বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

বাঙালির জীবনীশক্তিঃ জয় বাংলা


বাঙালির জীবনীশক্তিঃ জয়বাংলা

সংলাপ ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিটির জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়ে বাঙালির শক্তি হিসাবে সর্বজনীন হয়ে ওঠে। এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা সবাই কোনো একটা বিশেষ দলের লোক ছিলেন না। আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যান্য অনেক দলের কর্মীরা এবং গণমানুষ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিরাট অংশ ছিলেন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন, এ দেশের গণমানুষ। আমরা জানি, ‘জয়-বাংলা’ স্লোগান দিয়েই এদের সবাই  দেশের জন্য প্রাণ দিতে এগিয়ে গিয়েছেন। এই জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে হুঙ্কার দিয়েই এরা যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানী নরপিশাচদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বিজয়ের ক্ষণে বা পাকিস্তানী বাহিনী কিংবা রাজাকার, আল-বদর নামধারী এদেশী কাউকে পরাস্ত করতে পারলে, আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধাই ‘জয়-বাংলা’ বলে চিৎকার করে তাদের উল্লাস প্রকাশ করেছেন এবং এখনও করেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হবার পূর্ব মুহুর্তে জয়-বাংলা বলে চিৎকার করে তারা তাদের জীবনের শেষ মুহুর্তে শেষ প্রত্যয়, শেষ আকাঙ্খা ব্যক্ত করে গিয়েছেন।
সে সময় এ দেশের জনগণের মধ্যে যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেনি, তাদের মধ্যেও একমাত্র রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও তাদের মদদদানকারী ছাড়া আপামর বাঙালির কাছে ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিটি ছিল জীবনীশক্তি। 
এই ধ্বনিটি শুনলে সেই সময়কার ভীতি-বিহ্বল মুহুর্তগুলোতেও তাদের মনে সাহস ও আশার সঞ্চার হতো এবং আজও হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে এই জয়ধ্বনিটি কি রকম জনপ্রিয় ও সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল তা বিশ্ববাসী জানে।
মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত এই জয়ধ্বনিটির সর্বজনীনতাপ্রাপ্ত হবার পর এটা আওয়ামী লীগের একচেটিয়া সম্পদ থাকেনি। এটা এ দেশের সকল মানুষের, এ দেশের আপামর জনসাধারণের সম্পদ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছিল বলে এটাকে আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা বলা যায় না, এটা হলো আমাদের বাঙালি জাতির স্বাধীনতা; তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বজনীনতা প্রাপ্তির পর জয়-বাংলা ধ্বনিটিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সম্পদ বলা যাবে না, এটা সমগ্র বাংলা ও বাঙালি জাতির সম্পদ, এটা আপামর জনগণের শুধু জয়ধ্বনি নয় জীবনীশক্তিও।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া যে সমস্ত রাজনৈতিক দল এদেশে সরকার গঠন ও পরিচালনা করেছেন তাদের অনেক নেতা-কর্মীই এসেছেন আওয়ামী লীগ থেকে। তাই তারা যখন আওয়ামী লীগ থেকে সরে এসে নতুন পার্টি গঠন করেছেন, তখন স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল যে এসব পার্টি তাদের পৃথক অস্তিত্বের কারণ হিসেবে, তারা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ ও নীতিমালার দিক দিয়ে আওয়ামী লীগের থেকে অন্যরকম, সেই কথাটাই জনগণের কাছে বড় করে তুলে ধরবেন এবং এর উপরেই তারা বেশি জোর দিবেন। কিন্তু তা না করে তারা তাদের নেতা পৃথক, তাদের ধ্বনি পৃথক, তাদের ভাষায়, বেতার সংস্থার নাম পৃথক ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর বেশি প্রাধান্য দিতে থাকেন এবং এগুলোকেই তারা তাদের পৃথক অস্তিত্বের কারণ হিসেবে প্রতীয়মান করার চেষ্টা করতে থাকেন।
রাজনৈতিক দলগুলো না হয় তাদের পৃথক অস্তিত্ব প্রমাণ করতে অন্য কোনো জোরালো যুক্তি দেখাতে না পেরে এ দেশের বেতার ও টেলিভিশনে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়ে সেখানে একটা বিকল্প ধ্বনি চালু করেছেন এবং তাদেরটা ভালো তা বোঝাবার জন্য করেছেন, কিন্ত তাই বলে আমরা, যারা জনগণ, যারা কোনো দলের সদস্য নই, তাদের কি হয়েছে এতো সহজে শান্ত ছেলের মতো বাংলা ভাষায় রচিত ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত আমাদের নিজস্ব জয়ধ্বনিটি বিসর্জন দিয়ে, কোনোরূপ বিচার বিবেচনা না করে, যে পাকিস্তানের শোষণের অধীনে ছিলাম, যাদের অধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ নরনারীকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে, সেই পাকিস্তানের নারা থেকে জিন্দাবাদ শব্দটি আমাদের বাংলাদেশের নামের সঙ্গে গ্রহণ করা এবং সেই সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধ্বনিটি যা বাঙালির জীবনীশক্তি তা বিসর্জন দেয়া!
পাকিস্তান-পছন্দ দলগুলো জানতো এবং আজো জানে, যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত দেশবাসীর মন থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি নির্বাসিত করা সহজ হবে না। তাই তারা জাতীয়তাবাদের যুক্তি বাদ দিয়ে এ দেশের মানুষের ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, জয় শব্দটি ইসলামী নয় - ওটা হিন্দুদের শব্দ, তাই ও শব্দটি বলা চলবে না, তার বদলে জিন্দাবাদ শব্দটি বলতে হবে।
কি চমৎকার! বাংলায় কথা বলবো, বাংলার মাটির ফসল খাবো, আমার মাকে আমি বাংলা ভাষায় ‘মা’ বলতে পারবো। বাংলাদেশকে বাংলা ভাষায় ‘বাংলাদেশ’ বলতে পারবো। তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ‘জয়-বাংলা’কে আমার মায়ের ভাষায় ‘জয়- বাংলা’ বলতে পারবো না। সেটা আমাকে বলতে হবে পাকিস্তানীদের উর্দু ভাষায়, যারা এতোই বর্বর যে, আজও কোনো নারী যদি ধর্ষিত হবার ফলে অন্তঃসত্ত্বাও হয় তাহলে তারা সেই নির্যাতিত নারীকেই উল্টো বেত্রাঘাত করে। বাঙালি জাতি কি সময়ের তালে তালে ধর্মভীরুতার সংক্রামক ব্যধিতে ভুগে আত্মমর্যাদা শক্তি খোয়াতে বসেছে?
অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস। গত ৩০ মার্চ (১৯৯৬) তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জনগণের আন্দোলনের চাপে বিএনপি যখন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো, তখন তাদের নেত্রীকে জনতার কাছে মুখ দেখাবার লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বলতে হয়েছিল জয় (বিজয়) ওদের হয়নি, জয় হয়েছে আমাদের। জয় যদি এতোই হারাম (নিষিদ্ধ) শব্দ, তা হলে বলা দরকার ছিল জিন্দাবাদ ওদের হয়নি, জিন্দাবাদ আমাদের হয়েছে।
আমাদের মনে ‘জয়-বাংলা’ বাক্যটির প্রতি যে শক্তি ও আকর্ষণ আছে তাকে নিস্তেজ করে দেয়ার জন্য উর্দু পছন্দ / পাকিস্তান পছন্দ দলগুলোও যথেষ্ট চেষ্টা করেছে এবং আজও করছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যে রাজনৈতিক জারজ সন্তানদের মতো নিজ দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির চেয়ে অন্য একটা দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বেশি আকর্ষণ ও মমত্ববোধ রয়েছে। বাঙালি জাতি এখনও একটা মারাত্মক আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে সংক্রামক ব্যধিতে ভুগছে। এই ব্যধির হাত থেকে নিরাময় হতে একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব সময়ের দাবী।
আমাদের তবুও একটা সৌভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ এখনো পর্যন্ত এই জয়ধ্বনিটিকে টিকিয়ে রেখেছে। যে সুরে এই রণহুঙ্কারটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এই রণহুঙ্কারটি যে সুরে উচ্চারণ করে আমাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শেষ কামনা, তাদের শেষ প্রত্যয় ব্যক্ত করে গিয়েছেন, সেই  উচ্চারণের হুঙ্কার ‘জয়-বাংলা’ আমাদের প্রতিটি কর্মে ধরে রাখতে হবে। ধিক আমাদের বাঙালি রাজনীতি! ধিক আমাদের ধর্ম ভীরুতায়! বাঙালি যে দলের, যে ধর্মের, যে বর্ণের লোকই হোক না কেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা যে দলের সদস্যই হই, ‘জয়-বাংলা’ আমাদের সবার জন্যই জাতীয় জয়ধ্বনি। এই জীবনীশক্তিকে আমাদের সর্বজনীন জয়ধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করা -নৈতিক দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার।
জয়-বাংলা, বাংলার জয়। জয় বাঙালি, বাঙালির জয়। আমরা সত্য ও শান্তির (ইসলাম) ধর্মাবলম্বীর প্রতীক হই। ইদানিং এক ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক ইসলামি দল জয়-বাংলা ধ্বনিতে আওয়াজ তুলে ধ্বংসাত্মক ও হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে বর্তমান সরকারকে জনগণের কাছে হেয় করার জন্য। বাঙালিকে প্রতিটি পদক্ষেপে           আরো সাবধান হতে হবে এবং তাদেরকে শনাক্ত করে প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে হবে। বাঙালির সামনে সময় এসেছে ‘জয় বাংলা’ যে জীবনীশক্তি তার প্রমাণ দেয়ার।

সময়ের সাফ কথা.... কাল্পনিক তন্ত্রের ফাটকে....


সময়ের সাফ কথা....
কাল্পনিক তন্ত্রের ফাটকে....

নজরুল ইশতিয়াক ॥ জাতীয় ঐক্য, গণ ঐক্য, গণতান্ত্রিক ঐক্য, ঐক্যমত-ঐক্যবদ্ধ এসব কথার কথামালার বাকোয়াজ দূষণে দুষ্ট আমাদের রাজনীতি অঙ্গন। কথায় কথায় ঐক্যমতের কথা বলা হয়। কথায় কথায় বলা হয় রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের জানমাল নিরাপত্তা বিধানের, সরকারের দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে কিছু স্বঘোষিত সুশীল ও কাল্পনিক পান্ডিত্য নির্ভরদের এ নিয়ে পরামর্শ  পুরো দেশের রাজনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এসব রাজনীতি তথ্য বিক্রেতাদের কথা বলার আগ্রহ ও উৎস সন্ধান করলে ভয়ানক সব চিত্র প্রকাশ পায়। মেরুদন্ডহীন এসব পুতুল কোন না কোন মহলের ক্রীড়ানক। বড্ড অসহায় এদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চিন্তন জীবন। আজকের বাংলাদেশের সব সংকটের  উদ্যোক্তা সুশীল সজ্জন বুদ্ধিমান শিক্ষিত দাবিদার নাগরিকরা। কথায় পটু, ষড়যন্ত্রে পটু এসব ব্যক্তিদের তালিকা ধরে একটা একটা করে পরীক্ষা করলে এমন সব ভয়ানক তথ্য বের হয়ে আসবে যা আরব্য রূপকথার লেখকদের কল্পনারও অতীত। অধিকাংশ চেনামুখগুলোই অভ্যাস সংশোধনের অতীত। 
যারা রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেন তারা কি নিজেদের দায়িত্ব সম্বন্ধে অবগত? তারা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, চরিত্র, মূল্যবোধ, আদর্শ, দর্শন কি জানেন? যারা এসব নিয়ে স্বোচ্চার তাদের সংগঠনগুলোর দার্শনিক অবস্থান কি তা অনুধাবন করেন? সত্য এটাই-রাজনীতির ব্যবসায় জড়িত তথাকথিত নেতাদের নিজেদেরই কোন দর্শন বা দার্শনিক চরিত্র নেই। এরা ঐক্যমতের আহ্বান করেন, গণতন্ত্র সুশাসনের সবক দেন অথচ এদের নিজেদের সংগঠনগুলোর কোন জনভিত্তি নেই, দার্শনিক ভিত্তি নেই, এমনকি কোন কর্মসূচী বা অঙ্গীকারও নেই।
সংবিধানে রাষ্ট্রের দার্শনিক চরিত্রের প্রতিফলন থাকে। বাহাত্তরের সংবিধানে সুষ্পষ্টভাবেই রাষ্ট্র কোন পথে কিভাবে কোন নিক্তি মেপে যাবে তার দিকনির্দেশনা ছিল। পরবর্তীতে ইচ্ছে মত কাটা ছেঁড়ার কারণে রাষ্ট্রের দার্শনিক চরিত্র হারিয়ে গেছে এবং ফলশ্রুতিতে বর্তমানে ঐক্যমতের নানা কাল্পনিক ও স্বরচিত ফর্মূলা হাজির হচ্ছে। যারা এসব নিয়ে মাতামাতি করছেন তাদের অধিকাংশেরই কোন দার্শনিক চরিত্র নেই। কেবলমাত্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থে পানি ঘোলা করার জন্য বলছেন। যেখানে একটিপক্ষ বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালির চিন্তন প্রক্রিয়াকে উপজীব্য করে এগিয়ে যেতে চায়, সেখানে অন্যপক্ষটি তাদেরকে উপড়ে ফেলতে চায়, তাহলে ঐক্য হবে কিভাবে? যেখানে লুটপাট, ভোগ, পাকি..প্রেম, আধিপত্য ও ধর্মীয় ওহাবী বণিকদের ব্যবসার পথ প্রশস্ত করার জন্য সব কিছু করা হয় সেখানে পারস্পারিক সহঅবস্থান সম্ভব কিভাবে? প্লাষ্টিকের ফুলের কারুকার্য থাকতে পারে কিন্তু কোন সৌন্দর্য সৌরভ মাধুর্যতা নেই।
ঐক্যমত হয় কখন? ধনীর সাথে গরিবের, মালিকের সাথে দাসের, শত্রুর সাথে মিত্রের, ঘাতকের সাথে অসহায়ের, সেবকের সাথে সেবাবঞ্চিতদের, শোষকের সাথে শোষিতের, মিথ্যাবাদীর সাথে সত্যদর্শীর কোন কালেই কি বন্ধুত্ব হয়! মাতৃগর্ভে ভ্রণ হত্যার ঘাতকদের সাথে জননী জন্মভূমির কোনকালেই মিত্রতা হতে পারে না। দেশজন্মের ঘাতকের সাথে কিভাবে দেশপ্রেমিকের ঐক্যমত হবে। শান্তি বিনষ্টকারীকে দমন করেই তো শান্তি স্থাপন হয়। মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী-সৃজনশীলতার চর্চা কারীদের সাথে কিভাবে স্বরচিত কাল্পনিক ধর্মজীবিদের সহঅবস্থান থাকবে? অন্ধকারে যে প্রাণী চরে বেড়ায় তারা দিনের আলোয় বেঁচে থাকবে কিভাবে? বিষধর সাপ বিষের ভারে সুযোগ পেলে কামড় মারবেই। দাঁত ভেঙ্গে দেয়া না পর্যন্ত সতর্ক থাকাই সঙ্গত।
রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি না থাকলে রাষ্ট্র চরিত্রহীন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপরিচালনার সাথে যারা সম্পৃক্ত থাকেন তারা সবাই যখন লুটপাটের নানা কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত থাকেন। রাজনীতির নামে ভাগবাটোয়ারার জন্য যখন শত শত গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে তখন সমাজে লুটেরাদের ক্ষমতা বাড়ে, বিভাজন সৃষ্টি হয়। সমাজ চরিত্রহীন হয়ে পড়ে। অসম প্রতিযোগিতা বাড়ে, নিরাপত্তাহীনতা উদ্বিগ্নতা দেখা দেয়। স্মরণ রাখতে হবে রাষ্ট্র একটি বৃহৎ সমাজ। কাঙ্খিত রাষ্ট্র সমাজ সৃষ্টি কোন কাল্পনিক তত্ত্বে হয় না। সুষ্পষ্ট লক্ষ্য অঙ্গীকারের পথ ধরে বাস্তবতার শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র এগিয়ে যায়। ধর্মের নামে ব্যবসা, ধর্মের নামে অধর্ম, খুন হত্যা নির্মমতা, গুহা দোকানদারিত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধ সুশাসনের নামে যা ইচ্ছা তাই করার যে প্রবণতা এতদিন চালানো হয়েছে তারই ফল ভোগ করছি আমরা। এসবই রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ব্যর্থতা এবং কৃত কর্মের ফল। সুশাসনের ব্যর্থতা, দৃষ্টান্ত স্থাপনের ব্যর্থতা, অদূরদর্শীতায় রুগ্ন রাজনীতির চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে। সত্যের রাজনীতি ব্যর্থ হচ্ছে ফলে তার ফলাফল ভাগবাটোয়ারার গণতন্ত্র নিয়ে খুনোখুনি তান্ডবলীলা চলছে।  ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আন্দোলন সংগ্রাম স্বাধীনতা সাবভৌমত্ব উন্নয়নসহ সব কিছুর সাথে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী আওয়ামীলীগকেই আজ একটি চরম পরিস্থিতির মূখোমুখি হতে হচ্ছে। বাঙালির দলটিকে তটস্থ থাকতে হচ্ছে তাদের নিজেদেরই অপরিনামদর্শীতার কারণে। বামপন্থিদের শেষ ভরসার আওয়াজটুকুও ক্ষীণ হয়ে আসছে। দেশের জনগণ বামপন্থিদের ক্ষুদ্রতা অজ্ঞতা অহংকারের কফিনে পেরেক ঠুকে দেয়ার দিনক্ষণ গুনছে। বাস্তবতা অনুধাবনে সক্ষম বামপন্থিরা সুযোগ বুঝে নিজেদের বিক্রি করে যাচ্ছে আর কাল্পনিকতার ফাঁদে আটকা পড়ছে।
আজকে যারা দেশ দেশ বলে চিৎকার করছে সেই আওয়ামলীগ কি নিজেদের আয়নায় চেহারা দেখবে না, আর কতদিন ফাঁদ পাতা প্রতারণার রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে চলবে? তাদের কোন কোন নেতার প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা আছে? কোন কোন নেতা জানে আওয়ামলীগ কি? বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে কি-ই বা সম্পর্ক এই দলটির? ক্ষমতায় না আসতে পারলে বহু নেতা আত্মগোপনে থাকেন আর জনগণের উপর খড়গ নেমে আসে। এই জনগণ কারা কেন কোন কারণে তারা আওয়ামলীগকে সর্মথন করে তা আওয়ামলীগ জানে না। নিরবে নিভৃতে আপন মহিমায় চিন্তায় লক্ষ কোটি মানুষ বৃহত্তরস্বার্থে তাদের পাশে থাকে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামীলীগের বেশিরভাগ রাজনীতিকের কোন উপলব্ধি বোধ নেই বললেই চলে।  দলটির উপর পর্যায় থেকে শুরু করে বহু নেতা মনস্তাত্তিক ভাবে জামাত ও হেফাজতি। লুটপাট করাই তাদের নেশা পেশা। দেশে বিদেশে ঠিকানা। বিমানের টিকেট বুকিং করাই থাকে। সন্তান পরিজন সম্পদ সব বিদেশে তবু দেশের মাটিতে বসে বড় বড় কথা বলেন আরো কিছু পাবার আশায়। দলটির নেতৃত্বের প্রতি পৌঢ় রাজনীতিকদের দ্বি-চারিতা। দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম নেতাদের মর্যাদা সংকট দলটির বাস্তবে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। শুধু দ্বি-চারিতা নয়, বহুচারিতার দোষে দুষ্ট অপাংতেয় হাজারো তথাকথিত নেতা। অনেক মুখচেনা নেতা প্রকৃতপক্ষে পরিবার আত্মীয় স্বজন সমাবেশের নেতায় পরিণত হয়েছেন, জননেতা নয়।  এদেরকে দিয়ে দেশ কত দুর এগুবে তা দলীয় নীতি নির্ধারকদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। উন্নয়ন উন্নয়ন বলে, গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যে সব পরিচিত মুখগুলোর শ্রুতিবিরক্ত আওয়াজ কানে আসে তাতে তাদের অন্তসারশূন্য অভিনয়ই শুধু প্রকাশ পায়। উন্নয়ন বলতে কার উন্নয়ন, কিসের উন্নয়ন, কোন জনগণের উন্নয়ন, কোন গ্রুপের উন্নয়ন হয়েছে হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা গেলে এ সব তথাকথিত নেতাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে। দেশের মানুষ যাদেরকে শত্রু গণ্য করে যাদেরকে রাজনৈতিক দল মনে করে না তাদের সাথে আওয়ামীগের পার্থক্য কোথায় তা এখন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া দুস্কর। 
চাটুকারিতা গীত গাইলেই নেতা হওয়া যাবে, মোসাহেবীর কলাকৌশল জানলেই নেতার অনুগত থেকে সব সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে এমনটা ভেবে যারা দলটির মধ্যে রাজনীতি করছেন তাদের অবস্থান কোথায় এটা তারা নিজেরাও জানেন না। নষ্ট ভ্রষ্ট ওই আওয়ামীলীগ রাজনীতিকরা কি বায়ান্ন-বাষট্টি-সত্তর-একাত্তর-নব্বই পার করেছেন? এটা কি সেই দল যে দলের আদর্শিক নেতা চোদ্দ বছর জেল খেটেছেন তবু আপোষ করেননি, মাথা নিচু করেননি, লুটপাট করেননি! এটা কি সেই দল যার নেতা অসহায় গরিব মজুরকে বুকে টেনে নিতেন একসাথে খেতেন! দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পৃথিবীতে শোষণহীন বাংলা গড়তে আদর্শিক রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে দল গঠন করেছিলেন জনগণের ভালোর জন্য অবশেষে জীবন উৎসর্গ করে বাংলার বন্ধু হয়ে থাকলেন। যতদিন বাংলা থাকবে, একজন বাঙালিও থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধুও থাকবেন তাদের অন্তরে। আওয়ামীলীগের রাজনীতিকরা ভুলে যাচ্ছেন কতটা উত্তাল বৈরি সময়ে শেখ হাসিনা দেশের টানে ফিরে এসেছিলেন! বারবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছেন এটা কি আওয়ামীলীগের নষ্ট ভ্রষ্ট নেতারা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে কি তলিয়ে দেখছেন? কেন এদেশের মানুষ, এদেশের শান্তিপ্রিয় সত্যানুসন্ধানী মানুষরা আওয়ামীলীগকে পর্দার অন্তরাল থেকে সর্মথন করে এটি বুঝতে ব্যর্থ রাজনীতিকরা। ব্যর্থতা বাড়তে বাড়তে সীমা অতিক্রম করলে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে তাদের সরে যেতেই হবে। 
লুটেরা ঘুষখোর দখলদার চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ঘাতক সুদের কারবারী প্রতারকের সাথে একই সমাজে শোষিত বঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্তরা ততদিনই চোখ বুঝে সব সহ্য করে যতদিন কিছু করার থাকেনা অথবা পিট দেয়ালে না ঠেকে। বাধ্য হলে বারবার মার খেতে খেতে এক সময় যা ইচ্ছা তাই করে। রাজনীতিকদের দ্বি-চারিতা, বামপন্থিদের আত্মঅহংকার ও অদূরদর্শিতা আর সুশীল সজ্জনেরা এখন মূর্খের সর্দার আর না হয় কাপুরুষ। নষ্টের মূল ভদ্রবেশি ঘাতকেরা, নিচের তলার মানুষেরা নয়।
দলে ও সরকারে তল্পিবাহক অরাজনীতিক লুটেরা অবাঞ্ছিতদের উপড়ে ফেলতে না পারলে বাংলাকে ঘিরে যে অন্ধকার ঘণীভূত হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বেসুরো যন্ত্রীদের দৌরাত্ব না কমাতে পারলে জনবিচ্ছিন্নতা যে বাড়ছে তার জন্য চরমমূল্য দিতে হবে বাঙালি জাতিকে। জনগণের সাথে একাত্মতা প্রতিষ্ঠায় সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণে যত বিলম্ব হবে তত ক্ষতিগ্রস্থ হবে ঐতিহ্যবাহী দলটি।
সুষ্পষ্টভাবেই বলা যায় দেশের ও দলের শত্রুকে যারা চিহ্নিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারে দুর্নীতিকে সহযোগিতা করেছে তাদেরকেও জনগণের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। উগ্রবাদীতার যে বিষবৃক্ষ, লুটপাটতন্ত্রের যে বাজার বড় হয়ে উঠেছে তার জন্য দল হিসেবে আওয়ামলীগ ও বামপন্থিদের দায় নিতেই হবে।

বাংলার গণমানুষ সত্যের পথ ধরে চলছে


বাংলার গণমানুষ সত্যের পথধরে চলছে

সংলাপ ॥ বিএনপির গত সাত বছরে জনসমর্থন বাড়েনি, তবে তাদের চাটুকারের সংখ্যা বেড়েছে। এর কৃতিত্ব সরকারি দল আওয়ামী লীগের। সরকারের কাছে ঘুরে কিছু না পাওয়ার ব্যর্থতায় হতাশাগ্রস্তরা বিএনপির পাল্লায়। বিএনপির মধ্যে চলছে দলাদলি, বিশৃঙ্খলা, সংঘর্ষ। চলছে নেতৃত্বের কোন্দল। এখনো ধর্মীয় উগ্রবাদীদের মধ্য থেকে দলের কলকাঠি নাড়ানো হচ্ছে। চাটুকারিতা চলছে, কে হবে বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। বিএনপির তিন বছর গেছে স্থবিরতা কাটাতে। শুধু গতানুগতিক ধারায় রাজনীতিটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করেছে।
অতীতে নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপি যা বলেছিল আজ পর্যন্ত ওরা ঠিক বিপরীত কাজটিই করছে। এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে বিএনপির ভাবমূর্তি তলানিতে। প্রতীয়মান হয়েছে রাজনীতির নামে মিথ্যাচার। দূর্নীতির দায়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান, আরাফাত রহমান থেকে শুরু করে নেতা-কর্মীদের এক বিরাট অংশের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। ধরপাকড় চলছে। বিএনপির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব একটি বড় সমস্যা।
নিকট অতীতে বিএনপি প্রথম হরতাল করে ২৭ জুন, ২০১০। অনেকটা আকস্মিকভাবে। এরপর থেমে থেমে হরতাল করেছে নয় দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে হরতাল করেছে। কোনোটাই সর্বাত্মক সফল হয়নি। হরতালে মানুষের আগ্রহ কম। খালেদা জিয়া ১৪টি জনসভা, মহাসমাবেশ, বিভাগীয় সমাবেশ করেছেন এই তিন বছরে। রোডমার্চ হয়েছে এ পর্যন্ত চারটি। রোডমার্চে গড়ে তিন হাজার করে তোরণ নির্মিত হয়েছে।
এতে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সিলেট অভিমুখে রোডমার্চে শুধু হবিগঞ্জ অংশের ৮৭ কিলোমিটার রাস্তায় তোরণ বানানো হয়েছিল দেড় শতাধিক। এলাকাবাসীরা বলছে, ভবিষ্যতে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে আগ্রহী ব্যক্তিরা এসব তোরণ বানানোর খরচ দিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী, যাদের টাকার উৎস প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।
সস্তার রাজনীতি রোডমার্চের গাড়ি বহর। বিভিন্ন সেতুতে টোল প্রদানের হিসাব অনুযায়ী সিলেট অভিমুখে প্রায় তিন হাজার, উত্তরাঞ্চল অভিমুখে প্রায় আট শ এবং খুলনা অভিমুখে প্রায় পাঁচ শ গাড়ি ছিল। রোডর্মাচের গাড়ির নম্বর টুকে রাখার কথা উঠলে শেষ দুটি রোডমার্চে গাড়িবহরের আকার লক্ষণীয় ছোট হয়ে যায়। তাদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঢাকা, সিলেটসহ কয়েকটি বড় শহরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ককটেল বিস্ফোরণে ঢাকায় একজন ও বাসে আগুনে পুড়ে সিলেটে একজন নিহত হন। এসব ঘটনায় বিএনপি ও জামাতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। জামাতের পরামর্শ ও বিএনপির মধ্যম সারির নেতাদের দিয়ে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়ে ঢাকা অবরোধের পরিকল্পনা ছিল। এ খবর বিএনপির মূল নেতাদের অনেকেই জানতেন না। ফলে এর পেছনে জামাতি এক ধরনের চক্রান্তমূলক তৎপরতা ছিল বলে বিএনপির মধ্যেও অনেকে মনে করেন। এ ঘটনায় পুলিশ বিএনপি-জামাতের প্রায় আড়াইশ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। মামলা চলছে। বিএনপি  এখন গণমানুষের কাছে অনেকটা বেকায়দায়।
নিকট অতীতে বিএনপির কার্যক্রমে বিরক্ত হয়ে মানুষ সরকারের দিকে যাচ্ছে। জনমত বিএনপির সংসদে অনুপস্থিতি পছন্দ করেনি এখনও করছে না। সংসদের বর্তমান বিরোধী দল কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকতে হলে বিএনপির সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে একটি হলো সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে বিরোধী রাজনীতির শান্তিপূর্ণ পথে এগিয়ে যাওয়া। অন্য পথটি হলো মিথ্যাচারের মাধ্যমে সরকারের ব্যর্থতা দেখিয়ে সরকার পতনের জন্য রাজপথ উত্তপ্ত করা। এই দুই পথের দ্বন্দ্বের পরিণতিই নির্ধারণ করবে বিএনপির ভবিষ্যৎ।
বাংলার মানুষ বিএনপির ধ্বংসাত্মক রাজনীতিকে বয়কট করে করুণার দৃষ্টিতে দেখেন। চিন্তাবিদদের কাছে, বিনএনপি সঠিক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি রাজনীতিকরা জনস্বার্থে ও জাতীয় স্বার্থে তাদের উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেননি এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি-রাজপথ উত্তপ্ত করার হুমকি এবং সরকার পতনের আহ্বান ছাড়া। রাজনৈতিক দল হিসেবে যে দায়িত্বশীল ভূমিকা দরকার, বিএনপির রাজনীতিতে তা অনুপস্থিত। গণমানুষ মনে করে বিএনপিকে আন্দোলন করতে হবে গণমানুষের জন্যে, সত্যের পথে। বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল পুনর্মূল্যায়ন না করলে জামা ইসলামের ষড়যন্ত্রে রাজনীতির ময়দানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হবে যেহেতু গণমানুষ রাজনীতির মাঠে সত্যের পথ ধরে চলছে।

পৌর নির্বাচনঃ গণতন্ত্র সমুন্নত


পৌর নির্বাচনঃ গণতন্ত্র সমুন্নত

শেখ উল্লাস ॥ সংবিধান অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দেশের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগুন, সন্ত্রাস ও হত্যা যেভাবে কয়েকমাস সারাদেশকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক লোমহর্ষক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া শত শত অগ্নিদগ্ধ সাধারণ মানুষের আহাজারি যারা শুনেছে, দেখেছে এবং অনুভবের চেষ্টা করেছে তারা শুধুমাত্র অশ্রুসংবরণের মধ্য দিয়েই কর্তব্য সম্পাদন করেছে। ব্রিটিশ আমলে গান ছিল, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে’, ’৭১ সালে বলা হলো, ‘এক সাগরই রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা, আমরা তোমাদের ভুলবোনা’। ব্রিটিশ আর পাকিস্তানী আমলে ওইসব মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ হানাদার পাকিস্তানী শাসক-শোষকগোষ্ঠী। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে পেট্রোল বোমায় শত শত মানুষকে হত্যা বা আহত করার দায় কারা নেবে? নিশ্চয়ই এর দায়দায়িত্ব এক শ্রেণীর রাজনীতিকদেরই নিতে হবে- যারা শুধুমাত্র ওই নির্বাচনকে বানচাল করার কৌশল হিসেবে পেট্রোল বোমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা ও যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সহায়-সম্পত্তি ধবংসের পথ বেছে নিয়েছিল। এই রাজনীতিজীবীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোনো সরকার এবং কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার আন্দোলনের চেষ্টা চালায়, পরের বছর তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বের করা। সাধারণ মানুষের কষ্ট বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
গত ৩০শে ডিসেম্বর দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। সেই একই সরকার এবং  একই নির্বাচন কমিশনের অধীনে অংশ নিল বিএনপি এবং এই নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে এই দলটির। কমিশনের হিসেবে, নির্বাচনের সর্বশেষ বেসরকারি ফলে দেখা গেল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা ১৬৮টি পৌরসভার মেয়র পদে জয়লাভ করেছে, আর বিএনপি জয়লাভ করেছে মাত্র ১৯টি পৌরসভায়, ১টি পেয়েছে জাতীয় পার্টি এবং বাকী ২৬টিতে স্বতন্ত্রসহ অন্যান্য পরিচয়ের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। স্থগিত রয়েছে ২০টি পৌরসভার নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বাংলার মানুষের আরও বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো বিএনপি নির্বাচনে ভরাডুবির পরও ৩০ডিসেম্বরের নির্বাচনকে গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ‘সাফল্য’ বা ‘বিজয়’ হিসেবে দেখছে। এই ‘বিজয়’ ব্যাখ্যা করে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন পর দলের নেতাকর্মীরা প্রায় এক মাস ধরে মাঠপর্যায়ে সংগঠিত ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পেরেছেন। চরম বৈরি ও ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেও লড়াইয়ে থেকে নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই কমিশনের অধীনে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছে বিএনপি। এটাই আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। এ নির্বাচনের আরও ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, সহিংসতার ভয়াবহতা এবার জাতিকে প্রত্যক্ষ করতে হয়নি।
বাংলা ভাষার একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘আমও গেল, ছালাও গেল’। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে জোরালো ও সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়ে এবং তাদেরই ইন্ধনে ২০১৪ সালের জানুয়ারীর নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপির মতো একটি বড় দল যে ভুল করেছে তার খেসারত তারা দিচ্ছে। কিন্তু তাদের কারণে নিরীহ শত শত মানুষকে যে আগুনে পুড়ে মরতে হল সে জবাব কে দিবে? শত প্রতিকূলতা এবং অসম্পূর্ণতার মধ্যেও নির্বাচনী ধারাবাহিকতা রক্ষার সফলতার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং তাঁর প্রশাসনকে অবশ্যই অভিনন্দন জানিয়েছে দেশবাসী ভোট দেয়ার মাধ্যমে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রকাশ করছেন। দুই দলের প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষের নির্বাচনী যুদ্ধটি বহুদিন পরে আবারও গণমানুষের রাজনীতিতে নতুন একটি প্রাণের সঞ্চার করেছিল, নির্বাচনও ছিল মোটামুটিভাবে সহিংসতামুক্ত যা দেশের গণতন্ত্রের পথে এক নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে। নির্বাচনে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য এই দুটি দলের লোকদেরকে আরও অনেক অনেক বেশি সহিষ্ণু ও সত্যনিষ্ঠ হওয়া দরকার। রাজনীতিতে সততা ফিরিয়ে না আনলে দেশ পরিচালনা বা আমলাতন্ত্র, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কোনো কিছুতেই স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ সবই বোঝেন, তাই তাদের স্বার্থের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতা-কর্মীরা যত বেশি মনোযোগী হবেন ততই দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক।