বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি…. ৫


অধ্যাত্ম জগতে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি হ’ল আত্মিক উন্নতির জন্যে তিনটি সহায়ক। জ্ঞানবান জ্ঞানার্জনের পথে জ্ঞানচর্চার দ্বারা লক্ষ্যের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যান, শুধু একটু ব্যবধান থেকে যায়। কর্মীও কর্মসাধনার দ্বারা লক্ষ্যে প্রায় পৌঁছে যান, তবু কিছুটা দূরত্ব থেকেই যায়। ভক্ত ভক্তির পথ ধরে সরাসরি লক্ষ্যে পৌঁছে যান।
জ্ঞানবান জীবনভর জ্ঞানচর্চার পর শেষ দিকটায় অনুতাপ করতে থাকেন এই জন্যে যে তিনি সারা জীবন ধরে কেবল শুকনো জ্ঞানের কচ্কচি করে অযথা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন ও শেষ পর্যন্ত জীবনের লক্ষ্য থেকে দূরেই রয়ে গেছেন। কর্মীও ওই একই রকম হা-হুতাশ করে যান। ভাবেন সারাজীবন খেটেখুটে চরম সমাপ্তির লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছুলাম বটে কিন্তু চরম প্রাপ্তি তো ঘটলো না। ভক্তের কোন অনুতাপ নেই। ভক্তের চিত্ত তো সর্বদা আনন্দোচ্ছ্বল। তারা আনন্দে দিশাহারাও হন না, আবার ব্যথা-বেদনায় আতুরও হন না। অবিচ্ছিন্ন আনন্দানুভূতি ছাড়া তাদের দ্বিতীয় আর কোন অনুভূতিই থাকে না, তাই তারা সুখে-দুঃখে অবিচল থাকেন।
জ্ঞানবান যতোই সহজ-সরল হোক, তার চিন্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অহংকার লুকিয়ে থাকে। জ্ঞানবান ভাবেন, তিনি সমাজের আর পাঁচ জনের মতো নন। তিনি ভেবে থাকেন, তিনি যা জানেন বাকী লোকেরা তা জানেন না। এই অহংকার পতনের দিকে ঠেলে দেয়। তাই জ্ঞানবানের পতনের সম্ভাবনা থেকে যায়। যেখানে পতনের সম্ভাবনা, সেখানে পথটা ভাল হতে পারে কিন্তু নিরাপদ নয়। কর্মী যখন কোন কাজে সফল হয়েছেন ভাবতে থাকেন, তখন তার অহংকার জাগে। মুখে হয়তো বলছেন যে তিনি কিছুই করতে পারেননি কিন্তু চিন্তার জগতে গোপনে অনেক আশা পোষণ করতে থাকেন। কুশলী কর্মীরাও কাজ করার পরে অনেক সময় এ ধরনের মানসিক দৌর্বল্যের কবলে পড়েন। ভক্তের হারাবার কিছু নেই। তারা গুরু সত্যমানুষকে একান্ত আপনার বলে মানেন, তাই তাদের লাভ-ক্ষতির কোন ব্যাপারই নেই। কেবল ভক্তই বলতে পারেন, গুরু সত্যমানুষ সবার কাছে সমান। তিনি সুখ দেন আর দুঃখই দেন, তাতে কিছু যায় আসে না, কারণ দুঃখ-সুখ সবই তো সেই একই গুরুর অভিধান তাই তারা যখনই বিভিন্ন বিপরীতধর্মী পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, তখনই সুখ-দুঃখ-নিন্দা-অপমান ইত্যাদি বিরুদ্ধধর্মী অনুভূতির কাছে হেরে যান না।
ভক্ত কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কারো বিরুদ্ধে কোন বিদ্বেষ বা ঈর্ষার ভাব পোষণ করেন না। নিন্দা-স্তুতি তার কাছে কোন পার্থক্য বহন করে না! তিনি ফুল, ফল ও কাঁটাকে সমান ভালোবাসেন।
অভাব-অশান্তি দিয়ে গড়া এ সংসারে সংযোগ-বিয়োগ, সুখ-দুঃখ, রোগ-শোক, বিরহ-বিচ্ছেদ নিত্য ঘটনা। এটা দূর হবার নয়, কারও দূর হয়নি। এটা অনিবার্য্য। দূর করতে গেলে বহর বাড়ে মাত্র। সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধৈর্য্য ধরে গুরুর শিক্ষা অভ্যাস করাই প্রত্যেক গৃহীর পরম ধর্ম্ম। অভাব দিয়ে গড়া জগতে পূর্ণ সুখ-শান্তির আশা বিড়ম্বনা। এখানে আছে একধারে হাসি, একধারে কান্না, একধারে জীবন, অন্যধারে মৃত্যু, একদিকে সংযোগ, একদিকে বিয়োগ, একধারে মিলন, অন্যধারে বিরহ।
সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধৈর্য্য ধরে গুরুর শিক্ষা ও অভ্যাস অনুস্মরণ করাই প্রত্যেক গৃহীর পরম ধর্ম্ম। নিরবচ্ছিন্ন অনবদ্য সুখ-শান্তি আনন্দময় গুরুর চরণে। গুরু সুখস্বরূপ। তিনি ব্যতীত আর কোথাও সুখের লেশমাত্র নেই। বাহ্যিক বিষয়ে বা লোকের ভালবাসায় সুখ খুঁজলে অশান্তিই সার হয়ে থাকে। সুখ বাহিরে নেই, সুখ অন্তরে; সুখ ভোগ-লোভে নেই সুখ ত্যাগে, সুখ গুরুযোগে। বাহ্যিক বিষয়-সংযোগে যে সুখ হয়, তা আসক্তি – কলুষিত। চিন্তা জগতে গুরুর স্বরূপ উপলব্ধিই প্রকৃত নির্ম্মল ও পবিত্র সুখ। গুরুকৃপা মানে এই নয় যে, সংসারে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ আরামে দিন কাটানো। গুরুর আদেশ-উপদেশ-নিষেধ মোতাবেক হাসি মুখে লক্ষ্যপথে অগ্রসর হওয়াই যথার্থ গুরুকৃপা। নিজের মতলব সিদ্ধি হলো না বলে গুরুর দয়া, শক্তিমত্তা বা বিচারে সংশয় অজ্ঞানতা মাত্র। কামনা থাকলেই কাম্য বস্তুর বিয়োগে দুঃখ, সংশয়, ক্রোধ, অভিমান স্বাভাবিক। গুরুকৃপায় সত্যে কামনা পুঞ্জীকৃত হলে বিড়ম্বিত হওয়ার ভয় থাকে না।
কামনা বন্ধনের কারণ। কামনা হতেই সর্ব্বপ্রকার দুঃখের উৎপত্তি। তাই সত্যমানুষ হওয়ার পথের যাত্রীরা সর্ব্ব কামনা কর্ম্মনাশার চরণে সমর্পণ করে একাত্ম হন।
আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করলে বুঝতে পারা যায় কতটুকু শান্তির অধিকারী হলাম । অ-ভাব জীবনের একমাত্র অশান্তি ও নিরানন্দের কারণ। অজ্ঞানই অনন্ত প্রকার অভাবের সৃষ্টি করে। এই সংসারে সুখ-দুঃখ সবই মায়ার খেলা, অজ্ঞানের মোহিনী মূর্ত্তি। ব্যক্তি আপনাকে ভুলে এই মায়ার খেলায় মুগ্ধ হয়ে কখনও হাসছে, কখনও কাঁদছে; তবু তার চৈতন্যের উদয় হচ্ছে না। অন্যান্য দু’পেয়ে প্রজাতির মতো দৈহিক ভোগে মত্ত হয়ে নাচছে, আরো ভোগের অভাবে অতৃপ্তির দাবদাহে পুড়ছে। সুখ সুখ করে চারদিকে ছুটছে। মানুষ আপনাকে ভুলে রক্ত-মাংস, ধন-দৌলত, খ্যাতি-প্রতিপত্তির ধূলোখেলায় মত্ত! কালের চক্রতলে পড়ে হেসে-কেঁদে দেহ-কারাগারে বদ্ধ হয়ে আপন কারাগার দৃঢ় করে। গুরু মানুষের এই দুর্দ্দশা দেখে মতলবিদের সময় সময় উপদেশ দেন; অজ্ঞানীরা মনে করেন, তার বুঝি বিপদ্ উপস্থিত। বোঝে না তার গুরু-দয়াময় তার বন্ধন মোচন করে দিচ্ছেন। গুরু প্রদত্ত জ্ঞান হলে ভক্তের কল্পিত অভাব দূর হয়। তখন তিনি স্ব-ভাব লাভ করে শান্তি ও আনন্দের অধিকারী হন।
সৃষ্ট পদার্থ মাত্রেই অপূর্ণ পূর্ণের অংশ। অপূর্ণ বস্তু লাভ করে অভাব মিটে না। কারও মেটে নাই, মিটবার সম্ভাবনাও নাই। মানুষ সুখের কল্পনায় দুঃখ পাচ্ছেন। কেউ কাহারও সুখ-দুঃখের কারণ নয়। স্থান, কাল, পাত্র নিমিত্ত মাত্র।
যখন কর্ম্মফলে অশান্তি, তখন তিনি যেখানেই যাবেন, অশান্তি সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হবে।
প্রেম-সত্য-শান্তি চলমান, জগতের কোনও এক স্থানে জমাট বেঁধে নেই; যার আছে, জগতের সর্ব্বস্থানেই তার শান্তি অব্যাহত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন