বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. (৩)

ভক্তি, গুরু উপাসনার মাহাত্ম্য। গুরুভক্তি-সাধনার সর্বোচ্চ অবস্থা। সাধক ভক্তিসাধনার চরম-পরম দেশে তার উপাস্য গুরুকে দর্শন করে থাকেন। ভক্তিসাধনার ফলস্বরূপ এটাই পরম পরিণতি। প্রেমের জগতে এক এক মিলে দুই না হয়ে একই হয়। অংশ ও অংশী ভিন্নও বটে, আবার অভিন্নও। ভক্তের আকর্ষণ ও ব্যাকুলতা থাকে নিজ সত্তায় নিজেকে প্রেমাস্পদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে, তাঁর মধ্যে নিমজ্জিত হতে, তাঁর সত্তার সঙ্গে নিজের সত্তাকে একীভূত করতে। এজন্য প্রেমিক প্রেমের সর্বোচ্চ অবস্থায় প্রেমাস্পদের সঙ্গে অভেদসুখানন্দ অনুভব করেন। দ্বৈতভাব থাকলে প্রেমাস্পদের সঙ্গে প্রেমিকের সম্বন্ধাশ্রিত রসানুভব সম্ভব হয় । অদ্বৈতরাজ্যে জ্ঞানের ভেদ বিলুপ্ত হয়। অনুরাগী প্রেমিক ভক্ত স্বভাববশেই দ্বৈতদেশে নেমে এসে প্রেমাস্পদের সঙ্গে সম্বন্ধাশ্রিত রস-সম্ভোগ করে। ভক্তের সার্বজনীন প্রেম স্বাভাবিকভাবে উপস্থিত হয়ে থাকে। ভক্ত সব দেশে প্রেমাস্পদকে দর্শন করে সকল রূপে তাঁকেই অভিব্যক্ত দেখে সকলকে আন্তরিক ভালবাসেন। তখন কোন জীব আর তাঁর নিকট কেবল জীবমাত্র থাকে না, সকলকেই তিনি প্রেমাস্পদের বিভিন্ন রূপে দর্শন করেন। সার্বজনীন প্রেম বা বিশ্বপ্রেম প্রেমের চরম পরিণতি।
মানুষ শরীর, কথা ও চিন্তা দ্বারা যা কিছু করে তাই কর্ম। জীবমাত্রই সকল অবস্থায় সর্বদা কোন-না-কোন কর্ম করে। কর্মই জীবনের লক্ষণ। কর্ম না করে কেহই ক্ষণকালও থাকতে পারে না। যখন মানুষ গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত থাকে, তখনও তার ভুক্তদ্রব্য-পরিপাক, রক্তসঞ্চালন এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস প্রভৃতি দৈহিক কর্ম চলতে থাকে। নিঃশেষে সকল কর্ম ত্যাগ করা কোন জীবের পক্ষেও সম্ভব নয়। জীবনধারণ করতে হলে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে সর্বদা সংগ্রাম প্রাণীগণের পক্ষে অপরিহার্য। জীব-জগতে জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর অবিরত সংগ্রাম চলছে। এই সংগ্রামই কর্ম।
কর্মের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, কোন ভক্তই কেবলমাত্র জীবন-রক্ষার জন্যই সকল কর্ম করে না। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে চেষ্টা করে তার সীমাবদ্ধ অপূর্ণ জীবনের গন্ডি অতিক্রম করে এক অসীম ও পরিপূর্ণ জীবন লাভ করতে, সকল অজ্ঞান, অভাব ও দুঃখ হতে মুক্ত হয়ে, সকল চাওয়া ও সকল পাওয়ার অবসান ঘটাতেই নিজস্ব অভ্যাসের দাসত্ব ত্যাগ করে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে, সকল বন্ধন দূরে সরিয়ে মুক্তিলাভ করতে সাধক-ভক্তরা কর্ম করে।
অভ্যাস জীবনব্যাপী। গুরু যোগের মূল ভিত্তি অভ্যাস। চিত্ত নিরোধের প্রথম উপায় আসক্তি নিয়ন্ত্রণ। আসক্তি দু’প্রকার। বিষয়-আসক্তি আর গুণ-আসক্তি। বাইরের পদার্থ অনিত্য, এই বিচার নিজে করে চিত্ত সদা জাগ্রত রাখা দরকার। নিয়ন্ত্রণ বোধে চিত্ত জাগ্রত হয়। গুরুযোগের লক্ষ হলো রাগ, দ্বেষ, মোহ নিয়ন্ত্রণ। গুরুযোগে রাগ-দ্বেষের দ্বন্দ্বের অবসান হয়, বিমূঢ় ভাবও অন্তর্হিত হয়। এই অবস্থার জন্য প্রথম প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ। আমি গুরু ছাড়া কোন বাহ্য বস্তুর উপর নির্ভরশীল নই এই ভাবনা চিত্তে সদা জাগ্রত রাখা। গুরুযোগেও সমস্ত ভোগ সম্মুখে উপস্থিত হয়। গুরুযোগীকে তখন সবচেয়ে বেশী সতর্ক থাকার প্রয়োজন হয়। সমস্ত বাহ্যিক সুখকে ধীরে ধীরে প্রত্যাখ্যান করতে হয়। চিত্তকে তৈরি করতে হয়। চিত্ত প্রসাধনে ভক্তের অন্তরে শান্তি, আনন্দ জন্মায়। বাইরের জগতে অশান্তি, অবিচার, নিরানন্দ, দুঃখ সতত উপস্থিত থাকে। এই সবের প্রতি উপেক্ষার ভাব রাখা দরকার। উপেক্ষার পরে আসে করুণার স্থান। দুঃখে বিচলিত নয়। জগতে যা কিছু প্রতিকূল, তার প্রতি দৃষ্টি রেখে, এই ভাবের মনন করা। সবার জন্য হিত কামনা, শুভ কামনা থাকা দরকার। এই ভাব মৈত্রী ভাব। সবার প্রতি কল্যাণের ভাবনা, মৈত্রীর ভাবনা ও সবার দেখে আনন্দিত হলে চিত্তের ব্যাপ্তি সহজ হয়।
গুরু-প্রণিধান ভাবনা চেতনার প্রেরণায় সম্ভব। এই প্রেরণাই গুরুশক্তি অর্থাৎ গুরুময়তা। গুরু এমন এক পুঁরুষ, যাঁর ক্লেশ নেই, আশায় নেই, তিনি সবার গুরু। জপ চিত্ত নিরোধের এক সহজ উপায়। গুরুনাম স্মরণ, নিজের চিত্ত গুরুর চিত্তের মতো বীতরাগ, শুদ্ধ হয়ে যাক্, এমন ভাবনা চিন্তাজগতে রাখা দরকার। নিজেকে জ্যোতির্ময় তরঙ্গরূপে দর্শন করা, প্রাণের প্রচ্ছর্দন ও প্রসারণ, তার সাথে সাথে ব্যাপ্তি ভাবনা করা। প্রাণবৃত্তি আপনা আপনি শুদ্ধ হতে থাকবে। নিদ্রা আর স্বপ্নে জাগ্রত থাকার চেষ্টা করে তা হতে প্রাপ্ত চেতনাকে অবলম্বন করলে চিত্ত নিরোধ সহজ হয়।
শ্রদ্ধা আস্তিকতা। শ্রদ্ধা আপনা আপনি হৃদয়ে উৎপন্ন হয়। তাকে বলপূর্বক উৎপন্ন করা যায় না। শ্রদ্ধায় আবিষ্ট হলে দিব্য জীবনের আভাস আসে এবং লক্ষ্যের বিষয়ে চেতনা দৃঢ়মূল হয়ে যায়। শ্রদ্ধা ঊষার অরুণালোক। এরপরে সূর্যোদয় অবশ্যম্ভাবী। শ্রদ্ধাই প্রথম নিশ্চিত প্রত্যয় বা উপায় ভক্তি ভাবের। নিশ্চিত প্রত্যয় এলে সেই প্রত্যয়কে কার্য্যান্বিত করবার জন্য সংযোগশক্তির উদয় হয়। জাগ্রত হয় বিবেক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন