখেছেন। এভাবেই কি
সময় গড়িয়ে যাবে দলীয়করণের দলবাজিতে?
বিগত জোট সরকার প্রশাসন,
পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন,
বিচার-বিভাগ, পুলিশ, শিক্ষা সার্ভিস থেকে
শুরু করে সকল প্রশাসনিক বিভাগকে এমনভাবে দলীয়করণ করে গেছে যে বর্তমান সরকারকে বিগত
বছরগুলোতে সেই উল্টো চাবি গোছাতে দলীয়করণ নীতি অনুসরণ করতে হয়েছে কালক্ষেপণের পথ ধরে।
তাতে কি সর্বক্ষেত্রে সফল হওয়া গেছে? তোষামোদীর দল যোগ্যতা
থাকুক আর নাই বা থাকুক এগিয়ে যায় বাহ্যিক কর্মযজ্ঞ দেখিয়ে। ফলে প্রশাসনের সর্বস্তরে
সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে। সমন্বয়হীনতার খেসারত বর্তমান সরকারকে দিতেও হচ্ছে বলা বাহুল্য।
দক্ষতা যাচাইয়ে যেমন ভুলভ্রান্তি হয়েছে তেমনি তোষামোদী দলগোষ্ঠির জয়-ই সর্বত্র দেখা
যাচ্ছে। এ অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব পরিবর্তনের মাধ্যমেই। প্রশাসনকে দলীয়করণ থেকে ফিরিয়ে
আনতে কর্মদক্ষ ও দেশের সেবায় নিয়োজিত প্রশাসনিক দক্ষ ব্যক্তিত্বদের এগিয়ে আসতে হবে।
জায়গা করে দিতে হবে। অনেক কম দক্ষতা সম্পন্ন প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব দমাদম পদোন্নতি পেয়ে
যাচ্ছে, প্রশাসনকে বিশৃঙ্খল করছে, দলীয় ভাবমূর্তি বড় হয়ে যচ্ছে
দেশসেবার বিপরীতে। অপরদিকে বর্তমান নতুন প্রজন্মের তরুণেরা সফলতার সাথে মোকাবিলা করছে
দেশের সকল দুর্যোগময় ক্লান্তিলগ্ন। তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রানা
প্লাজা ভবন ধ্বসটি দেখিয়েছে জাতিকে নতুন প্রজন্মের মানবিকতার বোধকে। নানা সামাজিক উন্নয়ন
সংগঠন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে হতভাগ্য শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছে/সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।
'শুনতে কি পাও' নামক এমনি একটি সংগঠনের কুষ্টিয়ার আনিস কিংবা আমিনুল
টানা ৬দিন ধ্বংসস্তুপের নীচ থেকে জীবিত মানুষের সন্ধান করেছে। উদ্ধারকার্যে স্বেচ্ছাশ্রম
দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য তরুণ ডাক্তার ও নার্স নিঃস্বার্থ মানবিকতার পথ ধরে।
দেশ সেবা ও দেশ গড়ার অঙ্গীকারে আসুক সেই পরিবর্তন।
দলীয়করণের দলতন্ত্র নীতির বদলে আসুক দেশগড়ার অঙ্গীকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন