মন বলে কিছু নেই
সিদ্ধার্থ ॥ ৪০ কেজিতে এক মন, এতদতিরিক্ত মন সম্পর্কে এখন
পর্যন্ত যা বলা হয়েছে তা গ্রহণীয় নয়। বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে মন শব্দের
অর্থে লিখা হয়েছে - চিত্ত, অন্তরিন্দ্রিয়, হৃদয়, স্মৃতি, স্মরণ, বোধ, ইচ্ছা, প্রবৃত্তি,
নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, পছন্দ, অভিনিবেশ, একাগ্রতা, আকাঙ্খা, সংকল্প ইত্যাদি। উল্লিখিত
প্রত্যেকটি শব্দের পৃথক পৃথক অর্থ, উৎপত্তি স্থল, সংজ্ঞা ও তাৎপর্য আছে। যে শব্দের
ভিন্ন অর্থ, ভিন্ন উৎপত্তি স্থল ও সংজ্ঞা রয়েছে সে শব্দ দিয়ে অন্য কোন শব্দের অর্থ
কিংবা সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায় না। সুতরাং মন শব্দের আভিধানিক অর্থ অগ্রহণীয়।
মন আবিষ্কার করেছেন - ফ্রয়েড, ইয়ুং, আডলার কিন্তু বাস্তবে
মনের কোন অস্তিত্ব নেই। ফ্রয়েডের বিশ্ব ব্যাপী প্রচার প্রমাণ করে না যে তিনি সঠিক।
ফ্রয়েড একজন ফ্রড। যে মন নিয়ে আমরা এতো কথা বলি, বুঝার চেষ্টা করি, পরিবর্তন করার চেষ্টা
করি, সুখী করার চেষ্টা করি, নিরুদ্বিগ্ন করার চেষ্টা করি, সে মনটি কোথায় থাকে তা কি
আমরা জানি? কোন মনোবিজ্ঞানী কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞানী কি আছেন যিনি মন দেখাতে পারেন?
মন সম্পর্কে আমরা যা জানি তার সবকিছুই গ্রন্থগত, কথার কথা মাত্র। আমরা বইয়ে পড়েছি যে
নানা রকমের মন আছে - চেতন, অবচেতন, অচেতন, মহাচেতন ইত্যাদি নানা রকম মনের ব্যাখ্যা,
সংজ্ঞা পড়েছি কিন্তু নিজের মধ্যে চেতন, অচেতন, মহাচেতন কোন মনকেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
বইয়ের কথাগুলোকে বাদ দিলে মন সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব না। কারণ মন বলতে কিছু নেই। নিজের
মধ্যে খুঁজে কোথাও মন পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হলো চিন্তা।
চিন্তার স্থিতিতেই
চৈতণ্য প্রাপ্তি ঘটে
দর্শন, শ্রবন, ঘ্রাণ, স্পর্শ, স্বাদ এবং দেহাভ্যন্তরের স্মৃতি,
অনুভূতি থেকে উৎপন্ন বিষয়, উক্ত বিষয়ের পুনরুদ্ভাবন বা পুনরুদ্ভাবিত বিষয়ের পুনর্বিন্যাস
বা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে নতুন ধারণার উদ্ভাবনকে চিন্তা বলে। জীবনের স্থাপনায় চিন্তা
সুপ্ত। জন্মের সাথে সাথে চিন্তারও জন্ম হয় কিন্তু চিন্তার ভাষা থাকে না। চিন্তা বস্তু
জগতের প্রতিরূপ। স্মৃতিচারণ, পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে নতুন উপকরণ সহযোগে নতুন সিদ্ধান্তে
পৌঁছানো, যুক্তি, বিচার-বিবেচনা, কল্পনা, দিবাস্বপ্ন ইত্যাদি চিন্তার প্রকার। ক্ষেত্র
বিশেষে চিন্তা - আধ্যাত্মিক, বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও ব্যবহারিক হতে পারে।
স্মৃতিচারণ চিন্তার একটি প্রধান বিভাগ। মানুষ অর্থ-বিত্ত,
সহায়-সম্বল, আশ্রয়-নিরাপত্তা, স্ত্রী-পুত্র সব ত্যাগ করতে পারে কিন্তু স্মৃতি ত্যাগ
করতে পারে না। স্মৃতি জীবনের চক্রে আবদ্ধ। অধিকাংশ মানুষই জানে না স্মৃতি কোথায় থাকে।
মস্তিষ্কের নিউরন স্মৃতিকে ধারণ করে কিন্তু নিউরনকে ব্যবচ্ছেদ করে স্মৃতি পাওয়া যায়
না। আইনষ্টাইনের নিউরন এবং এবং একজন ইলেকট্রিশিয়ানের নিউরনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
কল্পনাও চিন্তারই একটা রূপ। চিন্তাকে অডিও ধরা হলে কল্পনা
হচ্ছে ভিডিও। কল্পনায় মানস ছবি দেখা যায়, শোনা যায়, অনুভব করা যায়, ঘ্রাণ নেয়া যায়
এমনকি স্বাদও নেয়া যায়। তেঁতুলের স্বাদকে কল্পনায় প্রকট করলে জিহ্বায় লালা আসে। কল্পনা
অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতো। কল্পনা সৃজনশীল বাস্তবতা সৃষ্টি করতে পারে আবার কল্পনা প্রবণতা
বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার পথে অন্তরায়ও সৃষ্টি করে। আকাশ কুসুম কল্পনাকে বলা হয় দিবাস্বপ্ন।
মানুষের অনুভূতিও এক প্রকারের চিন্তা। মানুষ যখন নিজেকে
সুখী ভাবে তখন সুখের সংবেদনকে চিন্তার পরিধিতে আবদ্ধ করে। চিন্তা ব্যতীত বিশুদ্ধ অনুভূতি
বিরল। আমরা বলে থাকি অনুভূতি চিন্তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চিন্তা ছাড়া অনুভব করতে
আমরা অক্ষম।
মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ প্রবাহ ও চিন্তার মধ্যে সংযোগ আছে। গামা,
বিটা, আলফা, থিটা, ডেল্টা মস্তিষ্ক তরঙ্গে চিন্তার ধরণ বিভিন্ন হয়। হালকা ঘুম এবং গভীর
ঘুমের মধ্যেও চিন্তা থাকে এবং চিন্তার একরৈখিকতাও বজায় রাখা যায়। ড্রাগ ও মাদক মস্তিষ্কের
বিদ্যুৎপ্রবাহে পরিবর্তন ঘটায় এবং চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
মানুষ সারাদিন চিন্তা করে। চিন্তা হচ্ছে নীরবে কথা বলা।
কথা হচ্ছে সরবে চিন্তা করা। যারা সারাদিন সরবে চিন্তা করে তারা পাগলা গারদের ভেতরে
এবং যারা সারাদিন নীরবে কথা বলে তারা গারদের বাহিরে অবস্থান করে। প্রকাশ মাত্রা ব্যতীত
উভয়ের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। সুচিন্তা ও কুচিন্তা বলে কিছু নেই। সু এবং কু এর
ধারণাও চিন্তাপ্রসূত। সুখ-দুঃখ, আসক্তি-অনাসক্তি, আশা-হতাশা ইত্যাদি সবকিছুই চিন্তার
সৃষ্টি। চিন্তাই জীবন। নিজেকে জানা মানে চিন্তাকে জানা। যে চিন্তা বার বার ফিরে আসে
তা-ই ব্যক্তির প্রকৃতি। যে যেমন চিন্তা করে সে তেমন হয়ে যায়। চিন্তা বদলে ফেললে জীবন
বদলে যায়।
চিন্তা সময়ের সৃষ্টি করে। চিন্তার সময় - অতীত ও ভবিষ্যতে
বিভক্ত। স্মৃতি অতীত নির্ভর। কল্পনা ভবিষ্যত নির্ভর। চিন্তায় বর্তমান নেই। বর্তমানে
সংবেদন আছে। সংবেদন চিন্তা নয়। চিন্তা - সংবেদনের পুনরুদ্ভাবন। আমাদের ধারণা - প্রেমাস্পদের
চিন্তাই প্রেম। কিন্তু স্মৃতির পুনরুদ্ভাবন প্রেম নয়। প্রেম চিন্তা মুক্ত অবস্থা। পরস্পরকে
বুঝা তখনই সম্ভব যখন বর্তমানে থাকা যায়।
মানুষের সকল সমস্যার মূলেও রয়েছে চিন্তা। চিন্তা সমস্যা
ছাড়া থাকতে পারে না। তাই কোন সমস্যা না থাকলে চিন্তা প্রথমে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং
তারপর তা সমাধানের চেষ্টা করে। চিন্তা সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। চিন্তার মাধ্যমে
যে সমাধান পাওয়া যায় তা থেকে আরো দশটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ চিন্তা নিজেই সমস্যা।
চিন্তা মানুষের নিজস্ব নয়। এমন কোন চিন্তা নেই যাকে নিজস্ব
চিন্তা বলে দাবী করা যায়। চিন্তা ভিতর থেকে আসে না, আসে বাহির থেকে। কেউ যদি এক চিন্তাকে
ধরে রাখতে চায় তবে তার স্থায়িত্ব বেশি হলে ২মিনিট। কথায় বলে - মানুষের চিন্তা কুমারের
পাক পলকে দেয় আঠারো পাক। চিন্তা আসে এবং যায়। কিন্তু আমরা যেমন ছিলাম তেমনি থাকি। চিন্তা
আমাদের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু আমরা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা ইচ্ছা
করলেই চিন্তা থামাতে পারি না। সে তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। মানুষ নিজের চিন্তাকেই
নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অথচ জগতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তাই জগতের এ হাল।
মানুষের সব চিন্তাই আত্মরক্ষামূলক। তাই প্রকৃতিগতভাবে যা
কিছুই মানুষের চিন্তা থেকে উৎপন্ন হয় তা ধ্বংসাত্মক। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক,
দার্শনিক ইত্যাদি যে কোন ধরনের চিন্তার ফলশ্রুতি ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। চিন্তা সব সময়
নিজেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত থাকে তাই নিজের চারিদিকে বিভিন্ন রকমের দুর্গ গড়ে তুলে। পরিবার,
সমাজ, রাষ্ট্র, জাতিয়তা ইত্যাদি সবকিছুই মানুষ সৃষ্টি করেছে নিজেকে রক্ষা করার জন্য,
যা চিন্তারই ফসল।
প্রতিটি চিন্তারই রয়েছে জন্ম মৃত্যু। একই চিন্তা বারবার
ফিরে আসে নবরূপে। গরু জীবনের প্রয়োজনে খাদ্য জাবর কাটে কিন্তু মানুষ অপ্রয়োজনে চিন্তার
জাবর কাটে। চিন্তা নিজেই নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে। একটা চিন্তার জন্ম হয় একটু পরেই তার
মৃত্যু হয়, আবার তার জন্ম হয় আবার তার মৃত্যু হয়। চিন্তার এই জন্ম মৃত্যু চলতে থাকে
অবিরাম। যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়।
যে চিন্তা আমরা করতে চাই না কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে আসে তাকে দুঃশ্চিন্তা বলা
হয়। দুঃচিন্তা লক্ষ্যহীন, বিশৃঙ্খল ও নিষ্ক্রিয়।
মানুষের মস্তিষ্ক সৃষ্টিশীল নয়। মস্তিষ্ক শুধু প্রতিক্রিয়া
করে। চিন্তা কোন কিছু বুঝার মাধ্যম নয় কিন্তু চিন্তা ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমও নাই যা
দিয়ে আমরা বুঝতে পারি। মানুষ চিন্তাকে ব্যবহার করে কিছু একটা ফলাফল পাবার জন্য, কিছু
একটা হবার জন্য। চিন্তা যা যেমন আছে তাকে তেমন ভাবে গ্রহণ করতে পারে না।
শিশুর চিন্তা নেই বলে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। মানুষ যখন যৌক্তিক
ভাবে চিন্তা করতে শেখে, তখন তার বৃদ্ধিও থেমে যায়। পৃথিবীর বিশিষ্ট চিন্তাবিদেরা বিশেষভাবে
রুক্ষ, বদমেজাজি, অসন্তুষ্ট এবং জীবনের প্রতি বিরক্ত। জাপানীদের ধারণা চিন্তা মানুষের
পেটে থাকে। তাই বিশিষ্ট চিন্দাবিদদের ভুরি মোটা হয়। পশু, পাখী, জীব জন্তু সবাই আনন্দে
আছে কারণ তারা মানুষের মতো চিন্তা করে না।
মানুষ চিন্তাকে ব্যবহার করে প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছে। গ্রহ
থেকে গ্রহান্তরে পাড়ি জমিয়েছে মানুষের তৈরি নভোযান। আমরা ঘরে বসেই জানতে পারছি কি ঘটছে
চাঁদ, মঙ্গল বা বৃহস্পতিতে কিন্তু জানতে পারি না আমার পাশে বসা মানুষটি কি চিন্তা করছে।
চিন্তার জগতে মানুষ একা।
চিন্তা আমাদের মধ্যে চিন্তা থেকে মুক্ত হবার চিন্তা জন্ম
দেয়। কিভাবে আমরা চিন্তা থেকে মুক্ত হবো? চিন্তার মাধ্যমে কি চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া
সম্ভব? কুকুর কি দৌড়িয়ে তার নিজের লেজকে অতিক্রম করতে পারবে? আমি কি আমার ছায়াকে পেছনে
ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো? মানুষ কি চিন্তা করে, কেন কেন চিন্তা করে, কিভাবে চিন্তা
মুক্ত হওয়া যায় এসবও চিন্তারই বস্তু। চিন্তা মুক্তির যে সব পদ্ধতি প্রচারিত হয়েছে তার
সব চিন্তারই ফসল। চিন্তা সম্পর্কে চিন্তা করা যায় না তাও চিন্তার বিষয় বটে।
গ্রহণ-বর্জনের রূপান্তরে চিন্তার রূপান্তর ঘটে। চিন্তা নিয়ন্ত্রণ
বলতে লক্ষ্য কেন্দ্রিক চিন্তা করা, চিন্তাকে একরৈখিক করা বুঝায়। একচিন্তা, অবলোকন,
শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি সতর্কতা, স্মরণ ইত্যাদি পদ্ধতিতে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা
যায়। 'আমি' চিন্তা নয়। চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে 'কি চিন্তা চলছে' - 'আমি' তা দেখতে পারে।
ফলে চিন্তা কমতে কমতে এক এ স্থিতি লাভ করে। এক এ স্থিতি লাভ করলেই চিন্তা মহাশক্তি।
বস্তু যত সূক্ষ্ম, তার শক্তিও তত বেশি। এক চিন্তা শক্তি বিশ্বকেও প্রভাবিত করে, কারণ
চিন্তা মূলত এক, ব্যক্তি বিশেষে অনেক। চিন্তার মহাশক্তি জগতের রূপান্তর সাধনে সক্ষম।
চিন্তার স্থিতিতেই চৈতণ্য প্রাপ্তি ঘটে।