বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৪

দুর্নীতির পৌষমাস শিক্ষার সর্বনাশ



দুর্নীতির পৌষমাস শিক্ষার সর্বনাশ

হরিভজন কুন্তল ॥ পাশাপাশি দু’টি সংবাদ- শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আগে শিক্ষার মান ছিলই না’ অন্যটি ‘জিপিএ-৫: হাজার হাজার মাকাল ফল’। প্রথমটি শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন। তিনি যে স্কুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ মন্ত্রীত্বের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, সেই স্কুলের ভবন নবায়ণ অনুষ্ঠানে। সেই স্কুলভবনকে ধ্বংস করেছিল, শিবির আর ছাত্রলীগের কর্মীরা- পরস্পরের সংঘর্ষে। ঘটনার পর তিনি ওখানে গিয়ে কেঁদেছিলেন। আমরা পত্রিকায় তার কান্নার সচিত্র সংবাদ পড়েছিলাম, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে তা দেখেওছিলাম। এবার তিনি গুড়িয়ে যাওয়া ভবনটিকে আগের মতো করে নির্মাণ করেছেন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি জানালেন- ‘আগে শিক্ষার মান ছিলই না’। অন্যদিকে কয়েকজন শিক্ষানুরাগী মানুষ একটি আলোচনার টেবিলে বলেছেন, বর্তমান শিক্ষার সংকট নিয়ে, সেখানে বক্তা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, মাকাল ফলের কথা। আমরা কোন্‌টিকে মানবো?
উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে যেদিন টিআইবি-র রিপোর্ট প্রকাশিত  হলো, সেদিন থেকে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে বোম ফাটতে শুরু করল। টিআইবি-কে চেপে ধরে তিনি এক হাত নিয়েও ছিলেন বেশ শক্তভাবেই। বিডি নিউজ ২৪-এ  বিষয় এর উপর তিনি তার মতামত দিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদনও লিখেছিলেন। তার সে বক্তব্যের জের ধরে ক্ষমতাসীনদের অনেকেই টিআইবি-কে যথাসম্ভব তীর্যক বাক্যবাণে ঘায়েল করার চেষ্টাও করেছেন, এখনও সে পরিবেশ শান্ত হয়েছে বলে মনে হয়না। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য পরবর্তীতে খুঁজে অনেক প্রমাণও পেয়েছেন, কিছু আ্যাক্‌শনও নেবার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তবে, সফল হয়েছেন কি-না, সেটি এখনও আমরা নিশ্চিত বলতে পারবো না। এরপর তিনি সত্যি ক্ষেপে গেলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গ নিয়ে। সেখানে ইংরেজি বিভাগে মাত্র দু’জনের সফলতাকে তিনি ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখলেন। চলমান সে সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন পনের থেকে নামিয়ে আটে এনে অথবা বিশ থেকে আঠারতে নামিয়ে কিংবা অন্য বিভাগ থেকে নিয়ে কোটা পূরণের একটি ব্যবস্থা করতে, কিন্তু তাতেও ১৫০-এর কোটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার এ চিত্র দেশের চিন্তাশীল মানুষদের মাঝে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি এ বিষয়টি বিশিষ্টজনের আলোচনায়ও উঠে এসেছে।  আলোচনা-সমালোচনা এখনও চলমান। শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল অবশ্য এই চিত্র মানতে রাজি নন। তিনি তার দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলতে চেয়েছেন আমাদের সন্তানদের অবস্থা মোটেও ওরকম নয়, তিনি অবশ্য জিপিএ-৫ এর বন্যা নিয়ে কোন আলোচনা করেন নি। তিনি দেখাতে চেয়েছেন ব্যবস্থা এবং ব্যবস্থাপনার সংকটকে। তবে, বোদ্ধারা তার সাথে ঐক্যমতে আসবেন কিনা সেটি অনিশ্চিত। আর সে কারণেই ড.আসিফ নজরুল যিনি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষক এবং লেখক ও গবেষক। তিনি বলছেন- মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ‘জিপিএ-৫ হলো   হাজার হাজার মাকাল ফল’। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্যে আমরা যেমন শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের অনুকূল প্রবাহের স্পন্দন পাই, তেমনি ড.আসিফ নজরুলের বক্তব্যেও নঞবোধক রাজনীতির অনুরণটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তা হলে সত্যটি কোথায়? আর আমাদের সন্তানদের তথা দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এই প্রশ্ন এখন চিন্তাশীল মানুষের জন্য বেশ উদ্বেগের। সমাধান চাইছেন তারা- সকল কৃতিত্বকে মাকাল ফল ভাবতেও যেমন রাজি নন, তেমনি এখনকার শিক্ষা পদ্ধতিতে যথেষ্ট মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ আছে এটাও সত্য নয়।
‘আগে মান ছিলই না’, শিক্ষামন্ত্রীর এই মন্তব্যটিকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করবো? এখানে তিনি কোন্‌‌ ‘আগের’ কথা বলছেন? তিনি যখন ছাত্র ছিলেন তখনকার সময়ের কথা বলছেন, না তার ক্ষমতার আগ পর্যন্ত এই দেশের শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের সময়কে? অথবা বিগত বিএনপি সরকারের সময়কে চিহ্নিত করতে চাচ্ছেন? তিনি সময়টিকে মোটেই স্পষ্ট করেন নি। তাই আমরা ধরে নিতে পারি তিনি আগের সরকারের সময়টাকেই বোঝাতে চাইছেন। সাধারণভাবে আমাদের ক্ষমতাসীনরা যেমনটা করে থাকেন। কারণ তার ছাত্রজীবনে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা না থাকলে, আজকে তিনি মন্ত্রীত্ব করছেন কীভাবে? তিনিও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। ছাত্ররাজনীতির সাথে তার গভীর সম্পৃক্ততাও ছিলো। বিস্তর আন্দোলনও করেছিলেন সেই সময়কার শিক্ষার নানাবিধ সংকট এবং অধিকার নিয়ে। আজ সেই শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব তার-ই হাতে। তাই, সবিনয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে এই প্রশ্নটি করতে পারি- সেদিনের শিক্ষা সংকটের কারণগুলো আজ কী নেই অথবা  তিনি তার কতটুকু মোচন করতে পেরেছেন? শিক্ষার অধিকার এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই প্রত্যয়ের সত্যিকারের  কোন সমাধান আমরা পেয়েছি কী? রাষ্ট্র কী সমাধান করেছে শিক্ষার মানদণ্ড কী হবে? যে শিক্ষানীতি তিনি প্রণয়ন করেছেন, তা নিয়েও কী বিতর্কের অন্ত নেই? এই শিক্ষানীতি বর্তমানের প্রচলিত বহুমুখী  শিক্ষা পদ্ধতির অটুট ব্যবস্থার পরিবর্তনে আদৌ কী কোন ছাপ রেখেছে? শিক্ষা জনগণের মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে, কিন্তু বাস্তবতায় শিক্ষা এখন পণ্য। ধনাঢ্য ক্রেতারাই শুধু তা অর্জন করতে পারে, সে কী মিথ্যা প্রলাপ?
শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে যারা তক্‌মা এঁটে বহুল প্রসার এবং পশার লাভ করে চলেছেন, সেই সত্যটিও তিনি জানেন। সে কারণেই একবার কোচিং বাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন কিন্তু পরে সরে আসতে বাধ্য হন। অনেকটা ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরে উল্টো দৌঁড় মারার মতো। তারপর এদের আর রুখে কে? এখন কোচিং বাণিজ্যের সাথে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপ্রতিরোধ্য বাণিজ্য আসমানে ঠেকেছে। সেইসঙ্গে ভর্তি বাণিজ্যেও স্রেফ দানবীয় ছাত্র রাজনীতি-ই শেষ কথা নয়, সাংসদ, নেতা, পাতিনেতা থেকে শুরু করে আমলা, আমলার কামলারাও জড়িত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত লটারি দিয়েও এই মধুর বাণিজ্য বন্ধের কোন পথই আবিষ্কার করা যায় নি। শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যে ক্ষমতাসীনদের বাণিজ্যের লম্বা হাতের রামায়ণ, কে-না জানেন এই দেশে। তারপর, যখন ডিজি অফিসে কোন শিক্ষকের পা পড়ে, তার চাকরি জীবনের প্রয়োজনে, তখন তাকে দিগম্বর করার নমুনা যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আছে, তারা জানেন শিক্ষকতার পেশা কাকে বলে, যার শুরু দুর্নীতি দিয়ে শেষও হয় দুর্নীতির আর্শীবাদ নিয়ে। এমন শিক্ষক শিক্ষার মান তৈরি করবেন, না নিজের উজাড় হওয়া পকেট খুঁজে ফিরবেন? ঢাকা শহরের বিখ্যাত ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তো দেশের শিক্ষার মানচিত্র নয়, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ষোল কোটি  মানুষের অধিকার, তা-কী নৈরাজ্য ব্যবস্থাপনা দিয়ে সংরক্ষণ করা যায়? শিক্ষামন্ত্রক আজ পর্যন্ত এই দুর্নীতি আর নৈরাজ্য বন্ধের কোন উদ্যোগ নিয়েছেন এমন দাবি আমরা করতে পারছি না।
শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে এ পর্যন্ত দড়ি টানাটানি কম হয়নি, শেষ পর্যন্ত এখন সৃজনশীল আর গ্রেডিং-এ এসে ঠেকেছে। তাতে ছাত্রদের লাভ ক্ষতি কী হয়েছে তা নিয়ে বিতর্কে রাত পার করা কঠিন নয়। তবে, রাজনীতি যে তাতে লাভবান হয়েছে অনেকেই আঙ্গুলটি সে দিকেই তুলে ধরছেন। বোর্ডের সিদ্ধান্ত পাশের হার আর গ্রেড বাড়াবার নির্দেশনা পত্রিকায় সংবাদ হয়ে এসেছে আমরা তা পড়েছি। তারপরও এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, সেটি মানবেন কেন একজন চিন্তাশীল মানুষ? ফেল করলে জবাবদিহিতায় পড়তে হবে একজন শিক্ষককে, এ ধরণের হুঁশিয়ারি বোর্ড থেকে শিক্ষকদেরকে খাতা প্রদানের সাথে মৌখিকভাবে ট্যাগ করা হয়, তা-কী গোপন থাকে? সেখান থেকেই যে পাশের হার আর গ্রেডের বন্যা শুরু হয়ে গেলো সেটি অস্বীকার করে মান বাড়াবার রাস্তাটি কী আদৌ খোলা থাকে? না তার কোন প্রয়োজন আছে? কোন্‌ শিক্ষকের ঘাড়ে কয়টি মাথা আছে, বোর্ডের নির্দেশনার বাইরে যায়? আর শিক্ষকদের জন্য বোর্ডগুলো মহা ফাঁদ, যে কেউ যে কোন সময় সে ফাঁদে পড়তে পারেন, সে কথাটি তাদের মনে থাকে বা রাখতে হয়। শিক্ষামন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে অনেক পদেরই নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতির সম্প্রসারণের ধারায় চলাটা এখন ঐতিহ্যে দাড়িয়েছে, সেখানে যোগ্যতাটি গৌণ- আনুগত্যটি মূখ্য। সংগত কারণেই দুর্নীতির পৌষ মাস, শিক্ষার সর্বনাশ তাই ধারাবাহিক নিয়মেই ঘটছে।
সৃজনশীলতায় নোট- গাইডের দুর্নীতি থেকে শিক্ষার্থীদেরকে মুক্ত করতে আদালত নিষিদ্ধনামা জারি রেখেছে। বিষয়টির গুরুত্ব, দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে শিক্ষামন্ত্রী অনুধাবন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলাবাজারে কিন্তু পা রাখতেই বুঝে গেলেন কুরুক্ষেত্রের এক প্রান্ত এই সদরঘাটেই। চাইলেই সে লড়াই তিনি লড়তে পারবেন না। এখন সকলের নাকের ডগার উপরে দিব্যি আয়েশে চলছে সৃজনশীলতার নোট-গাইডের বাজারজাতকরণ। ঠেকানো তো দূরের কথা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন তাদের জন্য, আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত তৈরিতে। তবে, ওরা কাউকে বঞ্চিত করে না। অন্তত বিশ হাজার কোটি টাকার এই পণ্য বাজার যাদের নজরদারিতে, সেই সব নজরদারি সংস্থাগুলোকে উদার হাতে বোনাস দিতে ওদের কার্পণ্য নেই। ফলে শিক্ষক আর শিক্ষক সমিতিগুলো অনেক আগেই নিজেদেরকে নিলামের বাজারে তুলে কম্পানিগুলোর কাছে তাদের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার অনন্য নিদর্শন ইতোমধ্যেই সৃষ্টি করতে পেরেছেন। সমিতি মানে এখন দোকানদারি, সে দোকানদারি স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁধে বেশ বসে আছে। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়ে লাল, সাদা, নীলের সাইনবোর্ড লাগিয়ে, তপস্যার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা। পদ-পদবি পেতে এই দোকানদারি বেশ কাজে দেয়। এই নভেম্বর মাস থেকেই নোট-গাইডের কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য শুরু হয়ে যাবে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক তারপর উচ্চ মাধ্যমিক সকলেরই নিলাম বাণিজ্য আছে। সমিতিগুলো এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় থাকে, আর সেই সমিতিগুলোর নেতৃত্বে যারা থাকেন তারা বরাবরই ক্ষমতাসীনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী।
সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষা দিবেন যে শিক্ষকরা তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রক জানেন, সে চেষ্টা অব্যাহত আছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে প্রচেষ্টায় ৪০%-এর বেশি সফলতা তারা দাবি করতে পারবেন বলে মনে হয় না। তারপরও জোড়া-তালি দিয়ে চলছে হয়তো। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষাটা দিবেন কে? যিনি ভালো ইংরেজি জানেন তিনি সরকারি স্কুল তো দূরের কথা বেসরকারি স্কুলেই থাকতে রাজি নন। বয়স ঠেকাতে কখনও কখনও ঢুকে পড়েন বটে, ভালো সুযোগটি হাতে এলেই কেটে পড়েন। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ এই চাকরির ভবিষ্যৎ যে শূণ্য তা সকলেই জানেন। অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদা বলতে যা বুঝায়, তাও শূণ্যের কোঠায়। গতিহীনের পণ্ডিতি সেই পুরনো বাক্যই যেনো দাঁত বের করে হাসছে, আধুনিক জাতি তৈরির কারিগরদের জন্য। এদিকে গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো রাজনীতির লম্বা হাত। এক ছত্র বাংলা লিখতে দিলে যিনি কলম ভাঙ্গবেন, তিনিই হলেন স্কুল কমিটির সভাপতি। এই পতিরাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তাদের দোকানদারি বলেই জানেন, মানেন। তাই, এই পদটি পাবার জন্য দৌঁড়ের পাল্লা জাতীয় নেতা- নেত্রীর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারাও আপনজনদেরকে  না ভুলে দুয়ার থেকে টেনে যথারীতি মর্যাদায় আসীন করে প্রতিষ্ঠানকে ধন্য করেন।
দেশে স্কুলের তিনগুণের কাছাকাছি মাদ্রাসার সংখ্যা। তবে মিল নেই দু’টো ধারায়। এদের এক করতে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীর পরিবর্ধন করা হয়েছে। এই ছাত্রদেরকে জাতীয় শিক্ষার সাথে সমন্বয় করতে তাদের নিজস্ব পাঠ্যক্রমের সাথে পড়তে হয় স্কুলের সকল বিষয়। একজন ছাত্র কতটা লোড নিতে পারেন? এই অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা আগামি দিনে কী সুফল বয়ে আনবে বলা মুশকিল। জেলা পর্যায়ের সরকারি স্কুলগুলো দুই শিফটে চলছে। হাজার দুয়েক ছাত্র/ছাত্রীর জন্য যেখানে শিক্ষক প্রয়োজন পঞ্চাশের উপর সেখানে  ত্রিশের বেশি যোগান দেয়া এই মন্ত্রকের পক্ষে সম্ভব নয়। তা হলে, ক্লাস কে নিবেন? তাই, অনেক স্কুলই এখন দিশেহারা। তবুও তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে মাষ্টার্স পর্যন্ত যাকে শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব পালন করতে হয়, তিনি মানের দিকে তাকাবেন কী-করে? এমনি করে হাজারো সমস্যা জিইয়ে রেখে,  গ্রেডের সাফল্যে আত্মহারা। এখন একটি চুড়ান্ত পর্বে এসে যখন ধাক্কাটা লেগেছে, তখন তার সমাধানের পথ না খুঁজে বাক্য বাণের আশ্রয় নেয়াটা কতটুকু নৈতিক? এর সব কিছুর পিছনে অনৈতিকতা আর দুর্নীতি যে স্থায়ী বাসা বেঁধে আছে, তারপরও আমরা আশা করছি শিক্ষার উচ্চ মান প্রতিষ্ঠা নিয়ে। স্রেফ প্রযুক্তিগত  বিদ্যা যে শিক্ষার মান নির্ধারণের উপায় নয়, সেটি যদি শিক্ষামন্ত্রী মেনে নিতেন তা হলে আমরা ভরসা পেতাম আমাদের সন্তানদের প্রযুক্তি অপব্যবহারের নিম্নগামীতা থেকে। ফেসবুক আর বোমা তৈরি প্রযুক্তি কোন্‌ দরজাকে উন্মুক্ত করছে, তা-কী আমরা একবারও ভেবে দেখি? কোন মানসম্পন্ন ছাত্র কী আজকের সময়ের এই ছাত্ররাজনীতি করতে পারে? আমাদের সন্তানরা অবশ্যই অযোগ্য নয়, কিন্তু আমরা তাদের বিদ্যার্জনের পরিবেশটি কী নিশ্চিত করতে পেরেছি?

গ্রহণ-বর্জনই রূপান্তরের মূল কারণ



সময়ের সাফ কথা ....
গ্রহণ-বর্জনই রূপান্তরের মূল কারণ

আইনুল হাফিজ ॥ তিনটি পৃথক পাত্রে গাজর, ডিম ও চা পাতা সিদ্ধ করলে শক্ত গাজরটি নরম হয়ে যাবে, নরম ডিমটি শক্ত হয়ে যাবে আর চা জলের রঙ এবং স্বাদকেই পরিবর্তন করে দেবে।
প্রত্যেকটি বস্তু একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে- জল এবং অগ্নি। কিন্তু একেকটি বস্তু একেকভাবে অগ্নির উত্তাপ এবং জল গ্রহণ-বর্জন করেছে। গাজরটি ছিল শক্ত ও অনমনীয়। কিন্তু ফুটন্ত জলে তা নরম ও দুর্বল হয়ে গেল। ডিমটি ছিল নাজুক ও ভঙ্গুর। ডিমের পাতলা বহিরাবরণ এর ভেতরের তরল অংশটি রক্ষা করছিল। জল ও অগ্নির মিথষ্ক্রিয়ায় তা শক্ত হয়ে গেল। কিন্তু চা-জলের মধ্যে নিজের গুণ ও ধর্ম সঞ্চার করে জলকেই বদলে দিল।
আমি কী গাজরের মতো, দেখতে শক্ত কিন্তু কষ্টে ও প্রতিকূলতায় নরম ও দুর্বল হয়ে যাই? আমি কী ডিমের মতো, প্রথমে নমনীয় থাকি কিন্তু কষ্ট, উত্তাপ ও বাধা-বিপত্তিতে শক্ত হয়ে ওঠি? নাকি আমি চায়ের মতো? যা জলকেই বদলে দেয়। আমি কী সেই পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারি যে পরিস্থিতি আমাকে বদলে দিতে চায়? আমি কী চায়ের মতো হতে পারবো- যে বুকের রস দিয়ে রক্ত বর্ণ করে দেবে বর্ণহীন জল? আমি কী পারবো আমার ঘ্রাণ আর স্বাদ ছড়িয়ে দিতে?
লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সম্যক পরিবেশই যথেষ্ট নয়। পরিবেশ থেকে কে কী গ্রহণ-বর্জন করবে সেটাই রূপান্তরের মূল কারণ। আমি তো খোলা বইয়ের মতো উন্মুক্ত হয়েই আছি! যে কোন মুহূর্তে ডাক আসতে পারে চলে যাওয়ার। তাহলে কেন আমি সেই পথে যাবো না, যে পথে যেতে আমার বিবেক বলছে আমাকে?
চা পান করলে ঘুম চলে যায়- সে তো সবাই জানে। কথিত আছে বোধিধর্ম একবার ধ্যানে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর ক্রুদ্ধ হয়ে চোখের পাতাদুটোই ছুরি দিয়ে কেটে ফেললেন। বোধিধর্মের চোখের পাতা থেকে উৎপন্ন হলো চা গাছ। সেই থেকে চা ধারণ করছে পরিবেশকে রূপান্তরিত করার ধর্ম।

কমরেড হাজী সাহেবদের কাছে জাতির প্রত্যশা



কমরেড হাজী সাহেবদের কাছে জাতির প্রত্যশা

মহিবুল্লাহ্‌ বাদশা ॥ মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন, যে ব্যক্তির হজ আল্লাহ্‌র দরবারে কবুল হয়ে যায়, তিনি পাপ মুক্ত হন। এ সুযোগটি কোন মুসলিম জীবৎকালীন অবস্থায় হাত ছাড়া করতে চান না। তবে, সামর্থ্যের প্রশ্নটি অবশ্যই থাকে, সেটি সবার জন্য বাস্তবতার রাস্তা দেখায় না। যারা সে সুযোগটি সময়মতো পেয়ে থাকেন তারা অবশ্যই নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন। যেদিন প্রথম ওমরাহ্‌ পালন করে বাবাকে জানিয়ে ছিলাম- ‘বাবা, ওমরাহ্‌ হজ পালন করেছি এবং আপনার নামে উৎসর্গ করেছি। বাবা জানিয়ে ছিলেন তার অন্তরে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে’। কারণ বাবার আর্থিক এবং শারীরিক সামর্থ্য কোনটাই তখন ছিলো না। কিন্তু অনুভূতিটি তখনও প্রবল ছিলো। এই অনুভূতি থেকে একজন ইসলাম বিশ্বাসীকে হজ কী পরিমাণ উজ্জীবিত করে সেটা আমরা অনুমান করতে পারি।
আমাদের দেশে হাজীদের সংখ্যা প্রতি বৎসরই বাড়ছে। এবৎসর সে সংখ্যাটা প্রায় লাখের কাছাকাছি। সাধারণ হাজীদের সাথে রাজনীতিকদের হাজী হবার প্রবণতাও এখন তীব্র। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের হাজী হবার মাত্রাটা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। ক্ষমতা হাতে থাকলে অনেক সহকারী পাওয়া যায়, যাদের উপর দায়িত্ব দিয়ে একটু সময় বের করে নেয়ার সুযোগ পাওয়া কঠিন হয় না। আর সে কারণেই রাজনীতিক হাজীদের কাছে, সাধারণ মানুষের নয়া আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়। তার উপর হাজী সাহেব যদি হন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন রাজনীতিক। হাজী দানেশও ছিলেন একজন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, তিনি অবশ্য ক্ষমতার রাজনীতি করেন নি। কিন্তু গণমানুষের অধিকারের লড়াইতে কোনদিন পিছ পা হন নি। মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি এঁর কথা আমরা সকলে জানি, যে পরিমাণে তিনি স্ব-ধর্মে আস্থাবান ছিলেন, সেই পরিমাণে তিনি সমাজতন্ত্রেও বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং সমাজতন্ত্রী হাজী হতে পারবে না এমন কথা কোথাও লেখা নেই।
বরং সমাজতন্ত্র- সাম্য, সমতা, ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করে- ইসলামেও তাই। তাহলে কমরেড হাজী সাহেবরা এবার যদি সত্যি উভয় বিশ্বাসকে সমন্বয় করে তাদের মন্ত্রণালয় চালাতে শুরু করেন,            তাহলে মন্ত্রণালয়ের গতানুগতিক চেহারাটাই যে বদলে যাবে তাতে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ থাকে না। যারা হজ করতে যান তারা তওবা করেন। জীবনের ভুল-ত্রুটি ও অপরাধের তওবা। আবার ওয়াদাও থাকে জীবনের বাকি দিনগুলো সেই পুরনো রাস্তায় ফিরে না যাওয়ার। আল্লাহ্‌র কাছে করা এই ওয়াদার বাস্তবতা আমরা আমাদের সমাজ জীবনে খুব একটা দেখতে পাই না। যদি এমনটা হতো, এই এক লক্ষ মানুষ যারা হাজী হয়ে এসেছেন, তারা আর পাপের জীবনের ধারে কাছেও যাবেন না এবং তাদের পরিবার পরিজনকেও যেতে দেবেন না, তাহলে আমাদের সমাজে যে বিপ্লব হয়ে যেতো সেটা নিশ্চিত। কিন্তু হয় বিপরীত। আমাদের এখানের একজন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা বছর তিনেক আগে হজ করে এসেছেন, মানুষজন এখন তাকে মিথ্যুক হাজী বলে ডাকেন। আমার অভিজ্ঞতা নেই, তবে অনেককেই বলতে শুনেছি তিনি নাকি মসজিদে দাঁড়িয়েও মিথ্যা বলেন। কমরেড হাজীদের কাছে আমরা নিশ্চয়ই এমনটা আশা করবো না। কারণ সমাজতন্ত্রীরা সংস্কৃতিতে গভীর বিশ্বাস রাখেন, তাই মিথ্যা বলাটা সেখানেও সম্মানের নয়, আর ইসলামের তো কথাই নেই, একেবারে নিষিদ্ধ। রাজনীতিক হাজীরা যদি সেটি মনে রেখে, গণমানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট থাকেন তাহলে শান্তি আসবেই। বাস্তবে রাজনীতিক হাজীরা সে পথের বিপরীতে, এবার কমরেড হাজী সাহেবরা সে কাজটি শুরু করতে পারেন। এদেশের সাধারণ মানুষ এইটুকু আশা করতেই পারেন।

জীবন একটি দলগত খেলা



জীবন একটি দলগত খেলা

আবদুল্লাহ্‌ মাযরান ॥ একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, ‘তুমি যদি কাউকে একটি মাছ দাও, তাহলে তুমি তার এক দিনের খাবারের ব্যবস্থা করলে। কিন্তু তুমি যদি কাউকে মাছ ধরা শেখাও তাহলে তুমি তার সারা জীবনের খাবারের ব্যবস্থাই নিশ্চিত করে দিলে’। অভিভাবক ও সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত শিশুদের হাতে মাছ তুলে না দিয়ে মাছ ধরতে শেখানো। আমরা যদি শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ আর সহায়তা দিই, তাহলে সরকারকে বেকার সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে না।
আমরা শিশুদের জ্ঞান দিই, কী কী করা উচিত নয়। কাউকে মেরো না, তর্ক কোরো না, এমন আরও শত শত বিধি-নিষেধ! আমরা তাদের বলি, সবচেয়ে ভালো চাকরিটাই পেতে হবে। স্কুলের শিক্ষক বলেন, চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী হতে না পারলে আর জীবনে হলোটা কী! টেলিভিশন আর পত্রিকা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, যদি একবার মডেল, গায়ক কিংবা নায়ক হতে পারো, তাহলে তোমাকে আর পায় কে! আমাদের এমবিএ প্রোগ্রামে উদ্যোক্তা হতে শেখানো হয় না। সেখানে শুধু শেখানো হয়, কীভাবে বড় বড় কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে। এসব বড় বড় কোম্পানি যারা তৈরি করছে তারা উদ্যোক্তা। অথচ আমরা তোতাপাখির মতো শিখিয়ে যাচ্ছি, ‘উদ্ভট কিছু করার চেষ্টা কোরো না। সবাই যা করে, সেটাই করো। ভালো ছাত্র হও’। উদ্যোক্তা হতে হলে এমবিএ করতেই হবে, স্কুলে ভালো ফল করতেই হবে- এমন কোনো কথা নেই।
আমরা শুধু ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য প্রাইভেট টিচার দিয়েই মনে করি দায়িত্ব শেষ! কিন্তু না, তাদের নেতৃত্ব দিতে শেখাতে হবে। তাদের মনে মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে জানতে হবে। সব মানুষই আসলে উদ্যোক্তা হয়ে জন্ম নেয়। মানুষ যখন গুহায় বাস করত, তখন তারা সবাই ছিল এক অর্থে উদ্যোক্তা। তারা নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করত, নিজেদের কাজের সংস্থানও করত। এভাবে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমেই মানব ইতিহাসের সূচনা হয়েছে। সভ্যতার সূচনালগ্নে বেকার বলে কোনো শব্দ ছিল না। কিন্তু সময় যত পেরিয়েছে, আমরা আমাদের সহজাত উদ্যোক্তাসুলভ মনোভাবকে তত দমিয়ে ফেলেছি। আমরা উদ্যোক্তা থেকে পরিণত হয়েছি শ্রমিকে। আমাদের মগজে পাকাপাকিভাবে এই ধারণা ঢুকে গিয়েছে যে আমাদের চাকরি করতে হবে।
পৃথিবী এখন বিশ্বায়ণ আর প্রযুক্তির কল্যাণে যত দ্রুত বদলে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। গত দশকে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ধাপে ধাপে তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলত। কর্মক্ষেত্রে তার কাজের একটি নির্দিষ্ট বিভাগ থাকত, ক্যারিয়ারের পথ ছিল সুনির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। যে কোম্পানিতেই কাজ করুক না কেন, সে সেই ছকের ভেতরে থেকেই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেত। কিন্তু বিশ্বায়ণ যেখানে প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছে, সেখানে ক্যারিয়ার-ভাবনাও বদলে ফেলতে হবে। আগে ক্যারিয়ার ছিল একটি সোজা ওপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি, এখন তা পরিণত হয়েছে গোলকধাঁধার মতো এক পাহাড়ি এলাকায়। এখান উপরে উঠতে হলে কখনো নিচেও নামতে হতে পারে, অনেক চড়াই-উতরাই পাশ কাটিয়ে যেতে হতে পারে বুদ্ধি করে, কখনো কখনো ঝুঁকি নিয়ে লাফ দিতেও হতে পারে। আবার সময়ের প্রয়োজনে হয়তো পাহাড়ের পাদদেশে নেমেও আসতে হতে পারে।
কিছুই একরকম থাকবে না, কখনো থাকে না। যা আছে তা বদলায়, কখনো বদলে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু তৈরি হয়, কখনো আগে যা ছিল তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। আধুনিক ক্যারিয়ার প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনকেই শিক্ষার্থীদের  একমাত্র স্থায়ী ব্যাপার বলে ধরে নিতে হবে। আশপাশের সবকিছুই বদলে যাবে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা ও সামর্থ্যকেও দ্রুত বদলে ফেলতে হবে। বর্তমান সময়ে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন কৌশল। আর সেই কৌশলটি হলো, উদ্যোক্তাদের মতো চিন্তা করা। বসে বসে দীর্ঘ পরিকল্পনা করে জীবন পার করে দিলে চলবে না, কাজে নেমে পড়তে হবে। নিজের কাজ, নিজের ক্যারিয়ার নিজেকেই সৃষ্টি করে নিতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করা। যার নেটওয়ার্ক যত শক্তিশালী হবে সে তত বেশি তথ্য পাবে, ব্যবহারিক জ্ঞান পাবে। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক যে কোন ক্ষেত্রে সফল হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা ও দুর্যোগ এড়িয়ে যাওয়া যায়, অনেক নতুন সম্ভাবনাও খুঁজে বের করা যায়, শুধু একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক শুধু পরিচিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না- মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আছে তারা এবং তাদের পরিচিত মানুষেরা, এমনকি সেই মানুষদের পরিচিত মানুষেরা সবাই এক অদৃশ্য সুতায় জড়িয়ে আছে। জীবন একটি দলগত খেলা। আশপাশের সবকিছু, দলের সবাইকে নিয়েই গড়ে উঠে ব্যক্তিত্ব।
পৃথিবী খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তাই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা আর নতুন কিছু আবিষ্কার করার তাগিদও দিন দিন বাড়ছে। পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে হলে উদ্যোক্তাদের মতো ভাবতে হবে।
যখন কেউ নতুন কিছু করে, পরিবর্তনের কথা বলে, তখন অধিকাংশ সময়ই তার পরিচিত মানুষেরা কিংবা নিজের দেশের লোকেরা তার যথাযথ মূল্যায়ণ করতে পারে না। স্বদেশে সে হয়তো উপহাসের পাত্র হয়, কিন্তু দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে ঠিকই তার কদর বুঝতে পেরে সমাদ্রিত করে ধন্য করে। সত্যকে প্রথম প্রথম কেউই মেনে নিতে না চাইলেও একসময় তা নিজগুণেই প্রকাশিত হয়। তত দিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাকে মেনে নেয়ার মানসিকতাও গড়ে ওঠে। আপনা-আপনিই তখন লোকে সেই আদর্শে চলতে থাকে, যে আদর্শকে তারাই একদিন তাচ্ছিল্য করেছিল।

জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্বিধাবিভক্তি



জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্বিধাবিভক্তি

শেখ উল্লাস ॥ জাতীয় প্রেস ক্লাবের হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে গত ১৮ই অক্টোবর শনিবার ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও জাতীয় প্রেসক্লাব’ শীর্ষক সেমিনারে বর্তমান সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা থেকে যেসব কথা উঠে এসেছে    তা আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, জাতীয় প্রেসক্লাব তথা দেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক সমাজ কতটা দ্বিধাবিভক্ত। সেমিনারে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও এটি শেষ হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাব ভাঙনের সুর  দিয়ে। ক্লাবের একজন সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক সমাজের দ্বিধাবিভক্তির কথা স্বীকার করে বলেছেন, বহুমতের প্রতিফলন ঘটানোর একটি জায়গা প্রেসক্লাব। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ক্লাব চত্বরকে ‘ডেমোক্রেসী স্কয়ার’ নাম দেয়া হয়েছিল। সেই ক্লাব লেজুরবৃত্তি, দলীয় স্বার্থসিদ্ধি ও ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কারণে সমালোচিত হচ্ছে’। তবে তিনি এও বলেছেন, অন্যান্য পেশার সঙ্গে তুলনা করলে সাংবাদিকতা এখনো ততটা পঁচে যায়নি’।
১৯৯২ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিউজে) এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফউজে) ভাঙনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সরকার-সমর্থক ও সরকার-বিরোধী বলে পরিচিত সাংবাদিকদের দু’টি ফোরামে বিভক্তি ঘটে। এই বিভক্তির পেছনে তৎকালীন  সরকার ও সরকারের তথ্যমন্ত্রীর প্ররোচনা কাজ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এই দুই ফোরামের নেতারাই স্বীকার করেছেন, ইউনিয়ন বিভক্ত হওয়ার জন্য সাংবাদিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন প্রেসক্লাব ভাঙলে সাংবাদিকদের অস্তিত্বের সংকট তৈরি হবে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন রাজনৈতিক কারণে ও ব্যক্তিস্বার্থে পণ্ড হয়ে গেছে বলেও কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন। সেমিনারে বক্তৃতা করতে গিয়ে ক্লাবের আরেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক বলেন, প্রেসক্লাব এখন সাংবাদিকদের জায়গা নয়। এখানে সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে ভোটের চিন্তাই আগে আসে। এ অবস্থায় দাবি ও আওয়াজ উঠেছে প্রেসক্লাব ভেঙে দেয়ার। সেমিনারের শেষ ভাগে এই সাংবাদিক নেতা আবারো বলে উঠেন, এই ক্লাব ভাঙবেই ভাঙবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।
১৯৯২ সালে ডিউজে ও বিএফউজে দু’টি ফোরামে বিভক্ত হওয়ার পর জাতীয় প্রেসক্লাব আনুষ্ঠানিকভাবে না ভাঙলেও এর কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে বিএনপি ও জামাতের অনুসারীরা প্রায় প্রতি বছর একচ্ছত্রভাবে পাশ করার ফলে এই ক্লাবে এই ধারার সাংবাদিকদেরই আধিপত্য তৈরি হয়েছে। এ কারণে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদও এই ধারার লোকজন যত সহজে পেয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রে একজন পেশাদার সাংবাদিক অনেক চেষ্টা করেও তা পায় না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যদের (যারা প্রেসক্লাবের নির্বাচনের ভোটার) তালিকার দিকে তাকালে দেখা যায়, বিএনপি-জামাতের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত রাজধানীর অধিকাংশ ‘বিশিষ্ট’ লোকই এই ক্লাবের সদস্য। জাতীয় প্রেসক্লাবের এই অব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকেই বিগত ৯০’র দশকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), সাব-এডিটরস্‌ ফোরাম, সাব-এডিটরস্‌ কাউন্সিলসহ অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠেছে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা এখন এমনই যে, নানা নামে ও কর্ম নিয়ে সাংবাদিকদের যত বেশি সংগঠন গড়ে উঠেছে দেশ ও সমাজের প্রতি সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিকতার অঙ্গীকার পূরণের দিকটি ততই যেন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কিছু সংখ্যক সাংবাদিক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান এবং প্লট-ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন, কেউ কেউ সূদুর আমেরিকায়ও নিজেদের আখের গুজিয়েছেন সত্য। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের বিশাল জগৎটির পুরো মালিকানাই আজ নব্য ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক চক্রের হাতে চলে গেছে। সেখানে সাংবাদিকরা যে নিছক চাকুরীজীবীতে পরিণত হয়েছেন, যেখানে সাংবাদিকদের পেশার স্বাধীনতার চাইতে মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে-সে দিকটির প্রতি যেন কারোরই খেয়াল নেই। সাংবাদিকদের অস্ত্বিত্বের সংকট তৈরি হয়েছে বলে আজ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ১৫/২০ বছরে এদেশের গণমাধ্যম জগতটিতে যেভাবে অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে, সাংবাদিকদের পেশাগত শক্তি, সাংবাদিকদের ইউনিয়নের শক্তি সেভাবে বিকশিত না হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতা তাই আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এদেশের রাজনীতি ও সাংবাদিকতা  এক সময় হাতে হাত ধরে এগিয়ে গেছে। এক সময় রাজনীতিতে পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের যে বিরাট প্রভাব ছিল, তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আজ হয়তো শুনতে অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার যে, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, আকরাম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, সাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকালের অগ্নিপুঁরুষ সূফী সাধক ভাসানী, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আব্দুস সালাম, তফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং কিছুদিন আগেও সন্তোষ গুপ্ত, ওয়াহিদুল হক, বজলুর রহমান প্রমুখ মনিষী সবাই ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক ও সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব। সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কর্মে নিয়োজিত ছিলেন বলে তারা আজও রাজনীতি ও সাংবাদিকতা জগতে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের কর্মের ধারাবাহিকতায় এদেশে সৃষ্ট জাতীয় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হলে আজকের দিনের সাংবাদিকদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় লেজুরবৃত্তির সংস্কৃতি থেকে  বেরিয়ে আসতে হবে। সাংবাদিকদেরকে যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ পেশা ও কর্মের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। যে নিজেকেই সম্মান দিতে জানে না, তাকে অন্য পেশা ও জগতের লোকজন সম্মান দেখাবে না-এটাই সত্য। তাই আজকের দিনের সাংবাদিকদের ঘুরে দাঁড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। যারা এ পেশায় দক্ষ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যারা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী তাদেরকে প্রেসক্লাবের সদস্য পদ দিয়ে প্রেসক্লাবের মর্যাদা বাড়াতে হবে। নচেৎ, সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর মতো জাতীয় প্রেসক্লাবও ভেঙ্গে গিয়ে দেশবাসীর কাছে সাংবাদিক সমাজের ভাবমূর্তির আরো শোচনীয় অবস্থা ডেকে আনতে পারে। মানুষকে সত্যিকারভাবে ভালো না বেসে, নিজ কর্ম ও পেশার প্রতি নিষ্ঠাবান না হয়ে শুধুমাত্র মিথ্যাচারের রাজনীতির সুফলভোগী হওয়ার অপচেষ্টায় নিয়োজিত কোন সংবাদকর্মী তার নিজের এবং দেশ ও দেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তা ভেবে দেখা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।