শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. আদর্শিক মধ্যবিত্ত সমাজটা হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে!

সময়ের সাফ কথা…. 

আদর্শিক মধ্যবিত্ত সমাজটা হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে!

সংলাপ ॥ সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে শব্দের অর্থও বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তার প্রচলিত চরিত্র। বংলাদেশের মধ্যবিত্তরা ক্রমশই বদলাচ্ছে। তার একটা কারণ অর্থনৈতিক। উচ্চবিত্তদের মতো আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় মধ্যবিত্তদের স্বপ্নগুলো, ইচ্ছেগুলো, আকাক্সক্ষাগুলো জেগে থাকে বহুকাল। তাই তারা স্বপ্ন বুনতে পারেন। সেই স্বপ্নের কেন্দ্রে হয়তো থাকে আপাত স্থূল বা বস্তুগত কোনও ঘটনা। কিন্তু তার মধ্যেও কল্পনাবিলাস ছিল বা আছে। কখনও-বা ফ্রিজ-টিভি-মাইক্রোওভেনের স্বপ্ন। আবার কখনও-বা গাড়ি-বাড়ির। বহু সাধনার ফলে কোনও স্বপ্ন পূরণ হয়। কোনওটা-বা স্বপ্ন থেকে যায় আমৃত্যু।
মধ্যবিত্ত সমাজটাই হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে! একুশ শতকে এসে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রচলিত আদর্শ, ধ্যান-ধারণা জীবনবোধ। আমাদের দেশে  নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এই বিভাজন প্রধানত আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর নির্ভরশীল। এই বিত্ত অনুযায়ী, গড়ে ওঠে শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য-আদর্শ। আর এভাবেই স্বতন্ত্র হয়ে যাচ্ছে একেকটি শ্রেণী। বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ‘মধ্যবিত্ত’ এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্যরকম বোধ-বিশ্বাস-আদর্শ ও অর্থ, যা অভিধান খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে না। ব্যবহৃত হতে হতে শব্দেরও আলাদা চরিত্র  তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, খেয়ে পরে বেঁচে থাকার বাইরেও যে আনুষ্ঠানিক ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবন আছে তার ধারক ও বাহক প্রধানত মধ্যবিত্তরাই। মধ্যবিত্তরা সংস্কৃতির তাগিদ থেকে উপস্থিত থাকেন যে কোন আসরে, গ্রুপ থিয়েটারে, চলচ্চিত্র উৎসবে, বইমেলায়।
রাজনীতির মুখও তারাই। মধ্যবিত্তের ওপরেই আমাদের যা কিছু বিশ্বাস ও ভরসা। তারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখেছেন আর তা বাস্তবায়িতও করেছেন। সারাজীবন ধরে স্নেহ-মমতা-শ্রদ্ধায় স্বপ্নটাকে লালন করার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন । সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-ধর্ম… সমস্ত ক্ষেত্রে পথপদর্শক এখন তারাই।
কোনও কিছুই আজ আর মহার্ঘ নয় মধ্যবিত্তের কাছে। স্বপ্ন দেখতে হয় না। ইচ্ছে হতে না হতেই মুঠোয় চলে আসে কাক্সিক্ষত বস্তু। চোখ ঢেকে যাওয়া বিজ্ঞাপনই তৈরি করে নিত্য-নতুন চাহিদা। তার জোগানও রাতারাতি চলে আসে দোরগোড়ায়। যে বস্তুটির কথা কল্পনায়ও আসেনি, আজ তার অভাবে জীবন অচল হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সবই বিজ্ঞাপনের মহিমা।
ইচ্ছেপূরণ, কাক্সিক্ষত বস্তুকে অবলীলায় করায়ত্ত করা, এ তো পুরোপুরি অর্থ নির্ভর। তাহলে কি মধ্যবিত্তের আর আর্থিক সমস্যা নেই? তবে তারা কি ক্রমশ বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন? আসলে ক্রয়-বিক্রয়ের এতদিনের ধারনাটাও পাল্টাতে শুরু করেছে একুশ শতকের গোড়ায়। পকেটে টাকা থাকা না-থাকার ওপর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নির্ভর করছে না আর। একটাও টাকা না খসিয়ে ফ্রিজ-টিভি-মোটর সাইকেল তো বটেই, মায় গাড়ি-বাড়ির মালিকও হওয়া যায় অনায়াসে। মধ্যবিত্তেরা সহজ কিস্তিতে সবই কিনতে পারে। দোকানেও যেতে হয় না সব সময়। বাড়ি বয়ে তারা দিয়ে যায় আপনার কাক্সিক্ষত বস্তু। এর অনিবার্য প্রভাব পড়ছে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক তথা সাংস্কৃতিক মানসে।
আর্থিক দিক থেকে তো বটেই সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক দিক থেকেও আমাদের সাংস্কৃতিক বোধ, রুচি নির্ধারণ করছে এখন বৈদ্যুতিন মাধ্যম। এভাবেই ক্রম ক্ষীয়মাণ মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব। মধ্যবিত্তের নিজস্বতা। মধ্যবিত্ত মানস। গত শতকের শেষ দশক থেকে বিশ্বায়ন ও ভোগবাদের সর্বগ্রাসী আধিপত্য ত্বরান্বিত করছে মধ্যবিত্তের প্রান্তিকায়ন।
একুশ শতকের প্রথম থেকেই তথাকথিত রাজনীতি সম্পর্কে এক ধরনের উদাসীনতা দেখা গেছে উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে। আর তার দু’দশক আগে মধ্যবিত্ত তরুণদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল রাজনীতি-সচেতনতা। ক’বছরে এত পরিবর্তনের প্রধান কারণ একটাই আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন। আর সেই আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মূলে আছে বিশ্বায়ন-পণ্যায়ন। সময়ের স্বর ও সুরের বদল। সমাজ-মানসের বদল। বাঙালি মানসের বদল। অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই তখন থেকে রাজনীতি বিমুখতা দেখা গিয়েছে।
ডান-বাম সব রাজনৈতিক দলের প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সর্বত্র দূষণ। রাজনীতিতেও দূষণ। শব্দ-দূষণ, বায়ু-দূষণ, পরিবেশ-দূষণের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজনীতি-দূষণও। আর এসবই প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে বাঙালিরা। রাজনীতিও হয়ে উঠছে মানুষের পেশা। নেশা নয়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মানবসেবামূলক মহানুভবতা আজ আর প্রায় নেই রাজনীতিতে। ক্ষমতার স্বাদ পেতে, ক্ষমতার সঙ্গে লগ্ন হতে রাজনীতির আঙিনায় ঢুকে পড়ছে মধ্যবিত্ত যুবসমাজ। তাই সচেতন তরুণরা তথাকথিত রাজনীতিকে অগ্রাহ্য করছে। কিন্তু তার সংখ্যা যে বড় কম। আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদ চায় না মানুষ নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হোক। ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরাও চান না মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হোক। তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হবে রাজনীতি-বিমুখতা।
আশ্চর্যজনকভাবে রাজনীতি-বিমুখতা নিয়েই এখন প্রচুর মানুষ নাম লেখাচ্ছেন রাজনীতির রং-বেরঙের দলে। ইচ্ছে মতো গোপনে রাতের অন্ধকারে দলবদল করছেন। আজ সকাল পর্যন্ত যাদের হয়ে গলা ফাটিয়েছেন, বিকেল থেকে তাদের বিরোধিতায় পঞ্চমুখ। নীতি-নৈতিকতা ছাড়াই ভেসে যাচ্ছেন রাজনীতিকদের নির্দেশে। যেসব নেতা-নেত্রীকে মন থেকে ঘৃণা করতেন, তারাই এখন তাদের আদর্শ। একাধারে ঘৃণা এবং মান্যতা। রাজনীতিকরাও এ ব্যাপারে চতুর। ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে রাজনীতিকরাও বিসর্জন দিচ্ছেন নীতি-নৈতিকতা। সব কিছু গুলিয়ে দিচ্ছেন তারা। তাই রাজনীতি আর ধর্ম একাকার হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে ।
এই উন্মাদনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত আদর্শিকদের অভাব বড় চোখে পড়ছে। এখন মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আদর্শিকদের দরকার খুব – যাদের চোখে লোভের ঝিলিক থাকে না, ব্যক্তি সুবিধার কথা ভেবে যখন-তখন রাজনীতির রং-বেরঙের বিচিত্র আলখেল্লা গায়ে দেয় না। যারা প্রকৃতই নীতির রাজাকে খুঁজতে চায় রাজনীতির হাত ধরে। যারা সহজে গর্জে উঠতে জানে। যারা গা-বাঁচিয়ে চলাটাকে কাপুরুষতা মনে করে। যারা সম্প্রীতি নিয়ে উচ্চকিত হওয়ার আগে ব্যক্তিযাপনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্পর্ক তৈরি করে। সময় এসেছে সেই মধ্যবিত্ত সমাজের সদস্য হওয়ার এবং মধ্যবিত্তের সমাজ-মানসকে অঙ্গীকার করে একটু অন্যভাবে নিজের চারপাশটাকে দেখার চেষ্টা করার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন