বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ৯


প্রত্যেকটা প্রাণের মধ্যে সহজাতক্রমে প্রেমজগৎ বিদ্যমান। মানবজাতিও এর বাইরে নয় তাই তারা ভাবপ্রবণ। এটা মানব জীবনের বৈশিষ্ট্য। প্রেরণা যখন কোন প্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করে তীব্র হতে তীব্রতর হতে থাকে, তখন মানবের অন্তর্জগতে এক স্নিগ্ধ মাধুর্যময় নৈসর্গিক অবস্থার উন্মেষ হয়। ওই অবস্থাই ভাব। ওই ভাব যখন ক্রমশ গভীর হতে গভীরতর অবস্থার ভেতর দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি প্রাপ্ত হয়, অর্থাৎ গাঢ় অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন সেই অবস্থাকে প্রেমজগতের প্রেম স্তর বলা হয় । প্রেমাবিষ্ট মানব অনুভব করে থাকে এক অনাবিল উল্লাস; তা-ই মানবের জীবনে আছে পরম আনন্দলোক। প্রেমজগৎ সমস্ত কালের সীমাকে অতিক্রম করে ব্যাপ্ত রয়েছেতা অনন্ত। সমস্ত দেশ, কাল ও পাত্র তাতে আবিষ্ট এবং তা দেশ, কাল ও পাত্রের ঊর্ধ্বে, তাই তা অসীম ও অপরিমেয়। যাকে পেলে সবই পাওয়া যায় অর্থাৎ সর্বস্ব প্রাপ্তির বোধ, সেই বোধের নিকট সমস্ত চলমান বিষয়বোধ ম্লান।
প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের সম্পর্ক এতো নিবিড় ও জমাট যে অপার্থিব সম্পর্ক কোন কথা দিয়ে তাকে ব্যক্ত করতে পারা যায় না। এই অবস্থা শাস্ত্রকথা বা তর্ক প্রতিপাদ্য বিষয় নয় এবং তর্ক বা শাস্ত্রের বচন দ্বারা এর অনুভব হয় না। তত্ত্বকথা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক পার্থক্য। জীবন চলার পথে সহজ বাস্তব বোধের মাধ্যমেই এর যথার্থ অনুভব । সহজ ও সাবলীলভাবে নিজের মধ্যে নিজের দ্বারাই এই বোধ হয়, অপরে সাহায্য করতে পারে না। গুরু কৃপা তখন সম্বল। গ্রন্থ যাদের একমাত্র অবলম্বন এবং যারা লালিত অভ্যাসের ক্রীতদাস তাদের পক্ষে এই স্তর বা দেশ অনুভব দুরূহ। শাস্ত্র কিংবা তর্কজালের দ্বারা নয়, শুধু নিজের অন্তঃকরণের মধ্যেই এর অনুভব হয়ে থাকে। প্রকৃত সহজ সত্যমানুষ সাধকের ভেতর রয়েছে জীবন্ত ধর্মীয় বোধ – সীমার মধ্যে এক অকল্পনীয় উদ্ভব। পন্ডিতরা শুধু অনুকারক, অনাস্বাদিত পুঁথির ভান্ডারী, সহজ বোধের সম্পর্কশূন্য ও ছন্দবিহীন অসহজ। তার অস্তিত্ব একমাত্র প্রেমিক সাধককুল উপলব্ধি করতে পারেন। সীমা অসীমের বাইরে নয় এবং অসীমও সীমাকে ছেড়ে নয়। সীমা ও অসীম একাধারে ওতপ্রোত অসীমের সীমা ধারণ ও সীমার অভিব্যক্তি অসীমের নিমিত্ত। সীমার ভেতর সেই অসীমের প্রকাশ আবার সীমার মধ্য দিয়ে ওই অসীমের উপলব্ধিই হলো পরমচেতনা। ওই অসীমকে যে কোনরূপে আহ্বান করতে পারা যায় এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা যায়। তার বিশেষ কোন নাম-রূপ নেই।
মানব সহজ ভাললাগা-ভালোবাসা-ভক্তি প্রেমাবস্থা লাভ করলে ভাষা তাকে ব্যক্ত করতে পারে না এবং অবকাশও থাকে না, তা কেবলমাত্র উপলব্ধিতেই থাকে প্রেমস্বরূপ। সমগ্র বিশ্ব প্রেমের লীলামূর্তি গুণাতীতের গুণময় লীলা। অসীমের মধ্যে সীমার উল্লাস আর সীমার মধ্যে অসীমের আবির্ভাব এই হলো আনন্দলোক-বিলাস। অনাদিকাল হতে অসীম নিজেকে সীমার মধ্যে সীমায়িত করেছে শুধুমাত্র আনন্দের ধারায়। সংসারের প্রতিটি বিষয় ওই প্রেমস্বরূপ চৈতন্যকে আলিঙ্গন করে আছে আর ওই প্রেমেই হলো আনন্দলোক।
মানব সচরাচর যা কামনা করে থাকে, তা সিদ্ধ না হলে কামনা উত্তেজনায় পরিণত হয়। ক্রমান্বয়ে তা হতে ভোগের লালসা হতে লোভ আপনা হতে এসে পড়ে এবং মানব পরিণত হয় মতিভ্রমগ্রস্ত অসহজ অবস্থায়। সাধারণ মানবের লক্ষ্যই হল সুখলাভ। কিন্তু কামনার ভোগে সুখলাভ হয় না। সুখের পরিবর্তে তখন দেখা যায় ভোগান্তি আর দুর্ভোগ। মানবকে পরম প্রেমের স্থিতিতে উপনীত হতে হবে, তাহলেই তার পূর্ণতা নতুবা মানব পূর্ণতাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। মানব নিজের সামর্থ্যে সেই স্থিতিতে পৌঁছাতে সক্ষম না হলে প্রয়োজন হয় গুরুর করুণা। গুরুর করুণা হলেই আসে জীবনের পূর্ণতার পথ। কামনাবিকার – মানব জীবনে প্রেমজগতের প্রাণক্রিয়ার নিম্ন লক্ষণ। প্রেম উৎকৃষ্ট এবং পূর্ণ। যাদের মধ্যে এই বিকার পরিলক্ষিত হয়, তারা এখনও আদিমতাকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তারা প্রাণীকুলের প্রেমজগতের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছেন। বাহ্যাচার ও কুসংস্কারে তারা আচ্ছন্ন। যেখানে দ্বিচারিতা সেখানে প্রেম থাকতে পারে না।
প্রেম মানবজীবনকে বিবর্তিত করে দেয় মানবজীবন ও মানব সমাজের মহত্ত্ব সূচনা করে। প্রেম মানবকে পাশবিক প্রবৃত্তির নিম্নস্তর হতে পরম চেতনার দিকে অগ্রসর করে। প্রেম সব অভাবকে দূরীভূত করে। সত্য সার্বজনীন। কখনও কোনও দেশ বা কালে সীমাবদ্ধ নয়, অসীম পরম সত্যের বিষয় কোন ধর্মে প্রচারিত হলে, সেই ধর্মকে সত্যেরই মতো অসীম হতে হবে; সত্যের জ্যোতি সূর্যের মতো সমগ্র মানব জাতির ওপর সমভাবে বিস্তার করে। তাতে উন্নতির সীমাহীন অবকাশ থাকে; পৃথিবীর সকল নর-নারীকে সাদরে আলিঙ্গন করে, অতি হীন বর্বর মানুষ হতে শুরু করে হৃদয় ও মস্তিষ্কের গুণরাশির জন্য যাঁরা সমগ্র মানবজাতির ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছেন, সমাজ যাঁদেরকে সত্যমানুষ হিসেবে ভক্তিতে সস্মুখে সশ্রদ্ধ দন্ডায়মান থাকে, সেই সকল শ্রেষ্ঠ মানব পর্যন্ত সকলকেই সত্য স্থান দেয়। সেই পরম সত্যের নীতিতে কারও প্রতি বিদ্বেষ বা উৎপীড়নের স্থান থাকে না; সত্যে প্রত্যেক নরনারীর স্ব-ভাব স্বীকৃত এবং এর সমগ্র শক্তি মানবজাতিকে স্ব-ভাব উপলব্ধি করতে সহায়তা করবার জন্যই সতত নিযুক্ত থাকে এরূপ সত্য প্রতিষ্ঠিত করলে, সমগ্র জাতিই অনুবর্তী হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন