শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৪

মন বলে কিছু নেই

মন বলে কিছু নেই

সিদ্ধার্থ ॥ ৪০ কেজিতে এক মন, এতদতিরিক্ত মন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যা বলা হয়েছে তা গ্রহণীয় নয়। বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে মন শব্দের অর্থে লিখা হয়েছে - চিত্ত, অন্তরিন্দ্রিয়, হৃদয়, স্মৃতি, স্মরণ, বোধ, ইচ্ছা, প্রবৃত্তি, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, পছন্দ, অভিনিবেশ, একাগ্রতা, আকাঙ্খা, সংকল্প ইত্যাদি। উল্লিখিত প্রত্যেকটি শব্দের পৃথক পৃথক অর্থ, উৎপত্তি স্থল, সংজ্ঞা ও তাৎপর্য আছে। যে শব্দের ভিন্ন অর্থ, ভিন্ন উৎপত্তি স্থল ও সংজ্ঞা রয়েছে সে শব্দ দিয়ে অন্য কোন শব্দের অর্থ কিংবা সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায় না। সুতরাং মন শব্দের আভিধানিক অর্থ অগ্রহণীয়।
মন আবিষ্কার করেছেন - ফ্রয়েড, ইয়ুং, আডলার কিন্তু বাস্তবে মনের কোন অস্তিত্ব নেই। ফ্রয়েডের বিশ্ব ব্যাপী প্রচার প্রমাণ করে না যে তিনি সঠিক। ফ্রয়েড একজন ফ্রড। যে মন নিয়ে আমরা এতো কথা বলি, বুঝার চেষ্টা করি, পরিবর্তন করার চেষ্টা করি, সুখী করার চেষ্টা করি, নিরুদ্বিগ্ন করার চেষ্টা করি, সে মনটি কোথায় থাকে তা কি আমরা জানি? কোন মনোবিজ্ঞানী কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞানী কি আছেন যিনি মন দেখাতে পারেন? মন সম্পর্কে আমরা যা জানি তার সবকিছুই গ্রন্থগত, কথার কথা মাত্র। আমরা বইয়ে পড়েছি যে নানা রকমের মন আছে - চেতন, অবচেতন, অচেতন, মহাচেতন ইত্যাদি নানা রকম মনের ব্যাখ্যা, সংজ্ঞা পড়েছি কিন্তু নিজের মধ্যে চেতন, অচেতন, মহাচেতন কোন মনকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। বইয়ের কথাগুলোকে বাদ দিলে মন সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব না। কারণ মন বলতে কিছু নেই। নিজের মধ্যে খুঁজে কোথাও মন পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হলো চিন্তা।

চিন্তার স্থিতিতেই চৈতণ্য প্রাপ্তি ঘটে

দর্শন, শ্রবন, ঘ্রাণ, স্পর্শ, স্বাদ এবং দেহাভ্যন্তরের স্মৃতি, অনুভূতি থেকে উৎপন্ন বিষয়, উক্ত বিষয়ের পুনরুদ্ভাবন বা পুনরুদ্ভাবিত বিষয়ের পুনর্বিন্যাস বা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে নতুন ধারণার উদ্ভাবনকে চিন্তা বলে। জীবনের স্থাপনায় চিন্তা সুপ্ত। জন্মের সাথে সাথে চিন্তারও জন্ম হয় কিন্তু চিন্তার ভাষা থাকে না। চিন্তা বস্তু জগতের প্রতিরূপ। স্মৃতিচারণ, পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে নতুন উপকরণ সহযোগে নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, যুক্তি, বিচার-বিবেচনা, কল্পনা, দিবাস্বপ্ন ইত্যাদি চিন্তার প্রকার। ক্ষেত্র বিশেষে চিন্তা - আধ্যাত্মিক, বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও ব্যবহারিক হতে পারে।
স্মৃতিচারণ চিন্তার একটি প্রধান বিভাগ। মানুষ অর্থ-বিত্ত, সহায়-সম্বল, আশ্রয়-নিরাপত্তা, স্ত্রী-পুত্র সব ত্যাগ করতে পারে কিন্তু স্মৃতি ত্যাগ করতে পারে না। স্মৃতি জীবনের চক্রে আবদ্ধ। অধিকাংশ মানুষই জানে না স্মৃতি কোথায় থাকে। মস্তিষ্কের নিউরন স্মৃতিকে ধারণ করে কিন্তু নিউরনকে ব্যবচ্ছেদ করে স্মৃতি পাওয়া যায় না। আইনষ্টাইনের নিউরন এবং এবং একজন ইলেকট্রিশিয়ানের নিউরনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
কল্পনাও চিন্তারই একটা রূপ। চিন্তাকে অডিও ধরা হলে কল্পনা হচ্ছে ভিডিও। কল্পনায় মানস ছবি দেখা যায়, শোনা যায়, অনুভব করা যায়, ঘ্রাণ নেয়া যায় এমনকি স্বাদও নেয়া যায়। তেঁতুলের স্বাদকে কল্পনায় প্রকট করলে জিহ্বায় লালা আসে। কল্পনা অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতো। কল্পনা সৃজনশীল বাস্তবতা সৃষ্টি করতে পারে আবার কল্পনা প্রবণতা বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার পথে অন্তরায়ও সৃষ্টি করে। আকাশ কুসুম কল্পনাকে বলা হয় দিবাস্বপ্ন।
মানুষের অনুভূতিও এক প্রকারের চিন্তা। মানুষ যখন নিজেকে সুখী ভাবে তখন সুখের সংবেদনকে চিন্তার পরিধিতে আবদ্ধ করে। চিন্তা ব্যতীত বিশুদ্ধ অনুভূতি বিরল। আমরা বলে থাকি অনুভূতি চিন্তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চিন্তা ছাড়া অনুভব করতে আমরা অক্ষম।
মস্তিষ্কের বিদ্যুৎ প্রবাহ ও চিন্তার মধ্যে সংযোগ আছে। গামা, বিটা, আলফা, থিটা, ডেল্টা মস্তিষ্ক তরঙ্গে চিন্তার ধরণ বিভিন্ন হয়। হালকা ঘুম এবং গভীর ঘুমের মধ্যেও চিন্তা থাকে এবং চিন্তার একরৈখিকতাও বজায় রাখা যায়। ড্রাগ ও মাদক মস্তিষ্কের বিদ্যুৎপ্রবাহে পরিবর্তন ঘটায় এবং চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
মানুষ সারাদিন চিন্তা করে। চিন্তা হচ্ছে নীরবে কথা বলা। কথা হচ্ছে সরবে চিন্তা করা। যারা সারাদিন সরবে চিন্তা করে তারা পাগলা গারদের ভেতরে এবং যারা সারাদিন নীরবে কথা বলে তারা গারদের বাহিরে অবস্থান করে। প্রকাশ মাত্রা ব্যতীত উভয়ের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। সুচিন্তা ও কুচিন্তা বলে কিছু নেই। সু এবং কু এর ধারণাও চিন্তাপ্রসূত। সুখ-দুঃখ, আসক্তি-অনাসক্তি, আশা-হতাশা ইত্যাদি সবকিছুই চিন্তার সৃষ্টি। চিন্তাই জীবন। নিজেকে জানা মানে চিন্তাকে জানা। যে চিন্তা বার বার ফিরে আসে তা-ই ব্যক্তির প্রকৃতি। যে যেমন চিন্তা করে সে তেমন হয়ে যায়। চিন্তা বদলে ফেললে জীবন বদলে যায়।
চিন্তা সময়ের সৃষ্টি করে। চিন্তার সময় - অতীত ও ভবিষ্যতে বিভক্ত। স্মৃতি অতীত নির্ভর। কল্পনা ভবিষ্যত নির্ভর। চিন্তায় বর্তমান নেই। বর্তমানে সংবেদন আছে। সংবেদন চিন্তা নয়। চিন্তা - সংবেদনের পুনরুদ্ভাবন। আমাদের ধারণা - প্রেমাস্পদের চিন্তাই প্রেম। কিন্তু স্মৃতির পুনরুদ্ভাবন প্রেম নয়। প্রেম চিন্তা মুক্ত অবস্থা। পরস্পরকে বুঝা তখনই সম্ভব যখন বর্তমানে থাকা যায়।
মানুষের সকল সমস্যার মূলেও রয়েছে চিন্তা। চিন্তা সমস্যা ছাড়া থাকতে পারে না। তাই কোন সমস্যা না থাকলে চিন্তা প্রথমে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং তারপর তা সমাধানের চেষ্টা করে। চিন্তা সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। চিন্তার মাধ্যমে যে সমাধান পাওয়া যায় তা থেকে আরো দশটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ চিন্তা নিজেই সমস্যা।
চিন্তা মানুষের নিজস্ব নয়। এমন কোন চিন্তা নেই যাকে নিজস্ব চিন্তা বলে দাবী করা যায়। চিন্তা ভিতর থেকে আসে না, আসে বাহির থেকে। কেউ যদি এক চিন্তাকে ধরে রাখতে চায় তবে তার স্থায়িত্ব বেশি হলে ২মিনিট। কথায় বলে - মানুষের চিন্তা কুমারের পাক পলকে দেয় আঠারো পাক। চিন্তা আসে এবং যায়। কিন্তু আমরা যেমন ছিলাম তেমনি থাকি। চিন্তা আমাদের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু আমরা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা ইচ্ছা করলেই চিন্তা থামাতে পারি না। সে তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। মানুষ নিজের চিন্তাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অথচ জগতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তাই জগতের এ হাল।
মানুষের সব চিন্তাই আত্মরক্ষামূলক। তাই প্রকৃতিগতভাবে যা কিছুই মানুষের চিন্তা থেকে উৎপন্ন হয় তা ধ্বংসাত্মক। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ইত্যাদি যে কোন ধরনের চিন্তার ফলশ্রুতি ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। চিন্তা সব সময় নিজেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত থাকে তাই নিজের চারিদিকে বিভিন্ন রকমের দুর্গ গড়ে তুলে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, জাতিয়তা ইত্যাদি সবকিছুই মানুষ সৃষ্টি করেছে নিজেকে রক্ষা করার জন্য, যা চিন্তারই ফসল।
প্রতিটি চিন্তারই রয়েছে জন্ম মৃত্যু। একই চিন্তা বারবার ফিরে আসে নবরূপে। গরু জীবনের প্রয়োজনে খাদ্য জাবর কাটে কিন্তু মানুষ অপ্রয়োজনে চিন্তার জাবর কাটে। চিন্তা নিজেই নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে। একটা চিন্তার জন্ম হয় একটু পরেই তার মৃত্যু হয়, আবার তার জন্ম হয় আবার তার মৃত্যু হয়। চিন্তার এই জন্ম মৃত্যু চলতে থাকে অবিরাম। যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়।  যে চিন্তা আমরা করতে চাই না কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে আসে তাকে দুঃশ্চিন্তা বলা হয়। দুঃচিন্তা লক্ষ্যহীন, বিশৃঙ্খল ও নিষ্ক্রিয়।
মানুষের মস্তিষ্ক সৃষ্টিশীল নয়। মস্তিষ্ক শুধু প্রতিক্রিয়া করে। চিন্তা কোন কিছু বুঝার মাধ্যম নয় কিন্তু চিন্তা ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমও নাই যা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি। মানুষ চিন্তাকে ব্যবহার করে কিছু একটা ফলাফল পাবার জন্য, কিছু একটা হবার জন্য। চিন্তা যা যেমন আছে তাকে তেমন ভাবে গ্রহণ করতে পারে না।
শিশুর চিন্তা নেই বলে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। মানুষ যখন যৌক্তিক ভাবে চিন্তা করতে শেখে, তখন তার বৃদ্ধিও থেমে যায়। পৃথিবীর বিশিষ্ট চিন্তাবিদেরা বিশেষভাবে রুক্ষ, বদমেজাজি, অসন্তুষ্ট এবং জীবনের প্রতি বিরক্ত। জাপানীদের ধারণা চিন্তা মানুষের পেটে থাকে। তাই বিশিষ্ট চিন্দাবিদদের ভুরি মোটা হয়। পশু, পাখী, জীব জন্তু সবাই আনন্দে আছে কারণ তারা মানুষের মতো চিন্তা করে না।
মানুষ চিন্তাকে ব্যবহার করে প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে পাড়ি জমিয়েছে মানুষের তৈরি নভোযান। আমরা ঘরে বসেই জানতে পারছি কি ঘটছে চাঁদ, মঙ্গল বা বৃহস্পতিতে কিন্তু জানতে পারি না আমার পাশে বসা মানুষটি কি চিন্তা করছে। চিন্তার জগতে মানুষ একা।
চিন্তা আমাদের মধ্যে চিন্তা থেকে মুক্ত হবার চিন্তা জন্ম দেয়। কিভাবে আমরা চিন্তা থেকে মুক্ত হবো? চিন্তার মাধ্যমে কি চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব? কুকুর কি দৌড়িয়ে তার নিজের লেজকে অতিক্রম করতে পারবে? আমি কি আমার ছায়াকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো? মানুষ কি চিন্তা করে, কেন কেন চিন্তা করে, কিভাবে চিন্তা মুক্ত হওয়া যায় এসবও চিন্তারই বস্তু। চিন্তা মুক্তির যে সব পদ্ধতি প্রচারিত হয়েছে তার সব চিন্তারই ফসল। চিন্তা সম্পর্কে চিন্তা করা যায় না তাও চিন্তার বিষয় বটে।

গ্রহণ-বর্জনের রূপান্তরে চিন্তার রূপান্তর ঘটে। চিন্তা নিয়ন্ত্রণ বলতে লক্ষ্য কেন্দ্রিক চিন্তা করা, চিন্তাকে একরৈখিক করা বুঝায়। একচিন্তা, অবলোকন, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রতি সতর্কতা, স্মরণ ইত্যাদি পদ্ধতিতে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। 'আমি' চিন্তা নয়। চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে 'কি চিন্তা চলছে' - 'আমি' তা দেখতে পারে। ফলে চিন্তা কমতে কমতে এক এ স্থিতি লাভ করে। এক এ স্থিতি লাভ করলেই চিন্তা মহাশক্তি। বস্তু যত সূক্ষ্ম, তার শক্তিও তত বেশি। এক চিন্তা শক্তি বিশ্বকেও প্রভাবিত করে, কারণ চিন্তা মূলত এক, ব্যক্তি বিশেষে অনেক। চিন্তার মহাশক্তি জগতের রূপান্তর সাধনে সক্ষম। চিন্তার স্থিতিতেই চৈতণ্য প্রাপ্তি ঘটে।

ধর্মের এক আধার হলো বিজ্ঞান

সময়ের সাফ কথা ....
ধর্মের এক আধার হলো বিজ্ঞান

দিগন্ত ॥ যে সকল বিধান ধারণ ও লালন-পালনে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা, সুস্থতা তথা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় তাই ধর্ম। বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ বিশেষ জ্ঞান। জ্ঞান ভিন্ন সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায় না, সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করা যায় না। মূর্খের কোন উপাসনা নেই। মূর্খের ধর্ম নাই বললেও অত্যুক্তি হয় না। মূর্খরাই সৃষ্টির কর্তাকে মানে না। স্মর্তব্য, লেখাপড়া জানা কিংবা না জানা মূর্খতা বা জ্ঞানের মানদণ্ড নয়। লেখাপড়া জানলেই কেউ জ্ঞানী হয় না কিংবা লেখাপড়া না জানলেও কেউ মূর্খ হয় না। জ্ঞান অন্য প্রকারে অর্জিত হয়।
জ্ঞানীর জ্ঞানীকে বলে বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী ব্যস্ত থাকেন ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কিংবা সৃষ্টিকর্তার উপাসনায়। বিজ্ঞানীরা বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করে বিধাতা কি বিধি দিয়ে বস্তুটি সৃষ্টি করেছেন তা জানার চেষ্টা করেন এবং এই সব বিধিকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
জগত প্রাকৃতিক বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গাছ থেকে আপেল মাটিতে পতিত হয় মধ্যাকর্ষণ বিধিতে। কোন মন্ত্র, যজ্ঞ বা প্রার্থনা মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অকার্যকর করতে পারে না। জগৎ ও জীবন কার্য-কারণ বিধিতে আবদ্ধ। মহাবিশ্বের প্রতিটি অস্তিত্ব বিধির অধীন। এই সব বিধিকে জানা এবং মানা সুস্থ দেহে বেঁচে থাকা, ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করা এবং জীবনে শান্তি লাভ করার প্রধান শর্ত। বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনই শান্তির জীবন বা ধর্মজীবন। বিধানের বিপরীতে কল্প কাহিনীর উপর নির্ভর করলে বিশৃঙ্খলা, হতাশা, দুঃখ ও অশান্তি অনিবার্য। বিজ্ঞান বিধানগুলোকে জানছে এবং ব্যাখা করছে যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং প্রমাণ করছে যুক্তির যৌক্তিকতা। তাই শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য বিজ্ঞানের চর্চা ও চর্যা অপরিহার্য।
প্রাকৃতিক বিধান জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নিরপেক্ষ এবং সর্বত্রই এক ও অপরিবর্তনীয় কিন্তু মানুষের তৈরি বিধান স্থান-কাল ভেদে ভিন্ন এবং পরিবর্তনশীল। সতীদাহ প্রথা এক কালে ছিল ধর্মানুষ্ঠান কিন্তু এখন বর্বরতা ও কঠোর শস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মানুষ্ঠানিকতার এই বিবর্তনে রয়েছে বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞানের প্রভাব। যে যে ধর্মেই বিশ্বাস করুক না কেন বিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে মেনে নিতে বাধ্য। বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে ধর্মকর্ম তো দূরের কথা মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করাই অসম্ভব।
বিজ্ঞানের সূত্রগুলোই ধর্ম পালনে সৃষ্টি করছে যুক্তিশীলতা। যেমন,  বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে প্রতিটি ক্রিয়ারই আছে একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া! ধর্ম প্রতিষ্ঠার এটিই প্রধান সূত্র। কাউকে আঘাত করলে সে সমান ও বিপরীত আঘাত করবে বা করতে চেষ্টা করবে তা যে কোন দিকে হোক। যে মানুষ ভালোবাসার প্রতিক্রিয়ায় ঘৃণা দেয় সে প্রাকৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক বিধি লঙ্ঘন করে ফলে সে ঘৃণাই প্রাপ্ত হয়। ধর্মের এই তো সার কথা। বিজ্ঞান শিক্ষার ভিত্তিতে, মানুষের উন্নত মস্তিষ্কের বুদ্ধি, বিবেচনা খাটিয়ে, মানুষ বৈজ্ঞানিক সত্যে উপনীত হয়েছে - 'এই পৃথিবীর সকল মানুষ এক ও অভিন্ন প্রজাতি'। এই বৈজ্ঞানিক সত্যটির চর্যা পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র অবারিত করতে পারে। যে সকল শাস্ত্র মানুষকে সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে এবং মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ ও শত্রুতাকে উস্কে দেয় তা পরিত্যাগের সময় এসেছে।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে অ্যারিষ্টটল বলেছিলেন - 'মানুষ যুক্তিশীল প্রাণী'। যে যুক্তি মানে না সে মানুষ নয়। নিরন্তর চর্যার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিকে আরো শানিত করা, যুক্তিকে ত্রুটিমুক্ত করা, বিচার বিবেচনা এবং মস্তিষ্কের বিশ্ল্লেষণ ক্ষমতাকে তীক্ষ্ণ করা ব্যতীত ধর্মচর্যা  নেই, কোন কালে ছিলও না। একমাত্র যুক্তি ও বুদ্ধি চর্যার মাধ্যমে মানুষ নিজের জন্য এবং মানব জাতির জন্য কল্যাণ কর্মের সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে। একজন বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিশীল মানুষের পক্ষেই কেবল ধার্মিক হওয়া সম্ভব।
বিজ্ঞান এখনো সব বিধান জানতে পারেনি কিন্তু বিধানকে জানার জন্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোন বিকল্প নেই। প্রত্যেক সাধক একজন বিজ্ঞানী। জগত ও জীবনের রহস্য উন্মোচন করাই সাধক ও বিজ্ঞানীর কাজ। ওয়াইক্লিফ, জন হাস, টমাস মুয়েনৎসার, উইনস্টানলি, কপারনিকাস, জিওর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও এঁদের  সবাই ছিলেন সত্যানুসন্ধানী সাধক। আলবার্ট আইনস্টাইন এবং বিজ্ঞানী আব্দুস সালামও ব্যতিক্রম নন।
সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকশিত হয়েছে ধর্মকে ভিত্তি করে। মানুষের মধ্যে অজানাকে জানার, সীমার মধ্যে থেকেও অসীমকে উপলব্ধি করার যে স্পৃহা তা-ই মানুষকে যুগে যুগে করেছে বিকশিত। প্রায় ৩ হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে মানুষের চিন্তাশক্তির যে স্ফুরণ ঘটেছিলো তাও ছিলো ধর্মভিত্তিক।
বস্তুর ধর্মকে জানা বিজ্ঞানীর কাজ আর নিজ ধর্মকে জানা সাধকের কাজ। বিজ্ঞানী বস্তুর ধর্মকে জেনে নিজেকে জানার দিকে অগ্রসর হন আর সাধক নিজেকে জেনে বস্তুর ধর্মকে আবিষ্কার করেন। কল্যাণ ও অকল্যাণের মধ্যে পার্থক্য ব্যতীত তথা ধর্ম ব্যতীত বিজ্ঞান টিকে থাকতে পারবে না। অন্যদিকে ধর্মেরও প্রয়োজন রয়েছে এমন এক আধারের যা ধর্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে।
বিজ্ঞান ধর্ম নয় কিন্তু ধর্মের আধার অবশ্যই। জ্ঞানের সকল শাখা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞানের কোন সূত্রই ধর্মকে অপ্রমাণ করার প্রয়াসে আবিষ্কৃত হয়নি। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে যারা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেন তারা বিজ্ঞানীও নয় ধার্মিকও নয়।  বিজ্ঞানী ও ধার্মিক উভয়েই সাক্ষ্যপ্রমাণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যা জানা যায় শুধুমাত্র তাকেই সত্য হিসেবে গ্রহণ করেন।

প্রযুক্তি উন্নয়নের এক অপরিহার্য শর্ত। কিন্তু প্রযুক্তিকে কি লক্ষ্যে ব্যবহার করা হবে তা মানুষই নির্ধারণ করে। তাই মনুষ্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা না হলে প্রযুক্তিকে উন্নয়নের কাজে না লাগিয়ে ধ্বংসের কাজে লাগানো হবে। তাই পৃথিবীতে মনুষ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠার দায় রয়েছে বিজ্ঞানীদের।

একটা জীবনই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যথেষ্ট

একটা জীবনই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যথেষ্ট

সাদিকুল হক ॥ মানুষ কেন বাঁচে, কী নিয়ে বাঁচে! সবাই কি আসলে বাঁচে? বেশিরভাগই কেবল অস্তিত্ব রক্ষা করে চলে। এ ধরনের বেঁচে থাকা মানে শুধু দিন যাপনের জন্য বাঁচা। জীবন মানে কি কেবলই দিন যাপন, ভেসে বেড়ানো অজানা গন্তব্যে? তাহলে বন্যার জলে ভাসতে থাকা কচুরিপানার সাথে মানব জীবনের পার্থক্য কোথায়? মানুষ কী পারে স্রোতের টানে ভাটির দেশে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে? সত্যিকার অর্থে যিনি বাঁচেন বা বাঁচতে চান, তিনি ভেসে যেতে পারেন না গড্ডালিকা প্রবাহে। তাঁর জীবন কাণ্ডারি বিহীন নৌকা নয়। জীবনের নৌকা তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাতে দুলতেই পারে। কিন্তু তাই বলে ডুবে যাওয়া তো জীবনকে বাদ দেয়া।
যাদের লক্ষ্য আছে তাদের তো এক চিন্তা - আরো কতো কাজ বাকী! মানুষের জীবন একটাই বটে। কিন্তু সম্যক কাজ সম্যক সময়ে সম্যকভাবে সম্পন্ন করতে পারলে ছোট একটা জীবনই লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য যথেষ্ট। আইনস্টাইন ভালোবাসতেন সাইকেল চালাতে। তিনি জীবনকে তুলনা করেছিলেন বাইসাইকেলের সাথে। ভারসাম্য হারালে বাইসাইকেল ভূমিতে পতিত হয়। জীবনও তাই। জীবন সাইকেলের ভারসাম্য কিসে সুরক্ষিত হয়? জীবনতরীর কাণ্ডারি আছে কি? এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে না পেলে কেউ কোনো দিন সেই জীবন পাবে না, যে জীবন মানে সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকা, যে বাঁচার মধ্যে আছে আনন্দের ফল্গুধারা। জীবন একটাই। কাজেই এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে কখনও অনুশোচনা করতে না হয়।
মানুষের যখন অর্থ-সম্পদ হারায় তখন আসলে কিছুই হারায় না কিন্তু যখন আত্মপরিচয় হারায় তখন সে নিঃস্ব হয়ে যায়। কেমন করে পাওয়া যায় আত্মপরিচয়? আমি কে তা তো আমিময় আদর্শ ব্যতীত জানা সম্ভব নয়! আদর্শকে ধারণ করলেই মানুষ ধার্মিক হয়। আদর্শ আছে যার, ধর্ম তো তারই জন্য। আদর্শহীন কখনো ধার্মিক হতে পারেন না। আদর্শই হচ্ছে জীবন সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষার মূলমন্ত্র যা জীবনকে গন্তব্যে নিয়ে যায়। আদর্শকে জীবনতরীর কাণ্ডারিও বলা চলে।
আদর্শহীন জীবন মাঝিহীন নৌকার মতোই কিংবা কচুরিপানার জীবন। কচুরিপানার কাছে পৃথিবীর চাওয়া পাওয়ার কি আছে? জগত তাদের জন্যই অপেক্ষা করে যারা কোনো আদর্শকে ধারণ করেন। তারাই মানুষকে পথ দেখান।
সুতরাং, তোমার গন্তব্য তুমিই ঠিক করে নাও। জাগ্রত করো তোমার ভেতরের সুপ্ত শক্তিকে। তবে দেখবে তুমিই তোমার গন্তব্য। কোথায় যাবে তুমি? যাবার মতো স্থান কোথাও নেই। মানুষ অসীমের যাত্রী। মানুষ আবদ্ধ নয় জন্ম-মৃত্যুর সীমানায়। মানুষের জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। আছে এক অনন্তকালীন ভ্রমণ।
মানুষ জগতকে নিয়ে গবেষণা করছে বটে কিন্তু জীবনকে যাপন করেনি। জগত নিয়ে গবেষণার ফলে জগতের অনেক রহস্য তার কাছে উদঘাটিত হয়েছে কিন্তু জীবনকে যাপন না করার জন্য সে রয়েছে জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত। প্রতিটি মানুষ মহাবিশ্ব, যা আছে আমাতে তা আছে ব্রহ্মাণ্ডে। কিন্তু মানুষ নিজের দিকে না তাকিয়ে তাকিয়েছে বাইরের দিকে। আমরা জীবন প্রাপ্ত হয়েছি তা যাপন করার জন্য, জীবন নিয়ে গবেষণার জন্য নয়। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে যাপন করা সহজ নয়। জীবন তো নয় অতীতের স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতের স্বপ্ন! জীবন তো আছে এখন, এই মুহূর্তটির মধ্যে। যে এই মুহূর্তটিকে উপলব্ধি করতে পারে সে জীবনকে যথার্থভাবে যাপন করতে পারে।

দুধ, ঘি, মাখন, ফল-মূলের গুণাবলীর ব্যাখ্যা যতই বিস্তৃত হোক না কেন, ভক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত তা দেহের পুষ্টি সাধন করতে অক্ষম। ঠিক তেমনি বর্তমানে বেঁচে থাকতে না পারলে, এ নিয়ে আলোচনা করা বৃথা, জীবনও বৃথা।

আত্মদর্শনে সত্যদর্শন

আত্মদর্শনে সত্যদর্শন

আরিফিন হক ॥ জীবিত মানেই কোন না কোন কর্ম করা। মৃত জীবদেহ বস্তু মাত্র, জীবনের সমাপ্তি। মৃত্যু এমন একটি অবস্থা যখন দেহের কর্ম থেমে যায়। থেমে যায় শ্বসন, গ্রহণ-বর্জন, পরিচলন। জীবন যেখানে লালিত সেখানেই লালিত হয় জীবনের ধর্ম। চিন্তা, জ্ঞান, অনুভব, বোধ জীবনের প্রয়োজনেই জন্ম, জীবদেহের কোষে কোষে সমগ্র অবয়ব জুড়ে। প্রতিটি কোষ জীবিত। জীব কোষের অস্তিত্বকে ঘিরে রয়েছে অনুভব ও উপলব্ধির ক্ষমতা - এই ক্ষমতা কি আত্মা?
আত্মার কোন সহজ ব্যাখ্যা নেই। তাই আত্মাকে ঘিরে রয়েছে বিশ্বাস অবিশ্বাসের নানা কথা। যুগ যুগ ধরে আমরা শুনে এসেছি - আত্মদর্শন, আত্মসমর্পন ও আত্মোৎসর্গ শব্দগুলো। কিন্তু এসব শব্দের তাৎপর্য যে কি তাও সহজে আমাদের বোধগম্য হয় না। আত্ম থেকে আত্মা। 'আত্ম' শব্দের অর্থতো 'আমি'। জীবনে যখন তত্ত্ব আসে, তখন 'আমি'র রূপান্তর ঘটে আমিত্বে। আমি তত্ত্বের অধিকারীকে বলে আমিত্ব। আমিত্ব্বই মানব অস্তিত্বের মৌলিক উপাদান। জীবনের সকল তত্ত্ব যেখানে সঞ্চিত তাকে বলা যায় আত্মা। সঞ্চিত তত্ত্বকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করি না বটে কিন্তু তত্ত্বই মানুষের ক্রমবিকাশ ঘটায় কর্মের প্রবাহে। আত্মাহীন মানুষ কোন কর্ম করতে পারে না।
শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হলেই জীবন অচল হয়ে যায়। জীবনের মৃত্যু হয়। মানুষ এখন সহজভাবে বুঝতে পারছে দেহের প্রায় সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আমরা জানি, বাতাসের সাথে 'আত্মা'র গভীর সর্ম্পক। দম বাতাসের ক্রিয়া। বাতাস বায়বীয় পদার্থ। ইংরেজীতে আত্মাকে বলে Spirit. Spirit শব্দটা ইংরেজিতে এসেছে ল্যাটিন ভাষায় Spirit শব্দ থেকে যার অর্থ শ্বাসক্রিয়া। আরবিতে রূহের আভিধানিক অর্থও শ্বাসক্রিয়াই। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া অবশ্যই সকল জীবনেরই প্রতীক, বাতাসের মাধ্যমে অক্সিজেনের ধর্ম পালন করে। এই সব তত্ত্ব যদি আরো বিশ্লেষণ করা যায় তবে আত্মাকে  অজানা-অছোঁয়া হিসাবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন নেই। যে সব শব্দকে আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারি না, তাকে বিশ্বাস করা যায় কি? অজ্ঞতা মানুষকে ধরে রেখেছে অন্ধকারে। কিন্তু জ্ঞান ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে অন্ধকার জগৎ থেকে মুক্তির আলোতে, লাঘব হচ্ছে মানুষের কষ্ট ও শ্রম। এই বিশ্বে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে আত্মাকে আবিষ্কার করেছে আমিত্বের পরিচয়ে। আবিষ্কারের তাৎপর্য হলো জানা বা জ্ঞাত হওয়া। জ্ঞাত বা জানা ব্যতীত স্রষ্টাকে কখনো জানা বা তার পরিচয় পাওয়া যায় না। পরমাত্মা বিরাজ করেন মানুষেরই অনুভূতির জগতে।  স্রষ্টা, সর্বদাই অবস্থান করে আছেন মানুষের আত্মাতে, যা নিরাকার তত্ত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। সকল সৃষ্টি এক সময় ছিল না। আদমও এককালে ছিল না, কোটি কোটি বছর লেগেছে, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটাতে। পবিত্রতা মানুষেরই আবিষ্কার এবং মানুষ তাকে স্রষ্টা হিসাবে জানে, পরমাত্মা নামকরণে। আত্মাকে যারা না-বুঝে তথাকথিত বিশ্বাস নিয়ে আছে অজ্ঞতাই তাদের মূলধন। অজ্ঞতাই হল মানুষের মূল পাপ। অজ্ঞতা থেকেই  ভয়ের উৎপত্তি। জ্ঞাত বা জানলেই মানুষের ভয় থাকে না অর্থাৎ অর্জন করে পূণ্য, জ্ঞানের আলোতে।
আত্মা কিংবা বোধহীন জীবনের কোন মূল্য নেই। বোধেরই জন্যে মানুষের জীবনে বিচার করার ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতায় মানুষ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করে ভালো-মন্দের বিচার-বিশ্লেষণে, নানান মাত্রার আলোড়নে। প্রাকৃতিক সকল ঘটনাসমূহ  চলে আপন নিয়মে। মানুষের একটি মাত্র লক্ষ্য, প্রগতির পথে শান্তি প্রাপ্ত হওয়া। শান্তির অন্বেষণেই মানব-সভ্যতা গতিময়। শান্তি ব্যতীত মানুষ আর কি চায়?

জীবন মাত্রই তার চাহিদা বা প্রয়োজন থাকবে। প্রয়োজন থেকেই মানুষের মনে আকর্ষণ করার ক্ষমতা জন্মে। আকর্ষণের মাধ্যমেই প্রেমে রূপান্তর ঘটে। ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে আত্মার সাথে আত্মার সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ভাষা। যারা একই ভাষায় কথা বলে তাদের চিন্তাধারায় দেখা যায় বিশেষ ঐক্য। ভাষার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় একের সাথে অন্যের নৈকট্য। এই নৈকট্য দিয়ে রচিত হয় ঐক্যতান।