শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

চেতনায় হালচাল – ৩

সময়ের সাফ কথা…. 

চেতনায় হালচাল – ৩

সংলাপ ॥ বিরোধীদের জয়কে ছোট করে দেখতেই হয় রাজনীতির দস্তুর। সুতরাং জাপার সন্ধির মধ্যে কতটা সুবিধাবাদিতা, কত নড়বড়ে জোট, কত পশ্চাদপর এই সংকীর্ণ স্বার্থভিত্তিক অঙ্ক এবং অভিযোগের বন্যা। সত্য কথা, ভোটকে কী ভাবে ‘ট্রান্সফার’ বা স্থানান্তর করে ভোটের ফলে পরিবর্তন আনা সম্ভব, আবারও সেই অঙ্কে পারদর্শিতার প্রমাণ রাখলেন এরশাদ। সম্পর্কে টালমাটাল, ভবিষ্যতে সমস্যার সম্ভাবনাও আছে। তবু অভিযোগ আছে। সুবিধাবাদিতা, অঙ্কের হিসাব, সংকীর্ণ স্বার্থের চর্চা, এই সমস্ত ‘গুণাবলি’ই  রাজনীতিরও বৈশিষ্ট্য। মাত্র কিছুদিন আগেই নির্বাচনে জয় জাপার নির্বাচন-কৌশল বলা যেতে পারে। বলা যেতে পারে কৌশলে জিতে গেলো না কি দুর্নীতি!
ফলাফল বুঝিয়ে দিল, বাঙালি সমাজের মধ্যে কত বিচিত্র রাজনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। নানাবিধ স্বার্থ ও সত্তাবোধে বিভক্ত সমাজে রাজনৈতিক জয়-পরাজয় অনেকাংশেই কৌশল ও অঙ্কের হিসাবের প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের মতো বৃহৎ ও সুসংগঠিত দল না হয়েও সে হিসাব মেলানো যায়, বহু স্বার্থকে এক মঞ্চে আনা যায়। যে দল আজ অপরাজেয়, সে দলেরও স্তম্ভিত করে দেয়া যায়। রাজনীতি একটা সম্ভাবনার শিল্প। আর বাংলার মাটিতে রাজনীতি অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারার উপযুক্ত শিল্প। ভোট-বোঝাপড়ার শক্তি আসে জোট দলগুলোর সমর্থক সমাজ হতে। যখন জনতা জোটের বিরুদ্ধে তিতিবিরক্ত-বিক্ষুব্ধ তখন স্বেচ্ছাচার ও দমনপীড়ন দিয়ে সরকারি দলের একাংশের রাজনীতিকরা নিজেদের বিরুদ্ধতার বলয় অনেক দূর প্রসারিত করছেন। বিভিন্ন অক্ষের বিরোধীদের মিলিত হবার অবকাশটিও তৈরি করে দিচ্ছেন যা কাংখিত নয়।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কট্টরপন্থী মনোভাবই বর্তমানে গোটা বিশ্বের সামনে অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তরুণদের মধ্যে চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেয়াটা এখন একটা ট্রেন্ড-এ পরিণত হয়েছে। গোটা বিশ্বের কাছে এটা একটা বড় সমস্যা। বিশ্বের কয়েকটি দেশ সন্ত্রাসবাদীদের আর্থিক মদত ও সুরক্ষা দিয়ে চলছে।
আর এটাই সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্তে সাহায্য করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় একের পর এক সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনের উত্থান বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের চরিত্রটাই আমূল বদলে দিয়েছে। জঙ্গিরা এখন অপরাধজগতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করছে। সেখানে অস্ত্র, মাদক পাচারকারী থেকে সংগঠিত অপরাধ গোষ্ঠীর লোকজনদের সোর্স করা হচ্ছে। বিভিন্নরকম হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থের আদান-প্রদান ঘটছে। আর এভাবেই স্বশরীরে উপস্থিত না থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে যেকোনও দেশে সন্ত্রাস ছড়াতে পারছে জঙ্গিরা।
ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি দেশ এই সমস্যাটিকে চিহ্নিত করে তার সমাধানে তৎপর হয়েছে। বাংলাদেশ ঠিক সময়ে এইধরনের কয়েকটি গোষ্ঠীর পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে সক্ষম হয়েছে, যারা দেশের মাটিতে সন্ত্রাস ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল। শুধু আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী বিরোধীরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর সঙ্গে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে পাক মদতপুষ্ট বিভিন্ন তথাকথিত ইসলামিক গোষ্ঠীরা। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমকে চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। আইএস সারা বিশ্বে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবী মুসলমান, মেধাবী তরুণদের মগজধোলাই থেকে সংগঠনে নিয়োগ করা সবই সামাজিক মাধ্যমে করে থাকে আইএস। এ বিষয়টার ওপরও বাংলাদেশ সরকার তীক্ষ্ম নজর রাখুক এটাই সময়ের দাবী।
ভদ্রলোকদের সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে সমাজে বলা হচ্ছে যাদের চালচলন, সহবত, পোশাক, কথাবার্তা, বসবাসের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, পেশা ও সঙ্গ ইত্যাদির মাধ্যমে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। ভদ্রলোকদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক শোভনতা। ভদ্রলোক সমাজ একদম প্রথম থেকেই নিজেদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা, বিদ্রুপ, উপহাস, সমালোচনা করেছে। মজা হলো, ভদ্রলোক কিন্তু সব সময় অর্ধেক মেকি এবং অর্ধেক আসল। রাজনীতি ও ধর্ম ভদ্রলোকদের মধ্যে প্রাচীর তুলে দিয়েছে। ভদ্রলোকশ্রেণী চিহ্নিত তাদের আচরণ, সহবত, শিষ্টতা, মার্জিত রুচি, ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে।
ভদ্রলোকশ্রেণী পরিবর্তনের চলমান ধারায় তৈরি হয়েছেন দলদাসবৃত্তির জন্য। এদের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, চিত্রপরিচালক, অভিনেতা সকলেই ছিলেন। পরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতেই এরাই আবার অন্য শাসক দলের দলদাসবৃত্তি করতে থাকেন। উনিশ শতকে বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের জীবন কাটত দল ও দলপতির অধীনে। দলপতি ছিলেন দলস্থ সকলের জাতি, জীবন ও ধর্মের রক্ষক ও ভক্ষক। এই দল বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পার্টি হয়ে গেল, বাঙালি ভদ্রলোকশ্রেণী দলদাসই থেকে গেলেন। দলাদলি ও দলদাসত্বের শিকড় বাঙালি ভদ্রলোকদের সমাজজীবনের খুব গভীরে প্রোথিত। বাঙালি ভদ্রলোকরা নিজেদের সমাজ ও জীবনে দলকে অতিক্রম করতে পারেননি। এই শ্রেণি আটকে রয়েছেন সেই দলাদলির কর্দমাক্ত জমিতে। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণী আসলে দলের অধীনেই থাকতে অভ্যস্ত, দলের ছত্রছায়ায় এই ভদ্রলোকরা নিরাপদ বোধ করেন, নিজের স্বার্থকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।
দলতন্ত্রের অধীন এই ভদ্রলোক সমাজ তাই কোনও ক্ষমতাই অর্জন করতে পারেনি। পরনির্ভর, পরমুখাপেক্ষী, দল, গোষ্ঠী, পার্টি-নির্ভর মানুষ কোনও ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। এই কারণে বাঙালি ভদ্রলোকেরা কোনও স্বাধীন নাগরিক সমাজ গড়ে তুলতে পারেননি। একটা বয়সে মানুষকে পরিবারের গণ্ডি অতিক্রম করে নাগরিক সমাজ থেকে শিক্ষা নিতে হয়। সমাজে নীতি নির্ধারনে নাগরিক সমাজের কেন্দ্রীয় ভূমিকা আছে। নাগরিক সমাজ গড়তে ব্যর্থতা, দলাদলি, দলের অধীনতা মেনে জীবন-যাপন বাঙালি ভদ্রলোকদের শুধু ক্ষমতাহীন করে রাখেনি, আধুনিকও হতে দেয়নি। জ্ঞান বুদ্ধি মেধা যুক্তির মাধ্যমে যে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা অর্জন করা যায়, বাঙালি ভদ্রলোকরা সেটা কোনও দিন বোঝেননি এবং শেখেনওনি। এই গন্ডি, এই বেড়ি ভেঙে বেরিয়ে আসতে গেলে দলতন্ত্রকে, দলদাসতন্ত্রকে বর্জন করার সাহস দেখাতে হয়। নিজের চিন্তাভাবনা যুক্তিবোধের উপর বিশ্বাস করার সাহস রাখতে হয়। এই সাহস বাঙালি ভদ্রলোকরা আজো অর্জন করতে পারেননি।
রাজনীতিতে মূল আদর্শ-সংকটটা রয়েই গেছে। যত দিন পর্যন্ত না আমলারা নিজেদের কেবল দক্ষতার যন্ত্র হিসাবে মেনে নিবেন, এবং কোনও রাজনীতির নিকট প্রণিপাত ছাড়াই নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারবেন, তত দিন চড়-থাপ্পড় না হলেও প্রশাসনিক পঙ্গুত্বের সম্ভাবনা থেকেই যাবে। আমলাদের নিরপেক্ষতা হওয়া উচিত এমনই যাতে রাজনীতির ছোঁয়া তাদের ছুঁতে আসলেও তারা ধরা না দেন। আর ক্ষমতাসীন দলের উচিত, গণতান্ত্রিক আদর্শ মেনে আমলাদের রাজনীতির ছোঁওয়ার বাইরে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে দেয়া।
দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হোক। একথা ঠিক আইনের চোখে সবাই সমান। গদিতে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে যেনতেন প্রকারে ভ্রান্ত অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে জেলের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি করে রাখাও সমান অপরাধ। এই প্রতিহিংসার লড়াই চলতে থাকলে আখেরে দেশেরই ক্ষতি। এতে সাময়িক রাজনৈতিক লাভ হলেও দেশের মূল সমস্যাগুলোর কোনও সমাধান হয় না। সরকার এবং বিরোধীপক্ষের আকছা-আকছিতে দেশও পিছিয়ে যায়। উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বেকার সমস্যা, দারিদ্র, খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সঙ্কটে সাধারণ মানুষ জেরবার, সেখানে ধনী কিছু রাজনীতিকের স্বার্থে দুর্নীতি-দুর্নীতি, চোর-পুলিশ খেলা দেশের মানুষের পক্ষে মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। এই সর্বনেশে খেলা অচিরেই বন্ধ হওয়া উচিত।
জাতির নামে, ধর্মের নামে, রাষ্ট্রের নামে, ভাষার নামে, রাজনীতির নামে যে সব ‘অহঙ্কার’ বিভিন্ন সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এই বাঙালি সমাজে, সে সব ‘অহঙ্কার’ বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনেনি। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত হত্যালীলাগুলোর অন্যতম সেই নিধন যজ্ঞগুলোর সমর্থনেও ‘যুক্তি’ দেখিয়েছিল হত্যাকারী দল। ইতিহাস সাক্ষী, বিশ্ব কিন্তু সেই ‘যুক্তি’র পাশে এসে দাঁড়ায়নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন