গণজাগরণে বাউল সমাজ
সংলাপ ॥ মানুষ একদিন পাখর ডাক,
নদীর কলতানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল সুর। তার আনন্দ-বেদনা এবং ভালোবাসার ভাষারূপ
পেয়ছিল প্রকৃতির পটে, বাতাসের স্নিগ্ধ কোমলতায়,
পাখির সুরেলা ধ্বনিতে। বুক চিরে বেরিয়ে এসেছিল গান। সেই শুরু। আজো থামেনি। এক কণ্ঠ
থেকে আরেক কণ্ঠে গান জেগেছে। এমনি করেই কণ্ঠ পরম্পরায় এই গান গীত হয়ে আসছে যুগ যুগ
ধরে। প্রকৃতির বুকে লালিত এই গান প্রকৃতির মতই সহজ তালে এগিয়ে চলেছে।
সহজভাবে এগিয়ে যাওয়াই এই লোকসঙ্গীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য
বলেই এটাকে সব সঙ্গীতের উৎস হিসেবে ধরা হয়। বাংলার সঙ্গীত জগতও এই লোকসঙ্গীতের অবদানে
বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। বাংলার সঙ্গীত একান্তভাবে
লোকসঙ্গীতকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করেছে। শুধু বাংলাদেশ
নয় পৃথিবীর তাবৎ সঙ্গীত ও সাহিত্যে লৌকিক অবদান অনস্বীকার্য একথা বললে অত্যুক্তি হবে
না। আজ যে সঙ্গীতের এত উন্নতি ঘটেছে-আমরা নিত্য নতুন সুর নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শিখছি
এসবের উৎস মূলই হলো লোকসঙ্গীত।
বাংলাদেশে লোকসঙ্গীতের দুটি বিশেষ ধারা বিদ্যমান-একটি
ধর্ম নিরপেক্ষ, অপরটি ধর্ম প্রধান। তবে বাংলাদেশে ধর্ম প্রধান লোকসঙ্গীতের
আধিক্য বিদ্যমান। কিন্তু এই ধর্ম একান্ত লোকজীবন ভিত্তিক এবং সহজিয়া ভাবনাজাত। কাজেই
এটা দু'টি পর্যায়ভুক্ত। (ক) ধর্মীয় লোকগীতি (খ) ভক্তিমূলক লোকগীতি। ধর্মীয় লোকগীতিতে একটি
বিশেষ সাধনা সংক্রান্ত এবং ভক্তিমূলক লোকগীতিতে বাংলা সঙ্গীতে ভক্তিভাবই প্রাধান্য
লাভ করে। ভক্তিমূলক লোকগীতিতে আত্মনিবেদনের ভাবটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। মুসলমানেরা
অতীতকাল থেকেই সঙ্গীতপ্রিয় ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্যদান করে। হিজরী সাল গণনার শতাব্দিকাল
পরে মক্কা ও মদীনায় অনেক আরব সঙ্গীতঙ্গের নাম জানা গেছে। কিতাবুল আঘানী বা (Book of songs) এ উল্লেখিত প্রসিদ্ধ
আরবীয় সঙ্গীতজ্ঞদের মধ্যে মা'বাদ ফরিদ,
তুবাইজ, ইবনে সুবাইজ এবং ইবনে আয়শা অন্যতম। প্রসঙ্গত উল্লেখ
করা যায় আরবের মাটিতেই সর্বপ্রথম সূফী ভাবনার জন্ম এবং এখানে সূফী সঙ্গীতও প্রসার লাভ
করেছিল। উল্লেখ্য আরবের সূফী চিন্তাধারায় স্রষ্টার প্রতি 'ভয়'
এবং ভক্তি প্রাধান্য লাভ করে; কিন্তু পারসীয় সূফী চিন্তাধারায়
'প্রেম'
প্রাধান্য লাভ করে এবং স্রষ্টাকে 'মাশুক'
বা প্রিয়জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যিনি সূফী মতবাদকে সর্বান্তকরণে স্বীকৃতি দিয়েছেন
প্রখ্যাত ধর্ম বিষয়ক চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালীর মতে 'সঙ্গীত হচ্ছে পাষাণে
নিহিত সুপ্ত আগুনের মতো।' ঘর্ষণে শিলা থেকে যেমন আগুন বের হয় এবং তা সমস্ত অরণ্য
ভস্মীভূত করে, তেমনি সঙ্গীতের স্পর্শে আত্মার আগুন জ্বলে উঠে। সূফী
সাধকেরা সমাজের উচ্চস্তর অপেক্ষা নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যেই সমধিক প্রভাব বিস্তারে
সমর্থ হয়েছিলেন। এই নিম্নস্তরের মানুষেরা ছিল লাঞ্ছিত,
নিপীড়িত এবং নিগৃহীত। তারা একদিকে যেমন সূফীদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে তেমনি
কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেদের মতের সাথে সূফী ভাবনাকে সমন্বয় করে গড়ে তুলেছে দেশজ সূফী
ধর্ম। এই দেশজ সূফী ধর্মে প্রভাবিত একটি বিশেষ মতাদর্শের অনুসারীদের বলা হয় বাউল।
বাউল শব্দের উদ্ভব সম্পর্কে ধারণা করা হয় অনেক সময়
অল্প বিস্তর অপরিচিত শব্দ উচ্চারণের বিকৃতির কারণে নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছে। গানের ক্ষেত্রে
'কাউল' শব্দের রূপ 'বাউল' হওয়া অস্বাভাবিক
নয়; বিশেষ করে যখন বাউল গানের প্রকৃতি কাউল গানের অনুরূপ। বাউল গান বাংলাদেশের সঙ্গীত
জগতে এক অনুপম সৃষ্টি। এই গানে মূলত দু'টি ধারা একটি সূফী এবং অপরটি
দেশজ। এই বাউল গানের রচয়িতা হিসেবে যার পরিচয় সর্বাগ্রে আসে তিনি হচ্ছেন কুষ্টিয়া জেলা
নিবাসী বাউল সাধক লালন শাহ্। বাউল গানের ভূবনে লালন শাহ্ের গান সর্বযুগের আর সর্বকালের
শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাঁর পূর্বে অন্য কারো তেমন কোন রচনা পাওয়া যায়নি।
লালনের গান বাউল সম্প্রদায়ের জন্য রচিত। এই জনগোষ্ঠী
একান্তভাবেই 'লোক' শ্রেণীভুক্ত। লালন
নিজেও একজন বাউল সাধক ছিলেন। তাঁর গানের বাণী এবং সুর সম্পূর্ণই বাউল ভাবনানুগ। বাউল
গানে বিভিন্ন অংশ আছে। যেমন গুরু বা মুর্শিদ তত্ত্ব, আত্ম বা দেহ তত্ত্ব,
সৃষ্টি তত্ত্ব এবং সাধন-ভজন তত্ত্ব। বাউল গানে একজন মূল প্রবক্তা থাকে। বাউল গান
একের সাধনাভিত্তিক গান। বাউল তার নিজেকে নিয়েই অধিক ব্যস্ত। বাউল গানের সাথে যে নাচ
হয়ে থাকে তাও সাধনার অঙ্গ। একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে গায়ক তার দেহকে নৃত্য সর্বস্ব করে
তুলে। লালনের গানেও নাচের প্রচলন আছে। বাউল সঙ্গীতের নাচের উদ্ভব সম্পর্কে বলা হয় বাউলরা
যেখানে যে ছন্দ পেয়েছে তাকেই গ্রহণ করেছে অত্যন্ত সহজভাবে। গান গাইবার রীতিতে তারা
যতপ্রকার ছন্দ পেয়েছে তাকেই নৃত্য দিতে চেষ্টা করেছে। যার নাচ ভাল লেগেছে নেচেছে,
যার ইচ্ছা করেনি সে নাচেনি। সাধারণত বাউল তার গানের আনন্দকে নৃত্যে ফুটিয়ে তুলতে
আগ্রহী হয়ে থাকে এবং সেটা থেকেই এই বাউল নৃত্যের উদ্ভব।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে
বাউল গানের একটি ভিন্নরূপ গড়ে উঠেছে। এই গানগুলোকে মুর্শিদী গান বলা হয়। বাউল গানের
মতো এ গানের দু'টি পদ বা অংশ আছে। বাউল সঙ্গীত ইতিহাসে লালন ফকিরের
গানেই প্রথম প্রাণের স্পর্শ অনুভূত হয়। এর কারণ তিনি গানে নিপীড়িত মানুষের বেদনার কথা
ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর গানে মানুষকে তিনি সকল সংকীর্ণতা,
স্বার্থপরতা এবং সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠবার আহবান জনিয়েছেন। বলেছেন সমগ্র পৃথিবীর
মানুষ এক জাতি-
সবলোকে কয় লালন কি
জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না নজরে
কুপে গেলে কুপজল হয়
গঙ্গায় গেলে গঙ্গাজল
মুলে একজল ভিন্ন জানায় পাত্র অনুসারে
বাংলার লোকসঙ্গীতে ধর্মের ভাবনা প্রাধান্য লাভ করেছে।
বাউল গানগুলোও লোকশ্রেণীভুক্ত সঙ্গীত। এ গান সাধকের গান। সাধকেরা বাউল নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ সঙ্গীতের দেশ। প্রতিটি দেশের একটা নিজস্ব
সঙ্গীত রয়েছে। এ সঙ্গীত দেশে দেশে ভিন্ন নামে পরিচিত। অথচ এ সঙ্গীত সে দেশের একান্ত
আপন ঐতিহ্য। দেশ থেকে উদ্ভুত বলে এ সঙ্গীত যেমন আমাদের দেশে লোকসঙ্গীত নামে পরিচিত;
তেমনি পাশ্চাত্যে কাউন্টি মিউজিক নামে অভিহিত। আমাদের লোকসঙ্গীত আর কাউন্টি মিউজিকে
কোন পার্থক্য নেই। ধারা কিংবা মেজাজ একই, শুধু দেশ ভেদে নামের
পরিবর্তন। সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন দেশের সঙ্গীতের একই রূপ থেকে এক বিশ্বের সন্ধান পাওয়া
যায়। লোক সংস্কৃতিকে জানতে হলে মানুষের জীবনকে জানতে হবে। তাদের জীবনের গতিধারা সম্পর্কে
ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। তাদের জীবনে কিসের প্রভাব রয়েছে তার একটা চিত্র মনের পটে থাকতে
হবে। তবেই প্রকৃতি লোক সংস্কৃতির রূপ সম্পর্কে ধারণা জন্মানো সম্ভব। আর এই সত্য সবদেশের
লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই অনেক সংস্কৃতি দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিফলিত
হলেও বাউল গানের মতো লোকসঙ্গীতের ভেতর দিয়ে সকল দেশের একই রূপ ধরা পড়ে।
বাউল মতবাদ একটি লোকধর্ম। বাউলদের মাঝে তাই দু'টি জীবন লক্ষ্য করা
যায়। ব্যবহারিক জীবন এবং সাধক জীবন। বাউল গানের সুর এদেশের মানুষের প্রাণের সুর। গানের
বাণীতে, গানের সুরে কখনো লক্ষ্যে, কখনো অলক্ষ্যে বাউল আপন স্থান
অধিকার করে নিয়েছে। মূলত মধ্যযুগ থেকে বাউল ধর্ম তার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে। বাউল তার
গানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছে মানুষের মনের আর্তি। 'আমি কোথায় পাবো তারে,
আমার মনের মানুষ যে রে।' তখন বুঝতে কষ্ট হয় যে মনের
মানুষের অনুসন্ধানেরই ভেতরই রয়েছ বাংলাদেশের গণজীবনের মূল রহস্য লুকিয়ে। ভোরের কুয়াশা
ঢাকা পরিবেশে যখন বাউল তার একতারা বাজিয়ে কণ্ঠে গানের ঝংকার তুলে তখন গণমানুষের প্রাণের
কথা, মনের ভাষা, অন্তরের আবেদন আর হৃদয়ের ব্যকুলতা অপরূপ সুরে দিক-দিগন্তে
ছড়িয়ে পড়ে। বাউল এদেশের গণমানুষের প্রতীক। যারা এদেশের গণমানুষের প্রতীক আজ তারাই এদেশের
সমাজ ব্যবস্থার কাছে উপেক্ষিত চরমভাবে। যারা মুনষের প্রাণের কথা বলে বেড়ায় - সময়ের
কষাঘাতে আজ তারা নির্বাক-হতবিহ্বল। তাদের দুঃখ, বেদনা উপলব্ধি করার
মতো কেউ আজ বাউল গোষ্ঠীর পাশে নাই। '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এরা দেশের
টানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে; আবার গান রচনা করে মুক্তিযোদ্ধাদের
অনুপ্রানিত করেছে। বর্তমান অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। দেশের
উন্নয়নের স্বার্থে গৃহীত বিভিন্ন কল্যাণমুলক পরিকল্পনা,
গণশিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণের
ব্যাপারে তারা প্রচারমূলক কাজে সহযোগিতা করেছে তাদের গায়কী ঢঙে।
যারা দেশের স্বার্থে সবসময়ই এগিয়ে এসেছে তারা আজ কেন
রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত?
বাউলকে প্রধানত কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যদিও
এদের মধ্যে অনেক প্রকারভেদ আছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তান্ত্রিক বাউল,
সাধক বাউল, দরবেশী বাউল, কবি বাউল,
বৈষ্ণব বাউল ইত্যাদি। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের চলন-বলন এবং ব্যবহারিক জীবনেও
পরিবর্তন এসেছে। অধরাকে ধরার যে বাসনা, নিরাকারকে সাধনার
ভিতর দিয়ে পাবার যে আকাঙক্ষা-সেই কামনাকে কেন্দ্র করে রচিত হতো মূলত বাউল গান। বর্তমান
সামাজিক অবকাঠামোতে বাউলরা কি তাদের সেই ঐতিহ্যগত ধর্মভাবটুকু বজায় রাখতে পারছে কিনা
এ ব্যাপারে নজর দেয়া প্রয়োজন রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সত্যের পথে গণজাগরণের জন্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন