মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৪

দুর্নীতি প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে আরও তৎপর হতে হবে

দুর্নীতি প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে 
আরও তৎপর হতে হবে

শেখ উল্লাস ॥  সমাজে দুর্নীতিবাজচক্র সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে উঠলে সৎ মানুষেরা কোণঠাসা ও মর্যাদাহীন হয়ে পড়ে। এরই একটি উদাহরণ - ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সরাইল থানার শাহবাজপুর গ্রামের মালেকা বেগম। স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি তিনি। (জামুকায় তার সর্বশেষ আবেদনের নম্বর: ডিজি ১৫৮৫৪, তারিখ-২৩/১০/২০১৩)। বিগত সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব যখন মালেকা বেগমের নিজ জেলার লোক ছিলেন তখনও মালেকা বেগমের চেষ্টা সফল হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একজন অসহায় ও দরিদ্র নারী হিসেবে তার অনেক কাজে আসতো। নিজের জীবনকে তিনি সার্থক মনে করতে পারতেন।  মালেকা বেগমের মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেতে ৪৩ বছর পার হয়ে যায়, অথচ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও নিজের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সনদ পেয়ে যান মন্ত্রণালয়েরই সচিব, উপসচিব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের মতো পদে থেকে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগকারী অনেক কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াত চক্র সক্রিয় থাকার কারণেই যে এমনটি হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ১৯৭১ সালের ১৯শে মার্চ জয়দেবপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের (জয়দেবপুর চৌরাস্তার জাগ্রত চৌরঙ্গী আজও যে স্মৃতি বহন করছে) অন্যতম নায়ক আ.ক.ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সনদ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতি তদন্তে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থাৎ, আমলাতন্ত্রে দুর্নীতিবাজরা যেভাবে ঘাপটি মেরে বসে আছে তা মোকাবেলার জন্য মুক্তিযুদ্ধের একজন বলিষ্ঠ সংগঠককে যথাযথ শক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করেই এগোতে হবে এবং লক্ষ্য অর্জনে একনিষ্ঠ হলে অবশ্যই তিনি সফল হবেন।
ইতোমধ্যে সনাক্ত করা হয়েছে বেশ কয়েক জন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাকে যারা দুর্নীতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ আদায়ে লিপ্ত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব এইচ মাসুদ সিদ্দিকী তার চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়াতে গত বছর নিজের মন্ত্রণালয় থেকে নিজেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছিলেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিদেশি অতিথিদেরকে ক্রেষ্ট প্রদান ও সনদে জালিয়াতি করার জন্য তাকে সচিবের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ওএসডি করা হয়েছে। জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ তোলার জন্য এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিকে সনাক্ত করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিককালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, সঠিক জায়গায় সঠিক লোক থাকলে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিন্তা-চেতনায় ও কর্মে আন্তরিক হলে যে-কোনো দুর্নীতিবাজকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।

সরিষা দিয়ে ভূত তাড়াতে হয় বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। কিন্তু  সর্ষের ভেতরেই যদি ভূত থাকে সে ভূত কে তাড়াবে? মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই জালিয়াত চক্র যদি ভুঁয়া সনদ তৈরিতে সক্রিয় থাকে, তাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদানে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপ দেশে দুর্নীতিবাজদের সনাক্তকরণের পথে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ -যা দেশের বিবেকবান মহল কর্তৃক অভিনন্দিত হবে-এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও তৎপর হতে হবে। দুর্নীতিবাজরা সকল নৈতিক মূল্যবোধ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ৭১' এর পরাজিত শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিভ্রান্ত, বিতর্কিত ও অমর্যাদাকর করে তোলার জন্য সব সময় তৎপর এবং এই চক্রটি থাবা বিস্তার করে আছে সর্বস্তরে। এই চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করাও তাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের কারণেই দেশে বৈষম্য, সন্ত্রাস, ধর্মান্ধতা ও অশান্তি সৃষ্টি হয়, এরাই  মানুষকে মিথ্যাচারের পথে ঠেলে দিতে প্ররোচনা দেয়। আজ দেশের নতুন বাস্তবতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিরাট দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওপর অর্পিত হয়েছে। সঠিক জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সঠিক ব্যক্তিত্বকে বসিয়ে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও আদর্শ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাবে-এটাই আজ জাতির প্রত্যাশা। 

সময়ের সাফ কথা .... উপদেশে কোন কাজ হয় না

সময়ের সাফ কথা ....
উপদেশে কোন কাজ হয় না

আরিফিন হক ॥ আমরা সর্বত্রই দেখতে পাই, একে অন্যকে উপদেশ দিচ্ছে -'সৎ হও, ভাল হও'। সম্ভবত পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যাকে উপদেশ দেয়া হয়নি -'সদা সত্য কথা বলিবে','মিথ্যা কহিও না','চুরি করিও না' ইত্যাদি। কারণে-অকারণে উপদেশ শুনতে শুনতে উপদেশ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও কেউ আর শুনতে চায় না, মানা তো দূরের কথা। শুধু তা-ই নয়, উপদেশ শুনলে অনেকেই চটে যায়, বিরক্ত হয়। তারপরও অবশ্য উপদেশদাতার কোনো ঘাটতি নেই।
কোনো প্রেমিক প্রেমাস্পদের কাছ থেকে উপদেশ চায় না, চায় ভালোবাসা। কোনো ভিক্ষুকও উপদেশ শুনতে পছন্দ করে না, সেও ভিক্ষা চায়। শুধু প্রেমিক বা ভিক্ষুকই নয়, উপদেশ কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো, আমাদের সমাজে সবাই শুধু উপদেশ দিতে চায়। উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মবেত্তা, রাজনৈতিক নেতা, ফতোয়াবাজ, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী, বন্ধু, এমনকি বয়সে যারা ছোট তারাও কম যায় না। আমাদের সমাজ জুড়ে কেবলই উপদেশ-দাতা, জীবনের প্রতি পদে পদে কেবল উপদেশ আর উপদেশ। এটা করো না, ওটা করো, ওভাবে করো না, এভাবে করো না। উপদেশ কেউ মানে না তবু আমরা একে-অপরকে উপদেশ দিয়েই যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। উপদেশ কোনো কাজে আসে না, তারপরও মানুষ কেন যে সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়, এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। মানুষের জীবনের অসংখ্য রহস্যের মধ্যে উপদেশ দেয়ার বাতিকটাও একটা বড় রহস্য বটে। মানুষ কেন উপদেশ দেয় আবার কেনই বা কেউ কারো উপদেশ মানতে চায় না, এসব রহস্য ভেদ করা জটিল। সম্ভবত উপদেশ দানের মূল কারণটি হলো - প্রত্যেক মানুষই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। সে যা জানে-বোঝে, অন্য কেউ তার ধারে কাছেও নেই - এমন একটা ভাব বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই কাজ করে।
সূফী সাধক আনোয়ারুল হক বলতেন -'যে উপদেশ চায় তাকে পারলে কিছু টাকা দিয়ে দিবেন আর যে টাকা চায় তাকে কিছু উপদেশ দিয়ে দিবেন।' আমরা না বুঝলেও, আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী এ বাণীর তাৎপর্য বুঝে ফেলেছে। তাই এখন দাতারা টাকার চেয়ে বেশি দেয় উপদেশ। আমরা দাতাদের কাছ থেকে টাকা চাই, ঋণ-অনুদান-সাহায্য চাই কিন্তু আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এখন আমাদের দেশে এসে দিয়ে যায় কেবল উপদেশ। তাদেরকে জানিয়ে দেয়া উচিত যে,  আমাদের দেশে মন্ত্রী থেকে যন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী থেকে পকেটমার, রিক্সাওয়ালা থেকে সচিব সবাই উপদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে সমান দক্ষ। আমাদের আর যা কিছুরই অভাব থাকুক না কেনো, উপদেশের কোনো অভাব নেই। কাজেই আমাদের ও জিনিসের কোনো দরকার নেই। আমাদের টাকার অভাব। তাই টাকা চাই, উপদেশ চাই না।
অনেকেই আমাদের কাছে উপদেশ চায়, কেবল কানচুলকানির বিকল্প হিসেবে। কাউকে উপদেশ দেওয়ার আগে উপদেশ দাতার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে সে প্রকৃতই উপদেশ চায় কি-না তা উপলব্ধি করা। যদি প্রকৃতই কেউ উপদেশ চায় তবে তাকে তাড়াহুড়ো করে  উপদেশ না দেয়া ভালো। আমরা হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই দ্রুত উত্তর দিতে পারি। কিন্তু, সেটা কি আসলে বিজ্ঞতার কাজ হবে, বিশেষভাবে যদি আমরা এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, যে-বিষয়ে আমরা খুব ভালোভাবে গবেষণা করিনি?
প্রেমময় ও যুক্তিযুক্ত উপদেশ মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। উত্তম উপদেশ দেয়া হলে তা স্থায়ী ফল উৎপন্ন করতে পারে। উত্তম উপদেশ দেয়ার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই যিনি উপদেশ চাচ্ছেন, তার পরিস্থিতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হবে। পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান না থাকলে আমরা হয়তো এমন উপদেশও দিতে পারি, যা একজন ব্যক্তিকে আরও বিভ্রান্ত করে দিতে পারে। সুতরাং যে কোন বিষয়ে উপদেশ কিংবা কোন প্রস্তাব উপস্থাপন করার আগে তা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সময় নেয়া দরকার। শুধুমাত্র ভালো উদ্দেশ্য থাকাই যথেষ্ট নয়।

অন্যদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা না করাই উত্তম। কোন ব্যক্তির উপর কখনও এমন ভার অর্পিত হয় না যা বহন করার যোগ্যতা সে রাখে না। যে ব্যক্তি উপদেশের প্রয়োজন অনুভব করে শেষ পর্যন্ত তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় উপদেশ সে গ্রহণ করবে কি না। জ্ঞানবানদের বাক্য মালবাহী পশুকে চালিয়ে নেয়ার জন্য ব্যবহৃত সূচালো লাঠির মতো। সূচালো লাঠির আঘাতে কষ্ট ও ক্ষতি স্বীকার করে যে যতদূর পথ অতিক্রম করেছে তার কাছে ততটুকু পথের খবরই আছে। উপদেশের সীমাও ঐ টুকুই। সীমালঙ্ঘন না করাই শ্রেয়।

‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাহি নহে কিছু মহীয়ান'

‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাহি
নহে কিছু মহীয়ান'

সংলাপ ॥ ২৭ আগস্ট - প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি, সাধক কবি নজরুলের মহাপ্রয়াণ দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৬ থেকে ২০১৪  কালিক যাত্রায় কত কিছুই না হারিয়ে গেছে কিন্তু নজরুল এমন এক নাম, এমন এক জীবন ও আদর্শ যা অম্লান ও জীবন্ত। শাশ্বত চেতনার ধারক হয়ে নজরুল তাঁর অস্তিত্বকে রেখেছেন চিরঞ্জীব করে। নজরুল ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
সাধক নজরুল কাব্যের উর্বর মাটিতে চালিয়েছেন চেতনার দুর্বার লাঙল, ফলিয়েছেন'কালের ফসল'। সে ফসলে নিজের ভোগাকাঙ্খা মেটাতে উদগ্রীব হননি কখনো। বিলিয়েছেন দু'হাতে, অকৃপণভাবে। কাব্যের রস আস্বাদন করে তিনি কাব্য-রসিকের হাতে তুলে দিয়েছেন অমৃতের সুধা। শিল্প-স্রষ্টা নজরুলকে সেই সব রসিকেরাই রেখেছে স্মরণে, প্রাত্যহিকতায়। কেবল 'জাতীয় কবি' বলে নয়, তাঁকে স্মরণ করতে হয় কালের প্রয়োজনে, আত্ম-অনুসন্ধানে, চেতনার উদ্বোধনে। জীবন এবং বাস্তবতার ঝড়ো হাওয়ায়  তিনি 'সত্যের পাঞ্জেরী' হয়ে ধেয়ে চলেছেন গন্তব্যে। পথ হারাননি। বরং পথ-হারাদের দেখিয়েছেন পথের দিশা। জাগরণের উদ্বোধনী সঙ্গীত বারবার বেজে উঠেছে তাঁর কন্ঠে। তিনি মুক্তি চেয়েছেন - নিজের এবং মানুষের। বিশ্ব মানবতার জয়গানে তিনি আত্মনিবেদিত।
আয়ুষ্কাল বিচারে নজরুলের জীবন যতখানি বিস্তৃত, সৃষ্টিশীলতার বিচারে তা আরো বহুগুণ সুদূর প্রসারী এবং যথার্থ মূল্যায়নের দাবিদার। সময়ের হিসেবে তাঁর সৃষ্টি-কর্মের দৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন, সেই সময়েই তিনি পেয়েছেন এবং দিয়েছেন বৃহতের সন্ধান। সাহিত্যের সকল শাখায় শিল্প-সাধনার স্বাক্ষর রেখে তিনি আস্বাদন এবং প্রস্বেদন করেছেন মানবতা। নিছক শিল্পের জন্য শিল্পের পূজারী ছিলেন না তিনি। তিনি গগণচারী শিল্পকে টেনে নামিয়েছেন মাটিতে, গণমানুষের পায়ের কাছে। নতুন  এক জয়ডঙ্কা বাজিয়েছেন তিনি বিপ্লবী চেতনায়। নিভৃতে শিল্প সাধনার একাকীত্বকে এড়িয়ে তিনি গণ-মানুষের মাঝে একক হয়ে সাহিত্য-সেবায় নিজেকে চিরভাস্বর করেছেন। এখানেই তিনি ব্যতিক্রম। তিনি নতুন পথের স্রষ্টা।
স্বতন্ত্র সাত্ত্বিকতায় তিনি জীবনের যে আদর্শ বিশ্ব মানবতার জন্য তুলে ধরেছেন তা অনুসরণীয় অবশ্যই। সংগ্রামে এবং প্রেমে তিনি যে সুকঠিন ও সুকোমল বৃত্তের পরিধি রচেছেন সেখানে আছে জীবনের স্পন্দন এবং মুক্তির বারতা। ভাঙা এবং গড়ার মাঝে বার বার তিনি নতুনের সন্ধান দিয়েছেন। দু'হাতে ত্যাগের নিশান উড়িয়ে তিনি নিজেকে করে গেছেন চিরন্তন। চির নতুনের মাঝে তাই তিনি চির বরণীয় হয়েই থাকবেন।

ভেতরে ও বাহিরে যার সমান বিস্তৃতি তিনিই পূর্ণাঙ্গ সত্তা। নজরুলও তেমনই এক সত্তা। অর্থের বন্ধনী ভেঙে তিনি নিজেকে বিস্তৃত করেছেন 'অর্থপূর্ণ এক জীবন্ত সত্তা' রূপে। সে সত্তায় যেমন আছে জাতীয়তাবাদ, তেমন আছে মানবতাবাদ। অসামপ্রদায়িক এই সত্তার জীবন-দর্শন বর্তমানের জন্য একান্ত জরুরি। বিভেদের এই বিচূর্ণ সময়ের ধোঁয়াটে মেঘ সরাতে সাম্যের নজরুলী আহ্বান এখন অতি আবশ্যক। বাংলার বুকে কার কন্ঠে ধ্বনিত হবে সেই আহ্বান? এ প্রতীক্ষায় আছে বর্তমানের অস্থির সময়।

ইয়াবা কারখানা!

ইয়াবা কারখানা!

সংলাপ ॥ মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সাগর সীমান্তে ইয়াবা তৈরির জন্য গড়ে উঠেছে ৪০টি কারখানা। আর চট্টগ্রামের নৌপথে আসছে কোটি-কোটি টাকার এসব ইয়াবা। পার হয়ে যাচ্ছে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। পাচারকারীরা অত্যন্ত সুকৌশলে এ মাদক নিয়ে আসছে রাতের আঁধারে। এ সব চালানের কিছু ধরা পড়লেও বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ইয়াবা পাচারের ঘটনায় কোস্টগার্ডের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত রোববার কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে ১০ কোটি টাকার ইয়াবা। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীতে। সূত্র জানায়, পাচারকারীরা ইয়াবা পাচারের রুট বদল করেছে। তারা এখন সড়কপথের চেয়ে নৌপথ বেশি বেছে নিচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে সাগর পথে টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করছে লাখ লাখ। বিশাল একটি অংশ চলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম চ্যানেল দিয়ে দেশের বিভিন্ন নৌরুটে। কিছু আসছে কর্ণফুলী, সাঙ্গু, নাফ নদ দিয়ে পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এসব ইয়াবার চালান পাচারের কাজে জড়িত রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা নৌকায় পণ্য পরিবহনের নামে এসব ইয়াবা নিয়ে আসছে গভীর রাতে।
আটক হওয়া ইয়াবার একাধিক চালানের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, বেশির ভাগ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে। গত শনিবার রাত দুইটায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে হানা দেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এসময় তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পান একটি চক্র প্রচুর পরিমাণ ইয়াবা সাগর থেকে কর্ণফুলী নদীতে নিয়ে আসছে। এগুলো আনোয়ারা হয়ে পাচার করা হবে বিভিন্ন অঞ্চলে।
কোস্টগার্ডের সদস্যরা স্থানীয় কাফকো এলাকায় অভিযান চালান। এ সময় তারা একটি নৌকা থেকে দুই লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। তবে কাউকে ঘটনার সময় আটক কিংবা গ্রেপ্তার করা যায়নি। পাচারকারীরা কোস্ট গার্ড সদস্যদের দেখে নৌকা থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়ে। পরে নৌকায় খালি থাকা একটি তেলের কন্টেইনারের ভেতরে ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো দেখা যায়। এ সময় কন্টেইনারে মোট ২০টি প্যাকেট পাওয়া যায়। যার প্রতিটিতে ১০ হাজার করে ইয়াবা ছিল। এর বর্তমান বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের গত ২০শে জুন গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে আরও ৩০ হাজার পিস ইয়াবা। এগুলো পাওয়া যায় শহরের পাথরঘাটা ফিশারিঘাট এলাকা থেকে। এ ঘটনায় অবশ্য আক্তার ও আজম নামে দুই হোতাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে প্রচুর পরিমানে ইয়াবা মাদক পাচার হচ্ছে। যার বেশির ভাগই আসছে মিয়ানমার থেকে। এসব ইয়াবার রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে টেকনাফের নাফ নদীকে।
পাশাপাশি কর্ণফুলী নদী হয়ে সাগর দিয়ে বিশাল চালান চলে যাচ্ছে নোয়াখালীর দিকে। পুলিশ কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করে জানিয়েছেন, আগের মতো সড়কপথে আর ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে না। যেমনটি আটক করা হচ্ছে সাগর কিংবা নদী থেকে। আটক হওয়া আক্তার ও আজম এ বিষয়ে পুলিশকে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব চালান বড় বড় ট্রলার থেকে খালাস হচ্ছে। উপরের গ্রিন সিগন্যাল থাকায় সাধারণ নৌকাতেও নিয়ে আসা হচ্ছে কমপেক্ষে ৫০ থেকে ৮০ হাজার পিস ইয়াবা। সেগুলো আনা হচ্ছে মাছ ধরার বড় বড় ট্রলারে। এসব ইয়াবা তৈরি করছে মিয়ানমারের একটি চক্র। সেখানে ওরা কারখানা গড়ে তুলেছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার বলেন, 'নৌপথে আটক করা বেশ কিছু চালানের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত। কেননা, সড়কপথে গোয়েন্দা পুলিশ ভীষণ তৎপর রয়েছে। কিন্তু এখন যেভাবে সাগর কিংবা নদী দিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে পাচারকারীরা রুট পরিবর্তন করেছে। তবে আমরা পুলিশ বিভাগ এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছি। বিষয়টি আর বেশিদূর এগোতে দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, নৌপথে নিরাপত্তা ও তল্লাশি বাড়ানোর জন্য শিগগিরই উপরের মহলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে জরুরিভাবে কথা বলা হবে। পাচারকারীরা কৌশলে মাছের চালান কিংবা নৌকার পাটাতনের নিচ দিয়ে এসব ইয়াবা পাচার করছে। ঘটনাটি ভাবিয়ে তুলেছে পুরো পুলিশ বিভাগকে।
সাগরের ওই পাড়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ইয়াবা পাচারের জন্য গড়ে উঠেছে ৪০টি কারখানা। বিভিন্ন ঘটনায় আটক হওয়া পাচারকারীরা এমনি তথ্য দিয়েছে তাদের। কক্সবাজার ও টেকনাফের গডফাদাররা এসব ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। কেবলমাত্র জুন ও জুলাই মাসেই তারা উদ্ধার করেছে তিন লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা।
এ সব ঘটনায় আটক করা হয়েছে মাত্র ৫ জনকে। কেননা পাচারকারীরা প্রতিবারই কোস্টগার্ডের উপস্থিতি টের পেয়ে এসব ইয়াবা ফেলে  রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। ঈদের আগে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেলের কাছাকাছি একটি ট্রলারে অভিযান চালিয়ে দেড় লাখ পিস ইয়াবাসহ একজনকে আটক করেন কোস্টগার্ড সদস্যরা। তার নাম রফিক আজিজ (৫৫)। সে একজন বড় ধরনের ইয়াবা পাচারকারী। এ সময় সে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ইয়াবা তৈরির একাধিক কারখানার কথা জানায়।

কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের জোনাল কমান্ডার শহীদুল ইসলাম বলেন, পাচারকারীদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বেশ কয়েকজন বড় গডফাদার ধরা পড়েছে। তাদের কাছ থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। আশা করছি এ রুটে ইয়াবা পাচার অনেক কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, এত ইয়াবা কোথা থেকে আসছে তা নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে বসে এগুলো তৈরি করা অনেক দুরূহ। কক্সজার, টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসছে পাচারকারীরা। পরে  রুট হিসেবে ব্যবহার করছে   সাগর ও নদীগুলোকে। পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের সঙ্গে এদেশের একটি বড় ধরনের সিন্ডিকেট যৌথভাবে কাজ করছে। ধারণা করছি তারাই ইয়াবা তৈরি করে এদেশে বিক্রির জন্য পাঠাচ্ছে।

রাজনীতির বিবর্তন ও সৈয়দ আশরাফের আক্ষেপ

রাজনীতির বিবর্তন ও সৈয়দ আশরাফের আক্ষেপ


বর্ষা ॥ তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল বাংলাদেশের ডামাডোলের এ সময়ে রাস্তাঘাটের দিকে এক নজর তাকালেই বোঝা যায় এদেশের রাজনীতি কতটা বদলে গেছে। আগের দিনে একজন ছাত্র নেতা কিংবা রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা করতেন ছাত্রসভায় বা জনসভায়, ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতো, যে দৃশ্য এখন দেখা যায় না বললেই চলে।  সেই জনসভায় বক্তৃতা বা ভাষণ দেয়ার আগে সেই নেতাকে কত রকমের যোগ্যতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হতো- সে সব কথা সংশ্লিষ্ট সচেতন মানুষেরা এখনো ঠিকই স্মরণে রেখেছে। আগের দিনে নেতা হতো জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্নভাবে নির্বাচিত হয়ে, নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগেও দেশ ও জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে কতো আন্দোলন-সংগ্রামেই না তাদেরকে যোগদান করতে হতো। কতো ত্যাগ-তিতিক্ষাই না ছিলো একজন নেতার জীবনে। এখন রাজনীতি করা যেন শুধুই পাওয়ার জন্য। অবশ্য ভুঁইফোড় নেতা কিংবা সংগঠন তখনো যে ছিলো না তা নয়। তবে তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রের নিয়ামক শক্তি ছিলো না। এখন ডিজিটাল ব্যানার আর অসংখ্য টিভি চ্যানেলের কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভুঁইফোড় নেতাদেরকেই রাজনীতির প্রধান শক্তি হিসেবে দেখা যায়। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন এমন অবস্থাতেই পৌঁছেছে যে, নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ 'নেই বললেই চলে' অবস্থা। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে নির্বাচন হয়নি বলে সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত দেখানো হয়েছে। দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। আগের দিনের জনসভার স্থান আজ যেন দখল করে নিয়েছে মানববন্ধন, কিংবা জনসভার চাইতে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ডিজিটাল ব্যানার। কিছু টাকা খরচ করে বড় বড় ছবি ছাপিয়ে রাস্তার এপাশ-ওপাশ দখল করে টাঙ্গিয়ে দিলেই হলো। মানুষ তার ছবি না দেখে যাবে কোথায়? এই জাতীয় ছবি টানানোর পেছনে যে কতো রকমের বাণিজ্য ও মিথ্যাচার আছে তাও এদেশের রাজনীতির ইতিহাসের এক দুঃখজনক অধ্যায়। বড় বড় নেতা-নেত্রী এমনকি স্বাধীনতার মহান স্থপতির ছোট্ট ছবির পাশে নিজের একখানা বড় ছবি ছাপিয়ে পোষ্টার-ব্যানার টাঙ্গিয়ে দেয়া হচ্ছে রাস্তার পাশে। এই অবস্থায় আক্ষেপ করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এবারের ১৫ই আগষ্টে রাজধানীতে জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনা সভায়  নিজ দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা তাকে না জানিয়ে তার ছবি দিয়ে পোষ্টার ছাপানোর জন্য আক্ষেপ করে চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি ও অন্তর্দলীয় কোন্দল থেকে বিরত থাকতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একজন সৎ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই আক্ষেপ, এই জাতীয় উপলব্ধি সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নতি হবে। নচেৎ রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা থেকে আরও দূরে সরে যাবেন-এই আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে যা দেশের জন্য আরও অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে।

বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০১৪

ধর্ম যার যার কিন্তু রাষ্ট্র কি সবার?

ধর্ম যার যার কিন্তু রাষ্ট্র কি সবার?

সিদ্ধার্থ ॥ বরাবরই জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সমাবেশে বক্তারা বলে থাকেন - 'ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার'। এবারও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ কথাটি উঠে এসেছে। গত রোববার সকালে সিরাজগঞ্জে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন - 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার'। নাসিম বলেন, 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মহানায়ক। '৭৫-এ ওরা জাতির জনক ও তার পরিবারকে হত্যা করে দেশটাকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছিল। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারো বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে পরিণত করা হয়েছে। ধর্ম যার যার এবং রাষ্ট্র সবার  এ দীক্ষায় আমরা সবাই এদেশে বসবাস করবো'। 'এদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করানোই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লক্ষ্য' - একথা উল্লেখ করে নাসিম বলেন, 'এ অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে দলমত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সহযোগিতা করতে হবে।'
ধর্ম সম্বন্ধে রাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব বন্ধ করাটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ন্যূনতম দাবি। '৭১-এ সাধারণ মানুষের আকাঙ্খা ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সকল ধর্ম ও ধর্মপালনকারীদের প্রতি সম-আচরণ করা হবে। রাষ্ট্রে ধর্ম থাকবে তবে রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না। অর্থাৎ, রাষ্ট্র কোন ধর্মের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না, রাষ্ট্র তার ধর্ম সম্বন্ধে নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে, মানুষের কর্মকাণ্ড এবং সিদ্ধান্তগুলো বিশেষত রাজনীতিক সিদ্ধান্তগুলো, তথ্য এবং প্রমাণের উপর নির্ভর করবে, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নয়। বলাই বাহুল্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা ধর্মকে ব্যবহার করেন হাতিয়ার হিসেবে। ধর্ম যখন রাজনীতিকদের হাতিয়ার হয়ে যায় তখন ধর্মের ভয়াবহ রূপ ধরা পড়ে মানবসমাজে উগ্র ধর্মান্ধতা হয়ে। রাজনীতিকরা সর্বদাই ধর্মকে ছলে-বলে-কলে কৌশলে এমনভাবে মোড়ক দিয়ে রেখে আসছে যাতে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের আসল রূপ 'শান্তি' ও 'সত্য' না বেরিয়ে পড়ে। তাই ধর্মের প্রগতিশীলতা মেহনতী মানুষের হাতিয়ার হতে পারেনি, এখনও পারছে না। বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৌদি ইসলামের ধর্ম-ব্যবসায়ী, ধর্মবেত্তারা এমনভাবে ঢুকে পড়ে মিথ্যাচারের প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে যাতে মনে হয় রাজনীতিকরা আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। রাজনীতিকরা শ্রমজীবী মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে, মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধর্মের নামে ব্যবসার জাল বিছিয়ে শোষণ এবং শাসন করে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে উঠতি রাজনীতিক লুটেরা শ্রেণী। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে এমন এক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, যে কোন সময় বিস্ফোরণ হতে পারে।
রাজনীতির মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতা। যখন ক্ষমতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয় তখন উদ্ভব ঘটে সাম্প্রদায়িকতার। সাম্প্রদায়িকতায় ধর্ম চলে যায় রাজনীতির অধীনে, তখন হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার অনাচার আমরা অতীতে দেখেছি, এখনো দেখছি। কেবল উপমহাদেশে কেন, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তো এখন সাম্প্রদায়িকতার তাণ্ডব চলছে। ক্রুসেড ও জিহাদের ঘটনা অতীতের  মতো একালেও বিদ্যমান। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে ফিলিস্তিনবাসীকে উচ্ছেদ করে ধর্মরাজ্য কায়েম করার প্রচেষ্টা এখনও চলছে।
রাজনীতিতে ধর্ম আসে, ধর্মের স্বার্থে নয়, রাজনীতিকদের বস্তুগত স্বার্থে। ক্ষমতায় যাবার জন্য এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা ধর্মকে ব্যবহার করে। সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরোধের মূল কারণটি রাজনৈতিক, যার সঙ্গে রাষ্ট্র জড়িত থাকে। সে জন্যই রাষ্ট্রের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্র হচ্ছে নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র সব নাগরিককে সমান চোখে দেখবে - এটিই প্রত্যাশিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব নাগরিকের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে - এমন অঙ্গীকার বেশ জোর গলায় ব্যক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্র তা মান্য করে না। রাষ্ট্রমাত্রেই রাষ্ট্রশাসকদের স্বার্থ দেখে।
আমরা স্বীকার করি বা না করি এ নিয়ে কোন বিতর্কের অবকাশই নেই যে ধর্ম যার যার। 'যত কেল্লা তত আল্লাহ'। সৃষ্টিকর্তা এক এবং অদ্ধিতীয় কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সমন্ধে প্রত্যেক মানুষের ধারণা এক নয়। জগতের প্রত্যেক মানুষ যেমন অনন্য তেমনি প্রত্যেক মানুষের ধর্মবোধও অনন্য। প্রত্যেকেই নিজের ধর্ম নিজে ধারণ, পালন করে। সুতরাং ধর্ম অবশ্যই যার যার। কিন্তু রাষ্ট্র কি সবার? বর্তমানে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি কার?
সত্য হলো - বাংলাদেশ সবার নয়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের। রাষ্ট্রে যতক্ষণ শ্রেণীবিভক্তি থাকে ততক্ষণ রাষ্ট্র সবার হতে পারে না, তা নির্দিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কাজেই ব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে ধনিক শ্রেণী রাষ্ট্রের সমস্ত হাতিয়ার - যেমন, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রচার মাধ্যমসহ সমস্ত কিছু নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহার করে থাকে। ধনিক শ্রেণী ছলে ও বলে নিজেদের মুনাফা আহরণের পথকে কণ্টকমুক্ত রাখতে শ্রমজীবী মানুষসহ যে কোনো নিপীড়িত শ্রেণীর প্রতিরোধকে দমন ও দিক্‌ভ্রান্ত করে।
বাস্তবতা হলো এই যে, আধুনিক বিশ্বে পুঁজির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএনডিপি, ডিএফআইডি, ইউএসএইড থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এই বিশ্বব্যবস্থার ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করছে। আধিপত্যশীল শক্তি হিসেবে এখন ধর্মের ভূমিকা প্রান্তিক। বস্তুত ধর্মকে কেবল শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহার করা হয় ক্ষমতার ভীতকে পাকাপোক্ত করার জন্য। সেটা যেমন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার চেহারায় হতে পারে তেমনি তা ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা - এমনকি উগ্র ধর্মবিরোধিতার রূপ নিয়েও আসতে পারে। পুঁজির সার্বভৌমত্বে অবস্থান করে রাষ্ট্র ও ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা কোন রাজনৈতিক কিংবা ধর্মতাত্ত্বিক তাৎপর্য বহন করে না।  রাজনীতিকরা ধর্মকথা বলেন কেবল নিজেদের স্বার্থে।

রাজনীতিকদের দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রকে সবার করা। রাষ্ট্রে সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। এখনও সময় আছে - মিথ্যাচার ছেড়ে দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনীতিকরা রাজনীতি করুন। ধর্ম যার যার আছেই এ নিয়ে আপনাদের না ভাবলেও চলবে, রাষ্ট্রটাকে সবার করুন। নচেৎ শ্রমজীবী মানুষের বিস্ফোরণ অনিবার্য হয়ে উঠবে।

গুরুই যথার্থ সারথি

সময়ের সাফ কথা ....
গুরুই যথার্থ সারথি

আরিফিন হক ॥ যারা বুদ্ধিমান তারা ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জীবনযাপন  করে। আর যারা নির্বোধ তারা ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে জীবনযাপন করে। ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে জীবনযাপন করলে যতো কিছুই প্রাপ্তি হোক না কেন পরিণামে তৃপ্তি হয় না। আর অতৃপ্তি হচ্ছে দুঃখের কারণ। যদি কারও অর্থ বিত্ত নাও থাকে কিন্তু অন্তরে তিনি যদি তৃপ্ত হন তাহলে তিনি সুখেই আছেন, আর কারও কাছে প্রচুর অর্থ বিত্ত থাকা সত্ত্বেও যদি তিনি অন্তরে অতৃপ্ত হন তাহলে তিনি দুঃখেই আছেন। তাহলে সুখ বা দুঃখের মূল কারণটি হচ্ছে তৃপ্তি এবং অতৃপ্তি, অন্তরের সন্তুষ্টি এবং অসন্তুষ্টি। অন্তরে যিনি সন্তুষ্ট তার কাছে যদি কিছু নাও থাকে, তবুও তিনি সুখী। আর অন্তরে যিনি অতৃপ্ত, অন্তরে যিনি অসন্তুষ্ট ও অশান্ত, তার কাছে সবকিছু থাকলেও তিনি অসুখী।
যারা ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করে তারা সর্ব অবস্থাতেই অতৃপ্ত থাকে, কেন না ইন্দ্রিয়ের অবস্থাটিই এই রকম। ইন্দ্রিয় সব সময়ই ভোগ চাইছে। সে সর্বদা বলে আমি এটা চাই, আমি ওটা চাই। কিন্তু সে যতই পায় কখনও কি সে তৃপ্ত হয়? উপভোগের দ্বারা কখনই ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা যায় না বা তৃপ্ত করা যায় না। অগ্নিতে ঘি ঢেলে অগ্নি নেভানো যায় না। যত ঘি ঢালা হবে আগুন ততই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠবে। অর্থাৎ যারা ইন্দ্রিয় উপভোগের মাধ্যমে তৃপ্তি সাধন করতে চায় তারা কখনও তৃপ্ত হতে পারে না।
আমাদের দেহটিকে যদি একটি রথের সঙ্গে তুলনা করি, ইন্দ্রিয়গুলিকে যদি পাঁচটি ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করি তাহলে এই রথটি কিভাবে আমাদের চালাতে হবে? ঘোড়াগুলিকে সংযত করার জন্য লাগাম দরকার। লাগামটি হলো চিন্তা। আবার লাগামটাকে সংযত করতে হলেও একজন সারথি বা চালক প্রয়োজন। সেই সারথি কে? - 'আমি'। কিন্তু 'আমি' কে? তা আমরা জানি না। তাই এমন এক 'আমি'র সাথে সংযোগ দরকার যে 'আমি' 'আমি'-কে চিনে। এই 'আমি'ই গুরু।

রথ তা জীবনেরই হোক কিংবা যুদ্ধের গুরুই যথার্থ সারথি। সুতরাং - ‘হে মানবজাতি! তোমরা যে ধর্মাবলম্বীই হও না কেন দ্বীন-দুনিয়ার শান্তি ও মঙ্গল হাসিল করার জন্য মুর্শিদ/গুরু/পথ-প্রদর্শক তালাশ কর এবং সংযোগ স্থাপন কর। যদি সংযোগ স্থাপন করতে না পার তাহলে অন্ততঃপক্ষে সংযোগ রক্ষা করে চল।’

মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৪

নবাব খেতাব ফিরে পেলো মীরজাফরের বংশধর

নবাব খেতাব ফিরে পেলো মীরজাফরের বংশধর

সংলাপ ॥ ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে ধিক্কৃত চরিত্র মীরজাফরকে মুর্শিদাবাদের মস্‌‌নদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন লর্ড ক্লাইভ। সেদিন বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পরাধীন ভারতের গ্লানির দীর্ঘ অধ্যায়ের শুরু। ২৫৭ বছর পর এবার সেই মীরজাফরের বংশধরকেই মুর্শিদাবাদের নবাবের স্বীকৃতি ফিরিয়ে দিল স্বাধীন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর মুর্শিদাবাদের নবাবের স্বীকৃতি পেলেন আব্বাস আলি মির্জা।
গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং বিচারপতি আর কে আগরওয়ালের ডিভিশন বেঞ্চের এই রায়ে আপাতত কিনারা হলো দীর্ঘদিন ধরে চলা এক আইনি ধাঁধার। ১৯৬৯ সালে কলকাতায় মারা যান মুর্শিদাবাদের শেষ নবাব ওয়ারিশ আলি শাহ। কিন্তু তার মৃত্যুর পর নবাবি খেতাব কে পাবেন তা নিয়ে আইনি লড়াই বাধে তার পরিবারে।
ওয়ারিশের এক ছেলে ইহুদি মহিলাকে বিয়ে করায় তিনি গোড়াতেই সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এর পর মামলায় জড়িয়ে যান ওয়ারিশের দুই ভাই ফতেয়াব আলি মির্জা এবং কাজিম আলি মির্জা। নবাবের খেতাব দাবি করে মামলা চালাচ্ছিলেন ফতেয়াবের ভাগনে আব্বাস আলি মির্জা। 'মুর্শিদাবাদের নবাব' হওয়ার খবর পেয়ে তার প্রতিক্রিয়া, 'এই স্বীকৃতিটুকু আদায়ের জন্য বহু লড়াই করেছি। এই স্বীকৃতি আমার পূর্বপুরুষের আত্মাকে শান্তি দেবে'।
তবে আব্বাস আলির পূর্বপুরুষের ইতিবৃত্তকে বরাবর ঘৃণার চোখেই দেখেছে আপামর ভারতবাসী। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার হিসেবেই মীরজাফর নবাবি পেয়েছিলেন বলে মনে করেন দেশের অধিকাংশ মানুষ। তার পরিবারের এই আইনি লড়াই তাই গোড়া থেকেই ছিল নিঃসঙ্গ। সেই কথাই শোনা গেল আব্বাসের আত্মীয় রেজা আলি খানের গলায়। তার আক্ষেপ, হাজারদুয়ারির প্রাসাদের পাশে যে ওয়াসিম মঞ্জিলে বেড়ে উঠেছেন তিনি, সরকার সম্পত্তি দখলের পর সেই বাড়িতেই অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়েছে তাদের। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর হাজারদুয়ারির বিরাট প্রাসাদ, সংলগ্ন ইমামবাড়া, মতিঝিল, ওয়াসিম মঞ্জিলের মতো ঐতিহাসিক সৌধগুলোর দখল আদৌ তারা ফিরে পাবেন কিনা তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়।
বস্তুত এই মামলাকে ঘিরে একটা সময় কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতও চরমে উঠেছিল। সত্তরের দশকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবের উত্তরাধিকারী কে তা জানতে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনসুর হবিবুল্লাহের উদ্যোগে রাজ্য সরকার এই মামলায় জড়িয়ে পড়ে। জ্যোতি বসুর বাম সরকার হাজারদুয়ারি-সহ মুর্শিদাবাদের নবাবের বিপুল সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে নেয়। সেই তালিকায় ঢুকে যায় কলকাতার চৌরঙ্গি এলাকার একটি বিশাল প্রাসাদ। জটিলতা রয়েছে ৮৫ পার্ক স্ট্রিটের কয়েক একরের বিশাল বাড়িটি নিয়েও। ইংরেজ শাসনে কলকাতা যখন ভারতের রাজধানী, তখন দেশের শাসকদের সঙ্গে দরবার করার জন্য ওই বাড়িটি তৈরি করেছিল নবাবের পরিবার। কিন্তু আটের দশকের গোড়ায় মামলার নিষ্পত্তি চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারস্থ হন মীরজাফরের উত্তরসূরিরা। কেন্দ্রের রাজীব গান্ধীর সরকার তলে তলে তাদের নবাবি খেতাব ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে জেনে নিজের ক্ষোভ গোপন করেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে এর প্রতিবাদে কড়া চিঠিও লেখেন তিনি। তাতেও হাল ছাড়েননি মীরজাফরের পরিবারের সদস্যরা। একদিকে, নবাবির স্বীকৃতি অন্যদিকে মাথার উপর ছাদ থাকার অধিকারের দাবি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তারা। রাজ্য সরকারের অধিগৃহীত সম্পত্তির সেই মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বৃটিশ পার্লামেন্ট মীরজাফরের পরিবারকেই মুর্শিদাবাদের নবাবের স্বীকৃতি দেয়। সেই আইন বলে বছরে এক লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা ভাতা বরাবরের জন্য পাওয়ার দাবিদার হন তারা। কিন্তু সেই স্বীকৃতিও মুছে যায় ১৯৬৯-এর পরে। এতদিন পরে নবাবের আইনি স্বীকৃতি ফিরে পেলেন আব্বাস আলি মির্জা। কিন্তু পরিবারের কলঙ্কিত ইতিহাস কি আদৌ মুছতে পারবেন মুর্শিদাবাদের নবাব?

চিন্তার সংযম ও একরৈখিকতা

চিন্তার সংযম ও একরৈখিকতা

আল্লামা নূরী ॥ চিন্তা চেতনার একপ্রকার ক্রিয়া। মস্তিষ্কের বিভিন্ন চেম্বার অথবা কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে চিন্তা, উদ্রেক উদ্‌গত ও উৎসারিত হয় এবং হৃদয়যন্ত্রে এসে তা নিবস্তু ও বস্তু নির্বিশেষে বিষয়াদি অবলম্বনে স্বতন্ত্র নাম ও রূপ লাভ ও ধারণ করে।
হৃদয়যন্ত্রে এসে নানান স্বতন্ত্র নাম ও রূপ লাভ ও ধারণ করার পূর্ব পর্যন্ত কোন ব্যক্তির মস্তিষ্কে ষাট/সত্তর অথবা আরো বেশি চিন্তা থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু তা হৃদয়যন্ত্রের ছকে এসে বিভিন্ন বিষয় আশ্রয়ী রূপ ও নাম লাভ ও ধারণ করার পর চিন্তা সততই সীমিত সংখ্যায় উপনীত হয়। এ সীমিত সংখ্যক চিন্তাকে নিজের পছন্দ ও প্রয়োজনানুযায়ী আরো সীমিত করার নাম চিন্তার সংযম। মনে রাখা প্রয়োজন যে, চিন্তার সংযম অর্থ চিন্তাকে সংখ্যায় কমিয়ে আনা, চিন্তার পরিসর অথবা প্রসারতা বা সীমাকে সংকোচিত করা নয়।
উল্লেখ্য যে, চিন্তাকে সংখ্যায় সীমিত বা সংযত করা হলে কোন বিষয়ে চিন্তার কার্যকারিতা, শক্তি নিপুণতা এবং নির্ভুলতা বা বিশুদ্ধতা ততই বৃদ্ধি পায়। এজন্যই সাধকগণ সাধারণত একরৈখিক অর্থাৎ বস্তু ও নিবস্তু নির্বিশেষে একই সময়ে কেবল কোন একটি বিষয়ে নিজ নিজ চিন্তাকে নিবিষ্ট নিবদ্ধ করা ও রাখার অভ্যাস করার উপদেশ দিয়ে থাকেন; কারণ তাতে চিন্তা শক্তিশালী ও নির্ভুলভাবে সফল হয়।
উল্লেখ্য যে, চূড়ান্ত অর্থে চিন্তার সংযমের মর্মার্থই হলো চিন্তাকে একরৈখিক তথা এক সময়ে একচিন্তায় নিজ সর্বশক্তি নিয়োগ-নিবিষ্ট করার সাধনা কিংবা অভ্যাস করা।

সার্থক ও সফল কার্যকর চিন্তার জন্য এর কোন বিকল্প নেই। প্রসঙ্গক্রমে স্মর্তব্য যে, চিন্তার মূল উপাদান ও উৎস ইন্দ্রয়াদি অর্থাৎ যে সকল দেহ-যন্ত্র ও শক্তি দ্বারা বাহ্য বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান ও বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ জন্মে। সে সবের সংগৃহীত তথ্যাদি। মস্তিষ্ক হলো চিন্তার প্রক্রিয়া ও প্রকর্ষণযন্ত্র; আর হৃদয় হলো চিন্তার শ্রেণী বিন্যাস যন্ত্র বিশেষ, এ যন্ত্রে এসে চিন্তা বিশেষায়িত এবং বিশিষ্ট হয়। 

চাওয়া পাওয়া

চাওয়া পাওয়া

দিগন্ত ॥ আল্লাহ্‌ সর্বত্রই বিরাজমান। এমন কোন স্থান নেই যেখানে তিনি অনুপস্থিত। অতএব, তাঁকে এখান থেকে ওখানে খুঁজে বেড়ানো মূর্খতা। আল্লাহকে খোঁজা এবং খুঁজে পাওয়ার ধারণাতেই রয়েছে ভ্রান্তি। কিভাবে তাঁকে খুঁজতে এবং খুঁজে পেতে পারি যিনি এখন এখানেই রয়েছেন? সুতরাং আল্লাহকে পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা নয় বরং আল্লাহকে দেয়ার প্রশ্নটাই প্রধান। আমরা শুধু পেতে চাই, এমনকি আল্লাহকেও পেতে চাই আমরা। আমাদের এই চাওয়ার মধ্যেই আছে সংকীর্ণতা। পাওয়ার জন্য আমাদের লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ, সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার প্রাচীর নিজেকে পৃথক করে রেখেছে সত্য থেকে।
আল্লাহকে পাওয়ার জন্য কোন প্রচেষ্টাই আমরা করতে পারি না। প্রচেষ্টা করতে পারি কেবল দেয়ার জন্য। দিতে দিতে যখন ব্যক্তি স্বার্থের প্রাচীরটি ভেঙ্গে যাবে তখনই একের সাথে একাত্ম হওয়া যাবে। কিন্তু এই দেয়া পাওয়ার লোভে নয়। দিতে হবে পাওয়ার লোভটুকুই।
আল্লাহ তায়ালা যা দেয়ার তার সবই দিয়ে দিয়েছেন। জীবন প্রাপ্তির পর দেয়ার পালা আমাদের। আল্লাহ যেভাবে সব দিয়ে দিয়েছেন আমরাও যদি সেভাবে সব দিয়ে দিতে পারি তাহলে তার সাথে একাত্ম হওয়ার সুযোগ আসে। নিজেকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করার প্রচেষ্টাই উপাসনা। দিনে দিনে ভক্তি-দ্বারা, সেবার দ্বারা তাঁর মধ্যে নিজেকে ব্যাপ্ত করে দেয়ার প্রচেষ্টাই তাঁর উপাসনা।
আমরা যেন কখনো অভিযোগ না করি যে আল্লাহকে পাচ্ছি না। আমরা যেন বলতে পারি নিজেকে আল্লাহর হাতে তুলে দিতে পারছি না কেন? আমাদের যা কিছু আছে সবই কেন তোমায় দিতে পারি না প্রভু! সকল শক্তি কেন ব্যয় করতে পারি না কেবল তোমার জন্য? আমাদের যত দুঃখ, যত বেদনা সে কেবল নিজেকে ঘোচাতে পারছি না বলেই, সেটা ঘুচলেই দেখতে পাবো যা চাই তা পেয়েই বসে আছি।

তন্ময় হয়ে যাওয়াটা কেবল ধ্যানের ব্যাপার নয় এটা হচ্ছে সমস্ত জীবনেরই ব্যাপার। সকল অবস্থায়, সকল চিন্তায়, সকল কাজে এ উপলব্ধি যেন থাকে যে, আমরা তাঁর মধ্যেই আছি, কোথাও বিচ্ছেদ নেই। এই উপলব্ধি যেন প্রতিদিনই ক্রমে ক্রমে একান্ত সহজ হয়ে আসে যে, আমাদের দেহ, চিন্তা ও ইচ্ছায় তিনিই বিরাজ করছেন। আমরা আছি তাঁরই মধ্যে, আমরা করছি তাঁরই শক্তিতে এবং ভোগ করছি তাঁরই দান। এই বোধটিকে সহজ করে তুলতে হবে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, তাহলেই হলো।   

বঙ্গোপসাগরের তলদেশে বসছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন


বঙ্গোপসাগরের তলদেশে বসছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন

শামসুর রহমান ॥ লোডশেডিং এর অসহনীয় জ্বালা থেকে মুক্ত করতে সরকার একের পর এক প্রকল্প হাতে নিয়ে বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবেশি দেশ ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানীর কথা প্রায় পাকা করে এনেছে সরকার। অন্যদিকে দেশের ভেতরেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব ধরনের প্রচেষ্টাই করে চলেছে। এর ফলশ্রুতিতে দেশের  গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ সন্দ্বীপকে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের আওতায় আনা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশ দিয়ে ৮০ কিলোমিটার সাবমেরিন বিদ্যুৎ কেবল স্থাপনের মাধ্যমে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযুক্ত করা হচ্ছে এই দ্বীপবাসীকে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলায় নতুন করে দেড় হাজার কিলোমিটার বিদ্যুতের নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ ও তিন হাজার কিলোমিটার লাইনের সংস্কার করা হবে। এ জন্য এক হাজার ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে 'চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন' নামে একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
এ বিপুল ব্যয়ের মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ হাজার ৩০ কোটি আর মাত্র ২৪ কোটি টাকা পিডিবির তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। শিগগির প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সরকার চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে ১৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়া হয়।
সরকার মনে করে, ২০২১ সালের মধ্যেই চট্টগ্রামে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হতে পারে। বর্ধিত এ চাহিদা পূরণের জন্য সরকারি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এ প্রকল্পটি নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ  কেন্দ্র ছাড়াও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১ হাজার ৩০০ ও  কোরিয়ার একটি কোম্পানির ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের আরও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কিছু বিদ্যুৎ প্রকল নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। এসব প্রকল্পের আগে বিতরণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ সঞ্চালনে আরও বড় ধরনের প্রকল্প  নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল প্রাক-মূল্যায়ন কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়। সভায় সন্দীপের জন্য সাবমেরিন কেবল স্থাপনের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে কি-না জানতে চাওয়া হয়। এটি প্রযুক্তিনির্ভর ও আধুনিক কাজ। কমিশন মনে করে, এ ধরনের কাজ দেশে নতুন। এর আগে এ ধরনের কাজ খুব বেশি হয়নি। তাই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়, যাতে করে প্রযুক্তির স্থাপনায় দেশীয় প্রকৌশলীদের প্রাধান্য দেয়ার অবকাশ থাকে। কমিশনের  এধরণের মনে করার পেছনে দেশীয় প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হলে পরের প্রকলের গুলোর জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করতে হবে না। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই পিডিবি বিষয়ের উপর ভালো করে যাচাই করে দেখার পক্ষে মত দেয়।

সূত্র জানায়, প্রকলে সন্দ্বীপকে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত করতে ৮০ কিলোমিটার মেরিন কেবল স্থাপনে প্রায় ১১০  কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানান, সন্দীপকে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ওই দ্বীপের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপক পরিবর্তন হবে। দেশে মৎস সম্পদ নতুন মোড় নেবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে দ্বীপটির মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি নতুন করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড  আরো জোরদার হবে।

বুধবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৪

প্রেম থেকেই আসে একত্বের অনুভূতি



প্রেম থেকেই আসে একত্বের অনুভূতি

সিদ্ধার্থ ॥ আধ্যাত্মিকতা মানে জীবন সম্বন্ধে সচেতনতা - সত্য, সুন্দর, আনন্দ ও প্রেমের উপলব্ধি। আধ্যাত্মিক সাধক শাস্ত্রীয় বিধি বিধান নয় বরং নিজের সুক্ষ্ম-চেতনা দ্বারা জীবনের যাবতীয় কর্ম নির্বাহ করেন। সাধকদের উপর বাহ্যজগতের রীতি-নীতি কিংবা প্রথা আরোপ করতে গেলে নিজেকে আবিষ্কার করার প্রচেষ্টা ব্যাহত হয়। বাহির থেকে আরোপিত চাপে সূক্ষ্ম-চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আত্মা সূক্ষ্ম-চেতনারই অপর নাম।
আত্মাকে জানার মাধ্যমে নিজের মধ্যে স্রষ্টার প্রকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে আনুষ্ঠানিক ধর্মের আচার অনুষ্ঠান ও শাস্ত্র চর্চা নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকে তারা স্রষ্টাকে জীবন যাপনের প্রেরণা হিসেবে উপলব্ধি করে না। তাদের স্রষ্টা থাকেন কোটি কোটি মাইল দূরে কল্পিত কোন স্থানে। যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে তথা সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টাকে উপলব্ধি করে না, শাস্ত্র তাকে পথ দেখাতে পারে না। ধর্মের নামে যতটুকু আনুষ্ঠানিকতা তারা করে তার উদ্দেশ্য নরকের ভয় আর স্বর্গের লোভ। ভয় এবং লোভ তা পার্থিব হোক কিংবা অপার্থিব, উভয়ই আত্মবিকাশের পথে বাধা।
যে চর্চা করতে চায় সে এটা ওটা জানতে চাইবে। কিছু একটা পেতে চাইবে। সে আলোচনা করবে এবং শুনবে। লিখবে, পড়বে কিন্তু নিজ জীবনে তা বাস্তবায়িত করবে না। ফলে তাদের কোন উপলব্ধিই হবে না। তারা কেবল খুঁজতে থাকবে কিন্তু পাবে না কিছুই। সত্য খুঁজলে কোথাও পাওয়া যাবে না। সত্য হতে হবে। জ্ঞান অনুশীলনের মাধ্যমে, চর্যার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
যে চর্চা করে সে কেবল পানির কথা চিন্তা করে, তৃষ্ণা অনুভব করে কিন্তু নিবারণ করে না। যে চর্যা করে সে জল সন্ধান করে নিয়ে আসে পান করে এবং তৃষ্ণা নিবারণ করে। সত্য সম্পর্কে কেবল চিন্তা করলে, সত্য চাইলে কিংবা পড়লে, শুনলে পাওয়া যায় না। সত্য পাওয়ার জিনিস নয়। সত্যের কেনা বেচা হয় না। সত্য হওয়ার জিনিস।
সাধকের জীবনে ভয় ও লোভের কোন স্থান নেই। সাধক সত্য, সুন্দর, আনন্দ ও প্রেমের অনুভূতিতে সিক্ত। তার জীবনের সকল কর্ম সম্মাদিত হয় প্রেমের পরশে। প্রেম এবং সত্য কোন তথ্য নয় যে শাস্ত্র চর্চার মাধ্যমে জানা যাবে। প্রেম এবং সত্য হলো আত্মজ্ঞান। ভয় এবং লোভের প্রকার ও প্রকৃতির শাস্ত্রীয় বর্ণনা কেবল অজ্ঞতাই বৃদ্ধি করে। আমরা যতই সত্য নিয়ে ভাবতে থাকি ততই সত্য থেকে বিচ্যুত হই। সত্য খোঁজার কোন প্রয়োজন নেই। সত্য হলো এখন। যা এখন এবং এখানে আছে একমাত্র তা-ই হলো সত্য। সত্যের খোঁজে আমরা এখন এবং এখান থেকে চলে যাই তখন এবং ওখানে। এখন যা আমাদের সামনে আছে, যেমনভাবে আছে কেবল তাই সত্য। যা কিছু আমাদেরক এখন ও এখান থেকে দূরে নিয়ে যায় তা সত্যকে উপলব্ধি করার প্রতিবন্ধক।
সবকিছুর মতো সত্যের অন্বেষণকেও মানুষ সস্তা বিনোদনে পরিণত করেছে। বেশিরভাগ মানুষই প্রেম ও সত্য চায় না। মানুষ স্ফূর্তি চায়, বিনোদন চায়, উত্তেজনা চায়, তথ্য চায় এবং এসবেই তুষ্ট হয়। তাই মানুষ পত্রিকা পড়ে, সিনেমা দেখে, টিভি দেখে, বিতর্ক করে। ধর্মের নামে জলসা, গান-বাজনা, কিংবা সভা-সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমরা সবাই এসব করে থাকি কিন্তু যখন এসবকেই জীবনের কেন্দ্র বানিয়ে ফেলি তখন নিজেই নিজের মধ্যে সংকোচিত হতে থাকি, মরতে থাকি।
আনুষ্ঠানিকতা ধর্ম নয়। ধর্ম হলো সত্যকে ভালোবাসা, সুন্দরকে ভালোবাসা, ভালোবাসাকে ভালোবাসা, প্রত্যাশাহীন ভালোবাসা। যে সত্য ও সুন্দরকে ভালোবাসে সে ভালোবাসার আনন্দ সাথে সাথেই পেয়ে যায় এজন্য মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সত্যকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই সাধক ভালোবাসেন তাঁর স্রষ্টাকে আর স্রষ্টাকে ভালোবাসার মাধ্যমে জীবনকে। জীবনকে ভালোবাসার জন্যই আমরা জীবন প্রাপ্ত হয়েছি। আর জীবনকে ভালোবাসি বলেই আমরা বেঁচে আছি।
প্রকৃত অর্থে প্রেম কোন ভালোলাগা, আরাম লাগা নয়। ভালোলাগা, আরাম লাগা ইত্যাদি কামেরই নানা প্রকার মাত্র। যা মানুষকে ক্রমে হতাশার দিকে নিয়ে যায়। যেখানে প্রেম আছে সেখানে কাম চরিতার্থতা অনিবার্য নয়। প্রেমের উপস্থিতিই সন্তুষ্টি লাভের জন্য যথেষ্ট। একমাত্র সেই ব্যক্তিই প্রেম করতে পারে যে আবেগ, ভাবাবেগ, উদ্বেগ, উত্তেজনা, সন্দেহ ও ভয় থেকে মুক্ত। একমাত্র সেই প্রেম বুঝে যে প্রেমাস্পদের কাছে সমর্পিত। সত্য জানার কোন প্রয়োজন নেই। কাকে ভালোবাসি তা না জেনেও প্রেমভাবে থাকা যায়। এ প্রকার প্রেম থেকেই আসে একত্বের অনুভূতি।

সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে হতাশার স্থান নেই



সময়ের সাফ কথা ....
সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে হতাশার স্থান নেই

আরিফিন হক ॥ মানব সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল যা এখনো চলছে এবং চলতেই থাকবে যতদিন পৃথিবীতে মানব জাতি থাকবে। কুরআন মতে হাবিল ও কাবিলের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এ যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখনো পৃথিবীতে এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে সত্য প্রতিষ্ঠিত আছে। এ পরিস্থিতিতে সত্যানুসন্ধানীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হওয়ারই কথা। অনেকের কাছেই সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়া দুরূহ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।
সত্যানুসন্ধানীদের কাছে প্রকৃত সফলতা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ও তাঁর নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলা। ইসলাম বলে 'আকিমুদ্দীন' অর্থাৎ দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করো, ব্যক্তি জীবনে শান্তিকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখো। শান্তি প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলেও প্রয়াস থেকে অব্যাহতি নেয়ার জো নেই। তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ বলেন, 'যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে, সে তার ভালোর জন্যই করবে' (সুরা আনকাবুত-৬)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন -'আর যারা আমার খাতিরে প্রচেষ্টা করবে তাদের আমি অবশ্য অবশ্যই আমার পথ দেখাবো। আর নিশ্চয় আল্লাহ সত্যানুসন্ধানীদের সাথেই আছেন' (সুরা আনকাবুত-৬৯)।
সত্যানুসন্ধানীদের পথচলা যতই কঠিন হোক না কেন আল্লাহর পথে অবিচল থাকতে হবে আমৃত্যু। যারা লক্ষ্যময় জীবন শুরু করেছেন লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া ব্যতীত অন্য কোন পথ ও মত তাদের কাছে নেই। কারণ লক্ষ্য নির্ধারণ করার অর্থ কেবল লক্ষ্য নির্ধারণ করা নয়, লক্ষ্যহীন বিষয়গুলোকে বর্জন করাও। নিজের লক্ষ্যের প্রতি সমর্পিত তারাই যারা লক্ষ্য নির্ধারণের পর এতে কোন সন্দেহ করে না এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে প্রয়াস করে। প্রকৃত প্রস্তাবে তারাই সত্যানুসন্ধানী।
যারা এ পথে চলতে গিয়ে সাময়িক বিজয় পেয়ে উল্লসিত হয় অথবা বিপদের সম্মুখীন হয়ে হত-বিহ্বল হয় তাদের জীবনেই নেমে আসে হতাশার তমসা। যারা অবিরত চলতে থাকেন তাদের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনে কোন সন্দেহ সংশয় থাকার অবকাশই নেই।
নিজের জন্য 'এক' সত্য নির্ধারণের পর একজন ব্যক্তি মুমিন হয়ে যান। আর যিনি মুমিন হয়ে যান তার জন্য লক্ষ্য ব্যতীত এদিক সেদিক দৃষ্টি ক্ষেপণের প্রয়োজনীয়তা থাকে না। কিন্তু তবু পার্থিব প্রাপ্তি,  লোভ-লালসা, ক্ষমতার আকাঙ্খা মানুষকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে ফেলে। নিজের মধ্যেই কুমন্ত্রণা তৈরি হয়। এ কারণে মহান আল্লাহ তায়ালা শান্তিকে পরিপূর্ণভাবে চর্যা করার তাগিদ দিয়েছেন। হতাশা তার মধ্যেই আসে যে সম্পদ, ক্ষমতা ও দুনিয়ার হাতছানিকে অস্বীকার করতে পারে না। 'সময়ের কসম! নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মাঝে নিমজ্জিত! তারা ছাড়া যারা বিশ্বাস করে, সৎ কাজ করে, সৎ কাজের উপদেশ দেয় এবং  ধৈর্য ধারণ করার জন্য উপদেশ দেয়' (সূরা আল আসর)।
মুসলিম মিল্লাত আজ মহাসংকটাপন্ন অবস্থায়। এ অবস্থার জন্য আমরাই দায়ী। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করার পরিবর্তে দুনিয়ার সাময়িক ক্ষমতাধরদের কাছে মুসলিম মিল্লাতের নেতৃবৃন্দ মাথানত করে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করছেন। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে বেমালুম ভুলে গিয়ে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন প্রতিনিয়ত। যে কারণে ইসলামের স্বরূপ অমুসলিমদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাই বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা চলছে তা বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করছে। এতে ইসলামের চিরন্তন শাশ্বত সৌন্দর্য থেকে বিশ্বমানবতা বঞ্চিত হচ্ছে। মৌলবাদী, জঙ্গি, পশ্চাৎপদ ইত্যাদি নামে মুসলমানদেরকে অভিহিত করা হচ্ছে।
সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পৃথিবীর সকল মানুষও যদি বিরোধিতা করে, বাধা দেয় তাতেও প্রকৃত সত্যানুসন্ধীদের পথ চলা বন্ধ হবে না। যারা বিরোধিতা করে বা যারা না বুঝে ঝামেলা পাকায় তারা সত্য পন্থীদের জীবনাচরণের মধ্যেই অনেকগুলো উত্তর খুঁজে পাবে। তারপরও যদি তারা নিবৃত্ত না হয় তা হলে কি হাল ছাড়ার উপায় আছে? প্রথমে মক্কার লোকেরা নবী মোহাম্মদ (সা.) এঁর কথায় কর্ণপাত করেনি, তাদের সত্যের পথে বারবার আহ্বান জানানোর পরও প্রত্যাখ্যান করেছিল, আবার কখনও রাগান্বিত হয়ে- নবী (সা.)-কে নানাভাবে অপমানিত করেছে, নির্যাতন করেছে। কিন্তু তিনি প্রচেষ্টা থামাননি। অবিরত প্রচেষ্টার ফলেই নবী মোহাম্মদ (সা.) চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছিলেন।
সত্যের পথে চলতে গিয়ে বাধা-বিপত্তি আসলে গন্তব্য পানে চলা বন্ধ করার কোন সুযোগ নেই। আরবীতে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে -“মান লাহুল মাওলা ফালাহু কুল' মানে যার জন্য আল্লাহ তার জন্য সব। মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহর নৈকট্য সহজে প্রাপ্তির বস্তু নয়। এজন্য অনেক কষ্ট ও ক্ষতি স্বীকার করতে হয়।

দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সম্প্রচার কমিশন গঠন জরুরি



দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ
সম্প্রচার কমিশন গঠন জরুরি

শেখ উল্লাস ॥ সাংবাদিকরা জাতির বিবেক-এটি শুধু কথার কথা নয়, বাংলাদেশের এমন বহু সাংবাদিকের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় যাঁরা ছিলেন জাতির বিবেক। এদেশের বর্তমান সম্প্রচার জগৎ সেই ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র জগতের (প্রিন্ট মিডিয়া বা মুদ্রণ মাধ্যম)-ই উত্তরাধিকার। সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি এবং এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন যখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে তখন দেশ ও জাতির প্রতি সাংবাদিকতার ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার কথাগুলো জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলছে। সাংবাদিকতার ইতিহাস বলছে, ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষক শ্রেণী এবং তাদের তল্পিবাহকদের মুখোশ উন্মোচনে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ ও লেখালেখির কারণে ১৭৮০ সালে জেমস অগাষ্টাস হিকি নামের ভবঘুরে এক ইংরেজকে তৎকালীন ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর কোপানলে পড়ে ভারত ছাড়তে হয়েছিলো। সেই থেকে শুরু এদেশের মুদ্রিত সংবাদপত্রের পথচলা। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থক কোনো কোনো গোষ্ঠীর উদ্যোগেও বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্র প্রকাশিত হলেও এসব পত্রিকা এদেশের সাংবাদিকতার মূলধারা হিসেবে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং এর কারণ দেশ ও জনগণের প্রতি এদের কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে এদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা উন্মেষিত ও বিকশিত হয়েছিল - গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন রায়, জন ক্লার্ক মার্শম্যান, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশ চন্দ্র মুখার্জী, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, বিপীন চন্দ্র পাল, শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কমরেড মুজাফফর আহমদ, সাধক কাজী নজরুল ইসলাম, আকরাম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায়।
আজকের দিনে মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনিক) মাধ্যমের সম্মিলনে গড়ে উঠেছে বিশাল পরিসরের সম্প্রচার জগত। এই জগতের অধিকাংশই যখন অনিয়ন্ত্রিত পুঁজি ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হলে একটি যথাযথ নীতিমালা অবশ্যই দরকার- যে নীতিমালা অবশ্য এদেশের সাংবাদিকতা জগতের বিবেকবান অংশ ঐতিহ্যগতভাবেই ধারণ, পালন ও লালন করে আসছে। এই অর্থে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নতুন কিছু নয়।
এদেশের সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রণীত আচরণবিধি ইতোমধ্যে কার্যকর রয়েছে।  সময়ের বিবর্তনে আজকের দিনের বৈদ্যুতিন  মাধ্যম - বেতার ও টেলিভিশন অর্থাৎ সম্প্রচার জগতের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় গত ৬ আগষ্ট গেজেট আকারে জারি করেছে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা। গেজেট আকারে তা প্রকাশিত হয়েছে ৭ আগষ্ট। এর আগে গত ৪ আগষ্ট  বেতার ও টেলিভিশনের সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারে বিভিন্ন ধরনের পরিচালনাবিধি আরোপ করে মন্ত্রিসভা এ নীতিমালার অনুমোদন দেয়। এ নীতিমালা অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। অপরাধীদের দ- দিতে পারেন, এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার মতো দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে (টক শো) বিভ্রান্তিমূলক ও অসত্য তথ্য পরিহার করতে হবে। জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না। বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন নিয়ম বা বিধি মেনে চলতে হবে। জনস্বার্থের জন্য হানিকর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট  করে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো খবরও সম্প্রচার করা যাবে না।
এই নীতিতে একটি স্বাধীন ও সংবিধিবদ্ধ কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে, যারা এসব বাস্তবায়ন করবে। প্রচার মাধ্যমগুলোর জন্য 'পরিচালনাবিধি' প্রণয়ন করবে এই কমিশন, একই সঙ্গে এই নীতিমালা ভঙ্গ করলে কী শাস্তি প্রযোজ্য হবে তাও নির্ধারণ করবে এই কমিশন। প্রযোজ্য হলে কমিশন সুপারিশও করতে পারবে। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ এবং সেদেশের সমাজের সার্বিক ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেখানে সেদেশের সরকারের দায়িত্বটাই সবচেয়ে বেশি, সেখানে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি-না তার নজরদারির জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কোনো কারণ নেই। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্প্রচার নীতিমালাকে গণতান্ত্রিক দেশের সুষ্ঠু বিকাশের পথে একটি প্রক্রিয়ার শুরু বলা যায়। এই প্রস্তাবিত কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন এক দিন আসতে পারে যখন গণমাধ্যমের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কচ্ছেদ হবে। কমিশনই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দেখভাল করবে।
এদেশের জনগণ ও সমাজের প্রতি বর্তমান সময়ের  সাংবাদিকতা ও সম্প্রচার জগতের দায়বদ্ধতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন মাঝে মধ্যেই  উঠে। সংবাদপত্রের জগৎ নিয়ে এই জাতীয় প্রশ্ন ও সংশয় সবচেয়ে বেশি। আজ থেকে এক দশকের ও বেশি সময় আগে এদেশে নতুন পুঁজি ও জঙ্গীবাদের উত্থানের সময়ে নতুন পত্র-পত্রিকা প্রকাশনা ও অনেকগুলো সম্প্রচার মাধ্যমের আত্মপ্রকাশ ঘটে তখন কবি-সাংবাদিক আবু হাসান শাহরিয়ার লিখেছিলেন, 'সম্পদ-পাহারায় বড়লোকরা আগে কুকুর পুষত; এখন পোষে দৈনিক। একুশ শতকের দৈনিক হচ্ছে বড়লোকের বাড়ির পোষা কুকুর। মাঝে-মধ্যে সেই কুকুরকে তার প্রভু এদিক-সেদিক লেলিয়েও দেয়। জমিদখল-ব্যবসাদখলে দৈনিককে ব্যবহার করে (অর্ধসত্য, সাহিত্য বিকাশ, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৪)। প্রখ্যাত সাংবাদিক-কলামিষ্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হক লিখেছিলেন, 'বাংলার প্রেস আজ পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ম্যানেজ্‌ড প্রেসের একটি। এটি এখন কোনক্রমে রাষ্ট্রীক ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে পরিমাণ ও গুণগতভাবে বৃদ্ধি করার কোন প্রতিষ্ঠান নয়। আবদ্ধ প্রেস অন্ধকারে ও শৃঙ্খলে আবদ্ধ প্রাণীর মতোই বিকাশহীন ও পচনশীল হতে বাধ্য। এতসব বাধাবন্ধের পরেও বাংলাদেশের প্রেসের মূলধারা এবং প্রবণতাটি দালালির বিপরীতে। বীরত্বের প্রবণতা তার। (-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্র,  দৈনিক সংবাদ এর বর্ষপূর্তি সংখ্যা, ২৬মে, ২০০৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১২)।  বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে ঘটে যাওয়া ব্যাপক পরিবর্তন বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের একটি মন্তব্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেছেন- 'সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জগতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে এ ক্ষেত্রে। গণমাধ্যমকে দেশ, জাতি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত করতে হলে প্রয়োজন নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ তথা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, বিচার-বিশ্লেষণ ও গবেষণা” (সাপ্তাহিক বর্তমান সংলাপ-এর বর্ষপূর্তি সংখ্যা, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১১)।
তাই বলা যায়, বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা ঐতিহাসিকভাবে মাটি, মানুষ তথা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ বলেই বর্তমান সময়ের সম্প্রচার জগৎকে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে হলে এগুলোর নজরদারির জন্য একটি সম্প্রচার কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি। এই ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক জারি করা জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার গেজেট প্রকাশ একটি সূচনা মাত্র। এই সূচনাকে দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে চলমান রাখতে হলে এমন সব অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে সম্প্রচার কমিশন গঠন করতে হবে যারা দায়বদ্ধ থাকবেন শুধুই দেশ ও সমাজের প্রতি। ব্যক্তি ও কায়েমী স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে কাজ করবেন সমাজের সার্বিক ক্ষেত্রে সত্য প্রতিষ্ঠায়, তারা ধারণ, পালন ও লালন করবেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শিক সেই সব সাংবাদিককে যারা এদেশের সমাজ ও  মানুষের কল্যাণে সাংবাদিকতার মহান ব্রতে একদিন নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছিলেন।