বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

লালন দর্শন প্রচারে বাধা আর কতকাল!!!

লালন দর্শন প্রচারে

বাধা আর কতকাল!!!

শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমিতে লালন উপেক্ষিত ॥ জাতীয়ভাবে লালন উৎসব  হয় না ॥ লালন একাডেমিতে সরকারের যুগোপযোগী কোন কর্মসূচি নেই ॥ নতুন প্রজন্মকে সত্যমানুষ সম্বন্ধে জানানোর কোন উদ্যোগ নেই ॥
নজরুল ইশতিয়াক ॥ বাঙালি রেনেসাঁর প্রাণ পুঁরুষ মহান সাধক লালন সাঁইজীর সৃষ্টিকর্মের উপর আঘাত নতুন নয়। সাঁইজীর জীবদ্দশায় ও পরবর্তী নানা সময়ে তাঁর অনুসারীদের উপর স্থানীয় উগ্রপন্থিদের হামলা, চুল কেটে ন্যাড়া করে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা, একঘরে করে রাখার ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য বার। তৎকালীন মুসলিম লীগের মন্ত্রী শামসুদ্দীন আহমেদের নির্দেশে লালন আখড়ায় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান চলাকালীন অবস্থায় শোধনসেবা ফেলে দেয়া ও লালন অনুসারীদের মারপিট করা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। অনুসন্ধানে দেখা যায় তথাকথিত ধর্মান্ধ মোল্লারা ফতোয়া দিয়ে বাউল নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে, হত্যা করা হয়েছে অনেক লালন ভক্তকে। ১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়ার তৎকালীন ডিসির নির্দেশে বাউলদেরকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। টেনে হিঁচড়ে বের করে দেয়া হয় আখড়া থেকে। রাজবাড়ীতে আহত করা হয় বহু বাউলকে, পন্ড করে দেয়া হয় বাউল অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন। সাম্প্রতিক কালে একাধিক বাউলকে হত্যা করা হয়েছে। মাঝে মধ্যেই সে সবের দৃশ্যায়ন হয় মাত্র।
সম্প্রতি নেত্রকোনায় ধর্মান্ধদের বাধার মুখে লালন উৎসব করতে দেয়া হয়নি। লিফলেট ছাপিয়ে ধর্মান্ধরা লালনের বাণীকে ধর্মীয় পরিপন্থি হিসেবে প্রচার করে। উগ্রপন্থি ধর্মান্ধদের অভিযোগের লিখিত উত্তর দেবার পরও প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। ইতোপূর্বে ধর্মীয় পবিত্রতা ক্ষুন্নের অজুহাতে ছেউড়িয়াস্থ সাঁইজী ধামে নির্ধারিত অনুষ্ঠান করতে দেয়া হয়নি। টেলিভিশনে ধর্মীয় খোদবায় লালন বিরোধী ফতোয়া দেয়া হয় প্রকাশ্যে। তথ্যপ্রযুক্তি মাধ্যম ইউটিউবে তথাকথিত ভন্ড ধর্মজীবীরা সাঁইজীকে নিয়ে মনগড়া কত ফতোয়া দিয়ে রেখেছেন তা কানে না শুনলে অনুধাবন করা যাবে না। আজ পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জাতীয়ভাবে লালন উৎসব করার প্রয়োজনীয়তা দেখায়নি। শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি , শিশু একাডেমিসহ সব সরকারী অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে লালনকে সচেতনভাবেই উপেক্ষা করা হয়েছে। এতকিছুর মধ্যেও ইতালি, জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, কাতার, আমেরিকায় লালন জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ইতালিতে লালন শাহ্ সড়ক, ফ্রান্সে বাউল শিল্পীদের বিশেষ সরকারী সহায়তা, জাপানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা চোখে পড়ার মতো। জানা মতে বিশ্বের ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লালন দর্শন পড়ানো হয়। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় লালন পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত। অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে লালন দর্শনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ভারতের কলকাতা আসাম বীরভূম অঞ্চলে লালন আরাধ্য নিত্য চর্চার বিষয়। আমাদের দেশে ও ভারতের বাউল ফকিরদের মধ্যে গভীর আন্ত:যোগাযোগ রয়েছে। ধর্ম পরিচয়ের উর্দ্ধে এ সম্পর্ক দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। সত্যি বলতে কলকাতা থেকেই লালন বিষয়ক বই সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে। ইউনেস্কোর তালিকায় রয়েছে লালন। জানা গেছে বছরে শতাধিক বিদেশী গবেষক আসেন  লালনকে জানতে, চিনতে বুঝতে। উপমহাদেশে সূফী সঙ্গিতে ফোক উৎসবে লালন চর্চা হয়। দেশে বিদেশের সাধনার পীঠগুলোতে ধর্ম বর্ণ সব পরিচয়ের উর্দ্ধে লালনবাণী গীত হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ব্যক্তিগত আগ্রহে লালন শিল্পীদের আমন্ত্রন করে গান শুনেছেন। বিভিন্ন দুতাবাসের কর্তাব্যক্তিরা সাঁইজীর আখড়া পরিদর্শন করে থাকেন। এত এত প্রাপ্তির ভীড়ে কেবলমাত্র নিজ দেশে রাষ্ট্র ও প্রগতিশীল নামধারী রাজনৈতিক শক্তির কাছে লালন উপেক্ষিত। রাজনৈতিক শক্তি লালনকে করুণা করে দয়া দাক্ষিণ্য করে এটিই এখন পর্যন্ত তাদের আচরনগত সত্য। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নামে মাত্র লালনস্মরনোৎসব করে থাকে। খুব নিম্ন মানের প্রকাশনা, এলোমেলো আয়োজন তাদের দৈন্যদশাকেই তুলে ধরে। জাতীয় পর্যায়ে লালন উৎসব করা হয় না। পরিচিত সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কোন উদ্যোগ আগ্রহ নেই সাঁইজীকে ঘিরে। কর্পোরেটরা বাণিজ্যিক কারণে কিছু অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। বামপন্থিরা লালনকে অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ মনে করে আর আওয়ামীলীগ ব্যবহার করে লোক লজ্জার ভয়ে।
লালনপন্থিদের উপর হামলার লম্বা পরিসংখ্যান রয়েছে। এমনকি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় কিভাবে লালনকে অবজ্ঞা করা হয়েছে, আজও করা হচ্ছে তা নিয়ে বিস্তর দলিল দেয়া যেতে পারে। সাঁইজীর চৌহদ্দী দখল করে মূল পরিসরকে ছোটো করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর একদিকে নিয়ন্ত্রন ব্যবসা, অন্যদিকে পান্ডিত্যের ব্যবসাকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যা আজো অব্যাহত। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজবাড়ি, যশোর, ঝিনাইদহে লালনপন্থিদের উপর হামলা নির্যাতন খুব স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যারা লালন একাডেমি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের একজনও লালন অনুসারী নন। এমনকি ন্যূনতম শ্রদ্ধা-ভক্তিও তারা দেখাতে পারেননি। স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের আচরণে এটাই প্রমানিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা লালন সাঁইজীকে উদ্ধার করতে এসেছেন। একাধিক জেলা প্রশাসক ও তাদের অধীনস্তরা মৎস শিকারী হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে প্রমোদ বিহার অথবা আনন্দ আয়োজন চালিয়েছেন সাঁইজীর মাজারের সম্পদে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীরা মিলে মিশে লালন সেবার নামে, লালন বন্দনার নামে যথেচ্ছাচার অব্যাহত রেখেছেন। তারপরও এটা সত্য যে প্রশাসনের বহু কর্তাব্যক্তি দায়িত্ব পালনের সুবাদে লালন সাঁইজীকে কিঞ্চিত জানার সুযোগ পান। আর এতে করেই সাঁইজীর ভক্ত হয়ে উঠেন তারা।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীন দেশে বিমান বন্দরের সামনে স্থাপিত লালন মূরল অপসারণ করতে হয়েছে তথাকথিত ধর্মান্ধ শক্তির চাপে। বাউল সাধু ফকিরদের চরম বিরোধিতার পরও মাজারের সাথে অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত কিচ্ছা কাহিনী প্রচারের জন্য মাজারের আশপাশ জুড়ে যত্রতত্র আখড়া, আস্তানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পুরো মাজার এলাকাকে পর্যটনের আদলে গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে যা সত্যধামের ভাব-গাম্ভির্যতাকে ক্ষুন্ন করছে নিঃসন্দেহে।
যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ পুরো মাজারের ভাব-গাম্ভির্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এবং দেশের তথাকথিত বিপ্লবী সাংস্কৃতিক বিজ্ঞজনেরা রাজধানীতে বসে যেভাবে দেশ ও জাতি নিয়ে কথা বলেন তাতে তাদের ভিতরের অন্ধকার বের হয়ে আসে। হাল আমলে তাদের লালনপ্রীতি সন্দেহের উদ্রেক করে। সুনামধারী এসব সংগঠকদের লুটপাট করা অর্থসম্পদের পরিমান জাতির সামনে উন্মোচিত হলে ভয়াবহ ক্ষত সামনে চলে আসবে। উপরন্তু এরা দেশে বসে দেশীয় সংস্কৃতির জাগরণ বন্দনায় মাতলেও নিজ সন্তানদের কর্পোরেট শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেকের রয়েছে বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী পন্ডিত নাট্যজন, শিল্পজন, আরাধ্যজনদের রুগ্নতার ক্ষত পুরো সংস্কৃতি অঙ্গনকেই শেষ করে দিয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রকৃতপক্ষে কি হয়? খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেখানে অর্থের অপচয় ও লুটপাট চলে মহাধুমধামের সাথে। বাস্তব কোন পরিকল্পনা নেই, লক্ষ্য নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা একাডেমি থেকে লালন বিষয়ক বেশ কিছু প্রকাশনা বের করা হলেও অধিকাংশের পূর্ণ সংস্করণ করা হয়নি। অথচ তারা কত অনুৎপাদনশীলখাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে তা অনুসন্ধানে ধরা পড়ে। নতুন প্রজন্মের কাছে লালনসহ সব পর্যায়ের সত্য মানুষকে দূরে রাখা হয়েছে। চলতি পথে যে সব ধান্দাবাজী আর তোষন বন্দনার ব্যানার চোখে পড়ে তাতেই তো এদের রুগ্নতার চিত্র চোখে পড়ে। আর অনুসন্ধান চিত্র তো আরও ভয়াবহ। বর্তমান সংলাপ পত্রিকায় সেসব কর্তাব্যক্তিদের কিংবা কারো ব্যক্তিগত সংবাদ প্রচারে উৎসাহ না থাকায় এ নিয়ে কোন কিছু লেখা থেকে বিরত থাকা গেল। তবে সময় এদের আত্মপ্রতারণার সঠিক জবাব লিপিবদ্ধ করে রাখবে এতে কোন সন্দেহ নাই।
পাকিস্তান আমলে লালন পন্থীদের সমাজচ্যুত করে রাখার জন্য ওহাবী মোল্লারা একজোট ছিল। ৫০ এর দশকে মাওলানা শামসুদ্দীন মিনিষ্টার খ্যাত মুসলিমলীগের তৎকালীন মন্ত্রীর নির্দেশে লালনপন্থীদের নিজস্ব অনুষ্ঠানকে বাধা দেয়া হয়েছে। ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের বহুমুখী অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনী আজও প্রবীন বাউল অনুসারীদের মুখে মুখে ফেরে। ফলে গোপনে দূর দূরান্তে চলতো সাঁইজী স্মরনে নানা কর্মযজ্ঞ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, তৎকালীন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে থেকে ভক্তগন লালন চর্চা চালিয়েছেন দীর্ঘ দিন। স্বাধীনতার পর এটি জনপ্রিয়তা পায়। বাউলরাই বাংলার গান হয়ে, প্রাণ হয়ে বাংলার জয়রথ তুলে ধরে। বাংলা ও বাঙালি একে অপরের সমর্থক। আর তাই মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের ধর্ম হিসেবে বাউলরাই উগ্রপন্থী কট্টরপন্থীদের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুখে বাঙালি, উদার, অসাম্প্রদায়িক দেশ নির্মাণ যেন রাজনীতির প্রবঞ্চক বচন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় কথায় প্রগতিশীলতার দাবিদাররা এটি বলতেই থাকেন। বিজয়ের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালির জাগরণ এসব যে কেবলই কথার কথা তা বুঝতে পারার জন্য কোন বিশেষ জ্ঞানের দরকার হয় না। আওয়াজ এবং আওয়াজসস্বর্বস্ব এসব কথা গভীর দৈন্যতা থেকে উৎসারিত তা বুঝা যায়। প্রথমত তারা বোঝেন না তারা কি বলছেন, কি বোঝাতে চান, দ্বিতীয়ত এটি একটি মারাত্মক অসুস্থতা। প্রশাসন ও রাজনীতির পরতে পরতে ওহাবী ও বর্ণচোরা ঘাতকেরা সক্রিয় রয়েছে। পুরো জাতিকেই এর জন্য চরম খেসারত দিতে হবে একদিন। দেশে সুষ্পষ্ট একটি বিভাজন থাকলেও প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির তথাকথিত ধারক বাহকরা তা অনুধাবনে অক্ষম। মাঠ পর্যায়ে লোকায়িত সহজ সত্য পথের কাজগুলোকে তারা আমলে নেন না। মাজার জিয়ারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ তাদের সাধক ওলি প্রেম। অন্যদিকে উগ্রপন্থি রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকরা এক্ষেত্রে চরম আন্তরিক। তারা মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্র তাদের আন্ত:জালে বেধে রেখেছে। শিক্ষা সংস্কৃতির অভ্যন্তরে তাদের কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে কারিগরি ও চিকিৎসা শিক্ষা। এতিমদের যেহেতু তেমন কোন পিছুটান থাকেনা তাদেরকে এরা মাঠ পর্যায়ে একটি মানবিক কৌশল দিয়ে আটকে রেখেছে। বহুমুখী কর্মতৎপরতা অর্থাৎ বৃহৎ পরিকল্পনার বাস্তবায়নের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে উগ্রপন্থিরা।

লালন ফকিরকে না জানলে না বুঝলে পুরো জাতিকেই এর জন্য চরম খেসারত দিতে হবে। রাজনীতিজীবীদের বুঝতে হবে দেশ জাতি টিকে আছে সত্য মানুষের কর্মে আশীর্বাদে। বাঙালির হৃদয় জমিনের সত্য লালন। বাঙালির জাতিসত্ত্বার উৎসারিত সত্য লালন। লালনই আমাদের জাতীয় চেতনার ঠিকানা। লালনকে লালন না করে আমরা যা করছি তা চরম দৈন্যতাকেই প্রকাশ করছে বারবার। সচেতন সবাইকে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে কেন লালন সৃষ্টিকর্মের উপর এত হামলা এত বাধা। মূল কারণতো একটিই নিরবে নিভৃতে বাঙালির চেতনায় লালন সত্য হয়ে অন্য সব ধর্মজীবী ধর্মান্ধদের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

সময়ের সাফ কথা.... সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারাটা রাজনীতিবিদদের দেউলিয়াপনা

সময়ের সাফ কথা....

সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারাটা রাজনীতিবিদদের দেউলিয়াপনা

সংলাপ ॥ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন ‘দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারাটা রাজনীতিবিদদের দেউলিয়াপনা। গত শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০১৬’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, একটা গণতান্ত্রিক সরকার দেশে পাঁচ বছর শাসন করতে পারবে অথচ স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে কোনো নির্বাচন দিতে পারবে না, এটা রাজনীতিবিদদের জন্য দেউলিয়াপনা।
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলে বিচার বিভাগের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনকে একটি মহলের খেয়াল খুশি মতো পরিচালনার ব্যবস্থা হয়েছিল। ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন রাষ্ট্রের মূলভিত্তি জনগণের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পরিচয় খর্ব করায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত তা অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলে ঘোষণা করে।
সামরিক ফরমানের মাধ্যমে আনা সংবিধানের সংশোধনীসমূহ বাতিল প্রসঙ্গেও কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। বিচার বিভাগের ভূমিকার কারণে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতার পালাবদলের পথ রুদ্ধ হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
গত রোববার সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন ২০১৬-এর দ্বিতীয় দিনে কর্ম-অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেন, বিচারব্যবস্থায় মামলাজট ও বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা জনগণের বিচার লাভের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই মামলাজটের দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হবে।’ বিচারকাজে অপ্রয়োজনীয় সময়দানের সংস্কৃতি পরিহার করতে তিনি বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের নিম্ন আদালতে প্রায় ২৭ লাখ মামলার জট আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। অনিষ্পন্ন মামলার এই বোঝা আদালত ব্যবস্থাপনাকে গতিহীন করতে পারে। মামলার ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে। এ কারণে মানুষ তার বিরোধকে আদালতে আনতে নিরুৎসাহিত হতে পারে। আগ্রহী হতে পারে বিচারবহির্ভূত পন্থায় অর্থ বা পেশিশক্তির মাধ্যমে সুবিধাজনক সমাধান প্রাপ্তিতে। ফলে আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা শিথিল হতে পারে। সমাজে অসহিষ্ণুতা ও সংঘাতের প্রসার ঘটতে পারে।’

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা উপস্থিত বিচারকদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘মানসম্মত সুবিচার প্রাপ্তির ক্রমবর্ধমান জন-আকাঙ্খার বিপরীতে অবকাঠামোগত ঘাটতিসহ বহুবিধ সীমাবদ্ধতার মাঝে আপনাদের কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে বিনা বিলম্বে, স্বল্পব্যয়ে ও প্রকাশ্যে বিচারের মাধ্যমে আইনসম্মত সুবিচার প্রাপ্তি প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। আমরা নাগরিকদের মানসম্মত সুবিচার নিশ্চিতকরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে কোনো সীমাবদ্ধতাই অজুহাত হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

সময়ের দাবি - বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন আইন

সময়ের দাবি -

বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন আইন

সংলাপ ॥ বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে বরাবর বিতর্ক থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনও সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করেনি। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সুস্পষ্টভাবে আইনের কথা বলা রয়েছে।  নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ এখন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন।
কিন্তু সাবেক কমিশনার, পর্যবেক্ষক এবং আইন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখনই সুযোগ একটি আইন তৈরি করে স্বাধীন কমিশন গঠন করার।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্টভাবে আইনের কথা বলা আছে যে, নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগ করবেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন না থাকায় অতীতে আস্থাহীনতা আর রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কমিশন গঠন হতে পারে কিন্তু আইন প্রণয়ন ছাড়া একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে যাচ্ছে তা নিয়ে আবারো বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ থেকে যায়। 

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাণিজ্য ও রাজনীতির অবসান হোক!

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে

বাণিজ্য ও রাজনীতির অবসান হোক!

সংলাপ ॥ স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে শহীদদের স্বপ্নের শোষণমুক্ত সমাজ বা দেশ প্রতিষ্ঠিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য কখনোই বন্ধ ছিল না। রাজধানী ঢাকার দৃশ্যপটঃ গুরুত্বপূর্ণ ছোটবড় সকল সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে খেতাব অর্জনকারী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নামে, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন নেতৃত্ব ও সংগঠকদের নামে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিবর্গের নাম ও কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখা একটি জাতীয় দায়িত্ব। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদর ও তাদের আদর্শের ধারক-বাহকরা ছাড়া এ কথা অস্বীকার করতে পারে না কেউই। কিন্তু বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের অনেক নামফলকে যেভাবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নাম প্রায় সমান আকারের টাইপে ফলাও করে লেখা হয়েছে তাতে স্পষ্টই বোঝা গেছে সংশ্লিষ্ট মেয়র তার নামকে জনসমক্ষে তুলে ধরার একটি মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগানোর যথাসাধ্য চেষ্টা-তদ্বির করেছেন।
অর্থাৎ  মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক তৈরি ও সড়কের নামকরণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হবে এ আশংকা রয়েই গেল। অবশ্য যেসব ফলকে কেবল বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যক্তিত্বের নামের পাশাপাশি তাদের কর্ম ও অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোতে নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রয়েছে। বাংলার মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক এঁর একটি স্মরণীয় বাণী হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি চিন্তা ও কর্মে এক নয় তার ইবাদত শুদ্ধ নয়।’ আর হাজার বছর আগেকার এক সাধক-ইমাম জাফর সাদিক ইবাদতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সঠিক সময়ে সঠিক কাজ সুসম্পন্ন করার নাম ইবাদত।’ ৪৫ বছর বয়সী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকালের আশা-আকাংখা ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়েও আজ দেখা যাচ্ছে, যারা স্বাধীন দেশের সকল সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগ করেছে তাদের অনেকেই চিন্তা ও কর্মের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না, পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আজও স্বপ্নেই থেকে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ম ও অবদানের ফসল হিসেবে যে সাফল্য তার সুফল ভোগ করছে অতি নগণ্য সংখ্যক মানুষ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের যে মেয়রের সময় সড়কগুলোর নামকরণ মুক্তিযুদ্ধের নামে করা হলো তিনিও একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জানবাজ গেরিলা হিসেবে ঢাকায় অনেক দুঃসাহসী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে যে ভূমিকা পালন করেছেন তাতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ব্যক্তিবর্গ ও দলই বেশি উপকৃত হয়েছে, ভূলুন্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই। রাজাকারদের তালিকা না করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে গিয়েই সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। কেননা, ’৭১-এর নয় মাসে কতিপয় রাজাকার-আলবদর-মুসলিম লীগ-শান্তি কমিটির লোক ছাড়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিবাহিনীর লোক ওসৈনিকদেরকে যুগিয়েছিল খাদ্য আশ্রয়সহ যাবতীয় সহযোগিতা।
যে কারণে মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধ-বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জনতার কাছে যার আবেদন চিরভাস্কর হয়ে আছে। আর এ যুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটিতে ছিল সমগ্র মুক্তিকামী বাঙালির সকল বিজয় ও আশা-ভরসার প্রাণস্পন্দন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এর আবেদনকে সংকীর্ণ করে তোলার পেছনে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে আজও বিদ্যমান। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার আড়ালে তৎকালীন সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোনাফেক ও ভন্ড রাজনীতিকদের যোগসাজশে বিলি করা হয়েছিল হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট যার সুবিধা নিয়ে সুযোগ-সন্ধানী কথিত শিক্ষিত শ্রেণী এমনকি অনেক রাজাকারও সরকারি চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে এবং এ শ্রেণীটিই পরবর্তী ৪৫ বছর ধরে দেশের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিয়ন্তা সাজতে গিয়ে আবহমান বাংলা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে করেছে কলুষিত। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে আবারো পাকিস্তানী ভাবধারার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ (যার সর্বশেষ পরিণতি জঙ্গীবাদ) বানানোর এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর ক্ষমতা ভোগকারী জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কেউই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি ও বাণিজ্য করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। জিয়া সারা দেশে ‘ইয়ূথ কমপ্লেক্স’ গঠন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর কার্যক্রমকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করে এদেশের ছাত্র, যুব সমাজ ও মুক্তিবাহিনীর বেকার সৈনিকদের পদস্খলন ঘটানোর পেছনে মারাত্মক ভূমিকা পালন করে গেছেন। জেনারেল এরশাদ, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’-এ ঘোষণা দিয়ে আরও বড় রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতা মেয়াদ নয় বছর পর্যন্ত বাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন।

তারপর ১৯৯১ সালে এদেশের জনগণ তথা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের অবসান ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহনের পর মৃত্যুর পরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। যে দেশে ’৭১-এর বীর সেনানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, অন্যদিকে রাজাকার, আলবদর চক্র বিভিন্ন ছলচাতুরি ও দেশি-বিদেশী অশুভ শক্তির সহযোগিতায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সেখানে শুধুমাত্র মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থায় তুষ্ট থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে  ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তুমি দিতে এলে ফুল’?-এই গানের কথাগুলোই মনে পড়ে যায়। মুক্তিয্দ্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে বলেই শহীদদের স্বপ্নের সোনার বাংলা আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধুমাত্র নগন্য সংখ্যক লোকের হাতে দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গেছে। দারিদ্র্য অশিক্ষা-কুশিক্ষা, শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন নির্যাতনের’ নির্মম শিকার হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। তবু আশার কথা, বহু পরে হলেও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বদৌলতে দেশবাসী আজ যুদ্ধাপরাধীদের চিনতে পেরেছে, তাদের বিচারের দাবি জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং এত বিজয়ের ঘটনা যে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা তা সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক একটি অসম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এখন সবার আগে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতিকদের রাজনীতি ও বাণিজ্যের অবসান ঘটানো। তবেই সুগম হতে পারে শহীদদের স্বপ্নের দেশ গড়ার, মুক্তি পাবে এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবিদার সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব এ বিষয়টি যত শীঘ্রই উপলব্ধি করতে পারবে ততই মঙ্গল। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে আর সুযোগ দেয়ার অবকাশ নেই। তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন পর্যন্ত কপটতাই তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম। 

বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৬

বিজয়ের ৪৫ বছর লক্ষ্য এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ

বিজয়ের ৪৫ বছর

লক্ষ্য এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ

শাহ্ ফুয়াদ ॥ ১৬ই ডিসেম্বর’ ২০১৬, মহান বিজয় দিবসের ৪৫ বছর পার করছে বাংলাদেশ। সোনার বাংলা গড়ার চেতনায় সময়ের প্রয়োজনে আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে দেশ। ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করেছিল এই বিজয়। ’৭১-এর ৭ই মার্চে যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সে উদ্যানেই ওই বছরের ১৬ই ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণ দলিলে বাধ্য হলো পাকিস্তানী বাহিনী। বাংলা ও বাঙালি জাতির এ এক আশ্চর্য ইতিহাস, এক অমোঘ সত্য। অথচ এই সত্যকে মুছে ফেলার জন্য এদেশে কী অপচেষ্টাটাই না করেছে ১৬ই ডিসেম্বরের শত্রুরা, স্বাধীনতার শত্রুরা। বাংলাদেশের বিগত ৪৫ বছরের ইতিহাস এর স্বাক্ষী। কিন্তু সত্য সত্যই। শত-সহস্র প্রতিকূলতা, ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করেও বাংলাদেশ টিকে রয়েছে। দিনে দিনে এর জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে, কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ আজ পরম সত্য, গর্বের বিষয়। তাই সমসাময়িক প্রসঙ্গ টেনেও আজ  কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘সাবাশ বাংলাদেশ, পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, সব জ্বলে-পুড়ে ছাড়খাড় তবু মাথা নোয়াবার নয়’!
বাঙালি জাতি কোনো দিন কি ভুলতে পারবে ১৬ই ডিসেম্বরের পূর্বাপর ঘটনাবলী? সেদিনের অবিস্মরণীয় ঘটনাবলীর দিকে চোখ ফেরালে আজও উদ্বেলিত হয় যে-কোন সচেতন বাঙালি।
৭ ডিসেম্বর: যশোর মুক্ত। বাংলা ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় ইষ্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার কম্যান্ডে। অরোরা জে. মানেকশ’র মাধ্যমে উভয় সরকারকে রিপোর্ট করবেন।
৮ ডিসেম্বর: ভারতের সরকারি মুখপাত্রের ঘোষণা, পাকিস্তান যদি পূর্ববাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবে সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে।
৯ ডিসেম্বর: মেঘনার সমগ্র পূর্বাঞ্চল মুক্ত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন কর্তৃক অপেক্ষমান নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ।
১০ ডিসেম্বর: খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে দায়িত্ব পালনকালে বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন শহীদ হন, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের মালাক্কা প্রণালীর পূর্বে অবস্থান, সিকিম-ভুটান সীমান্তে চিনা সৈন্যবাহিনীর তৎপরতা, হেলিকপ্টারযোগে ভারতীয় বাহিনীর রায়পুরায় অবতরণ, ঢাকায় সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর ক্রমাগত বিমান আক্রমণ।
১১ ডিসেম্বর: ভারতের ছত্রীবাহিনীর সাতশ’ সৈন্যের কাদের সিদ্দিকী বাহিনীনিয়ন্ত্রিত মধুপুর এলাকায় অবতরণ। পাকিস্তানী ব্রিগেডের সঙ্গে সংঘর্ষ। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও উপকূলীয় অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধজাহাজের তৎপরতা।
১২ ডিসেম্বর : সকাল আটটায় নরসিংদী মুক্ত। গত তিন দিনে ভারতীয় বাহিনীর পাঁচটি ব্যাটালিয়ন, দু’টি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ৫৭ ডিভিশনের ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার মেঘনা অতিক্রম করে। সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে ভারতের জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাসুট ব্যাটালিয়নের সঙ্গে মিলিত হয়। বিকেলে চিনা প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া নিউইয়র্কের আলেকজান্ডার হেগকে জানান, চিন কেবল আরেকবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে আগ্রহী, উপমহাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করার বিষয়ে নয়, বঙ্গোপসাগর থেকে ২৪ ঘন্টার পথের দূরত্বে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের নিশ্চল অবস্থান।
১৩ ডিসেম্বর : নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তৃতীয় সোভিয়েত ভেটো। পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ না দেয় তবে যুক্তরাষ্ট্র রুশ-মার্কিন শান্তি বৈঠকে যোগ দেবে না বলে নিক্সনের হুমকি।
১৪ ডিসেম্বর: ঢাকায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর হামলায় গভর্নর ভবন ক্ষতিগ্রস্ত। মন্ত্রিপরিষদসহ গভর্নরের পদত্যাগ। অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. আবুল খায়ের, গিয়াসুদ্দিন আহমদ, ড. মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা,          ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ মুতর্জা, সেলিনা পারভিন, ড. আলীম চৌধুরী, ড. ফজলে রাব্বি ও        সাংবাদিক শহীদুল্লাহ্ কায়সারও নিজামুদ্দিনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। মহানন্দা নদীর চরে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শহীদ।
১৫ ডিসেম্বর: সন্ধ্যায় দক্ষিণ, পূর্ব, পূর্ব-উত্তর ও উত্তর দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে সমবেত। নিয়াজির অনুরোধে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫.৩০ থেকে পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত বিমান আক্রমণ স্থগিত, কুড়িটি সোভিয়েত রণতরীর ভারত মহাসাগরে অবস্থান।
১৬ ডিসেম্বর : ১০-৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনীর ঢাকা প্রবেশ। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের প্রবেশ, ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বিকাল ৫টায় ভারত ও বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সৈন্যদের শর্তহীন আত্মসমর্পণ। মেজর জেনারেল জ্যাকবের প্রস্তুতকৃত আত্মসমর্পণের দলিলে লে. জে. নিয়াজি ও লে. জে. অরোরার স্বাক্ষর।
১৭ ডিসেম্বর: পাকিস্তান বাহিনীর বিপর্যয়ের ওপর জেনারেল অরোরার মন্তব্য, ‘মেঘনা ও মধুমতী নদীদ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাদের অবস্থান কেন্দ্রীভূত করলে, আমার মনে হয় তারা আরও কয়েক মাস টিকে থাকতে পারতো।’
১৮ ডিসেম্বর: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের বহু লাশ রায়েরবাজারে কাটাসুর ইটখোলায় আবিষ্কার।
১৯ ডিসেম্বর: রোববার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকারের সকল কর্মচারির কাজে যোগদান, বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনী প্রধান লে. জে. জগজিৎ সিং বলেন, ‘ভারতীয় বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় বাংলাদেশে অবস্থান করবে না’।
২০ ডিসেম্বর : পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভুট্টো বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য মিলিত হতে রাজি।’ ‘শেখ মুজিবকে প্রাণদন্ড দিলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা আর দেশে ফিরতে পারবে না।’-ভুট্টো।
২১ ডিসেম্বর: ন্যাশনাল আওয়ামী প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ কর্র্তৃক সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান। শেষ মূহুর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার লক্ষ্যে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী ১০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ নোট জ্বালিয়ে দেয়।
২২ ডিসেম্বর : মুজিবনগর থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের সংবর্ধনা।
২৩ ডিসেম্বর : দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক কে. এম. ওবায়দুর রহমান সর্বদলীয় সরকারের ধারণার বিরোধিতা করেন। ২৫ ডিসেম্বর : প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, যুদ্ধ চলাকালে সময়ে সাহায্যকারী ৫ দলীয় পরামর্শদাতা কমিটি বহাল থাকবে। মুক্তিবাহিনীকে নিরস্ত্র করার প্রশ্ন আসে না। যুদ্ধপরাধীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতামতের ওপর ভারত কোন ভূমিকা রাখবে না।  (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের তারিখ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৪৯-৫০)।
এর আগে ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক-এর ৮-কলাম শিরোনামের খবর ‘দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ সোনার বাংলা মুক্ত।’ ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত অবজারভারের ৮-কলাম শিরোনামের খবর, ‘বাংলাদেশ কামস ইনটু বিয়িং’।  (তথ্য সূত্র, পিআইবি আর্কাইভ)
এই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় এবং তার পরবর্তী মূহুর্তগুলো। কী ছিল তখন এদেশ বাসীর চাওয়া-পাওয়া? এর উত্তর ছিল, এদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া সেদিন বেশি ছিল না, তবে ধর্ম নিয়ে এদেশের মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা হবে না, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সৃষ্টি করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হবে না, সমাজ শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন হবে, সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে-এটাই চেয়েছিল এদেশের মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছরে কত কিছুই না দেখতে হয়েছে এদেশের মানুষকে। তবে আজকের দিনে আশার কথা হচ্ছে কিছু যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ক্ষমতার জন্য ধর্মের নামে মানুষ হত্যা, মানুষে মানুষে হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি করে যারা দেশটাকে মিনি পাকিস্তান বানিয়ে তাদের সৌদি-ওহাবি-ঈঙ্গ-মার্কিনী বন্ধুদের কাছে দেশটাকে বিকিয়ে দিতে চেয়েছিল তাদের সব অপচেষ্টা আবারো আপাতত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ২০০৮ সালের ১২ই ডিসেম্বর বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশের। সরকারি-বেসরকারি সকল খাতে সমন্বয়ের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠাই ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে প্রান্তিক মানুষের কাছে খুব সহজে এবং দ্রুত তথ্য ও সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে  ‘জনগণের দোড়গড়ায় সেবা’ শ্লোগানকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ৪৫৪৫টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (ইউআইএসসি)। তথ্য প্রযুক্তি মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে যাওয়ার কারণে যেকোন কাজে জনগণের ভোগান্তি অনেক কমে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ এক বাস্তবতা। দেশের সকল ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও তদারকির মাধ্যমে জনগণের ভাগ্য আমূল পরিবর্তন করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের সুষ্ঠু তদারকীই এ ক্ষেত্রে বেশি জরুরি। 

তবে যে কঠিন বাস্তবতা আবারো নতুন করে সচেতন মানুষদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলে ঢুকে পড়েছে জামায়াতের অনেক এজেন্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে    ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই অনুপ্রবেশকারীরা কৌশলে ক্ষমতাসীন সরকার ও দল থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতে মাঠে অত্যন্ত সক্রিয়। সুযোগ পেলেই মুখোশ খুলে আসল পরিচয় প্রকাশ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বাস্তবতা অনুভব করেই বিজয় দিবস’২০১৬ উপলক্ষে শনিবার রাজধানীতে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রশ্ন রেখেছেন, ‘নির্বাচন ও আন্দোলনে পরাজিতদের (বিএনপি-জামায়াত জোট) জনগণ কেন ভোট দেবে? এসব খুনী, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস্ যাদের আমরা বিচার করেছি, তারা ক্ষমতায় এলে দেশে একাত্তরের  মতোই গণহত্যা চালাবে’। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সকল মানুষ ও সরকারকে এ ব্যাপারে সদা সচেতন থাকতে হবে। বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তিতে এমনটাই আজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দেশপ্রেমিক জনগণের চাওয়া।

সময়ের সাফ কথা.... বাঙালি রেঁনেসা কতদূর কোন পথে?

সময়ের সাফ কথা....

বাঙালি রেঁনেসা কতদূর কোন পথে?

বিজয় আমার বিজয় তোমার
বিজয় ভালবাসার
সকল প্রাণে প্রেম জাগানিয়া সকল কিছু আশার
এই তো আমি এই তুমি এই আমাদের দেশ
সবাই যখন বলতে পারে বিজয় অনিশেষ ॥
নজরুল ইশতিয়াক ॥  মুক্ত প্রাণই কেবল জানে মুক্তির আনন্দ। সে আনন্দ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়। মানুষের মর্যাদা সমাজ রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতেই হয় আজ অথবা কাল। এটা যারা যত আগে বোঝে ততই দেশ-জাতির মঙ্গল হয়। জনগণের দেশে জনমানসের সংস্কৃতির চাষ এবং তার নবায়নের মধ্যে সব পারদর্শিতা, উন্নয়নতত্ত্ব, কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণের পথরেখার সন্ধান মিলে। গাছের গোড়া ঠিক না করে গাছের মাথায় রঙ বাহারি বেলুন, জরি, মালা ঝুলিয়ে বিভ্রান্ত করা যায় তাতে কোন কাজ হয় না। ছোটখাট ঝড়ে তা টলে পড়ে। শেকড়বিহীন গাছ দাঁড়িয়ে থাকে না। তেমনি মানুষময় দেশ গঠনই মূল কথা। একটি জাতি ক্রমশ তার জাতিসত্ত্বার উৎস সন্ধানে আত্মনিয়োগ করার মধ্য দিয়েই সঞ্জিবনী সুধা পান করে এগিয়ে যাবে। বিশ্বের যে সব জাতি বিপন্ন হয়েছে, হারিয়ে গেছে, বিলুপ্ত হয়েছে, পরাধীনতার শিকলে বাধা পড়েছে, তার কারণ তারা তাদের জাতীয় পরিচয়কে ধরে রাখেনি। একটি জাতিসত্ত্বা যেমন গড়ে উঠে দীর্ঘ ধারাবাহিক আচার-শিষ্টাচার আবিষ্কার, সংস্কার, সম্মিলনের মধ্য দিয়ে, স্ব-স্ব কীর্তিমান আদর্শিক ব্যক্তিত্বদের উর্দ্ধে তুলে ধরে তেমনি পতনও হয় সে সব ভুলে যাবার মধ্য দিয়ে।
ইউরোপে রেঁনেসা সংগঠিত হয়েছে মানুষের মহীমা কীর্তনের মধ্য দিয়ে। দেশ ও জাতিগত এ ঐক্যের মূল রচনা করে গেছে ইউরোপের সৃষ্টিশীল মহান মানুষেরা। কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের কর্মের প্রতি আস্থাশীল বিশ্বাসীরা এসব স্বীকার করেছে, চর্চা-চর্যার পথে এগিয়েছে। আর এ কারণেই ঐক্যবদ্ধ হবার পথে একে অপরে মিলে-মিশে সব সংকট মোকাবেলায় পারস্পরিক জানা বোঝার পথে এগিয়েছে। সৃষ্টিশীল মানুষের কর্মকে ধরেই সৃষ্টি প্রাণ পায়। সমাজের প্রতিটি অংশ ক্রিয়াশীল হয় সৃষ্টির বন্যায় কাঁপন ঝরাতে ঝরাতে এবং তা জাতির জন্য প্রধান চিন্তনের বিষয়বস্তু হয়ে পড়ে। মানুষ তো মানুষের কাছেই শিক্ষা পায়। মহত মানুষের রঙে রঞ্জিত হয়। সেই মহৎ মানুষের শিক্ষা নিয়ে নিজেকে জানতে পারে, জানতে পারে অন্য সব কিছুকে। আমাদের দেশও এগিয়েছে কর্মনির্ভর গতিশীল মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। অনুসন্ধানী চোখে ধরা পড়বে আমাদের এগিয়ে চলার পথে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা মহান সব মানুষেরা। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস সেই সত্যকেই তুলে ধরে। বিশেষ করে আঠার ও উনিশ শতকের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সৃষ্টিশীলতার নির্যাস। জাতিগত চিন্তার প্রতিফলন উন্মেষ সাধন সবই সংগঠিত হয়েছে। জাতীয় পরিচয়ের নিক্তি তার রং-রূপ-আদর্শের পথরেখা।
কিন্তু বুঝে হোক আর না বুঝে হোক নাগরিক বৃত্তশালী রাজশক্তি সেগুলো যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের সংকীর্ণতার কারণেই। ফলে জাতি হিসেবে বহুপথ পাড়ি দিয়ে অবাস্তব কল্পনার আবর্তে আবার ততটাই পিছিয়ে গেছে। অন্ধকারে উদ্ভাসিত আলোর পথে না হেঁটে আবারও গহীন তিমিরেই আশ্রয় খুঁজে পেতে মরিয়া হয়েছে।
মানুষের শক্তি থাকে তার চিন্তা-চেতনায় অনুভূতি-উপলব্ধিতে। সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা বুঝে উঠার ক্ষমতার মধ্যে, মানবিক সৌন্দর্য জীবনের উদ্দেশ্য দায়-দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে। অন্ধকারে যতই অট্টহাসি দেয়া হোক তা অন্ধকারেই হারিয়ে যায়। যাদের আমরা বন্দনা করি, গুণকীর্তন করি সবই দারুন এক আনুষ্ঠানিকতার ঘেরাটোপে আটকা পড়েছে। লোক দেখানোর মহোৎসব চলছে অথচ নিজেরাই তা দেখি না। রাষ্ট্রের যে সব প্রতিষ্ঠান শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে, গুণী মহৎ মহাজনদের জন্য কাজ করবে, তারা কেবলই নেতা, মন্ত্রী, উচ্চ কর্তাদের দৃষ্টি আকষর্ণের জন্য বড় বড় ফেষ্টুন ব্যানারের কাজের মধ্যে রয়েছে। গুণীজনদের যথেচ্ছাচার ব্যবহারের সাথে যোগ হয়েছে বড় বড় কোম্পানীগুলোর বাণিজ্যিক যোগ। সরকারী বেসরকারী সব ক্ষেত্রে রোগ প্রকট হয়েছে। ফলে গুণীজনদের আশ্রয় পেতে এসে নিজের জনপ্রিয়তা নিজের আর্থিক প্রতিষ্ঠা মূখ্য হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর নামে কত কিছুই না করা হচ্ছে; যারা করছে তারা কেউই বাংলার প্রকৃত বন্ধু হতে চান না। কেবলই ভুঁইফোড় ছোটাছুটি সার। অনেকটা এমন নিজে কানা পথ চেনে না পরকে দেখায় বারেবার। দেশে গুণীদের কদর কদাচিৎ আছে সভা, সেমিনারে, রেফারেন্সে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। অন্য কোথাও তাদের মূল্যায়ন করা হয়না। দিক্-নির্দেশনাকে মানা হয় না। যারা এটি বাস্তবায়ন করবে তারা এগুলোকে পাঠ্যসূচীর অংশ ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। পরিস্কারভাবে বললে যে দু’একজন গুণীর কথা বাজারে আছে তার নেপথ্যে বাজারীপনা ছাড়া অন্য কোন কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিছু কিছু নামে সবাই গগনবিদারী ধ্বনি তোলেন কিন্তু তাদের জীবনে সে ধ্বনির কোন প্রতিফলন নেই। গুণীজনের মধ্যে থাকে গুণের সমাহার। প্রত্যেকটি নামই এক একটি আদর্শের নাম। প্রত্যেককেই বিশেষ বিশেষ বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। সবকিছুর উর্দ্ধে ব্যক্তিত্বই প্রধান হয়ে উঠে। ব্যক্তি যখন ব্যক্তিত্বের আদর্শে পরিণত হন তখন তার নামই সবকিছুর উর্দ্ধে চলে আসে। তাদের কর্মের বন্দনার সাথে সাথে সমানভাবে নাম কীর্তন হয়।
বাঙালির প্রাণপুঁরুষরা এই জাতিকে তার নিজস্ব জাতিসত্ত্বায় পরিণত করেছে। আজকের যে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তা তো তাদেরই অবদান। নিরবে নিভৃতে সে সব ব্যক্তিত্বরা তুলে ধরেছেন বাঙালির জাতিসত্ত্বার পতাকা। হাল আমলে শেখ হাসিনা পরিণত হয়েছেন অনুকরণীয় অনুস্মরণীয় দারুন ব্যক্তিত্বে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, দলের সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, দেশরত্ন, জননেত্রী সব পরিচয় বিশেষণ ছাপিয়ে তিনি শেখ হাসিনা। তিনি সাহসী, উদ্যমী, অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, ন্যায় পরায়ণ, পরিশ্রমী। তিনি বিশ্বব্যাংক সংস্কার চেয়েছেন; বলেছেন বিশ্বব্যাংকের আধুনিকায়ণ দরকার। তিনি বলেছেন যে উদ্দেশ্য নিয়ে এটি যাত্রা শুরু করেছিল তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। পরামর্শ আর অপকৌশলী ভূমিকার কারণে বিশ্বব্যাংক দরিদ্র দেশগুলোর জন্য কার্যত কিছু করছে না। তিনি শান্তি সুরক্ষায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুকি মোকাবেলায় জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার দাবি তুলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগী পরিশ্রমী শেখ হাসিনা গুণীজনদের কর্মকে সমাজে প্রতিটি অধ্যায়ে ছড়িয়ে দেবার আহবান জানিয়েছেন। তাদের আদর্শে দলীয় নেতা কর্মীদের আদর্শে পরিণত করার তাগিদ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন-সততাই আমার শক্তি, সততাই আমার সৌন্দর্য, সততাই আমার সাধনা।
মানুষে মানুষে দূরত্ব কমানোর মানবপ্রেমের কর্মসূচী দেশরত্নকে উচ্চতায় আসীন করেছে। তিনি বারবার গুণীজন, সৃষ্টিশীল মহান দিক্নির্দেশক ব্যক্তিত্বদের মতো জীবনাদর্শ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। দেশরত্নের এসব আবেদন দলের নেতা কর্মীকে কতটুকু অনুপ্রাণিত করেছে? তারা ব্যক্তি জীবনে কর্মী সমর্থকদের সাথে দিক্নির্দেশক সে সব আহ্বান নিয়ে কাজ করছেন? দারিদ্র বিমোচন তথা অভাব অভিযোগ দূর করাতো সদিচ্ছা, সততার উপর নির্ভর করে।
মানুষের দেশে মানুষের চাষ হবে এটাই তো সত্য। সমাজের সর্বত্র মানুষের দেখা মিলবে, তবেই তো মিলবে মানুষে মানুষে, হবে মহীয়ান। তাদেরকেই অনুকরণ অনুস্মরণ করবে নতুন প্রজন্ম। মানুষকে না ধরে টাকা পয়সা বৃত্ত বৈভব খ্যাতি পান্ডিত্য ক্ষমতা লুটপাটকে যারা উপজীব্য করেছেন তারা সে সবের স্তুপে চাপা পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই।

আমরা কি শেখ হাসিনার উচ্চতা অনুধাবনে সক্ষম। ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে উঠে দল ও দেশকে স্থান দিতে পেরেছি ? বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ কি নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছি? ভাসানী-তাজউদ্দীন-নজরুল-রবীন্দ্রনাথ-লালন-জয়নুল-সুলতানের রঙে কি রঞ্জিত হতে পেরেছি? চেতনার কোথায় বিজয় অনুরণন তোলে, কোথায় বৈশাখের কাঁপন শিহরণ জাগায়, কোথায় বন্ধুত্ব সেতু বন্ধন গড়ে দেয়? প্রেম মর্যাদা কাছে টানে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে না। বরং নিজেদের অজান্তেই এগুলোকে আমরা নির্বাসন দিয়েছি, বাতিল কাল্পনিক অবাস্তবের অভিধায় অভিহিত করেছি। শক্তি সৌন্দর্যের উৎসকে চিহ্নিত না করেই ছুটছি। ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে। বিভাজন, বিভেদ, দূরত্ব বাড়ছে। ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা, রুগ্নতা, রুক্ষতা বর্বরতা সবকিছু ছাপিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ব্যক্তি জীবনে মহান মহৎ সৃষ্টিশীলতাকে স্থান না দিলে সে আলোয় আলোকিত না হলে দিক্নির্দেশক ব্যক্তিত্ব হবার কোন সুযোগ নেই। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে নিজেকে নিজের উপর, তারপর অন্যের উপর। আমরা অন্যকে হতে বলি, করতে বলি, নিজেরা তা করি না। যে সত্য, যে আলো, যে রঙ নিজেদেরকেই স্পর্শ করেনি তা অন্যে বললে কেমন করে স্পর্শ করবে? রাজনীতির নামে, জনপ্রশাসন সেবার নামে যা করা হচ্ছে তার আবেদন সমাজে নেই। মানুষের দেখানো পথে মানুষ এগিয়ে যাবে। মানুষকে বড় করে মানবতাকে উর্দ্ধে তুলে ধরার এই তো সময়। তবেই তো আসবে বাঙালির রেঁনেসা। 

মুক্তিযুদ্ধ হাজার বছরের মহত্তম অর্জন

মুক্তিযুদ্ধ হাজার বছরের মহত্তম অর্জন

সংলাপ ॥ বাঙালি জাতির পাঁচ  হাজার বছরের ইতিহাসে মহত্তম ও গৌরবের অর্জন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় যে স্বপ্ন বা আকাঙ্খা কাজ করেছে তা-ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কি ছিল সে চেতনা? আমাদের প্রাথমিক স্বপ্ন ছিল আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হবো। আমাদের পরবর্তী স্বপ্ন ছিল আমরা আমাদের রক্তার্জিত দেশটিকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব। সেই সোনার বাংলায় প্রতিটি নাগরিক হবে সোনার মানুষ, আর সামষ্টিকভাবে জাতিটি হবে সোনার জাতি। সেখানে প্রত্যেক বাঙালি সব ধরনের বৈষম্য, বঞ্চনা, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, ত্রাস, অগণতান্ত্রিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, আধিপত্যকামিতা বা ক্ষমতান্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে এমন এক নৈয়ায়িক রাষ্ট্রের নাগরিক হবে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে একটি সমতাভিত্তিক শান্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ও শোষণ মুক্তির চেতনাকে ধরে রাখার জন্য আমরা একটি অসাধারণ দলিল প্রণয়ন করেছিলাম। সেই দলিলটিরই নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে পুষ্ট করে তোলার জন্য, রাষ্ট্রের জন্য আমরা চারটি মূলনীতি বিধিবদ্ধ করেছিলাম। জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র - এই চারটি মূলনীতিই ছিল আমাদের রাষ্ট্রের স্তম্ভ।
আমাদের বিজয়ের চার বছর যেতে না যেতেই বিজয়ের সুফলটিকে স্বাধীনতার শত্রুরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। রাষ্ট্রের স্থপতিকে তারা স্বপরিবারে হত্যা করে। স্বাধীনতার পক্ষের অনেক নেতাকে কারাবন্দি করে। বন্দি অবস্থাতেই হত্যা করে আমাদের আরও চারজন নেতাকে। এর পরপরই আমাদের সংবিধান ও দলিলটিকে প্রায় পুরোপুরি নষ্ট করে দেয় তারা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে এক উদ্ভট জাতীয়তাবাদের আমদানি করে। নাম দেয় তারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।
আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। উদ্দীষ্ট লক্ষ্য ছিল সেক্যুলারিজম। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে এও বলা হয়েছিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে রাষ্ট্র কোন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। কিন্তু স্বাধীনতার শত্রুরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুরোপুরি ধর্মহীনতা বলে অপপ্রচার চালায়। সেই অপপ্রচারে অনেক মানুষকেই তারা বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। তাদের বক্তব্য ছিল - যে দেশের নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, সেই বিশ্বাসকেই ধ্বসিয়ে দেবার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি আমদানি করা হয়েছে। এ রকম অপপ্রচারের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার শত্রুরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় চেতনা লুট হয়ে যায়। বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত চেতনার স্থলে পাকিস্তানি চেতনাকে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনা হয়। এখন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম উভয়ই সংবিধানে আছে। তবে বদলে দেয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার তাৎপর্য। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে এখন বুঝানো হচ্ছে সব ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা। অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকায় ইসলাম নিয়ে রাজনীতির সুযোগ অবারিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ইসলামের কূট কৌশলের প্যাঁচে পড়ে আমরা হারাতে বসেছি  নিজস্ব গৌরব ও শক্তি। রাজনৈতিক ইসলাম বাঙালি জাতি সত্তাকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমানকে আবার নতুন করে মুসলমান বানানোর প্রচেষ্টা চলছে।  বস্তাপঁচা শারিয়া গেলানোর সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশের গরীব মানুষ ও অশিক্ষিত লোকদেরকে উগ্রবাদী ও  ধর্মান্ধ বানানোর নেশায় তথাকথিত রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের ঘুম নেই। তারা ইসলামের নামে তথাকথিত জেহাদী শিক্ষা দিয়ে চলেছে যার সাথে নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত  হোক)-এঁর ইসলাম এর জেহাদী শিক্ষার কোন মিল নেই। নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত  হোক)-এঁর সময় কোথায় ছিল শারিয়া? কোথায় ছিলো ইসলামী রাষ্ট্র? এমনকি আজকের পৃথিবীতে কোথাও কি কোন ইসলামী রাষ্ট্র আছে বলে কেউ প্রমাণ করতে পারবেন? সবই যুগে যুগে তৈরি করা হয়েছে ধর্মের নামে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দ্বারা শোষণ এবং শাসন করার জন্য। তাই বাঙালির সামনে এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্ন। তিন হাজার বছরের শান্তির ধারক-বাহক বাঙালি জাতি যারা নিজেদের শান্তিকে শান্তিময় করে রাখার জন্য নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর (ইসলাম) শান্তিকে আঁকড়ে ধরে হাজার বছর শান্তিতে বসবাস করে আসছে সত্য ধর্মকে আঁকড়ে ধরে, সেখানে তথাকথিত রাজনৈতিক ইসলাম তৈরি করে ধর্মান্ধরা বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
সময় আসছে দেশবাসীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আল্লাহ্ ও মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত  হোক)-এঁর ইসলাম ধারণ-লালন-পালন করবে নাকি ধর্মান্ধ মানুষের গড়া ইসলাম মানবে। অপরদিকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের উর্দ্ধে উঠতে না পারায় এবং মুক্তিযোদ্ধা বাঙালি জাতিকে দলীয়করণের নেশায় মত্ত হওয়ার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা আজ বহুধা বিভক্ত। শুধু তাই নয়, একদল মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাপরাধী ধর্মান্ধদের লেজুড়বৃত্তি করছে শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতার জন্য!
এখন সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে মাঠে নামার, বাঙালি জাতির বাঙালিত্ব নিয়ে মাঠে নামার। আবার সেই মুক্তিযুদ্ধের জীবনীশক্তি জয়ধ্বনি প্রতিটি বাঙালির কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে হবে এবং আওয়াজ তুলতে হবে - জয় বাংলা - জয় বাংলা - জয় বাংলা। যারা তথাকথিত ধর্মের নামে একে অসম্মান করতে চায় তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার সময় এসেছে এবং প্রতিহত করার সময় এসেছে যে জয় বাংলার শান্তি (ইসলাম) আর নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত  হোক)-এঁর ইসলাম এক ও অভিন্ন যা এদেশের মাটিতে আল্লাহর ওলীগণের দ্বারা বীজবপন করা হয়েছিলো এক হাজার বছর আগে। বাংলাদেশে বাঙালি সত্তাই একমাত্র সত্তা যাকে ধারণ-লালন-পালন করতে হবে তবেই নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত  হোক)-এঁর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাঙালি জগৎসভায় মর্যাদাময় আসন পাবে। এতে যদি আমরা অমনোযোগী হই, তাহলে আমাদের দুঃখ ঘুচবে না, আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়েই থাকবে। এ কাজটি আমাদের করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই।