তাহলে আমরা কি ?
সংলাপ ॥ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশই
মুসলমান। সারা পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ মুসলমানের আবাসস্থল এই বাংলাদেশ। যা সংখ্যায়
প্রায় ১৬ কোটি। ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের শহর, ঢাকার অলিতে-গলিতে অপূর্ব কারুকার্যপূর্ণ
ও চিত্তাকর্ষক মসজিদসমূহ শোভা পায়, প্রতিদিন পাঁচবার চারিদিক থেকে ভেসে আসে সুমধুর
আজানের ধ্বনি, শুক্রবার দিন সৃষ্টি হয় নামাজিদের এক মনোরম দৃশ্য! রোজার সময় সব হোটেল
ও রেস্তোরার ঝাপ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মুসলমান অধ্যুষিত এই দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১ শত
কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। প্রতিদিন গড়ে খুন হয় ১০ জন মানুষ! দূর্ঘটনায় মৃত্যু, ধর্ষণ,
ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি নিত্যদিনের ঘটনা। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন
জাগে - আমরা কি কুরআনিক মুসলিম?
এখন এমন একটা
সময় এসেছে যখন ইসলাম কেবল নামেই আছে আর কুরআন আছে লিখিত আকারে। কারুকার্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক
মসজিদ নির্মিত হচ্ছে শহর-উপশহর-গ্রামে-গঞ্জে কিন্তু মসজিদের ভেতর কুরআনিক শিক্ষা নেই।
আলেমগণ নিজেদের মধ্যে ফেৎনা-ফ্যাসাদে লিপ্ত। আর এই ফেৎনা-ফ্যাসাদে নির্বাসিত হতে চলেছে
শান্তি (ইসলাম)। মুসলমান এখন সেই শান্তির (ইসলামের) উপর প্রতিষ্ঠিত নেই, যে শান্তির
বাণী প্রচার করেছিলেন মোহাম্মদ (সা.)। কতগুলো পছন্দনীয় আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব মনগড়া
এক অদ্ভুত ইসলামের চর্চা চলছে। কিভাবে এবং কেমন করে 'শান্তি' জীবন-দর্শন না হয়ে কতিপয়
বিচ্ছিন্ন, সম্পর্কহীন ও গুরুত্বহীন আনুষাঙ্গিক বিষয়ের নাম হয়ে গেলো?
বর্তমান পৃথিবীর
সিংহ ভাগ মুসলমানই জন্মসূত্রে মুসলমান। অর্থাৎ মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে বলে
মুসলমান। কিন্তু মুসলমানের ঘরে জন্ম হবার কারণেই কি কাউকে মুসলিম বলা যায়? মুসলিম হওয়া
কি জন্মগত জিনিস?
আমাদের মধ্যে
এমন একটা ধারণা জন্মাল যে বাস্তব জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে আল্লাহকে অমান্য করা যাবে,
জিনিসপত্রে ভেজাল মেশানো যাবে, হালাল-হারামের সীমালঙ্ঘন করা যাবে, মিথ্যা বলা যাবে
আর তারপরও নিজেকে মুসলিম হিসেবেই পরিচয় দেয়া যাবে? কুরআনকে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত
করবো না, ব্যবসা-বানিজ্যে, আচরণে কুরআনিক সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীর হবো না অথচ
নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য মিথ্যার পথে চলবো? মুসলিম কে?
আরবি মুসলিম শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে 'সিলম' ধাতু থেকে। সিলম অর্থ শান্তি। সিলম ধাতু থেকে
কর্তৃকারকে মুসলিম হচ্ছেন শান্তি (ইসলাম) গ্রহণকারী। মুসলিম - শান্তিপ্রিয়, শান্তির
পতাকাবাহী, শান্তিকামী। মুসলিম শব্দটি বহুবচনে মুসলিমুন বা মুসলিমিন। কুরআনের সিদ্ধান্ত
হচ্ছে - যিনি শান্ত, ভদ্র, নম্র, বিনয়ী, ক্ষমাশীল, আত্মবিশ্বাসী, সাবধানি, সতর্ক, ধৈর্যশীল,
ধীর, স্থির এবং আল্লাহ্তে সমর্পিত তিনিই মুসলিম। একজন মুসলিম হবেন সৎ পরিশ্রমী। ন্যায়বান,
উদার, ত্যাগী। একজন শান্তিকামী মানুষ স্বার্থপর না হয়ে পরার্থপর হবেন, পাওয়াকে গুরুত্ব
না দিয়ে তিনি দেওয়াকে গুরুত্ব দেবেন। ঘৃণা ও অশান্তির সৃষ্টি না করে তিনি প্রেম ও শান্তির
আরাধনা করবেন। রাগ নয় অনুরাগই তাঁর পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি। প্রতিশোধ নয় ক্ষমাই
তাঁর নীতি। আত্মগ্লানি নয় আত্মসম্মানই তাঁর শক্তি। অবিশ্বাস নয় বিশ্বাসেই তাঁর স্থিতি। কোন মুসলিম
ধন-সম্পত্তি অর্জনের প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকেন না, তিনি মানুষকে সহযোগিতা করেন। একজন
শান্তিকামীর কাছে আমিত্ব নয়, তুমি এবং সে গুরুত্বপূর্ণ। পরশ্রীকাতরতা ও হিংসা পরিত্যাগ করে শান্তিকামী প্রসংশাকারী হয়ে
উঠেন, লোভ ত্যাগ করে তিনি হয়ে উঠেন নির্লোভ। ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নতা ত্যাগ করে তিনি
বর্তমানে থাকতে সচেষ্ট। নেতিবাচক চিন্তা না করে তিনি ইতিবাচক চিন্তাশীল। তর্কের স্থলে
তিনি বেছে নেন নীরবতা। অস্থিরতাকে ত্যাগ করে তিনি গ্রহণ করেন স্থিরতা। মুসলিম হচ্ছেন
'অ' ত্যাগী। অপব্যয়, অশান্তি, অনিরাপত্তা, অস্থিরতা, অসতর্কতা, অন্যায়, অসাম্য, অবিচার,
অনাচার, অসততা, অসংযম, অপচয়, অদূরদর্শিতা, অবিচক্ষণতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অনৈতিকতা,
অবমাননা, অমানবিকতা, অবজ্ঞা, অনিশ্চয়তা - জীবনের অভিধানে লিখিত এসব শব্দ থেকে যিনি 'অ' -কে ত্যাগ করেছেন তিনিই মুসলিম। মুসলিম অজ্ঞানতা (জাহেল) থেকে মুক্ত জ্ঞানবান পুরুষ।
মানুষে মানুষে পার্থকের মানদন্ড জ্ঞান এবং অজ্ঞানতায়, অস্থিরতা ও স্থিরতায়, অসংযম এবং
সংযমে। কে কোন্ শাস্ত্র পাঠ করে তা মানুষে মানুষে পার্থক্যের কোন মানদন্ড নয়।
মুসলিম তার উদ্বৃত্ত
অভাবী ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়,
সম্পদ পুঞ্জীভুত করে না। একজন মুসলিমের কথা ও কর্ম থেকে অন্য মানুষ সম্পূর্ণ নিরাপদ।
তিনি আমানত রক্ষা করেন এবং অঙ্গীকার পালন করেন। মুসলিম - সত্য বলেন, অভাবীকে দান করেন,
অন্যের অনুগ্রহের প্রতিদান দেন, আপনজনদের প্রতি সংবেদনশীল থাকেন, প্রতিবেশী ও আত্মীয়
স্বজনের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখেন, অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকেন। তাঁর কাছে লোকেরা
তাদের জান ও সম্পদ সম্পর্কে নিরাপদ। তিনি - নিষ্পাপ, শান্তিকামী, ভালো এবং ভালোবাসার
কেন্দ্র্রস্থল। তিনি নিজের জন্য যা পছন্দ করেন
অপরের জন্যও তা-ই পছন্দ করেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন এবং মানুষও তাকে ভালোবাসে। লজ্জাশীলতা
তাঁর ভূষণ। তিনি 'এক' এ প্রতিষ্ঠিত। নিজের প্রবৃত্তি, মন, হৃদয়, অন্তর যতক্ষণ পর্যন্ত
এক আল্লাহর অনুগত না হবে ততক্ষণ কেউ মুসলিম হতে পারে।
কুরআন মতে মুসলিম
হচ্ছেন - 'পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। তারা একে অপরকে যাবতীয় ভাল কাজের নির্দেশ
দেয়। অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে,' (তওবা : ৭১), “যারা আমানত ও ওয়াদা চুক্তির
রক্ষণাবেক্ষণ করে।” (মুমিমুন : ৮)। 'ন্যায়ের নির্দেশদানকারী, অন্যায়ের
বাধাদানকারী এবং আল্লাহ্র নির্ধারিত সীমা রক্ষাকারী।”
(তওবা : ১১২)। “যে ব্যক্তি আল্লাহ্র দিকে মানুষকে ডাক দেয়, সৎকাজ করে”
(হা-মিম-সিজদা : ৩৩)। কুরআন মতে মুসলমান তাঁরাই - “যারা বিশ্বাস করে এবং ভালো কাজ করে।”
(সূরা নিসা : ৫৭, ১২২)। মুসলমান তাঁরাই - “যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে সৎকর্ম করে বা (কারও)
অপরাধ ক্ষমা করে” ( নিসা : ১৪৯) এবং “পরস্পরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ
দেয়।” (আসর : ৩)।
মুসলিমদের প্রতি
আল্লাহ সুস্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছেন -
'আর তোমরা সকলে
আল্লাহর রশিকে (কুরআন) শক্ত করে ধরো ও বিভক্ত হয়ো না'। (৩ ইমরানঃ ১০৩)।
'অবশ্য যারা ধর্ম
সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো কাজের দায়িত্ব তোমার নয়'। (৬ আনআম ঃ ১৫৯)
'অংশীবাদীদের
অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা ধর্ম সম্বন্ধে নানা
মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে'। (৩০ রূম ৩২)।
'আর তোমরা তাদের
মতো হয়ো না, যারা তাদের কাছে স্পষ্ট নির্দেশ আসার পর বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে
মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি'। (৩ ইমরানঃ ১০৫)।
'তিনি তোমাদের
জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন সেই ধর্মই, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে আর আমি ওহি করেছি তোমাকে
এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহিম মুসা ও ইসাকে এই বলে যে, তোমরা ধর্ম ধারণ করবে
এবং তাতে দলাদলি ও মতভেদ সৃষ্টি করবে না'। (৪২ সুরা ঃ ১৩)।
অথচ মসুরম নামধারী
কিছুলোক “জেনেশুনেই কেবলমাত্র পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই নিজেদের মধ্যে দলাদলি
ও মতভেদ ঘটাচ্ছে/ঘটাবে”। (৪২ সুরা ঃ ১৪)। হযরত মোহাম্মদ (সা.) ২২ বৎসরের
একনিষ্ঠ সাধনায় যে মুসলিম জাতি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর ওফাতের ৩০/৩৫ বৎসর পর থেকেই নানা
দল-উপদলে বিভক্ত। রাফেজি, মোতাজেলি, শিয়া, সুন্নী, সুন্নী হানাফি, সুন্নী হাম্বেলি,
সুন্নী ওহাবি, কাদিয়ানি, শিয়া যায়েদি, শিয়া ওলাতি, শিয়া দুরুজ, শিয়া ইসনে আশারিয়া ইত্যাদি
নানা দলে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেদের ফ্যাৎনা-ফ্যাসাদে লিপ্ত। নিজেদের মধ্যে দলাদলি
ও মতভেদে লিপ্ত হয়ে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবানন, সোমালিয়া,
ইয়েমেন, ইরান, ইরাক সর্বত্র মুসলিমগণ ইসলাম বা শান্তি থেকে দূরবর্তী হয়ে অশান্তির বিস্তার
ঘটাচ্ছে। কুরআনের একটি আয়াতও নেই যা শিয়া মুসলিম, সুন্নী মুসলিম, কাদিয়ানি কিংবা ওহাবীদের
উদ্দেশে। এসব শব্দই কুরআনে নেই। যাদের কথা কুরআনে নেই কোরআন তাদের জন্য নয়।
কুরআনের ব্যাখ্যা
বিশ্লেষণ শেষ হয়ে যায়নি এটা কোনকালে শেষ হবেও না। যুগে যুগে যুগের উপযোগি ব্যাখ্যা
আসবে। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা যদি অশান্তির সৃষ্টি করে তবে তা পরিত্যাজ্য। কারণ কুরআনের
মূল সূত্র শান্তি। কোন মতবাদ গ্রহণ-বর্জনের জন্য বলপ্রয়োগ কুরআনের মূলসূত্র বিরোধী।
ইসলাম বা শান্তি বজায় রেখে কুরআনে সত্যের অন্বেষণ করাকে কুরআন উৎসাহিত করেছে। কুরআনের
সিদ্ধান্ত হচ্ছে - একজন মুসলিম সবকিছু ত্যাগ করতে পারে কিন্তু কোন কিছুর জন্যই শান্তি
ত্যাগ করতে পারে না।
আজ পৃথিবীতে মুসলিম
অতি দুর্লভ এবং প্রায় বিলুপ্ত এক প্রজাতি। সূফী সাধক হাছান বসরী বলেছিলেন - 'মুসলিমগণ
আছেন কবরে এবং ইসলাম আছে কুরআনে।' একবার এক পন্ডিত সূফী সাধক আনোয়ারুল হক -কে জিজ্ঞেস
করেছিলেন - 'হুজুর, প্রকৃত মুসলিম কে?' সাধক আনোয়ারুল হক উত্তর দিয়েছিলেন - 'আমার বাম
গালে চড় দিলেও আল্হামদুলিল্লাহ্, ডান গালে চড় দিলেও আল্হামদুলিল্লাহ্'। অর্থাৎ
যিনি বিরোধীদের চড় হজম করে সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর প্রশংসা করতে পারেন তিনি নিজেকে
মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন। মানুষ মাটির তৈরি। মাটি স্বর্বংসহা। যিনি মাটির মতো
সহনশীল তিনি মুসলিম। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক ছিলেন এমনই একজন মুসলিম। তাহলে আমরা কি?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন