শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

চেতনায় হালচাল – ২

সময়ের সাফ কথা…. 

চেতনায় হালচাল – ২

সংলাপ ॥ ভৌগোলিক সীমা, রাজনৈতিক সীমান্ত, সাম্প্রদায়িক রেখা নানা বিভাজনে ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে এই পৃথিবী। সংবেদনশীল মানবতা এই বিভাজন রেখাগুলোর বিপরীতে অবস্থান করে। এ ভাগাভাগিগুলো পৃথিবীকে সীমাবদ্ধ করে দিতে চায়। সংবেদনশীল এবং প্রগতিশীল চিন্তা তাই এই সব ভাগাভাগির ঊর্ধ্বে উঠতে চায়। যত এগোবে সময়, যত আধুনিক হবে সভ্যতা, আমরা ততই বিভাজনগুলোর ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করবো এমনটাই তো কাম্য। তার বদলে বিভাজনের আরও নতুন নতুন রেখা এঁকে দেয়ার চেষ্টা, পৃথিবীটাকে আরও সীমাবদ্ধ করে তোলার চেষ্টা আসলে দেশ ও বিশ্ব সভ্যতার গতির বিপরীতে হাঁটার সামিল।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা ধনীশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন তারা দল পরিচালনা ও নির্বাচনে অঢেল অর্থ ব্যয় করে প্রকারান্তরে পরোক্ষ টাকার জোরে ভোট কেনার ব্যবস্থা করেন। এই দলগুলো কর্পোরেট অর্থে ক্ষমতা দখল করে কর্পোরেট স্বার্থেই সরকারকে উৎসর্গ করেন। পাশাপাশি অঢেল অর্থ ব্যয় করে নির্বাচনী লড়াই জিতে সংসদ-সদস্য হয়ে আখের গোছানোতেই বেশি মনোনিবেশ করেন। দেশের তথা সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজের বিনিময়ে নিজেদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধিতে অগ্রাধিকার দেন। একাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ পথে সংগঠিত হয় বলে সংসদ-সদস্যদের সম্পদ অস্বাভাবিক হারে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এটাও দেখা যায় নির্বাচনে টাকার খেলা অনিবার্য হয়ে ওঠায় আর্থিকভাবে দুর্বল সাধারণ মানুষ নির্বাচনে প্রার্থী হবার সুযোগ পান না। কারণ অঢেল অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় করার ক্ষমতা তাদের নেই। বিত্তবান কোটিপতিরাই এখন বেশি বেশি করে প্রার্থী হচ্ছেন এবং নির্বাচিতও হচ্ছেন।
সমস্ত আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধিই ক্ষমতায় থাকাকালীন অস্বাভাবিক হারে সম্পদ বাড়িয়েছেন। জনপ্রতিনিধিদের যথেষ্ট সম্পদ বৃদ্ধির এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা। বস্তুত জনপ্রতিনিধিত্ব ইদানীংকালে সবচেয়ে লোভনীয় উপার্জনের পেশায় পরিণত হয়েছে। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা আরও বেশি উপার্জনের জন্য বেশি বেশি করে সংসদ-সদস্য হচ্ছেন। দেশবাসী সংগত কারণেই এবং সমর্থন যোগ্যভাবেই চাইছে নির্বাচিত সংসদ-সদস্যদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি, সততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে হোক। কিভাবে তাদের আয় ও সম্পদ বাড়ে তা স্পষ্টভাবে সাধারণের গোচরে থাকুক। অন্যথা হলে পদ খারিজ হোক।
রাজনীতিতে মতভেদ কোনও নতুন বিষয় নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা, বরং রাজনৈতিক ময়দানে বিভিন্ন দল থাকবে, তাদের পরস্পর বিরোধী মতামত থাকবে, এই দৃশ্যই পরিচিত যে কোনও গণতন্ত্রে। কিন্তু আদর্শ বা নীতির ফারাক যতোই থাক, সব রাজনৈতিক সংগঠনই শৃঙ্খলার প্রশ্নে কম-বেশি একই অবস্থানে থাকে। দলে বা সংগঠনে থাকতে হলে দলীয় নীতি-আদর্শই শিরোধার্য করে চলতে হবে, নীতি-আদর্শ-কার্যপ্রণালী নিয়ে প্রশ্ন থাকলে দলের ভিতরে সে বিষয়ে মুখ খুলতে হবে, বাইরে নয়-শৃঙ্খলার মূল কথা এই। সাধারণ কর্মী থেকে দলের শীর্ষ পদাধিকারী, সকলের জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য, কেউই শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে নন। পদ যতো উঁচু হয়, দায়বদ্ধতা ততই বৃদ্ধি পায়।
সাম্প্রতিক নয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে যে পরম্পরা তা হলো, কখনও প্রশাসনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজনীতিকরা, কখনও নিজেদের দলের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, কখনও নিশানা হয়ে উঠেছেন কোনও রাজনৈতিক নেতা। শুধু সামাজিক মাধ্যম নয়, তার বাইরের পরিসরেও রাজনীতিকদের কার্যকলাপ কোন কোন দলের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে একাধিক অবকাশে। রাজনীতিকদের বেফাঁস কথাবার্তা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং দিচ্ছে। কখনও রাজনীতিকদের অন্যদলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার গুঞ্জন তাদের দলের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সর্বশেষ সংযোজন রাজনীতিকরা যুক্তি-তর্ক বা বিচার-বিশ্লেষণের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করছেন না।
কোন দলের নীতি-আদর্শ ঠিক না ভুল, সে নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতিতে অন্তর্দলীয় কোন্দল বা মতবিরোধ কোনও অপরিচিত দৃশ্য নয়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোন্দল বা বিরোধ যে স্বাস্থ্যকরও নয়, সে কথাও উপলব্ধিতে নেই। চিন্তাবিদরা নীতির কথা বলছেন। বলছেন নৈতিকতার সঙ্গে আপোস করতে পারবেন না। যে দলের প্রতীকে একজন নির্বাচন জিতে সংসদ সদস্য হয়েছেন, সেই দলের রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখতে না পারাটা কী খুব নৈতিকতার নিদর্শন বহন করছে? ধরে নেয়া যাক, দলের সঙ্গে তার অনেক কিছুই যে মিলবে না, তা আগে বুঝতে পারেননি তিনি। এখন বুঝতে পারছেন। সে ক্ষেত্রে সংসদ সদস্য পদে ইস্তফা দিয়ে দল ছেড়ে দেয়ার রাস্তা তো খোলা।  কিন্তু সে পথে না হেঁটে, পদ এবং দলীয় সদস্যতা আঁকড়ে থেকে প্রকাশ্যে দলের অস্বস্তি বাড়াতে থাকা কি নৈতিকতা?
আমাদের সদা স্মরণ রাখতে হবে দেশ কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের ৮০ ভাগ কৃষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান কৃষি থেকেই আসে। ব্যবস্থাপনায় ভুল নীতির কারণে কৃষক আজ বিপন্ন। সারাদেশে সেচ সুবিধা ও বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা হয়নি। কৃষি উপকরণ নিয়ে ব্যবসা করছে বহুজাতিক সংস্থা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। ভেজাল সার ও বীজ ব্যবহার করে প্রতি বছর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক। বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিপূরণ পায় না। আলু ও সবজি সংরক্ষণে প্রয়োজন মাফিক কোনও কোল্ড স্টোরেজ নেই। কঠিন পরিশ্রম করে ফসল ফলায় কৃষক কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। আজও দেশে ভূমিসংস্কার হয়নি। কৃষি জমিতে কল – কারখানা ও আবাসন গড়ে উঠছে। কৃষক জমি হারিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পাড়ি দিচ্ছে দেশ – বিদেশের শ্রম বাজারে। কৃষি জমি চলে যাচ্ছে ধনীদের হাতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন