বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪

আচারিক ধর্মে সামাজিক বিন্যাস

আচারিক ধর্মে সামাজিক বিন্যাস

আব্বাস মোহান্দিস ॥ মানুষের মাঝে ধর্ম চেতনা কখন, কোথায় জেগে উঠেছিল, তার পরিপূর্ণ ইতিহাস জানা সম্ভব না হলেও এটা অনুমান করা মোটেই অসম্ভব নয় যে, সভ্য মানুষের সামাজিক চেতনাই তার আত্মজিজ্ঞাসাকে উন্মুক্ত করে ধর্ম চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিল। এই ধর্ম চেতনা সামাজিক মানুষের যূথবদ্ধতায় আজও একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। ধর্ম মানুষের সমাজকে তার প্রগতির পথে সহায়ক না বাধা সৃষ্টি করেছে তা তর্কাতীত নয়, কিন্তু ধর্ম চেতনা মানব সমাজকে বারবার যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রক্ত গঙ্গার মধ্য দিয়ে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়েছে সে  ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। আজও থেমে নেই ধর্ম চেতনাকে ব্যবহার করে রক্ত বন্যার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গোটা মধ্যপ্রাচ্য জ্বলছে শিয়া-সুন্নীর অগ্নীদহনে। আবার এই ধর্ম চেতনাই সামাজিক মানুষের প্রয়োজনে পতিত মানব সমাজকে দিক্‌ দিশার আলোকবর্তিকা দিয়ে এগিয়ে যাবার পথ তৈরি করেছে। তবে এটা নিশ্চিত বলা যায়, ধর্মচেতনার উদ্ভব মানব সভ্যতার উষালগ্নেই। তার বিস্তার আজও অব্যাহত আছে জীবন চলার পথে।
মানুষ তার জীবন প্রয়োজনে যে ধর্মকে আবিষ্কার করেছে, কালে কালে তার সংস্কারও করেছে- কোন ধর্মই আদি বা অকৃত্রিম থাকে নি। সেটাই সামাজিক মানুষের চৈতন্য বাস্তবতা। সেই বাস্তবতায় আজও অনন্ত জিজ্ঞাসা, ধর্ম কী? ধর্মপ্রবক্তারা তার বিশ্লেষণ যেমন করেছেন তেমনি বৌদ্ধিক জনেরা আজও তা অনুসন্ধান করে চলছেন। শাহ সূফী ড. এমদাদুল হক তাঁর 'কুরবানি বনাম পশু জবাই' বইটিতে এ বিষয়টিকে দেখছেন এভাবে- “অপ্রয়োজনে প্রথা ও রীতি-নীতির অনুকরণ ধর্ম নয়। ধর্ম তো ধারণ করা। যা ধারণায় ছিল এবং দৈনন্দিন কর্মপ্রবাহে যা ধৃত হয় তা-ই ধর্ম! জীবনের প্রয়োজনে কখন, কোথায়, কী, কীভাবে, কতটুকু ধারণ করা সম্যক তা নির্ণয় করে পূর্বধারণা। ধারণের বিষয়বস্তু, গতি, গুণ ও পরিমাণ কালে কালে রূপান্তরিত হয় বিজ্ঞান ও পরিবেশের রূপান্তরে। পরিবর্তনের ধারায় ধর্মের আচারিক আনুষ্ঠানিকতা তার সামাজিক শক্তিকে সংগঠিত যেমন করেছে তেমনি সংস্কার সংকীর্ণতা অহং এবং বিচ্ছিন্নতাকেও প্রসারিতও  করেছে। এই বাস্তবতায় গুজরাটের দাঙ্গা কিংবা আমাদের রামু ট্র্যাজিডিসহ অসংখ্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের বন্য বর্বরতাকে আমরা দেখতে পাই।
পৃথিবীর এমন কোন ধর্ম নাই যা শান্তির জন্য নয় বরং শান্তিকে ধারণ করবার সামাজিক যূথবদ্ধতাকে স্বীকার করতে ধর্মের আচারিক অনুষ্ঠান বা আনুষ্ঠানিকতা। একজন মানুষের ব্যক্তিক জীবনের শান্তির প্রত্যয় সামাজিক জীবনের অনন্য পৌরুষকে নির্ণয় করে। অথচ আমরা এর বিপরীতটাকেই প্রত্যক্ষ অথবা গ্রহণ করে থাকি। ধর্মনিষ্ঠাবান কেউ সেটাকে গ্রহণ করতে পারেন না। তাই তারা ব্যক্তিক অনন্য বিশ্বাসকে আত্মস্থ করে সামাজিক সমন্বয়কে গ্রহণ করেন। জাতপাত বর্ণ কিংবা অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের প্রতি কোন রকম হিংসা-প্রতিহিংসা কিংবা জিঘাংসার প্রশ্রয় দিতে প্রস্তুত নয়। উপমহাদেশে ধর্ম সমন্বয়ের কাজটি শুরু হয় সূফী সাধকদের আগমন কাল থেকে। যদিও বৈদিক ধর্মের আত্ম উন্নয়নের ব্যাপকতা বৌদ্ধ ধর্মের ধারাবাহিক অহিংসা প্রণয় লাভ করলেও তার ঐতিহাসিক স্থিতি রাজনীতির ডামাডোলে হারাতে বাধ্য হয়। কিন্তু এর একটি সফল প্রক্রিয়া শুরু করেন সম্রাট আকবর তার 'দীন-ই-ইলাহী' ধর্মধারার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সনাতনে তার শিকড় যেমন সামাজিক গভীরতা পায় নি তেমনি আগত মুসলিম ব্যবস্থাপনায়ও তার সাংস্কৃতিক প্রথা ভেঙ্গে প্রথা তৈরিতে স্থায়িত্ব পায় নি। রাজা রামমোহন রায় সে কাজটিকে এগিয়ে নেবার একটি প্রচেষ্টা নিষ্ঠার সাথে করেছিলেন, সেই পথ ধরেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'মানুষের ধর্ম' আবিষ্কার করেন। মানুষই ধর্মের আবিষ্কারক, মানুষই তার ধারক, মানুষই তাকে লালন করে মানুষের জন্য। তাই মানুষের ধর্ম ভেদ-বুদ্ধির জন্য নয়, ঘৃণা অস্পৃশ্যতা সৃষ্টির জন্য নয়, অন্যকে দখল-দমন করার জন্য নয়, অন্যকে শাসন-ত্রাসনের জন্য নয়- একান্তই মানুষের মানবিকতায় অনন্যতা বিকাশের সামাজিক চেতনাবোধকে উন্নত করতে ধর্ম মানুষের জন্য। তার অন্তরস্থ বিশ্বাস ন্যায়বোধকে উন্নত করতে না পারলে ধর্মের নামে বর্বরতাকেই আত্মস্থ করা হয়। আদি ধর্মনিষ্ঠাবানরা সেই সত্যকে উপলব্ধি করে আচারিক ধর্মের সামাজিকায়ণ করেন।
ষষ্ঠি পূজায় দেবীর আগমনী বার্তা বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে আনন্দ বার্তা পৌঁছে দেয়। ঢাকের বাদ্যের তালে তালে অঞ্জলি প্রস্তুত দেবীর আরতির জন্য। কিন্তু সেই অঞ্জলি দেবার জন্য ভক্তের অন্তরের দরজাটি যদি উন্মুক্ত না হয় মানুষের চিরকালীন অনন্ত ভালোবাসার পথকে উন্মুক্ত করতে, তা হলে দেবীর আগমনী সুর লহরি অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জিত হবে কীভাবে? বিশ্বাস যুক্তির বাইরে গেলে তা যেমন অন্ধত্বের শিকল পড়িয়ে দেয়, তেমনি আচারিকতার মৌল চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রাখলে তা সামাজিক বিশ্বাস এবং আস্থায় ফাটল ধরায়। সেই অন্ধত্ব থেকেই আসে কর্তৃত্ববাদিতার স্বার্থ গৃধ্নুতা। এখানেই মানবতা পরাজিত হয়,  উঠে আসে অসুরেরা। প্রতি বছরই দেবী আসেন অসুর বধে, কিন্তু ফিরে যেতে হয় খালি হাতে, কারণ প্রতিবারই ভক্তরা নিজেদেরকে আলাদা রাখেন নিজেদের অন্তর চেতনার বদ্ধ কুঠুরিতে। তাই 'ওম শান্তির' চিরন্তন প্রবাহ শঙ্খনিনাদে ধ্বনিত হয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে যায় স্বর্গলোকে।
ঢাকের গুরু গুরু আওয়াজের সাথে মুসলমান সম্প্রদায়ের দুয়ারে কুরবানি হাজির হয়ে যায়। বাঙালির দুই ধর্মের সামাজিক উৎসবের এমন যমজ আগমন সহসা ঘটে না। কিন্তু ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার বদলে প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক আচারিকতায় কখন যে মানবিকতা হারিয়ে পশু নির্যাতনের নির্মমতার অসুরকে ধারণ করে নিয়েছে নিজেরাই টের পায় নি। সীমাহীন লোভ কী পরিমাণ নির্যাতনের অসুরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তার নমুনা মোটাতাজা করণ প্রক্রিয়ায়। আর বাজারিরা ছুটেছেন প্রতিযোগিতায় নিজের বিত্ত-বৈভবের প্রমাণ দিতে। সামাজিক মানুষদের কাছে প্রমাণ করতে হবে, নিজের ত্যাগ প্রাকৃতিক রেখে, চতুস্পদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পৌরুূষ দেখাবার। সাধক কবি নজরুল এখানে এসে চিৎকার দিয়ে উঠেছেন- 'ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা'। সুতরাং নিজের চিত্তকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ত্যাগের আদর্শকে ধারণ করা যায় না। ত্যাগ একটি স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিনির্মাণ প্রক্রিয়া। এর অব্যাহত প্রচেষ্টা মানুষকে ধার্মিকতার বিশ্বাসের দিকে দৃঢ় চিত্ত করে তোলে। আর এটাই মানুষকে হিংসা-প্রতিহিংসার প্রলম্বিত জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে শান্তির পথকে প্রশস্ত করে দেয়। তাই ত্যাগের বিশ্বাসী অর্থাৎ কুরবানি হবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে ত্যাগকে ফরজ করা হয়েছে ইসলামে মৌল বিশ্বাসে। সেখানে প্রস্তুতিহীনতা উদ্দেশের সফলতা এনে দেয় না। আক্ষরিক অর্থেই সেখানে ত্যাগের মহিমা ডুবে গিয়ে লোভের কামাতুর জিহ্বা বেড়িয়ে আসা ছাড়া  কোন উপকার করে না।

তাই সামাজিক আচারিকতা আনন্দের বন্ধনহীন প্রলয় নয় মোটেও, তা একান্তই পারস্পরিক চেনার উন্নত ধারণারই প্রকাশ মাত্র। আর সেখান থেকে বিশ্বাসটি একান্তই সমূলের কিন্তু উপভোগ্যতা সামাজিক মানুষ সকলের। আনন্দের বিহার নয়- সম্মিলন। বাঙালি সমাজে এই সম্মিলনটা অতি প্রাচীন, শ্রদ্ধা ভালোবাসার এক অনন্য প্রাসাদ, তাকে বিনম্রচিত্তে গ্রহণ করে কালিক ভাবনাকে প্রজন্মের অধিকার করে রেখে যাওয়াটাই মানুষের কর্তব্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন