জাতীয় প্রেসক্লাবে
দ্বিধাবিভক্তি
শেখ উল্লাস ॥ জাতীয় প্রেস ক্লাবের হীরকজয়ন্তী উপলক্ষে গত
১৮ই অক্টোবর শনিবার ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও জাতীয় প্রেসক্লাব’ শীর্ষক সেমিনারে বর্তমান
সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের আলোচনা থেকে যেসব কথা উঠে এসেছে তা আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, জাতীয়
প্রেসক্লাব তথা দেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক সমাজ কতটা দ্বিধাবিভক্ত। সেমিনারে বাংলাদেশের
সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও এটি শেষ হয়েছে জাতীয় প্রেসক্লাব ভাঙনের সুর দিয়ে। ক্লাবের একজন সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক
সমাজের দ্বিধাবিভক্তির কথা স্বীকার করে বলেছেন, বহুমতের প্রতিফলন ঘটানোর একটি জায়গা
প্রেসক্লাব। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ক্লাব চত্বরকে ‘ডেমোক্রেসী স্কয়ার’
নাম দেয়া হয়েছিল। সেই ক্লাব লেজুরবৃত্তি, দলীয় স্বার্থসিদ্ধি ও ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার
কারণে সমালোচিত হচ্ছে’। তবে তিনি এও বলেছেন, অন্যান্য পেশার সঙ্গে তুলনা করলে সাংবাদিকতা
এখনো ততটা পঁচে যায়নি’।
১৯৯২ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিউজে) এবং বাংলাদেশ ফেডারেল
সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফউজে) ভাঙনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সরকার-সমর্থক ও সরকার-বিরোধী
বলে পরিচিত সাংবাদিকদের দু’টি ফোরামে বিভক্তি ঘটে। এই বিভক্তির পেছনে তৎকালীন সরকার ও সরকারের তথ্যমন্ত্রীর প্ররোচনা কাজ করেছিল
বলে অভিযোগ রয়েছে। এই দুই ফোরামের নেতারাই স্বীকার করেছেন, ইউনিয়ন বিভক্ত হওয়ার জন্য
সাংবাদিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন প্রেসক্লাব ভাঙলে সাংবাদিকদের অস্তিত্বের সংকট
তৈরি হবে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
রাজনৈতিক কারণে ও ব্যক্তিস্বার্থে পণ্ড হয়ে গেছে বলেও কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন।
সেমিনারে বক্তৃতা করতে গিয়ে ক্লাবের আরেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক বলেন, প্রেসক্লাব এখন
সাংবাদিকদের জায়গা নয়। এখানে সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে ভোটের চিন্তাই আগে আসে। এ অবস্থায়
দাবি ও আওয়াজ উঠেছে প্রেসক্লাব ভেঙে দেয়ার। সেমিনারের শেষ ভাগে এই সাংবাদিক নেতা আবারো
বলে উঠেন, এই ক্লাব ভাঙবেই ভাঙবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।
১৯৯২ সালে ডিউজে ও বিএফউজে দু’টি ফোরামে বিভক্ত হওয়ার পর
জাতীয় প্রেসক্লাব আনুষ্ঠানিকভাবে না ভাঙলেও এর কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনে বিএনপি
ও জামাতের অনুসারীরা প্রায় প্রতি বছর একচ্ছত্রভাবে পাশ করার ফলে এই ক্লাবে এই ধারার
সাংবাদিকদেরই আধিপত্য তৈরি হয়েছে। এ কারণে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদও এই ধারার লোকজন
যত সহজে পেয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রে একজন পেশাদার সাংবাদিক অনেক চেষ্টা করেও তা পায় না।
ফলে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যদের (যারা প্রেসক্লাবের নির্বাচনের ভোটার)
তালিকার দিকে তাকালে দেখা যায়, বিএনপি-জামাতের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে
যুক্ত রাজধানীর অধিকাংশ ‘বিশিষ্ট’ লোকই এই ক্লাবের সদস্য। জাতীয় প্রেসক্লাবের এই অব্যবস্থাপনার
কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ থেকেই বিগত ৯০’র দশকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), সাব-এডিটরস্
ফোরাম, সাব-এডিটরস্ কাউন্সিলসহ অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠেছে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে। কিন্তু
বাস্তবতা এখন এমনই যে, নানা নামে ও কর্ম নিয়ে সাংবাদিকদের যত বেশি সংগঠন গড়ে উঠেছে
দেশ ও সমাজের প্রতি সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিকতার অঙ্গীকার পূরণের দিকটি ততই যেন ক্ষীণ
হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কিছু সংখ্যক সাংবাদিক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান এবং প্লট-ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ির
মালিক হয়েছেন, কেউ কেউ সূদুর আমেরিকায়ও নিজেদের আখের গুজিয়েছেন সত্য। কিন্তু সময়ের
বিবর্তনে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের বিশাল জগৎটির পুরো মালিকানাই আজ নব্য ব্যবসায়ী ও
বাণিজ্যিক চক্রের হাতে চলে গেছে। সেখানে সাংবাদিকরা যে নিছক চাকুরীজীবীতে পরিণত হয়েছেন,
যেখানে সাংবাদিকদের পেশার স্বাধীনতার চাইতে মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থই বড় হয়ে দেখা
দিয়েছে-সে দিকটির প্রতি যেন কারোরই খেয়াল নেই। সাংবাদিকদের অস্ত্বিত্বের সংকট তৈরি
হয়েছে বলে আজ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ১৫/২০ বছরে এদেশের গণমাধ্যম জগতটিতে যেভাবে অর্থ
বিনিয়োগ হয়েছে, সাংবাদিকদের পেশাগত শক্তি, সাংবাদিকদের ইউনিয়নের শক্তি সেভাবে বিকশিত
না হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতা তাই আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এদেশের রাজনীতি
ও সাংবাদিকতা এক সময় হাতে হাত ধরে এগিয়ে গেছে।
এক সময় রাজনীতিতে পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের যে বিরাট প্রভাব ছিল, তা আজ হারিয়ে
যেতে বসেছে। আজ হয়তো শুনতে অনেকের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার যে, শেরে বাংলা একে ফজলুল
হক, আকরাম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, সাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকালের অগ্নিপুঁরুষ
সূফী সাধক ভাসানী, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আব্দুস সালাম, তফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া,
শহীদুল্লাহ কায়সার এবং কিছুদিন আগেও সন্তোষ গুপ্ত, ওয়াহিদুল হক, বজলুর রহমান প্রমুখ
মনিষী সবাই ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক ও সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব। সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধ
থেকে কর্মে নিয়োজিত ছিলেন বলে তারা আজও রাজনীতি ও সাংবাদিকতা জগতে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
তাদের কর্মের ধারাবাহিকতায় এদেশে সৃষ্ট জাতীয় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর মর্যাদা
সমুন্নত রাখতে হলে আজকের দিনের সাংবাদিকদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় লেজুরবৃত্তির
সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সাংবাদিকদেরকে
যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ পেশা ও কর্মের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। যে নিজেকেই সম্মান
দিতে জানে না, তাকে অন্য পেশা ও জগতের লোকজন সম্মান দেখাবে না-এটাই সত্য। তাই আজকের
দিনের সাংবাদিকদের ঘুরে দাঁড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। যারা এ পেশায় দক্ষ ও অভিজ্ঞতা অর্জন
করেছে, যারা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী তাদেরকে প্রেসক্লাবের সদস্য পদ দিয়ে প্রেসক্লাবের
মর্যাদা বাড়াতে হবে। নচেৎ, সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর মতো জাতীয় প্রেসক্লাবও ভেঙ্গে গিয়ে
দেশবাসীর কাছে সাংবাদিক সমাজের ভাবমূর্তির আরো শোচনীয় অবস্থা ডেকে আনতে পারে। মানুষকে
সত্যিকারভাবে ভালো না বেসে, নিজ কর্ম ও পেশার প্রতি নিষ্ঠাবান না হয়ে শুধুমাত্র মিথ্যাচারের
রাজনীতির সুফলভোগী হওয়ার অপচেষ্টায় নিয়োজিত কোন সংবাদকর্মী তার নিজের এবং দেশ ও দেশের
জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তা ভেবে দেখা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন