বৃহস্পতিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৮

সত্যমানুষকুলের আহ্বান - সত্য দিয়েই সকল অন্ধতার প্রতিরোধ সম্ভব




সংলাপ ॥ আভিধানিক অর্থে, ধর্ম+অন্ধ=ধর্মান্ধ। অর্থাৎ নিজ ধর্ম সম্পর্কে যে অন্ধ সে ধর্মান্ধ। ধর্ম ব্যতীত কোন বস্তু নাই। কিন্তু জড় বস্তু জানে না তার ধর্ম কি। তাই জড় বস্তু ধর্মান্ধ। মানুষও জড় বস্তুর মতো ধর্মান্ধ হয় যখন সে নিজের ধর্ম সম্পর্কে জানে না। ধর্মান্ধ নিজের ধর্ম জানে না তাই জানে না অন্যের ধর্মও। পারিভাষিক অর্থে ধর্মান্ধ হচ্ছে - অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে একগুঁয়েভাবে প্রচলিত প্রথার অনুসরণ। একান্ত রক্ষণশীলতা, অত্যন্ত পক্ষপাত বা পক্ষপাতের আতিশয্য ধর্মান্ধতার সমার্থবোধক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধর্মান্ধ কোন যুক্তি গ্রহণ করে না। সে যতটুকু জানে ততটুকুকেই  চূড়ান্ত বলে মনে করে এবং যারা তার মতের বিরোধিতা করে তাদেরকে সে মূর্খ এবং ধর্মবিরোধী বলে মনে করে। ধর্মান্ধরা দাবি করে - ‘বলার অধিকার কেবল আমার, তুমি কেবল শুনবে। আমি পথ দেখাবো, তুমি সেই পথে চলবে। আমার মত অভ্রান্ত, তুমি ভ্রান্ত। আমার ভুল হতে পারে না, আর তোমারটা কখনো ঠিক হতেই পারে না।’
ধর্মান্ধরা বাস্তবতা বাদ দিয়ে প্রচলিত প্রথা অন্ধভাবে পালন করে এবং রীতিনীতিতে কোন পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না। অন্ধভাবে প্রথা ও আচার অনুষ্ঠান পালন করতে করতে এক পর্যায়ে যারা তাদের মতো আনুষ্ঠানিকতা পালন করে না তাদেরকে তারা শত্রু ভাবতে থাকে এবং সকলের জন্য তারা হৃদয়ের দরজা রুদ্ধ করে দেয়। তারা নিজস্ব সাম্প্রদায়িক উৎস ব্যতীত অন্য কোন উৎস থেকে জ্ঞান আহরণ করাকে মহাপাপ বলে মনে করে। তাদের চিন্তা ও জীবন-যাপন পদ্ধতিতে ভিন্নমতালম্বীদের প্রবেশাধিকার থাকে না। সংকীর্ণতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে তারা ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও জাতির প্রতি অসহনশীল ও বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে ওঠে।
ধর্মান্ধতার উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হচ্ছে, বড় বড় বিষয়গুলো উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা। ‘খোদা হাফেজ’ বলতে হবে নাকি ‘আল্লাহ্ হাফেজ’ এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে তারা রক্তারক্তি কা- বাঁধিয়ে দিতে পিছপা হয় না। দাড়ি রাখা, গোড়ালির নিচে কাপড় পড়া, তাশাহুদের সময় আঙ্গুল নড়ানো, দাঁড়িয়ে কিংবা বসে ক্বিয়াম করা, ছবি তোলা, কুকুর পোষা ইত্যাদি ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে তারা অবিরাম বাড়াবাড়ি করে। তাদের বাড়াবাড়িতে সমাজের সর্বস্তরে মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধির মতো বিস্তার লাভ করছে ধর্মান্ধতা। এই সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণে এখন ইসলাম বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হচ্ছে। ধর্মান্ধতার আক্রমণে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো ক্রমেই জ্ঞানহীন, বিবেকবুদ্ধিহীন, বিত্তহীন, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। ধর্মান্ধদের দাপটে উপেক্ষিত হচ্ছে ইসলামের মৌলিক ও বিতর্কাতিত বিষয়গুলো এবং কিছু অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে ইসলামের প্রতিপাদ্য বিষয়।
ধর্মান্ধতা রাষ্ট্র এবং মানবসভ্যতার জন্য বিপদজ্জনক হয়ে ওঠে যখন ধর্মান্ধদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপ আমেরিকাতেও ধর্মান্ধরা আছে কিন্তু তাদের ধর্মান্ধতা দৃশ্যমান নয় কারণ ঐসব দেশে তাদেরকে রাজনীতিতে ব্যবহারের প্রবণতা কম। অন্ততপক্ষে বাইবেলভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের মতো ধর্মান্ধতা খ্রীষ্টধর্ম প্রধান দেশে অনুপস্থিত। তাই ঐসব দেশে ধর্মান্ধতা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন আফগানিস্তানের মতো তালেবানি রাষ্ট্র গঠনের ভীতি তাদের নেই। পক্ষান্তরে, মুসলমান ধর্মান্ধদের মধ্যে তথাকথিত শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের প্রবণতা প্রবল।
আশার কথা, সকল মুসলমান ধর্মান্ধ এক দলভুক্ত নয়। এদের মধ্যেও রয়েছে অসংখ্য বিভাজন। ধর্মান্ধদের মধ্যেও একটা বড় অংশ রয়েছে যারা আরব শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে। একেক ধর্মান্ধ দলের চাওয়া একেক রকম কিন্তু উৎকন্ঠার ব্যাপার হলো, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এদের মধ্যে সাজুয্য রয়েছে। কিছু মতভেদ সত্ত্বেও ধর্মান্ধদের ভিত্তি করেই মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে দরিদ্রতা ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি দিন দিন প্রবল আকার ধারণ করছে। রাজনীতিতে টাকা ও ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নীতি-নৈতিকতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ। ধর্মের রাজনীতিকরণের কারণে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে ধর্মান্ধদের উত্থান ঘটছে এবং শক্তি অর্জন করছে। মুসলমান ধর্মান্ধদের ধবংসাত্মক কর্মকান্ড সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মানুষ এখন পরিচিত। এরা চরম অনমনীয়, বিজ্ঞান ও আধুনিকতা বিমুখ, সংস্কারবিরোধী ও সহিংস। দুঃখজনক যে, বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই এখন ইসলামকে বিচার করছে উগ্র ধর্মান্ধদের কর্মকান্ডের ভিত্তিতে। স্বল্পসংখ্যক উগ্র ধর্মান্ধের কারণে ইসলাম আজ কলঙ্কিত হচ্ছে। এই উপমহাদেশে ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ধর্মান্ধদের উল্লেখযোগ্য তা-বলীলা।
উগ্রধর্মান্ধদের যুক্তি হলো - রসুল (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত) ১৯ টি সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন এবং সাহাবীদের ৫৫টিরও বেশি যুদ্ধে পাঠিয়েছেন সে হিসেবে রাসুলের (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত) মাদানী জীবনের ১০ বছরে মুসলমানরা ৭০টির বেশি যুদ্ধ করেছে যা বছরে গড়ে প্রায় ৭টি। প্রতিবছর গড়ে ৭টি করে যুদ্ধ করলে যুদ্ধের পরিকল্পনা, আয়োজন, যুদ্ধে গমন, অংশগ্রহণ ও প্রত্যাবর্তন আবার নতুন যুদ্ধের পরিকল্পনা, আয়োজন, যুদ্ধে গমন, অংশগ্রহণ ও প্রত্যাবর্তন এই হলো মুসলমানদের ইবাদত। উগ্র ধর্মান্ধতা ও সশস্ত্র যুদ্ধ ব্যতীত মুসলমানদের আর কিছু করার নেই। এরা মনে করে যুদ্ধে যাবার চিন্তা করতে করতে বিছানায় হার্ট এটাকে মৃত্যু হলেও শহীদের মর্যাদা পাবে। তাই তাদের চিন্তা জগতে সশস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তপাত স্থায়ী আসন গেড়ে নেয়। এ রকম কোন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যদি মনে করে যে মাজারে যাওয়া ইসলাম পরিপন্থি তবে সে বোমা মেরে মাজার উড়িয়ে দিতে পারে কিংবা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনকে অনৈসলামিক মনে করলে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে ছায়ানটের মঞ্চ। একই কারণে তারা জনসমাবেশে আত্মঘাতি হামলায় হত্যা করতে পারে নিরীহ মানুষ, রক্তাক্ত করতে পারে লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের, ছিন্ন-ভিন্ন করে দিতে পারে সভ্যতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক। তাই ধর্মান্ধতা উপেক্ষার বিষয় নয়। ওদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলে ওরা আরো শক্তিশালী হবে এবং ক্রমে মানবজাতির অস্তিত্ব, আশা, আকাঙ্খা, পরিবেশ তথা পৃথিবীর অস্তিত্বই বিপন্ন করে দিতে পারে।
সুতরাং ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করতেই হবে। ধর্মান্ধতার আশ্রয়ে থেকে ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করা যাবে না। অযৌক্তিকতাকে দূর করতে চাই যুক্তি, অজ্ঞানতাকে দূর করতে চাই জ্ঞান, মূর্খতাকে দূর করতে চাই শিক্ষা, অন্ধতাকে দূর করতে চাই আলো। ধর্মান্ধতা দূর করতে প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে উদারতা, মহানুভবতা, যুক্তিশীলতা, পরমত-সহিষ্ণুতার চর্চাকে বেগবান করতে হবে এবং কুরআনের উদার ধার্মিক মূল্যবোধ এবং বিচার-বুদ্ধির প্রয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার অতি জরুরি। সকল শিক্ষাই এক হওয়া উচিত। স্কুল পর্যন্ত সকলেই ভাষা, অংক, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় পড়বে এবং স্কুলের পরে কেউ ইচ্ছে করলে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে, যেমনটা অন্য সকল উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে হচ্ছে। বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, এখনই। যদি কেউ ধর্মীয় বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করতে চায় তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ প্রশস্ত করতে হবে। এটা তো নিশ্চিত যে ধর্মান্ধগোষ্ঠী এর সাথে একমত হবে না। কারণ একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে শিশু-কিশোর-তরুণদের ওপর ধর্মান্ধদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এবং নতুন ধর্মান্ধ সৃষ্টির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
পাশাপাশি এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, মানুষ যেন নিজ ধর্মকে চিনে ধার্মিক হতে পারে। ধার্মিক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক উপযোজন ও আত্মিক উন্নতির প্রতি গুরুত্ব দেন এবং নিজের প্রকৃতিকে অনুসন্ধান করে নিজের ধর্মকে সাধনার মাধ্যমে আবিষ্কার করেন। তাই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে ধর্ম সামষ্টিক নয় ব্যষ্টিক। যিনি নিজ ধর্মকে জানেন তিনি এটাও জানেন যে প্রত্যেক মানুষের ধর্ম আছে। ফলে ধার্মিক সম্প্রদায় মুক্ত হয়। ধার্মিক ব্যতীত প্রত্যেক মানুষই কোন না কোন সম্প্রদায়ভুক্ত। আচার অনুষ্ঠান পালনেও ধর্মান্ধ ও ধার্মিকের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ধার্মিকের কাছে সালাত হচ্ছে সনির্বন্ধ আবেদন, আল্লাহর সাথে সংযোগ, অপরদিকে ধর্মান্ধদের কাছে সালাত অর্থ কেবলই নামাজ পড়া। ধার্মিকের কাছে জেহাদ অর্থ আত্মিক উন্নতি লাভের জন্য চরম প্রচেষ্টা, আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম, সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম কিন্তু ধর্মান্ধদের কাছে জেহাদ হচ্ছে সশস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তপাত। বাংলাদেশে শান্তিধর্মের ধারক বাহক হচ্ছেন ধার্মিক সত্যমানুষকুল। তাই এতকিছুর পরও আশার কথা হলো - এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ঐতিহ্যগত কারণে ধর্মান্ধ নয়। এদেশের মানুষ ধর্মান্ধ হলে এতদিনে ধর্মান্ধগোষ্ঠী কিংবা তাদের ব্যবহারকারী রাজনৈতিক দল স্থায়ীভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতো। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করাই বাঙালির ঐতিহ্য। বাঙালি তাদের ঐতিহ্যকে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না। সাংস্কৃতিক আন্দোলন, উদারতা, মহানুভবতা, যুক্তিশীলতা ও পরমত-সহিষ্ণুতা চর্চার মাধ্যমে বাঙালি ধর্মান্ধদের প্রতিরোধ করবে এবং পাশাপাশি নিজের ধর্মকে জানার প্রচেষ্টায় রত থাকবে এটাই সময়ের দাবী।

সংলাপ-সংবর্ধনা উত্তরণের পথে নতুন যাত্রা!




সংলাপ ॥ হাক্কানী সূফীতত্ত্বে বলা হয়, দেশে রাজনীতির আর দরকার নেই, এখন প্রয়োজন হচ্ছে জননীতি প্রণয়ন। সাম্প্রতিককালে দেশের দু’টি বিরাট ঘটনা-এক, ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের জোটের সাথে প্রধান বিরোধী শক্তি ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ এবং দুই, ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে কওমী মাদ্রাসাপন্থী আলেম-ওলামা কর্র্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদান ও প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’- উপাধি প্রদান। অভূতপূর্ব এই দুটি ঘটনার প্রতি এদেশের সর্বস্তরের মানুষের, এক কথায় সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি এমনভাবে নিবদ্ধ হয়েছে যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। সরকারবিরোধী বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির নেতা-কর্মী ও সমর্থকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার এই সফলতায় বলতে গেলে নির্বাক হয়ে পড়েছে। কারণ, দীর্ঘ দিন ধরে তারা এই কওমি মাদ্রাসা ও মক্তবের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে যেভাবে ব্যবহার করে আসছিল তার অবসান ঘটার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সরকারি অনুমোদন বাতিল করে তাদেরকে যে এক অন্ধকার জগতে নিক্ষেপ করেছিল তাও আজ জাতির কাছে নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। এই সংবর্ধনা তথা শোকরানা মাহফিল কওমি শিক্ষা-ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী করে এসব মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যোগ্য করে তুলে তাদেরকে দেশ ও সমাজে শান্তি ধর্ম ইসলামের সেবা করার একটি মোক্ষম সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কারণ, জনগণের এই বিরাট অংশকে অন্ধকারে রেখে তাদেরকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে বৈষম্যহীন সমাজ তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়ন সূদুর পরাহত। 
ঐতিহ্যগতভাবে ‘রাজনীতি’ শব্দটির সাথে এদেশের মানুষের নিবিড় একটি সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে বিভিন্ন কারণে ‘রাজনীতি’ নিয়ে সৃষ্ট জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে এই সংলাপ ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন সারা দেশের মানুষকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে তা আগামী দিনগুলোতে এই দেশে নতুন একটি উত্তরণের পথে যাত্রার একটি আশার আলো দেখা দিয়েছে বিবেকবান মানুষদের চিন্তাজগতে।
জনগণের কল্যাণে, তাদের ভালোমন্দ বিবেচনায় কর্মসম্পাদন করার উপায় এবং সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যা, বিজ্ঞানই জননীতি। আর ইংরেজি ‘পলিটিক’ শব্দের আভিধানিক বাংলা অর্থ হচ্ছে সুকৌশলী, সুবিচেনাপূর্ণ, কূটকৌশলপূর্ণ, ‘পলিটিক্স’ অর্থ রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি; রাজনৈতিক মতাদি বা কার্যাদি ইত্যাদি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজ দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, ‘পলিটিক্স’ ও ‘রাজনীতি’-এই দুটো শব্দই এখন নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার বেশি হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, ‘রাজনীতি’র মধ্যে এখন ‘পলিটিক্স’ ঢুকে গেছে। ফলে একদিন যে রাজনীতির মাধ্যমে এদেশের স্বাধীনতা  অর্জিত হয়েছিল, যে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে এদেশে স্বৈরাচার ও অবৈধ শাসকদের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রামে নিয়োজিত হয়েছিল, সে রাজনীতিতে এখন দেশদরদী, জনকল্যাণকামী, নিঃস্বার্থ সমাজসেবী কয়জন আছেন তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। এর কারণ হিসেবে বলা চলে, রাজনীতিক বা রাজনীতিজীবীদের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস মানুষ যে হারিয়ে যেতে বসেছে সে-কথা কেউ অস্বীকার করবে না। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে  যে, ভালো কাজের মধ্যেও মানুষ এখন ‘রাজনীতি’র গন্ধ পায়। 
সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া সংলাপ ও সংবর্ধনা-এই দুটি ঘটনার মধ্যে কতটুকু রাজনীতি? আর কতটুকুই বা জননীতি?-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে দেশেরই উত্তরণের স্বার্থে। গত ২০ কার্তিক, ১৪২৫, ৪ নভেম্বর, ২০১৮ রোববার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘শুকরানা মাহফিল’ থেকে কওমি আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তাঁকে ‘কওমি শিক্ষার্থীদের জননী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে অনুষ্ঠানের অন্যতম বক্তা ও জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা, গোপালগঞ্জ-এর অধ্যক্ষ, হাফেজ মুফতি রুহুল আমীন বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন অবদানের কথা উপস্থাপন করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা। তিনি কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি দিয়েছেন। সমস্ত কওমি শিক্ষার্থীদের মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন। আজ প্রধানমন্ত্রীকে কওমি শিক্ষার্থীদের জননী উপাধি দিলাম। তিনি কওমি শিক্ষার্থীদের জননী। মুফতি রুহুল আমীন আরও বলেন, ’আপনি ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর জননীর ভূমিকা পালন করেছেন। আপনার এই মাতৃত্বের ভূমিকা না থাকলে এই দেশে সাহাবাদের শত্রু, ওলামায়ে কেরামের শত্রু, বাংলাদেশের শত্রু জামায়াত-মওদুদীরা তা হতে দিত না’। 
এ সময় উপস্থিত লাখো মানুষের মধ্য থেকে এ প্রস্তাবনার পক্ষে সম্মতির আওয়াজ ভেসে আসে। পরবর্তী বক্তা হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ পূর্বের বক্তার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের শ্রদ্ধেয় হুজুর প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দিয়েছেন। তাহলে আত্মীয়তার দিক দিয়ে আপনারা কি হন? যদি জননেত্রী শেখ হাসিনা জননী হন, আপনারা সন্তান। সন্তানের প্রতি মায়ের যেমন, পিতার যেমন দায়িত্ব আছে, মায়ের প্রয়োজনে সন্তানদের দায়িত্ব আছে কি-না? এ দায়িত্ব সম্পর্কে আপনারা কি সজাগ আছেন? সেই দায়িত্ব পালন করতে আপনারা কি রাজি আছেন?’- এ সময় উপস্থিত অনেকেই হাত তুলে সম্মতি দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ’যারা সত্যিকার অর্থে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে, তারা কখনো সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদী হতে পারে না। দেশের শান্তি বিঘ্নিত হোক, তা আমরা চাই না। দেশে শান্তি থাকলেই উন্নতি হবে, উন্নতি থাকলে সবাই লাভবান হবে’।
এ সংবর্ধনা ও শোকরানা অনুষ্ঠানের আগে ও পরে দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসেছেন প্রথম বারের মত। দেশের প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠের বিভিন্ন এলাকা তারা ঘুরে দেখেছেন, সোপার্জিত স্বাধীনতা আর রাজু ভাস্বর্যের সামনে সেলফি তুলতেও দেখা গেছে অনেককে। যারা বাংলাদেশের গ্রাম-মফস্বলের সমাজকে চেনেন জানেন, যারা এদের সাথে মেশেন, মিশতে পারেন, এ মেশার সুযোগ ও অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তাদের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এক ধরনের, তাদের কাছে উপলব্ধি হেফাজতপন্থীদের এ পরিবর্তন ও বিবর্তন মূলধারায় ফেরা। আর যারা লেখাপড়া শিখে তথাকথিত আধুনিক হয়ে গিয়ে চাকুরি-ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি করতে গিয়ে গ্রাম-মফস্বলের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন তাদের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা আরেক রকম হবে- তারা এ নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করতে পারেন, নাক সিঁটকাতে পারেন, এখানে ডানপন্থার উত্থান-বামপন্থার সংকট ইত্যাদি বিষয় খুঁজতে পারেন-যা স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে দেখলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশে হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা-উদ্যোক্তা-শিক্ষক-শিক্ষার্থী- মাদ্রাসার জায়গা-জমি সবই এদেশের মাটিতে। পরাধীনতার সেই দুঃসময়ে এদেশে ব্রিটিশ বণিক ও রাজশক্তি ইসলাম ধর্মকে তাদের সুবিধা অনুযায়ী প্রচারের জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র এবং এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তারাই বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা স্থাপন করেছিল। তবে সত্য হচ্ছে, ব্রিটিশরা এদেশকে ব্রিটেন বানাতে পারেনি এবং তার সবচেয়ে প্রমাণ হচ্ছে এদেশের মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আজকে যারা এদেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র তারা ৯০ ভাগেরও বেশি এদেশের কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত-বিদেশে কর্মরত শ্রমিক-ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের সন্তান। ৭১’এ যেসব পরিবার ও তাদের সন্তানেরা দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য অস্ত্রহাতে নিয়েছিল পরবর্তীকালে এই স্বাধীন দেশে তাদেরকে যথাযথভাবে পুনর্বাসন করা হয়নি, বরং নানা ক্ষেত্রে তাদের বঞ্চনার পরিমাণটা ছিল বেশি। তা সত্ত্বেও এদেশের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা-সংগ্রামীদের প্রতি তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে তারা কখনও কার্পণ্য করে না। এক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করেছে শুধুমাত্র ৭১এর রাজাকার-আলবদর-মুসলিম লীগ-শান্তি-কমিটি-জামায়াত পরিবারের লোকজন যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল জিয়াউর রহমানের বিএনপি এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি।  এদেশের সাধারণ মানুষের সাথে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কোনো বিরোধ নেই, কখনো ছিলোও না। এক কথায় বলা চলে, এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিই তাদের জঘন্য রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য কওমি মাদ্রাসাসহ ধর্মভিত্তিক সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষক-আয়োজকদেরকে মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগ-বঙ্গবন্ধু-জয় বাংলার বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিল। এবারের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক সংবর্ধনা ও শোকরানা মাহফিল এই ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটানোর ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করছে দেশের বিবেকবান মহল।
অপরদিকে, সম্প্রতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের বিরোধী রাজনৈতিক জোটের সাথে দুই-দফা সংলাপ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় এবং রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এক নতুন পথের সন্ধান দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  দশম নির্বাচনের আগে একইভাবে সংলাপে বসার জন্য তাঁর প্রস্তাবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সম্মত হলে বিগত পাঁচ বছরে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ আরও মজবুত কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত হতো। অবশ্য ২০১৩ সালে সালের চাইতে বর্তমান পরিবেশ ভিন্ন। বর্তমান পরিবেশে ড. কামাল হোসেন সংলাপে বসার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া এখনও কারাগারের বাইরে থাকলে এমন একটি সংলাপ আদৌ অনুষ্ঠিত হতো কিনা তাতে সন্দেহ ছিল। অথচ অপার সম্ভাবনাময় এই দেশের সর্বস্তরে শান্তি ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংলাপ-সমঝোতাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, আলাপ-আলোচনা-সংলাপের মধ্য দিয়েই অনেক সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসে এবং জননীতি গ্রহণ-প্রণয়ণ সম্ভব হয়। কিন্তু জনগণের কল্যাণে যারা নিবেদিত নয়, ব্যক্তি-গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তির স্বার্থে যাদের রাজনীতি, তাদের পক্ষে জননীতি প্রণয়নও সম্ভব হয় না। এই কঠিন বাস্তবতা থেকে উত্তরণের পথে এই সংলাপ থেকে কল্যাণকর সবকিছু উঠে আসবে, দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য যথাসময়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সকলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হবে-এই আশায় আজ দিন গুণছে জাতি। পবিত্র কুরআনের ভাষায় বলতে হচ্ছে, ‘সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসারিত’।

পরগাছা-আগাছামুক্ত রাজনীতি



সংলাপ ॥ গাছ-গাছালির মধ্যে যে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় গাছ বেড়ে উঠে সেটাই আগাছা। গাছের যতœ নেয়া না হলে আগাছাই সেখানে বড় হয়ে দেখা দেয়। এমনকি প্রয়োজনীয় গাছটিকে প্রায় নিঃশেষও করে দিতে পারে আগাছা আর স্বর্ণলতার মতো পরগাছারা। অযত্ন-অবহেলায় থাকা এদেশের যে-কোনো ফসলের জমি, বাগান বা বাগানের গাছের দিকে তাকালে এমন দৃশ্য চোখে-পড়ে সহজেই। গাছের মতো রাজনীতির অঙ্গনেও আগাছা ও পরগাছা জন্মে। কয়েকশ’ বছর ধরে এই বাংলা তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অসংখ্য বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীর নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন ও লড়াই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১’র ৭ মার্চে লক্ষাধিক মানুষের সামনে এসে ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরই ধারাবাহিকতায় বহু আত্মত্যাগে এলো ১৬ ডিসেম্বর, বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো জনতার সমাবেশে বললেন, ‘আমার স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে’।
২৪ জানুয়ারি কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি তোমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারবো না। আরো তিন বছর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতে না? (উত্তর, ‘করতাম, করতাম’) তা হলে মনে কর যুদ্ধ চলছে, তিন বৎসর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙ্গল আর কোদাল।’-তারপর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে চললো ব্যাপক আয়োজন। সেদিন সবই হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু রাজনীতিতে যে আগাছা ও পরগাছা রয়ে গিয়েছিল এবং নতুন করে জন্ম নিচ্ছিল সেদিকে খেয়াল দেয়ার সময় পাননি তিনি, কারণ তিনি সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন বাংলা ও বাঙালি জাতির উন্নতির ভাবনায়। কিন্তু এরই মাঝে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কত আগাছা ও পরগাছা জন্ম নিয়েছিলো তা জাতি বুঝতে পেরেছিল ৭৫’র ১৫ আগষ্টের পর।
বঙ্গবন্ধু সরকারকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির গাছ ধরলে সেই গাছেই আগাছা ও পরগাছা হিসেবে খন্দকার মোশতাক গং (বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী!) যে কীভাবে পেঁচিয়ে ধরে জীবনীশক্তি শোষণ করেছিল এবং আজও করছে তা বাঙালি জাতির উপলব্ধিতে আজও বিদ্যমান। বঙ্গবন্ধু সরকারের কোনো মন্ত্রী, সশস্ত্রবাহিনীর কেউ তাঁর দলের কোনো নেতা-কর্মী, সেদিন সেই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করার সৎ সাহস দেখায় নাই। রাজনীতির আগাছা-পরগাছাগুলো বড় হয়ে যাওয়ার কারণে সেদিন বাঙালি জাতি হয়ে পড়েছিল নেতৃত্বহীন এবং বাকরুদ্ধ। মোশতাক স্বাধীনতার পর কীভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিল, মুজিবনগর সরকারের নির্ভিক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তৎকালীন সরকার থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, সেই ঘটনাগুলোকে বাস্তবতার নিরীখে উপলব্ধি করা আজও বড় বেশি প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশরত্ন কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে দুঃখ করে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে যে জাতি বীরের জাতিতে পরিণত হয়েছে, ৭৫’এর ১৫ আগষ্টে তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই জাতির একাংশ দেশ ও জাতির কাছে ঘাতক হিসেবে  পরিচিতি লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধুর সাথে একজন মেজরকে তুলনা করার ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে, যা শান্তি (ইসলাম) ধর্মের পরিপন্থী। দুঃখের বিষয় এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। দীর্ঘ একুশ বছর খোদ্ বঙ্গবন্ধুর নামটিকেই বাংলাদেশে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পরগাছা ও আগাছাগুলোই ডালপালা মেলে এদেশের গণমানুষের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিকে আদর্শহীন ও লুটপাটতন্ত্রে পরিণত করেছিল। এর সংক্রমণ দেশের প্রশাসনসহ সর্বস্তরে আজও বর্তমান। জিয়াউর রহমানের আমলে দেশের ছাত্র-যুবসমাজের চরিত্রকে কলংকিত করার জন্য যে ইয়ুথ কমপ্লেক্স গঠন এবং হিজবুল বাহার জাহাজে চড়ানো হয়েছিলো সেই ধারাবাহিকতা অর্থাৎ, রাজনীতিতে আগাছা তৈরির যে বীজ বপন করা হয়েছিল তার পরিণতি আজও বহন করতে হচ্ছে দেশ ও জাতিকে। এদেশের যে রাজনীতি একদিন ছিল সমাজসেবা, আজ তাই হয়ে উঠেছে ব্যক্তি ও কায়েমী স্বার্থ উদ্ধার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্র রাজনীতির নামে আজ দেশসেবা নয়, সন্ত্রাস ও নিজের আখের গুছানোর রাজনীতি হচ্ছে। আর এ কাজটি করার জন্যই আগাছা-পরগাছা রাজনীতিক ও ছাত্র-যুবকেরা ছাত্রলীগ তথা আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি সংগঠনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, কলংকিত হচ্ছে ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগ এর রাজনীতিকরা।
রাজনীতির অঙ্গনে এই দুরাবস্থার জন্য যারা শুধুমাত্র ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে দোষারূপ করে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে তারা বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে শুধুমাত্র রাজনীতির পানি ঘোলাটে করছে, তাই রাজনীতির অঙ্গনে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনকেই আগাছা ও পরগাছা মুক্ত করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। এর জন্যে সব অঙ্গনেই যত ত্যাগের প্রয়োজন তা দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে বাঙালি জাতিকেই করতে হবে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই, যেহেতু তিনি জাতির কাছে ওয়াদাবদ্ধ।
ইংরেজী শব্দ ‘পলিটিক্স-এর বাংলা ‘রাজনীতি’ শব্দটির সংস্কার প্রয়োজন। ইংরেজ আমলের তথাকথিত বাঙালি পন্ডিতদের করা অনুবাদ ‘রাজনীতি’র পরিবর্তে এখন ‘জননীতি’ শব্দটি চালু করলে অনেক বেশি প্রান্তিক মানুষের কাছাকাছি আসা যাবে এবং এর কার্যকারিতা জাতিকে আরও বলিষ্ঠ করবে। নিজের সমাজ ও দেশ গঠনে মনোনিবেশ না করে যারা শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছানোর জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ করে তারাই লাখো শহীদের আত্মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী এবং নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে তারাই রাজনৈতিক অঙ্গনে আগাছা হয়ে আজও বর্তমান। এরাই ‘ইন্দুরের’ মতো ধানের গোলা থেকে ধান নষ্ট করে ফেলছে। সার্বিক অঙ্গনে এইসব আগাছা-পরগাছাদের সংস্কারের মাধ্যমে যতো বেশি সম্ভব উপড়ে ফেলা যাবে এবং নির্মূল করার চেষ্টা করা যাবে, দেশ ততো দ্রুত ক্রমোন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

স্ব-ভাব


মানুষ জন্মাবার পর পারিপার্শ্বিকতা হতে তার অভ্যাস গড়ে তোলে। প্রথমে সে চোখকে বেশি কাজে লাগায়। অনুকরণ ও অনুসরণ করতে চেষ্টা করে পরিবারের সদস্যদের এবং চোখ দিয়ে যা দেখছে সেগুলোকে। অতঃপর চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বকের সহযোগিতায় হাত, পা, মুখ, পায়খানা ও প্রসাবের রাস্তা সমূহের দ্বারা বিভিন্ন কর্মের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করে। যখনই কোন কর্ম করে তখনই সে সুখ, দুঃখ বা ঔদাসীন্যের সঙ্গে জড়িত হয়, কর্মফলের উপর নির্ভর করে। এভাবেই ধীরে ধীরে সে বড় হতে থাকে পরিবেশগত কর্মের মাধ্যমে। গবেষকদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ৫ (পাঁচ) হাজার হতে ৭ (সাত) হাজার কর্মের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখে প্রতিদিন। প্রতিদিনের এই কর্মগুলোর মধ্য দিয়েই একই পরিবেশ অন্তর্ভূক্ত কর্মের বারবার বাস্তবায়নে তার গড়ে ওঠে অভ্যাস। এই অভ্যাসের প্রকাশ ভঙ্গিতেই আস্থা গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে স্ব-ভাবে পরিণত হয়। ধর্মীয় আঙ্গিকে স্ব-ভাবের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। স্ব-ভাবকে দুই ভাগ করে সৎ স্ব-ভাব ও মন্দ স্ব-ভাব বলা হয়েছে এবং সৎ স্ব-ভাবের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সর্বযুগে-সর্বকালে সকল ধর্মে।
ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে সরাসরি সৎ স্ব-ভাবের উপর জোর দেয়া হয়েছে আত্মিক উন্নতির জন্য। নবী মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন:
- সৎ স্ব-ভাবই ধর্ম।
- সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট কার্য সৎ স্ব-ভাব।
- সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট গুণ সৎ স্ব-ভাব।
- সৎ স্ব-ভাবের বলে মানুষ ‘ছায়েমুদ্দাহার’ অর্থাৎ সারা বৎসর সিয়াম পালন করার এবং ‘ক্বায়েমুল্লাইল’ অর্থাৎ সারা রাত্রি দাঁড়িয়ে এবাদত করার ফযিলত ও ছওয়াব লাভ করতে পারে।
ধর্মীয় গবেষকগণ সৎ স্ব-ভাবের পরিচয় বা তত্ত্ব বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়ে নানা মত ও পথের জন্ম দিয়েছেন নিজেদের জানা ও উপলব্ধিবোধ হতে। যেমন - হাসি মুখ, কষ্ট সহ্য করা বা অত্যাচারে প্রতিশোধ না নেয়া সৎ স্ব-ভাব। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এগুলো এক একটি শাখা বা লক্ষণ কিন্তু সৎ স্ব-ভাবের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নয়।
মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মেই জন্ম নেয়। পরবর্তীতে নিজের এক এক রূপ সৃষ্টি করে বিবর্তনের ধারায়। পরিবেশকে মোকাবিলা করার জন্যে কর্ম করে। কর্মের মধ্য দিয়েই তার দেহ শক্তিশালী হয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি ও বৃত্তিগুলি সমভাবেই বিকশিত ও স্ফূর্ত হয়। এই বিকাশের ধারা থেকেই বিভিন্ন অঙ্গের শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, নিয়ন্ত্রণ শক্তি এবং প্রবৃত্তি জেগে উঠে। এদের মাঝে সমতা এবং সামঞ্জস্য রক্ষা করার জন্য আবির্ভাব ঘটে বিচার শক্তির। এই চার শক্তির কোনটা কম বা বেশি থাকলে স্ব-ভাব গড়ে উঠে না অপূর্ণ থাকে। কম হলে দুর্বল বা অকর্মণ্য হয় আর বেশি হলে কুৎসিত আকার ধারণ করে এবং তা তার কর্মের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। একই তালে চারশক্তির প্রবৃদ্ধি যখন ঘটে একটা কর্মকে কেন্দ্র করে তখনই গড়ে ওঠে স্ব-ভাব। স্ব-ভাব দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে এবং তা যথাক্রমে সৎ স্ব-ভাব ও অসৎ স্ব-ভাব। এই দুই স্ব-ভাবের মধ্যে ব্যবধান নির্ণয় করার জন্য কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। ব্যক্তি যখন তার কর্ম অঙ্গগুলো সজাগ রাখে, তার বিচার শক্তি দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং প্রতিটি কর্ম বিশ্লেষণ করে তখনই তার মধ্যে চিন্তাজগতে দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয় আর এই দ্বন্দ্বই তাকে সৎ-অসৎ পথের সন্ধান দেয়।
যখনই দ্বন্দ্ব দেখা দেয় প্রতিটি কর্মকে ঘিরে তখনই সৎ সংসর্গে আসা একান্ত আবশ্যক যিনি সংশোধনের জন্য পথ দেখান। তিনি অসৎ পথগুলোর ব্যাখ্যা করেন এবং পারিপার্শ্বিকতা গড়ে তুলতে অসৎ হতে সৎ পথের যাত্রীকে সহযোগিতা করেন। এছাড়াও যখন কেহ কর্ম বিশ্লেষণ করে নিজেকে উপলব্ধির পর্যায়ে উন্নীত করেন তখন তার কর্মগুলো খারাপ হতে পারে না। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং চিন্তাজগতকে সঠিক পথে চালাতে পারে। এইভাবে কোন কাজের অভ্যাস করতে থাকলে পরিশেষে ওই অভ্যাসই তার স্ব-ভাব হয়ে দাঁড়ায়। আর এই কারণেই বলা হয় অভ্যাস দ্বিতীয় স্ব-ভাব। এখানেই অনুসন্ধিৎসু মানুষ পথ প্রদর্শক খোঁজে এবং মুর্শিদের সন্ধান করে আত্মসমর্পণ করে আত্মিক উন্নতির জন্যে। মুর্শিদ তাকে পথ দেখায় - আল্লাহ্ প্রেমের সন্ধান দিয়ে।
শরীর অসুস্থ হলে ভাল খাবারও যেমন মুখে খারাপ লাগতে পারে অরুচির জন্যে, ঠিক তেমনি চিন্তা ও চেতনায় খারাপগুলো অনুপ্রবেশ ঘটালে আল্লাহ্ প্রেম হতে সে দূরে থাকবে। তার ভাল লাগবে না আজ্ঞাবহ হতে।
চিন্তাজগতকে একরৈখিকতায় কার্যকরী করে যে সমস্ত কাজ করা যায় তার একটা প্রভাব অভ্যন্তরীণ চেতনায় বিস্তার লাভ করে। ফলে ব্যক্তি এক অনির্বচনীয় জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে। নবী মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন - আল্লাহ্র নির্দেশ আনন্দের সাথে পালন কর। যদি না পার তবে জবরদস্তি সহকারে পালন কর, কেননা এই জবরদস্তি করার মধ্যে প্রচুর পুণ্য রয়েছে।
সাধনা এবং পরিশ্রম দুটোর সাহায্যেই ফিরিশতার স্ব-ভাব ও গুণ অর্জন করা যায় এবং আধ্যাত্মিক জগতই মানবজাতির মূল উৎপত্তিস্থল। ধন-দৌলত এবং পার্থিব প্রতিপত্তির মোহে মত্ত থাকিলে নিকৃষ্ট স্ব-ভাব গড়ে উঠে। সেই নির্বোধ যে নিজের সম্বন্ধে ভাল ধারণা পোষণ করে, নিজকে  বহু গুণের অধিকারী বলে মনে করে ও নিজের মধ্যে কোন দোষ-ত্রুটি আছে বলে মনে করে না। বুদ্ধিমান সেই যে নিজের দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধে সজাগ থাকে।
“একদা এক জিহাদ হতে আসার পর সাহাবাগণকে নবী মুহাম্মদ (সঃ) জিজ্ঞাসা করলেন - আমরা ছোট জিহাদ হতে আসলাম, না বড় জিহাদ হতে? সকলে আরয করলেন - ইয়া রাসুলাল্লাহ্ (সঃ), বড় জিহাদ কি? তিনি উত্তর দিলেন - নিজের নফস্ বা প্রবৃত্তির সাথে যুদ্ধ করাই বড় জিহাদ।” যত বড় দুর্দম্য এবং অবাধ্য প্রজাতি হোক না কেন নফস্ বা প্রবৃত্তি তদপেক্ষা অধিকতর অবাধ্য। তাই শক্তির লাগাম হতে অধিকতর শক্ত লাগাম দিয়ে নফস্কে সর্বদা বশে রাখা আবশ্যক। আর এর জন্য মুর্শিদের উপদেশ নামক অধিকতর শক্ত লাগামটি সর্বোৎকৃষ্ট।
এই আলোকে ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সৎ স্ব-ভাবের কি প্রয়োজন তা একটু চিন্তা করলে বেশ বুঝা যাবে। মা-বাবা সৎ স্ব-ভাবী হলে ছেলে-মেয়ে সৎ স্ব-ভাবী হতে বাধ্য। এভাবে প্রত্যেকটি পরিবার সচেতন হলে সমাজ সচেতন হবে এবং সামাজিক পরিবর্তনের পথ খুলে যাবে। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় জীবনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন কর্ণধারদের অবশ্যই সৎ স্ব-ভাবী হতে হবে। তাঁদের সৎ স্ব-ভাব থাকলে তারই স্পর্শে প্রশাসনিক ধারায় সৎ স্ব-ভাবের প্রভাব পড়তে থাকবে যা শুধু সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ করবে না বরং আত্ম-উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে।
পৃথিবীর সকল চোখকে ফাঁকি দেয়া যায় কিন্তু নিজের বিবেককে ফাঁকি দেয়া যায় না। তাই মানুষ সংসার জীবনে শুধু লোভ আর মিথ্যা অহং ভাবের বশবর্তী হয়ে বিবেকের তাড়নাকে ঢাকা দেয়ার জন্য অভিনয় করে যাচ্ছে মাত্র। ব্যক্তি জীবনে প্রত্যেক মানুষই ধর্মপালন করে যাচ্ছে আর সেটা হচ্ছে তার মোহাচ্ছন্নতার ইচ্ছাধর্ম। পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু তাতে তার লোভ ও অহংকার দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না। ‘নিয়ন্ত্রণ’ বলে শব্দটা বই পুস্তকে রয়ে যাচ্ছে কিন্তু ব্যক্তি জীবনে এর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণকে স্ব স্ব জীবনে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করে চোখ। এই চোখই যতো নষ্টের গোড়া আবার এই চোখই সাধারণ মানুষকে আত্মিক উন্নতিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে স্ব-ভাব গড়াতে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির স্ব-ভাবের পরিবর্তন দলের উপর প্রভাব বিস্তার করতে করতে সমগ্র জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করে জাতীয় জীবনে এক মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তাই প্রয়োজন নেতৃত্বদানকারী নেতা-নেত্রীর সত্য ও দৃঢ় প্রত্যয়ী স্ব-ভাবীহওয়া। বিপদে পড়লে মানুষের চরিত্রের অনেক গোপন রহস্য উদ্ঘাটিত হয় আবার প্রকৃত বন্ধুও চেনা যায়।
আমাদের স্মরণে রাখতে হবে দেশবাসী না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তারা একটু শান্তি চায়, একটা সুন্দর পরিবেশ চায় যেখানে সার্বিক আতঙ্কমুক্ত থাকতে পারা যায়। আসুন, আমরা সৎ স্ব-ভাবী হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের পথে পা রাখি। 

বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮

সময়ের দাবী - দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতা


সময়ের দাবী -
দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতা

সংলাপ ॥ দশম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন ছিল গত ২৯ অক্টোবর। একটি সংসদের নির্ধারিত মেয়াদকাল সমাপ্তির পথে। সারাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সর্বমহলে চলছে জোর আলোচনা। ক্ষমতা আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জোটের রাজনীতি বেশ ঝাঁকিয়ে বসেছে কিন্তু চাপা উত্তেজনায় সারা দেশের মানুষ। নির্বাচনের পূর্বে সংলাপ শুরু করার জোর আবেদন ছিল বিরোধী সব মহল থেকে বর্তমান সরকারের কাছে। সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যে সংলাপ বিষয়ে যখন হতাশার জন্ম নিচ্ছিল ঠিক তখনই বিরোধী ঐক্যফ্রন্টের নেতার চিঠি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে তিনিও দেরি না করে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতাকে সংলাপের দিনক্ষণ জানিয়ে পত্র পাঠালেন। হঠাৎ যেন বাংলার রাজনীতিতে সমঝোতার সুর!   
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করা জরুরী হয়ে পড়েছিল কারণ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। রাজনীতির মাঠে যারা আছেন তারা তো অবশ্যই, বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক, গবেষক সকলেরই এক কথা - সমাজে সর্বস্তরে দ্রুত সংলাপের ব্যবস্থা নেয়া দেশ ও দেশের জনগণের স্বার্থে। বিদেশী বন্ধুরাও সরব ছিল সংলাপের পক্ষে। তারাও যথারীতি পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা বেশ জোরের সাথে প্রচারিত হচ্ছে, যাতে জনসমর্থন সংলাপের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানতৈরি হয়। সকলের একই কথা-সংলাপের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রে ফিরতে হবে যদিও বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন আছে তা কোন গণতন্ত্র? সর্বদিক থেকে সংলাপ আয়োজনের বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। রাজনৈতিক দল ছাড়া যেহেতু রাজনীতি চলবে না আর রাজনীতি না থাকলে যে কোন পদ্ধতির গণতন্ত্র থাকবে কোথায়? নিঃসন্দেহে এর চেয়ে যৌক্তিক বিবেচনা আর কী হতে পারে? এমন সরল সমীকরণ অস্বীকার করবে কে?
সংলাপ বা আলোচনা যেহেতু গণতন্ত্রের একটি ভীত, সুতরাং তাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র মনষ্কতা নিশ্চয়ই সুচিন্তিত নয়। কাজেই সর্বস্তরে সংলাপ হোক। আমাদের গণতন্ত্র ছিলো, একসময় আমরা হারিয়েছি, এখন আমরা আবার হাঁটি হাঁটি করে সেখানে ফিরে যাচ্ছি। আর সে যাওয়ার পথে দেশ ও জাতির উপযোগী গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়নের দায় বর্তমান সরকারের। তারা হাত ধরে জাতিকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাবেন।
বর্তমান সরকার জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার। দেশে যুগোপযোগী গণতন্ত্রে ফিরতে এই সরকার কর্তৃক বিভিন্ন আঙ্গিকে সংস্কার ও বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে যা বাংলার ও বাঙালি জাতির ঐতিহ্য রাখতে পারে। তাই আবার ফিরতে হবে শিকড়ের সন্ধানে এবং যাদের দ্বারা তা কার্যকর হবে তাদেরই কাছে অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের হাতেই তুলে দিতে হবে দেশকে গণতান্ত্রিক শাসনে ফিরিয়ে আনতে। তাই সর্বস্তরে সংলাপ জরুরি।
কোনো সন্দেহ নেই গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন অবশ্যই অপরিহার্য আর সে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল তো থাকতেই হবে। কিন্তু যে দলগুলো ৭৫’ পরবর্তী বছরগুলোতে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে গণতন্ত্রের নামে যে বন্যতা, বর্বরতা উপহার দিয়েছিলো আমরা কি আবার তাদেরই কাছে ফিরে যাবো গণতন্ত্রের জন্য? গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে এই সরকার কর্তৃক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইনগত বৈধতা রয়েছে। সরকারের চিন্তাগত অবস্থান স্পষ্ট না হলেও কর্মকা-ে মোটামুটি প্রতীয়মান যে খুব বেশি হার্ডলাইনে তারাও আর অবস্থান নিতে চাচ্ছেন না।
 দেশে গণতন্ত্র আছে কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য যুগপোযোগী গণতন্ত্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনসমর্থন পেয়ে একটানা ১০বছর অতিক্রান্ত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বর্তমান সরকার। কিন্তু সেই জনগণতান্ত্রিক গণতন্ত্র এবং জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজনীতির অঙ্গনের খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে স্বদেশী ধারায়।কিন্তু যারা ছিলো যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মের নামে উগ্র সন্ত্রাসী, দেশ ধ্বংসকারী, মানবাধিকার লংঘনকারী, দানবীয় রাজনীতির প্রবর্তনকারী, দুর্বৃত্তায়িত চিন্তা পরিবেষ্টিত হিংস্র শ্বাপদ তারা যেন আবার অপরিহার্য হয়ে উঠতে না পারে দেশ পরিচালনায় গণতন্ত্রের নামে। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে প্রতিটি সচেতন বাঙালিকে।
শুধুমাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার পরিচালনা করতে পারবে না। সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ায় গণদাবি ও ন্যায়বিচারকে পাশ কাটিয়ে চলা সেই সব দুর্বৃত্ত রাজনীতিকদেরকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার হীনচক্রান্ত রুখতে হবে। গত ১০ বৎসরের অভিজ্ঞতা বলছে ন্যায়বিচারের দরজা এখনো যথারীতি রুদ্ধ হয়ে যায়নি। ইঁদুর-বিড়ালের খেলা আর মিডিয়ায় নানা নাটক, সংস্কারের মৌলিকত্বকে এখন যে-চোরা গলিপথের দিকেই ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে, তা কি সচেতন রাজনীতিকরা অনুধাবন করতে পারছেন না? শুরুতে দৃঢ়তা না থাকলে লক্ষ্যের স্থিরতা থাকবে না, লক্ষ্যে পৌঁছানোও যাবে না।
গণতন্ত্র কোনো পণ্য নয়, যা মুদি দোকানে বিক্রি হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসলেই অমনি তা জনগণ প্রয়োজন মতো মুদি দোকান থেকে কিনতে পারবে। এর কোনো অলৌকিকত্বও নেই যা আলাদিনের প্রদীপ হয়ে আমাদেরকে গণতান্ত্রিক বানিয়ে ফেলবে কিংবা আমাদের রাজনীতিকদেরকে সত্যি সত্যিই গণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বদলে দেবে। এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন না। স্বাধীনতার উত্তরকালে ক্ষমতায় থাকাকালীন সব দলের রাজনীতিকদের চরিত্রগুলো দেশবাসীর কাছে একেবারেই অপরিচিত নয়। এদের মধ্যে থেকে পাঁচ শতাংশ বের করা যাবে না যাদের ন্যূনতম দেশপ্রেম ছিলো বা আছে। তাই দেশ ও জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় এনে যুগোপযোগী গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রণয়ন করে নতুন প্রজন্মকে সামনে এগিয়ে দিতে না পারলে বর্তমান সরকারকেও পিছু হঠতে হবে যা কোনভাবেই কাম্য  নয়। তাই সময়ের সাথে সাথে সমাজের সার্বিক অঙ্গনে সত্য প্রতিষ্ঠার কান্ডারি হওয়া বর্তমান সরকারের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

বাংলাদেশে অতি-রাজনীতির সঙ্কট


বাংলাদেশে অতি-রাজনীতির সঙ্কট

* ভাল যদি সমর্থিত না হয়, খারাপ যদি ধিকৃত না হয়, তা কি সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হতে পারে?
* মানুষের অভ্যন্তরীণ ভাবনার কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা না করে  বাহ্যিক কাঠামোর পরিবর্তন কি সম্ভব?
* সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানের জন্য প্রয়োজন পক্ষপাতশূন্য, যুক্তিশীল, ও স্বচ্ছ  চিন্তা।

সংলাপ ॥ এক সময় বাঙালির গর্ব করার বিষয় ছিল তার রাজনৈতিক বোধ। আমরা রাজনীতি সচেতন, সাম্প্রদায়িক নই, জাত-পাতের পরোয়া করি না, ইত্যাদি। অর্থাৎ আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য যা যা অপরিহার্য সেগুলো আমাদের ছিল। মনে প্রশ্ন জাগে, মানুষ রাজনীতি করে কেন? সময়ের পরিক্রমায় জানা যায়, জীবনের প্রতিটি পরতে জড়িয়ে  রয়েছে রাজনীতি। তা সে দেশ শাসন হোক বা অর্থনীতি। শিক্ষার জগৎ বা খেলার জগৎ। রাজনীতি ছাড়া জীবন অচল।  নিজেকে প্রশ্ন করে দেখি, আমি রাজনীতির কোন দিকে? উত্তর যেন একটা পুরনো গান , ‘আমি বাম দিকে রই না, আমি ডান দিকে রই না/ দুই দিকেতেই রই পরান জলাঞ্জলি দিয়া রে।’
এক সময় ট্রেনে-বাসে-হাটে-মাঠের আড্ডায় সাবলীল ভাবে ঢুকে পড়ত রাজনীতির প্রাণবন্ত আলোচনা। সব সময়ই সাবলীল থাকত না অবশ্য। কখনও কখনও কথা বলার সময় সাবধানী হতে হত। এ দিক ও দিক দেখে তবে বলতে হত।
প্রাণের কথাও বলতে গিয়ে ঢোক গিলে তৈরি কথা বলতে হত। অন্য দিকে যারা স্পষ্টত এক পক্ষের, তাদের এ সব টানাপড়ন ছিল না। যারা প্রকৃতিগতভাবে সুযোগসন্ধানী, তাদেরও কোনও সমস্যা হত না। সমস্যা হত আমাদের মতো মাঝের মানুষদের। সব দিক সামলে চলতে হত। রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতি নিয়ে গভীর সব প্রশ্ন ছিল। মানুষের অভ্যন্তরীণ ভাবনার কাঠামো বদলের চেষ্টা না করে শুধু ওপর ওপর বদল কি সম্ভব?
এখন সেই সব প্রশ্নের দিন আর নেই। কর্মপদ্ধতি, অভ্যন্তরীণ ভাবনা ইত্যাদি রাজনীতির অঙ্গন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এখন স্পষ্ট, বাঙালি পাঠক বা শ্রোতা কেউই বস্তুমুখী সৎ খবর পছন্দ করেন না। মনমতো খবর তাদের কাছে পৌঁছলেই তারা খুশি। এমন খবর যা মনকে তৃপ্তি দেবে। আজকের পাঠক নিজের পছন্দের কাগজ থেকে নিজ মতাদর্শ সমর্থনের পাথেয় জোগাড় করে নেন। সংবাদপত্র গোষ্ঠীর ‘টার্গেট মার্কেটিং’ মডেলটা বেশ খাপ খায় এর সঙ্গে। এলাকার রাস্তা কেন খারাপ? উত্তর, হয় দেশ পরিচালনায় সরকারী দলের ব্যর্থতা কিংবা প্রশাসনের অপদার্থতা, যিনি যেটা শুনতে চান। শাসকবিরোধীরা সর্বদা শাসকদলের দোষ দেখেন, আর শাসকরা সর্বদা বিরোধীদের কিংবা আগের সরকারগুলোর ত্রুটি খুঁজে চলেন। অথচ রাস্তা খারাপ থাকার প্রকৃত কারণ হয়তো অন্য।
আশ্চর্যের বিষয়, আপাদমস্তক পক্ষপাতদুষ্ট সাধারণ মানুষের সমাজ এত বিশাল। এই বিশাল সংখ্যা নেহাত উপেক্ষার বস্তু নয়। এটা কি কাম্য? তাই কি দেশে যে কোনও বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, ধর্ষণ বা খুনের তদন্তে শেষ অবধি ন্যায়বিচার জোটে না সাধারণের কপালে, কেবল পক্ষপাতদুষ্ট চাপানউতোর চলতে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত উপসংহার যে কী হবে, সেটা প্রায় পূর্বনির্ধারিতই বলা চলে।
কোনও রাজনৈতিক দলের তাই আজ আর বেশীরভাগক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। বাস্তব যেহেতু অস্পষ্ট, নীতি বস্তুটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো, আদর্শ কাকে বলে তাও কেউ ঠিকমতো জানে না, তাই রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মতো করে এ সবের ব্যাখ্যা দিয়ে যায়, আর মানুষ পক্ষপাতদুষ্ট মনে কোনও রকম অগ্রপশ্চাৎ বিচার না করেই সে সব গ্রহণ করে। অপছন্দের তথ্যকে সন্দেহ করে, তাকে গুরুত্ব দেয় না, গ্রহণ করে না। আর পছন্দের মিথ্যাকে বিশ্বাস করে, উপরে  তুলে ধরে। এই অতি-রাজনীতির জেরে সমাজের অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাকে কি দেশের জন্য মঙ্গলজনক বলা চলে? ভাল যদি সমর্থিত না হয়, খারাপ যদি ধিক্কৃত না হয়, তবে তা কি সমাজের জন্য ভাল হতে পারে? একটি আলোচনা সভায় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের উক্তি ব্যবহার করায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকের সেই বক্তব্য মনোমতো হয়নি বলে তিনি বললেন, ‘দেড়শো-দু’শো বছরের পুরনো রেফারেন্স আজ অচল।’ তাই কি? মূল্যবোধের নতুন-পুরনো কি এতটাই আলাদা? না কি, পক্ষপাতের উপর নির্ভর করেই আমরা নতুন পুরনো বেছে নিই?
আজ বাংলার রাজনীতির অভিধানে ‘মিথ্যা কথা’র পরিবর্তে প্রবেশ করতে পারে একটি নতুন শব্দ: ‘রাজনৈতিক কথা’। অর্থাৎ ডাহা মিথ্যা কথাও রাজনৈতিক হলে এখানে চলে যায়, চালানো যায়। রাজনীতিই যখন মুখ্য, সেখানে সত্য-মিথ্যার বাছবিচার দরকার কী। বরং সেই ফাঁকে স্বার্থ গুছিয়ে নেয়াই বুদ্ধির কাজ। সত্য বা সততা এখন বোকামির লক্ষণ। যে যত বুদ্ধিমান, সে তত মিথ্যা ও ভুলের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে স্বার্থের সিদ্ধি ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নেয়। আমরা সবাই জানি এবং মানি যে, কাল দুই পা এগোনোর জন্য আজ এক পা পেছোনই ঠিক কাজ।
ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী পাঁচ দশকের বেশি সময় বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘দলবিরোধী কাজের জন্য’ তাকে  সাসপেন্ড করা হয়। একমাত্র মৃত্যুর পরে জানা যায় কে প্রকৃত বামপন্থী। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সে সবই প্রেক্ষিতনির্ভর। সুতরাং এ পাপ কারও একার নয়, এ পাপ আমাদের সকলের।
অথচ যে কোনও সমাজের মতো বাঙালি সমাজেও বেশ কিছু মানুষ কাজ করতে ভালবাসেন, কাজ করে তৃপ্তি পান। এদের অনেকেরই জীবনবোধ বা রাজনীতিবোধ হয়তো তত স্পষ্ট নয়, কিন্তু এরা সকলেই জানেন, কাজের জন্য, জীবিকার জন্য প্রয়োজনে কিছু ছাড়তে হয়। এই মানুষগুলোকে রাজনীতি তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে শিখে গিয়েছে। শাসনের প্রতি স্তরে, সরকারি পদের নিয়োগে স্বজনপোষণ চালু করে এই রাজনীতি কাজের মানুষদেরও রাজনীতির মানুষ বানিয়ে নিয়েছে। কাজের স্বার্থে ও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজের মানুষও ক্রমে ক্রমে শাসকের অনুগত হন। জীবনের স্বাভাবিক সুযোগ সুবিধেগুলো পাওয়ার জন্যও শাসক দলের রাজনীতির আনুগত্য প্রকাশ করতে তারা ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে যান। এইভাবে যখন সাধারণ মানুষই রাজনৈতিক হয়ে পড়েন, তখন দেখা দেয় একটা নতুন সমস্যা। সরকার পরিবর্তন হয়ে নতুন সরকার এলে সেই সমস্যাটা স্পষ্ট হয়।
রাজনীতি এখন রোজ সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর, তাই নতুন শাসকরা অনেক সময়েই পুরনো কাজের লোকেদের গুরুত্ব দেন না। এর ফলে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্র উপযুক্ত লোকের অভাবে ধুঁকতে থাকে। বর্তমানে দেশের শিক্ষাক্ষেত্র এই সমস্যার উজ্জ্বল উদাহরণ। স্কুল, কলেজ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে উপযুক্ত ইচ্ছুক ব্যক্তির বিরাট অভাব চার দিকে। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে দিনের পর দিন, দেশ ও সমাজের জন্য তা মোটেও হিতকর হতে পারে না।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকা জরুরি। যে ওষুধে রোগ নিরাময় হয়, তারই অতিরিক্ত সেবনে আবার হিতে বিপরীত হয়। দিন কয়েক আগে হোয়াটসআপে চাণক্যের নামে একটা উক্তি পেলাম: ‘যা কিছু মাত্রাতিরিক্ত তা-ই বিষ।’ এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা রাজনীতি বিষয়েও প্রাসঙ্গিক। সমগ্র জাতি যদি চব্বিশ ঘণ্টা ধর্মাচরণে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে কিছু মানুষ হয়তো তৃপ্তি পাবেন, কিন্তু সার্বিক ভাবে তা দেশের পক্ষে কোনও ভাবেই শুভ হতে পারে না। দেশের সব মানুষ হিমালয় বা সাগর-অভিযানে মেতে উঠে বেরিয়ে পড়লে সেটাও দেশের পক্ষে সুখকর হবে না। একই কথা প্রযোজ্য রাজনীতির প্রসঙ্গেও।

স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছে জনগণ পুনরুদ্ধার করার কিছু নেই


স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছে জনগণ

পুনরুদ্ধার করার কিছু নেই

  • ·        দেশ কি পাক-বৃটিশ হায়েনাদের হাতে বন্দি যে তাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে?
  • ·        দেশ বাঙালির হাতেই আছে, পাক হায়েনা ও তাদের দোসররা তাই শান্তি পাচ্ছে না।
  • ·        সর্বকালীন পাকি হায়েনারা ক্ষমতালোভী স্বার্থপ্রতিবন্ধী, তাই সচেতন বাঙালিকে মুক্তির যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

শেখ উল্লাস ॥ ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি, বাংলাদেশের নাম’। ১৯৭১ সালে এই দেশকে যারা রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছিল এবং অপরদিকে যারা বাঙালি জাতির এই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল দেশি-বিদেশি অপশক্তি-এই দুই মেরুর অবস্থান কখনও এক হতে পারে না। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের আর যখন দুই বছরের মতো কম সময় বাকী, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে মূহুর্তে বাঙালি জাতিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে এদেশের রাজনীতিতে তখনই আবার এই দুই মেরুর অবস্থান আবারও স্পষ্ট হয়েছে। ৭১’এর ২৫ মার্চের পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে চলে যাওয়া এবং স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদারতা ও কৃপায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ গ্রহণকারী, সংবিধান প্রণেতার দাবিদার ড. কামাল হোসেন গত ২৫ অক্টোবর পূণ্যভূমি সিলেটের মাটিতে যখন বলেন, ‘জনগণকে মালিকানা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। জনগণের মালিকানা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এ জন্য ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, দলীয় ঐক্য নয়, জাতীয় ঐক্য। জেলায় জেলায়, থানায় থানায়, ঐক্যকে সুসংহত করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে হবে। বিজয় আমাদের অনিবার্য’-তখন একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে ড. কামাল হোসেনের এই কথাগুলোকে পাকি দোসর রাজাকার দন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতা গোলাম আযম, যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করা খালেদা জিয়া এবং জাতির জনকের কন্যাকে হত্যার নীলনকশায় জড়িত যাবৎজীবন দন্ডপ্রাপ্ত অপরাধী তারেক রহমানের কথা হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। ওদের সকলের চিন্তা ও ভাষার মধ্যে একটি গভীর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আর এ সাদৃশ্য না থাকার কোনো কারণও নেই। পাকিস্তানী মতাদর্শের লোকেরা তাদের ভাষায় কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক।
তবে এ মূহুর্তের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণের মালিকানা কে কার কাছ থেকে উদ্ধার করবে? কে কাকে ফিরিয়ে দেবে? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার ৩য় অংশে বলা হয়েছে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল - জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে’। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭। (১)- সংবিধানের প্রাধান্য বিষয়ে এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্র্তৃত্বে কার্যকর হইবে’। এই মহান সংবিধান সমুন্নত রাখতে গিয়ে গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকারের আমলে দেশে যে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হয়েছে তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। উন্নয়ন ও মানবতার পক্ষে কাজ করতে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘দেশরত্ন’ ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত য়েছেন। বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো মেগা-প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেশীয় অর্থে সম্পন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীও পুলিশের সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা ও সুনাম অর্জন করেছে, করছে। বাংলাদেশের বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের কর্মনিষ্ঠা দিয়ে বিশ্ব শ্রমবাজারে বিরাট একটি স্থান করে নিয়েছেন এবং দেশের উন্নয়নে তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। দেশের অভ্যন্তরে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মজগৎ ও চাকরির বাজার ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে। সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বের যে-কোনো উন্নত দেশের উদাহরণকে আজ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলার। এক কথায় দেশের গ্রাম-শহর-মফস্বল-রাজধানী সর্বক্ষেত্রে নবজাগরণের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে-যার সব কিছুর নিয়ন্তা ও ভোগকারী শুধুই এদেশের জনগণ। শুধুমাত্র দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা ও বিভিন্ন রকমের সংকীর্ণতা একটি বৈষম্যহীন কাঙ্খিত সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে এবং এর জন্য শুধুমাত্র সরকারকে দায়ী করলেই বিরোধী দলের সব কিছু হালাল হয়ে যায় না। সরকার বিরোধিতার নামে শুধু সরকারের দোষ না খুঁজে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ভূমিকা পালন করলে সরকারের বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাগুলো আরও শক্তিশালী হতো। শুধু সরকারে গেলে আর ক্ষমতায় থাকলেই দেশের কাজ করা যাবে-এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ইংরেজ আমল ও পাকিস্তানী আমলে যখন এদেশের মানুষের ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না, তখন অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ছিলেন যারা দেশ ও মানুষের সেবায় অংশ নিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।
আজকের দিনে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সমাজ ও সরকারের বিভিন্ন স্তরে এমন অসংখ্য চক্র বাসা বেঁধে আছে যারা সরকারের বিরোধী শক্তির সাথে আঁতাত করে সেখানে দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার জিইয়ে রাখতে চায়। বস্তুতপক্ষে, বাংলাদেশ আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সমস্যা শুধু শিক্ষিত সমাজের মধ্যে যার ফলে সর্বস্তরের প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিরাজ করছে আস্থাহীনতা ও সমন্বয়হীনতাজনিত সংকট। এ সমস্যা সমাজের উঁচু স্তরে অপেক্ষাকৃত বেশি বলে এর কুপ্রভাব নিচের দিকেও গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনে সুষ্ঠু অবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দেশ সমৃদ্ধির উচ্চস্তরে উপনীত হবে-এই আশা সচেতন মহলে এখন আস্থার সাথেই ব্যক্ত করা  হচ্ছে। এ অবস্থায় আধ্যাত্মিক স্থান হিসেবে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে সম্মানীত সিলেটের মতো জায়গায় জনসভা করে যখন জনগণের মালিকানা ‘পুনরুদ্ধার’ এবং দেশকে ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ করার আহবান জানানো হয়  তখন সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠছে এরা কারা? এরা সত্যিকার অর্থেই কি বাংলাদেশ এবং এর  জনগণের মঙ্গল চায়? এরা কখনো তা চাইতে পারে? এদের পূর্ব-পরিচয়ের দিকে একটু তাকালেই বোঝা যায়, এরা কখনও বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল চায়নি। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ৭১’এ এদেরকে এদেশের জনগণ কাছে পায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে ড. কামাল হোসেন কখনো কি পাকিস্তান বা লন্ডন থেকে এদেশে ফিরতেন? বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবে নিজেকে দেশ-বিদেশে তুলে ধরতে পারতেন? বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ কি তাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানাতেন? অথচ আজ বঙ্গবন্ধুর কন্যা শত বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং তাঁর রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে তথাকথিত জাতীয় ঐক্যের নামে বিএনপি-জামাতের নেতৃত্ব দিতে মাঠে নেমেছেন! আর বিএনপি-জামাতকে নেতৃত্ব দিতে তিনি এমন এক সময় মাঠে নেমেছেন যখন আদালতে ২১শে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারেক-নিজামী-বাবরের সরাসরি মদদে এই হামলা চালানো হয়েছিল। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পরিচালিত ওই হামলার সাথে রাষ্ট্রীয় কয়েকটি সংস্থার প্রধানগণই জড়িত ছিল। যে হামলার একমাত্র লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সকল নেতৃবৃন্দকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। এমন জঘন্যতম ষড়যন্ত্র ও হামলা যারা চালাতে পারে তাদের ব্যাপারে চুপ থেকে এবং এমন কি তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন যারা করতে চায় তারা কখনো বাংলাদেশের মানুষের বন্ধু হতে পারে না, মুখে মুখে যত বড় কথাই তারা বলুক না কেন। স্বাধীনতার ৪৭ বছরের যাবতীয় অর্জনকে সমুন্নত রাখতে হলে তাদের ব্যাপারে জাতিকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নেয়নি, বরং বিরোধিতা করেছে এবং যারা ১৫ই আগষ্ট ও ২১শে আগষ্টের হামলাকারীদের পক্ষ অবলম্বন করে তাদের এদেশে রাজনীতি করারই কোনো অধিকার থাকতে পারে না। দুঃখজনক হলে ও সত্যি যে, ড. কামাল হোসেন আজ এই হামলাকারীদের পক্ষের শক্তির নেতৃত্ব ও স্বাধীনতাবিরোধী তথা পাকিস্তানপন্থীদের ক্রীড়ণকের ভূমিকায় আসীন হয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি যে তার স্বভাবসুলভ পলায়নপর মনোবৃত্তি থেকে এই তথাকথিত নেতৃত্বের আসন থেকে কেটে পড়ে পাকিস্তান ও লন্ডনে পাড়ি জমাবেন তাও সময়ের ব্যাপার মাত্র।   
তবু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, এই ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে দেশবাসীকে অতীতের চাইতে আরও বেশি সচেতন থাকার সময় এসেছে। দেশ ঠিকমতই চলছে। জনগণও ঠিক পথেই আছে, স্বাধীনতার সুফল এরা ভোগ করছে। প্রয়োজন শুধু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী এবং সরকার ও সরকারি দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বার্থান্ধ ও মতলববাজদের মুখোশ উন্মোচন করে সর্বক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা।