বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই হোক আগস্টের অঙ্গীকার

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে

এগিয়ে চলাই হোক আগস্টের অঙ্গীকার


সংলাপ ॥ ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টের পর থেকে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাঙালি শোক করছে কিন্তু শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগের কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার শোককে ত্যাগের মহিমায় রূপান্তর করতে সাধক কবি নজরুল আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগে বলেছিলেন, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা, ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’। অভিধানে ‘মর্সিয়া’ শব্দটির অর্থ এক ধরনের বিলাপ যা মহররম মাসে কারবালার প্রান্তরে শাহাদাৎবরণকারী নবী-দৌহিত্র ইমাম হেসেন (রাঃ)-এর স্মরণে গাওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার এত বছর পর দেশে আজ সার্বিক ক্ষেত্রে যে অবস্থা তাতে কবি নজরুলের ‘ত্যাগ চাই’- আহ্বানটির বাস্তবায়নই বেশি উপলব্ধি করছে জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সারা জীবনের রাজনীতি ছিল ত্যাগের। সাধক কবি নজরুলকে পরম শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সুযোগ পেয়েই বঙ্গবন্ধু তাঁকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্ব-উদ্যোগে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে সেখানে তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে কবিকে বাংলাদেশের মাটিতে নিয়ে আসার উদ্যোগকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন। চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, পারস্পরিক ভক্তি-শ্রদ্ধা, মানবিকতা, দেশপ্রেম, বাঙালি জাত্যাভিমান এবং সর্বোপরি মানবতার মহান ব্রতে নিয়োজিত হয়ে এই দুই মহান পুরুষ তাঁদের জীবনে ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা আজকের দিনেও এদেশের জনগণের এবং তাঁদের নেতৃত্বের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় ও দিক-নির্দেশনা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি ও নির্দেশনা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাইনা, আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই’। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য যা তাঁর বিভিন্ন সময়ে দেয়া ভাষণে স্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করে গেছেন। আদর্শগতভাবে এবং কর্মের মাধ্যমে এদেশের কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য যখনই তিনি কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই তাঁকে হত্যা করলো স্বাধীনতা বিরোধী তথা গণবিরোধী শক্তি!
সেই ১৫ই আগষ্ট এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই শোক দিবসে কালো ব্যাজ ধারণ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের গান শোনা, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কাঙালী ভোজের আয়োজন ইত্যাদি বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা তখনই সার্থকতা পেতে পারে যখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তাঁর দেশের বিশেষ করে তাঁর দলের প্রতিটি নেতা-কর্মী, সমর্থক ও তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিটি নাগরিক তাদের নিজেদের জীবনে ধারণ করবে। অথচ দুঃখজনক হলেও একথা আজ সত্য যে, তাঁর আদর্শকে ধারণ করে এরকম নেতা-কর্মীর সংখ্যা এখন ক’জন পাওয়া যাবে? ত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন, দেশের কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ বলে ভাবছে এবং তাদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে রাজনীতি করছে এমন নেতা-কর্মীর সংখ্যা যে এখন নিদারুণভাবে কমে যাচ্ছে অথবা তাদের প্রয়োজন গৌণ হয়ে পড়েছে যা দেশের সার্বিক উন্নতির পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধুর নামে অনুষ্ঠান, ব্যানার-ফেষ্টুন তৈরি করে লোক-দেখানো বঙ্গবন্ধু-দরদী সাজা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হওয়া এবং তাঁর আদর্শকে ধারণ, লালন ও পালন করে দেশকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করা যায় না তা বোধ হয় এখন জরুরি ভিত্তিতে ভেবে দেখার সময় এসেছে। আর তা না হলে দেশের উন্নতি স্থিত হয়ে পড়বে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় তাঁর দেয়া ভাষণগুলোর যে কোনোটির দিকে তাকালে তাঁর আদর্শ কী ছিল তা বুঝতে কোন কষ্ট হয় না সাধারণ মানুষের। কৃষক-শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করেনা। করাপশন আমার বাংলার মজদুররা করেনা। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ’। দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের প্রতি শিক্ষিতদের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে। আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? ডাক্তারি পাস করায় কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করায় কে? বৈজ্ঞানিক করে কে? অফিসার করে কে?-বাংলার দুঃখী জনগণের টাকা’।

বঙ্গবন্ধুর রক্তঋণে অর্জিত এই দেশ আজ রাজনীতি, ব্যবসা ও আমলাতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে একটি অতি সুবিধাভোগী রাজনীতিকদের হাতে যেভাবে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে, তাতে বিশাল জনগোষ্ঠীকে বঞ্চনা ও উপহাসের পাত্র করে তোলা হচ্ছে। তাই আর সময় নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শকে যারা ধারণ করে না তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত দল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার এখনই সময়। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে জাতিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দূরদর্শী কার্যক্রম গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। 

তরুণদের নেতৃত্বেই হতে পারে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ


তরুণদের নেতৃত্বেই হতে পারে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ

সংলাপ ॥ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা বার বার ব্যক্ত করছেন। কিন্তু দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে পারে যে তরুণরা তাদের বিরাট অংশ এখন অন্ধ রাজনৈতিক চর্চায় মত্ত, দিশেহারা।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সুস্থ ধারার রাজনীতির অনুপস্থিতি ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকা- কখনোই এ প্রযুক্তি যুগের তরুণ সমাজের কাছে কাম্য হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে তবে দেশের ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যতও অন্ধকারে পতিত হবে বৈকি।
যদি আমাদের তরুণ সমাজ প্রতিহিংসা, পরনিন্দা, সমালোচনার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সহনশীলতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহাবস্থান ও পরোপকারের নীতি এবং শিক্ষা গ্রহণ করে সুস্থধারার রাজনীতির উন্মেষ ঘটাতে পারে তাহলেই কেবল এদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
তরুণদের একটি শ্রেণী ধীরে-ধীরে কিভাবে উচ্ছৃংখলতা ও অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে তা দৈনিক পত্র-পত্রিকা খুললে সহজেই অনুমান করা যায়। বখাটেপনা, অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপ, অপ-সংস্কৃতির প্রভাব, মাদক, চুরি, ছিনতাই ইত্যাদি বহু রকমের অন্যায় কর্মকা- আজ তরুণ সমাজের দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এভাবে আর কত দিন? অভিভাবক মহলের দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার দিন কবে শেষ হবে তা হয়তো কারোরই জানা নেই। বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ও মাদকাসক্তির ভয়াল থাবা থেকে তরুণ সমাজকে মুক্ত করতে না পারলে সামাজিক অবক্ষয় দূর করা যাবে না।
পরিবেশ মানুষকে যে শিক্ষা দেয় পাঠ্যপুস্তক তা দিতে পারে না। চারপাশের পরিবেশ সমাজের প্রতিটি নাগরিককে প্রভাবিত করে। তাই, সমাজে যার যার অবস্থান থেকে বখাটেপনা সহ সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয় নেয়ার এখনই সময়। নতুন একটি সভ্যতা বিনির্মাণের লক্ষ্যে তরুণ ও ছাত্র সমাজকে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, নীতিহীন শিক্ষার কোন মানে হয় না। যে শিক্ষায় কোন নীতি নেই এমন শিক্ষা ও জ্ঞান আমাদের দরকার নেই। বিদেশী সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান লাভ করতে হবে ঠিকই কিন্তু যেটুকু ভাল কেবল সেটুকুই আমরা গ্রহণ করতে পারি, অন্যথায় নয়। আমাদের নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, মূল্যবোধ ধরে রাখা এবং বিদেশী অপ-সংস্কৃতির চর্চা পরিত্যাগ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের সুনজর রাখা, সুশিক্ষা প্রদান, ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গুরুত্বারোপ করার মাধ্যমে তাদেরকে একটি পরিচ্ছন্ন জীবনের ভীত গড়ে দিতে হবে। যাতে বড় হয়ে কোন ছেলে-মেয়ে অন্যায় পথে পা না বাড়ায়।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরেও সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রতি গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। একজন কর্মক্ষম শিক্ষিত বেকারের চাকরি প্রাপ্তি অনেক বেশি জরুরি। কেননা, অর্থ কষ্টের কারণে কিংবা বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য অনেক তরুণ বিপথে পা বাড়ায় ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তাই প্রয়োজন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও চাকরি প্রাপ্তির সমস্যার দিক বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিভাগ/জেলা পর্যায়ে বৃহৎ/ মাঝারি /ছোট শিল্প-কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ে বেকারদের কর্মসংস্থান। 

সময়ের সাফ কথা.... ১৫ আগস্ট বাঙালির শেকড় সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করে

সময়ের সাফ কথা....

১৫ আগস্ট বাঙালির শেকড় সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করে
শেখ উল্লাস ॥ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এদেশের রাজনীতি ও সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের জন্য এক কালো অধ্যায়ের শুরু যা এখনও পরিপূর্ণভাবে মুছে যায়নি জাতীয় জীবন হতে। ১৯৭৫-সালের ১৫ই আগস্ট ভোর বেলায় বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর এদেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যমের কর্ণধাররা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও বলিষ্ঠ প্রতিরোধ আজও গড়ে তুলতে পারেননি এবং প্রতিবাদের দৃঢ় প্রত্যয়ী ভাষাও তারা সৃষ্টি করতে পারেননি। তৎকালে সবচাইতে প্রভাবশালী গণমাধ্যম বাংলাদেশ বেতারকে করা হয়েছিল পাকিস্তানী কায়দায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’, যেখান থেকে ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’ বলে ঘোষণার মধ্য দিয়ে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি দাম্ভিকতার সাথে প্রচার করেছিল খুনী মোশতাক-ডালিম চক্র। বাঙালির যে মহান নেতার জীবন ও কর্মের সাথে এদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও সংবাদপত্রের সম্পর্ক ছিল এক সুতোয় গাঁথা, তাঁকে হত্যার পর সবাই ছিল নিশ্চুপ।
দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল সরকারি গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের পাতায়। এখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের সময়ে যখন সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গণ-মাধ্যমগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নাম ও মর্যাদা যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব বজার রাখার জন্য কিন্তু সেখানে কতটুকু আন্তরিকতা আছে তা জনগণ ভালো করেই জানে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্ট-পরবর্তীতে দেশের কোনও পত্রিকা বা কোনও বৈদ্যুতিন মাধ্যম (অর্থাৎ, রেডিও, টিভি) বা কোনও সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলার সাহস কেউ দেখাতে পারেননি। কেন পারেননি তার কারণ খুঁজে বের করার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি? না-কি সেই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটিই মনে করতে হবে যা তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতার পর পর-‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’। বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান দেখাতে গেলে তাঁর জীবনের প্রতিটি কথা থেকেই যে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে তা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র এক সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশের দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক ও চিন্তাবিদদের গ্রেফতার করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি করা হয় আতঙ্ক। কোনো সংবাদপত্র কিংবা সাংবাদিকের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সংবাদ, সম্পাদকীয় বা প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়নি বরং সংবাদপত্রগুলোতে দেখা গেছে এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে অনেক লেখা হয়েছে বিশেষ সম্পাদকীয়। যারা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন হত্যাকাণ্ডের পর তারাই অনেকে প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে যারা নিজেদের মধ্যে ধারণ,  লালন ও পালন করতেন তাদেরকে কারাবরণ করতে হয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় ৪ নেতাকে কারাগারে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে দেখা যায়, একদিকে দেশ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, অপরদিকে কতিপয় রাজনীতিকের দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের অনুপম উদাহরণ তৈরি হয়েছে ১৫ই আগস্টকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারই নামে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান এই চার নেতাকে জেলখানায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য। আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন কিছু রাজনীতিকদের মধ্যে যে চরম বিশ্বাসঘাতকতা লক্ষ্য করা গেছে তা একজন বিবেকবান বাঙালি কোনোদিনই মেনে নিতে পারেনি এবং আজও পারছে না। সে সময়ের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা ও চরম কপটতা ও কাপুরুষতার এক জঘন্য উদাহরণ হয়েই থাকবে।
আধিপত্যবাদী এদেশীয় এজেন্টদের চোখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তাঁর নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি কেউ বাংলদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে। বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না। (তথ্যসূত্র: এই দেশ এই মাটি প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান - বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-১৬৫) তারপর একদিকে চলতে থাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ, অপরদিকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের সেই কালো রাতে। এর অব্যবহিত পরবর্তী প্রায় ৩০ বছরের পরিস্থিতি তাই বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনীতিক ও সংবাদপত্রের জন্য এক অসহনীয় কলংকিত অধ্যায় যা জাতিকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে বার বার।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের সাথে যে দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পর্ক ছিল সবচাইতে নিবিড়,  ১৫ আগস্টের ভোরবেলায় রক্তাক্ত ঘটনার পর পত্রিকাটির বক্তব্য ও ভূমিকা পাল্টে যায় আশ্চর্যজনকভাবে। ১৫ই আগস্ট সংখ্যায় ওইদিন বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের খবর দুই কলাম শিরোনামে ‘লীড’ করা হয়। চ্যান্সেলর হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ওইটিই ছিল প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন। খবরটিতে পরিদর্শনের বিস্তারিত সূচীও প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে বঙ্গবন্ধুসহ তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, ডাকসুর ভিপি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রবন্ধে, নিবন্ধে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, সমাজতান্ত্রিক কাঠামোয় গড়ে তোলার আশা-আকাক্সক্ষা প্রত্যয় ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু ১৬ আগস্টের ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ ॥ সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা ॥ খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ।’ প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শীর্ষক বিশেষ সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে গতকাল প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন এবং এক ভাব-গম্ভীর অথচ অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তাঁহার নতুন সরকারের প্রতি স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর অধিনায়কগণ তাঁহাদের স্ব-স্ব বাহিনীর পক্ষ হইতে অবিচল আস্থা ও আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছেন।’
ওইদিন পূর্ণ দুই কলাম জুড়ে এই সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নামটিও উল্লেখ করা হয়নি।
‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’ শীর্ষক শিরোনামে বাসস-এর একটি খবর : ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল শুক্রবার সকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন বলিয়া ঘোষণা করা হয়।’
‘উপ-রাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’ শীর্ষক খবর : ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ গতকাল উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনাব মুহম্মদুল্লাহ্, মন্ত্রিপরিষদের ১০ জন সদস্য ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করিয়াছেন।’ বাসস-এর খবরে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি গতকাল বিকালে বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে নয়া উপ-রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের শপথ করান।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ হইতেছেন - ‘বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, জনাব ফণী মজুমদার, জনাব মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, জনাব আবদুল মান্নান, জনাব মনোরঞ্জন ধর, জনাব আবদুল মমিন, জনাব আসাদুজ্জামান খান, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক ও ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী।
প্রতিমন্ত্রীগণ হইতেছেন - শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও জনাব কে এম ওবায়দুর রহমান।’ উল্লেখ্য যে, এসব মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সবাই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
অপরদিকে, ১৭ আগস্ট ‘খন্দকার মোশতাকের জীবনালেখ্য’ শিরোনামে ইত্তেফাক লিখেছিল: ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৪২ সাল হইতে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রগতিশীল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের দায়ে বিভিন্ন সময়ে মোট ৭ বৎসরেরও অধিককাল তিনি কারাবরণ করেন। তাহার বর্তমান বয়স ৫৬ বৎসর। খন্দকার মোশতাক ১৯১৯ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির দশপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাহার পিতা-মাতার চতুর্থ পুত্র।
তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ দফতরের মন্ত্রী এবং পরে বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন।’ (সংক্ষিপ্ত)
১৭ আগস্ট ইত্তেফাকে ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ উদার মানবতার দৃষ্টিতে বিশ্বাসী আর এজন্যই সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কাহারও প্রতি শত্রুতা নয় এই মহান আদর্শের কথা নতুন সরকার ঘোষণা করিয়াছেন। শান্তি যেমন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য তেমনি বিশ্বের যেখানে অন্যায়, অবিচার সেখানেই তার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদও হইবে উচ্চকণ্ঠ।’
১৮ আগস্ট ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় নিজস্ব কয়েকটি রিপোর্টের শিরোনাম- ‘সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করুন : রাষ্ট্রপতি (৮ কলামের ব্যানার) ‘সর্বত্র উৎসাহব্যঞ্জক তৎপরতা’, নয়া সরকারের প্রতি সকল মহলের সমর্থন, ‘বাংলাদেশে পরিবর্তন বিদেশে ব্যাপকভাবে আদৃত’। ১৯ আগস্ট - ‘সর্বস্তরে স্বাভাবিক কাজ শুরু’, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে পূর্ণ কর্মতৎপরতা, সর্বত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুনরায় ক্লাশ চালু,’ ‘কুয়েত বাংলাদেশের জনগণের সমৃদ্ধি কামনা করিয়াছে।’
দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৭৫-এর ২৪ আগস্ট ‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জন গ্রেফতার’ শীর্ষক ৬ কলাম শিরোনামের সংবাদ : ‘দুর্নীতি, সমাজবিরোধী তৎপরতা, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তি হস্তগত করার অভিযোগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব কোরবান আলী, জনাব আবদুস সামাদ আজাদ এবং কয়েকজন এমপিসহ মোট ২৬ জনকে গতকাল (শনিবার) গ্রেফতার করা হইয়াছে। গত রাত্রে জনৈক সরকারী মুখপাত্র জানান যে, দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে আয়ের জ্ঞাতসূত্রের সহিত সামঞ্জস্যবিহীন বিপুল সম্পদ অর্জন এবং গর্হিত পন্থা স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পত্তি কব্জাগত করার অভিযোগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় ব্যক্তিদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে।’
২৫ আগস্টের ইত্তেফাকে ‘জেনারেল জিয়াউর রহমান চীফ অফ আর্মী স্টাফ’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, ‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, পিএসসিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে নিয়োগ করা হইয়াছে। তিনি মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম, পিএসসির স্থলাভিষিক্ত হইবেন।
মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর চাকরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে ন্যস্ত করা হইয়াছে। বর্তমানে ভারতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদ পিএসসিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দান করিয়া তাঁহাকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্থলে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ করা হইয়াছে।’ ওইদিন ‘যাদুমিয়া ও অলি আহাদের মুক্তিলাভ’ শীর্ষক সংবাদ- ‘গত রাত্রে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে দুইজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা জনাব মশিহুর রহমান (যাদুমিয়া) ও জনাব অলি আহাদকে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে। ১৯৭৪ সালের ৩০শে জুন তাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছিল।’
১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট পত্রিকাটিতে ‘ইত্তেফাক ও সংবাদ মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ’ এর খবর প্রকাশিত হয় এবং ২৪ আগস্ট থেকে প্রিন্টার্স লাইনে ইত্তেফাক সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হিসেবে মইনুল হোসেন এবং সম্পাদক হিসেবে আনোয়ার হোসেনের নাম ছাপা হয়। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল নূরুল ইসলাম পাটোয়ারীর।
২৬ আগস্টের ইত্তেফাক-এ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির পাশাপাশি মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি (ছবিসহ) প্রকাশিত হয়।
৩১ আগস্ট ‘রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ’ শীর্ষক ৫ কলাম-এর সংবাদ : ‘প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ গতকাল (শনিবার) জারিকৃত এক অর্ডিন্যান্স বলে কোন রাজনৈতিক দল গঠন, সংগঠন, প্রতিষ্ঠা বা আয়োজন অথবা উহার সদস্য হওয়া অথবা অন্যভাবে উহার তৎপরতায় শরিক হওয়া অথবা কোনভাবে উহার সহিত সংশ্লিষ্ট থাকা নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন।
সরকারী হ্যান্ডআউটের বরাত দিয়া বাসস জানান, এই বিধান লঙ্ঘন করিলে ৭ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- অথবা জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ড দেওয়া যাইতে পারে।’
২১ আগস্ট ‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ’ সংবিধানের আংশিক সংশোধন ॥ পার্লামেন্ট অব্যাহত ॥ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অপরিবর্তিত’ শীর্ষক ব্যানার শিরোনামের খবর : ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ গতকাল তাহার জারিকৃত এক ঘোষণাবলে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। রাষ্ট্রপতি এই ঘোষণা এবং সামরিক বিধি ও আদেশসাপেক্ষে দেশের সংবিধানের কার্যকারিতা বলবৎ রাখিয়াছেন।
রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময়ে সামরিক আইনের বিধি প্রণয়ন এবং যে কোন অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনাল গঠন করিয়া আদেশ জারি করিতে পারিবেন বলিয়া ঘোষণায় ব্যবস্থা করা হইয়াছে। একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন, এই ঘোষণা বলে সংবিধানের ৪৮, ৫৫ ও ৪৫ নম্বর ধারা সংশোধন করা হইয়াছে। তিনি বলেন, সংবিধান বাতিল করা হয় নাই এবং ৪টি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অক্ষুন্ন থাকিবে। সংসদও বাতিল করা হয় নাই।’

এভাবে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরই বোঝা গিয়েছিল কারা এই হত্যাকাণ্ডের সুফলভোগী। যে দল মাত্র বছর কয়েক আগে একটা সফল স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, যে দলের সুদৃঢ় রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল এদেশের প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জ-শহরে সে দলের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে কেন সংগঠিত কোনও মিছিল বের হয়নি সে প্রশ্ন আজও তাড়িয়ে বেড়ায় এদেশের বিবেকবান জনগোষ্ঠীকে। কারণ, বঙ্গবন্ধু সারাজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম-জেল-জুলুম সহ্য করে জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন ও ভালবাসা নিয়ে আমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পর সরকারের সুবিধাভোগী অংশ ও সারা দেশের রাজনীতিকদের নিস্ক্রিয়তা এবং গণমাধ্যমগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থান আজও জাতিকে পীড়া দেয়। তাই বর্তমান সরকারের ও দলের মধ্যে এখনো ঘাপটি মেরে থাকা চোর, চাটুকার, ষড়যন্ত্রকারী ও লুটেরাদের সম্পর্কে সজাগ থেকে যথাযথ কর্মপন্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। 

বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৬

বাঙালি জাতিসত্ত্বা সমুন্নত রাখতে বাউল সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সময়ের দাবি




বাঙালি জাতিসত্ত্বা সমুন্নত রাখতে
বাউল সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সময়ের দাবি

রাজীব, কুষ্টিয়া ॥ বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষদেরকে অশান্ত করে তোলার জন্য দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের নানা অপকর্ম বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। বিশেষ করে বাঙালি জাতিসত্ত্বা ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি ধারা বাউল সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে আমদানীকৃত ধর্মের ধর্মান্ধ স্বার্থান্বেষী মহল। বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক বাহক সত্যমানুষ ফকির লালন শাহ্ এর উত্তরসূরী নির্লোভ-নির্মোহ ফকির বাউল ও তাদের আস্তানায় বিগত কয়েক বছর ধরে একের পর এক হামলা হচ্ছে। আজ উন্নত বিশ্বে দেশ-বিদেশের বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বাংলার সনামধন্য পথ প্রদর্শক সত্যমানুষ ফকির লালন শাহ্ ও বাউল সাধনা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, যেখানে ফকির লালন শাহ্ এঁর দর্শন পাঠদান করা হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে বাংলার একটি ধর্মজীবী-ধর্মান্ধ গোষ্ঠী লালন দর্শন তথা বাউল দর্শনকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
গত ২৯ জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাতে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার গোবিন্দপুর গ্রামে ফকির জুলমত শাহ্ এঁর আখড়ায় ৭/৮ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী আনুমানিক রাত্রি ১২ টার দিকে অতর্কিত হামলা চালায়। তারা প্রথমেই এসে লাইট এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উপস্থিত তিনজন বাউল ফকির জুলমত শাহ্, তাঁর স্ত্রী মোমেনা বেগম ও হরেন্দ্রনাথ গোস্বামী নামক এক ভক্তকে গাছের সাথে বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটায় ও চুল, দাঁড়ি কেটে দেয়। এক পর্যায়ে জুলমত শাহ্ গলায় ছুরি চালানোর জন্য উদ্ধত হলে হাতে পায়ে ধরে তারা রক্ষা পায়।
আগামী ১ মাসের মধ্যে তারা আখড়া ভেঙে না ফেললে পুনরায় হামলা করবে বলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দেয়। সন্ত্রাসীরা ঘরের আসবাবসহ তবলা, হারমোনিয়াম, সাইকেল, একটি শ্যালোমেশিন ও বেশ কিছু বইপত্র এক জায়গায় জড়ো করে প্রেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফকির জুলমত শাহ্ বেশ কিছু দিন যাবৎ হৃদরোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য জমানো ১৭০০০ (সতের হাজার) টাকাও একই সাথে পুড়িয়ে দিয়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
বাউল জুলমত শাহ জানিয়েছেন, বছর ছয়েক আগে তিন বিঘা জমির উপর তিনি আখড়াটি বসিয়েছিলেন। প্রতি বছর ১৫ বৈশাখ, ৫ আষাঢ় এবং ২৫ ফাল্গুন সেখানে আসর বসে, দেশ-বিদেশ থেকেও বহু বাউল-ফকির তাতে অংশ নেন। আক্রমণের শিকার বাউলরা জানিয়েছেন, আক্রমণকারী তরুণরা নিজেদের খুলনার লোক বলে দাবি করলেও চুয়াডাঙ্গার আঞ্চলিক টান ছিল তাদের কথায়।
এ ব্যাপারে দামুড়হুদা থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি আবু জিহাদ মোহাম্মদ ফকরুল ইসলাম জানিয়েছেন ইতোমধ্যে অভিযান চালিয়ে মদনা নামক পার্শ্ববর্তী ১টি গ্রাম থেকে আলাউদ্দিন (২৮) এবং নাসিরুল নাসির (২৫) নামে দুই জন আসামীকে ধরা হয়েছে। সোমবার সকালে তাদেরকে কোর্টে প্রেরণ করা হয়েছে এবং তারা পুলিশ হেফাজতে আছে। এদিকে চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক ও চুয়াডাঙ্গা বাউল পরিষদের সভাপতি মনিরুজ্জামান আগামী শুক্রবার মানববন্ধন ও কালোব্যাজ ধারণের এক কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা ২ আসনের এমপি হাজী আলী আজগর টগর, পুলিশ সুপার, টিএনও সকলেই জায়গাটি পরিদর্শন করে তাদের পুনর্বাসন ও নিরাপাত্তার আশ্বাস দিয়েছেন।
অন্যদিকে গত ১৬ জুলাই শনিবার রাতেও একই জেলার জীবননগর উপজেলার একতাপুর গ্রামের আখড়ায় বাউলদের ওপর হামলা চালিয়েছিল মুখোশ পরা দুষ্কৃতিরা। রাত ১টার দিকে সাত-আট জন যুবক আখড়ায় এসে বাউলদেরকে লোহার রড ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে। একতারপুরের আখড়াটিও পুড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতিরা। পরে তাদের চিৎকারে এলাকার লোকজন এলে তারা পালিয়ে যায়। দুই মহিলাসহ তিনজন এই হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতরা হলেন - কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার শহরদা গ্রামের আবদুর রহিম (৬৫) ও তার স্ত্রী বুলু খাতুন (৫০) এবং ঝিনাইদহের হরিণাকু উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের রুশিয়া খাতুন (৪৫)। তদন্তে নেমে জামাতে ইসলামি ও তাদের ছাত্র শাখার কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ দিনের ঘটনার পিছনেও জামাতের সন্ত্রাসীরা রয়েছে বলে সন্দেহ পুলিশের। স্থানীয়রা সে সময় আহতদের উদ্ধার করে প্রথমে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি  করে। হামলার পর থেকে আখড়ায় সাধারণ বাউল - সাধু - ফকিরসহ তরিকাপন্থীদের অবস্থান ও গানবাজনা বন্ধ রয়েছে। সন্ত্রাসীদের হামলায় তছনছ হয়ে পড়া আখড়াবাড়িটি মেরামত করা হয়নি। এ ঘটনায় পরদিন ১৭ জুলাই একতারপুর গ্রামের শহিদুল হক শাহ বাদী হয়ে জীবননগর থানায়  মামলা দায়ের করেন। আখড়াবাড়িতে অনধিকার প্রবেশ, ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো-জীবননগর উপজেলার সেনেরহুদা গ্রামের নিয়ামত মন্ডলের ছেলে জামায়াত নেতা জামাত দ. কলিমদ্দিন (৩৯), আনাম আলীর ছেলে শফি উদ্দিন (২৬) ও উথলী গ্রামের সাগর আলীর ছেলে ইলিয়াস হোসেন (২৫)। এদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবী করেছেন জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন বাউল সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। জেলা বাউল কল্যাণ সংস্থার সভাপতি মহিউদ্দিন শাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাউল-সাধুরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। তাঁরা কাউকে কোনো ক্ষতি না করলেও একটি মহল কারণ ছাড়াই একতারপুর আখড়াবাড়িতে হামলা চালায়।
বিগত কয়েক বছর ধরে বাউল সম্প্রদায়ের উপর বার বার হামলা করা হচ্ছে। কারা বাউল সংস্কৃতি বিরোধী তা এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ সবাই জানে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রেরও অজানা নয় কারা বাউলদের উপর হামলার জন্য দায়ী। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এইদেশে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন সময় একই উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হতাহত করেছে। বিগত কয়েক মাসে হিন্দু-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অনেক পুরোহিত নিহত ও আহত হয়েছে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠীর দ্বারা যা রোধ করার কোন পন্থা প্রশাসন বের করতে পারছে না। বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ধারা বাউল সম্প্রদায়ের ফকিরদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারের আশু প্রশাসনিক পদক্ষেপ সময়ের দাবী।

সময়ের সাফ কথা.... আগষ্ট জাগ্রতচিত্ত হওয়ার ডাক দেয়



সময়ের সাফ কথা....
আগষ্ট জাগ্রতচিত্ত হওয়ার ডাক দেয়

সংলাপ ॥ আবারও এসেছে আগষ্ট মাস। বাঙালির জাতীয় শোকের মাস। ১৯৭৫ থেকে ২০১৬, আজ থেকে ৪১ বছর আগে বাঙালি জাতির জীবনে এসেছিল এই মাস-১৫ই আগষ্টে জাতি স্ব-পরিবারে হারিয়েছিল জাতির পিতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীনতা অর্জনের অর্থাৎ, ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়ের ৩ বছর ৮ মাস মাত্র পার হয়েছে। ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারবো না। আরো তিন বছর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতে না’ (উত্তর, ‘করতাম  করতাম...)’ তাহলে মনে কর যুদ্ধ চলছে, তিন বৎসর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙ্গল আর কোদাল।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন। সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সকল স্বীকৃতি আদায়সহ ৭৪’এর বন্যার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে দেশ যখন অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারের হত্যা করা হলো। সফল হয়েছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা। তারপর একে একে হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে, মুক্তিবাহিনীর প্রধান প্রধান অধিনায়কদেরকে। দেশকে নিয়ে যাওয়া হলো পাকিস্তানী ধর্মান্ধ ভাবধারায়। বিসর্জন দেয়া হলো মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সকল অর্জনকে। এর সবই করা হয়েছিল ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। দেশ পিছিয়ে পড়ে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মুশতাকচক্র সেদিন বঙ্গবন্ধু সরকার ও তাঁর দলের মধ্যেই ঘাপটি মেরেছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচন হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর।   
৪১ বছর পর আগষ্ট মাস আবারো বাঙালির দ্বারে। অনেক কঠিন ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে বর্তমানে দেশের সফল ও অভিজ্ঞ কাণ্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ বঙ্গবন্ধুরই রক্তের উত্তরাধিকার, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শক্ত হাতেই তিনি ধরেছেন দেশের হাল। আর তাই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতা-বিরোধী  ধর্মান্ধ, ধর্ম-ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র যে এক মূহুর্তও থেমে নেই তা সচেতন মানুষ কারোরই অজানা নয়। এই ষড়যন্ত্রকারীরা কোনো দিনই চায় না, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক্ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তাই এদের সম্পর্কে সজাগ থাকাই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, বঙ্গবন্ধু সরকার ও দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা গুটি কয়েক যড়যন্ত্রকারী দেশ ও জাতির জন্য যে কী ভয়াবহ অবস্থা ডেকে আনতে পারে ১৯৭৫’এর ১৫ই আগষ্ট তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ইতিহাস স্বাক্ষী, ১৫ই আগষ্টের পূর্ববর্তী ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশ যখন সঠিক পথে চলছিল ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এর কয়েকমাস আগে ১৯৭৫-এর ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত র‌্যালীতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে সরকার বাধ্যতামূলকভাবে ৬৫ হাজার গ্রামে বিভিন্নমুখী সমবায় সমিতি পদ্ধতি চালু করবে। সকল সাবডিভিশনকে প্রশাসনিক জেলায় উন্নীত করা হবে। প্রচলিত জেলাসমূহ প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে বিলুপ্ত হবে এবং থানা ও জেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের তারিখ, মুহাম্মদ হাবিুবর রহমান, পৃষ্ঠা-৮৯)। তারই পথ ধরে বর্তমান সরকার জেলা পরিষদ প্রশাসক পদে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ঘোষণা দিয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সূদুরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছে সচেতন মহল। কিন্তু সব কিছুই নির্ভর করছে ষড়যন্ত্রকারীদের কালো থাবা থেকে দেশকে রক্ষার ওপর।  
’৭৫ সালে ষড়যন্ত্রকারীদের সফলতা এটাই ছিল যে, দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত সকল পরিকল্পনা ওরা নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। তারা এতটাই সফল ছিল যে, ’৭৫-এর নির্মম ঘটনার প্রতিবাদ বা প্রতিকার করার মতো কাউকেও সেদিন পাওয়া যায়নি। ১৫ আগষ্টেই রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য এবং তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী খন্দকার মুশতাক। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিপরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট, ১০ জন মন্ত্রী এবং ৬ জন প্রতিমন্ত্রী পুনর্বহাল হয়। এমন জঘন্যতম ও লজ্জাজনক ঘটনা বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে চিরকাল।
সেই ষড়যন্ত্রকারীদের দোসর এবং তাদের বশংবদরা আজও মিশে আছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, প্রশাসনে, সরকারি দলে। বাহ্যিক অবস্থাটা এমন যে, প্রশাসনের কোথাও এখন সরকারবিরোধী লোক খুঁজে পাওয়া যায় না! আর আওয়ামী লীগের ভিতরে, বিভিন্ন স্তরে ঢুকে পড়েছে অনেক স্বাধীনতাবিরোধীর সন্তান, জামাত-বিএনপির এজেন্ট হিসেবে। অথচ সুযোগ পেলেই ওরা ওদের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করবে। এইসব কপটদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার ক্ষেত্রে সরকার যতটুকু সফল হবে-ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল। ২১০৬ সাল বাংলার ভাগ্যাকাশে আবারও এসেছে সেই বার্তা নিয়ে-এই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর, তাজউদ্দীনের, এই বাংলা সাধক নজরুলের, শেরে বাংলার, মওলানা ভাসানীর, সোহ্রাওয়ার্দীর। বিশ্বাসঘাতকদের স্থান এখানে কখনো হয়নি, হবেও না।

সঙ্কটের মূলে ব্যক্তিস্বার্থপরতা



সঙ্কটের মূলে ব্যক্তিস্বার্থপরতা

ধন-সম্পদ বাড়াবার লোভ ও লিপ্সা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে যতক্ষণ না পর্যন্ত কবরে উপনীত হও। এটা সঙ্গত নয়, শীঘ্রই তোমরা তা জানতে পারবে; আবার বলি, এটা সঙ্গত নয়, তোমরা শীঘ্রই তা জানতে পারবে। কখনোই নয়! যদি তোমরা নিশ্চিত জানতে পারতে অবশ্যই তোমরা মোহাচ্ছন্ন  হতে না। তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে; আবার বলি তোমরাতো তা অবশ্যই দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে, এরপর সেদিন অবশ্যই আল্লাহ্র নিয়ামতসমূহ সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (আল কুরআনঃ ১০২: ১-৯)
শাহ্ ফুয়াদ ॥ ব্যক্তিত্ব আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বা ব্যক্তিস্বার্থপরতা এক কথা নয়, ভিন্ন বিষয়। বাংলা একাডেমীর সহজ বাংলা অভিধান মতে, ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির স্বকীয়তা। অন্যের সঙ্গে পার্থক্য করা যায় এমন ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য। আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অর্থ হচ্ছে, সর্বজনীন বা সমষ্টির গুরুত্বের চেয়ে যে মতবাদ ব্যক্তির গুরুত্বকে প্রাধান্য দেয়। এমন এক নীতি যাতে সমাজের চেয়ে ব্যক্তি বড়। এটা একজন মানুষের এমন একটি অবস্থা যা তাকে চরম আত্মকেন্দ্রিক, সমাজবিমুখ ও স্বার্থপর করে তোলে। আমাদের সমাজ ও দেশের এখন যে অবস্থা তাতে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, প্রতিষ্ঠা হয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তিস্বার্থপরতায় আচ্ছন্ন লোকদের প্রভাবে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্য, দুর্নীতি ও মিথ্যাচার। তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদ, স্বাধীনতার সুফল হিসেবে মানুষের আর্থিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ইত্যাদি সবকিছুই মানুষকে আগের চাইতে যেন আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। ফলে গুলশান ও কিশোরগঞ্জে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও বিদেশি হত্যাযজ্ঞ, রাজধানীর কল্যাণপুরে অভিযান চালিয়ে ৯ জঙ্গীকে হত্যার ঘটনায় দেশের সবাই আজ সরব ও উচ্চকিত হয়ে উঠেছে ঠিকই, এই ঘটনা যে সমাজের ব্যক্তিস্বার্থপরতারই পরিণতি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, এদেশেরই এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ছাত্র ও যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করছে, সন্ত্রাসী বানাচ্ছে, হত্যা করছে নিরীহ মানুষকে । দেশ রসাতলে যাক-এ নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য এদের নেই। ১৯৭১-এ যেমনটি করেছিল রাজাকার-আলবদর-জামাত-মুসলিম লীগ-শান্তিকমিটিসহ এদেশীয় স্বার্থান্ধ, বর্বর পাকিস্তানীদের দালালেরা। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, পাকিস্তানী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের সময় এদেশের রাজনীতিতে, সমাজের সর্বস্তরের নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী ও সংগঠকের  অভাব ছিল না, স্বাধীন দেশে এই সংখ্যাটি কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। সবাই চায় এখন নিজেই বড় হয়ে যেতে। রাজনৈতিক দল, সরকার, চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব ক্ষেত্রেই একথা আজ প্রযোজ্য। সামগ্রিক স্বার্থে নয়, সব কিছুই যেন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থে। ফলে মিথ্যাচারের সংস্কৃতি থেকে জাতি মুক্ত হতে পারছে না।                          
আর এরই পরিণতিতে, বাংলা ভাষায় প্রচলিত নির্দেশনামূলক বাক্য-‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’- বর্তমান সমাজে এর বাস্তবতা কতটুকু ? আর এর বিপরীতে অবস্থাটি ‘দেশের চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’- এর মধ্যে বাস্তবতা কতটুকু? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা রয়েছে সমাজের সচেতন প্রতিটি মানুষের কাছেই। ব্যক্তিগতভাবে একজন মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে-এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু রাজনীতি, সমাজনীতি, আমলাতন্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষাদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামগ্রিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়া হয় না বলেই সমাজে বিরাজ করে অশান্তি, অন্যায়, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি চলে ধর্মের নামে। ধর্মের নামে উগ্র-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আজ তাই ভয়াবহ রূপ পেয়েছে-নাম নিয়েছে জঙ্গীবাদ বলে। আর সেই সন্ত্রাসকে রুখে দেয়ার জন্য ব্যবহার করতে হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি ।
অবশ্য অন্যায়-অশান্তি-সন্ত্রাস-মানুষের নিত্য সঙ্গী, পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই। এসবের বিরুদ্ধে মানুষকে শান্তির নিশানা দেয়ার জন্যই যুগে যুগে আবির্ভূত হয়েছেন নবী-রাসুলগণ। এঁদেরই উত্তরাধিকার সূফী-সাধক-আউলিয়াগণ যাঁরা সময় ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় মানুষকে শান্তি ও সত্যের বাণী শুনিয়েছেন, মানুষকে এই পথে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। এক সাধক বলেছিলেন, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। এই ‘সকল’ বলতে তিনি শুধু মানুষ প্রজাতিকেই বুঝিয়েছিলেন, অন্য কোনো চতুষ্পদ প্রাণী এর মধ্যে পড়ে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ নিজেকে নিয়ে আজ বড় বেশি ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা ব্যক্তিগত সুখভোগ, সম্ভোগ বৃদ্ধি, নগদ অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি তথা পুঁজি বাড়ানোর লক্ষ্যে। সেই বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংকিং পদ্ধতি, যা আজ বিশাল আকার ধারণ করেছে আমাদের দেশেও। এই পুঁজি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা ইসলাম ধর্ম (শান্তিধর্ম) কখনো স্বীকার করে না। হাক্কানী সাধক বলেন, ‘ যে নিজেকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর অনুসারী দাবি করবে তার কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ (বর্তমান যুগে যা ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট)  থাকতে পারে না। কারণ, মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না।’ ইতিহাস বলে, বিবি খাদিজা (রাঃ)-এঁর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ শান্তিধর্ম (ইসলাম ধর্ম) তথা মানবতার মহান ব্রতে নিয়োজিত করেছিলেন। ব্যক্তিস্বার্থের কথা ভাবার কোনো চিন্তাও নবীজীর ছিল না। অপরদিকে, তাঁর শান্তি ও সত্যের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে ব্যক্তিস্বার্থ তথা গোষ্ঠীস্বার্থ যাদের ক্ষুন্ন হবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, সেই কুরাইশ বংশের লোকেরা তাঁর ওপর কত অত্যাচার, নির্যাতন, জ্বালাতন করেছে তা বিশ্ব ইতিহাসেরই অংশ হয়ে আজও বিরাজ করছে।
আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান হলেও এর কত শতাংশ নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সেই আদর্শ ধারণ, পালন ও লালন করেন সেটাই প্রশ্ন। ব্যক্তি স্বার্থ আদায় ও ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের জন্য, পার্থিব সম্পদ বৃদ্ধিও জন্য মুসলমানরাও যেভাবে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলার কিছু নেই। বিশেষ করে তথাকথিত শিক্ষিত ও সুবিধাভোগী মুসলমানেরাই বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনেরও যেন শেষ নেই। এই চাহিদা মেটাতে গিয়েই তারা দুর্নীতি করছে, সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে চিন্তা করার সময়ও তাদের নেই। অথচ রাজনৈতিক স্বার্থে বলা হয়, ‘মুসলমান-মুসলমান ভাই, মুসলিম উম্মাহ’-এ জাতীয় কত কথা! এভাবে এক শ্রেণীর মুসলমানরাই বঞ্চিত করছে আরেক মুসলমানকে, বঞ্চিত করছে দেশ ও সমাজকে। কিন্তু পরিণতিতে তারা নিজেরাও যে বঞ্চিত হচ্ছে সে-কথা স্মরণ রাখার সময়ও হয়তো তারা পান না। প্রাকৃতিক নিয়মে অন্যসব প্রাণীর মতোই তারা পৃথিবীতে আসেন। ত্যাগে, জগতের সাথে ভালোবাসা ও প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মধ্যে যে অপার আনন্দ রয়েছে, সেটি উপলব্ধি করার আগেই তারা পৃথিবী থেকে চলেও যান। মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ ও এর সার্থক পরিণতির মধ্যেকার আনন্দ কোনোদিনই পান না তারা। এ প্রসঙ্গে সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর অমূল্য বাণী হচ্ছে, ‘ভোগের আনন্দ সাময়িক, ত্যাগের আনন্দ চিরন্তন’।
প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই বাংলাদেশের মানুষদের সে কারণেই আজ জেগে উঠার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রের। উল্লেখ্য, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের ১৮ কার্তিক মোতাবেক ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত (যা আজও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ) রয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা - যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’। রাষ্ট্র, সরকার তথা সমাজের সর্বস্তরে দায়িত্বশীল সকলকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন হওয়ার ডাক এসেছে। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর অমর বাণী, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই তার স্বীয় কর্মবৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে’। সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হবেন, রাষ্ট্র ও সরকার সেখানে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে-বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল সময় রাষ্ট্রের এই ভূমিকা পালনের যে অভাবনীয় সুযোগ এনে দিয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার হবে-এটাই আজ বিবেকবান মানুষদের প্রত্যাশা।