আল্লাহ এবং আগুন আজও আছে নেই শুধু
ইব্রাহিম!
সংলাপ
॥ আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে যেসকল নবী-রাসূল প্রেরণ
করেছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.)। তিনি প্রতিটি পরীক্ষায়
ধৈর্য ও ত্যাগের মাধ্যমে উত্তীর্ণ
হয়েছিলেন। তাই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘মানবজাতির নেতা' করেছেন (২ সুরা বাকারাহ : ১২৪)।
মানুষকে
সত্য ও ন্যায়ের পথে আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন প্রতিটি পদক্ষেপে।
সকল বাধাকে তুচ্ছজ্ঞান করে তিনি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তিনি তৎকালের
পন্ডিতদের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ভেঙ্গে দিয়েছিলেন মূর্তি। তার সমপ্রদায়ের
নেতারা ইব্রাহিমকে চূড়ান্ত শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, একে
আর বাঁচতে দেয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, একে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারতে হবে,
যেন কেউ এর দলে যেতে সাহস না করে। তারা তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব গ্রহণ করল
এবং সেটা বাদশাহ নমরূদের কাছে পেশ করল। সম্রাটের মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের
ছেলে ছিল ইব্রাহিম। তাই তাকে সরাসরি সম্রাটের দরবারে আনা হল।
ইব্রাহিম
(আ.) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ‘একত্ব দর্শন' প্রচারের সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ
বংশ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং তৎকালীন সম্রাট নিজেকেই
একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নির্ভীক
কণ্ঠে ইব্রাহিম জবাব দিলেন, ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন'। নমরূদ
বলল, ‘আমিও বাঁচাই ও মারি'। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত
আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারি।
এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করল। ইব্রাহিম তখন দ্বিতীয়
যুক্তি পেশ করে বললেন, ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম
দিক হ'তে উদিত করুন'। ‘অতঃপর নমরূদ এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো' (২ বাকারাহ : ২৫৮)।
কওমের
নেতারাই যেখানে পরাজয় মেনে নেয়নি, সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট পরাজয় মেনে নিবেন না এটাই স্বাভাবিক। যথারীতি তিনিও অহংকারে
ফেটে পড়লেন এবং ইব্রাহিমকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের দোহাই দিয়ে
বললেন, ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে
চাও' ( ২১ সুরা আম্বিয়া : ৬৮)।
অতঃপর
‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ'ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ'ল। তারপর সেখানে
তাকে নিক্ষেপ করা হলো। (৩৭ সুরা সাফফাত : ৯৭)। জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইব্রাহিম
(আ.) বলে ওঠেন, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক'। বস্তুতঃ
এই কঠিন পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরষ্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এলো
- ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইব্রাহিমের
উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও' ( ২১ আম্বিয়া : ৬৯)। অতঃপর ইব্রাহিম মুক্তি পেলেন। একইভাবে
আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিমকে প্রিয় বস্তু ত্যাগের
মাধ্যমে প্রেমের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছিলেন। ছুড়ি চালাতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়ার
পর আল্লাহ তায়ালা একইভাবে ইব্রাহিম ও তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে মুক্ত করেছিলেন।
পরীক্ষাটা ছিল শুধুমাত্র ইব্রাহিমের জন্য। ফতোয়া বিশ্বাসী মুসলমানগণ ইব্রাহিমের
পুত্র জবাইয়ের ঘটনার স্মরণে পশুজবাই করে কিন্তু নিজেদেরকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে
তাদের ঈমানী পরীক্ষা দেয় না কেন?
ইব্রাহিমের
আদর্শ অনুসরণে পশুজবাই ও মজা করে গোশত ভক্ষণ তো এক তামাশা! প্রতি বছর পশু জবাই করা
হয় কিন্তু আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও মুসলিম উম্মাহর জীবনে তার কোন ইতিবাচক প্রতিফলন আছে
কি? দেশে দেশে মুসলমানরা নিগৃহীত হচ্ছে, দেশ থেকে বিতাড়িত হচ্ছে, মা বোনেরা ধর্ষিতা
হচ্ছে, নিষ্পাপ শিশুরা প্রাণ দিচ্ছে অথচ ঘুমিয়ে আছে মুসলমানদের ইব্রাহিমী চেতনা। আজও
বিভিন্ন জনপদে নমরূদরা দুঃশাসন চালাচ্ছে কিন্তু ইব্রাহিম (আ.) নমরূদী দুঃশাসন উৎখাত
করতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন সেই ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুতি ও ঈমানের দৃঢ়তা
মুসলমানদের নেই। আছে শুধু পশু জবাই ও গোশত খাওয়া।
মোটা-তাজা
পশুর গোশত খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা আর নয়। মানবতার কল্যাণে সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য
ঈমানী শক্তির উব্দোধন চাই। নিজের কামনা, বাসনা, সম্পদ ও প্রিয় বস্তুকে মানবতার কল্যাণে
নিবেদনের উদ্যোগ চাই। ইব্রাহিম (আ.) যেভাবে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বাধা বিপত্তি
ও অমানবিক অত্যাচার উপেক্ষা করে তাঁর বিশ্বাসের প্রতি পাহাড়ের ন্যায় অবিচল ছিলেন, তিনি
যেমন নিজের জীবনকে অনিবার্য মত্যুর দিকে ঠেলে
দিতে কুণ্ঠিত হননি, নিজ বিশ্বাসের প্রতি সেই দৃঢ়তা চাই।
আজও
যদি পৃথিবীর কোথঅও একজন ইব্রাহিমের ঈমানের জ্যোতি বিকীরিত হয় তবে বর্তমান অশান্ত পৃথিবীর
নমরূদী হুতাশন আবারও পুষ্পকাননে পরিণত হবে। কবি আল্লমা ইকবাল বলেন, ‘সেই আল্ল্লাহ এবং
সেই আগুন আজও আছে। নেই শুধু ইব্রাহিম (আ.)। আজও যদি কোন ইব্রাহিম পয়দা হতো এবং কোন
নমরুদ যদি তাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করত, তবে সেখানেও আগুনের মধ্যে ফুল ফুটত।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন