মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৩

কেমন বাজেট চাই?


কেমন বাজেট চাই?

 

ফ.র. আল-সিদ্দিক ॥ একটা দেশের বাৎসরিক বাজেটকে সব সময়ই যুগোপযোগী হতে হবে। তাই আগামী বর্ষের জন্য বাজেট তৈরি করতে গিয়ে প্রথমেই আমাদেরকে যে কথাটি মনে রাখতে হবে, তা হলো, আমরা এখন একটা যুগসন্ধিক্ষণে বাস করছি। কারণ, এখন থেকে খুব দ্রুতই সারা পৃথিবীর হাইড্রোকার্বন, মানে তেল গ্যাস সম্পদ ফুরিয়ে আসবে।

অতএব, আগামী দিনগুলোতে আমাদের শিল্প কারখানাগুলো যে সব শক্তি দিয়ে চালাতে হবে, সেই সব শক্তি সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহার, এখন থেকেই আমাদেরকে দ্রুতগতিতে শুরু করতে হবে এবং সেই শক্তি সম্পদগুলো ব্যবহার করার জন্য আমাদের শিল্প কারখানাগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের কাজটা এখনই শুরু করতে হবে।

এই কাজটি করা যে কতটা জরুরি তা বুঝতে হলে যুগ পরিবর্তন সম্বন্ধে একটা সুষ্ঠু ধারণা থাকা চাই। তাই আমাদেরকে জানতে হবে যে, ১৪৯৭-৯৯ খৃষ্টাব্দের দিকে ভাস্কো-ডা-গামা কর্তৃক উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ইউরোপ থেকে ভারত উপমহাদেশে আসার নৌপথ আবিষ্কার করার সাথে সাথে, সারা বিশ্বে এমনি একটা যুগসন্ধিক্ষণের সৃষ্টি হয়েছিল।

সেই যুগসন্ধিক্ষণের আগ পর্যন্ত এই উপমহাদেশে যে সব বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়েছে, সেসব শত্রুর বেশির ভাগই এসেছে, এই এই উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিম সীমান্তের-খাইবার, গোলান, গোখাল, ইত্যাদি গিরিপথ দিয়ে। তাই তাদের আক্রমণ থেকে এই অঞ্চলটিকে বাঁচাবার জন্য আমাদের সৈন্য সামন্তকে ওই সব গিরিপথগুলোর এপাশে মোতায়েন রাখলেই চলতো। এবং সেই সৈন্যদের সবগুলো হতো স্থলবাহিনীর। তাই, এই উপমহাদেশের রাজ্যগুলো তাদের নৌ-বাহিনীকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেনি।

ইউরোপের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য, তাই নতুন নৌপথ আবিষ্কৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের বুঝতে পারা উচিত ছিল যে, এখন থেকে বৈদেশিক আক্রমণগুলোর বেশিরভাগই আসবে ইউরোপ থেকে এবং তা আসবে নৌপথের মাধ্যমে। তাই তখন থেকেই আমাদের নৌবাহিনীকে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের রাজন্যবৃন্দ সেই কথাটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই তারা শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গড়ে তোলার কোন চেষ্টাই করেনি।

সে যুগের বঙ্গীয় অঞ্চলের বণিক সম্প্রদায় এবং সমুদ্রোপকুলবাসীরা এই সমস্যাটি বুঝতে পেরে, তখনকার মুঘল সম্রাটকে এই কথাটি বুঝাবার জন্য তাদের একজন প্রতিনিধিকে দিল্লিতে প্রেরণ করেছিল। কিন্তু দিল্লির বাদশা সেই প্রতিনিধির কথাকে কোন পাত্তাই দেয় নাই। তাই তারাও পর্তুগীজ জলদস্যুদের প্রতিহত করার জন্য শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার কোন প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেনি।

তার ফলে পর্তুগীজ আরমাডার (হার্মাদ-দের) আক্রমণে আমাদের বণিকদের সামুদ্রিক বাণিজ্যপথগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে নৌ-বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে ইউরোপীয়দের অধিকারে চলে যায়। তার ফলে এই উপমহাদেশটি অর্থনৈতিকভাবে এতই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, ইউরোপের পক্ষে এই উপমহাদেশটি দখল করে নেয়া খুবই সহজ হয়ে যায়। সেই দখলদারীটা এতদিন ধরে চলে যে, তার হাত থেকে মুক্ত হতে আমাদেরকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সেবারের সেই যুগসন্ধিক্ষণে আমাদের যা করণীয় ছিল , তা করতে ব্যর্থ হবার জন্য আমাদের যা ক্ষতি হবার, তাতো হয়েই গেছে। তাই, এবারের এই যুগসন্ধিক্ষণটির প্রভাবকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের যা করণীয় তা আমাদেরকে অবশ্যই সঠিকভাবে পালন করতে হবে।

তাই এখন থেকে আমাদের দেশে, সে সব বাৎসরিক বাজেট, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং দশ শালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে, তার সবগুলোতেই এই যুগন্ধিক্ষণের জন্য আমাদের যা যা করণীয়, সে কথা মনে রেখে, তার জন্য বাজেট বরাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে।

তাই এখন আলোচনা করা যাক, এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় কি? - এই ব্যাপারে আমাদের প্রথম করণীয় হবে, নতুন করে কোন প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। তাই পরমাণু শক্তি এবং কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য বাজেট বরাদ্য রাখতে হবে।

এ দেশে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র যে কয়টা এখনো চালু আছে, সেগুলোকে কয়লা ভিত্তিক অথবা কোল-গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করতে হবে এবং এই কাজগুলো করার জন্য বাজেট বরাদ্য রাখতে হবে।

আমাদের গৃহস্থালিতে আমরা যে সব গ্যাস সংযোগ দিয়েছি অথবা দিতে যাচ্ছি, সেগুলোতে গ্যাসের অপচয় কমাবার উদ্দেশ্যে মিটার সংযোজন করার জন্যও বাজেট বরাদ্য রাখতে হবে। বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন বহুগুণ বৃদ্ধি করার জন্য পর্যন্ত বাজেট বরাদ্য রাখতে হবে।

আর একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ইউরিয়া উৎপাদনের জন্য আমাদেরকে গ্যাসের উপরই নির্ভর করতে হবে। অথচ এ দেশে যতটুকু বায়োগ্যাস উৎপাদন করা যাবে, তার বেশির ভাগই রান্না-বান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়ে যাবে। বাকিটা বিদ্যুৎ উৎপাদনে হয়তো ব্যবহার করা হবে। তাই এই গ্যাস ইউরিয়া উৎপাদনের জন্য পাওয়া যাবে না। তাছাড়া বায়োগ্যাসে সেসব অপদ্রব্য মিসৃত থাকবে, তার জন্য এই গ্যাস দিয়ে ইউরিয়া উৎপাদন অর্থকরি দৃষ্টি থেকে লাভজনক হবে না। তাই ইউরিয়া উৎপাদনের জন্য আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশ্বমজুদ যখন কমে আসবে, এবং এই গ্যাসের আমাদের মজুদ শেষ হয়ে যাবে, তখন যে সব দেশে গ্যাসের মজুদ তখনো টিকে থাকবে, তাদের কাছ থেকে আমরা ইউরিয়া কিনতে বাধ্য হবো। ইউরিয়া উৎপাদনের মনোপলি তখন তাদের হাতে চলে যাবে বলে তারা তখন এই ইউরিয়ার জন্য যে দাম থাকবে, সেই দামেই আমরা তাদের কাছ থেকে এই ইউরিয়া কিনতে বাধ্য হবো। ফলে, আমরা তখন তাদের হাতের মুঠিতে বন্দি হয়ে পড়বো।

এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে, আমাদের গ্যাসের মজুদ যাতে দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকে তার চেষ্টা করতে হবে এবং তা করতে হলে, একমাত্র ইউরিয়া উৎপাদন ছাড়া অন্যান্য শিল্পে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ভীষণ ভাবে কমিয়ে আনতে হবে। তার জন্যও বাজেট বরাদ্য রাখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন