বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ২৬


আধ্যাত্মিক সাধনার পথে যাত্রা আরম্ভ করার আগে নিজেকে নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। শ্রীগুরুর উপদেশ অতি অবশ্য পালনীয়। উপদেশ যতদিন অন্তরে বদ্ধমূল না হয়-ভক্ত না হয়, ততদিন হাজার বাহ্যিক অনুষ্ঠান সত্ত্বেও কিছুই হবার নয়।
সম্পর্কের ভিত্তি সুদৃঢ় হওয়া প্রয়োজন এবং তা লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে নীতিপরায়ণতার ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। নিজের প্রশান্তির জন্যও এ সব প্রয়োজন, অন্তরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে অনিন্দ্য না বোধ হলে শান্তি বা চিত্ত উপভোগ করা যায় না। আধ্যত্মিক নীতিসমূহের সঙ্গে স্বীয় জীবনচর্যার অনৈক্য থাকলে, হাজার মেরুদ- সরল করে বসা ও ধ্যানের চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার আনন্দদায়ক ফল লাভ হবে না। বসাও একটা অভ্যাস। এমনভাবে বসা শিক্ষা করা প্রয়োজন, যাতে দেহবোধ যথাসম্ভব কম হয়; এরূপে চিন্তা শরীরের ভারে অবনত হবে না এবং ক্রমশই অতি সহজেই তা শান্ত হয়ে আসবে। শরীর নিজ বশে না থাকলে চিন্তাজগৎ এবং প্রেমজগৎ যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব নয়: একাগ্রতা লাভই হয় না, সংযোগ-সম্পর্ক তো দূরের কথা। চিন্তার ভারসাম্য বজায় না থাকলে, ক্ষণকালের জন্যও স্থিরভাবে সংযোগ সম্ভব নয়। চিন্তাজগৎ ও শরীরের দৃঢ়তা লাভ করতে হবে। দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর আধিপত্য না থাকলে আধ্যাত্মিক চেতনা লাভ করা যায় না।
শরীরকে স্থির করতে শক্তি প্রয়োগের আবশ্যক হয়। সঙ্কল্প করতে হয়, নির্দিষ্ট ক্ষণে শরীরকে একটি নির্দিষ্ট মুদ্রায় স্থির ও দৃঢ় অবস্থায় ধরে রাখার। দিনের পর দিন এরূপ অভ্যাস করলে, আলস্য ও শারীরিক অস্থিরতা ক্রমশই কাটায়ে উঠতে পারা যায়।
জানা মিশ্রিত-স্বরূপ, সমুদয় বিষয়ানুভূতি পর্যবেক্ষণ ও  বিশ্লে­ষণ থেকেই এসে থাকে। শাস্ত্র বা বই পড়ে দার্শনিক জ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান হয় না, বরং যত বই পড়া যাবে, ততই সব গুলিয়ে যাবে, পরমুখাপেক্ষী হবে। চেতনার অবস্থান ও স্তর সমূহের বিশ্লে­ষণ করে দেখা যায় যে, ইচ্ছা একটা মিশ্রবস্তু, আর যেহেতু প্রত্যেক মিশ্রবস্তু কোন-না-কোন বাহ্য শক্তিবলে বিধৃত থাকে, সেহেতু ইচ্ছার বহিঃস্থ শক্তিসমূহের সংযোগে বিধৃত রয়েছে। এমনকী, যতক্ষণ না মানুষের ক্ষুধা পাচ্ছে, ততক্ষণ সে খাবার ইচ্ছা করতেও পারে না। ইচ্ছা বাসনার অধীন। আমরা সকলেই বিভিন্ন জগৎ দেখছি ও তার অস্তিত্ব অনুভব করছি। ‘ইচ্ছা’-বদ্ধভাবাপন্ন হবার আগে যেরূপ ছিল, তাই মুক্ত স্ব-ভাব। স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা – প্রতিমুহূর্তে দেখাচ্ছে যে, মানুষ বন্ধন কাটাবার চেষ্টা করছে। একমাত্র মুক্ত স্ব-ভাব – তা অনন্ত, অসীম, দেশ-কাল নিমিত্তের বাইরে। মানুষের ভিতর যে স্বাধীনতা রয়েছে, সেটা একটা পূর্বস্মৃতিমাত্র – স্বাধীনতা মুক্তিলাভের চেষ্টামাত্র। দেহজগতে সব শক্তিই ঘুরে ঘুরে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা করছে – তার উৎপত্তিস্থানে যাবার, তার একমাত্র যথার্থ উৎস নিজ-এর কাছে যাবার চেষ্টা করছে। মানুষ যে সুখের অন্বেষণ করছে, সেটা আর কিছু নয় – সে যে সাম্যভাব হারিয়েছে, সেটা ফিরে পাবার চেষ্টা। নীতিপালন, এও বদ্ধভাবাপন্ন ইচ্ছার মুক্ত হবার চেষ্টা, আর এ থেকেই প্রমাণিত, পূর্ণাবস্থা থেকে নেমে আসার।
ক্রিয়া হতে থাক্, কিন্তু প্রতিক্রিয়া যেন না আসে, ক্রিয়া থেকে সুখই হয়ে থাকে, সমুদয় দুঃখ হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার ফল। প্রতিক্রিয়াটা বন্ধ করতে পারলে ভয়ের কারণ কিছু নেই। চিন্তা জগৎকে শ্রীগুরু স্মরণে নিজের বশে নিয়ে আসা, যাতে প্রতিক্রিয়াটা মাথাচাড়া না দিতে পারে। জীবনের সবচেয়ে সুখকর মুহূর্ত সেইগুলো, যখন নিজেকে একেবারে ভুলে থাকা যায়। স্বাধীন-ভাবে নিমগ্ন হয়ে কাজ করা, কর্তব্যের ভার থেকে কাজ করা নয়। দেহজগৎ একটা খেলার মাঠ-এখানে শুধু খেলা আর খেলা। জীবনের রহস্য হচ্ছে নির্ভীক হয়ে খেলা। কি হবে-এ ভয় কখনও করা নয়, কারও উপর নির্ভর করা নয়। যে  মুহূর্তে বাহ্যিক সাহায্য প্রত্যাখ্যান, সেই মুহূর্তেই মুক্তি।
যশের জন্য, বংশমর্যাদার জন্য, ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য কিংবা কারো অনুরোধ-উপরোধে দান করা সঠিক নয়। এরূপ দানে নিজের অকল্যাণ হয়। যথার্থ ভক্তি সহকারে যখন একটা পয়সাও দেয়া যায়, তা শতগুণ হয়ে ওঠে। এ-দানই ধর্মের শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট। দারিদ্র্য ব্যক্তির সৃষ্ট। একমাত্র শ্রীগুরুর আশীর্বাদ-কৃপাপ্রসাদ পেলে দারিদ্র্য নাশ হয়। শ্রীগুরু নাম স্মরণের শক্তিতে সমস্যা খুব দ্রুত কাটে। তিনি সদানন্দময়, কাউকে নিরানন্দে রাখেন না। নিজের মধ্যে সর্বশক্তিগুলোকে জাগ্রত করা দরকার। নিয়ন্ত্রিত-নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, তারপর সেবা। প্রয়োজন অকারণে দিনে দিনে বাড়ানো নয়। বাড়লে সে বোঝার ভারে ক্লান্তি আসে, বিপন্ন হতে হয়। আহার, আমোদ, আহ্লাদ, কিছুই কেউ ভুলে না, শুধু ভুলে থাকে শ্রীগুরুকে। যেখানে ধর্ম সেখানে জয় – ধার্মিককে শ্রীগুরু নিজে রক্ষা করেন।
ভক্তির সাথে শ্রীগুরুকে ডাকলে, তিনি সব ব্যবস্থায় সাড়া দেন। তিনিই প্রকৃত বন্ধু। শিক্ষা পরিবারেই শুরু হয়। পরিবারের কারো সমর্থন না থাকলে ছেলে মেয়েরা বিলাসী, উদ্ধত হতে পারে না। আর এজন্য ঘরে ঘরে দুঃখ, দৈন্য, রোদন, হাহাকার। ভোগ বিলাস নিয়েই ব্যস্ততায় কি কেউ যথার্থ শান্তি, সুখ পেয়েছে? অন্তরের দয়া, প্রেম, ভালোবাসা, প্রীতি -এসব বৃদ্ধি পেয়েছে? শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নত অবস্থা লাভ করেছে? অধিকাংশই অন্তঃসারশূন্য। নিজের মাঝে সত্য প্রতিষ্ঠা ও শ্রীগুরু নামই মানুষের পরম আশ্রয়।
ভক্তের কাছে শ্রীগুরুই সর্বশক্তিমান। তিনি কৃপা করেন, কিন্তু সান্নিধ্য-প্রাপ্তরা মর্যাদা দেন না। শ্রীগুরু  সর্বকালের বন্ধু। শ্রীগুরু নিত্য যুক্ত না থাকলে ভক্তের শান্তি বা আনন্দ নেই। শ্রীগুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারলে আর কিছুই দরকার হয় না। যার মান অপমান কলংক বোধ নেই – তিনিই প্রকৃত শ্রীগুরুতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। শ্রীগুরুর উপদেশ মোতাবেক সদাচার না মানলে নিজধর্ম রক্ষা হয় না। সদাচার পালন না করাতে নাম নিয়েও বিশেষ ফল পাওয়া যায় না। তাই ধর্ম বিরল। কেবল আচার অনুষ্ঠান করলে কি হবে, অন্তরে সত্য ও অহিংসা প্রতিষ্ঠিত না হলে, ধর্মলাভ হয়নি বুঝতে হবে। লোকের কোলাহলে থাকলেও উপলব্ধি করতে হবে ধর্মের চূড়ো কতো উত্তুঙ্গ। ধর্ম মুখের কথা নয়, জীবনের পরম সত্য-পরম চেতনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন