বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬

সময়ের সাফ কথা.... ১৫ আগস্ট বাঙালির শেকড় সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করে

সময়ের সাফ কথা....

১৫ আগস্ট বাঙালির শেকড় সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করে
শেখ উল্লাস ॥ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এদেশের রাজনীতি ও সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের জন্য এক কালো অধ্যায়ের শুরু যা এখনও পরিপূর্ণভাবে মুছে যায়নি জাতীয় জীবন হতে। ১৯৭৫-সালের ১৫ই আগস্ট ভোর বেলায় বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর এদেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যমের কর্ণধাররা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও বলিষ্ঠ প্রতিরোধ আজও গড়ে তুলতে পারেননি এবং প্রতিবাদের দৃঢ় প্রত্যয়ী ভাষাও তারা সৃষ্টি করতে পারেননি। তৎকালে সবচাইতে প্রভাবশালী গণমাধ্যম বাংলাদেশ বেতারকে করা হয়েছিল পাকিস্তানী কায়দায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’, যেখান থেকে ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’ বলে ঘোষণার মধ্য দিয়ে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবরটি দাম্ভিকতার সাথে প্রচার করেছিল খুনী মোশতাক-ডালিম চক্র। বাঙালির যে মহান নেতার জীবন ও কর্মের সাথে এদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি ও সংবাদপত্রের সম্পর্ক ছিল এক সুতোয় গাঁথা, তাঁকে হত্যার পর সবাই ছিল নিশ্চুপ।
দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল সরকারি গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রের পাতায়। এখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের সময়ে যখন সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গণ-মাধ্যমগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নাম ও মর্যাদা যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব বজার রাখার জন্য কিন্তু সেখানে কতটুকু আন্তরিকতা আছে তা জনগণ ভালো করেই জানে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্ট-পরবর্তীতে দেশের কোনও পত্রিকা বা কোনও বৈদ্যুতিন মাধ্যম (অর্থাৎ, রেডিও, টিভি) বা কোনও সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলার সাহস কেউ দেখাতে পারেননি। কেন পারেননি তার কারণ খুঁজে বের করার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি? না-কি সেই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটিই মনে করতে হবে যা তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতার পর পর-‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’। বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ সম্মান দেখাতে গেলে তাঁর জীবনের প্রতিটি কথা থেকেই যে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে তা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র এক সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশের দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক ও চিন্তাবিদদের গ্রেফতার করে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি করা হয় আতঙ্ক। কোনো সংবাদপত্র কিংবা সাংবাদিকের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সংবাদ, সম্পাদকীয় বা প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়নি বরং সংবাদপত্রগুলোতে দেখা গেছে এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে অনেক লেখা হয়েছে বিশেষ সম্পাদকীয়। যারা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন হত্যাকাণ্ডের পর তারাই অনেকে প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে যারা নিজেদের মধ্যে ধারণ,  লালন ও পালন করতেন তাদেরকে কারাবরণ করতে হয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যে জাতীয় ৪ নেতাকে কারাগারে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে দেখা যায়, একদিকে দেশ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, অপরদিকে কতিপয় রাজনীতিকের দেশপ্রেম ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের অনুপম উদাহরণ তৈরি হয়েছে ১৫ই আগস্টকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারই নামে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান এই চার নেতাকে জেলখানায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু ও বাংলার জনগণের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের জন্য। আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন কিছু রাজনীতিকদের মধ্যে যে চরম বিশ্বাসঘাতকতা লক্ষ্য করা গেছে তা একজন বিবেকবান বাঙালি কোনোদিনই মেনে নিতে পারেনি এবং আজও পারছে না। সে সময়ের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা ও চরম কপটতা ও কাপুরুষতার এক জঘন্য উদাহরণ হয়েই থাকবে।
আধিপত্যবাদী এদেশীয় এজেন্টদের চোখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তাঁর নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি কেউ বাংলদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে। বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না। (তথ্যসূত্র: এই দেশ এই মাটি প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান - বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-১৬৫) তারপর একদিকে চলতে থাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ, অপরদিকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ৭৫-এর ১৫ই আগস্টের সেই কালো রাতে। এর অব্যবহিত পরবর্তী প্রায় ৩০ বছরের পরিস্থিতি তাই বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনীতিক ও সংবাদপত্রের জন্য এক অসহনীয় কলংকিত অধ্যায় যা জাতিকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে বার বার।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের সাথে যে দৈনিক ইত্তেফাক এর সম্পর্ক ছিল সবচাইতে নিবিড়,  ১৫ আগস্টের ভোরবেলায় রক্তাক্ত ঘটনার পর পত্রিকাটির বক্তব্য ও ভূমিকা পাল্টে যায় আশ্চর্যজনকভাবে। ১৫ই আগস্ট সংখ্যায় ওইদিন বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের খবর দুই কলাম শিরোনামে ‘লীড’ করা হয়। চ্যান্সেলর হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ওইটিই ছিল প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন। খবরটিতে পরিদর্শনের বিস্তারিত সূচীও প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে বঙ্গবন্ধুসহ তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, ডাকসুর ভিপি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রবন্ধে, নিবন্ধে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, সমাজতান্ত্রিক কাঠামোয় গড়ে তোলার আশা-আকাক্সক্ষা প্রত্যয় ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু ১৬ আগস্টের ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ ॥ সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা ॥ খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ।’ প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শীর্ষক বিশেষ সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে গতকাল প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন এবং এক ভাব-গম্ভীর অথচ অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তাঁহার নতুন সরকারের প্রতি স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর অধিনায়কগণ তাঁহাদের স্ব-স্ব বাহিনীর পক্ষ হইতে অবিচল আস্থা ও আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছেন।’
ওইদিন পূর্ণ দুই কলাম জুড়ে এই সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নামটিও উল্লেখ করা হয়নি।
‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ’ শীর্ষক শিরোনামে বাসস-এর একটি খবর : ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল শুক্রবার সকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন। শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন বলিয়া ঘোষণা করা হয়।’
‘উপ-রাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’ শীর্ষক খবর : ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ গতকাল উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনাব মুহম্মদুল্লাহ্, মন্ত্রিপরিষদের ১০ জন সদস্য ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করিয়াছেন।’ বাসস-এর খবরে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি গতকাল বিকালে বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে নয়া উপ-রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের শপথ করান।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ হইতেছেন - ‘বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, জনাব ফণী মজুমদার, জনাব মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, জনাব আবদুল মান্নান, জনাব মনোরঞ্জন ধর, জনাব আবদুল মমিন, জনাব আসাদুজ্জামান খান, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক ও ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী।
প্রতিমন্ত্রীগণ হইতেছেন - শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও জনাব কে এম ওবায়দুর রহমান।’ উল্লেখ্য যে, এসব মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সবাই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
অপরদিকে, ১৭ আগস্ট ‘খন্দকার মোশতাকের জীবনালেখ্য’ শিরোনামে ইত্তেফাক লিখেছিল: ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯৪২ সাল হইতে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রগতিশীল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের দায়ে বিভিন্ন সময়ে মোট ৭ বৎসরেরও অধিককাল তিনি কারাবরণ করেন। তাহার বর্তমান বয়স ৫৬ বৎসর। খন্দকার মোশতাক ১৯১৯ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির দশপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাহার পিতা-মাতার চতুর্থ পুত্র।
তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি প্রথমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ দফতরের মন্ত্রী এবং পরে বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন।’ (সংক্ষিপ্ত)
১৭ আগস্ট ইত্তেফাকে ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ উদার মানবতার দৃষ্টিতে বিশ্বাসী আর এজন্যই সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কাহারও প্রতি শত্রুতা নয় এই মহান আদর্শের কথা নতুন সরকার ঘোষণা করিয়াছেন। শান্তি যেমন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য তেমনি বিশ্বের যেখানে অন্যায়, অবিচার সেখানেই তার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদও হইবে উচ্চকণ্ঠ।’
১৮ আগস্ট ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় নিজস্ব কয়েকটি রিপোর্টের শিরোনাম- ‘সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করুন : রাষ্ট্রপতি (৮ কলামের ব্যানার) ‘সর্বত্র উৎসাহব্যঞ্জক তৎপরতা’, নয়া সরকারের প্রতি সকল মহলের সমর্থন, ‘বাংলাদেশে পরিবর্তন বিদেশে ব্যাপকভাবে আদৃত’। ১৯ আগস্ট - ‘সর্বস্তরে স্বাভাবিক কাজ শুরু’, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে পূর্ণ কর্মতৎপরতা, সর্বত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুনরায় ক্লাশ চালু,’ ‘কুয়েত বাংলাদেশের জনগণের সমৃদ্ধি কামনা করিয়াছে।’
দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৭৫-এর ২৪ আগস্ট ‘দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জন গ্রেফতার’ শীর্ষক ৬ কলাম শিরোনামের সংবাদ : ‘দুর্নীতি, সমাজবিরোধী তৎপরতা, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তি হস্তগত করার অভিযোগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব কোরবান আলী, জনাব আবদুস সামাদ আজাদ এবং কয়েকজন এমপিসহ মোট ২৬ জনকে গতকাল (শনিবার) গ্রেফতার করা হইয়াছে। গত রাত্রে জনৈক সরকারী মুখপাত্র জানান যে, দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী তৎপরতার মাধ্যমে আয়ের জ্ঞাতসূত্রের সহিত সামঞ্জস্যবিহীন বিপুল সম্পদ অর্জন এবং গর্হিত পন্থা স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পত্তি কব্জাগত করার অভিযোগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় ব্যক্তিদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে।’
২৫ আগস্টের ইত্তেফাকে ‘জেনারেল জিয়াউর রহমান চীফ অফ আর্মী স্টাফ’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, ‘মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, পিএসসিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অফ আর্মী স্টাফ পদে নিয়োগ করা হইয়াছে। তিনি মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম, পিএসসির স্থলাভিষিক্ত হইবেন।
মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর চাকরী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে ন্যস্ত করা হইয়াছে। বর্তমানে ভারতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদ পিএসসিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দান করিয়া তাঁহাকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্থলে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ করা হইয়াছে।’ ওইদিন ‘যাদুমিয়া ও অলি আহাদের মুক্তিলাভ’ শীর্ষক সংবাদ- ‘গত রাত্রে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে দুইজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা জনাব মশিহুর রহমান (যাদুমিয়া) ও জনাব অলি আহাদকে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে। ১৯৭৪ সালের ৩০শে জুন তাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছিল।’
১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট পত্রিকাটিতে ‘ইত্তেফাক ও সংবাদ মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ’ এর খবর প্রকাশিত হয় এবং ২৪ আগস্ট থেকে প্রিন্টার্স লাইনে ইত্তেফাক সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি হিসেবে মইনুল হোসেন এবং সম্পাদক হিসেবে আনোয়ার হোসেনের নাম ছাপা হয়। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল নূরুল ইসলাম পাটোয়ারীর।
২৬ আগস্টের ইত্তেফাক-এ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির পাশাপাশি মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি (ছবিসহ) প্রকাশিত হয়।
৩১ আগস্ট ‘রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ’ শীর্ষক ৫ কলাম-এর সংবাদ : ‘প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ গতকাল (শনিবার) জারিকৃত এক অর্ডিন্যান্স বলে কোন রাজনৈতিক দল গঠন, সংগঠন, প্রতিষ্ঠা বা আয়োজন অথবা উহার সদস্য হওয়া অথবা অন্যভাবে উহার তৎপরতায় শরিক হওয়া অথবা কোনভাবে উহার সহিত সংশ্লিষ্ট থাকা নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন।
সরকারী হ্যান্ডআউটের বরাত দিয়া বাসস জানান, এই বিধান লঙ্ঘন করিলে ৭ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- অথবা জরিমানা অথবা উভয়বিধ দণ্ড দেওয়া যাইতে পারে।’
২১ আগস্ট ‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ’ সংবিধানের আংশিক সংশোধন ॥ পার্লামেন্ট অব্যাহত ॥ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অপরিবর্তিত’ শীর্ষক ব্যানার শিরোনামের খবর : ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ গতকাল তাহার জারিকৃত এক ঘোষণাবলে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। রাষ্ট্রপতি এই ঘোষণা এবং সামরিক বিধি ও আদেশসাপেক্ষে দেশের সংবিধানের কার্যকারিতা বলবৎ রাখিয়াছেন।
রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময়ে সামরিক আইনের বিধি প্রণয়ন এবং যে কোন অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনাল গঠন করিয়া আদেশ জারি করিতে পারিবেন বলিয়া ঘোষণায় ব্যবস্থা করা হইয়াছে। একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন, এই ঘোষণা বলে সংবিধানের ৪৮, ৫৫ ও ৪৫ নম্বর ধারা সংশোধন করা হইয়াছে। তিনি বলেন, সংবিধান বাতিল করা হয় নাই এবং ৪টি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি অক্ষুন্ন থাকিবে। সংসদও বাতিল করা হয় নাই।’

এভাবে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরই বোঝা গিয়েছিল কারা এই হত্যাকাণ্ডের সুফলভোগী। যে দল মাত্র বছর কয়েক আগে একটা সফল স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, যে দলের সুদৃঢ় রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল এদেশের প্রতিটি পাড়া, মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জ-শহরে সে দলের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে কেন সংগঠিত কোনও মিছিল বের হয়নি সে প্রশ্ন আজও তাড়িয়ে বেড়ায় এদেশের বিবেকবান জনগোষ্ঠীকে। কারণ, বঙ্গবন্ধু সারাজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম-জেল-জুলুম সহ্য করে জনগণের অকুন্ঠ সমর্থন ও ভালবাসা নিয়ে আমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পর সরকারের সুবিধাভোগী অংশ ও সারা দেশের রাজনীতিকদের নিস্ক্রিয়তা এবং গণমাধ্যমগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থান আজও জাতিকে পীড়া দেয়। তাই বর্তমান সরকারের ও দলের মধ্যে এখনো ঘাপটি মেরে থাকা চোর, চাটুকার, ষড়যন্ত্রকারী ও লুটেরাদের সম্পর্কে সজাগ থেকে যথাযথ কর্মপন্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন