বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ১০


সত্যমানুষ গুরু ঐশী শক্তির অধিকারী। সেই শক্তিগুলো হচ্ছে ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য।
তিনি যখন আবির্ভূত হন তখন মানুষের সমাজে স্পষ্টতই ধ্রুবীকরণ ঘটে যায়। সমাজও দু’টো শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিছু লোক একান্তভাবেই তাঁর নির্দেশ-উপদেশ মেনে কাজ করতে প্রস্তুত থাকে, আর কিছু লোক প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। কেউ যশোগাথা গাইতে থাকে আবার কেউ তাঁর বিরুদ্ধে অপযশ গাইতে থাকে।
তাঁর মধ্যে থাকে প্রচন্ড আকর্ষণী শক্তি। তাই মানুষ তাঁর দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হ’তে থাকে। তাঁর মধ্যে থাকে ‘জ্ঞানের আলো’। জ্ঞান বাহ্যিক বিষয়ের আত্মস্থীকরণ। বাহ্যিক বিষয়ের, বিশ্বব্রহ্মান্ডের আত্মস্থীকরণ যিনি যতটুকু ধারণ করতে পারেন তিনি ততটুকু জ্ঞানবান হয়ে যান। তাঁর মধ্যে থাকে জ্ঞান অর্জনের পথের দিশা। একই সঙ্গে তাঁর মধ্যে থাকে ‘বৈরাগ্য’। সাধারণ মানুষের মনে বৈরাগ্য নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। বৈরাগ্য শব্দের একটা মানে করা হয়েছিল সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে গুহায় বা জঙ্গলে আশ্রয় নেয়া। ধর্ম প্রাকৃতিক এবং স্বভাবজাত। অত্যন্ত স্বাভাবিক জিনিস। ধর্মজগতে সেবা সাধনা ধর্মের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ধর্মাচরণের জন্যে ‘বৈরাগ্য’ এক অত্যাবশ্যকীয় গুণ। ‘বিরাগ’ শব্দটির ভাববাচক বিশেষ্য রূপ হচ্ছে ‘বৈরাগ্য’। বৈরাগ্য’ জাগতিক বিষয়-আশয়ের মধ্যে থেকেও কোন কিছুতেই আসক্ত না হওয়া অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ। চিন্তার নিয়ন্ত্রণ।
শরীর রয়েছে, চিন্তা রয়েছে, সেগুলো অন্তরের বিষয়। দেহ ও চিন্তা ছেড়ে দিতে হলে মানুষ মারা পড়বে। জীবন কর্ম করার জন্যে-বাঁচবার সাধনা করার জন্যে, মৃত্যুর সাধনা করার জন্যে নয়। বৈরাগ্য পার্থিব বস্তুর মধ্যে থাকা কোন বিষয়ের রঙে নিজেকে কখনও রঞ্জিত হতে না দেয়া। জাগতিক বিষয়বস্তুর দ্বারা কখনও প্রভাবিত না হওয়া। জগতের সকল বিষয় নিজের বশীভূত থাকুক, কিন্তু নিজে বিষয়ের বশীভূত না হওয়া। সত্যমানুষ গুরু সেই সত্তা যিনি সমগ্র জীবকুলকে নিজের দিকে আকর্ষণ করছেন। এই জন্যে বলা হয়ে থাকে তিনি এক আকর্ষণী শক্তি। তিনটি বিষয়: গ্রহীতা, গ্রহণ ও কার্য। যে গ্রহণ করছে, জানছে বা দেখছে সেই হল গ্রহীতা, যা দিয়ে দেখছে তাই করণ এবং যা দেখছে তাই কার্য। তাই তিনটিকেই যথাযথভাবে জানতে হয়, আমাদের জানার মধ্যে যে ভেজাল ঢুকে আছে, বোঝার মধ্যে যে সব ভুল মিশে আছে তা দূর করার জন্যে। জীবন চলার পথে চেতনার যে আলো চিন্তা জগতের আয়নায় এসে পড়ছে তাকে একাগ্র ও স্বচ্ছ করে ফেলতে হবে এই তিন স্তরে। সবিতর্ক- নিবিতর্কতায় নিমগ্নতা লাভ হলে আসে বিষয়ের যথার্থ জ্ঞান, সবিচার, নির্বিচারে সূক্ষ্ম বিষয়ের যথাযথ উপলব্ধি, সানন্দ নিমগ্নতা করণ সমূহের পূর্ণ জ্ঞান এবং গ্রহীতার শুদ্ধ রূপ। স্বজ্ঞাত নিমগ্নতা সবগুলোই সাবলম্বন-নিমগ্নতা, অর্থাৎ কোন কিছুকে অবলম্বন করে নিমগ্ন হওয়া, তার সব কিছু তন্নতন্ন করে নিখুঁতভাবে জানা।
নিমগ্নতার অবশ্যম্ভাবী ফল প্রজ্ঞা। যে নিমগ্নতার ফলে প্রজ্ঞা ফোটে না, তা নিমগ্নতা নয়, ব্যাধি। শুধু দেহের স্থির স্পন্দনতাই নিমগ্নতা নয়, এটা তন্ময়তার একটা আনুষঙ্গিক বাহ্যিক লক্ষণমাত্র। তন্ময়তা সেই গভীর অতলে পৌঁছাল কিনা, সেখানে ডুবুরির মতো ডুব দিয়ে প্রজ্ঞার অমূল্য মণি-মাণিক্য, অরূপ-রতন সত্যটা তুলে আনা গেল কিনা, তারই উপর নিমগ্নতার সার্থকতা হয়ে থাকে। নিমগ্নতা সম্বন্ধে এত ভ্রান্ত ধারণা আছে যে, সামান্য হৃদয়াবেগ উচ্চগ্রামে ওঠার ফলে যখন দৃষ্টি স্তিমিত হয়, অঙ্গ শিথিল হয়, তরঙ্গ স্তব্ধ হয়, প্রাণস্পন্দ নিরুদ্ধ হয়, অমনি অনেকে চিন্তা করেন নিমগ্ন হয়েছেন। আমরা ভুলে যাই নিমগ্নতা চেতনার আলোর বিষ্ফোরণ, প্রজ্ঞা জ্যোতির সমুদ্ভাসন, যার ফলে হয় প্রত্যক্ষ দূরদর্শন। এখানেই প্রমাণ। জ্ঞানের যেটি করণ বা সাধন অর্থাৎ উপায়, তারই নাম প্রমাণ। জ্ঞানলাভের মোটামুটি তিনটি হাতিয়ার— প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগমন। কোন কোন দর্শনে প্রমাণের সংখ্যা বাড়িয়ে চার, পাঁচ, ছয়, এমনকি এগারো পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মূলত এই তিনের মধ্যেই সব অন্তর্ভুক্ত। আবার এই-তিনও একে এসেই পর্যবসিত হয় প্রত্যক্ষমূলক প্রমাণ। প্রত্যক্ষকে ভিক্তি করেই… অনুমান ও আগমনের প্রসার ও প্রামাণ্য। চেতনার আলো অন্তরে বিচ্ছুরিত হয়ে বাইরের জগৎকে যতটুকু দেখিয়ে বা জানিয়ে দেয়, তারই উপরই জ্ঞান অর্জনের পথ নির্ভরশীল। তাই জ্ঞান অর্জনের পথ খুবই সংকুচিত ও সীমাবদ্ধ।
দূরের জিনিস বা সূক্ষ্ম জিনিস চোখ দেখতে পারে না, সেখানে অনুমান বা আগমনের আশ্রয়ে জ্ঞান ব্যাপকতা লাভ করে। দূরে যে আগুন আছে ধোঁয়া দেখে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হওয়া যায়। কোন স্থানে নিজে না গিয়েও প্রত্যক্ষ দর্শীর মুখে শুনে সেখানকার যথাযথ জ্ঞান আহরণ করতে পারা যায়। কিন্তু অনুমান ও আগমনের মারাত্মক ত্রুটি হল যে তারা প্রামাণিক হয় বটে, কিন্তু সেটি কী ধরণের গুনাবলীর সমষ্টি তার কোনো বিশেষ পরিচয় অনুমান এনে দিতে পারে না। আগমন সম্বন্ধেও সেই একইকথা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন