বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি….১৩


যতটুকু দরকার তার বেশি কিছুই না নেয়া উত্তম। একজনকে লক্ষ্য করা চাই, ধ্রুবতারা ঠিক রাখলে প্রবল ভোগের ইচ্ছাও অবসান হয়। মানুষের অতীত চিন্তাসমূহের পরিণতি, মানুষ এখন যা তাই। বর্তমান মানুষের চিন্তা-ভাবনায় নির্মিত এবং তার দ্বারাই গঠিত। যে বিষয়ে মানুষ সর্বাধিক সময় ও সর্বাধিক আগ্রহ সহকারে চিন্তা করে অবসর মুহূর্তেও তা অবাধে আবর্তিত হয়। দুঃখ হতে পরিত্রাণ পেতে ও সুখের আশায় মানুষ বৃথাই ঘুরে ফেরে, তারা তাদের চিন্তাজগৎকে শুদ্ধ করে না, যা একরৈখিক যাত্রাপথে পবিত্রতার অলৌকিক নির্যাস। মানুষ তার চিন্তার সমষ্টিস্বরূপ। অন্তরের গভীরে নিষ্ঠার সাথে এক চিন্তা ব্যতিরেকে সে সুন্দরতর, মহত্তর অথবা বলবান কিছুই ধারণা করতে সক্ষম হয় না। চিন্তা সৃজনশীল শক্তি।
কর্মের চেয়ে চিন্তা অধিকতর সৃজনশীল। কর্ম ফলোৎপাদক এবং সক্রিয়। যে প্রকৃতই চিন্তা করে সে অলস হতে পারে না। এক লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে যার চিন্তা মহান ও আকর্ষণীয় আদর্শসমূহের আধাররূপে পর্যবসিত তার সমগ্র সত্তা দ্বারাই কর্ম রূপায়িত হতে থাকে। চিন্তা ও কর্মের বিষম-ভাব দ্বারা মানুষ জীবন চলার পথে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। কেউ সুখী হবার ভান করতে পারে, কিন্তু যখন তার চিন্তাসমূহ অসুখী হয়, সে বেশিদিন এই মেকিভাব বজায় রাখতে পারে না, চিন্তা ও কার্যের সমন্বয়ের অনুপাতের উপর মানুষের সকল শক্তি নির্ভরশীল। সমৃদ্ধ চিন্তা দ্বারাই মানুষ তাদের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত শক্তি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং নিজেদের সম্পর্কেও সচেতন হয়। মানুষ চিন্তা করুক সে নিজে যা তা-ই নিয়ে। অন্য কিছু নিয়ে নয়।
চিন্তার শৈলী। যে চিন্তা করার প্রণালীগুলো আয়ত্ত করতে পেরেছে, যার নিমগ্নতার কাল এক লক্ষ্যে বহমান এবং উর্দ্ধমুখী হয়েছে বা হচ্ছে, সে কখনও বিচলিত হয় না। এরূপ মানুষ চিন্তার প্রবাহ দ্বারা পরিচালিত হয়। এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন অন্তরজগৎ আনন্দে পরিপূর্ণ হয় এবং মহাশক্তির প্রবল স্ফূরণ ঘটে। সময়ের সাথে সাথে চিন্তা করার কৌশলগুলো রপ্ত করা ছাড়া আর কিছুই নাই। সূক্ষ্ম, শক্তিশালী, সুসংহত ও অবিরাম চিন্তা, যে চিন্তার কোন ছেদ নাই, তাই হল উর্দ্ধমুখী চেতনা। যা দৃঢ়ভাবে কোন বিষয়ে কোন বিশেষভাবে বা আদর্শে সংলগ্ন থাকে, যা যে কোন প্রকার জটিল বা অসুবিধাকর পরিস্থিতিতেও অবিচলিত ও অপরাজিত থাকে।
চিন্তা জগতে যে তার মেরুদন্ডটা যত শক্ত করতে পারে, গুরুর চরণে তার আত্মবিসর্জ্জনের মূল্য ততো বেশী, তার উৎসর্গে জগতের ততো বেশী কল্যাণ। ‘শেষটা দেখে ছাড়ব’ গুরুর সাথে একাত্মতা, এই পণ করে যারা কাজে নামে, বুদ্ধির জোর না থাকলেও, একমাত্র আগ্রহের জোরে, একনিষ্ঠার বলে তারা উর্দ্ধমুখী হয়। সাহসের সাথে একমাত্র সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই সিদ্ধিলাভ । মেরুদন্ড বাঁকা করে না, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে, সদর্প-দৃষ্টিতে বিশ্বটাকে দেখতে হয়।
মানুষকে ধর্মহীন এবং পাপী বলাই এক মহাপাপ। মানুষের যথার্থ স্বরূপের ওপর এটা মিথ্যা কলঙ্কারোপ। মানুষ-প্রকৃতির মধ্যে যা কিছু শক্তিশলী, যা কিছু মঙ্গলময় এবং যা কিছু ঐশ্বর্যবান, সে-সবই ওই এক সত্তা হতে উদ্ভূত এবং সুপ্তভাবে বিরাজমান, মানুষে মানুষে কোন প্রভেদ নাই, কারণ ‘এক’ অভিন্ন। প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার রয়েছে। প্রত্যেকের পরস্পরের মধ্যে যে পার্থক্য, তা ঐশী সম্ভাবনাকে প্রকাশ করবার সময় ও পরিবেশের তারতম্যের দরুন ঘটছে।
নিজের অনন্ত শক্তি যখন জড় বস্তুর ওপর পড়ে, তখন জাগতিক উন্নতি হয়; যখন নিজের আলো চিন্তার ওপর নিক্ষিপ্ত হয়, তখন চিন্তাশক্তি বিকশিত হয়; আর নিজ যখন ওই-শক্তিকে নিজের ওপর প্রয়োগ করে, তখন নিজ হয়ে যায় একের সাথে একাত্ম। গুরুর উপদেশ অনুস্মরণ করে নিজের ঐশী শক্তি ও দিব্যসত্তাকে উপলব্ধি করা যায় এবং প্রকাশ করা যায়।
মানুষের চরম লক্ষ্য সুখ নয়, জ্ঞান নয়, একের সাথে একের একাত্মতা, প্রেমজগতের মাঝে ডুবে থাকা। সুখ ও দুঃখ ক্ষনস্থায়ী, কালে কালে তা হয় কালেতে বিলীন। জীবনের অর্ঘ্য গুরুর চরণে অর্পণ করা ভক্তের জীবনের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। তারপরে নির্ম্মাল্য হয়ে জগতের প্রতিজনের সংস্পর্শে আসা। অকপটে যে জীবন গুরুতে উৎসর্গীকৃত হয়েছে, গুরুর সংস্পর্শে যে যখনি আসুক, নির্ম্মাল্যের পবিত্রতাকে সম্মান করে চলতে সে ব্যাকুল । ভক্ত গুরুকে দেখতে পায় আবার পায় না। সত্য-পবিত্রতা এবং রূপে-ভাবে যে প্রভা গুরু বিকিরণ করে যাচ্ছেন, তা উর্দ্ধমুখী ভক্ত অনুভব করতে পারেন এবং তাঁর নির্যাস সৌরভ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। যে যতটুকু অনুভবে, উপলব্ধিতে পবিত্র হয়েছেন, সে ততটুকু গুরুর সাথে একাত্ম, সে ততটুকু উন্নত, সে ততটুকু আদরণীয় গুরুর কাছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন