আত্মদর্শনে সত্যদর্শন
আরিফিন হক ॥ জীবিত মানেই কোন না কোন কর্ম করা। মৃত জীবদেহ
বস্তু মাত্র, জীবনের সমাপ্তি। মৃত্যু এমন একটি অবস্থা যখন দেহের কর্ম থেমে যায়। থেমে
যায় শ্বসন, গ্রহণ-বর্জন, পরিচলন। জীবন যেখানে লালিত সেখানেই লালিত হয় জীবনের ধর্ম।
চিন্তা, জ্ঞান, অনুভব, বোধ জীবনের প্রয়োজনেই জন্ম, জীবদেহের কোষে কোষে সমগ্র অবয়ব জুড়ে।
প্রতিটি কোষ জীবিত। জীব কোষের অস্তিত্বকে ঘিরে রয়েছে অনুভব ও উপলব্ধির ক্ষমতা - এই
ক্ষমতা কি আত্মা?
আত্মার কোন সহজ ব্যাখ্যা নেই। তাই আত্মাকে ঘিরে রয়েছে বিশ্বাস
অবিশ্বাসের নানা কথা। যুগ যুগ ধরে আমরা শুনে এসেছি - আত্মদর্শন, আত্মসমর্পন ও আত্মোৎসর্গ
শব্দগুলো। কিন্তু এসব শব্দের তাৎপর্য যে কি তাও সহজে আমাদের বোধগম্য হয় না। আত্ম থেকে
আত্মা। 'আত্ম' শব্দের অর্থতো 'আমি'। জীবনে যখন তত্ত্ব আসে, তখন 'আমি'র রূপান্তর ঘটে
আমিত্বে। আমি তত্ত্বের অধিকারীকে বলে আমিত্ব। আমিত্ব্বই মানব অস্তিত্বের মৌলিক উপাদান।
জীবনের সকল তত্ত্ব যেখানে সঞ্চিত তাকে বলা যায় আত্মা। সঞ্চিত তত্ত্বকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে
অনুভব করি না বটে কিন্তু তত্ত্বই মানুষের ক্রমবিকাশ ঘটায় কর্মের প্রবাহে। আত্মাহীন
মানুষ কোন কর্ম করতে পারে না।
শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হলেই জীবন অচল হয়ে যায়। জীবনের মৃত্যু
হয়। মানুষ এখন সহজভাবে বুঝতে পারছে দেহের প্রায় সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। আমরা জানি,
বাতাসের সাথে 'আত্মা'র গভীর সর্ম্পক। দম বাতাসের ক্রিয়া। বাতাস বায়বীয় পদার্থ। ইংরেজীতে
আত্মাকে বলে Spirit. Spirit শব্দটা ইংরেজিতে এসেছে ল্যাটিন
ভাষায় Spirit শব্দ থেকে যার অর্থ শ্বাসক্রিয়া। আরবিতে রূহের আভিধানিক
অর্থও শ্বাসক্রিয়াই। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া অবশ্যই সকল জীবনেরই প্রতীক, বাতাসের
মাধ্যমে অক্সিজেনের ধর্ম পালন করে। এই সব তত্ত্ব যদি আরো বিশ্লেষণ করা যায় তবে আত্মাকে অজানা-অছোঁয়া হিসাবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন নেই।
যে সব শব্দকে আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারি না, তাকে বিশ্বাস করা যায় কি? অজ্ঞতা মানুষকে
ধরে রেখেছে অন্ধকারে। কিন্তু জ্ঞান ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে অন্ধকার জগৎ থেকে মুক্তির
আলোতে, লাঘব হচ্ছে মানুষের কষ্ট ও শ্রম। এই বিশ্বে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে আত্মাকে
আবিষ্কার করেছে আমিত্বের পরিচয়ে। আবিষ্কারের তাৎপর্য হলো জানা বা জ্ঞাত হওয়া। জ্ঞাত
বা জানা ব্যতীত স্রষ্টাকে কখনো জানা বা তার পরিচয় পাওয়া যায় না। পরমাত্মা বিরাজ করেন
মানুষেরই অনুভূতির জগতে। স্রষ্টা, সর্বদাই
অবস্থান করে আছেন মানুষের আত্মাতে, যা নিরাকার তত্ত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। সকল সৃষ্টি
এক সময় ছিল না। আদমও এককালে ছিল না, কোটি কোটি বছর লেগেছে, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়
অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটাতে। পবিত্রতা মানুষেরই আবিষ্কার এবং মানুষ তাকে স্রষ্টা হিসাবে
জানে, পরমাত্মা নামকরণে। আত্মাকে যারা না-বুঝে তথাকথিত বিশ্বাস নিয়ে আছে অজ্ঞতাই তাদের
মূলধন। অজ্ঞতাই হল মানুষের মূল পাপ। অজ্ঞতা থেকেই
ভয়ের উৎপত্তি। জ্ঞাত বা জানলেই মানুষের ভয় থাকে না অর্থাৎ অর্জন করে পূণ্য,
জ্ঞানের আলোতে।
আত্মা কিংবা বোধহীন জীবনের কোন মূল্য নেই। বোধেরই জন্যে
মানুষের জীবনে বিচার করার ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতায় মানুষ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করে ভালো-মন্দের
বিচার-বিশ্লেষণে, নানান মাত্রার আলোড়নে। প্রাকৃতিক সকল ঘটনাসমূহ চলে আপন নিয়মে। মানুষের একটি মাত্র লক্ষ্য, প্রগতির
পথে শান্তি প্রাপ্ত হওয়া। শান্তির অন্বেষণেই মানব-সভ্যতা গতিময়। শান্তি ব্যতীত মানুষ
আর কি চায়?
জীবন মাত্রই তার চাহিদা বা প্রয়োজন থাকবে। প্রয়োজন থেকেই
মানুষের মনে আকর্ষণ করার ক্ষমতা জন্মে। আকর্ষণের মাধ্যমেই প্রেমে রূপান্তর ঘটে। ভাব
বিনিময়ের মাধ্যমে আত্মার সাথে আত্মার সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে সৃষ্টি
হয় ভাষা। যারা একই ভাষায় কথা বলে তাদের চিন্তাধারায় দেখা যায় বিশেষ ঐক্য। ভাষার মাধ্যমে
সৃষ্টি হয় একের সাথে অন্যের নৈকট্য। এই নৈকট্য দিয়ে রচিত হয় ঐক্যতান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন