বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি....৩০


সার্বিক একাত্মতা ও মিলন, একের সর্বোত্তম গুণ বহমান উপদেশের মাধ্যমে অন্য এক-কে দেয়ার মাধ্যমে ধারণ-লালন-পালন। একাত্মতা ও এক সত্য সমন্বয় সাধনের জন্যই পৃথিবী জুড়ে ‘চিন্তনপীঠ’ ছিল - আছে - থাকবে সব রকমের বিদ্যাভাসের জন্য। সত্যব্রত চিন্তনপীঠ যুগে যুগে নেতৃত্বে থাকে সেইসব চিন্তনপীঠগুলোর কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে। সাধক-ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যম। সে ভাষা সমগ্র পৃথিবীর সত্যমানুষকুলের অর্থাৎ সাধককুলের সাংস্কৃতিক ভাষা। লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী চিন্তাবিদরাই সেই ভাষা শিখতে পেরেছেন এবং পারবেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চিন্তনপীঠগুলোর ভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলে চিন্তাজগতের স্বাভাবিক প্রবণতা হবে পুরানো সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ধর্মকে উপলব্ধি করা। সত্যব্রত চিন্তনপীঠ বাঙালি জাতির অতীতের সব কিছুর মূল্য সম্যক হৃদয়ঙ্গম করে নতুন কিছু সৃষ্টি করছে, এমন কিছুর অবতরণ ঘটাতে চাচ্ছে যা হবে পৃথিবীর পক্ষে নতুন। এই প্রচেষ্টায় চিন্তাজগৎ যাতে অতীতের সব কিছুর দ্বারা শৃঙ্খলিত না হয়, তারজন্য নিজকে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ করেই এগিয়ে যেতে হয়। অতীত সম্বন্ধে জ্ঞানলাভের প্রয়োজনীয়তা আছে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কাজের বিঘ্ন না ঘটাতে।
সর্বপ্রকারের বিদ্যাভাস অথবা যে কোন অবস্থাতেই বিদ্যাভাসের বেশীরভাগ অংশ অতীত সম্পর্কে জানবারই প্রচেষ্টা এই আশায় যে এই জ্ঞান বর্তমান সম্বন্ধে ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। অতীতকে আঁকড়ে নয় বা ভবিষ্যতের দিকে তাকানো নয় এই বিপদকে এড়াতে চাইলে নিজকে বোঝবার এবং জানবার জন্য বিশেষ যত্ন নিতে হবে। অতীতে যা কিছু ঘটেছিল, আজকে যা ঘটছে তারই প্রস্তুতির জন্য আর এখন যা কিছু ঘটছে তা ভবিষ্যতের পথ প্রস্তুত করার জন্য ছাড়া আর কিছু নয় এই হল সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় দৃঢ় প্রত্যয় যার জন্য নিজকে অবশ্যই তৈরী করতে হয়।
উপলব্ধি বোধের অনুশীলনের দ্বারাই বর্তমান ও ভাবীকালে লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজকে তৈরী করা যায়। মানব আধারের আর সব অংশের মত চিত্তেরও বিশ্রাম চাই, আর এ বিশ্রাম সে পাবে না যতক্ষণ না জানে কি রকমে তা দিতে হয়। চিত্তকে কি করে বিশ্রাম দিতে হয় তা অনুশীলনের জিনিস। এক উপায় হল, এক লক্ষ্য অর্জনের জন্য চিন্তাজগতের কাজ বদলান, কিন্তু সবচেয়ে ভাল বিশ্রাম হতে পারে এক লক্ষ্য ছাড়া সব ব্যাপারে নীরবতায়।
যখন ইচ্ছামত চিত্তকে নীরব করতে পারা যায়, গ্রহণোম্মুখ নীরবতার মধ্যে তাকে একাগ্র করে ধরে রাখা যায়, তখনি সমস্যার সমাধান হয়, সঙ্কট দূর করা যায়। শ্রীগুরু, আমি আমার উপলব্ধি ও বাস্তবতার সাহায্যে কাজ করতে চেষ্টা করব, আমার এই প্রয়াসে তুমি সাহায্য কর, প্রাণশক্তিকে শান্ত কর, চিন্তাজগতকে নীরব ও অচঞ্চল রাখ এমনভাবে যেন একাত্মতার ক্ষেত্র ঊর্দ্ধের দিকে উন্মুক্ত ও গতিসম্পন্ন হয় এই প্রার্থনাই উত্তম। আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত হচ্ছি কিন্তু নিজ-এর মধ্যে স্বজ্ঞার গুণ ও সমত্ববোধের সাহায্যে জ্ঞান লাভের ক্ষমতা বিকাশেরও চেষ্টাও করিনি, তাই এখুনিই শুরু করি। 
প্রত্যক্ষ দর্শন, উপলব্ধি ও জ্ঞান - তা অন্তরের গোপন দিনলিপিতে লিখে রাখতে হয়। আত্মসূর্যই শ্রীগুরুর রূপ। এই আত্মসূর্যের রূপ এবং আমি রূপ একই এবং অভিন্ন। জিহ্বার দ্বারা সকল স্বাদ বোঝা যায়। লালসাযুক্ত জিহ্বা দ্বারা লালসা উৎপন্ন হয়। এই লালসার জন্যই আমিত্ব আবদ্ধ হয়। লোভ চরিতার্থ না হলে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। এগুলো সবই সত্যমানুষ হওয়ার অর্থাৎ সাধনার অন্তরায়। অতএব, লোভ ক্রোধ ইত্যাদি এগুলোকে সর্বাগ্রে নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত প্রয়োজন। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আত্মরাজ্যে প্রবেশ করা যায় । 
কোন বস্তু লাভের জন্য লোভ হয়। সেই লোভ বাইরের থেকে আমি-র মধ্যে প্রবেশ করে না। লোভ আমি-র ভেতরেই আছে। কোন বস্তু লাভের ইচ্ছা জাগ্রত হওয়াই দেহাভ্যন্তরস্থ লোভরূপী অবস্থার প্রকাশ। লোভ বর্তমান। এই লোভ কে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাহ্যিক উপায়ে বা বাহ্যিক ত্যাগে সম্ভব নয়। যেমন যে বস্তুর প্রাপ্তির জন্য লোভ হল, সেই বস্তুকে যখন গ্রহণ না করা হয় তখন বাহ্যিক ত্যাগ হল বটে কিন্তু চিন্তাজগতের অন্তরে সেই বস্তু লাভের লোভ রয়ে গেল। অতএব এ ভাবে লালসা বা লোভ চরিতার্থতা হল না ঠিকই, কিন্তু এ উপায়ে সঠিক ত্যাগ সম্ভব নয়। ত্যাগ, শ্রীগুরুর আদেশ-উপদেশ-নিষেধের মধ্যের নির্যাস নিয়ে সংস্পর্শ-সান্নিধ্য-স্মরণে লক্ষ্য অর্জনে মগ্নতা। 
চরণ দেখা নাকি যার দ্বারা বিচরণ করা যায়। মানুষ দুই পায়ের দ্বারা বিচরণ করে। পা হাড় মাংস দ্বারা গঠিত। প্রকৃতপক্ষে পায়ের কি নিজস্ব ক্ষমতা আছে? যদি থাকত মৃত মানুষের পাও চলত। তা যখন চলে না, তখন এই দুই পায়ের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। অতএব প্রকৃতপক্ষে এই দুই পা সহ সারা শরীরটাকে যিনি চালাচ্ছেন তিনি হলেন শ্বাস। এই শ্বাসের গতি থাকায় জীব জীবিত থাকে।
নিজ অন্তরকে সম্পূর্ণ রিক্ত কর, মুক্ত কর, উজাড় করে নিঃশেষে শ্রীগুরুর চরণে ঢেলে দাও, তাঁর সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হও, অন্তরকে সর্ব্বদা পূর্ণরূপে তাঁর প্রতি উন্মুখ করে রাখ, তবেই নিমেষের মধ্যে তাঁর কৃপার বৈদ্যুতিক স্পর্শে হতাশা বিপর্য্যস্ত আমি-প্রাণ সরল সতেজ হয়ে থাকবে, তাঁর করুণাধারায় অভিসিঞ্চিত হয়ে জীবন চলার পথে সমগ্র জীবন-জনম ধন্য ও কৃতার্থ করে এবং কৃতজ্ঞ হয়ে আনন্দলোকে থাকা যায়।

আমরা সবাই জানি....২৯


আনুষ্ঠানিকতা অধমাধম। তার মানে অধমেরও অধম, সবচেয়ে নীচু, সবচেয়ে স্থূল। ধ্যানভাব মধ্যম। অধম হলেও আনুষ্ঠানিকতা ত্যাজ্য নয়। আনুষ্ঠানিকতা একেবারে তলায়, তলায় হলেও সেটা একটা ধাপ; আরম্ভেতে সেটাও করতে হয়। সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে ছাদে উঠতে হয়।
সাধনা নিজের মন্দকে দূর করা। শ্রীগুরু শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ, তাঁকে পাপ স্পর্শ করতে পারে না, তিনি পাপকে প্রকাশ করতে পারেন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য লক্ষ্যকে চিন্তা করতে হয়। আরোপ করতে করতে লক্ষ্য স্বরূপ সম্বন্ধে ধারণা হয়; নিয়ন্ত্রণ আসে নিজের ওপর, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় নিজের ওপর। কৃচ্ছসাধন ইচ্ছে হয়, তাই কৃচ্ছসাধন করা। তীর্থভ্রমণে কাজের কাজ কিছু হয় না, কেবল অন্তর উচাটন আর অর্থহানি হয়ে থাকে। ঘরে বসে শান্তভাবে অন্তরে শ্রীগুরু চিন্তা করলেই কাজ হয়। মানুষ নিজের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। দরকার সকলেরই আছে! যত জপ করতে পারা যায় ততই ভাল। গুরুউপদেশ! লালন আর পালনে খাটতে হয় খুব। শ্রীগুরুর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে সাধনার পথের যাত্রীর চাই:-(১) ধৈর্য। (২) অধ্যবসায়। (৩) দেহ ও অন্তরের পবিত্রতা। (৪) তীব্র আকাক্সক্ষা বা ব্যাকুলতা। (৫) অন্তরের স্থিরতা, বিষয়ে আসক্তি-ত্যাগ, সকল প্রকার দুঃখে অবিচলিত থাকা, শ্রদ্ধাবনত শ্রীগুরুতে ও তাঁর উপদেশবাক্যে আস্থা ও চিত্তস্থাপন।
সাধন-ভজনের দ্বারা যেসব বিষয়ে উপলব্ধি বা দর্শনাদি হয় তা শ্রীগুরু ছাড়া আর কাকেও না বলা। আধ্যাত্মিক সম্পদ-অন্তরতম চিন্তাধারা-নিজের অন্তরে লুকিয়ে রাখতে হয়। তা অপরের কাছে প্রকাশ করতে হয় না। ওটা পবিত্র গুপ্তধন, একমাত্র শ্রীগুরুর সঙ্গে একান্তে উপভোগ্য বস্তু। আবার দোষ, ত্রুটি ও অনাচারের কথা অপরের কাছে বলে বেড়ানো সঠিক নয়। তাতে আত্মসম্ভ্রম খোয়া যায় ও অপরের কাছে হীন বলে প্রতিপন্ন হয়। নিজের দোষ, দুর্বলতা শ্রীগুরুকে জানাতে হয় ও তার কাছে প্রার্থনা করতে হয় যেন তিনি সেগুলো শোধরাবার শক্তি দেন।
ধ্যান করতে হলে প্রথমে খানিকক্ষণ স্থির হয়ে বসে চিন্তা যেখানে যেতে চায় যেতে দিতে হয়। ভাবতে হয়, নিজেই সাক্ষী, নিজেই দ্রষ্টা। বসে বসে লক্ষ্য-চিন্তায় ভাসা-ডোবা, চিন্তার দৌঁড়-ঝাঁপ দেখা এবং উপলব্ধি করা। ভাবতে হয়, আমি সম্পূর্ণ পৃথক। যখনই কোন অন্য চিন্তা আসে, তখনই সেটাকে জোর করে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়। অভ্যাস বৈরাগ্য ছাড়া লক্ষ্যে একাগ্রতা আনবার অন্য কোনও সুগম বা সহজ উপায় নেই। যতক্ষণই জপ বা ধ্যান করা-ততটুকু নিমগ্ন হয়ে করা। শ্রীগুরু অন্তর্যামী, ভেতর দেখেন, তিনি তো আর কতটুকু সময় ধ্যান করা হলো বা কতবার জপ করা হলো তা দেখেন না। ৪/৫ বছর নিষ্ঠার সাথে নিয়মিত করলে তবে আনন্দ পাওয়া যায়। তখন একদিন না করলে ভারি কষ্ট হয়, কিছু ভাল লাগে না। আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী হওয়া দরকার। 
জীবনের অর্ঘ্য শ্রীগুরুর পায়ে অর্পণ করতে হয়। এটা জীবনের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। তারপরে নির্ম্মাল্য হয়ে জগতের প্রতিজনের সংস্পর্শে আসা। অকপটে যে জীবন শ্রীগুরুতে উৎসর্গীকৃত হয়েছে, সে জীবনের সংস্পর্শে যে যখনি আসুক, নির্ম্মাল্যের পবিত্রতাকে সম্মান করে চলতে সে বাধ্য হয়। চর্মচক্ষে মানুষ শ্রীগুরুর বাহ্যিক রূপ দেখতে পায় আসল সত্য রূপ দেখতে পায় না, কিন্তু সত্যময় পবিত্রতা-রূপে যে প্রভা তিনি বিকিরণ করছেন, তা অনুভব করতে পারে এবং তার সৌরভ গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। যে যতটুকু নিবেদনে পবিত্র, সে ততটুকু শ্রীগুরুর, সে ততটুকু উন্নত, সে ততটুকু আদরণীয়। শ্রীগুরুর হলে,-পবিত্রতার দিব্য সুগন্ধ সমস্ত অস্তিত্বকে ঘিরে ধরে থাকে।
শ্রীগুরুকে ভালবাসলে কামনা আপনি কমে যায়, ক্রোধ আপনি থেমে যায়, লোভ আপনি দমিত হয়,- এর জন্য আলাদা করে আর কোনও চেষ্টা করতে হয় না। পন্ডিতেরা মানবের সকল আচরণে, সকল দৃষ্টিভঙ্গীতে, সকল চিন্তা-ধারায় কামনার অপ্রতিহত মূর্তি আবিষ্কার করে শঙ্কিত হয়েছেন এবং অর্দ্ধোপভুক্ত ও অনুপভুক্ত কামনার কুফল যেমন করে সমাজের প্রতি অঙ্গে অকল্পনীয় অশান্তি এনেছে, তা দেখে কামনাকে অধিকতর নিশ্চয়তার সাথে উপভোগ করে অন্তরের বিকার প্রশমিত করে নিয়ে সকলকে শান্তি ও নিরুদ্বেগ জীবনের পথপ্রদর্শন করবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। 
কামনার পৃথক অস্তিত্ব নেই। নিখিল ভুবন প্রেমময় প্রেমজগৎ, একের সাথে সম্পর্ক হতে প্রেম সৃষ্টি হয়েছে, তাই সব-কিছু প্রেমময়। সে প্রেম ক্ষুদ্র আধারে পড়ে কামনা নাম ধারণ করে। আবার অনন্ত অসীম শ্রীগুরুর চরণে পড়ে নিজ স্বরূপ প্রকাশ করে, প্রেম হয়। কামনা প্রেমজগতেরই একটা দিক মাত্র, সম্পর্ক নিত্যশুদ্ধ অবস্থা। আত্মসুখের লিপ্সার সাথে যখন মিশ্রিত হয়, সম্পর্ক তখন কামনা হয়ে যায়; শ্রীগুরুর বিশ্বসুখে, বিশ্বাত্মার সুখে, বিশ্বপ্রভু সুখের লিপ্সার সাথে যখন যুক্ত হয়, কামনা তখন প্রেমে পরিণত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন রূপ ধরে সর্ব্বপ্রাণীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হৃদয়ে বাস করে। যে মুহূর্তে কোনও প্রাণী জানে যে, কামনার পৃথক কোনও অস্তিত্ব নেই, শ্রীগুরুর প্রেমময় অস্তিত্বেই তার প্রকৃত অস্তিত্ব, তখন আর কামনা তার ক্ষুদ্র লক্ষ্য, ক্ষুদ্র দৃষ্টি, ক্ষুদ্র লীলা-বিলাস-লাস্য নিয়ে বসে থাকতে পারে না, তখন সে প্রেমের বিশ্বম্ভরী মূর্তি ধারণ করে এবং শ্রীগুরুর প্রতি অর্পিত ভালবাসাকে বিশ্বের প্রতিজনের প্রতি বিসর্পিত করে দিয়ে নিজেও হয় প্রতিক্রিয়া বর্জিত মধুময়, বিশ্বকেও করে বিপুল আনন্দে উল্লসিত। শ্রীগুরুকে ভালবেসে, অন্তরের কামনাকে শ্রীগুরুর চরণে রাখতে হয়, তাঁর অকৈতব প্রেমের মধুময় স্পর্শে কামনা তার কণ্টকমালা হতে রিক্ত হয়ে পারিজাত-মাল্য গলদেশে ধারণ করে বার হয়ে আসে, পূতিগন্ধময় তার অস্তিত্ব কলুষহীন নিষ্পাপ-সুন্দর দিব্যসুরভি নিয়ে বহির্গত হয়। যা ছিল গুপ্ত শত্রু, তা হোক নিখিল বিশ্বের প্রতিজনের পরম কুশলকারী নিত্যবন্ধু।
সত্য-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শ্রীগুরুচর্য্যের পরম-সহায়ক। পরম সত্যই স্রষ্টা শ্রীগুরু - এটা সাধককুলের তথা সত্যমানুষকুলের উপলব্ধি। সত্যে যে বিচরণ করে, শ্রীগুরুতে বিচরণ তার কঠিন হয় না। সত্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে হয়। যে পরের প্রাপ্যের প্রতি অন্যায় ও লুব্ধ দৃষ্টি দেয় না, তার পক্ষে সত্যে সুদৃঢ় হওয়ার পথ সুগম। যে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না, তার পক্ষে সত্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সহজ। যে অপরের অনুগ্রহ-লাভের প্রত্যাশী নয়, নিজের কার্য্য নিজের শক্তিতেই সাধন করতে চেষ্টিত, তার পক্ষেও সত্যে প্রতিষ্ঠালাভ সহজ। জগতের অধিকাংশ ভুলই বস্তু লাভের লোভ হতে সৃষ্ট হয়। যা লক্ষ্যপথে কিছু লাভ করতে পারে না। শ্রীগুরুর প্রতি লোভ মানুষকে ভুল পথে যেতে বাধ্য করে। যার প্রতি বিদ্বেষ আছে, ক্ষমার মহিমায় যদি তার প্রতি অন্তরের শত্রুতা-বোধ প্রশমিত করতে না পারা যায়, তা হলে তাকে অপদস্থ, হতমান ও পরাভূত করবার জন্য ভুল পথের আশ্রয় নিতে প্রলুব্ধ হয়।
ধর্মের শিক্ষা মানবকে বিনয়ী করে। ধর্মের জ্ঞান মানবকে মহান করে। মানবের এই জ্ঞানকে জীবনে লালন করতে হয়। একজানা জীবনে যুক্ত না হলে, সমস্তই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এটা জীবনে অনুশীলন করতে হয়, তাহলেই এর সার্থকতা। যে কোন অনুভূতি অনুশীলন সাপেক্ষ অর্থাৎ সব কিছুই অনুশীলনের ভিতরে। এক-লক্ষ্য জানাকে জীবনে অনুশীলন করাই মানব জীবনের সাধনার একটা বৈশিষ্ট্য। সত্যাশ্রয়ী, নিষ্কন্টক, সহজ মানবই এক-লক্ষ্য জানাকে জীবনে অনুশীলন করেন। আর তাই তিনিই কেবল পরম উপলব্ধি লাভ করতে পারেন। অনুভূতিই ধর্মের প্রাণ-অনুভূতি বিহীন ধর্ম নিষ্ফল।

আমরা সবাই জানি....২৭-২৮


যার জীবনে শ্রীগুরু ধরা দেবে-অপরূপের দিব্য মহিমা-সে যে পথ দিয়ে চলবে সবাই সুখী হবে তার সেবায়। সবকিছু উজ্জ্বল হবে শ্রীগুরুর জ্যোতিতে - শ্রীগুরুর আদেশ-উপদেশ-নিষেধে উজ্জীবিত হয় সত্তা - সবাইকে দিতে পারে আনন্দ-সংবাদ।
লোভ, মোহ, আসুক নব নব ছলনা-সেদিকে লক্ষ্য না রেখে আপন চিন্তায় চিহ্নিত পথ ধরে এগিয়ে চললে, একদিন না একদিন গন্তব্য স্থানে গিয়ে পৌঁছানো যায়-এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কল্যাণকর্মে জীবন কখনো ব্যর্থ, বিফল হয় না।
শ্রীগুরুকে ডাকলে জীবনের সকল অভাব, অপূর্ণতা দূর হয়। এটা শুধুমাত্র কথার কথা বা কল্পনা নয়। সাধককুল সত্যমানুষকুল তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
সম্পর্ক করার জন্যই মানুষের সাধনা। যেদিন মানুষ শ্রীগুরুর সাথে সম্পর্ক করে নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক হয়, সেদিন সে নিজের অন্তরের মুকুরে দেখে হৃদয়-দেবতা শ্রীগুরুর মুখ। সে লাভ করে এক অপূর্ব আনন্দঘন দিব্যজীবন।
শ্রীগুরু তাঁর কাঁধ বাড়িয়ে আছেন বোঝা নেবার জন্য। বিশ্বাস করে মানুষ তাঁর কাঁধে জীবন বোঝা দিতে পারেন না। তাই মানুষের দুরবস্থা-জীবন বোঝা তাঁর কাঁধে বোঝা দিতে পারলে জীবনের সব কাজই সুসম্পন্ন হয়।
মহাপুরুষরা ইচ্ছানুযায়ী বারবার জন্মগ্রহণ করেন-জীবের কল্যাণের জন্য। আমিত্বের আবরণগুলো হতে একেবারে মুক্ত হতে হলে নিয়ম নিষ্ঠা লালন-পালন করতে হয়। শ্রীগুরু কাউকে কিছু দেন না, তিনি সম্পূর্ণ নিস্পৃহ দ্রষ্টা-কিন্তু তাঁর উপদেশ, সান্নিধ্য আর নাম স্মরণ থেকে সব কিছু পাওয়া যায়।
শ্রীগুরুর আশীর্বাদ প্রসাদ ছাড়া মানুষ উর্দ্ধমুখী হন না। শ্রীগুরু সর্বত্র থাকলেও এক এক দেশে এক এক অবস্থানে শ্রীগুরুর এক এক বিশেষত্ব, দেখা যায় উপলব্ধির মাধ্যমে, বুঝতে হয় এবং চিনতে হয় তাঁর মধ্যের ভাব এবং বহমান বিশেষ করুণার ঝর্ণাধারা।
শ্বাসে প্রশ্বাসে নাম অভ্যস্ত হয়ে গেলে অপ্রাপ্য কিছুই থাকে না। শ্বাসে প্রশ্বাসে নাম স্মরণ সাধনার প্রথম দেশ এবং সিদ্ধি-সিঁড়ির প্রথম ধাপ। শ্রীগুরুর প্রিয় অপ্রিয় ভেদ নেই। ভক্তিতে ভজনা করলে শ্রীগুরুর সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায়। অন্তরে শ্রীগুরুর স্থিতি উপলব্ধি হয়। শ্বাসে-প্রশ্বাসে নাম করার অর্থ তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকা। সমস্ত চিন্তা-জগৎ নামে এবং শ্রীগুরুর কর্মে মগ্ন থাকলে সুখ-দুঃখ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আঘাতে কোন যন্ত্রণাবোধ থাকেনা কারণ তার বর্তমান তখন নামে মগ্ন।
যে কোন একটা প্রজাতির সদস্যকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারলে শ্রীগুরুদর্শন হয়। তিনি সর্বত্র। নিজকে নিয়ন্ত্রণ না করলে, ত্যাগ ও তপস্যার দ্বারা অন্তর শুদ্ধ ও পবিত্র না হলে শ্রীগুরুর আনন্দ-লোকে প্রবেশ করা যায় না।
সারাদিন আহার সুখ, নিদ্রা সুখ, বিষয় সুখ-এগুলো নিয়ে থাকলেও অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু সময়ের জন্য শ্রীগুরু স্মরণে থাকা যায়। সুখ যত বাড়ে তত বাড়ে দুঃখের দহন-পরিত্রাণের উপায়-শরণাগতি। একান্ত চিত্তে শ্রীগুরুর উপর নির্ভর করে থাকা যায়। শ্রীগুরু প্রয়োজন মত সব ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন। একটা অস্ফুট ব্যথাও তাঁর অগোচর নয়।
অন্তরে অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক ভাবগুলো, যথা-শক্তি, জ্ঞান, প্রেমস্তর, পবিত্রতা, অন্তরের জ্যোতির্ময়তা এবং জীবন চলার পথে এমন কিছু কর্ম যার মধ্যে দিব্য জীবন-স্রোতে প্রবাহমান, তাতে একনিষ্ঠতা যোগে ধারণ করাই উত্তম। চৈতন্যসত্তা যখন শ্রীগুরুর ভাবগুলো দ্বারা পরিপূর্ণ হতে থাকে, তখন অপবিত্রতার কোন স্থানই সেখানে থাকে না। এ প্রকার সাধনা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে চিত্ত শুদ্ধ হয়। নিমগ্ন থাকলে সত্যমানুষে বিবর্তিত হয়, সত্য-শক্তি ও জ্যোতিতে পরিপূর্ণ হওয়ার পথ ধরে উর্দ্ধমুখী হওয়া যায়।
অশান্তির মূল হচ্ছে দ্বৈতভাব এবং দ্বিচারিতা। চতুর্দিকে সুন্দর পুষ্পরাশি থাকতে পারে; পবিত্র ভাবোদ্দীপক চিত্র -পটাদি থাকতে পারে, সুরভিত ধূপ থাকতে পারে, কিন্তু চিন্তায় অপবিত্রতা থাকলে; অর্থাৎ একাগ্রতা না থাকলে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি স্থির না থাকলে-পবিত্রতা বস্তুটা অজ্ঞাতই থেকে যায়। অবিচলিত একাগ্রতার শক্তি দ্বারা যে কোন বাহ্য অবস্থা অতিক্রম করা যায়। সংযত চিন্তা শক্তিশালী হয় এবং যা কিছু দ্বারা বিক্ষিপ্ততা আসে, তা হতে নিজকে বিযুক্ত করার ক্ষমতা তার আয়ত্তে আসে। সাধনা, প্রেমজগতের পবিত্রতায় দৃঢ়ভাবে স্থিতিশীল হয়, কোন কিছুই আর তখন চিত্তকে উদ্বিগ্ন করতে পারে না। বিক্ষিপ্ত এক একটা চিন্তা এক একটা সুতোর মতো, তাকে সহজেই ছেঁড়া যায়। কিন্তু একাগ্রতা সুতোর এক গুচ্ছ, তাকে ছেঁড়া কঠিন। চিন্তারাশি সংযত করে লক্ষ্য-বিষয়ে দৃঢ়ভাবে সংযোগে থাকতে হয়। একাগ্র হলে কিছু শ্রুতিগোচর হয় না, কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না-সব সমর্পিত হয়ে যায়। বাহ্য শব্দ, বাহ্য দৃষ্টি প্রভৃতি সকল বাহ্যিক ক্রিয়াসমূহ একাগ্রতা দ্বারা জয় করা যায়। সম্পর্কের সর্বোচ্চ রূপ একাগ্রতার তীব্রতায় নিকটে আসে। সংযোগে থাকা সহজ নয়। সংযোগে থাকার অর্থ অন্তরে শ্রীগুরুর অস্তিত্ব অনুভব করা। যোগ এবং সংযোগ শিল্প সৃষ্টির একমাত্র সত্য পথ বলে উপলব্ধ। তার অর্থ এই নয় যে, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ব্যাপারটা উপেক্ষা বা অবহেলা করা। শ্রীগুরুকে অন্য কোন কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। শ্রীগুরু চিন্তায় ভাবের অভিব্যক্তি ঘটায়।
প্রেমজগতের ভালবাসায় শ্রীগুরুকে ভালবাসলে কামনা কমে যায়, ক্রোধ থেমে যায়, লোভ দমিত হয়, - এর জন্য আলাদা করে আর কোনও চেষ্টা করতে হয় না। পন্ডিতেরা মানুষের সব আচরণে, সব দৃষ্টিভঙ্গীতে, সব চিন্তা-ধারায় কামনার অপ্রতিহত মূর্ত্তি আবিষ্কার করে শঙ্কিত হয়েছেন। তাঁরা অর্দ্ধোপভুক্ত ও অনুপভুক্ত কামনার কুফল কেমন করে সমাজের প্রতি স্তরে অকল্পনীয় অশান্তি আনছে, তা দেখে কামনাকে অধিকতর নিশ্চয়তার সাথে উপভোগ করে স্ব-বিকার প্রশমিত করার জন্য সকলকে শান্তি ও নিরুদ্বেগ জীবনের পথপ্রদর্শন করবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন এবং আছেন।
সাধককুল তথা সত্যমানুষকুল কামনার পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। প্রাণ আর প্রেমজগৎ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। নিখিল ভুবন প্রাণ-প্রেমজগৎ-প্রেমময়-প্রেমসম্পর্ক হতে সৃষ্ট, তাই সব-কিছুই প্রেমময়। সেখানে মিথ্যা বলে কিছু নেই। প্রেমজগতে লক্ষ্যচ্যূত হলে বা লক্ষ্য না থাকলে বিক্ষিপ্ত চিন্তার মাঝে আত্মসুখ লিপ্সায় কামনার সৃষ্টি। আবার অনন্ত অসীম শ্রীগুরুর সাথে একাত্মতায়, স্বরূপে প্রকাশিত হয়ে হয় প্রেমময়। কামনা প্রেমজগতেরই একটা পরিবর্তনশীল অবস্থা। আত্মসুখ লিপ্সার সাথে মিশ্রিত হয়ে কামনা হয় বহমান; শ্রীগুরুর সাথে একাত্মতায়-পরমসত্যের সাথে একাত্মতায়-পরম চেতনার মাঝে নিমজ্জিত অবস্থায় প্রেমজগৎ শুধু প্রেমে ভরপুর থাকে। প্রাণ আর প্রেমজগৎ শ্রীগুরুতে লীন হয়ে যায়।

আমরা সবাই জানি…. ২৬


আধ্যাত্মিক সাধনার পথে যাত্রা আরম্ভ করার আগে নিজেকে নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। শ্রীগুরুর উপদেশ অতি অবশ্য পালনীয়। উপদেশ যতদিন অন্তরে বদ্ধমূল না হয়-ভক্ত না হয়, ততদিন হাজার বাহ্যিক অনুষ্ঠান সত্ত্বেও কিছুই হবার নয়।
সম্পর্কের ভিত্তি সুদৃঢ় হওয়া প্রয়োজন এবং তা লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে নীতিপরায়ণতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। নিজের প্রশান্তির জন্যও এ সব প্রয়োজন, অন্তরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে অনিন্দ্য না বোধ হলে শান্তি বা চিত্ত উপভোগ করা যায় না। আধ্যত্মিক নীতিসমূহের সঙ্গে স্বীয় জীবনচর্যার অনৈক্য থাকলে, হাজার মেরুদ- সরল করে বসা ও ধ্যানের চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার আনন্দদায়ক ফল লাভ হবে না। বসাও একটা অভ্যাস। এমনভাবে বসা শিক্ষা করা প্রয়োজন, যাতে দেহবোধ যথাসম্ভব কম হয়; এরূপে চিন্তা শরীরের ভারে অবনত হবে না এবং ক্রমশই অতি সহজেই তা শান্ত হয়ে আসবে। শরীর নিজ বশে না থাকলে চিন্তাজগৎ এবং প্রেমজগৎ যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব নয়: একাগ্রতা লাভই হয় না, সংযোগ-সম্পর্ক তো দূরের কথা। চিন্তার ভারসাম্য বজায় না থাকলে, ক্ষণকালের জন্যও স্থিরভাবে সংযোগ সম্ভব নয়। চিন্তাজগৎ ও শরীরের দৃঢ়তা লাভ করতে হবে। দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর আধিপত্য না থাকলে আধ্যাত্মিক চেতনা লাভ করা যায় না।
শরীরকে স্থির করতে শক্তি প্রয়োগের আবশ্যক হয়। সঙ্কল্প করতে হয়, নির্দিষ্ট ক্ষণে শরীরকে একটি নির্দিষ্ট মুদ্রায় স্থির ও দৃঢ় অবস্থায় ধরে রাখার। দিনের পর দিন এরূপ অভ্যাস করলে, আলস্য ও শারীরিক অস্থিরতা ক্রমশই কাটায়ে উঠতে পারা যায়।
জানা মিশ্রিত-স্বরূপ, সমুদয় বিষয়ানুভূতি পর্যবেক্ষণ ও  বিশ্লে­ষণ থেকেই এসে থাকে। শাস্ত্র বা বই পড়ে দার্শনিক জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হয় না, বরং যত বই পড়া যাবে, ততই সব গুলিয়ে যাবে, পরমুখাপেক্ষী হবে। চেতনার অবস্থান ও স্তর সমূহের বিশ্লে­ষণ করে দেখা যায় যে, ইচ্ছা একটা মিশ্রবস্তু, আর যেহেতু প্রত্যেক মিশ্রবস্তু কোন-না-কোন বাহ্য শক্তিবলে বিধৃত থাকে, সেহেতু ইচ্ছার বহিঃস্থ শক্তিসমূহের সংযোগে বিধৃত রয়েছে। এমনকী, যতক্ষণ না মানুষের ক্ষুধা পাচ্ছে, ততক্ষণ সে খাবার ইচ্ছা করতেও পারে না। ইচ্ছা বাসনার অধীন। আমরা সকলেই বিভিন্ন জগৎ দেখছি ও তার অস্তিত্ব অনুভব করছি। ‘ইচ্ছা’-বদ্ধভাবাপন্ন হবার আগে যেরূপ ছিল, তাই মুক্ত স্ব-ভাব। স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা – প্রতিমুহূর্তে দেখাচ্ছে যে, মানুষ বন্ধন কাটাবার চেষ্টা করছে। একমাত্র মুক্ত স্ব-ভাব – তা অনন্ত, অসীম, দেশ-কাল নিমিত্তের বাইরে। মানুষের ভিতর যে স্বাধীনতা রয়েছে, সেটা একটা পূর্বস্মৃতিমাত্র – স্বাধীনতা মুক্তিলাভের চেষ্টামাত্র। দেহজগতে সব শক্তিই ঘুরে ঘুরে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করছে – তার উৎপত্তিস্থানে যাবার, তার একমাত্র যথার্থ উৎস নিজ-এর কাছে যাবার চেষ্টা করছে। মানুষ যে সুখের অন্বেষণ করছে, সেটা আর কিছু নয় – সে যে সাম্যভাব হারিয়েছে, সেটা ফিরে পাবার চেষ্টা। নীতিপালন, এও বদ্ধভাবাপন্ন ইচ্ছার মুক্ত হবার চেষ্টা, আর এ থেকেই প্রমাণিত, পূর্ণাবস্থা থেকে নেমে আসার।
ক্রিয়া হতে থাক্, কিন্তু প্রতিক্রিয়া যেন না আসে, ক্রিয়া থেকে সুখই হয়ে থাকে, সমুদয় দুঃখ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার ফল। প্রতিক্রিয়াটা বন্ধ করতে পারলে ভয়ের কারণ কিছু নেই। চিন্তা জগৎকে শ্রীগুরু স্মরণে নিজের বশে নিয়ে আসা, যাতে প্রতিক্রিয়াটা মাথাচাড়া না দিতে পারে। জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত সেইগুলো, যখন নিজেকে একেবারে ভুলে থাকা যায়। স্বাধীন-ভাবে নিমগ্ন হয়ে কাজ করা, কর্তব্যের ভার থেকে কাজ করা নয়। দেহজগৎ একটা খেলার মাঠ-এখানে শুধু খেলা আর খেলা। জীবনের রহস্য হচ্ছে নির্ভীক হয়ে খেলা। কি হবে-এ ভয় কখনও করা নয়, কারও উপর নির্ভর করা নয়। যে  মুহূর্তে বাহ্যিক সাহায্য প্রত্যাখ্যান, সেই মুহূর্তেই মুক্তি।
যশের জন্য, বংশমর্যাদার জন্য, ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য কিংবা কারো অনুরোধ-উপরোধে দান করা সঠিক নয়। এরূপ দানে নিজের অকল্যাণ হয়। যথার্থ ভক্তি সহকারে যখন একটা পয়সাও দেয়া যায়, তা শতগুণ হয়ে ওঠে। এ-দানই ধর্মের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট। দারিদ্র্য ব্যক্তির সৃষ্ট। একমাত্র শ্রীগুরুর আশীর্বাদ-কৃপাপ্রসাদ পেলে দারিদ্র্য নাশ হয়। শ্রীগুরু নাম স্মরণের শক্তিতে সমস্যা খুব দ্রুত কাটে। তিনি সদানন্দময়, কাউকে নিরানন্দে রাখেন না। নিজের মধ্যে সর্বশক্তিগুলোকে জাগ্রত করা দরকার। নিয়ন্ত্রিত-নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, তারপর সেবা। প্রয়োজন অকারণে দিনে দিনে বাড়ানো নয়। বাড়লে সে বোঝার ভারে ক্লান্তি আসে, বিপন্ন হতে হয়। আহার, আমোদ, আহ্লাদ, কিছুই কেউ ভুলে না, শুধু ভুলে থাকে শ্রীগুরুকে। যেখানে ধর্ম সেখানে জয় – ধার্মিককে শ্রীগুরু নিজে রক্ষা করেন।
ভক্তির সাথে শ্রীগুরুকে ডাকলে, তিনি সব ব্যবস্থায় সাড়া দেন। তিনিই প্রকৃত বন্ধু। শিক্ষা পরিবারেই শুরু হয়। পরিবারের কারো সমর্থন না থাকলে ছেলে মেয়েরা বিলাসী, উদ্ধত হতে পারে না। আর এজন্য ঘরে ঘরে দুঃখ, দৈন্য, রোদন, হাহাকার। ভোগ বিলাস নিয়েই ব্যস্ততায় কি কেউ যথার্থ শান্তি, সুখ পেয়েছে? অন্তরের দয়া, প্রেম, ভালোবাসা, প্রীতি -এসব বৃদ্ধি পেয়েছে? শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নত অবস্থা লাভ করেছে? অধিকাংশই অন্তঃসারশূন্য। নিজের মাঝে সত্য প্রতিষ্ঠা ও শ্রীগুরু নামই মানুষের পরম আশ্রয়।
ভক্তের কাছে শ্রীগুরুই সর্বশক্তিমান। তিনি কৃপা করেন, কিন্তু সান্নিধ্য-প্রাপ্তরা মর্যাদা দেন না। শ্রীগুরু  সর্বকালের বন্ধু। শ্রীগুরু নিত্য যুক্ত না থাকলে ভক্তের শান্তি বা আনন্দ নেই। শ্রীগুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারলে আর কিছুই দরকার হয় না। যার মান অপমান কলংক বোধ নেই – তিনিই প্রকৃত শ্রীগুরুতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। শ্রীগুরুর উপদেশ মোতাবেক সদাচার না মানলে নিজধর্ম রক্ষা হয় না। সদাচার পালন না করাতে নাম নিয়েও বিশেষ ফল পাওয়া যায় না। তাই ধর্ম বিরল। কেবল আচার অনুষ্ঠান করলে কি হবে, অন্তরে সত্য ও অহিংসা প্রতিষ্ঠিত না হলে, ধর্মলাভ হয়নি বুঝতে হবে। লোকের কোলাহলে থাকলেও উপলব্ধি করতে হবে ধর্মের চূড়ো কতো উত্তুঙ্গ। ধর্ম মুখের কথা নয়, জীবনের পরম সত্য-পরম চেতনা।

আমরা সবাই জানি.... - ২৫


মানুষ সংসার নিয়েই মত্ত। তারা ভাবেন যে, সংসারে বেশ সুখে ও নির্ভয়ে আছে। এটা বুঝতে পারেন না যে, লক্ষ্যহীন সাগরে ডুবে রয়েছে। মানুষ যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন, তখনও এমনি মায়া যে, প্রদীপে বেশী সল্তে জ্বললে বলেন, ‘তেল পুড়ে যাবে, সল্তে কমিয়ে দাও।’ আবার তার পরিবার বলে, ‘তুমি তো চল্লে, আমার কি করে গেলে?’ মানুষ সর্ব্বদা বিষয়েই আসক্ত, ভুলেও কখনও স্রষ্টার চিন্তা করেন না। তারা অবসর পেলে, আবোল-তাবোল গল্প করেন, না হয় বৃথা কাজ করেন। সময় কাটে না দেখে পরচর্চা করেন, তবু স্রষ্টার চিন্তা করেন না। উট কাঁটা ঘাস খেতে ভালবাসে। যত খায়, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে, তবুও ছাড়ে না। মানুষও তেমনি, তাদের কিছুতেই হুঁস হয় না। এত শোক, তাপ, দুঃখ দাগা পায়, এত বিপদে পড়ে, তবুও চৈতন্য নাই যেমন তেমনি যারা জন্মাচ্ছে বা জন্মেছে, তাদেরই ভাল খাওয়াতে-পরাতে, কিংবা ভাল জায়গায় রাখতে পারেন না, তবুও নিবৃত্তি নাই, জন্ম দিচ্ছেন। মোকর্দ্দমা করে সর্ব্বস্ব যাচ্ছে, তবুও মোকর্দ্দমা করছেন। সংসারী লোকদের সংসার থেকে সরিয়ে এনে ভাল জায়গায় (সাধুসঙ্গে) রাখা যায়, তাহলে হেদিয়ে হেদিয়ে মরে যাবেন। বিষ্ঠার পোকার বিষ্ঠাতেই আনন্দ, তাতেই বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়, যদি তাকে এনে ভাতের হাঁড়িতে রাখা যায়, সে মরে যাবে। গোবরের পোকা গোববের ভিতর থাকতে ভালবাসে, তাকে এনে পদ্মের ভিতর বসিয়ে দিলে ছট্ফট্ করে মারা যাবে। বিষয়ীও সেইরূপ বিষয়ের কথায় আনন্দ পায়; ধর্মকথায়, ত্যাগের কথায় মারা যাবার মতো বোধ করেন। মানুষকে হাজার শিক্ষা দিলেও, কিছুই করতে পারেন না। পাথরের উপর পেরেক মারতে গেলে, ভেঙ্গে যাবে, পাথরের কিছুই হবে না। সাধু সঙ্গ করে আসেন, কিন্তু যেমন তেতো তেমনি তেতোই থাকেন। মানুষের সামনে স্রষ্টার-কথা হলে, তিনি সেখান থেকে সরে যান। বলেন এসব মরবার সময় হবে, এখন কেন? মানুষ তীর্থ করতে গেলেও সেখানে গিয়ে স্রষ্টার চিন্তা করেন না, কেবল পরিবারের পুঁটলি বয়ে বেড়ান; আর মসজিদ, গীর্জা, প্যাগোডা, মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করেন ও গড়াগড়ি দেন। এতেই ব্যস্ত থাকেন। মানুষ নিজের ও পরিবার-স্বজনের পেটের জন্য দাসত্ব করেন। যারা স্রষ্টার চিন্তা করেন, ধ্যান করেন, মানুষ তাদের পাগল ব’লে উড়িয়ে দেন। সংসারী লোকগুলোর কোন লক্ষ্য নেই। তারা তিনটা জিনিসের দাস। টাকার দাস, অভ্যাসের দাস, আর যশের দাস। মানুষ স্রষ্টার নাম নিজেও শোনেন না, পরকেও শুনতে দেন না, ধর্ম্মসমাজ ও ধার্ম্মিকদের নিন্দা করেন এবং উপাসনা করলে ঠাট্টা করেন। কুমীরের গায়ে অস্ত্র মারলে ঠিকরে পড়ে, তার গায়ে কিছুমাত্র লাগে না। মানুষের কাছে ধর্ম্মকথা যতই বলা হোক না কেন, কিছুতেই তাদের অন্তরে প্রবেশ করে না।
স্প্রীংয়ের গদির উপর বসলেই নুয়ে যায়, উঠলেই আবার যেমন তেমনি। সংসারী লোকেরা যখন ধর্ম্মকথা শোনেন তখন একটু ধর্ম্মভাব হয়, কিন্তু সরে গেলেই সব ভুলে যেমন তেমনি হয়ে পড়েন।
কামারশালের লোহা, যতক্ষণ হাপড়ে থাকে ততক্ষণ লাল দেখায়; যেমনি বার করা হয়, অমনি কাল হয়ে যায়। সংসারী মানুষগুলোও তেমনি। ধার্ম্মিকের কাছে থাকলে একটু ধর্ম্মভাব দেখা যায়, কিন্তু সরে এলেই, সে ভাব আর থাকে না। গরম লোহায় জলের ছিটে যেমন শুকিয়ে যায়, মানুষের কাছে ধর্ম্মকথাও সেইমত উবে যায়। এক কান দিয়ে শোনেন, আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। পায়রার ছানার গলায় হাত দিলে যেমন মটর দানা গজ্গজ্ করে, সেরকম মানুষের সঙ্গে কথা কইলে টের পাওয়া যায় তাদের ভিতর বিষয় বাসনা গজ গজ করছে। বিষয়-কথাই তাদের ভাল লাগে, ধর্ম্ম-কথা ভাল লাগে না। বড় বড় দোকানে চাল-ডালের বড় বড় ঠেক থাকে; পাছে সেগুলো ইন্দুরে খায়, তাই দোকানদার কুলোয় করে মুড়কী রেখে দেন। সোঁদা সোঁদা গন্ধ আর মিষ্টিও লাগে; তাই যত ইন্দুর সেই কুলোতে গিয়ে পড়ে, ঠেকের সন্ধানও পায় না। মানুষ সংসারে কামনার-মায়াজালে মুগ্ধ হয়ে যান, স্রষ্টার খবর পর্যন্তও পান না। সংসারের কোন্দল শুনে, বাগানে বেড়াতে বেড়াতে একটা ফুল হাতে করে তুলে সঙ্গীকে বলেন ‘স্রষ্টা কি সুন্দর ফুল করেছেন!’ বিষয়ীরও ধর্মভাব ঠিক এরূপ ক্ষণিক।
যখন অন্তরে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কর্মের ফললাভ আপনা আপনিই হয়। সাধনার পথের যাত্রীগণও বাকসিদ্ধ হন। তারা যা বলেন তাই হয়। কোন বস্তুকে যেমন দেখা হয়, তাকে কথার দ্বারা তেমনভাবেই প্রকাশ করা হলো সত্যাচার। যেমন অনুভূতি তেমন প্রকাশ। যেমন শিশু বস্তুকে যে রকম দেখে, সেই রকমই প্রকাশ করে। এইরকম শিশুভাবের দ্বারাই অন্তরে সত্যপ্রতিষ্ঠা হয়। কুটিলতার জন্ম সংকীর্ণতা হতে হয়। তাইতো মানুষ অসত্যবাদী হয়ে যায়। অসত্য কথন ভয় বা কোন উদ্দেশ্যপূর্তির জন্য করা হয়। এই কথন অহিংসার অনুগত হওয়া দরকার। কখনও কখনও হিংসা আর সত্যের মধ্যে সমঝোতা করবার প্রয়োজন হয়। সেই সময় প্রকাশ না করা, মৌনাবলম্বন করা শ্রেয়। যখন প্রকাশ করা হবে, তখন তাকে সত্যভাবেই প্রকাশ করা উচিত। নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংগ্রহ না করা এই ভাবের প্রতিষ্ঠা করা। লোভবৃত্তি নির্মূল হলে এই ভাব প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হবে।
জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম আবশ্যক বস্তুর গ্রহণ করা আর বাকির পরিত্যাগ করা। কোনও বস্তুকে গ্রহণ করবার পূর্বে তাকে বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত যে সেটা অত্যাবশ্যক কি না। গ্রহণ বাইরের বস্তুর সাথে যুক্ত, অপরিগ্রহ ভিতরের ভাবের সাথে যুক্ত। অপরিগ্রহের ভাবনা হলে একপ্রকার নিজেকে সর্বদা মৃত্যুর সম্মুখীন রাখা। সব কিছু বিনষ্ট হয়ে গেলে অন্তরে বিকারের উৎপত্তি হওয়া উচিত নয়। সত্যবক্তা হন বাকসিদ্ধ। তিনি যাই বলেন, তাই ফলে। যখন চিত্তে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা বীতরাগ হয়ে যায়। সেই চিত্তে কোন প্রকারের উদ্দেশ্যপূর্তির আকাক্সক্ষা থাকে না। এই চিত্ত আকাশকল্প। তাতে যে ভাবের জাগরণ হয়, তা ফলীভূত হবেই।

আমরা সবাই জানি.... ২৪


বর্তমানের সমাজ ধর্মের দিক হতে একেবারে না অথবা নকলবাগীশ, নিজের আচারের দিক হতে ভোগবাদী কিন্তু নিজের বিচারের দিক থেকে ঘোর সংস্কারচ্ছন্ন। সমাজে প্রায় ষাট ভাগ মানুষ তাগা-তাবিজ, মাদুলি, ঝাড়ফুঁক, মন্ত্র-পড়া, তেল-পড়া, পানি-পড়া, নুন-পড়া ইত্যাদি নানা সংস্কারে আবদ্ধ। আধুনিক শিক্ষাতে শিক্ষিত হয়ে যারা নানান ভাবে গর্ববোধ করেন, তারাও কিন্তু নানা রকম সংস্কারের শিকড় তাদের মধ্যে গেড়ে রেখেছেন। সুতরাং শিক্ষিত সমাজও সংস্কার হতে মুক্ত নয়। এরা নিজেদের অজান্তে বা খেয়ালের আবেগে, ভয়ের তাড়নায় ও লোভের বশবর্তী হয়ে অনেক সংস্কার স্বীকার করছে এবং তা আচরণেও কার্যকর করবার প্রয়াস করছে। কী বিভ্রান্তি! কী মেকী শিক্ষার গর্ববোধ! ব্যক্তি পর্যায়ে যতদিন না অধ্যাত্ম চেতনার উন্মেষ হচ্ছে, ততদিন সমাজ সংস্কার ও ভ্রান্তি হতে মুক্ত হবে না। তাই যথার্থ নিজেকে নিজে বিচার করা এবং বিবেকী হওয়া।
ধর্ম বলতে যা বুঝায়, তা হলো যা ব্যক্তি নিজে সমস্তকে ধারণ করে বা ধরে রাখে এবং যাকে অবলম্বন করে সমষ্টিগতভাবে বাঁচে। কারণ জীবনের কলা হলো বাঁচার তাগিদ ও পূর্ণতা লাভের প্রবণতা বা প্রচেষ্টা। ধর্মকে আশ্রয় করেই সমষ্টিগতভাবে বাঁচা যায় এবং পূর্ণতা লাভের পথ প্রশস্ত হয়। নতুবা বাঁচার উদ্দেশ্যই বৃথা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তি বাঁচতে চায় এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় আহার, আচ্ছাদন ও আশ্রয়। জীবন ধারণ করতে গেলে এগুলোর একান্ত প্রয়োজন এবং সুন্দরভাবে বাঁচতে গেলে আরও তিনটি জিনিসের প্রয়োজন হয়, যথা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষা। কিন্তু এই জীবন ধারণ কিসের জন্য বা এর উদ্দেশ্য কি? নিশ্চয় জীবন ধারণের উদ্দেশ্য আছে এবং এর প্রয়োজনও আছে। কি সেই উদ্দেশ্য এবং কি সেই প্রয়োজন? উদ্দেশ্য হলো পরমসত্য বা আত্মতত্ত্বের উপলব্ধি আর এর জন্যই জীবন ধারণের প্রয়োজন। আত্মোপলব্ধি ও আনন্দলাভই হলো জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। যখন জীবনধারা সমষ্টির অনুকূল হয়ে প্রভাবিত হয় তখনই ধার্মিকতা, কারণ জীবন সহজ সৃজনাত্মক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। জীবনধারা যখন সমষ্টির প্রতিকূল হয়ে চালিত হয় তখন তা অধার্মিকতা বা অসহজতা। কারণ তা অধর্ম বা অসহজ ধ্বংসাত্মক পথে অগ্রসর হচ্ছে। সুতরাং সমষ্টির অনুকূল হয়ে বাঁচা এবং বাঁচার লক্ষ্যে বা জীবন-ধারণের উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়া। ধর্মের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল মহান। কিন্তু অধিকাংশ ধর্মজীবীরা বা ধর্মের তথাকথিত শিক্ষকরা ধর্মের নাম নিয়ে কি করছেন! সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা বা ভ্রান্তিকে আশ্রয় করে তারা করছেন ষড়যন্ত্র এবং ধর্মীয় অনুশাসনের নামে ধর্মীয় শোষণ। বিবেক বৃত্তি জাগ্রত হলে তাদের ষড়যন্ত্র ধরে ফেলে, তাই তারা প্রচার করছেন ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’ কারণ বিশ্বাস কি তারা তা জানেন না এবং যুক্তি বা তর্কে তাদের চালাকি ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে, এজন্য কৌশলে তারা সাধারণ মানুষের চিন্তা জগৎকে পঙ্গু করতে লেগেছেন। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস আনার জন্য আধ্যাত্মিকতার নাম নিয়ে তারা নানা কুসংস্কার ও বিচার বিহীন আচার তৈরী করছেন এবং নানা ভেলকিও ধারণ করছেন। ব্যক্তি যখন বিপদগ্রস্ত হয় এবং অসহায় বোধ করে তখনই সে ওই ব্যক্তিগণের ফাঁদে পা দেন আর শোষণ ও অপকর্মের শিকারে পরিণত হন। আবার অত্যধিক লোভাতুর তথাকথিত শিক্ষিত অসহজরা তাদের খপ্পরে পড়ে নাজেহাল ও নাস্তানাবুদ হন। যতক্ষণ অসহজ অবস্থা থাকে ততক্ষণ ওদের খপ্পরে পড়ে থাকেন, কিন্তু সহজ বা অধ্যাত্মচেতনা সম্পন্নরা ওদের ফাঁদে পড়েন না। আর পড়লেও তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। সহজ হতে হবে, অধ্যাত্মচেতনার বোধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, তবেই সমস্ত ভেল্কি বা অজ্ঞান কুসংস্কার দূর হবে, নতুবা ওগুলো দূর হওয়া বড়ই দুরূহ। অধ্যাত্ম চেতনার বোধ বিহীন সাধারণ মানুষ আজও প্রতারিত হচ্ছে স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্রে। আধাত্মিক অজ্ঞতার শিকারগ্রস্ত সাধারণ মানুষ কামনা সফলতার ভুয়ো আশ্বাসে অবাধে শোষিত ও ভ্রষ্টাচারে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অধ্যাত্মচেতনার উন্মেষ ব্যতিরেকে এই কুচক্রের ব্যুহ ভেদ করা সম্ভব নয়। 
জীবন কেহ একইভাবে চালাতে পারে না। জীবন স্তরে স্তরে সজ্জিত। সুতরাং কোন স্তরে কোন কর্ম করবে এরূপ অবস্থায় কর্তব্য সকল সময় লক্ষ্য ঠিক রাখা এবং শান্তভাবে জীবন চলার পথে পথ চলা। শ্রীগুরুর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে তাঁর নাম স্মরণে জীবন কাটানো। চঞ্চলতার বশবর্ত্তী হয়ে নিত্যনূতন পদ্ধতির কল্পনা করা নিতান্ত ভ্রমাত্মক। যেরূপ অবস্থাই আসুক না কেন, তাতে জীবনের লক্ষ্য ও চলার পথ ঠিক রাখতেই হবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিবর্ত্তন করলে কোনও দিনই কেহ লক্ষ্যস্থানে পৌঁছতে পারেন না। দেহসংযম, বাক্সংযম ও চিত্তসংযম, এই তিন সংযমেই আছে ধর্ম। কোনও কারণে দেহ, চিন্তা ও চিত্তে চঞ্চলতা জন্মাতে না দেয়া। সত্য যার জীবনের লক্ষ্য, ভ্রমেও যেন তাকে অন্য পথ ব্যবহার করতে না হয়। সংসারে কর্ত্তব্য গুরুতর। বিপদে-সম্পদে অবিচলিত থেকে ধীর ও স্থিরভাবে কর্ত্তব্যপালন করতে হয়। উত্তেজিত বা অবসন্ন হলে চলে না। অনিত্য উপাদানে যে বাসা ব্যক্তি বেঁধেছে, প্রতিমুহূর্ত্তে তা ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনায় ভরপূর। 
স্বভাবমৃত্যু না হওয়া পর্য্যন্ত সুখ-দুঃখ রোগ-শোক সহ্য করে যাওয়াই ব্যক্তির কর্ত্তব্য। এখানের বোঝা এখানেই ফেলে যেতে হবে। প্রকৃতির বিধান লঙ্ঘন করে কেউ কোন দিন সুখী হন না।
জীবনভোর চিত্তবৃত্তির সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কর্মানুসারে সঞ্চিত গুণে আত্মসমর্পণ করলে চলে না। সত্য দ্বারা অসত্যকে, ক্ষমা দ্বারা ক্রোধকে, প্রেম দ্বারা হিংসাকে জয় করতে হবে। সাধকের ধৈর্য্য, তিতিক্ষা, পরমতসহিষ্ণুতা, সমদর্শিতা অঙ্গের ভূষণ। সম্পদ বিপদ উভয় কালেই সুখ বা দুঃখে বিচলিত না হয়ে বীরের ন্যায় কর্মফল অতিক্রম করে লক্ষ্যপথে অগ্রসর হওয়াই সাধনা। 
ফলাফল না দেখে কর্ত্তব্যগুলো যথাযথ করাই আদর্শ। জন্ম-মৃত্যু যা সাধ্যায়ত্ত নয় তার জন্য অধীর হওয়া মায়া জ্ঞান অর্জনের পথে সহায়ক নয়। মর্ম্মান্তিক দুঃখের কারণ হলেও মঙ্গলময় শ্রীগুরুর দান মাথা পেতে গ্রহণ করতে হয়। কর্ম-জগতে থেকে কর্ত্তব্যে অবহেলা অপরাধ। কর্ত্তব্যে যার অবহেলা, তার দ্বারা জগতে কোন কর্ত্তব্য সাধিত হয় না। শ্রীগুরুর কৃপায় জ্ঞান হলে সুখ-দুঃখ, রোগ-শোক, বিপদ-সম্পদ সকল অবস্থাতেই শান্তি পাওয়া যায়। অজ্ঞান অশান্তি উদ্বেগ আনে। শত দুঃখ মাথায় নিয়ে ত্যাগী আনন্দময়। এখানের কর্মগুলোর বোঝা এখানেই নামিয়ে রেখে না যেতে পারলে শান্তি নেই। রোগ-শোক, বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট দেখে ভয় পেলে হবে না। সবই শ্রীগুরুর মঙ্গল হস্তের দান বলে গ্রহণ করতে হয়। ফলাফল শ্রীগুরু নির্ভর করে অকপটে চেষ্টা, যত্ন এবং নিমগ্নতাই কর্ত্তব্য। 
শ্রীগুরু প্রাপ্তির একমাত্র উপায় ব্যাকুলতা। তাঁর জন্য পাগল না হলে বেঁচে মরা না হলে কেহ তাঁকে পরিপূর্ন পান না। প্রেম জগতেই প্রেমময়কে লাভ করতে হয়। ব্যাকুলতাই সে পথের পাথেয়।

আমরা সবাই জানি.... ২৩


অবিশ্বাস সন্দেহ মানুষের চিত্তলোককে আচ্ছন্ন করার চেষ্টা করে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বে অন্তর হয়, ছিন্নভিন্ন, অবিচলিত থাকে সংকল্প ও সাধনা, অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একদিন আসে জীবনের পরম লগ্নজয়ের গৌরব, যা শ্রীগুরুর চরম দান। দিন যায় দিন আসে। সবাই ছুটছে স্বর্ণ-মরীচিকার পিছনে। কিন্তু চিন্তা করতে হবে জীবিকার অন্বেষণের চেয়ে জীবনের অন্বেষণ অনেক মহত্তর। সুখ ও সম্পদ জীবন ধারণের সামান্য উপকরণ। অতি সংকীর্ণ তার পরিধি, ক্ষণভঙ্গুর তার দান। আর জীবনের লক্ষ্য অন্বেষণ মানুষকে দেয় শাশ্বত পরমসত্যের সন্ধান, মৃত্যুতোরণ উত্তরণের উত্তরাধিকার সকল ক্ষয়ক্ষতির ঊর্ধ্বে এক দুর্লভ অমর জীবন। দেহ একদিন যাবে মাটির ভিতরে। একে কেন্দ্র করে স্বপ্ন-নীড় রচনা করা ভোগ-সহায়ক। এই দেহের মধ্যে আমি-র অস্তিত্ব কোথায়! আত্মাতেই আমি-র অস্তিত্ব, সেই অব্যক্ত আত্মাকে করে ব্যক্ত, অনুভব করে সেই সাধনায় নিয়ন্ত্রিত হোক আমি-র গতি ও প্রকৃতি। অকপট, অক্লান্ত যার সাধনা সেই হতে পারে দিব্যজীবনের অধিকারী। প্রকৃতির সকল ঐশ্বর্য প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে; কিন্তু তারা আত্মবিস্মৃত তাই এত দুঃখ, এত নৈরাশ্য। মোহ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে অন্ধকারের কঠিন অবরোধে, তাই রুদ্ধ গতি-শক্তির মুক্তধারা। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে মহাশক্তি ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগিয়ে তোলাইতো সাধনা। অসামান্য হয়ে উঠে জীবন। প্রয়োজন অশেষ দুঃখ বরণ, অসীম ত্যাগ ও অনন্ত ধৈর্যধারণ। অতীতের পানে ফিরে তাকানো, সামনে সত্যের আলোড়ন, নন্দনের আনন্দ সংবাদ। এই আমি-র আমিত্বগুলোকে শুধু নিয়ন্ত্রণ বা ভুলে যাওয়া, শুধু নিজকে সত্যের মাঝে বিলিয়ে দেয়া শ্রীগুরুর কৃপায়। 
সেবায় ধন্য ও পুণ্য হয় জীবন। রৌদ্রতাপে পুড়ে, বর্ষধারায় ভিজে, কঠোর পরিশ্রম করে চেতনার মাটিতে সোনার ফসল ফলানো, কোন দুঃখবরণ না করে, সে কি হয়? মহৎ কিছু পেতে হলে মূল্য দিতেই হবে, সইতে হবে অনেক দুঃখের তাপ, প্রতীক্ষার প্রহর কেটে যাবে, এরপর শুধু হাসি আর হাসি, আসবে উজ্জ্বল ফসলের কাল-পাবে অমূল্য রতন। শ্রীগুরুর উপদেশের ভিতর দিয়েই পাওয়া যায় দুর্লভের সন্ধান, লালন আর পালনের মাধ্যমে আবাদ করতে হয় সোনার ফসল-একাত্মতা। যে যতো দুঃখ সইতে পারে, সে ততো আনন্দ পাবার অধিকারী। এতো দুঃখ, এতো কান্না, যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে কেন পেতে হয় পরম জীবনকে? এ না হলে পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ ও গৌরব থাকে না; এ ছাড়া সুলভ যা মানুষ সহজে তাকে হারায়। মানুষ তাকে ধরে রাখে না। সেজন্য মূল্য জানিয়ে শ্রীগুরু তার দুর্লভ ধন ভক্তের হাতে তুলে দেন। যারা সুখে থাকে তারা পায় কি? ওরা খাঁচার পাখির মতো। ওদের গায়ে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের ঝাপটা লাগে না, কিন্তু ওরা কি অন্তহীন আকাশের নীলিমাকে এমন অবাধ করে পায়? এতো আলো, আলোর অমৃত, অক্লান্ত বনের সবুজ ডেকে ডেকে রাত্রিশেষে বনে ফোটায় আলোর ফুল! 
দুঃখ জীবনকে মহৎ কিছু দেয়, তবে সে দুঃখ বরণ করতে ভয় কেন? একটা লক্ষ্যভিত্তিক নিয়মের অধীন হয়ে না চললে জীবন গঠন হয় না। যেদিন ভাল লাগল, সেদিন তাঁকে অর্থাৎ শ্রীগুরুকে স্মরণ করবো আর যেদিন ভালো লাগল না, সেদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবো, অলস সুখে ঝরে পড়বে মুহূর্তের অফোটা কুঁড়ি, বৃথা জল্পনায় কাটবে দিন এ সমীচীন নয় মোটেই। সামান্য সাড়ে তিনহাত শরীর, তার পুষ্টি ও পরিণতির জন্য কত খাবার, কত যত্ন ও সেবার প্রয়োজন হয়, আর যে অসীম, যার গতির শেষ নেই, অশেষ যার রহস্য, প্রচন্ড শক্তি তার পরিচয় পাবে, পূর্ণায়ত একটি পদ্মের মতো ঘটবে তার সুচারু প্রকাশ। এজন্য চাই তীব্র ত্যাগ এবং দীর্ঘ একরৈখিক সাধনা। বহু সংস্কার নিয়ে গঠিত যে জীবন একদিনে তার দিব্য রূপান্তর অসম্ভব। অস্থির জীবন, মৃত্যু যার অনিবার্য পরিণতি, অকারণে তাকে নষ্ট না করে, কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে কোনো মহৎ আদর্শের বেদীতলে তা নিঃশেষে নিবেদন করাইতো বুদ্ধিমানের কাজ। এখানে জয় ও পরাজয় দুই-ই গৌরবময়। বিফলতার মধ্যেও থাকে সার্থকতা। একাত্মতা-সিদ্ধির চূড়ায় পৌঁছান না গেলেও অগ্রগতির পথে বহু সোপান অতিক্রম করা হয়। ধৈর্যই আমি-ধর্মের উপলব্ধি। তিল তিল করে আহরণ করতে হয় অমর জীবন। কোনো দুঃখে, কোনো লোভে, কোনো বেদনায় যে বিচলিত হয় না সে-ই পায় উত্তরাধিকার। পথিক হলেই দুঃখ, কণ্টকিত হবে পথ। এরই ভিতর দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। ভয় নয়, সঙ্গে রয়েছে তাঁর অর্থাৎ একাত্মতায় শ্রীগুরুশক্তি জীবন বিকাশের বহ্নিমন্ত্র।
জীবনকে যা ধারণ করে থাকে সেখানেই আছে ধর্ম। চিন্তাজগতের সর্বাত্মক প্রকর্ষ ধর্মেরই নামান্তর। ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত রয়েছে চিন্তাজগতে। জীবনের গভীরে বিদ্যমান এর অস্তিত্ব। গুরুর যাত্রাপথই প্রকৃত ধর্মপথ যা অনুস্মরণীয়। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক বাংলার এক অনন্য ধর্মাচার্য সত্যমানুষ শ্রীগুরু। সত্যান্দোলনের তিনি প্রবর্তক। ধর্মীয় ও সামাজিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের তিনি যুগনায়ক। ইতিহাস তাঁকে সৃষ্টি করেনি, ইতিহাসের তিনি গ্রষ্টা। তাঁর প্রেম-সত্য-শান্তি ধর্ম থেকে বাঙালি পেয়েছে কর্ম-মানবতা-শান্তির পথে আত্মিক, আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতির দিক্-নির্দেশনা। তিনি চেয়েছেন চেতনার জগতে আত্মউপলব্ধিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক প্রতিটি মানুষ। বাঙালির মধ্যে তিনি এনে দিয়েছেন পূর্ণাঙ্গ সত্যমানুষের প্রত্যয়, তাঁর বাণীগুলো পথ দেখায় কিভাবে পাখির মতো খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসে বাঙালি মাটির থেকে অনেক দূরে অসীম দিগন্তে উড়তে শিখতে পারে। মানবিকতার বেদীমূলে প্রতিষ্ঠিত তাঁর ধর্ম মূলতঃ সত্যের সাথে একাত্মতা।

আমরা সবাই জানি.... ২২



জগতে বস্তুর সঙ্গে ভয় মিশ্রিত থাকে। যার প্রচুর টাকা আছে, যার ভাল ব্যবসা আছে, তার ব্যবসায়ের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে; সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। সব বস্তুতেই ভয় মিশ্রিত হয়ে রয়েছে।
এই জগতে এমন কোন বস্তু নেই যাতে ভয় নেই। কেবল একটা জিনিস আছে যাতে ভয় নেই বৈরাগ্য ভয় নেই। বৈরাগ্যটা কী? বি-রন্জ ধাতুর উত্তর ঘঞ্ প্রত্যয় করে ‘বিরাগ’ শব্দ উৎপন্ন। ‘বিরাগ’ মানে কোন বস্তুর রঙেতে নিজেকে রাঙাতে দেব না। জগতে যা কিছু বস্তু রয়েছে, মানুষ জেনেশুনে বা না জেনে সেই বস্তুটার রঙেতে আকৃষ্ট হয়। যেমন মানুষের চোখ সবুজ রঙ, চকোলেট রঙ এগুলোতে চোখ ভাল থাকে, ঠান্ডা থাকে। সব জিনিসেই রঙের প্রভাব আছে। যখন মানুষ নিজেকে এমন মজবুত করে নেয় যে অন্য বস্তুর রঙের দ্বারা সে আর প্রভাবিত হচ্ছে না, তখন সেই অবস্থাটাকে বলা হয় বৈরাগ্য। বৈরাগ্য মানে সব কিছু ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যাওয়া নয়। বৈরাগ্য মানে পলায়নী মনোবৃত্তি নয়, বৈরাগ্য মানে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া। পাঁকাল মাছ পাঁকে থাকে, তবুও গায়ে পাঁক লাগে না। এই ধরনের জিনিসকে বলা হয় বৈরাগ্য। বৈরাগ্য জিনিসটাতে মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয় কখন? যখন বুঝতে শেখে যে, যে বস্তুর রঙ আমার ওপর এযাবৎ পড়েছে বা পড়তে পারে, চিন্তা জগতের ওপর তার যে প্রভাবই পড়ুক না কেন, সে জিনিসগুলো কোনটাই স্থায়ী নয়। আজ আছে, কাল চলে যাবে। সুতরাং নিজের ওপর যদি তা রঙ লাগিয়ে দিই, সে যখন চলে যাবে তখন বড্ড কষ্ট হবে। সুতরাং আমাতে কোন বস্তুর রঙ না লাগানোই উচিত।
চরম সত্য, শ্রীগুরু-বন্ধু, তাকে নিয়েই থাকতে হবে। কারণ, চিন্তা কোন না কোন বিষয় নিয়েই থাকবে। বিষয়রাহিত্য হয় না। বিষয় বর্জন করে চিন্তা জগৎ থাকতে পারে না। সৎকর্ম যে করে না, অসৎ কর্ম সে করে এই হচ্ছে নিয়ম। সুতরাং বিষয়ের রঙ যাতে লাগছে না, অবিষয়কে নিয়ে তাকে থাকতে হবে। এই অবিষয় হচ্ছে শ্রীগুরু, যিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তিনিই হলেন সৎ। এই সৎ-এর যে বাহ্যিক প্রকাশ তাকেই বলা হয় সত্য। সত্যকে সে আশ্রয় করছে, শ্রীগুরুর কাছে যে আশ্রয় নিয়েছে তার ভয় নেই। 
আনন্দজগৎ যিনি জেনেছেন, তিনি আর কিছু থেকেই ভয় পান না। ভয় পাবার কোন হেতুই নেই কারণ সমস্ত সাহসিকতা, তেজস্বিতা তৈরী হবেই। যার সাহসিকতা ও তেজস্বিতা আছে, তার মধ্যে ভয় থাকবে কী করে? একেবারে নির্ভয় জিনিস হ’ল সত্য। যখন সত্যের সঙ্গে অসত্যের সংগ্রাম শুরু হয়, তখন সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।
জীবন নিত্য অভাব ও অভিযোগ ও প্রয়োজনে পরিপূর্ণ, সুতরাং তার কামনা থাকেই, কেবল দেহে প্রাণে নয়, চিন্তায় এবং আধ্যাত্মিক সত্তাতেও। যখন মানুষ জানে যে জগৎ চলছে কোন উর্দ্ধচেতন শক্তির নিয়ন্ত্রণে, তখন সে ওই উচ্চশক্তির কাছে তার অভাব পূরণের জন্য প্রার্থনা জানায়, যাতে তার জীবনের বন্ধুর পথে ও কঠিন সংগ্রামে সাহায্য ও আশ্রয় লাভ করতে পারে। ধর্মীয় রীতিতে শ্রীগুরুর কাছে যতই কেন স্থূলভাবে প্রার্থনা করা হোক, যতই কেন স্তব-স্তুতির দ্বারা ও নৈবেদ্যাদি উৎসর্গ প্রভৃতি দেয়ার দ্বারা শ্রীগুরুর তুষ্টি সাধনের চেষ্টা করা হোক, যার মধ্যে আধ্যাত্মিক স্পৃহা প্রায় কিছুই থাকে না, তথাপি এ কথা সর্ববাদীসম্মত সত্য যে প্রার্থনার প্রয়োজন আছে আমাদের সত্তার পক্ষে।
প্রার্থনার যে কোন সুফল আছে এতে প্রায়ই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, বলা হয় যে তা অনাবশ্যক এবং নিষ্ফল। এ কথা সত্য যে বিশ্বনিয়ম তার আপন লক্ষ্যের পথে চলছে, কারো ব্যক্তিগত উপরোধে টলছে না, আর এ কথাও সত্য যে তিনি তাঁর সর্বজ্ঞ শক্তিতে দেখতে পান যে কখন কি করা দরকার, তিনি মানুষের চিন্তা ও ব্যক্তিগত কামনার দ্বারা জগৎ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোনরূপে প্রভাবিত হতে পারেন না। তথাপি সেটা যান্ত্রিক নিয়ম নয়, সেটা জীবন্ত শক্তির ক্রিয়া এবং সেখানে মানুষের আস্পৃহা ও শ্রদ্ধা স্থান নিতান্ত অনর্থক নয়। প্রার্থনা মানুষের সেই স্পৃহা ও শ্রদ্ধাকেই একটা আকার দেয়। যদিও তা অনেক সময় নিতান্ত স্থূল হয়ে দাঁড়ায়, তথাপি তার মধ্যে একটা তাৎপর্য থাকে এবং কিছু প্রকৃত শক্তিও থাকে। অর্থাৎ তা মানুষের ইচ্ছা ও স্পৃহা ও শ্রদ্ধাকে শ্রীগুরুর চেতন ইচ্ছার সংস্পর্শে এনে একটা সচেতন ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপন করে।
যদিও সেই সম্বন্ধ অহংবুদ্ধি প্রণোদিত হওয়াতে নিতান্ত নিম্নস্তরের হয়, কিন্তু তারপরে আমরা তার উচ্চতর আধ্যাত্মিক সত্যে গিয়ে পৌঁছাতে পারি। তখন আর কি চাইছি তা নিয়ে কথা নয়, মানুষের জীবনের সঙ্গে শ্রীগুরুর চেতন সংস্পর্শ ও লেনদেন নিয়ে কথা। আধ্যাত্মিকের দিক থেকে এই চেতন সংস্পর্শের শক্তিমূল্য অনেক বেশি। জীবনে আমরা একান্ত আত্মনির্ভর হয়ে যে সংগ্রাম করি, প্রার্থনা তার মধ্যে একটা পূর্ণতর আধ্যাত্মিক অনুভূতি এনে আমাদের শক্তিসমৃদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত সেই প্রার্থনা তার চেয়ে বৃহত্তম সংযোগে গিয়ে বিলীন হয়, অর্থাৎ তার ভিতরকার স্পৃহা ও শ্রদ্ধাবিশ্বাসই আনন্দের স্তরে ভক্তি হয়ে ওঠে। তখন আরো উচ্চ স্তরে গিয়ে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে উপনীত হয়, কোন দাবিদাওয়া ঘুচে গিয়ে তখন তা সহজ ও বিশুদ্ধ শ্রীগুরুর প্রেমে পরিণতি লাভ করে।
মানুষ শ্রীগুরুর কাছে চায় সাহায্য, চায় আশ্রয় এবং নির্দেশ, চায় সাফল্য অথবা চায় জ্ঞান, চায় শিক্ষণ, চায় আলো, কারণ তিনি জ্ঞানসূর্য, অথবা সে চায় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, ব্যক্তিগত ব্যথাবেদনা, অথবা জগৎযন্ত্রণা থেকে মুক্তি, অথবা তার মুক্তি। তার সকল কামনা ও দুঃখের কথা জানায় শ্রীগুরুর কাছে, আর জগন্মাতাও তাই চান, যাতে তিনি তাঁর হৃদয়ের স্নেহ সেখানে ঢেলে দিতে পারেন। শ্রীগুরুর ওই স্নেহ আপনা হতে আছে বলেই জীবন চলার পথের যাত্রীরা তাঁর দিকে ফেরে, কারণ সেখানেই আমাদের আপন গৃহ, জগতের পথে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সেই শ্রীগুরুর হৃদয়ে গিয়েই আমরা বিশ্রাম পেতে পারি। স্পৃহার কি দরকার? কিছু চাইবে কেন? শ্রীগুরুর যা করতে চান তাই তিনি করবেন এবং তাই তিনি করছেন। অবশ্য এ কথা বলাই বাহুল্য, তথাপি এই যে প্রার্থনা এতে তার অভিব্যক্তির মধ্যে একটা স্পন্দন জাগে।
নতুবা শ্রীগুরু তাঁর জগৎটাকে তিনি এমনভাবে গড়তেন না, এই জগতের আস্পৃহার মধ্যে তিনি তার পূর্বাবস্থাতে ফিরে যাবার জন্য এমন এক তীব্র স্পন্দন দিয়ে রেখেছেন যার মধ্যে বিশেষ রকমের শক্তি ও আনন্দ রয়েছে। আর ঠিক সেই কারণেই, সেই জন্যই বিবর্তনের ক্রিয়া চলছে। কিন্তু যদি চিরন্তন সম্পূর্ণ ও চিরন্তন নিখুঁত হ’ত তাহলে এখানে সেই বিবর্তনের অগ্রগতির আনন্দ থাকত না।
আমিত্বের আবরণকে দূর করার জন্য বই-পুস্তকের ধারায় কোনো কৃত্রিম উপায়ের আশ্রয় নিতে বলা হয়নি। প্রকৃতির স্বাভাবিক ধারায় চেতনার আকুঞ্চন-প্রসারণ, গুটিয়ে আনা ও ছড়িয়ে পড়ার দিকে দৃষ্টি রেখেই এই আবরণ মুক্ত করার প্রয়াস। চেতনা যখন ছড়ানো থাকে আমাদের জাগ্রত অবস্থায়, তখন তাকে তার আপন স্বরূপে পাওয়া যায়না, কারণ সে বাইরের জগতের নানা বস্তুর সঙ্গে জড়ানো থাকে তখন। কিন্তু বাইরের জগৎ থেকে যখন সে নিজেকে গুটিয়ে আনে তখন কিছুদূর পর্যন্ত বাইরের জগৎও ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে। এরই নাম স্বপ্নাবস্থা। চেতনাকে তাই এখানেও বিষয়বিহীন নিবারণরূপে পাওয়া যায় না। তারও পরে গভীর নিদ্রাতে স্বপ্নের নানা দৃশ্যও যখন মিলিয়ে যায়, তখন চেতনা বিষয়নির্মুক্ত হয়। এখানেই তাকে সরাসরি সাক্ষাৎভাবে ধরতে পারার সুযোগ। কোনো সময়ই শ্রীগুরুকে একলা পাই না। তিনি বাইরের দরবারে পাত্র-মিত্র নিয়ে সমাসীন। একবার অন্দরমহলে তাঁকে নিরিবিলি একলা পাওয়া গেল। কিন্তু পেয়েও তাঁকে পাওয়া গেল না, সামনে এক ঘন কৃষ্ণ আবরণ, অজ্ঞানের বা মোহের কালো পর্দা। বুঝতে পারা যায় এই কালোর আড়াল ঘুচে গেলেই সেই আলোর পারাবারে উপনীত হতে পারা যাবে ।
শ্রীগুরু আনন্দের পরাকাষ্ঠা, তার কারণ স্বরূপ-চেতনার সান্নিধ্য। অজ্ঞানে বা মোহের আবরণের মধ্য দিয়েও তার যে একটু ছোঁওয়া লাগে, তাই আমাদের জুড়িয়ে দিয়ে যায় স্বরূপানন্দের বিমল পরশে। করতে হবে এরই অন্বেষণ, তবেই মিলবে চেতনার মূল স্বরূপের সন্ধান। চেতনার এই আরোহ-অবরোহ, দেহের স্তরে নেমে আসা আবার দেহ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে উঠে যাওয়া, এই প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঘটনাটির উপর সতর্ক দৃষ্টি দাও, সজাগ হয়ে দেখো। 
মৃত্যু একটি অবধারিত, সুনিশ্চিত পরিণাম জীবনের। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মৃত্যুপথযাত্রী মুমূর্ষু ব্যক্তির চেতনার আলো কেমন ক্রমে ক্রমে গুটিয়ে আসে। দেখা যায় হঠাৎ তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, চোখ খোলা রয়েছে অথচ মানুষ চিনতে পারছেন না আর, ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, কোনো শব্দ আর কানে প্রবেশ করছে না।

আমরা সবাই জানি.... ২১



অনেক অবিশ্বাস সন্দেহ মানুষের চিত্তলোককে আচ্ছন্ন করার চেষ্টা করে, অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বে হৃদয় হয় ছিন্নভিন তবু সে যখন অবিচলিত থাকে সংকল্প ও সাধনায় অনেক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পর একদিন আসে জীবনের পরম লগ্নজয়ের গৌরব।
মানুষ ছুটছে স্বর্ণ-মরীচিকার পিছু পিছু। জীবিকার অন্বেষণের চেয়ে জীবনের অন্বেষণ অনেক মহত্তর। সুখ ও সম্পদ জীবন ধারণের সামান্য উপকরণ। অতি সংকীর্ণ তার পরিধি ক্ষণভঙ্গুর তার দান। সত্যমানুষ শ্রীগুরু মানুষকে দেন শাশ্বত সত্যের সন্ধান, মৃত্যুতোরণ উত্তরণের উত্তরাধিকার সকল ক্ষয়ক্ষতির ঊর্ধ্বে এক দুর্লভ অমর জীবন।
দেহ একদিন মিশে যাবে ধুলোয়। একে কেন্দ্র করে স্বপ্ন-নীড় রচনা করা বৃথা। এই দেহে আমিতে আমার অস্তিত্ব, সেই অব্যক্ত আমি-কে করতে হবে ব্যক্ত, অনুভব সেই সাধনায় নিয়ন্ত্রিত হোক দেহের গতি ও প্রকৃতি। অকপট, অক্লান্ত যার সাধনা সেই হতে পারে দিব্যজীবনের অধিকারী। প্রকৃতির সকল ঐশ্বর্য প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে; কিন্তু আত্মবিস্মৃত তাই এত দুঃখ, এত নৈরাশ্য। মোহগ্রস্থতা এবং অবিদ্যা আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে অন্ধকারের কঠিন অবরোধ, তাই রুদ্ধগতি শক্তির মুক্তধারা।
আমি-র মধ্যে যে মহাশক্তি ঘুমিয়ে আছে, তাকে জাগিয়ে তোলাই হোক সাধনা। অসামান্য হয়ে উঠুক জীবন। এরজন্য প্রয়োজন অশেষ দুঃখ বরণ, অসীম ত্যাগ ও তপস্যা আর অনন্ত ধৈর্যধারণ। অতীতের পানে ফিরে তাকালে দেখা যাবে কী দুঃখের তপস্যার ভিতর দিয়ে পাওয়া যায় সত্যের আলো নন্দনের আনন্দ সংবাদ। আমিত্বের আবরণগুলোকে শুধু ভুলে যাওয়ার চেষ্টায় রত থাকা, শুধু নিজকে বিলিয়ে দিতে হবে সত্যের শুভ সাধনায়। সেবায় ধন্য হবে দেশ, পুণ্য হবে জীবন।
রৌদ্রতাপে পুড়ে, বর্ষধারায় ভিজে, কঠোর পরিশ্রম করে চাষী তার ক্ষেতে ফসল ফলায়। আর আমি দেহের মাটিতে সোনার ফসল ফলাবে কোন দুঃখ বরণ না করে, সে কি হয়? মহৎ কিছু পেতে হলে মহৎ মূল্য দিতেই হবে, সইতে হবে অনেক দুঃখের তাপ, ফেলতে হবে চোখের জল, কত প্রতীক্ষার প্রহর কেটে যাবে, এরপর আসবে উজ্জ্বল ফসলের কাল। যেমন দীর্ঘ রাত্রির পর আকাশে ফোটে আলোর কুঁড়ি, আলোর ফুল, তেমনি দুশ্চর তপস্যার ভিতর দিয়েই আমিকে পেতে হবে দুর্লভের সন্ধান, আবাদ করতে হবে সোনার ফসল। যে যত দুঃখ সইতে পারে, সে-ই ততো আনন্দ পাবার অধিকারী। একটি অকিঞ্চন দীপ হতে হয় কি দীপান্বিতা? অনেক সলিতার বুক পুড়ে জাগে আলোর উৎসব, অগণন দুঃখের অনলশিখাই তো জীবনে জাগায় উৎসব রজনী, মুছে নেয় অন্ধকার। এতো দুঃখ, এতো কান্না, যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে কেন পেতে হয় পরম জীবনকে? এ না হলে পাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ ও গৌরব থাকে না; এ ছাড়া সুলভ যা আছে সহজে তাকে হারাই। তাকে ধরে রাখি না। যাতে অনাদরের ধুলোয় হারিয়ে না ফেলি, সেজন্য মূল্য জানিয়ে শ্রীগুরু তাঁর দুর্লভ ধন শিষ্যের হাতে তুলে দেন।
শ্রীগুরুর এক নিয়মের বা উপদেশের অধীন হয়ে না চললে জীবন গঠন হয় না। যেদিন ভাল লাগল, সেদিন তাঁকে ডাকবো আর যেদিন ভালো লাগল না, সেদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবো, অলস সুখে ঝরে পড়বে মুহূর্তের অফোটা কুঁড়ি, বৃথা জল্পনায় কাটবে দিন এ সমীচীন নয় মোটেই।
আধ্যাত্মিক সাধনায় ভক্তি স্বীকৃত সহায়ক। ভক্তের মাঝে কোন অনুতাপ নেই। ভক্ত সর্বদা আনন্দোচ্ছ্বল। তারা আনন্দে দিশাহারাও হন না, আবার ব্যথা-বেদনায় আতুরও হন না। অবিচ্ছিন্ন আনন্দানুভূতি ছাড়া তাদের ভিতরে দ্বিতীয় আর কোন অনুভূতিই থাকে না, তাই তারা সুখে-দুঃখে অবিচল থাকে। ভক্তের হারাবার কিছু নেই। যেহেতু তারা সত্যমানুষ শ্রীগুরুকে একান্ত আপনার বলে ধারণ করেই মানেন, তাই তাদের লাভ-ক্ষতির কোন ব্যাপারই নেই। কেবল ভক্তই বলতে পারেন, সত্যমানুষ শ্রীগুরু সবার কাছে সমান। তিনি সুখই দেন আর দুঃখই দেন, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না, কারণ দুঃখ-সুখ সবই তো সেই একই শ্রীগুরুর অভিব্যক্তি। অন্যরা জীবন চলার পথে যখন বিভিন্ন বিপরীতধর্মী পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তখনই সুখ-দুঃখ-নিন্দা-অপমান ইত্যাদি বিরুদ্ধধর্মী অনুভূতির দ্বারা পরামৃষ্ট হন। ভক্ত কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অন্যের বিরুদ্ধে কোন বিদ্বেষ বা ঈর্ষার মনোভাব পোষণ করেন না। হিংসা-অসুয়ার মনোভাব তিনি পোষণ করেন না। 
শ্রীগুরুর সান্নিধ্য পাওয়া যায় না যতক্ষণ আমিত্বের আবরণ থাকে। ভুলের রাজ্য ভুল। যখন দেহ বলে দাও দাও - মানে অভাব আছে। অভাব যেখানে সেখানে ভ্রান্তি, অজ্ঞান। যেখানে মোহ আর অজ্ঞান সেখানে ভুল ত থাকবেই। এর মধ্যে নিজেকে চেনা ও পাওয়ার দিকে যখন সাধনা করা, বা কৃপা পেয়ে যখন সাধনা হয় সাধনামাত্রেই কৃপা স্তর পার হতে হতে দেখতে পাওয়া যায়, উপলব্ধি করা যায় শ্রীগুরু ও আমি-কে সমগ্র রূপে। আমি আছি, তবেই না পৃথিবী, যত রূপ সে ত আমি-ই। যেখানে আমি-ই সেখানে এক অনন্তভাব, অনন্ত প্রকাশ। আমিও অনন্ত। 
দেশের সীমা ছাড়িয়ে আজ পৃথিবীর ঘটনাবাবলীর দিকে এক নজরে তাকালে প্রত্যেক দেশেই যে-লক্ষণটি সহজে চোখে পড়ে তা হলো যৌবনের পুনরুজ্জীবন। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে, যে-দিকেই তাকাই না কেন, সত্যব্রতী যুব আন্দোলন বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে। আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যগুলো : একদিকে কোন কোন শক্তিসমূহ তাকে পরিচালিত করছে এবং অপরদিকে কী তার চূড়ান্ত লক্ষ্য এই সমস্ত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা । যুবক ও যুবতীদের যে-কোনও সংগঠনই যুব সংগঠন নামে আখ্যাত হওয়ার যোগ্য নয়। একটা সমাজসেবী সঙ্ঘ অথবা একটা দুর্ভিক্ষত্রাণ সমিতি অনিবার্যরূপে যুবসংগঠন নয়। যুব-সংগঠনের বৈশিষ্ট্য হলো বর্তমান ব্যবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষের সত্যানুভূতি এবং উন্নততর ব্যবস্থার জন্য আকাঙ্খার সঙ্গে সেই ব্যবস্থার রূপ কল্পনায় ডুবে থাকা। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আন্দোলন সংস্কারধর্মী নয়, বিপ্লবী। কোনও আন্দোলন শুরু হবার আগে অবশ্যই বর্তমান ব্যবস্থা-সম্পর্কে এক অস্থির, এক অসহিষ্ণু অনুভূতি জন্ম নেবে। আদিমকাল হতে মানুষ এক মহত্তর পৃথিবীর স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং সেই অনুপ্রেরণার বশে সমাজ-পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছে। আধুনিক যুগের সত্যব্রতী যুব-আন্দোলন-সমূহও অনুরূপ স্বপ্ন এবং প্রচেষ্টার লক্ষণাক্রান্ত। পৃথিবীর যেখানেই কোনও আন্দোলন হোক না কেন সর্বত্রই একই আবেগ, একই স্বপ্ন এবং একই লক্ষ্য দেখতে পাওয়া যাবে। যেখানেই আগের প্রজন্মের নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানেই সত্যব্রতী যুবকরা আত্মসচেতন হয়ে উঠেছেন এবং সমাজ পুনর্গঠনের এবং সমাজকে উৎকৃষ্টতর এবং মহত্তর অস্তিত্বের পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
এখন আমরা নিজের ঘরের আরও কাছে আছি। শুধু বিশ্বের সত্যব্রতী তরুণরাই জেগে ওঠেনি, এই দেশেও জাগরণ এসেছে। এ জাগরণ এসেছে অন্তর থেকে এবং এ জাগরণ শুধু বাইরের বুদ্বুদ নয়। বাংলার তরুণরা আর সব দায়িত্ব বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, করজোড়ে বসে থেকে অথবা তাড়িত মূক প্রজাতির মতো অনুসরণ করে সন্তুষ্ট নয় আজ। তারা বুঝতে পেরেছেন যে, তাদেরই এক নতুন সৃষ্টি করতে হবে এক পরমসত্য, মহান এবং শক্তিশালী বাংলাদেশ। তারা দায়িত্ব গ্রহণ করছেন, পরিণামের জন্য তারা নিজেদের প্রস্তুত করছেন এবং যে-মহান কার্যভার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তার জন্য এখন তারা নিজেদের প্রশিক্ষিত করতে ব্যস্ত রয়েছেন।

আমরা সবাই জানি.... ২০


কর্ত্তব্যে দ্বন্দ্ব। মানবজীবনের একটা প্রধান সমস্যা। পরস্পরবিরোধী দুটি কর্ত্তব্য উপস্থিত। এখন এর কোন্টা করতে হবে? এর নিশ্চয় ও নির্দ্ধারণ করা একরূপ অসম্ভব বলেই বোধ হয়। এক্ষেত্রে যে মানব বুদ্ধির স্থিরতা রক্ষা করে কর্ম্মক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারে, সেই বীর হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে এরকম অবস্থায় কর্ত্তব্যের মানদন্ড স্থির রাখা বা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্থিরচিত্ত ব্যক্তিত্ব ভিন্ন এটা নির্দ্ধারণে অন্য কেউ সমর্থ হন না। বাস্তবিকভাবে এ দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তির মূলসূত্র খুঁজে বের করতে না পারলে কর্ম্মক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া বিশেষ বিপদ্সঙ্কুল। কর্ম্মের প্রকৃত তাৎপর্য থাকে না। যন্ত্রের মতন কর্ম্ম করায় মানুষের মনুষ্যত্ব লোপ পায়। কর্ত্তব্যের যে স্থলে দ্বন্দ্ব সেই স্থলেই সত্যমানুষ ভাব ফুটে ওঠে। দ্বন্দ্বের অতীত যারা হতে পারেন তারাই মানবের পথপ্রদর্শক সত্যমানুষ। সাধারণভাবে কর্ত্তব্য সবাই করে। 
সন্দেহাকুলচিত্ত ব্যক্তি কর্ত্তব্যের বিপদে আত্মহারা হয়ে পড়ে। আত্মহারা হলেই বুদ্ধির লোপ পায়। কর্মের ফল যে প্রকৃত শান্তি তা লাভ করতে পারে না। তেজস্বী মনস্বী ব্যক্তিত্বরাই এরূপ ক্ষেত্রে অবলীলাক্রমে নিজের আত্মভাব প্রকট করতে সমর্থ হয়। দুর্ব্বল অকর্ম্মণ্যরা ভাবের অধীনতায় অধীর হয়ে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়; কিন্তু সবল ব্যক্তি মানসিক বলে বলীয়ান্; তার তেজ অদম্য। সে স্থির, সে কোনও একটা পছন্দ করে বুদ্ধি ও শ্রদ্ধার সাহায্যে কর্ম্ম সম্পাদন করে। নিজেকে তৃপ্ত করে। কর্ম্মের প্রকৃত ফলে চিত্তশুদ্ধি লাভ করে। স্বাধীন ব্যক্তিত্বই প্রকৃত কর্ম্মাধিকারী। 
যাতে আন্তরিকতা থাকে না সে কর্ম্ম দ্বারা বিশেষ উপকার হয় না। আদেশ এবং উপদেশ প্রতিপালন কর্ত্তব্য, কিন্তু সে স্থলে যুক্তিতর্ক প্রতিপালনের পক্ষে হলেও, তা করেও সন্তোষ লাভ করে না, বরং ক্ষুব্ধ হয়। অবশ্যই পরস্পরবিরোধী ও বিপরীত কর্ত্তব্য একই কালে সম্পন্ন করা যায় না। এর কোনও একটা সম্পন্ন করতে হয়। কোন্টা করা উচিত এর মীমাংসার মানদন্ড করতে পারলেই কার্য্যক্রম শেষ হয়। 
যিনি সত্যমানুষ, অবতার, কর্মসাধক তাঁর জীবনেও কর্ত্তব্যের দ্বন্দ্ব সুপরিস্ফুটভাবে দেখা দেয়। তাঁরা একটা নিষ্পত্তি করেই অগ্রসর হয়েছেন। অগ্রসর হওয়াই তাঁদের বিশেষত্ব। সন্দেহ, সংশয়, সত্যমানুষের জন্য নয়। সত্যমানুষ নিজের মহিমায় অগ্রসর হয়। নিজের তেজে তেজীয়ান্, নিজের ভাবে অব্যাহত গতি। মানুষ প্রচেষ্টার ফলে, শিক্ষা-দীক্ষার ফলে শক্তি উপার্জ্জন করে। মূলশক্তি সবার আছে, কিন্তু সত্যমানুষেরা সব শক্তি স্বভাবজাত করে ফেলেন।
শ্রীগুরুর নাম-স্মরণ ভক্তের মুক্তি বিধান। নামই একমাত্র গতি। নাম-স্মরণ ধর্ম্মধারণের অঙ্গ-স্বরূপ। স্মরণ সাধনের সহায়ক, সাধনের রুচিবর্দ্ধক। জপই সাধনের মূল্যবান অঙ্গ। জপ অন্তরঙ্গ ধন। শ্বাসে-প্রশ্বাসে নামজপ করাটার ওপরেই সমস্ত জোর দেয় সাধনা জগৎ। নামে আস্থাহীন মানুষকে শ্রীগুরুর পানে টেনে আনার জন্য উপকারী নীরব সাধনা ও গোপন জপ। ভক্তমাত্রেই শ্বাস-প্রশ্বাসে নামজপ করা উত্তম। 
শ্রীগুরু অস্থির হলে ভক্তের চিন্তা ও দুর্ভাবনা বাড়ে, উৎসাহ ও সান্ত¡নাময় থাকলে ভক্তের বিশেষ শক্তিলাভ হয়, প্রফুল্লচিত্তে সব বিপদ ও ভয় অতিক্রম করতে পারে। গুরুকে ধারণ করে চলতে কষ্ট হয়, প্রত্যয় দৃঢ় হলে এবং আস্থার ওপর নির্ভর করলে দুঃখ আধিপত্য করতে পারে না। যারা শ্রীগুরুর সান্নিধ্যে থাকেন, তারা অনেকেই শ্রদ্ধাভাজন, তারা খারাপ কথা বললে, অন্যায় কথা বললে, তাদের ওপর ভক্তদের রাগ করা ঠিক নয়। তারা যা বলেন তা সবই তাদের চিন্তার স্তরের কথা, তাই ভক্তদের তা গায়ে মাখা উচিৎ নয়। শ্রীগুরু সঙ্গ বা সান্নিধ্যে ভক্ত সদা সর্বদা ভাবেন আমি আর নিজের ইচ্ছাধীন নই, শ্রীগুরু যেখানে আমাকে নিয়ে যাবেন, সেইখানে পুতুলের মতো যেতে হবে, যা করাবেন, তা পুতুলের মতো করতে হবে। এই কথার অর্থ বোঝা কঠিন, তবে শ্রীগুরুর গতি-বিধি ভক্তের আক্ষেপ ও দুঃখের কারণও হতে পারে। 
ভক্ত ভাবতে পারে সে শ্রীগুরুকে উপেক্ষা করে কাজ করেছে বা করছে। তা ভাবা ঠিক না। শ্রীগুরু ভক্তের বিরুদ্ধে অনেক দোষের কথা বলেন, ভক্ত যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন ভক্তের আর কোন স্বাধীনতা নেই, এর পরে ভক্তকে বুঝতে হবে যে তার সব কাজ নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভর না করে শ্রীগুরুর আদেশেই হয়। ভক্ত আসবে, শ্রীগুরুর কথার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করবে। শ্রীগুরু তাঁর অপার করুণায় যে আলোক দেখছেন এবং ভক্তকেও দেখাচ্ছেন, তা তাঁরই ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। 
সাধারণ মানুষ স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ, কতগুলো মাঠ-ক্ষেত্র বন পর্ব্বত নদী বলে জানে, শ্রীগুরু স্বদেশকে মা বলে জানেন, ভক্তি করেন, স্মরণ করেন। ভক্তরা জানেন এ পতিত জমিকে উদ্ধার করার বল শ্রীগুরুর পায়ে আছে।

আমরা সবাই জানি.... ১৯


মানুষের সামর্থ্য খুবই সীমিত। ওই সীমিত পরিবেশের ভেতরে যে যতটুকু জানে, তাই নিয়ে বলতে পারে আমি যা জানি, বুঝি, তদনুযায়ী কাজ করছি; কোনো নিশ্চয়তা দেবার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি আমার নেই। এ হ’ল স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। জাগতিক জানা যে রকমেই হোক আর যতোই বেশী হোক না কেন কারুর পূর্ণ জানা নেই, থাকতে পারে না। খন্ড বিদ্যা, খন্ড চিন্তা দিয়েই আহৃত হয়ে থাকে, তাই তা চিরদিন থাকে না। প্রকৃত জানা অর্থাৎ পুরোপুরি জানার পথে অর্জন হয় জ্ঞান। এই জ্ঞান একটাই এবং তা কোন লক্ষ্য বা শ্রীগুরু বিষয়ক জ্ঞান, জানার যে প্রয়াস সেটার মধ্যে জ্ঞান অর্জনের পথে চলে হয় জ্ঞানবান, বাকী জানার মধ্যে কোন জ্ঞান নেই কারণ তা আজ আছে, কাল থাকবে না ও যেটুকু আছে সেটুকুও পূর্ণ নয়, একটা কথা হলো যে জানাটা আছে সেটা শুদ্ধ নয়, খুবই কম; আর দ্বিতীয়ত:, সেই কম জানাটুকুও কেউ চিরদিন রাখতে পারবে না, কারণ এ পৃথিবীতে কোনো খন্ড বস্তুই চিরদিন থাকে না, তাই ওই জানাটাও থাকবে না। 
খন্ড জানা কোন অবস্থাতেই পূর্ণ নয়, নিজের শ্রীগুরুতে নিষ্ঠা এবং নিমগ্নতায় , যখনি কাজ করা যাক না কেন সেটাই শুভ সময়। সেটাই শুভ কাজ। এছাড়া আর অতিরিক্ত শুভ সময় কিছু হয় না। 
প্রাণের গতি অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী বা বিষয়মুখী, দুই-ই হতে পারে। শ্রীগুরুর দিকে গতি হলে সাধন-সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার বিনা চেষ্টায়ই সিদ্ধ হয়, বিনা চেষ্টায় প্রাণের সংযম আয়ত্ত হয়, বিনা চেষ্টায় হৃদয়গ্রন্থি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য গ্রন্থি খুলে যায়, বিনা চেষ্টায় সুন্দর সর্বাঙ্গ সম্পন্ন ভাবে সিদ্ধি ঘটে এবং নিজেকে সরল রেখে কর্ম করতে কোন প্রকার বেগ পেতে হয় না। এ সব স্বাভাবিকভাবে আয়ত্ত হয়ে থাকে। 
যখন প্রাণের গতি বাইরের দিকে ধাবিত হয় অথবা পূর্ব সংস্কার বশতঃ বহির্মুখী, তখন ভিতরের কাজ করতে গেলে চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টা সত্ত্বেও সব সময় কর্ম ঠিকভাবে সিদ্ধ হয় না। এই জন্য অন্তর্মুখ ও বহির্মুখ দুটি স্রোতে সংঘর্ষ উৎপন্ন হয়ে থাকে। প্রাণের গতিটি অন্তর্মুখ না হলে অধ্যাত্ম সাধনার ফল ঠিক ঠিক করা যায় না।
চেষ্টা করে কিছু করা বলতে ‘জোর করে করা’ বুঝতে হবে। বস্তুতঃ করা বলতে সর্বত্রই তাই; করা ও অভ্যাস স্বভাবের ধারার অন্তর্গত নহে। এটা হওয়ার ধারা নয়, স্বীকার করতে হবে; কিন্তু এরও সার্থকতা আছে। কারণ করতে করতে স্বভাবের গতি লাভ করা যায়। যতক্ষণ এটা না পাওয়া যায় ততক্ষণ এর উপকারিতা হৃদয়ঙ্গম হয় না, ততক্ষণ সাধন নীরস বলে প্রতীয়মান হয়। স্বভাবের ধারাতে প্রাণের গতি চালিত হলে, যেখানে থাকলে যখন যা প্রকাশ হবার তখন তা আপনিই হয়ে থাকে। করার পথে চিন্তার পরিবর্তন হয় না। করতে করতে স্বভাবের ধারাতে গেলে চিন্তার পরিবর্তন সিদ্ধ হয়। 
শ্রীগুরু শিষ্যের প্রাণের গতি বুঝে তাকে চালাতে পারেন। শ্রীগুরু কোন নির্দিষ্ট নিয়মের অনুসরণ করে চলেন না। যাকে চালাতে হবে, তার যোগ্যতা, রুচি, সংস্কার প্রভৃতি বিচার করে তাকে চালনা করেন। এজন্য অবস্থা অনুসারে প্রয়োজন বোধ করলে তিনি তাকে অগসর পথে চালনা করেন। কখনও তার প্রয়োজন অনুসারে অগ্রসর হতে না দিয়ে পেছনে টেনে নেন। উভয়ই শিষ্যের মঙ্গলের জন্য। তিনি ভবসাগরের কান্ডারী, শিষ্যের জীবনরূপী নৌকার কান্ডারি তিনি। তিনিই কর্ণধার। তিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিসম্পন্ন অন্তর্যামী। তিনি শিষ্যের কল্যাণের জন্য যখন যে দিকে প্রয়োজন হয়, তখন সে দিকেই নৌকাকে চালনা করে থাকেন। শ্রীগুরুতে শিষ্যের প্রতিটা স্থানের প্রতিটা ব্যাপার সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বিদ্যমান থাকে। তাঁর স্বভাবের স্পর্শ প্রাপ্ত হতে না পারলে জীবনের গতি অনুকূল হয় না। যতক্ষণ স্বভাবের গতি প্রাপ্ত না হওয়া যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আয়াস ও প্রয়াস উভয়ই থাকে।
চিন্তার শক্তি হতেই সর্বাপেক্ষা বেশি শক্তি পাওয়া যায়। বস্তু যত সূক্ষ্ম, শক্তিও ততই বেশি। চিন্তার নীরব শক্তি দূরের মানুষকেও প্রভাবিত করে, কারণ লক্ষ্য এক অর্থাৎ শ্রীগুরু এক, আবার বহু। সর্বব্যাপী এক অখন্ড সত্তারই প্রকার। বাহ্যিক জগৎ একটা ভ্রম, অর্থাৎ সত্য বস্তুর অসম্পূর্ণ প্রকাশ। সরলরেখাকে অনন্ত পর্যন্ত টানলে একটা বৃত্তই হয়। ‘আমি’ রহস্যের সমগ্র রূপ শ্রীগুরু।
মানুষের পবিত্রতা ও নীতিপরায়ণতায় ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় হয় যা যথার্থ স্বরূপ প্রকাশ করে মনন ও ইচ্ছাশক্তিকে সতেজ করে তার নৈতিকতাকে। যা কিছু এটার বিপরীত, তাই দুর্নীতি। দেশভেদে ব্যক্তিভেদে এর মানও পৃথক। মানুষকে বিধিনিষেধ শাস্ত্রীয় কথার দাসত্ব হতে মুক্তিলাভ করতে হয়। ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা নেই, কিন্তু যখন মুক্ত তখন ইচ্ছা স্বাধীন। সংসারকে এভাবে ছেড়ে দেয়ার নামই ত্যাগ। ত্যাগের ভাবে পূর্ণ হওয়া যায়। আমার দেহ ছিল, জন্ম হয়েছিল, আমি জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত ছিলাম এবং মরে গেলাম: কি ভয়াবহ প্রহেলিকা! দেহের মধ্যে আবদ্ধ থকে মুক্তির জন্য কাতর ক্রন্দন!

আমরা সবাই জানি…. ১৮


শ্রীগুরু। তাঁকে অনন্ত, অলভ্য বলে বর্ণনা করা যায়; তাঁকে যোগে-সংযোগে-সম্পর্কে দর্শন করা যায়। শ্রীগুরু ধ্যানের ক্রমোন্নতির ফল এক দিব্য বহ্নি-তেজ এবং শ্রীগুরু ভক্তির অবর্ণনীয়, শ্রীগুরু দিব্য ও মাধুর্যময় মগ্নতাতে, শ্রীগুরু চেতনার উচ্চভূমিতে, শ্রীগুরু চিত্তের শান্তি ও স্নিগ্ধময় আনন্দে, শ্রীগুরু দিব্যলোকের বস্তুসমূহের মহিমায় অভিভূত এবং শ্রীগুরু আশ্চর্যময় অনুভূতিতে দিব্য ও ভাষাতীত তীব্রানুভবে।
শ্রীগুরুর মহত্ত্বের অনুস্মরণে নিজেকে গড়ে তোলা, নিজের সমগ্র সত্তায় পরিবর্তন আনা। দেশ, কাল অতিক্রম করে অনন্তে রূপান্তরিত হওয়া। সকল মরমিয়া সাধক, ভক্ত ও মুক্তিপিপাসু সত্যমানুষের স্বপ্ন অতীন্দ্রিয় দর্শন। অধিকাংশের এ সম্পর্কে ধারণা অতি অস্পষ্ট, অগভীর এবং প্রাত্যহিক বাস্তব-জীবনের পরিপন্থী। দ্বিবিধ দ্বিচারী ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা? অর্থ? সম্পত্তি? নাম-যশ-ক্ষমতা? এ সব ছাড়া আর কিছুই কি কাংক্ষিত হতে পারে না? এমন কিছুর জন্য আর্তি হোক যা আরও অধিক স্থায়ী, যা কেবলমাত্র নিজ জীবন চলার পথেই নয়, অপর সহযাত্রীর চলার পথকেও আলোকিত করে।
জীবনের মূল ভিত্তি সাফল্য। আমরা তমসাচ্ছন্ন পথকেই আশ্রয় করে জীবন পথে চলছি, আমাদের সকল বিষয় ও বাসনারাশি শ্রীগুরুতে সমর্পণ করে তাঁর আলোকবৃত্তের অভিমুখে অগ্রসর কি হই? আমরা কি দৈহিক স্থূল আবেগের অনুবর্তী হতে চাই, অথবা সকল শক্তি সংহত করে অভ্যন্তরীণ সচেতনতার দ্বারা পরিচালিত হতে চাই? এ সব প্রশ্ন প্রতিটি সাধকের অতি একান্ত এবং উত্তর অন্তরের অন্তরতম দেশ হতেই উৎসারিত হয়।
নিমগ্নতায় জীবন যাপনের অর্থ এই নয় যে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে সকল বাস্তব উপযোগিতা হারানো, অথবা মানব কল্যাণে নিজ দেয় অংশটুকু দান করা থেকে বিরত থাকা। একরৈখিক নিমগ্নতায় জীবনচর্চায় পর্যবেক্ষণ-সহানুভূতি-উপলব্ধি বোধ হয় প্রবল, দৃষ্টি হয় স্বচ্ছ, অনুভব শক্তি হয় গভীর এবং কর্তব্যকর্মে অধিকতর দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কৃপা প্রার্থনার একনিষ্ঠতায় অর্জন হয়, আরও অধিক দক্ষতা, অধিক ক্ষমতা, অধিক দৃষ্টি-স্বচ্ছতা আয়ত্ত করা; যার ফলে যা-ই আমরা করি না কেন, তা শ্রীগুরুর দান বলেই গণ্য। এর ফলে বর্তমান ব্যক্তিত্ব খর্ব হয় না, বরং তা আরও বিকশিত হয়। সহানুভূতিবোধ এবং প্রেমজগতের প্রেমস্তর সঙ্কীর্ণ হয় না, তা আরও প্রেমজগতের অজস্র স্তরে অজস্র ধারায় প্রবাহিত হয়। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থে অথবা সঙ্কীর্ণ গন্ডিতে চেতনা দেশে কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিবর্তে তা ব্যাপ্ত হয় বিশ্ব চরাচরে। বিশ্ব-অন্তর অধিগ্রহণ করে ক্ষুদ্র ব্যক্তি-অন্তর এবং প্রাণ ছন্দায়িত হয় জীবন চলার পথে। মানব প্রজাতির সমাজবদ্ধতার মাধ্যমে সত্যমানুষকূলের সত্যমানুষদের আলোকোজ্জ্বল ছটা পার্থিবজগতে অনুপ্রবেশ ঘটে চলছে, যে আলোক উৎসারিত তাঁদের আপন সত্তা হতে যেমন সূর্যের দীপ্তি উদগত হয় সাগর হতে। প্রেমজগতের অধিকারী সকলেই। জ্ঞানালোকের অস্তিত্ব চিরন্তন, বহমান এবং প্রত্যেকেই নিজ চেষ্টায় ও শ্রীগুরুর কৃপায় কিছু পরিমাণে তা উপলব্ধি করে জ্ঞান অর্জনের পথে চলতে সক্ষম। যারা এই দিব্য অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, তারা কখনই তা অনুভব করেননি। উপলব্ধি বা প্রাপ্তির সৌন্দর্য এতই গভীর গাঢ় যে তার তুলনায় অপর যে কোনও অনুভূতির অস্তিত্ব বা সত্যতা মিথ্যা বলে উপেক্ষিত হয় এবং সৌন্দর্য এতটাই উজ্জ্বল যে অপর সকল কিছুই ছায়া বলে বোধ হয়।
কর্ম প্রকৃতির ভিত্তির অংশবিশেষ কর্মপ্রবাহ সর্বদাই দেহে বহে চলছে তরঙ্গায়িত হয়ে। যারা শ্রীগুরুতে বিশ্বাসী, তারা এটা আরও ভালরূপে বুঝতে পারেন, কারণ তারা জানেন শ্রীগুরু এমন একজন সর্বশক্তিমান সর্বত্র বিরাজমান নিরাকারে-আকার সক্ষম পুরুষোত্তম সত্যমানুষ যে, তিনি তাঁর আশ্রিত ও ভক্তদের, লক্ষ্য, মুক্তি, স্বার্থশূন্যতা – কর্মযোগ অনুসারে কর্মের দ্বারাই তাদেরকে ওই গন্তব্যে পৌঁছে দেন এবং পথ দেখাতে থাকেন যেখানে সত্য ও শান্তির ধারা বিরাজমান। এ জন্যই কর্মরহস্য জানা প্রয়োজন। জগৎকে সম্পূর্ণরূপে আনন্দময় করবার যাবতীয় ধারণা ধর্মীয় উগ্রবাদীদেরকে কর্মে প্রবৃত্ত করার পক্ষে শ্রেয়। গোঁড়ামি দ্বারা ভালও হতে পারে, মন্দও তেমনি হতে পারে। কর্ম করবার জন্য মুক্তির সহজাত অনুরাগ ব্যতীত উদ্দেশ্যমূলক কোন প্রেরণার প্রয়োজন কি? সাধারণ উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধির গ-ি অতিক্রম করা। কর্মেই অধিকার, ফলে নয়। যখন উপকার করবার ইচ্ছা মজ্জাগত হয়, তখন আর বাহিরের কোন প্রেরণার প্রয়োজন থাকে না। উপকার করে ভাল লাগে বলে। স্বর্গ/বেহেস্ত যাবে বলে যে ভাল কাজ করে, সে নিজেকে বদ্ধ করে ফেলে। এতটুকু স্বার্থযুক্ত অভিসন্ধি নিয়ে যে কর্ম করা যায়, তা মুক্তির পরিবর্তে আমাদের পায়ে একটা একটা শেকল পরায়ে দেয়।
উপায় সব কর্মের ফল ত্যাগ করা, অনাসক্ত হওয়া। জগৎ আমার নয়, আমরাও এ জগতের নয়; বাস্তবিকতায় আমরা শরীরও নই, আমরা প্রকৃতপক্ষে কর্ম করি না। আমরা চিরস্থির, চিরশান্ত। আমরা কেন কিছুর দ্বারা বদ্ধ নয়। আমাদের রোদনেরও কোন কারণ নেই, নিজের জন্যে কাঁদবার কিছু নেই। এমনকি, অপরের দুঃখে সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েও আমাদের কাঁদবার কোন প্রয়োজন নেই। কাঁদা বন্ধনের চিহ্ন দুর্বলতার চিহ্ন। একবিন্দু চোখের পানি যেন না পড়ে। এরূপ হবার উপায় অনাসক্ত হওয়া – অভিসন্ধিশূন্য হয়ে যে-কোন কাজ করলে, তা একটা নূতন শৃঙ্খল সৃষ্টি না করে যে শৃঙ্খলে আমরা বদ্ধ রয়েছি, তা একটা একটা করে ভেঙ্গে দেয়।
সমস্ত আপেক্ষিক সত্যের অতীত সেই পরম সত্যকে কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জনের দ্বারা বিচার করেই পরমসত্যে বিরাজমান। এই জ্ঞান কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা সাধন নয় সব সত্যকে অতিক্রম করে শ্রীগুরু যাকে একমাত্র স্বীকৃত বলেছেন, সেই জ্ঞানলভ্য একটা দার্শনিক তত্ত্ব। একাগ্রচিত্ত প্রবলবেগে প্রত্যক্ষ সন্ধানে লক্ষ্যের দিকে ধাবমান হলে, সেই পরমসত্যের মধ্যে প্রবেশ করে আবেগের সাথে তন্ময় হওয়া যায়। কেবলমাত্র সত্যনিরূপণ নয়, সেই সত্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই লক্ষ্য। সেই সত্য কেবলমাত্র সত্য নয়, তা অমৃত। তা কেবল জ্ঞানের ক্ষেত্র অধিকার করে নেই, তাকে আশ্রয় করেই অমরত্ব।

আমরা সবাই জানি…. ১৭


দেশের জন্য অনেক কাজই করার আছে। দেশের সেবা করতে হলে কোথা থেকে কাজ আরম্ভ করতে হবে? দেশের কাজ করতে হলে প্রথমে মানুষ ও সত্যমানুষ তৈরির কারখানা গড়তে হবে।
মানুষ তৈরির যে আশু প্রয়োজন তা ভেবে দেখতে হবে। ভাল সংস্কার সম্পন্ন শিশু না জন্মালে শুধু শিক্ষা দিয়ে তাদের বিশেষ কি করতে পারা যাবে? বীজ থেকেই গাছ হয়, বীজ ভাল হলেই গাছ ভাল হবে। দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ। দীর্ঘ সময় লাগবেই। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ জাতীয় লক্ষ্য ছাড়া জীবন চলার পথে জাতির বা সমাজের জন্য কতটুকু করতে পারেন। বহু গলদ জমে আছে। তা সাফ করতে সময় নেবে। কোনও স্বল্পকালীন পরিকল্পনায় জাতির সত্যকার কল্যাণ হবে না।
বিষয় ভেদে শ্রবণ বা শোনা দু’ প্রকার, অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে শ্রোতা নিজের অনুভবযোগ্য বিষয় অন্যের মুখ হতে শোনে সে ক্ষেত্রে শোনা এক । কিন্তু যে ক্ষেত্রে শ্রোতা যা কিছু শোনে তার কোন অংশই বুঝতে পারে না অথচ শ্রদ্ধার সাথে শোনে, সে ক্ষেত্রে শোনা দু’প্রকার। সাধারণ লোক কোন বিষয় বুঝতে না পারলে তা দীর্ঘকাল ধৈর্যের সাথে শুনতে চান না এবং পারেনও না। যখন কোন বিষয় রুচিকর হয় বা চিত্তাকর্ষক হয় তা হলে বিষয়ের গুণে শ্রোতার চিত্ত রঞ্জিত হয় বলেই সে ধৈর্য ধরে শুনতে পারে এবং সে অনুসারে কাজ করে থাকে। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু যারা আধাত্মিক সাধনার জগতে ঢুকে পড়েছেন তারা শোনাকে সাধনার অঙ্গ হিসেবে ধারণ করে থাকেন। এ স্তরে শোনাটা নিরপেক্ষ, বিষয়টা চিত্তাকর্ষক না হলেও অথবা অন্য কোন প্রকারে মনোরঞ্জনের না হলেও বিষয়ের অন্তর্নিহিত গুণে অথবা বাক্যের স্বভাবসিদ্ধ প্রভাবে শ্রোতা শুনতে প্রবৃত্ত হয়।
যে বিষয় অথবা যে ভাষা শ্রোতার বোধের অগোচর, তা শুনে কোন প্রকার ফল লাভ হতে পারে না। এটাই সত্য। কিন্তু অধ্যাত্ম ক্ষেত্রে শ্রোতার শোনা সাধনা, তার বুদ্ধি অথবা বিচার শক্তির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। সিদ্ধবচন বুঝতে হবে। সব শব্দের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে চেতনাশক্তি নিহিত রয়েছে। সেই শব্দগুলো কেবলমাত্র লৌকিক শব্দ নয়, যদিও সাধারণ শ্রোতার নিকট ওইগুলো সাধারণ শব্দরূপে প্রতীত হয়। সকল শব্দের অন্তঃস্থিত শক্তির প্রভাবে মানুষের জীবন প্রভাবিত এমন কি পরিবর্তিত হয়ে থাকে। কিন্তু ওই গুপ্ত শক্তিকে কার্যকরী রূপে পেতে হলে পূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে ওই সব বাক্য শুনতে হয়। বিশুদ্ধ শ্রদ্ধার সাথে শোনার ফলে ওই সব শব্দ জেগে ওঠে অর্থাৎ চেতনাময় শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই চেতনাময় শক্তির প্রভাবে দেহ, প্রাণ ও চিন্তার যাবতীয় শৃঙ্খল ক্রমশঃ ছিন্ন হয়ে যায় এবং একরৈখিক হয়।
এ জন্য বুদ্ধিদ্বারা বুঝতে না পারলেও বিভিন্ন অঙ্গনে শ্রীগুরুর বাণী শ্রদ্ধার সাথে শুনতে হয়। ওই শোনাও বৃথা যায় না। অনেক সময় ওই প্রকার সরল ও সাদরে শোনার ফলে অন্তঃকরণের আবরণ খুলে যায় এবং জ্ঞান ও অজ্ঞান উভয়ের অতীত নিজস্বরূপে স্থিতি লাভ করতে সমর্থ হয়। অনুভবে না আসলেও শুধু শোনার ফলে অনুভবের পথ খুলে যায়। পানি প’ড়ে প’ড়ে যেমন পাথরে ছিদ্র হয় ঠিক তেমনি।
পড়া, কথা এবং গান এই তিনটা স্থূলতঃ পৃথক্ পৃথক্ হলেও বিষয় গুণে অভিন্ন। সর্বত্রই শ্রীগুরু-প্রসঙ্গই একমাত্র অবলম্বন। ফলে কোন পার্থক্য নেই। যার যে দিকে রুচি সে সেই দিক্কার শোনায় আকৃষ্ট হয়। সেই দিক দিয়েই তার পথ খুলে যায়। অধিকার ভেদে সবই ঠিক। এ জন্য দোষ-দৃষ্টি বর্জন করে শোনা বিধেয়। বিভিন্ন অঙ্গনে শ্রীগুরুর উপদেশ শোনার সময় দোষ-গুণের বিচারের ভাব অন্তরের মধ্যে থাকা উচিত নয়। নিজ প্রচেষ্টায় উন্মুখ হয়ে সরলভাবে তা গ্রহণ করতে হয়। নিজে সমালোচক হয়ে উপদেশ শোনা নিষিদ্ধ। নিমগ্নভাবে শুনলে মননের অবসর আপনা থেকেই এসে উপস্থিত হয়। শোনা শ্রদ্ধার সাথে না হলে শোনার বিষয়ে সংশয় থেকে যায় বলেই তা অবলম্বন করে মননের কাজ ঠিকভাবে করা যায় না। মননের মুখ্য উদ্দেশ্য সংশয় নিরসন। কিন্তু প্রথমে শ্রদ্ধার সাথে শোনা না হলে দীর্ঘ সময় মননের যা যথার্থ ফল তা প্রাপ্ত হওয়া যায় না। মননের পরে দৃঢ় নিশ্চয়তার আবির্ভাব হলে তা উর্দ্ধমুখী কর্মরূপে প্রকাশ পেয়ে থাকে। যথাবিধি অনুষ্ঠানে শুনতে পারলে অনুভবশূন্য শোনা হতেও পূর্ণ অনুভবের উদয় সম্ভব। সংশয়-নিবৃত্তির পর কর্মরূপে প্রকাশ হওয়ার সময় প্রত্যক্ষ অনুভূতি অবশ্যম্ভাবীরুপে জেগে ওঠে।
মানুষ সর্বত্র খণ্ডভাব নিয়ে ব্যবহৃত-ভূমিতে কাজ করছে। তার দৃষ্টি ভেদ-দৃষ্টি। সমস্ত সত্তার মধ্যে যে এক অখন্ড অভিন্ন সত্তা বিদ্যমান রয়েছে এ উপলব্ধির বা প্রাপ্তির সৌন্দর্য অবলোকন করার দৃষ্টি তার নেই। তাই যে যখন যা দেখে সে তখন শুধুমাত্র তাই দেখে। দেশ ভেদে, কাল ভেদে, বস্তু এবং স্তর ভেদে সব দেখা পৃথক্ পৃথক্ সব অঙ্গনেই। এমন দেখা সে দেখে না যাতে তার এই নানা দেখার বৈচিত্রতা সাম্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তা’ই এ দেখা হতে সে স্থিতিলাভ করতে পারে না। কারণ সর্বত্র ভেদ রয়েছে, কোনভাবে পূর্ণ তৃপ্তি না পাওয়ার এক ভাব হতে অন্য ভাবে সঞ্চরণ অনবরত ঘটে যাচ্ছে। যা’র যে ভাব সেই ভাবই যে পূর্ণভাব এবং সেই ভাবই যে ভাবাতীত এটা অনুভবে আসে না। গুরুভাব, মাতৃভাব, পিতৃভাব, বন্ধুভাব, পতিভাব সবই খন্ড ভাব। শ্রীগুরু-অখন্ড ভাবের সাথে যোগ না থাকলে মা শুধু মা-ই, বাবা শুধু বাবাই। মা-তেও বাবাভাব নেই এবং বাবাতে মা-ভাব নেই। তাই অতৃপ্তির অবসান হয় না। কিন্তু প্রতি ভাবই সেই অখন্ড শ্রীগুরু-মহাভাবের প্রকার ভেদ মাত্র, এটার সৌন্দর্য দেখতে পেলে অনন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যেও সব সময় এককেই জানতে পারা যায়। তখন মাতা, পিতা, বন্ধু, স্বামী সকলের মধ্যে সেই এক-ই যে অনন্তরূপে বিদ্যমান রয়েছে তা বুঝতে পারা যায়। সুতরাং খন্ড ভাবকেও পূর্ণরূপে পেতে হলে অর্থাৎ কোন ভাবকেও পূর্ণভাবে অখণ্ডরূপে পেতে হলে চেতনা লব্ধ অভেদ দৃষ্টি আবশ্যক। কিঞ্চিৎ মাত্র ভেদ দৃষ্টি থাকা পর্যন্তও পরম স্থিতি পরম চেতনা লাভ করা যায় না এবং বিরোধেরও সমন্বয় হয় না। প্রকৃত লক্ষ্য একটাই, সেখানে ভেদ ও অভেদের পরস্পর বিরোধ নেই। দেশের সার্বিক অঙ্গনে শ্রীগুরু যে পথে পরিচালিত করছেন সেটাই সর্বকালের, সর্বমানবের পথ। এতে কোনও সন্দেহ নেই। এই পথই মানব প্রজাতি অনুসরণ করে আসছে এবং শেষ পর্যন্ত করে যেতে হবে।

আমরা সবাই জানি…. ১৬

জ্ঞান, ভক্তি, ধর্ম নিজে অর্জন করতে হয়; খুব খাটতে হয়, তবেই নিজস্ব হয়, স্থায়ী হয়, চিন্তায় ভরপুর হয়ে থাকে। কেউ কাউকে এসব দিতে পারে না। সাধন চাই, তবে সিদ্ধিলাভ হয়। যেমন সাধন তেমনি সিদ্ধি। বিনা সাধনে বা চেষ্টায় যা পাওয়া যায় তার গুরুত্ব থাকে না, কদর হয় না, পেয়েও তেমন সুখ হয় না বরং লোভ বাড়ে। যা সহজে আসে তা সহজে চলেও যায়। জীবন চলার পথে সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে, আপদে-বিপদে নানা পরীক্ষায়-প্রলোভনে যেটা আসে সেটা বড় বেশি কাজে আসে না, কোথায় ভেসে যায়।
ধর্মভাব নিজস্ব করা মানে নিজেকে তদ্ভাবে ভাবিত করা, যাতে নিজের অভ্যাসগুলো একেবারে বদলে গিয়ে স্ব-ভাবে যেন আর এক মানুষ হয়ে যাওয়া-এই শরীরেই পরিবর্তনের সাথে সাথে নবজন্মলাভ করা। জীবনপণ করে লাগলে তবে হয়। আর যতদিন সিদ্ধিলাভ বা লক্ষ্য অর্জন না হয় অবিরাম অনন্যমনে সাধন করে যেতে হবে। নিজেকে দাও তো নিজেকেও পাবে, পরও নিজের হবে। যত নিজেকে বাঁচাতে যাবে, তত নিজেকে খোয়াবে, আপনও পর হয়ে যাবে।
অবিরাম সংগ্রাম। বীরের মতো লড়া, পেছন ফিরে না চাওয়া, শুধু এগিয়ে চলা। অবসন্ন হলে বা ক্ষত-বিক্ষত হলে, ভ্রূক্ষেপ না করা। ভয়শূন্য হওয়া। পরাজয়ের কথা চিন্তায় স্থান না দেয়া। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর-পতন। হয় জয়, নয় মরণ। মরতে হয় তো বীরের মতো মরা শ্রেয়।
আমি অতি দীনহীন, দুর্বল, আমি কিছু পারছি না – বলে মিছে হতাশ হয়ে কোন ফল নেই। ওট নিষ্কর্মাদের লক্ষণ, ওদের দ্বারা কোন কাজ হয় না। উঠে পড়ে লেগে থাকতে হবে, তবে তো হবে। রাস্তা অনেক দূর ও দুর্গম বলে বসে থাকলে কি রাস্তা ফুরায় না।পথ চলতে শুরু করলে, অমনি পথ কমতে শুরু হবে। তবেই আশা হবে, সাহস আসবে, বল আসবে, অপ্রত্যাশিত সাহায্য আসবে, পথও ক্রমশঃ সহজ ও সরল হয়ে আসবে। দেখতে দেখতে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবে। তখন শুধু আনন্দ!
অনেকের ধারণা যে শ্রীগুরুর কাছে বয়াত বা মুরীদ বা দীক্ষা নিলে তাঁর কৃপায় সব দুঃখ ঘুচে যাবে। তখন দুরারোগ্য ব্যাধি সেরে যাবে, মনের মতো চাকরি হবে, ঐহিক সুখ-সম্পদ লাভ হবে, কন্যাদায় হতে মুক্ত হবে, স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় পাশ হবে, মামলায় জিত হবে, ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি হবে, সংসারের জ্বালাযন্ত্রণা, অশান্তি দূর হবে, শনির দশা কেটে যাবে আরও কত কি অলৌকিক বা অপ্রত্যাশিত ভাবে হবে! তাদের জানা উচিত যে, ধর্মলাভের সঙ্গে এসব ঐহিক লাভের ব্যাপারের কোন সম্বন্ধ নেই। আর এ-সকলের জন্যে গুরুর কাছে আবদার করা মহা হীনতা, ধর্মভাবের মোটেই লক্ষণ নয়। যদিও শ্রীগুরু হর্তা- কর্তা – বিধাতা। তাঁকে এসবের জন্যে বিব্রত ও জ্বালাতন করা অত্যন্ত অন্যায়। তাতে তাঁর আশীর্বাদলাভের চেয়ে বিরাগভাজনই হতে হয়। তাঁর সঙ্গে মাত্র পারমার্থিক ব্যাপারের সম্বন্ধ উত্তম।
কামনাভাবে সেবা বা উপাসনা ব্যবসাদারী মাত্র। তাতে ঠিক ঠিক ধর্মলাভ হয় না, ফল লাভ যা হয় তা অতি সামান্য, তুচ্ছ, অস্থায়ী, সহজে ক্ষয় হয়ে যায়। কামনাভাবে উপাসনায় চিত্তশুদ্ধি হয় না, ভক্তি-মুক্তি, বা শান্তি ও আনন্দলাভও হয় না! শ্রীগুরুর কামনা করে দেয়া জিনিস গ্রহণ করতে, এমনকি ছুঁতেও পারছেন না যদিও তিনি মুখে কছু বলেন না।
তাঁকে এই জীবনে পেতে হলে নিজের সমস্ত শক্তিসামর্থ্য দিয়ে সাধন করতে হবে, তাঁকে সর্বস্ব অর্পণ করতে হয়, ষোল আনার ওপরও যদি সম্ভব হয় দিতে হয়। অর্থাৎ যেন পাত্র ছাপিয়ে গড়িয়ে যায়। নিরাশ হবার কিছু নেই। নিজের শক্তি-অনুযায়ী যথাসাধ্য করে যাওয়া উত্তম। স্মরণ রাখতে হবে যতই করি না কেন, তাঁকে পাবার পক্ষে তা কিছুই নয়, তাঁর কৃপা ভিন্ন কিছুই হবার নয়।
আত্মসুখের জন্য বা ভোগলিপ্সু দেহের জন্য যে অন্ন গ্রহণ করছি, তা এই দেহখানাকে আর অমর করে দিতে পারে না! মৌন ভাবসাধনার দ্বারা আজ ক্ষুধার সাথে সত্য-সুন্দরের সংযোগ সাধন করে দেহ রক্ষার সাথে সাথে গুরুকে পরিতুষ্ট করা শ্রেয়। এই দেহ যে জগতের কল্যাণকল্পে উৎসর্গ করতে হবে, সুখলোভী মনোবৃত্তির প্রলোভন-মুখিনী প্রবণতা হতে সযত্নে রক্ষা করে তাকে শ্রীগুরুর কাছে সমর্পণ করতে হবে, প্রতি গ্রাস অন্নতে তা স্মরণে রাখতে হবে।
সাধকের কাছে মৌন কর্ম্মহীনতা নয়, ভবিষ্যৎ কর্ম্মের আয়োজন মাত্র; কর্ম্মবিরতি নয়, আরম্ভ মাত্র। যারা প্রেমজগত জানা সত্ত্বেও পথ চিনতে পারে না, তারা তখন মৌনীর অনাহত উপদেশে পথ বেছে নেয় আর, যারা কল্যাণকে চায় না, অকল্যাণের নরক কু-কেই বেহেশতি সুখ ভেবে অনির্দ্দেশ পতনের পথে ছুটে চলে, তারা কুশলের অভাব অনুভব করে,অন্তরের গোপনতম প্রদেশে নিবিড়তম বেদনা উপলব্ধি করে চমকে উঠে জীবন চলার পথে।
ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত পুণ্যকর্মও কামনার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মলিন বাসনার স্পর্শ হতে তা মুক্ত নয়। গুরুর উপর নির্ভর করে নির্বিচারে তাঁর আজ্ঞা পালন করা-এটাও কামনার কর্ম। তবে এ ক্ষেত্রে কামনা বা বাসনা বিশুদ্ধ। গুরুর ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্য যে আন্তরিক বাসনা তা বাসনা হলেও ভুল নয়। এই জাতীয় কর্মকে প্রত্যাশাহীন বলা চলে। চিত্তে ক্ষুদ্র কামনা বা বাসনা না থাকলে এক হিসেবে সেটা কামনাহীন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এটাকে কামনাহীন বলা হয় না। আত্মদর্শন না হলে কামনাহীন কর্ম হয় না-এটাও সঠিক নয়। আত্মদর্শন হলে কর্ম থাকে না। দ্বন্দ্ব ভিন্ন কর্ম হয় না-আত্মদর্শন হলে দ্বন্দ্বাতীত স্তরে স্থিতি হয়। তখন গুরু হতে ভিন্ন কিছুই দৃষ্ট হয় না, সবই আত্মরূপে প্রতিভাত হয়। তখন দ্বন্দ্বও নাই, কর্মও নাই।

আমরা সবাই জানি…. ১৫

গুরু ব্যতীত সাধকের জীবনে উচ্চতর লক্ষ্য আর কিছু নেই। সাধকের সর্বোচ্চ লক্ষ্য গুরুকে দর্শন করা, তাঁকে সম্ভোগ করা। গুরু অপেক্ষা উচ্চতর বস্তু সাধক ধারণাই করতে পারে না, কারণ গুরু পূর্ণস্বরূপ। প্রেমজগতের গুরুপ্রেম স্তর অপেক্ষা কোন উচ্চতর আনন্দ সাধক ধারণা করতে পারে না। প্রেম শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রেম-শব্দ দ্বারা সংসারের প্রত্যাশা যুক্ত সম্পর্ক সাধারণ ‘স্বার্থযুক্ত ভালবাসা’ বুঝায় না -একে প্রেম নামে অভিহিত করা আত্মনিন্দার সমান। মানুষের সংসারের প্রতি ভালবাসা প্রজাতির ভালবাসার মতো। যে ভালবাসা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, তাই একমাত্র ‘প্রেম’ এবং তা কেবল গুরুর জন্যই সম্ভব। এই প্রেমস্তর লাভ করা বড় কঠিন ব্যাপার। মানুষ পিতামাতা, পুত্রকন্যা ও অন্যান্য সকলকে ভালোবাসছে -এ রকম বিভিন্ন প্রকারের ভালোবাসা বা আসক্তির ভেতর দিয়ে মানুষ চলছে।
মানুষ ধীরে ধীরে প্রীতিবৃত্তির অনুশীলন করে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই বৃত্তির পরিচালনা হতে কিছুই শিখতে পারে না – একটা স্তরে আরোহণ করে তাতে মানুষ আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কখন কখন মানুষ এ বন্ধন অতিক্রম করে থাকে। মানুষ এ জগতে চিরকাল স্ত্রী-পুত্র ধন ও মান-এ সবের দিকে ছুটছে, সময়ে সময়ে তারা বিশেষ ধাক্কা খেয়ে সংসারের ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ বুঝতে পারে। এ জগতে গুরু ব্যতীত আর কাকেও ঠিক ঠিক ভালোবেসে প্রেম করতে পারে না। শেষ বয়সে মানুষ বোঝে, মানুষের ভালবাসা সব শূন্য। মানুষ ভালবাসতে পারে না-শুধু কথায় বলে। স্বামী আমি তোমায় বড় ভালোবাসি – বলে স্ত্রী অশ্রু বিসর্জন করে তথাকথিত পতিপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে থাকে, কিন্তু সেই স্বামীর যখন মৃত্যু হয়, অমনি সন্ধান করে, ব্যাঙ্কে তার কত আছে; আর কাল কি গতি হবে ভেবে আকুল হয়। স্বামীও স্ত্রীকে খুব ভালবেসে থাকেন, কিন্তু স্ত্রী রূপ-যৌবন হারালে অথবা সামান্য দোষ করলে তার দিকে আর চেয়েও দেখেন না। জগতের সব ভালোবাসা অন্তঃসারশূন্য ও কপটতাপূর্ণ।
সান্ত জীব কখন ভালোবাসতে পারে না, অথবা সান্ত জীব ভালোবাসার যোগ্যও হতে পারে না। প্রতি মুহূর্তেই যখন ভালবাসার পাত্রে দেহের তরঙ্গে তরঙ্গায়িত এবং সঙ্গে সঙ্গে চিন্তারও পরিবর্তন হচ্ছে, তখন এ জগতে অনন্ত প্রেমের কি আর আশা করা যেতে পারে? গুরু ব্যতীত অন্য কারও প্রতি প্রকৃত প্রেম সম্ভব নয়! তবে এসব ভালোবাসাবাসি কেন? এগুলো কেবল ভ্রম মাত্র, প্রেমজগতের বিভিন্ন অবস্থামাত্র। মহাশক্তি সত্যমানুষকূল নিরাকার পথে মানুষ প্রজাতির অন্তরাল হতে ভালবাসবার জন্য প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন-মানুষ জানেন না কোথায় সেই প্রেমাস্পদ সত্যমানুষ গুরুকে খুঁজবে, কিন্তু ব্যাকুলতা মানুষকে এর অনুসন্ধানে সামনে অগ্রসর করে দিচ্ছে। বারংবার ভুল ধরা পড়ছে। একটা জিনিস ধরলাম-সেটা হাত হতে ফসকে গেল, তখন অন্য একটা কিছুর জন্য হাত বাড়াচ্ছি। এ ভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি মৃত্যুর দিকে। শেষ পর্যন্ত আলো এসে থাকে, তখন অনুসন্ধিৎসু গুরুর কাছে হাজির হন – একমাত্র গুরুই যথার্থ ভালোবেসে থাকেন, তাঁর ভালোবাসার কোন পরিবর্তন নেই, তিনি সর্বদাই অভাবিদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকেন। ব্যক্তি নিজেকে অনিষ্ট করতে থাকলে কে কতক্ষণ অত্যাচার সহ্য করবেন?
যাঁর ক্রোধ ঘৃণা বা ঈর্ষা নেই, যাঁর সাম্যভাব কখন নষ্ট হয় না, যাঁর জন্ম নেই-মৃত্যু নেই, তিনি গুরু ব্যতীত আর কি হতে পারেন? তবে গুরুকে লাভ করা বড় কঠিন এবং তাঁর নিকটবর্তী হতে হলে বহু দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়-অতি অল্প লোকই তাঁকে লাভ করে থাকেন। মানুষ শিশুর মতো হাত-পা ছুঁড়ছে মাত্র। লক্ষ কোটি লোক ধর্মের দোকানদারি করেন, সকলেই ধর্মের কথা বলেন, খুব কম লোকই প্রকৃত ধর্ম লাভ করে থাকেন। এক শতাব্দীর মধ্যে অতি অল্প লোকই সেই গুরুপ্রেম লাভ করে থাকেন। এক সূর্যের উদয়ে সমগ্র অন্ধকার তিরোহিত হয়, তেমনি এক অল্পসংখ্যক যথার্থ ধার্মিক ও কালোত্তীর্ন সাধকের অভ্যুদয়েই সমগ্র দেশ ও জাতি ধন্য ও পবিত্র হয়ে যায়।
শিক্ষার মাধ্যমেই দেহ এই শিক্ষা পায় যে ব্যাধি আছে, অপ্রতিরোধ্য দুর্ঘটনা আছে বা দেহের বার্ধক্য আছে-এই শিক্ষা আস্থা ও বিশ্বাসকে নষ্ট করে দেয়। চিন্তার বিকৃতিই নিশ্চিয়তাকে বিনষ্ট করে। দেহ নমনীয় আবার খুবই অনমনীয় এবং সে জন্যই দেহের অবনতি ঘটে। দেহকে কি করে ব্যবহার করতে হয় মানুষ জানেন না। জানি না আমরা যখন ছোট ছোট পাতার মত সতেজ থাকি তখন কেমন করে মনোরম, অত্যুৎকৃষ্ট ও নিখুঁতভাবে পুষ্পিত হওয়ার জন্য আস্পৃহা করতে হয়। সৌন্দর্য্যরে যে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে, তার উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। একটা ছোট শিশুকেও সৌন্দর্য্যরে জন্য আস্পৃহা করা উচিত; অন্যদের সন্তুষ্ট করা বা তাদের প্রশংসা লাভের জন্য নয় বরং শুধু সৌন্দর্য্যকে ভালবাসার জন্যই। সৌন্দর্য্য এক আদর্শ যা স্থূল জীবনে সকলকেই লাভ করতে হবে। প্রত্যেক মানুষেরই তার শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ও তার ক্রিয়ারত বিভিন্ন গতিধারার মধ্যে সংগতি প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা আছে। প্রত্যেক মানবদেহই-যা তার অস্তিত্বের আদি থেকে যুক্তিসিদ্ধ প্রণালীতে শরীর চর্চা সাধন করে-নিজস্ব সংগতি লাভ করে এবং সৌন্দর্য্যরে প্রকাশে উপযুক্ত হয়ে ওঠে। সত্তার প্রত্যেক অংশে গুরু তাকে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত করে থাকেন। উচ্চতর অংশে শক্তি ভালবাসা ইত্যাদি রূপে প্রকাশিত হওয়ার পথ দেখান যাতে শরীর সত্তায় তিনি সৌষম্য ও সৌন্দর্য্য হিসাবে অভিব্যক্ত হন।
ধর্ম বাক্যাড়ম্বর নয়, অথবা মতবাদবিশেষ নয়, অথবা সাম্প্রদায়িকতা নয়। সম্প্রদায়ে বা সমিতির মধ্যে ধর্ম আবদ্ধ থাকতে পারে না। ধর্ম প্রেমিকের সাথে প্রেমাষ্পদের সম্মন্ধের মধ্যে নিহিত। ধর্ম কিরূপে দলে পরিণত হবে? সংখ্যাধিক্য হলেই কি মানুষ অধিক ধার্মিক হবে, অথবা উহার সংখ্যাল্পতায় কম ধার্মিক হবে? মসজিদ-মন্দির বা চার্চ-নির্মাণ অথবা সমবেত উপাসনায় ধর্ম হয় না, কোন গ্রন্থে, বচনে, অনুষ্ঠানে বা সমিতিতেও ধর্ম পাওয়া যায় না।
আসল কথা – অপরোক্ষানুভূতি। ধর্ম অনুরাগে, বাহ্য অনুষ্ঠানে নহে। হৃদয়ের পবিত্র ও অকপট প্রেমেই ধর্ম।
কোনও ব্যক্তি যে পথে চলতে ইচ্ছা করে তাকে সেই পথে চলতে দিতে হবে; কিন্তু যখন আমরা তাকে অন্য পথে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি, তখন তার যা আছে, সে তাও হারাবে, সে একেবারে অকর্মণ্য হয়ে পড়বে। যে দেশে সকলকে একপথে পরিচালিত করবার চেষ্টা করা হয়, সে দেশ ক্রমশ ধর্মহীন হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে বাংলাদেশে কখনও এরূপ চেষ্টা হয় নাই। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কখনও বিরোধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক ধর্মই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্য-সাধন করে গেছে-সেইজন্যই এখানে প্রকৃত ধর্মভাব এখনও জাগ্রত। সকল ধর্মে আছে ভাল ভাল লোক, এ কারণেই সে সব ধর্ম লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে থাকে। সুতরাং কোনও ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়।
আল্লাহ, ভগবান বা গডের নামে এত গন্ডগোল, যুদ্ধ ও বাদানুবাদ কেন? তাদের নামে যত রক্তপাত হয়েছে, অন্য কোনও বিষয়ের জন্য এত রক্তপাত হয় নি; কারণ সাধারণ মানুষ ধর্মের মূল উৎসে যায় না। সকলেই পূর্বপুরুষগণের কতকগুলো আচার অনুমোদন করেই সন্তুষ্ট থাকে। তারা চায় অপরেও তাই করুক। আত্ম অনুভূতি এবং উপলব্ধি না করে অথবা আত্ম বা গুরু দর্শন না করে ধর্ম-ধর্ম করার অধিকার কি মানুষের আছে? গুরুকে দর্শন করতে হবে; আত্মকে উপলব্ধি করতে হবে। জীবনের বর্তমান অবস্থায় ভয়ানক অশান্তি উপস্থিত হয়, যখন নিজের জীবনের পারিপার্শ্বকতার ওপরও আর মমতা থাকে না, যখন মিথ্যার ওপর ভয়ানক ঘৃণা উপস্থিত হয়, যখন প্রবঞ্চনার ওপর ভয়ানক বিতৃষ্ণা জন্মায়, তখনই ধর্মের শুরু হয় নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে।

আমরা সবাই জানি….১৪


গুরুকে যে মানুষ যেভাবে চায় অর্থাৎ গুরুর কাছ থেকে যে মানুষের যে ধরনের আকাক্সক্ষা সে সেই রকমের জিনিসই পায়। চাইতে হয় সতর্কভাবে। মানুষ তার ভক্তির স্তর অনুযায়ী তার চাওয়াটা নির্ধারণ করে, কারণ ভক্তি যদি খুব বেশী স্বার্থপ্রণোদিত হয়, তাহলে সে কী চাইবে? না, অমুক লোকটা আমাকে বড্ড জ্বালাতন করছে, অমুক ভাড়াটেটা কিছুতেই উঠতে চাইছে না, অমুক আমার শত্রু অতএব, হে গুরু ওকে শেষ করে দাও, নিপাত করে দাও। এখন কেউ যদি বলে হে গুরু লোকটা আমার শত্রু, তুমি ওকে শেষ করে দাও, গুরুকেও তো বুঝে-সুঝে কাজ করতে হবে, কারণ শত্রুও তো বলবে হে গুরু, আমার শত্রুটাকে শেষ করে দাও। তাই গুরুর পক্ষে মুশকিল হলো কোন্ কুল তিনি রাখবেন, কার মনোরঞ্জন করবেন তিনি। তাঁকে সামলে চলতে হচ্ছে সকল দিক। সুতরাং কেউ যদি গুরুকে বলে আমার শত্রু নিপাত করে দাও, আমার পথের কাঁটাটি সরিয়ে দাও, তাহদলে গুরু যা ভাল বুঝবেন তা-ই করবেন। তবে একথা ঠিক, এই শ্রেণীর ভক্তরা কখনও গুরুকে কোন দিন কাছে পাবে না কারণ সে তো গুরুকে চায়নি। যখন চায়নি তখন নিশ্চয়ই তা’ সে পাবে না। মা রান্না করছেন, শিশু চীৎকার করছে। ছোট্ট ছেলে মা তাকে একটা খেলনা দিয়ে, লাল রঙের কোন একটা জিনিস দিয়ে ভুলিয়ে বসিয়ে রেখে আবার কাজ করতে চলে গেলেন। কিন্তু শিশু যদি জেদী হয়, খেলনা না নিয়ে সে যদি কেবল মাকেই চায়, তখন মায়ের মহা মুশকিল। কিছুক্ষণের জন্যে রান্না বন্ধ রেখেও ছেলেকে নিয়ে ভোলাতে হবে। আদর করতে হবে। এছাড়া অন্য কোন পথ নেই। নইলে চীৎকার করে সে পাড়া মাৎ করবে। পাড়ার লোকেরা বলবে, কী রকমের মা রে বাবা! ছেলের দিকে তাকায় না! যারা চায় শত্রু নিপাত করে দাও, গুরু তার শত্রু নিপাত করুন আর নাই করুন, সে গুরুকে পাবে না। এতে কোন সংশয় নেই। সুতরাং চাওয়াটা খুব সতর্কতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে।
আবার কেউ কেউ বলে না, না, শত্রুর নিপাত চাই না, আমার খুব উন্নতি হোক, আর্থিক উন্নতি হোক, চাকরি-বাকরির উন্নতি হোক। চাকরি-বাকরির উন্নতি চাইছে, এমন লোকও তো অনেক রয়েছে সেক্ষেত্রে কাকে রেখে কাকে দেবেন! ওপরের পদ একটাই, সেটা কাকে দেবেন, কাকে দেবেন না! তিনি সেক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী হয়তো ব্যবস্থা করে দেবেন। তা যা চাওয়া হচ্ছিল তা, সে পেতেও পারে, নাও পেতে পারে। তবে একথা ঠিক, সে গুরুকে পাবে না কারণ সে তো গুরুকে চায়নি।
প্রথমোক্তটায় যারা শত্রুর নিপাত চায়, তাদের বলা হয় মূর্খ ভক্ত। আর যারা চায় আমার এই উন্নতি হোক, তারা মূর্খ ভক্ত নয়, কারণ তার দ্বারা অপরের ক্ষতি হচ্ছে না কিন্তু তারা যে জিনিসটা চাইছে, সেটা যুক্তিসঙ্গত হতেও পারে, আবার নাও হতেও পারে। মানুষের কাছে তার স্বার্থটা যখন খুব বড় হয়ে ওঠে, তখন যুক্তি তার কাছে থাকে না। এরা হলো আড়ম্বরপূর্ণ ভক্ত। এর চেয়েও উঁচু দরের ভক্ত আছেন তারা বলেন, কিচ্ছু চাই না, শুধু তোমার সংস্পর্শ-সান্নিধ্য-স্মরণে হে গুরু এবার মুক্ত হওয়ার পথ দেখাও যাতে দেহকে দ্রবীভূত করে নৈসর্গিক স্পন্দনের এক সাধারণ পুঞ্জের মধ্যে বিলীন হতে পারি।
প্রতিটি মানুষ সকল সম্ভাব্য উপায়ে এক পৃথক সত্তায় গঠন। একটি মানুষ যে অন্য সকলের থেকে পৃথক, অহংই এই ভাবটি সৃষ্টি করে। নিশ্চিত রূপেই অহং এই ভাবটি উদ্রেক করে, আমি আছি, আমি চাই, আমি করি, আমি অস্তিত্বশীল। এমন কি আমি চিন্তা করি তাই আমি অস্তিত্ববান, এটিও হলো অহং। যা থেকে আমার ধারণা হয় যে আমি হলেম মনোজ, তা হলো অহং। অহং, যা আমাকে দেয় এক যথাযথ আকার, নির্দ্দিষ্ট চরিত্র, এক পৃথক চেতনা, এই বোধ যে আমি সকলের থেকে স্বতন্ত্রভাবে নিজেতে সত্তাবান। কেউ নিজের অহংকে একটু বেশী তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলে তাহলে সে প্রাণিক ও মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আবার এক আকারহীন পিন্ডে পরিণত হবে। নিশ্চিতভাবেই অহং হলো স্বাতন্ত্রীকরণের সহায়ক। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত এক ব্যক্তিসত্তা নিজের মধ্যে এক স্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ অহং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। যদি কারুর শক্তি থাকে সময় পূর্ণ হবার আগেই অহংকে বিলুপ্ত করে দেয়ার, সেক্ষেত্রে তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হবে। কিন্তু একবার যখন ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়ে যায়, তখন এবং অপ্রয়োজনীয় এমনকি ক্ষতিকরও হয়। তখনই সেই সময় আসে যখন অহংকেও ত্যাগ করা উচিৎ। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই যেহেতু আমাকে গড়ে তুলতে সে এত পরিশ্রম করেছে, এত সহজে সে তার কাজ ছেড়ে দেবে না। সে চাইবে তার পরিশ্রমের পুরস্কার তা হল স্বাতন্ত্র্যকে উপভোগ করা। স্বার্থপরতা ও অহমিকা হলো এমন একটি বস্তু যাকে সংশোধন করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কারণ সবাই জানে স্বার্থপরতা ও অহমিকা কাকে বলে। সেটাকে আবিষ্কার করাও সহজ, সংশোধন করাও সহজ, অবশ্য সত্যিই কেউ তা করতে রাজী হলে এবং সে জন্যে লেগে পড়ে থাকলে, তবেই।
অহংকারকে উপলব্ধি করা বেশী শক্ত। কারণ ও যে কি বস্তু, তা উপলব্ধি করতে পারার আগে, নিজেকে সম্পূর্ণ অহঙ্কারমুক্ত হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে পারা চাই, নইলে তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। মানুষের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সবটা, বাহ্য চেতনা থেকে আধ্যাত্মিক চেতনা পর্যন্ত সমস্ত কিছু অহংকারের সঙ্গে মিশে এক হয়ে রয়েছে। এমন কিছুই নেই যার সঙ্গে অহংকার মিশে নেই। তাই ও যে কি বস্তু তা মানুষ বুঝতেই পারে না। আগে ওকে নিয়ন্ত্রণ করা চাই, ওর থেকে বেরিয়ে আসা চাই, নিজেকে ওর থেকে খানিকটাও অন্তত মুক্ত করা চাই, তা যদি নিজের সত্তার ক্ষুদ্রতম কোন একটি অংশেও হয়, তা হলেও শুরু করলে, তখন বুঝতে পারা যায় অহংকার কি।
যে বস্তু আমাদের স্বতন্ত্র ব্যক্তি হয়ে উঠতে সাহায্য করে এবং একইসঙ্গে আবার আমাদের উর্দ্ধমুখী চৈতন্য হয়ে উঠতে বাধা দেয় সেই হলো অহংকার। এ দুটিকে একসঙ্গে করলে অহংকে দেখতে পাওয়া যায়। অহং না থাকলে, জগৎ এখন যেভাবে গড়ে উঠেছে তাতে স্বতন্ত্র ব্যক্তি বলে কিছু থাকত না। অহং আছে বলে, বিশ্বজগৎ শান্তিময় হয়ে উঠতে পারছে না।

আমরা সবাই জানি….১৩


যতটুকু দরকার তার বেশি কিছুই না নেয়া উত্তম। একজনকে লক্ষ্য করা চাই, ধ্রুবতারা ঠিক রাখলে প্রবল ভোগের ইচ্ছাও অবসান হয়। মানুষের অতীত চিন্তাসমূহের পরিণতি, মানুষ এখন যা তাই। বর্তমান মানুষের চিন্তা-ভাবনায় নির্মিত এবং তার দ্বারাই গঠিত। যে বিষয়ে মানুষ সর্বাধিক সময় ও সর্বাধিক আগ্রহ সহকারে চিন্তা করে অবসর মুহূর্তেও তা অবাধে আবর্তিত হয়। দুঃখ হতে পরিত্রাণ পেতে ও সুখের আশায় মানুষ বৃথাই ঘুরে ফেরে, তারা তাদের চিন্তাজগৎকে শুদ্ধ করে না, যা একরৈখিক যাত্রাপথে পবিত্রতার অলৌকিক নির্যাস। মানুষ তার চিন্তার সমষ্টিস্বরূপ। অন্তরের গভীরে নিষ্ঠার সাথে এক চিন্তা ব্যতিরেকে সে সুন্দরতর, মহত্তর অথবা বলবান কিছুই ধারণা করতে সক্ষম হয় না। চিন্তা সৃজনশীল শক্তি।
কর্মের চেয়ে চিন্তা অধিকতর সৃজনশীল। কর্ম ফলোৎপাদক এবং সক্রিয়। যে প্রকৃতই চিন্তা করে সে অলস হতে পারে না। এক লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে যার চিন্তা মহান ও আকর্ষণীয় আদর্শসমূহের আধাররূপে পর্যবসিত তার সমগ্র সত্তা দ্বারাই কর্ম রূপায়িত হতে থাকে। চিন্তা ও কর্মের বিষম-ভাব দ্বারা মানুষ জীবন চলার পথে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। কেউ সুখী হবার ভান করতে পারে, কিন্তু যখন তার চিন্তাসমূহ অসুখী হয়, সে বেশিদিন এই মেকিভাব বজায় রাখতে পারে না, চিন্তা ও কার্যের সমন্বয়ের অনুপাতের উপর মানুষের সকল শক্তি নির্ভরশীল। সমৃদ্ধ চিন্তা দ্বারাই মানুষ তাদের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত শক্তি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং নিজেদের সম্পর্কেও সচেতন হয়। মানুষ চিন্তা করুক সে নিজে যা তা-ই নিয়ে। অন্য কিছু নিয়ে নয়।
চিন্তার শৈলী। যে চিন্তা করার প্রণালীগুলো আয়ত্ত করতে পেরেছে, যার নিমগ্নতার কাল এক লক্ষ্যে বহমান এবং উর্দ্ধমুখী হয়েছে বা হচ্ছে, সে কখনও বিচলিত হয় না। এরূপ মানুষ চিন্তার প্রবাহ দ্বারা পরিচালিত হয়। এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন অন্তরজগৎ আনন্দে পরিপূর্ণ হয় এবং মহাশক্তির প্রবল স্ফূরণ ঘটে। সময়ের সাথে সাথে চিন্তা করার কৌশলগুলো রপ্ত করা ছাড়া আর কিছুই নাই। সূক্ষ্ম, শক্তিশালী, সুসংহত ও অবিরাম চিন্তা, যে চিন্তার কোন ছেদ নাই, তাই হল উর্দ্ধমুখী চেতনা। যা দৃঢ়ভাবে কোন বিষয়ে কোন বিশেষভাবে বা আদর্শে সংলগ্ন থাকে, যা যে কোন প্রকার জটিল বা অসুবিধাকর পরিস্থিতিতেও অবিচলিত ও অপরাজিত থাকে।
চিন্তা জগতে যে তার মেরুদন্ডটা যত শক্ত করতে পারে, গুরুর চরণে তার আত্মবিসর্জ্জনের মূল্য ততো বেশী, তার উৎসর্গে জগতের ততো বেশী কল্যাণ। ‘শেষটা দেখে ছাড়ব’ গুরুর সাথে একাত্মতা, এই পণ করে যারা কাজে নামে, বুদ্ধির জোর না থাকলেও, একমাত্র আগ্রহের জোরে, একনিষ্ঠার বলে তারা উর্দ্ধমুখী হয়। সাহসের সাথে একমাত্র সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই সিদ্ধিলাভ । মেরুদন্ড বাঁকা করে না, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে, সদর্প-দৃষ্টিতে বিশ্বটাকে দেখতে হয়।
মানুষকে ধর্মহীন এবং পাপী বলাই এক মহাপাপ। মানুষের যথার্থ স্বরূপের ওপর এটা মিথ্যা কলঙ্কারোপ। মানুষ-প্রকৃতির মধ্যে যা কিছু শক্তিশলী, যা কিছু মঙ্গলময় এবং যা কিছু ঐশ্বর্যবান, সে-সবই ওই এক সত্তা হতে উদ্ভূত এবং সুপ্তভাবে বিরাজমান, মানুষে মানুষে কোন প্রভেদ নাই, কারণ ‘এক’ অভিন্ন। প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকের পরস্পরের মধ্যে যে পার্থক্য, তা ঐশী সম্ভাবনাকে প্রকাশ করবার সময় ও পরিবেশের তারতম্যের দরুন ঘটছে।
নিজের অনন্ত শক্তি যখন জড় বস্তুর ওপর পড়ে, তখন জাগতিক উন্নতি হয়; যখন নিজের আলো চিন্তার ওপর নিক্ষিপ্ত হয়, তখন চিন্তাশক্তি বিকশিত হয়; আর নিজ যখন ওই-শক্তিকে নিজের ওপর প্রয়োগ করে, তখন নিজ হয়ে যায় একের সাথে একাত্ম। গুরুর উপদেশ অনুস্মরণ করে নিজের ঐশী শক্তি ও দিব্যসত্তাকে উপলব্ধি করা যায় এবং প্রকাশ করা যায়।
মানুষের চরম লক্ষ্য সুখ নয়, জ্ঞান নয়, একের সাথে একের একাত্মতা, প্রেমজগতের মাঝে ডুবে থাকা। সুখ ও দুঃখ ক্ষনস্থায়ী, কালে কালে তা হয় কালেতে বিলীন। জীবনের অর্ঘ্য গুরুর চরণে অর্পণ করা ভক্তের জীবনের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। তারপরে নির্ম্মাল্য হয়ে জগতের প্রতিজনের সংস্পর্শে আসা। অকপটে যে জীবন গুরুতে উৎসর্গীকৃত হয়েছে, গুরুর সংস্পর্শে যে যখনি আসুক, নির্ম্মাল্যের পবিত্রতাকে সম্মান করে চলতে সে ব্যাকুল । ভক্ত গুরুকে দেখতে পায় আবার পায় না। সত্য-পবিত্রতা এবং রূপে-ভাবে যে প্রভা গুরু বিকিরণ করে যাচ্ছেন, তা উর্দ্ধমুখী ভক্ত অনুভব করতে পারেন এবং তাঁর নির্যাস সৌরভ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। যে যতটুকু অনুভবে, উপলব্ধিতে পবিত্র হয়েছেন, সে ততটুকু গুরুর সাথে একাত্ম, সে ততটুকু উন্নত, সে ততটুকু আদরণীয় গুরুর কাছে।