বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে চলাই হোক আগস্টের অঙ্গীকার

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে

এগিয়ে চলাই হোক আগস্টের অঙ্গীকার


সংলাপ ॥ ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টের পর থেকে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাঙালি শোক করছে কিন্তু শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগের কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার শোককে ত্যাগের মহিমায় রূপান্তর করতে সাধক কবি নজরুল আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগে বলেছিলেন, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা, ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’। অভিধানে ‘মর্সিয়া’ শব্দটির অর্থ এক ধরনের বিলাপ যা মহররম মাসে কারবালার প্রান্তরে শাহাদাৎবরণকারী নবী-দৌহিত্র ইমাম হেসেন (রাঃ)-এর স্মরণে গাওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার এত বছর পর দেশে আজ সার্বিক ক্ষেত্রে যে অবস্থা তাতে কবি নজরুলের ‘ত্যাগ চাই’- আহ্বানটির বাস্তবায়নই বেশি উপলব্ধি করছে জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সারা জীবনের রাজনীতি ছিল ত্যাগের। সাধক কবি নজরুলকে পরম শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন বলেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সুযোগ পেয়েই বঙ্গবন্ধু তাঁকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্ব-উদ্যোগে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে সেখানে তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে কবিকে বাংলাদেশের মাটিতে নিয়ে আসার উদ্যোগকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন। চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, পারস্পরিক ভক্তি-শ্রদ্ধা, মানবিকতা, দেশপ্রেম, বাঙালি জাত্যাভিমান এবং সর্বোপরি মানবতার মহান ব্রতে নিয়োজিত হয়ে এই দুই মহান পুরুষ তাঁদের জীবনে ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা আজকের দিনেও এদেশের জনগণের এবং তাঁদের নেতৃত্বের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় ও দিক-নির্দেশনা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি ও নির্দেশনা দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাইনা, আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই’। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য যা তাঁর বিভিন্ন সময়ে দেয়া ভাষণে স্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করে গেছেন। আদর্শগতভাবে এবং কর্মের মাধ্যমে এদেশের কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য যখনই তিনি কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই তাঁকে হত্যা করলো স্বাধীনতা বিরোধী তথা গণবিরোধী শক্তি!
সেই ১৫ই আগষ্ট এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই শোক দিবসে কালো ব্যাজ ধারণ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের গান শোনা, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, কাঙালী ভোজের আয়োজন ইত্যাদি বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা তখনই সার্থকতা পেতে পারে যখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তাঁর দেশের বিশেষ করে তাঁর দলের প্রতিটি নেতা-কর্মী, সমর্থক ও তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিটি নাগরিক তাদের নিজেদের জীবনে ধারণ করবে। অথচ দুঃখজনক হলেও একথা আজ সত্য যে, তাঁর আদর্শকে ধারণ করে এরকম নেতা-কর্মীর সংখ্যা এখন ক’জন পাওয়া যাবে? ত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন, দেশের কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ বলে ভাবছে এবং তাদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে রাজনীতি করছে এমন নেতা-কর্মীর সংখ্যা যে এখন নিদারুণভাবে কমে যাচ্ছে অথবা তাদের প্রয়োজন গৌণ হয়ে পড়েছে যা দেশের সার্বিক উন্নতির পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধুর নামে অনুষ্ঠান, ব্যানার-ফেষ্টুন তৈরি করে লোক-দেখানো বঙ্গবন্ধু-দরদী সাজা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হওয়া এবং তাঁর আদর্শকে ধারণ, লালন ও পালন করে দেশকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করা যায় না তা বোধ হয় এখন জরুরি ভিত্তিতে ভেবে দেখার সময় এসেছে। আর তা না হলে দেশের উন্নতি স্থিত হয়ে পড়বে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় তাঁর দেয়া ভাষণগুলোর যে কোনোটির দিকে তাকালে তাঁর আদর্শ কী ছিল তা বুঝতে কোন কষ্ট হয় না সাধারণ মানুষের। কৃষক-শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করেনা। করাপশন আমার বাংলার মজদুররা করেনা। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ’। দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের প্রতি শিক্ষিতদের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে। আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে কে? ডাক্তারি পাস করায় কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করায় কে? বৈজ্ঞানিক করে কে? অফিসার করে কে?-বাংলার দুঃখী জনগণের টাকা’।

বঙ্গবন্ধুর রক্তঋণে অর্জিত এই দেশ আজ রাজনীতি, ব্যবসা ও আমলাতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে একটি অতি সুবিধাভোগী রাজনীতিকদের হাতে যেভাবে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে, তাতে বিশাল জনগোষ্ঠীকে বঞ্চনা ও উপহাসের পাত্র করে তোলা হচ্ছে। তাই আর সময় নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শকে যারা ধারণ করে না তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত দল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার এখনই সময়। বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে জাতিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দূরদর্শী কার্যক্রম গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন