বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ১৮


শ্রীগুরু। তাঁকে অনন্ত, অলভ্য বলে বর্ণনা করা যায়; তাঁকে যোগে-সংযোগে-সম্পর্কে দর্শন করা যায়। শ্রীগুরু ধ্যানের ক্রমোন্নতির ফল এক দিব্য বহ্নি-তেজ এবং শ্রীগুরু ভক্তির অবর্ণনীয়, শ্রীগুরু দিব্য ও মাধুর্যময় মগ্নতাতে, শ্রীগুরু চেতনার উচ্চভূমিতে, শ্রীগুরু চিত্তের শান্তি ও স্নিগ্ধময় আনন্দে, শ্রীগুরু দিব্যলোকের বস্তুসমূহের মহিমায় অভিভূত এবং শ্রীগুরু আশ্চর্যময় অনুভূতিতে দিব্য ও ভাষাতীত তীব্রানুভবে।
শ্রীগুরুর মহত্ত্বের অনুস্মরণে নিজেকে গড়ে তোলা, নিজের সমগ্র সত্তায় পরিবর্তন আনা। দেশ, কাল অতিক্রম করে অনন্তে রূপান্তরিত হওয়া। সকল মরমিয়া সাধক, ভক্ত ও মুক্তিপিপাসু সত্যমানুষের স্বপ্ন অতীন্দ্রিয় দর্শন। অধিকাংশের এ সম্পর্কে ধারণা অতি অস্পষ্ট, অগভীর এবং প্রাত্যহিক বাস্তব-জীবনের পরিপন্থী। দ্বিবিধ দ্বিচারী ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা? অর্থ? সম্পত্তি? নাম-যশ-ক্ষমতা? এ সব ছাড়া আর কিছুই কি কাংক্ষিত হতে পারে না? এমন কিছুর জন্য আর্তি হোক যা আরও অধিক স্থায়ী, যা কেবলমাত্র নিজ জীবন চলার পথেই নয়, অপর সহযাত্রীর চলার পথকেও আলোকিত করে।
জীবনের মূল ভিত্তি সাফল্য। আমরা তমসাচ্ছন্ন পথকেই আশ্রয় করে জীবন পথে চলছি, আমাদের সকল বিষয় ও বাসনারাশি শ্রীগুরুতে সমর্পণ করে তাঁর আলোকবৃত্তের অভিমুখে অগ্রসর কি হই? আমরা কি দৈহিক স্থূল আবেগের অনুবর্তী হতে চাই, অথবা সকল শক্তি সংহত করে অভ্যন্তরীণ সচেতনতার দ্বারা পরিচালিত হতে চাই? এ সব প্রশ্ন প্রতিটি সাধকের অতি একান্ত এবং উত্তর অন্তরের অন্তরতম দেশ হতেই উৎসারিত হয়।
নিমগ্নতায় জীবন যাপনের অর্থ এই নয় যে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে সকল বাস্তব উপযোগিতা হারানো, অথবা মানব কল্যাণে নিজ দেয় অংশটুকু দান করা থেকে বিরত থাকা। একরৈখিক নিমগ্নতায় জীবনচর্চায় পর্যবেক্ষণ-সহানুভূতি-উপলব্ধি বোধ হয় প্রবল, দৃষ্টি হয় স্বচ্ছ, অনুভব শক্তি হয় গভীর এবং কর্তব্যকর্মে অধিকতর দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কৃপা প্রার্থনার একনিষ্ঠতায় অর্জন হয়, আরও অধিক দক্ষতা, অধিক ক্ষমতা, অধিক দৃষ্টি-স্বচ্ছতা আয়ত্ত করা; যার ফলে যা-ই আমরা করি না কেন, তা শ্রীগুরুর দান বলেই গণ্য। এর ফলে বর্তমান ব্যক্তিত্ব খর্ব হয় না, বরং তা আরও বিকশিত হয়। সহানুভূতিবোধ এবং প্রেমজগতের প্রেমস্তর সঙ্কীর্ণ হয় না, তা আরও প্রেমজগতের অজস্র স্তরে অজস্র ধারায় প্রবাহিত হয়। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থে অথবা সঙ্কীর্ণ গন্ডিতে চেতনা দেশে কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিবর্তে তা ব্যাপ্ত হয় বিশ্ব চরাচরে। বিশ্ব-অন্তর অধিগ্রহণ করে ক্ষুদ্র ব্যক্তি-অন্তর এবং প্রাণ ছন্দায়িত হয় জীবন চলার পথে। মানব প্রজাতির সমাজবদ্ধতার মাধ্যমে সত্যমানুষকূলের সত্যমানুষদের আলোকোজ্জ্বল ছটা পার্থিবজগতে অনুপ্রবেশ ঘটে চলছে, যে আলোক উৎসারিত তাঁদের আপন সত্তা হতে যেমন সূর্যের দীপ্তি উদগত হয় সাগর হতে। প্রেমজগতের অধিকারী সকলেই। জ্ঞানালোকের অস্তিত্ব চিরন্তন, বহমান এবং প্রত্যেকেই নিজ চেষ্টায় ও শ্রীগুরুর কৃপায় কিছু পরিমাণে তা উপলব্ধি করে জ্ঞান অর্জনের পথে চলতে সক্ষম। যারা এই দিব্য অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন, তারা কখনই তা অনুভব করেননি। উপলব্ধি বা প্রাপ্তির সৌন্দর্য এতই গভীর গাঢ় যে তার তুলনায় অপর যে কোনও অনুভূতির অস্তিত্ব বা সত্যতা মিথ্যা বলে উপেক্ষিত হয় এবং সৌন্দর্য এতটাই উজ্জ্বল যে অপর সকল কিছুই ছায়া বলে বোধ হয়।
কর্ম প্রকৃতির ভিত্তির অংশবিশেষ কর্মপ্রবাহ সর্বদাই দেহে বহে চলছে তরঙ্গায়িত হয়ে। যারা শ্রীগুরুতে বিশ্বাসী, তারা এটা আরও ভালরূপে বুঝতে পারেন, কারণ তারা জানেন শ্রীগুরু এমন একজন সর্বশক্তিমান সর্বত্র বিরাজমান নিরাকারে-আকার সক্ষম পুরুষোত্তম সত্যমানুষ যে, তিনি তাঁর আশ্রিত ও ভক্তদের, লক্ষ্য, মুক্তি, স্বার্থশূন্যতা – কর্মযোগ অনুসারে কর্মের দ্বারাই তাদেরকে ওই গন্তব্যে পৌঁছে দেন এবং পথ দেখাতে থাকেন যেখানে সত্য ও শান্তির ধারা বিরাজমান। এ জন্যই কর্মরহস্য জানা প্রয়োজন। জগৎকে সম্পূর্ণরূপে আনন্দময় করবার যাবতীয় ধারণা ধর্মীয় উগ্রবাদীদেরকে কর্মে প্রবৃত্ত করার পক্ষে শ্রেয়। গোঁড়ামি দ্বারা ভালও হতে পারে, মন্দও তেমনি হতে পারে। কর্ম করবার জন্য মুক্তির সহজাত অনুরাগ ব্যতীত উদ্দেশ্যমূলক কোন প্রেরণার প্রয়োজন কি? সাধারণ উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধির গ-ি অতিক্রম করা। কর্মেই অধিকার, ফলে নয়। যখন উপকার করবার ইচ্ছা মজ্জাগত হয়, তখন আর বাহিরের কোন প্রেরণার প্রয়োজন থাকে না। উপকার করে ভাল লাগে বলে। স্বর্গ/বেহেস্ত যাবে বলে যে ভাল কাজ করে, সে নিজেকে বদ্ধ করে ফেলে। এতটুকু স্বার্থযুক্ত অভিসন্ধি নিয়ে যে কর্ম করা যায়, তা মুক্তির পরিবর্তে আমাদের পায়ে একটা একটা শেকল পরায়ে দেয়।
উপায় সব কর্মের ফল ত্যাগ করা, অনাসক্ত হওয়া। জগৎ আমার নয়, আমরাও এ জগতের নয়; বাস্তবিকতায় আমরা শরীরও নই, আমরা প্রকৃতপক্ষে কর্ম করি না। আমরা চিরস্থির, চিরশান্ত। আমরা কেন কিছুর দ্বারা বদ্ধ নয়। আমাদের রোদনেরও কোন কারণ নেই, নিজের জন্যে কাঁদবার কিছু নেই। এমনকি, অপরের দুঃখে সহানুভূতিসম্পন্ন হয়েও আমাদের কাঁদবার কোন প্রয়োজন নেই। কাঁদা বন্ধনের চিহ্ন দুর্বলতার চিহ্ন। একবিন্দু চোখের পানি যেন না পড়ে। এরূপ হবার উপায় অনাসক্ত হওয়া – অভিসন্ধিশূন্য হয়ে যে-কোন কাজ করলে, তা একটা নূতন শৃঙ্খল সৃষ্টি না করে যে শৃঙ্খলে আমরা বদ্ধ রয়েছি, তা একটা একটা করে ভেঙ্গে দেয়।
সমস্ত আপেক্ষিক সত্যের অতীত সেই পরম সত্যকে কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জনের দ্বারা বিচার করেই পরমসত্যে বিরাজমান। এই জ্ঞান কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা সাধন নয় সব সত্যকে অতিক্রম করে শ্রীগুরু যাকে একমাত্র স্বীকৃত বলেছেন, সেই জ্ঞানলভ্য একটা দার্শনিক তত্ত্ব। একাগ্রচিত্ত প্রবলবেগে প্রত্যক্ষ সন্ধানে লক্ষ্যের দিকে ধাবমান হলে, সেই পরমসত্যের মধ্যে প্রবেশ করে আবেগের সাথে তন্ময় হওয়া যায়। কেবলমাত্র সত্যনিরূপণ নয়, সেই সত্যের মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই লক্ষ্য। সেই সত্য কেবলমাত্র সত্য নয়, তা অমৃত। তা কেবল জ্ঞানের ক্ষেত্র অধিকার করে নেই, তাকে আশ্রয় করেই অমরত্ব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন