শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. অন্যায় চাহিদায় ভর করে পিশাচ

সময়ের সাফ কথা…. 

অন্যায় চাহিদায় ভর করে পিশাচ

সংলাপ ॥ অন্যায় চাহিদার তাড়নায় মানুষের ভেতর যখন বিবেকবোধ আর ভালোবাসা শূন্য হয়ে ওঠে, তখনই তার পুরো সত্তায় ভর করে পিশাচ। মানুষের এই পৈশাচিক মূর্তি বাঘ সিংহ কিংবা সাপের চেয়েও নিকৃষ্টতর। মানুষের হিংস্রতা পৈশাচিকতা সব প্রাণীকে ছাপিয়ে যায়। এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে মানুষ প্রয়োজনে নিজেকেও শেষ করে দিতে ভয় পায় না। মুহূর্তের বিভ্রমে সে যে অন্যায় লক্ষ্য স্থির করে বসে, সেটা পূরণ না-হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই শান্ত হতে পারে না। তার থেকেই দেশ তথা পৃথিবী জুড়ে যত অমানবিক অনৈতিক  পৈশাচিক ঘটনা ঘটে চলেছে।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকবেই। কিন্তু সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিক বা দেশের মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হওয়ার পরেও যদি কারও এই উপলব্ধিটুকু না থাকে, তা হলে দেশের বড় দুর্ভাগ্যজনক ছবি তৈরি হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে আমরা যা বুঝি, তা তো আইনের বইয়ে হুবহু লেখা থাকে না। আইনের ধারা-উপধারা বা ফৌজদারি বিধি বা দ-বিধির যে সুনির্দিষ্ট এবং স্থূল কাঠামো, তাকে ঘিরে প্রলেপের মতো বিরাজ করে এক সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি। সেই বিচারবুদ্ধি বা উপলব্ধি বা মূল্যবোধই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইনের ব্যাখ্যাটা খুঁজে দেয়।
দেশের জনতা দু’ধরনের। এক ধরনের জনতা থাকে মাটির পৃথিবীতে, অন্যরা অন্তরাল জগতে। দু’পক্ষই একই বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ভিড়ের মাঝে দু’ধরনের মানুষজন পর্দার আড়াল নিয়ে থাকে। তারা ক্ষুব্ধ বা বিরক্ত হওয়ার ভান করে। তারা এককভাবে কিছু বলার বা করার সাহস রাখে না। তারা মনে করে যে, তারা এমন এক গণপ্রজাতন্ত্রের নাগরিক যেখানে তাদের জন্য কোনও শাস্তির ব্যবস্থা নেই। এই দু’ধরনের জনতা দেশ জুড়ে বেশ বেড়েছে। জিন্স পরার কারণে মেয়েদের, পার্কে বা হোটেলে গিয়ে বসার কারণে যুগলকে নিগ্রহ করছে বাস্তবের এই জনতা। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে শুধু গুজব রটিয়ে দিয়ে এ ধরনের জনতা কিছু মানুষকে মেরেছে এবং হত্যা করেছে।
অন্তরাল জগতের জনতাও খুব আলাদা কিছু নয়। ট্রোল নামে একটা ব্যাপার তারা ঘটিয়ে থকে। ট্রোল যারা করে থাকে তারা অসহিষ্ণু, অভব্য, অশিষ্ট, আচার-আচরণে অশালীন এবং হিংস্র। কথাবার্তায় ঘৃণা উদ্গীরণ, ভুয়ো খবর ছড়ানোই তাদের মতলব। তারা সাধারণভাবে খুন খারাবি করে না। কিন্তু, সচেতন মহলের ধারণা হলো এই ধরনের ছেলে বা মেয়ে কোনও হিংস্র জনতার মধ্যে রয়ে গেলে তারাও ওই অপকর্ম করে বসতে কুণ্ঠিত হবে না।
নেতাদের রোজ নিয়ম করে যে-লোকগুলো ট্রোল করে, অনেকে তাদেরই শিকার হন। ট্রোল যারা পড়েছেন তারা পরিষ্কার জানেন এই ‘ট্রোল দলে’তে কারা আছে আর তাদের অর্থ জোগায় কোন শক্তি। অনেক রাজনীতিকদের সমস্যা হয়ে গেছে একটা জায়গায় তারা নিজেরা এদের দ্বারা বিব্রত হওয়ার আগে ট্রোল দল সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেননি। এটা পরিষ্কার যে এই ট্রোল দল হলো নয়া ‘প্রচারক’ দল : তারা কোন দলেরই এক কী দু’জন নেতার সেবার্থে নিযুক্ত হয়, দলেরও বাকি নেতাদের কথা তারা ভাবেন না। এই ট্রোল দল যাদের সেবা করে সেই নেতাদের ‘অনুসরণ’ করেন বড় নেতারাও। অতএব ট্রোলদের ঘাঁটাতে সাহস পায় না কেউই।
সামাজিক মাধ্যমেতে ট্রোল এবং ঘৃণার প্রচারকদের এভাবে চিহ্নিত করা উচিত যে, তারা হলো আজকের সমাজটার নতুন অবনমনের কারিগর। আইনশৃঙ্খলা এবং বিচার-প্রদান ব্যবস্থার সামনেও তারা নতুন বিপদ। শুধু মুখের কথায় কোনও কাজ হবে না। এই ধরনের হিংসা দমনের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপই প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রয়োজন খুন ও ধর্ষণের হুমকির বেলা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এসব ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা উচ্চ সাংবিধানিক পদে আসীন থাকলে বা সম্পর্কিত থাকলে তাদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ দূরে থাক, দ্রুত এবং আন্তরিকভাবে সামান্য মৌখিক ভর্ৎসনাটুকুও করা হচ্ছে না।
আধুনিক পৃথিবী, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ। তাল মেলাতে পেরেছি ভেবে বেশ শ্লাঘা বোধ করি আমরা। কিন্তু আদৌ কি পেরেছি?
আদৌ কি আধুনিক সভ্যতার আত্তীকরণ ঘটাতে পেরেছি? না কি যাবতীয় আধুনিকতা বহিরঙ্গেই? নারী ও পুরুষ, উভয়েই যখন সৃষ্টি, তখন মানুষ কেন ধর্মের দরজায় দু’জনকে দু’রকম চোখে দেখবে? সমাজে সংস্কার আনার লড়াইটাতো বহু বহু বছর আগে শুরু হয়েছে। নবজাগরণের মূল্যবোধের সঙ্গে এ দেশের সমাজকে খাপ খাইয়ে নেয়ার লড়াই সেই ১৮০০ শতক থেকে চলছে। যতটা প্রতিকূলতার মুখে তাদের পড়তে হয়েছিল সেদিন, আজকের ‘আধুনিক’ বাংলাদেশেও সম্ভবত প্রতিকূলতা ততোটাই। ২০১৮ সাল, চার দশক পার করে স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকা বাংলাদেশ, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি জাতির দেশ। কিন্তু আধুনিক শিক্ষার আলো যে আজও বাঙালি সমাজের সব স্তরে পৌঁছায়নি।
আপাতদৃষ্টিতে আজকের বাংলাদেশ আধুনিকতায় আলোকিত। বহিরঙ্গে এই দেশ অত্যন্ত উজ্জ্বল। আধুনিক শিক্ষা, আধুনিক মূল্যবোধ, আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তি, আধুনিক জীবনযাত্রা দেশে সবই রয়েছে। কিন্তু অন্তরঙ্গে এখনও এক আদিম গন্ধ রয়ে গিয়েছে। আর্থ-সামাজিকতার উপরের স্তরে ঘোরাফেরা করলে সে গন্ধ নাকে আসবে না। সমাজের একটু গভীরে বা একটু নীচের স্তরে ডুব দিলেই আদিম ঘ্রাণটা টের পাওয়া যাবে। সেই আদিমতাই এখনও নারী-পুরুষে বৈষম্য করে, সেই আদিমতাই জাত-পাতের বিভেদ-বিদ্বেষ জিইয়ে রাখে, সেই আদিমতাই আইন-কানুন-গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে অন্ধ সংস্কারে সমাজকে ডুবিয়ে রাখতে চায়, সেই আদিমতাই নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করতে চায়। একবিংশ শতকে এসেও বাঙালিদেরকে লড়তে হচ্ছে আদিমতার ছায়ার বিরূদ্ধে, এ বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। তবু লড়াই জারি থাকা দরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন