বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আমরা সবাই জানি.... - ২৫


মানুষ সংসার নিয়েই মত্ত। তারা ভাবেন যে, সংসারে বেশ সুখে ও নির্ভয়ে আছে। এটা বুঝতে পারেন না যে, লক্ষ্যহীন সাগরে ডুবে রয়েছে। মানুষ যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন, তখনও এমনি মায়া যে, প্রদীপে বেশী সল্তে জ্বললে বলেন, ‘তেল পুড়ে যাবে, সল্তে কমিয়ে দাও।’ আবার তার পরিবার বলে, ‘তুমি তো চল্লে, আমার কি করে গেলে?’ মানুষ সর্ব্বদা বিষয়েই আসক্ত, ভুলেও কখনও স্রষ্টার চিন্তা করেন না। তারা অবসর পেলে, আবোল-তাবোল গল্প করেন, না হয় বৃথা কাজ করেন। সময় কাটে না দেখে পরচর্চা করেন, তবু স্রষ্টার চিন্তা করেন না। উট কাঁটা ঘাস খেতে ভালবাসে। যত খায়, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে, তবুও ছাড়ে না। মানুষও তেমনি, তাদের কিছুতেই হুঁস হয় না। এত শোক, তাপ, দুঃখ দাগা পায়, এত বিপদে পড়ে, তবুও চৈতন্য নাই যেমন তেমনি যারা জন্মাচ্ছে বা জন্মেছে, তাদেরই ভাল খাওয়াতে-পরাতে, কিংবা ভাল জায়গায় রাখতে পারেন না, তবুও নিবৃত্তি নাই, জন্ম দিচ্ছেন। মোকর্দ্দমা করে সর্ব্বস্ব যাচ্ছে, তবুও মোকর্দ্দমা করছেন। সংসারী লোকদের সংসার থেকে সরিয়ে এনে ভাল জায়গায় (সাধুসঙ্গে) রাখা যায়, তাহলে হেদিয়ে হেদিয়ে মরে যাবেন। বিষ্ঠার পোকার বিষ্ঠাতেই আনন্দ, তাতেই বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়, যদি তাকে এনে ভাতের হাঁড়িতে রাখা যায়, সে মরে যাবে। গোবরের পোকা গোববের ভিতর থাকতে ভালবাসে, তাকে এনে পদ্মের ভিতর বসিয়ে দিলে ছট্ফট্ করে মারা যাবে। বিষয়ীও সেইরূপ বিষয়ের কথায় আনন্দ পায়; ধর্মকথায়, ত্যাগের কথায় মারা যাবার মতো বোধ করেন। মানুষকে হাজার শিক্ষা দিলেও, কিছুই করতে পারেন না। পাথরের উপর পেরেক মারতে গেলে, ভেঙ্গে যাবে, পাথরের কিছুই হবে না। সাধু সঙ্গ করে আসেন, কিন্তু যেমন তেতো তেমনি তেতোই থাকেন। মানুষের সামনে স্রষ্টার-কথা হলে, তিনি সেখান থেকে সরে যান। বলেন এসব মরবার সময় হবে, এখন কেন? মানুষ তীর্থ করতে গেলেও সেখানে গিয়ে স্রষ্টার চিন্তা করেন না, কেবল পরিবারের পুঁটলি বয়ে বেড়ান; আর মসজিদ, গীর্জা, প্যাগোডা, মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করেন ও গড়াগড়ি দেন। এতেই ব্যস্ত থাকেন। মানুষ নিজের ও পরিবার-স্বজনের পেটের জন্য দাসত্ব করেন। যারা স্রষ্টার চিন্তা করেন, ধ্যান করেন, মানুষ তাদের পাগল ব’লে উড়িয়ে দেন। সংসারী লোকগুলোর কোন লক্ষ্য নেই। তারা তিনটা জিনিসের দাস। টাকার দাস, অভ্যাসের দাস, আর যশের দাস। মানুষ স্রষ্টার নাম নিজেও শোনেন না, পরকেও শুনতে দেন না, ধর্ম্মসমাজ ও ধার্ম্মিকদের নিন্দা করেন এবং উপাসনা করলে ঠাট্টা করেন। কুমীরের গায়ে অস্ত্র মারলে ঠিকরে পড়ে, তার গায়ে কিছুমাত্র লাগে না। মানুষের কাছে ধর্ম্মকথা যতই বলা হোক না কেন, কিছুতেই তাদের অন্তরে প্রবেশ করে না।
স্প্রীংয়ের গদির উপর বসলেই নুয়ে যায়, উঠলেই আবার যেমন তেমনি। সংসারী লোকেরা যখন ধর্ম্মকথা শোনেন তখন একটু ধর্ম্মভাব হয়, কিন্তু সরে গেলেই সব ভুলে যেমন তেমনি হয়ে পড়েন।
কামারশালের লোহা, যতক্ষণ হাপড়ে থাকে ততক্ষণ লাল দেখায়; যেমনি বার করা হয়, অমনি কাল হয়ে যায়। সংসারী মানুষগুলোও তেমনি। ধার্ম্মিকের কাছে থাকলে একটু ধর্ম্মভাব দেখা যায়, কিন্তু সরে এলেই, সে ভাব আর থাকে না। গরম লোহায় জলের ছিটে যেমন শুকিয়ে যায়, মানুষের কাছে ধর্ম্মকথাও সেইমত উবে যায়। এক কান দিয়ে শোনেন, আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। পায়রার ছানার গলায় হাত দিলে যেমন মটর দানা গজ্গজ্ করে, সেরকম মানুষের সঙ্গে কথা কইলে টের পাওয়া যায় তাদের ভিতর বিষয় বাসনা গজ গজ করছে। বিষয়-কথাই তাদের ভাল লাগে, ধর্ম্ম-কথা ভাল লাগে না। বড় বড় দোকানে চাল-ডালের বড় বড় ঠেক থাকে; পাছে সেগুলো ইন্দুরে খায়, তাই দোকানদার কুলোয় করে মুড়কী রেখে দেন। সোঁদা সোঁদা গন্ধ আর মিষ্টিও লাগে; তাই যত ইন্দুর সেই কুলোতে গিয়ে পড়ে, ঠেকের সন্ধানও পায় না। মানুষ সংসারে কামনার-মায়াজালে মুগ্ধ হয়ে যান, স্রষ্টার খবর পর্যন্তও পান না। সংসারের কোন্দল শুনে, বাগানে বেড়াতে বেড়াতে একটা ফুল হাতে করে তুলে সঙ্গীকে বলেন ‘স্রষ্টা কি সুন্দর ফুল করেছেন!’ বিষয়ীরও ধর্মভাব ঠিক এরূপ ক্ষণিক।
যখন অন্তরে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কর্মের ফললাভ আপনা আপনিই হয়। সাধনার পথের যাত্রীগণও বাকসিদ্ধ হন। তারা যা বলেন তাই হয়। কোন বস্তুকে যেমন দেখা হয়, তাকে কথার দ্বারা তেমনভাবেই প্রকাশ করা হলো সত্যাচার। যেমন অনুভূতি তেমন প্রকাশ। যেমন শিশু বস্তুকে যে রকম দেখে, সেই রকমই প্রকাশ করে। এইরকম শিশুভাবের দ্বারাই অন্তরে সত্যপ্রতিষ্ঠা হয়। কুটিলতার জন্ম সংকীর্ণতা হতে হয়। তাইতো মানুষ অসত্যবাদী হয়ে যায়। অসত্য কথন ভয় বা কোন উদ্দেশ্যপূর্তির জন্য করা হয়। এই কথন অহিংসার অনুগত হওয়া দরকার। কখনও কখনও হিংসা আর সত্যের মধ্যে সমঝোতা করবার প্রয়োজন হয়। সেই সময় প্রকাশ না করা, মৌনাবলম্বন করা শ্রেয়। যখন প্রকাশ করা হবে, তখন তাকে সত্যভাবেই প্রকাশ করা উচিত। নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংগ্রহ না করা এই ভাবের প্রতিষ্ঠা করা। লোভবৃত্তি নির্মূল হলে এই ভাব প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হবে।
জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম আবশ্যক বস্তুর গ্রহণ করা আর বাকির পরিত্যাগ করা। কোনও বস্তুকে গ্রহণ করবার পূর্বে তাকে বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত যে সেটা অত্যাবশ্যক কি না। গ্রহণ বাইরের বস্তুর সাথে যুক্ত, অপরিগ্রহ ভিতরের ভাবের সাথে যুক্ত। অপরিগ্রহের ভাবনা হলে একপ্রকার নিজেকে সর্বদা মৃত্যুর সম্মুখীন রাখা। সব কিছু বিনষ্ট হয়ে গেলে অন্তরে বিকারের উৎপত্তি হওয়া উচিত নয়। সত্যবক্তা হন বাকসিদ্ধ। তিনি যাই বলেন, তাই ফলে। যখন চিত্তে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তা বীতরাগ হয়ে যায়। সেই চিত্তে কোন প্রকারের উদ্দেশ্যপূর্তির আকাক্সক্ষা থাকে না। এই চিত্ত আকাশকল্প। তাতে যে ভাবের জাগরণ হয়, তা ফলীভূত হবেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন