বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বিভ্রান্তির বেড়াজালে - কুরবানি


বিভ্রান্তির বেড়াজালে - কুরবানি

 
আরিফিন হক ॥ যার টাকা আছে তার জন্য নির্দিষ্ট দিনে পশু জবাই করা বাধ্যতামূলক এমন কোন নির্দেশনা কুরআনে নেই। কুরআন পূর্ণ মীমাংসা (১০:৩৭),  এতে কোন সন্দেহ নেই (১০:৩৭) এবং সর্বোপরি যেহেতু 'আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোন রহস্য নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা নেই' (২৭:৭৫) সেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভে কুরআন ভিন্ন অন্য কোন উৎসের তালাশ করা জ্ঞানময় কিতাবের আয়াতকে অবমাননা করার শামিল।

এতদসত্ত্বেও, ফতোয়া জারী করা হয়েছে যে, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়ষ্ক মুসলিম (পুরুষ অথবা নারী), যার প্রাত্যহিক চাহিদা ও খরচ বাদে ৬১৩.৩৫ গ্রাম রূপা (প্রায় ৯০হাজার টাকা) বা সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি স্বর্ণ বা তার সমমূল্য পরিমাণ অর্থ অথবা সম্পদ উদ্ধৃত থাকে তার উপর পশু জবাই ওয়াজিব হবে। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)।

এটি স্পষ্ট যে উক্ত বিধান ফতোয়া দাতার, পরমজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালার নয়। আল্লাহর বাণী জ্ঞানময় কুরআনে এমন কোন ইঙ্গিতও নেই যা থেকে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে। যারা আল্লাহর বাণী অনুসারে বিধান দেয় না তাদের সম্পর্কে কুরআনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে - “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফের, ফাছেক ও জালেম। (কুরআন ৫ : ৪৪, ৪৫, ৪৭ এর শেষ অংশ )। কোন ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বা ব্যাখ্যা মানতে কুরআনিক মুসলিম বাধ্য নয়। কিন্তু কুরআনিক মুসলিম কুরআন মানতে বাধ্য। অথচ, অধিকাংশ মানুষ এখন আর কুরআন বুঝার চেষ্টা করে না। মানুষ এখন মেতে আছে ফতোয়া নিয়ে। অধিকাংশ মানুষই কুরআন অনুসরণ করে না, অনুসরণ করে ফতোয়াবাজ মুফতিদের। ফতোয়াবাজদের প্রতাপে বিবেক বুদ্ধির প্রয়োগও হারিয়ে ফেলছে অনেকে।

ফতোয়াবাজদের মতে পশু জবাই করা সুন্নতে মুআক্কাদা, মতান্তরে ওয়াজিব, মতান্তরে এমন একটা সুন্নত যা পালন না করলে আল্লাহ কোন শাস্তি দেবেন না। পশু জবাই সম্পর্কিত এসব বিতর্কিত ফতোয়া এসেছে রসুল (সা.)-এঁর ওফাতের প্রায় ৩০০ বছর পর রচিত হাদিসের ভিত্তিতে। হাদিস বিশেষজ্ঞরা হাদিসগুলোকে ছহীহ (বিশুদ্ধ), হাসান (ভালো), যঈফ (দুর্বল), মুরসাল (সাহাবী বিহীন সনদ), মনকাদি (সংযোগ বিচ্ছিন্ন), জাল ইত্যাদি নানাভাবে বিভক্ত করেছেন। হাদিস বিশেষজ্ঞগণ নিজেরোই দুর্বল ও জাল হাদিসের অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং দুর্বল ও জাল হাদিসকেও তারা হাদিস হিসেবেই আখ্যায়িত করেন।

কুরআন মহানবী (সা.) এঁর সময়েই লিখিত আকারে সংরক্ষিত ছিল, কণ্ঠস্থ ছিল অনেক সাহাবির। তাই ইসলামের শত্রুরা কুরআনে হাত দিতে পারেনি। কিন্তু নবী করীম (সা.) এঁর হাদিস লিখিত আকারে ছিল না। এই সুযোগে ইসলামের শত্রুরা ও মুসলিম নামধারী বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল জাল হাদিস লিখে হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করেছে এবং ইসলামকে বিতর্কিত করেছে। এখন অবস্থা এতোই খারাপ যে, 'এমন আলিম প্রাপ্তি পশ্চিমা ডলফিন প্রাপ্তির চেয়েও দুর্লভ হয়ে পড়েছে যারা জাল হাদিস চিহ্নিত করে ইসলামকে বিতর্কমুক্ত করবে'। [ সূত্র : ইমাম ইবনুল জাওযী, সিলসিলাতুল আহাদীছ আয-যাঈফাহ ওয়াল মওযূআহ ১/৪১]।

ইমাম ইবনুল জাওযীর যুগেই যেখানে জাল হাদিস চিহ্নিতকরণে পন্ডিতদের অভাব ছিল, সেখানে বর্তমান যুগে এ অভাব আরও তীব্র হওয়াই স্বাভাবিক। তাই সারা বিশ্বে এখন যঈফ ও জাল হাদিসের ছড়াছড়ি। খতিব, ওয়ায়েয, প্রবন্ধকার, তথাকথিত মুহাদ্দিস সকলের মুখে যঈফ ও জাল হাদিস শুনা যায় প্রতিনিয়ত।

আমরা বুখারি, মুসলিম, আবুদাউদ, নাসাঈ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ এসব ইমামদের হাদিস গ্রন্থগুলিকে ছিহাহ সিত্তাহ বলে থাকি। যার অর্থ হাদিসের ছয়টি ছহীহ কিতাব। আসলে কি এ ছয় খানি কিতাবই ছহীহ হাদিসের কিতাব? নিবিড় পাঠে দেখা যায়, সব হাদিসের কিতাবেই যঈফ ও জাল হাদিস রয়েছে। হাদিসের সংকলকগণও তাদের কিতাবগুলোকে ছহীহ হিসেবে নামকরণ করেননি। মুহাদ্দিস আলবানি প্রণীত চারটি যঈফ গ্রন্থে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে,  নাসাঈতে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ৪৪০ টি, আবু দাউদে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ১১২৭ টি, তিরমিযিতে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ৮২৯ টি, ইবনু মাজাহ্‌তে যঈফ হাদিসের সংখ্যা ৯৪৮টি। উক্ত ৪টি গ্রন্থে মোট ৩৩৪৪ টি যঈফ হাদিস রয়েছে। আল্লামা জামালুদ্দীন ক্বাসেমি বলেন - ইমাম বুখারি, মুসলিম, ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে মঈন, ইবনুল আরাবি, ইবনে হাযম এবং ইবনু তাইময়াহ প্রমুখ মনীষীগণের মতে ফযীলত কিংবা আহকাম কোন ব্যাপারেই যঈফ হাদিস আমল যোগ্য নয়। [সূত্র : ফাওয়ায়েদুত্‌, তাহদিস পৃষ্ঠা-৯৫]।

যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা হাদিস প্রচার করে তার ঠিকানা জাহান্নাম। অথচ কোরবানি বিষয়ে আমাদের দেশে যে সব হাদিসের প্রচলন রয়েছে তার অধিকাংশই জাল। ওয়ায়েজ, মুফতি এবং বিভিন্ন প্রবন্ধকারও এসব জাল হাদিসের উদ্বৃতি দিয়ে প্রবন্ধ লেখেন যা অতি জঘন্য অপরাধ। শায়খ মুহাম্মদ নাছিরুদ্দীন আলবানী তাঁর “মিশকাতে বর্ণিত যঈফ ও জাল হাদিসসমূহ গ্রন্থে  কোরবানি বিষয়ক কিছু জাল হাদিসের উল্লেখ করেছেন এবং সূত্র দ্ধারা এসব জাল ও ভিত্তিহীন হাদিসকে অনুসরণ না করার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। হাদিসের নামে মিথ্যাচার ও জঘন্য অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার জন্য শায়খ মুহাম্মদ নাছিরুদ্দীন আলবানী'র গ্রন্থে উল্লেখিত কোরবানি বিষয়ক যঈফ ও জাল হাদিসগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো -

১. জাবের (রা.) বলেন, রসুল (সা.) এক কোরবানির দিনে দু'টি ধূসর রংয়ের শিংওয়ালা খাসী দুম্বা জবেহ করলেন এবং যখন ওদের কেবলামুখী করলেন তখন বললেন, 'আমি আমার চেহারাকে ফিরে নিলাম তাঁর দিকে যিনি নিজেকে ইব্রাহিম (আ.)-এঁর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন; আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। উপরন্তু আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবই জগৎ সমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্‌র উদ্দেশে। তাঁর কোন শরীক নেই। আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি মুসলিমদের অন্তর্গত। হে আল্লাহ! আপনার পক্ষ হতে প্রাপ্ত এবং আপনারই জন্য উৎসর্গিত। কবুল করুন মুহাম্মদের পক্ষ হতে এবং তার উম্মতগণের পক্ষ হতে। অতঃপর রসুল (সা.) বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবর' বলে জবেহ করলেন। (আবুদাঊদ হা/২৭৯৫; ইবনু মাজাহ হা/৩১২১; মিশকাত হা/১৪৬১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭৭, ৩/২২৩ পৃষ্ঠা)।

২. হানাশ (রহ.) বলেন, আমি আলীকে দু'টি দুম্বা কোরবানি করতে দেখলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, এই কি? তিনি উত্তর করলেন, রসুল (সা.) আমাকে ওছিয়ত করে গেছেন, আমি যেন তাঁর পক্ষ হতে কোরবানি করি। সুতরাং আমি তাঁর পক্ষ হতে (একটি) কোরবানি করছি। (আবু দাঊদ হা/১৭৯০; তিরমিযী হা/১৪৯৫; মিশকাত হা/১৪৪২; তাহক্বীক, সনদ হা/৮৪৩)।

৩. আলী (রা.) বলেন, রসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন চোখ ও কান উত্তম রূপে দেখে নেই এবং আমরা যেন যে পশুর কানের অগ্রভাগ কাটা গিয়েছে, যার কানের শেষ ভাগ কাটা গেছে অথবা যার কান গোলাকারে ছেদিত হয়েছে বা যার কান পাশের দিকে ফেড়ে গিয়েছে তার দ্বারা  কোরবানি না করি। (আবু দাঊদ হা/২৮০৪; তিরমিযী হা/১৪৯৮; মিশকাত হা/১৪৬৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৭৯, ৩/২২৪ পৃষ্ঠা) ।

৪. আলী (রা.) বলেন, রসুল (সা.) নিষেধ করেছেন, আমরা যেন শিং ভাঙ্গা ও কান কাটা পশু দ্বারা কোরবানি না করি। ( যঈফ ইবনে মাজাহ হা/৩১৩৫; যঈফ তিরমিযী হা/১৫০৪।)

৫. আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি , ছয় মাস পূর্ণ ভেড়া উত্তম কোরবানি। (তিরমিযী হা/১৪৯৯; মিশকাত হা/১৪৬৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৮৪, ৩/২২৬)।

৬. আয়েশা (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, কোরবানির দিনে বনী আদম এমন কোন কাজ করতে পারে না যা আল্লাহ্‌র নিকট রক্ত প্রবাহিত করা অপেক্ষা প্রিয়তর। কোরবানির পশুর শিং, পশম ও খুরসহ ক্বিয়ামতের দিন হাজির হবে এবং কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ্‌র নিকট সম্মানের স্থানে পৌঁছে যায়। (তিরমিযী হা/১৪৯৩; মিশকাত হা/১৪৬৮; মিশকাত হা/১২৮৬, ৩/২২৬)।

৭. আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, দিনসমূহের মধ্যে এমন কোন দিন নেই যা আল্লাহ্‌র ইবাদত করা তাঁর প্রিয়তর হতে পারে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন অপেক্ষা। এর প্রত্যেক দিনের সিয়াম এক বছরেরর সিয়ামের সমান এবং প্রত্যেক রাত্রির সালাত ক্বদরের রাত্রির সালাতের সমান। (তিরমিযী হা/৭৫৮; ইবনু মাজাহ হা/১৭২৮; মিশকাত হা/১৪৭১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৮৭)।

৮. ইবনু ওমর (রা.) বলেন, রসুল (সা.) মদীনায় দশ বছর বছর অবস্থান করেছেন আর বরাবর কোরবানি করেছেন।  (তিরমিযী হা/১৫০৭; মিশকাত হা/১৪৭৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৯০)।

৯. যায়দ ইবনু আরকাম (রা.) বলেন, এক দিন রসুল (সা.)-কে সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্‌র রসুল (সা.)! এই কোরবানি কী? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম-এঁর সুন্নত। তাঁরা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের কী রয়েছে হে আল্লাহ্‌র রসুল (সা.)? রসুল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রত্যেক লোমের পরিবর্তে একটি নেকি রয়েছে। তাঁরা আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্‌র রসুল (সা.)! পশমওয়ালা পশুদের পরিবর্তে কি হবে? রসুল (সা.) বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তেও একটি নেকি রয়েছে। (ইবনু মাজাহ হা/               ৩১২৭; মিশকাত হা/১৪৭৬ বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৯১, ৩/২২৮ পৃষ্ঠা)।

১০. আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, আমি ওহি প্রাপ্ত হয়েছি যে, আল্লাহ তা'আলা কোরবানির দিনকে এই উম্মতের জন্য ঈদ রূপে পরিণত করেছেন। এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্‌র রসুল ! আমি যদি মাদী 'মানীহা' (দুধ দেয় এমন গাভী) ব্যতীত অপর কোন পশু না পাই, তবে কি উহা দ্বারা কোরবানি করব? রসুল (সা.) বললেন, না; কিন্তু তুমি (কোরবানির দিনে) তোমার চুল ও নখ কাটবে, তোমার গোঁফ খাট করবে এবং নাভির নীচের কেশ খৌরী করবে - এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পূর্ণ কোরবানি। (আবু দাঊদ হা/২৭৮৯; নাসাঈ হা/৪৩৬৫; মিশকাত হা/১৪৭৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৩৯৪)।

আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, পশুর গোশত ও রক্ত তাঁর কাছে পৌঁছে না। অথচ হাদিস মতে জবেহকৃত পশুর রক্ত জমিনে পতিত হবার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। শুধু রক্ত নয় জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশমও হাদিস মতে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। এইসব হাদিস কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক, আল্লাহর বাণীর সাথে বিদ্রোহ।  আল্লাহর রসুল আল্লাহর বাণীর বিরুদ্ধে কোন বাণী বা হাদিস দিতে পারেন না। অতএব যে গ্রন্থেই লেখা থাকুক না কেন তা জাল। সাধারণ বিচার-বিবেচনা যাদের আছে তারাও একটু চিন্তা-ভাবনা করলে এইসব হাদিসের জালিয়াতি ধরতে পারবেন। 

সব পশুর সাইজ এক নয় তাই তাদের গায়ের লোমের সংখ্যারও বিরাট তফাৎ আছে। ছাগল বা ভেড়ার চাইতে গরুর গায়ের লোম বেশি, আবার গরুর চাইতে উটের গায়ে লোম বেশি। তার মানে কি এই -  যে ব্যক্তি একটি ছাগল কোরবানি দিবে তার চাইতে যে ব্যক্তি একটা উট বা গরু কোরবানি দিবে সে বেশি নেকি পাবে? আবার যারা বহুসংখ্যক পশু কোরবানি দিবে তারা বহুসংখ্যক নেকি পাবে? যদি তা-ই হয় তাহলে যারা গরিব পশু জবাই করতে পারল না, তাদের কি হবে? নির্ধারিত দিন সমূহের জন্য যদি তারা রোজা রাখে তাহলে তাদের নেকি কোন্‌ পশু বা পশুসমূহের সমান হবে? তারা কি একটা ছাগল, নাকি একটা গরু, নাকি একটা উটের লোমের সংখ্যার সমান নেকি পাবে?  উক্ত হাদিস মতে যে বেশি ধনী সে কয়েক ডজন গরু একত্রে কোরবানি দিলে লোমের হিসাবে অনেক সওয়াব পাবে। আর যে মধ্যবিত্ত সে যদি মাত্র একটি ছোট ছাগল কোরবানি দেয় কিংবা গরিবরা যদি একটা গরুর সাত ভাগের এক ভাগ অংশীদার  হয়ে কোরবানি দেয় তাহলে অতি সামান্য সওয়াব পাবে। তাই যদি হয় তাহলে কি আল্লাহ তায়ালার বিধান বৈষম্যমূলক হয় না? টাকা দিয়ে নেকি কিনার মতো হয় না? যার যত বেশি টাকা আছে তার তত বেশি নেকি এমন বৈষম্যমূলক বিধান আল্লাহ-রসুলের বিধান হতেই পারে না। আল্লাহ পরম ন্যায় বিচারক, তিনি লোমের হিসাবে নেকি দেন না। লোম, রক্ত ও গোশতের হিসাব তিনি রাখেন না, তিনি হিসাব রাখেন তাকওয়ার।

উল্লিখিত হাদিসগুলো ছাড়াও কোন সনদের উল্লেখ না করেই একদল ফতোয়াবাজ বলে থাকেন - “কোরবানির পশু পুলসীরাতের উপর তোমাদের বাহন হবে। তাই তোমরা মোটা তাজা পশু কোরবানি কর। এই জাল হাদিসটি সরাসরি কুরআনিক চেতনা পরিপন্থী ও হাদিসের নামে জালিয়াতি। তারগীব নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে একবার হযরত নবী করিম (সা.) স্বীয় কন্যা ফাতেমাকে (রা.) ডেকে বললেন “হে ফাতেমা! তুমি তোমার জবাইকৃত জন্তুর নিকট যাও কেন না পশু জবেহ করার পর রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে তোমার যাবতীয় গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। হযরত ফাতেমা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! এটা কি শুধু আমার জন্য? প্রিয় নবী (সা.) জবাব দিলেন “এটা সকল মুসলমানের জন্য। এটিও একটি বাতিল বাণী। সুরা মায়িদার ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ সবার কোরবান কবুল করেন না, কেবল মুত্তাকীদের কোরবান কবুল করেন। ইমাম বোখারী এবং ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের মতো বিখ্যাত হাদিস সংকলকগণ মনে করেন উক্ত হাদিস আবদুল্লাহ বিন নাফায়ের ভাষ্য, যা মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়।

গোশত খাওয়া যাবে কতদিন?  'কোরবানির গোশত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না' -  এই মর্মে মুসলিম শরিফে আলি (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ফতোয়াবাজরা বলেন এই হাদিস রহিত হয়ে গেছে (সম্ভবত ফ্রিজ আবিষ্কারের ফলে!)। এখন সালমা ইবনে আকওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসটি ব্যবহার করা হয় যার মূল কথা - 'তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর'। তাই এখন যতদিন ইচ্ছা ততদিন কোরবানির গোশত সংরক্ষণে রাখা যায়। তাতে কোন অসুবিধা হয় না, নেকির কমতি হয় না। ফতোয়া মতে -  কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেয়া উত্তম। কিন্তু পুরো গোশত নিজের ভোগের জন্য রেখে দিলেও তাতে কোনো অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী (৫/৩০০)।

ফতোয়া রয়েছে, কোরবানির পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি। যদি কেউ উপকৃত হয় তবে উপকারের মূল্য - যেমন পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, নায়লুল আওতার ৩/১৭২, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০০)। ফতোয়া রয়েছে, কোরবানির পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে না বলে মনে হয় তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। নিজে পান করে থাকলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে।  (মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭)। সত্যিই তো!  যে বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে ত্যাগের সংকল্প করলাম  তা আবার ভোগ করি কি করে? অথচ মানুষ জবেহ করে পুরো পশুর গোশত ভোগ করে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! একমাত্র কোরবানির গোশত ব্যতীত আর কিছু নেই যা মানুষ ত্যাগ করার পর ভোগ করে। ত্যাগ আর ভোগ দুটি পরস্পরের বিপরীত। ত্যাগ করলে ভোগ করা যায় না ভোগ করলে ত্যাগ করা যায় না। অথচ প্রচলিত কোরবানিতে দুটিই একসাথে চলে!

ফতোয়া রয়েছে - ছাগল বা দুম্বা দ্বারা কোরবানি করাই উত্তম। এই ফতোয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় - রসুল (সা.) মদিনায় থাকা অবস্থায় উট, গরু ইত্যাদি পাওয়া যাওয়া সত্ত্বেও সর্বদাই তিনি (সা.) নাকি দুম্বা কোরবানি দিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ.) যখন তার পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে কোরবানি করতে নিলেন তখন আল্লাহ তায়ালা ইসমাঈল (আ.) এর পরিবর্তে জান্নাত থেকে যে পশু প্রেরণ করেছিলেন তাও নাকি ছিল দুম্বা। মানুষের ব্যবহারিক জীবনে উট ও গরুর তুলনায় দুম্বা বা ছাগলের প্রয়োজন অনেক কম আবার অধিকাংশ মানুষের ক্রয় সীমারও মধ্যে কিন্তু সম্ভবত লোমের হিসাবে কম হওয়ায় এই ফতোয়া বাঙালী মুসলমানদের পছন্দ হয়নি!

ধর্ম, জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে মিথ্যাকে পাপ, অন্যায় ও ঘৃণিত মনে করা হয়। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষকে সর্বাবস্থায় সত্যপরায়ণ হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে মিথ্যাকে ঘৃণিত পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তজ্জন্য ভয়াবহ শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। মিথ্যা সর্বদা ঘৃণিত। মিথ্যা যদি রসুল (সা.) এঁর নামে হয় তাহলে তা আরো বেশি ঘৃণিত ও ক্ষতিকর। সাধারণ মিথ্যা মানুষের বা মানব সমাজের জন্য জাগতিক ক্ষতি বয়ে আনে। আর রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ধ্বংস ও ক্ষতি করে। অথচ রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যাচার চলছে সকল প্রচার মাধ্যমে। রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা প্রচারের দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত, নিজে মিথ্যা বলা ও দ্বিতীয়ত, অন্যের বলা মিথ্যা গ্রহণ ও প্রচার করা। উভয় পথ রুদ্ধ করার জন্য কুরআনে আল্লাহ ও রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা বলতে কিংবা সন্দেহজনক কিছু বলতে কিংবা আন্দাজে কিছু বলতে কঠুরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এবং রসুল (সা.) এঁর নামে যে কোন কথা বলার আগে নির্ভুলতা যাচাই করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয। প্রত্যেক মুসলিমকে স্মরণে রাখতে হবে, “যে ব্যক্তি রসুল (সা.) এঁর নামে মিথ্যা বলবে তার আবাসস্থল জাহান্নাম

প্রায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্‌ আজ হাদিসের খপ্পরে পড়ে গেছে। হাদিসের প্রচারে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত  হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহর হাদিস বা কুরআন ক্রমেই চাপা পড়ে যাচ্ছে।। একদিকে, আল্লাহ তায়ালা একবারও যা করতে বলেননি তা হয়ে গেছে এখন মুসলমানের মানদন্ড (যেমন - দাড়ি রাখা, টুপি পড়া ইত্যাদি আরো অনেক কিছু)। অন্যদিকে, মানুষ মনোযোগ দিতে পারছে না কুরআনের প্রতি। ফলে কুরআনের উদার, মানবিক আহ্বানের প্রতি সাড়া দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ তৈরী হচ্ছে না।
মুসলিমের দায়িত্ব হলো কুরআন অধ্যয়ন, বুঝা এবং কুরআন দর্শনকে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করা, লালন করা, পালন করা। প্রত্যেক মুসলিমকে আল্লাহর দরবারে তার নিজ কর্মের হিসাব দিতে হবে। অন্যে কারো কর্মের জন্য আমাদেরকে দায়ী করা হবে না, হিসেবও চাওয়া হবে না। তাই কথায় কথায় হাদিসের ব্যবহার থেকে প্রত্যেক মুসলিমকেই সতর্ক হতে হবে। কোন অজুহাত দেখিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকেই বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন। প্রত্যেককেই দিয়েছেন চিন্তা করার ক্ষমতা, সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার ক্ষমতা। পৃথিবীর অনেক মানুষ মিথ্যা বললেও মিথ্যা বলা বৈধ হয় না। জেনে বা না জেনে অধিকাংশ মানুষ মিথ্যা বলছে তাই বলে আমিও মিথ্যা বলব এটা কোন যুক্তি হতে পারে না। যে কোন বিষয়ে বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তা করে সত্যের অন্বেষণ করা প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। যে কোন বিষয়ে হাদিসের উদ্বৃতি দেয়ার আগে জেনে নিতে হবে যা বলা হচ্ছে তা কি সঠিক? কারো কথায় প্রভাবিত না হয়ে প্রত্যেককে অনুসন্ধ্যিৎসু হতে হবে এবং প্রয়োজনে গবেষণা করে সত্য আবিষ্কার করতে হবে। নতুবা হাদিস বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ যদি জীবনে একটি হাদিসও না বলে তাহলে তার কোন পাপ হবে না কিন্তু রসুল (সা.) এঁর নামে একটি কথাও যদি মিথ্যা বলা হয় তা হলে তা হবে মহাপাপ। মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের এই মহাপাপ থেকে রক্ষা  করেন। আমাদের জীবন আবর্তিত হোক কুরআনকে কেন্দ্র করে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে হাতিয়ার করে যুদ্ধাপরাধীদের 'ইসলামপন্থী' বলা হচ্ছে!


আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে হাতিয়ার করে
যুদ্ধাপরাধীদের 'ইসলামপন্থী' বলা হচ্ছে!

 

শেখ উল্লাস ॥ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছেন গত ১৭ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার । এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জ্বীবন কারাদ- দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ কর্তৃক এই মৃত্যুদন্ডের রায়ের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে প্রচার করেছে। তবে এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো আন্তর্জাতিক গণামধ্যমগুলোর বিশেষ কয়েকটি গণমাধ্যমে কাদের মোল্লাকে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র 'ইসলাম' শব্দটির অর্থ- যেখানে শান্তি এবং যেখানে এই কাদেরের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে অসংখ্য হত্যা, ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সেখানে তাকে ইসলামপন্থী নেতা হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচার বিশ্বব্যাপী শান্তিপ্রিয় মানুষদের এবং মুসলিম বিশ্ব বিবেককে আশ্চার্যান্বিত করেছে।

কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের রায়ের খবরকে আন্তর্জাতিক কোন্‌ গণমাধ্যম কীভাবে প্রচার বা সম্প্রচার করেছিল? ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আপিল বিভাগ থেকে এই রায় প্রচারের পর পরই বিবিসি অনলাইনের শীর্ষ সংবাদ হিসেবে স্থান করে নেয় এই খবর যার শিরোনাম ছিল -'যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির সাজা ইসলামপন্থী কাদের মোল্লার'। অবশ্য বিবিসির প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার মিরপুরে নৃশংস গণহত্যা পরিচালনার জন্য কাদের মোল্লা যে 'কসাই' নামেও অভিহিত হন, সেটাও উল্লেখ করা হয়।

আল-জাজিরার শিরোনাম ছিল, 'বাংলাদেশের ইসলামপন্থী নেতার মৃত্যুদন্ড'। ব্রিটিশ পত্রিকা 'ইনডিপেন্ডেন্ট'-এর শিরোনাম ছিল, 'বাংলাদেশের ইসলামপন্থী নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড। 'বাংলাদেশ টপ কোর্ট অর্ডারস সিনিয়র ইসলামিষ্ট টু হ্যাং' শিরোনোমে 'ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া' জানায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যাকা- সংঘটিত করার দায়ে ইসলামপন্থী নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

'যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসলামী দলের নেতার মৃত্যুদন্ড' শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওয়াশিংটন পোষ্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিচারকের প্যানেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকার কারণে মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছেন।

পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডন 'জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের ফাঁসির আদেশ' শিরোনামে বলেছে, বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট একজন জ্যেষ্ঠ ইসলামপন্থী নেতাকে গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন।

উপসাগরীয় এলাকার শীর্ষ দৈনিক খালিজ টাইমস বলেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে  মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল ষ্ট্রীট জার্নাল-এর শিরোনাম ছিল, বাংলাদেশের আদালতে ইসলামি রাজনীতিবিদের মৃত্যুদন্ড'। এতে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট দেশটির জ্যেষ্ঠ ইসলামি রাজনীতিবিদ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দেন। এভাবে অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করা গেছে যে, কাদের মোল্লাকে ইসলামপন্থী নেতা বা ইসলামী রাজনীতিবিদ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করার হিড়িক দেখা যায় বিভিন্ন বিদেশী গণমাধ্যমে। কাদের মোল্লাকে এভাবে বিশেষায়িত করে বাংলাদেশের কোন কোন গণমাধ্যমকর্মী বা সাংবাদিকগণ মিথ্যাচারের পথ ধরে ওইসব বিদেশী গণমাধ্যমগুলো কাদের খুশী করতে চেয়েছে তা বোধগম্য নয়। এটা কি শান্তির ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে তাদের এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর অজ্ঞতা নাকি ইসলাম ধর্মের শান্তির ধারাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে এটাকে একটি জঙ্গী দল হিসেবে বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করার একটি সূদুরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ।

ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের  পর থেকেই একটি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের আলখেল্লা পরে ধর্মকে পার্থিব ভোগ-বিলাসের রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উপায় হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল যার সর্বনিষ্ট উদাহরণ স্থাপন করে মানবজাতির কাছে আজও ঘৃণিত হয়ে আছে মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদ। ইয়াজিদ ইসলাম ও পবিত্র কুরআনের দোহাই দিয়েছিল এবং আরবসহ বিশ্বের অনেক দেশে ইসলামের নামে কায়েম করেছিল ইয়াজিদতন্ত্র তথা রাজতন্ত্র । সেই ধারা আজও  অব্যাহত এবং তারই আজকের দিনের জ্বলন্ত উদাহরণ ইসলামের নামে ওহাবী  বাদের প্রতিষ্ঠাতা সৌদি আরব যার প্রভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন তথা পশ্চিমা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী চক্র। এই পশ্চিমা শক্তি ইসলামের নামে  সারা বিশ্বে প্রচার করে চলেছে এই ওহাবীবাদ তথা এই উপমাহাদেশে মওদুদীবাদ। নবী মুহাম্মদ (দঃ)-এর চিরশত্রু নজদের আব্দুল ওয়াহাবের প্রবর্তিত এই ওয়াহাবীবাদকেই এরা বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ধর্ম বলে চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের চিরাকাঙ্খিত শান্তি (ইসলাম) ধর্মকে বিতর্কিত ও বিভ্রান্ত করে বিশ্বে অশান্তির বীজ বপন করে রাখাই এদের মূল লক্ষ্য। আর এদেরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় কাদের মোল্লার মতো একজন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীকে ইসলামপন্থী নেতা বা ইসলামী রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রচার করেছে চলেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম।

 ইসলাম কোনোদিন কাউকে আঘাত করার অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি, সাধক নজরুলের ভাষায় বলতে হয়, 'ইসলাম কাউকে গোলাম করতে আসেনি এবং কারো গোলাম হতেও আসেনি'। ইসলাম সাম্য, মৈত্রী ও সত্যের ধর্ম। আর কাদের মোল্লারা এর প্রকাশ্য শত্রু। তাই এরা ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। এদের প্রভু পাকিস্তানী জেনারেল টিক্কা খান বলেছিল, 'বাংলার মানুষ চাই না, মাটি চাই'। কাদের মোল্লা সেদিন ঢাকার মিরপুরের কসাই হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল, আর টিক্কা খান খ্যাতি পেয়েছিল 'বুচার অব বেঙ্গল' অর্থাৎ বাংলার কসাই হিসেবে। আর এ কারণে এসব ব্যাপারে দেশের গণমাধ্যমকর্মী ও সাংবাদিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো আরও সচেতন হয়ে সংবাদ প্রচারে সচেষ্ট হবে-সেটিই আশা করে এদেশের শান্তিপ্রিয় সকল মানুষ। অবশ্য মুহাম্মদী ইসলামকে বহু নামে এখন বিশ্বে প্রচলন করা হয়েছে। মিরপুরের কসাই নামে পরিচিত এবং সর্বোচ্চ আদালত হতে দন্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লাকে কোনো গণমাধ্যম ইসলামী রাজনীতিবিদ বা ইসলামপন্থী নেতা হিসেবে উল্লেখ করলেই মুসলমান  হিসেবে নিজেদের অজ্ঞতা, হীনমন্যতা বা সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়া হবে এবং দেশের মানুষ বিভ্রান্ত হবে যা কখনোই প্রত্যাশা করে না আজ এদেশের শান্তিপ্রিয়, বিবেকবান ও সচেতন মানুষ।

তাহলে আমরা কি ?


তাহলে আমরা কি ?

 
সংলাপ ॥  বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশই মুসলমান। সারা পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ মুসলমানের আবাসস্থল এই বাংলাদেশ। যা সংখ্যায় প্রায় ১৬ কোটি। ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর, ঢাকার অলিতে-গলিতে অপূর্ব কারুকার্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক মসজিদসমূহ শোভা পায়, প্রতিদিন পাঁচবার চারিদিক থেকে ভেসে আসে সুমধুর আজানের ধ্বনি, শুক্রবার দিন সৃষ্টি হয় নামাজিদের এক মনোরম দৃশ্য! রোজার সময় সব হোটেল ও রেস্তোরার ঝাপ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মুসলমান অধ্যুষিত এই দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১ শত কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। প্রতিদিন গড়ে খুন হয় ১০ জন মানুষ! দূর্ঘটনায় মৃত্যু, ধর্ষণ, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি নিত্যদিনের ঘটনা। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে - আমরা কি কুরআনিক মুসলিম?

এখন এমন একটা সময় এসেছে যখন ইসলাম কেবল নামেই আছে আর কুরআন আছে লিখিত আকারে। কারুকার্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক মসজিদ নির্মিত হচ্ছে শহর-উপশহর-গ্রামে-গঞ্জে কিন্তু মসজিদের ভেতর কুরআনিক শিক্ষা নেই। আলেমগণ নিজেদের মধ্যে ফেৎনা-ফ্যাসাদে লিপ্ত। আর এই ফেৎনা-ফ্যাসাদে নির্বাসিত হতে চলেছে শান্তি (ইসলাম)। মুসলমান এখন সেই শান্তির (ইসলামের) উপর প্রতিষ্ঠিত নেই, যে শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন মোহাম্মদ (সা.)। কতগুলো পছন্দনীয় আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব মনগড়া এক অদ্ভুত ইসলামের চর্চা চলছে। কিভাবে এবং কেমন করে 'শান্তি' জীবন-দর্শন না হয়ে কতিপয় বিচ্ছিন্ন, সম্পর্কহীন ও গুরুত্বহীন আনুষাঙ্গিক বিষয়ের নাম হয়ে গেলো?

বর্তমান পৃথিবীর সিংহ ভাগ মুসলমানই জন্মসূত্রে মুসলমান। অর্থাৎ মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে বলে মুসলমান। কিন্তু মুসলমানের ঘরে জন্ম হবার কারণেই কি কাউকে মুসলিম বলা যায়? মুসলিম হওয়া কি  জন্মগত জিনিস?

আমাদের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাল যে বাস্তব জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে আল্লাহকে অমান্য করা যাবে, জিনিসপত্রে ভেজাল মেশানো যাবে, হালাল-হারামের সীমালঙ্ঘন করা যাবে, মিথ্যা বলা যাবে আর তারপরও নিজেকে মুসলিম হিসেবেই পরিচয় দেয়া যাবে? কুরআনকে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করবো না, ব্যবসা-বানিজ্যে, আচরণে কুরআনিক সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীর হবো না অথচ নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য মিথ্যার পথে চলবো? মুসলিম কে? আরবি মুসলিম শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে 'সিলম' ধাতু থেকে। সিলম অর্থ শান্তি। সিলম ধাতু থেকে কর্তৃকারকে মুসলিম হচ্ছেন শান্তি (ইসলাম) গ্রহণকারী। মুসলিম - শান্তিপ্রিয়, শান্তির পতাকাবাহী, শান্তিকামী। মুসলিম শব্দটি বহুবচনে মুসলিমুন বা মুসলিমিন। কুরআনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে - যিনি শান্ত, ভদ্র, নম্র, বিনয়ী, ক্ষমাশীল, আত্মবিশ্বাসী, সাবধানি, সতর্ক, ধৈর্যশীল, ধীর, স্থির এবং আল্লাহ্‌তে সমর্পিত তিনিই মুসলিম। একজন মুসলিম হবেন সৎ পরিশ্রমী। ন্যায়বান, উদার, ত্যাগী। একজন শান্তিকামী মানুষ স্বার্থপর না হয়ে পরার্থপর হবেন, পাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি দেওয়াকে গুরুত্ব দেবেন। ঘৃণা ও অশান্তির সৃষ্টি না করে তিনি প্রেম ও শান্তির আরাধনা করবেন। রাগ নয় অনুরাগই তাঁর পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি। প্রতিশোধ নয় ক্ষমাই তাঁর নীতি। আত্মগ্লানি নয় আত্মসম্মানই তাঁর শক্তি।  অবিশ্বাস নয় বিশ্বাসেই তাঁর স্থিতি। কোন মুসলিম ধন-সম্পত্তি অর্জনের প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকেন না, তিনি মানুষকে সহযোগিতা করেন। একজন শান্তিকামীর কাছে আমিত্ব নয়, তুমি এবং সে গুরুত্বপূর্ণ। পরশ্রীকাতরতা ও  হিংসা পরিত্যাগ করে শান্তিকামী প্রসংশাকারী হয়ে উঠেন, লোভ ত্যাগ করে তিনি হয়ে উঠেন নির্লোভ। ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নতা ত্যাগ করে তিনি বর্তমানে থাকতে সচেষ্ট। নেতিবাচক চিন্তা না করে তিনি ইতিবাচক চিন্তাশীল। তর্কের স্থলে তিনি বেছে নেন নীরবতা। অস্থিরতাকে ত্যাগ করে তিনি গ্রহণ করেন স্থিরতা। মুসলিম হচ্ছেন 'অ' ত্যাগী। অপব্যয়, অশান্তি, অনিরাপত্তা, অস্থিরতা, অসতর্কতা, অন্যায়, অসাম্য, অবিচার, অনাচার, অসততা, অসংযম, অপচয়, অদূরদর্শিতা, অবিচক্ষণতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অনৈতিকতা, অবমাননা, অমানবিকতা, অবজ্ঞা, অনিশ্চয়তা - জীবনের অভিধানে লিখিত এসব শব্দ থেকে যিনি 'অ' -কে ত্যাগ করেছেন তিনিই মুসলিম।  মুসলিম অজ্ঞানতা (জাহেল) থেকে মুক্ত জ্ঞানবান পুরুষ। মানুষে মানুষে পার্থকের মানদন্ড জ্ঞান এবং অজ্ঞানতায়, অস্থিরতা ও স্থিরতায়, অসংযম এবং সংযমে। কে কোন্‌ শাস্ত্র পাঠ করে তা মানুষে মানুষে পার্থক্যের কোন মানদন্ড নয়।

মুসলিম তার উদ্বৃত্ত অভাবী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়, সম্পদ পুঞ্জীভুত করে না। একজন মুসলিমের কথা ও কর্ম থেকে অন্য মানুষ সম্পূর্ণ নিরাপদ। তিনি আমানত রক্ষা করেন এবং অঙ্গীকার পালন করেন। মুসলিম - সত্য বলেন, অভাবীকে দান করেন, অন্যের অনুগ্রহের প্রতিদান দেন, আপনজনদের প্রতি সংবেদনশীল থাকেন, প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখেন, অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকেন। তাঁর কাছে লোকেরা তাদের জান ও সম্পদ সম্পর্কে নিরাপদ। তিনি - নিষ্পাপ, শান্তিকামী, ভালো এবং ভালোবাসার কেন্দ্র্রস্থল। তিনি নিজের জন্য যা পছন্দ  করেন অপরের জন্যও তা-ই পছন্দ করেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন এবং মানুষও তাকে ভালোবাসে। লজ্জাশীলতা তাঁর ভূষণ। তিনি 'এক' এ প্রতিষ্ঠিত। নিজের প্রবৃত্তি, মন, হৃদয়, অন্তর যতক্ষণ পর্যন্ত এক আল্লাহর অনুগত না হবে ততক্ষণ কেউ মুসলিম হতে পারে।

কুরআন মতে মুসলিম হচ্ছেন - 'পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। তারা একে অপরকে যাবতীয় ভাল কাজের নির্দেশ দেয়। অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে,' (তওবা : ৭১), “যারা আমানত ও ওয়াদা চুক্তির রক্ষণাবেক্ষণ করে। (মুমিমুন : ৮)। 'ন্যায়ের নির্দেশদানকারী, অন্যায়ের বাধাদানকারী এবং আল্লাহ্‌র নির্ধারিত সীমা রক্ষাকারী। (তওবা : ১১২)। “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র দিকে মানুষকে ডাক দেয়, সৎকাজ করে (হা-মিম-সিজদা : ৩৩)। কুরআন মতে মুসলমান তাঁরাই - “যারা বিশ্বাস করে এবং ভালো কাজ করে। (সূরা নিসা : ৫৭, ১২২)। মুসলমান তাঁরাই - “যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে সৎকর্ম করে বা (কারও) অপরাধ ক্ষমা করে ( নিসা : ১৪৯) এবং “পরস্পরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়। (আসর : ৩)।

মুসলিমদের প্রতি আল্লাহ সুস্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছেন -

'আর তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে (কুরআন) শক্ত করে ধরো ও বিভক্ত হয়ো না'। (৩ ইমরানঃ ১০৩)।

'অবশ্য যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো কাজের দায়িত্ব তোমার নয়'। (৬ আনআম ঃ ১৫৯)

'অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না,  যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে'। (৩০ রূম ৩২)।

'আর তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা তাদের কাছে স্পষ্ট নির্দেশ আসার পর বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি'। (৩ ইমরানঃ ১০৫)।

'তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন সেই ধর্মই, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে আর আমি ওহি করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম মুসা ও ইসাকে এই বলে যে, তোমরা ধর্ম ধারণ করবে এবং তাতে দলাদলি ও মতভেদ সৃষ্টি করবে না'। (৪২ সুরা ঃ ১৩)।

অথচ মসুরম নামধারী কিছুলোক “জেনেশুনেই কেবলমাত্র পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও মতভেদ ঘটাচ্ছে/ঘটাবে। (৪২ সুরা ঃ ১৪)। হযরত মোহাম্মদ (সা.) ২২ বৎসরের একনিষ্ঠ সাধনায় যে মুসলিম জাতি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর ওফাতের ৩০/৩৫ বৎসর পর থেকেই নানা দল-উপদলে বিভক্ত। রাফেজি, মোতাজেলি, শিয়া, সুন্নী, সুন্নী হানাফি, সুন্নী হাম্বেলি, সুন্নী ওহাবি, কাদিয়ানি, শিয়া যায়েদি, শিয়া ওলাতি, শিয়া দুরুজ, শিয়া ইসনে আশারিয়া ইত্যাদি নানা দলে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেদের ফ্যাৎনা-ফ্যাসাদে লিপ্ত। নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও মতভেদে লিপ্ত হয়ে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবানন, সোমালিয়া, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক সর্বত্র মুসলিমগণ ইসলাম বা শান্তি থেকে দূরবর্তী হয়ে অশান্তির বিস্তার ঘটাচ্ছে। কুরআনের একটি আয়াতও নেই যা শিয়া মুসলিম, সুন্নী মুসলিম, কাদিয়ানি কিংবা ওহাবীদের উদ্দেশে। এসব শব্দই কুরআনে নেই। যাদের কথা কুরআনে নেই কোরআন তাদের জন্য নয়।

কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শেষ হয়ে যায়নি এটা কোনকালে শেষ হবেও না। যুগে যুগে যুগের উপযোগি ব্যাখ্যা আসবে। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা যদি অশান্তির সৃষ্টি করে তবে তা পরিত্যাজ্য। কারণ কুরআনের মূল সূত্র শান্তি। কোন মতবাদ গ্রহণ-বর্জনের জন্য বলপ্রয়োগ কুরআনের মূলসূত্র বিরোধী। ইসলাম বা শান্তি বজায় রেখে কুরআনে সত্যের অন্বেষণ করাকে কুরআন উৎসাহিত করেছে। কুরআনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে - একজন মুসলিম সবকিছু ত্যাগ করতে পারে কিন্তু কোন কিছুর জন্যই শান্তি ত্যাগ করতে পারে না।

আজ পৃথিবীতে মুসলিম অতি দুর্লভ এবং প্রায় বিলুপ্ত এক প্রজাতি। সূফী সাধক হাছান বসরী বলেছিলেন - 'মুসলিমগণ আছেন কবরে এবং ইসলাম আছে কুরআনে।' একবার এক পন্ডিত সূফী সাধক আনোয়ারুল হক -কে জিজ্ঞেস করেছিলেন - 'হুজুর, প্রকৃত মুসলিম কে?' সাধক আনোয়ারুল হক উত্তর দিয়েছিলেন - 'আমার বাম গালে চড় দিলেও আল্‌হামদুলিল্লাহ্‌, ডান গালে চড় দিলেও আল্‌হামদুলিল্লাহ্‌'। অর্থাৎ যিনি বিরোধীদের চড় হজম করে সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর প্রশংসা করতে পারেন তিনি নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন। মানুষ মাটির তৈরি। মাটি স্বর্বংসহা। যিনি মাটির মতো সহনশীল তিনি মুসলিম। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক ছিলেন এমনই একজন মুসলিম। তাহলে আমরা কি?

মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

জাতি সত্যের পথ ধরে শান্তি চায়


জাতি সত্যের পথ ধরে শান্তি চায়
 

আমরা তাহাদিগকে কর্ণ, চক্ষু এবং হৃদয় দান করিয়াছিলাম কিন্তু তাহাদের কর্ণ, চক্ষু হৃদয় কোন কিছুই তাহাদের উপকারে আসিল না; কারণ তাহারা অস্বীকার করিত এবং যে আযাব লইয়া তাহারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিত উহাই তাহাদিগকে পরিবেষ্টন করিয়া ফেলিল ৪৬:২৭ সত্যকে মিথ্যা বলিয়া প্রত্যাখ্যানকারীদের  জন্য দুর্ভোগ ৮৩:১১

 সংলাপ এবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আরও একটি বিশেষত্ব হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরাও দ্রুত ভোল পাল্টে ভয়ংকর বিভ্রান্তি সৃষ্টির চক্রান্ত নিয়ে মাঠে নেমেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে এরা ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করার

চেষ্টা বলে শোর তুলছে যদিও এটা  নতুন নয় মোটেও সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন, ক্ষমতার চরম স্বেচ্ছাচারিতা, সর্বোপরি লুটপাট ক্ষমতার প্রয়োজনে ধর্মকে খেয়াল খুশিমত ব্যবহার করা এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় লালন-পালনে মোটেও পিছিয়ে নেই রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত  বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে দারুণ মিল বর্তমানে বিবেক, নৈতিকতা, মূল্যবোধ শব্দগুলোকে সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দিতে একটুও বাধেনা রাজনীতিকদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ধর্মীয় চেতনার লেশ মাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না এদের কর্মকান্ড, বক্তৃতা, আচার-আচরণে আদর্শভিত্তিক একরৈখিক চিন্তাপ্রবাহের মাঝে বিবেকের অবস্থান আর বিবেক থেকে উদ্ভব হয় চেতনা চেতনাকে সুদৃঢ় করে যুক্তি চেতনা স্থান-কাল-পাত্রের উপর নির্ভরশীল ধর্মীয় দর্শনের বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত নির্ভরশীল মানুষের সমাজ যেমন গতিশীল প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ঠিক তেমনি মানুষের ধর্মও ছিল-আছে-থাকবে গতিশীল পরিবর্তনশীল সদা সর্বদাই পুরাতন থেকে নতুনের উত্তরণ এবং সম্মুখমুখী ধর্ম সব সময়ে বর্তমান যেহেতু ইসলামের বাংলা নামই 'শান্তি' এবং শান্তি বর্তমানে অন্ত:র্নিহিত মানব সমাজে ধর্ম কোন বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা নয় প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অন্যায় আধিপত্য বিস্তার আর সংস্কার সংকীর্ণতার মূল খুঁজতে গেলেই ধর্মের উৎপত্তি পাওয়া সহজ হয় ধর্মকে যখন আধিপত্যবাদীরা (তা সমাজের যে অঙ্গনে বা স্তরেই হোক না কেন) হাতিয়ার করে ফেলে তখন ধর্মের ভয়াবহ রূপ ধরা পড়ে মানবসমাজে গ্র ধর্মান্ধতা হয়ে

আধিপত্যবাদীরা সব সময়েই ধর্মকে ছলে-বলে-কলে কৌশলে এমনভাবে মোড়ক দিয়ে রেখে আসছে যাতে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের আসল রূপ 'শান্তি' 'সত্য' না বেরিয়ে পড়ে তাই ধর্ম প্রগতিশীল হয়ে মেহনতী মানুষের হাতিয়ার হতে পারেনি, এখনও পারছে না এজন্য প্রয়োজন সর্বাগ্রে ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে একনিষ্ঠ, শান্তিপ্রিয়, সত্যবাদী, নির্ভীক, দেশপ্রেমিক রাজনীতিক সব দলের মধ্যে

শ্রমজীবী মানুষ হলো ধর্মভীরু, সংগ্রামী বিশেষ করে বাংলাদেশে সমাজ কাঠামো পরিবর্তন করে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন-ধর্ম সত্য শান্তির আধার তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা আনুষ্ঠানিকতায় বা জীবন চলার পথে তথাকথিত ধর্ম মানুষের প্রগতির পথে কোন পরিবর্তন আনছে না এটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যারা সত্যিকার রাজনীতিক হয়ে দেশ জাতির জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে চায় তাদের প্রথমে সত্যকে ধারণ-লালন-পালন করতে হবে ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে সত্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সার্বিক শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে আধিপত্যবাদীদের - এটাই প্রকৃত ধার্মিকের কাজ

বাংলাদেশের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ধর্ম-ব্যবসায়ী, ধর্মবেত্তারা এমনভাবে ঢুকে পড়ে প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে যাতে মনে হয় রাজনীতিকরা আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে দীর্ঘ ৪০ বছরে শ্রমজীবী মানুষকে তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে, ভবিষ্যতের কথা বলে মিথ্যাচারের মাধ্যমে শোষণ এবং শাসন করে যাচ্ছে এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে উঠতি লুটেরা শ্রেণী সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উপর থেকে আস্থা হারাতে হারাতে এমন এক পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোন সময়ে যে কোন অঙ্গনে ধ্বংসযজ্ঞ চললে অবাক হওয়ার কিছু নেই এটাই বাস্তবতা যার কিছু কিছু নমুনা মাঝে মধ্যেই    দেখা যাচ্ছে
তাই এখনও সময় আছে মিথ্যাচার ছেড়ে দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনীতিকরা রাজনীতি করুন ধর্ম-ব্যবসায়ী ধর্মবেত্তারাও সত্যকে তুলে ধরুন, নচেৎ আপনাদের কথাও কেউ কানে নেবে না বাংলাদেশে আপনাদের চেহারা জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়েছে আপনারা নবী মুহাম্মদ (সঃ) এঁর ধর্ম ইসলাম (শান্তি) প্রতিষ্ঠার জন্য কোন কর্মকান্ড করছেন না বরং সৌদী আরবের অর্থায়নে ওহাবী-এজিদি-মওদুদী পন্থা অনুসরণ করে মুখে ইসলামের কথা বলে সম্পদের পাহাড় বানানোয় ব্যস্ত কিন্তু ভুলে যাবেন না দেশবাসী আপনাদের সব সম্পদের খবর  জানে জনগণ রুখে দাঁড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের পোশাক সংস্কৃতি, দাড়ি-টুপি-জোব্বা আপনাদের জন্য কাজে লাগবে না তাই তওবা করুন এবং নিজেকে চেনার জন্য সজাগ হোন সত্য কাউকে ছাড় দেয় না কেউই আল্লাহ্ আইনের বাইরে নয় এটাই স্মরণ রাখার চেষ্টা করুন তাহলে দেশ জাতি বাঁচবে