শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

সময়ের সাফ কথা…. চেতনার পদচারণা চলছে চলবে

সময়ের সাফ কথা…. 

চেতনার পদচারণা চলছে চলবে

সংলাপ ॥ সারা বিশ্বে বাঙালি জাতি অত্যুজ্জ্বল তার গৌরবময় স্বাতন্ত্রে। প্রত্যেক জাতিরই আছে নির্দিষ্ট ভাষা যার পুষ্পিত শাখায় প্রস্ফুটিত হয় সে জাতির স্বকীয় চিন্তা, চেতনা, ধ্যান-ধারণা অর্থাৎ তার স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। ভাষাতেই প্রবাহিত হয় তার সত্তার সলিল ধারা।  ভাষা জাতির প্রাণের সম্পদ, অচ্ছেদ্য হৃদ-স্পন্দন। কখনো কেউ সে হৃদ-স্পন্দনে যমের কালো থাবা বসাতে চাইলে কিংবা প্রাণের সম্পদ জবর দখল করে ফলাতে চায় স্ব-ইচ্ছার ফসল তখনই জাতি সোচ্চার হয়ে ওঠে প্রতিবাদে, অস্তিত্বের ভিত্তি রাখতে সুদৃঢ় হয়ে ওঠে উৎসর্গিত প্রাণ। প্রমাণ করেছে একমাত্র বাঙালি জাতি সমস্ত বিশ্বের মধ্যে। নিঃসঙ্কোচে দূরন্ত সাহসে বুকের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে সুরক্ষিত করেছে বাঙালি জাতি অমূল্য মানিক – বাংলা ভাষা।
শুধু ইতিহাসের ধূলিধূসর কালো অক্ষরে নয়, সমস্ত বাঙালির সতেজ বুকে ৮ ফাল্গুন তাই এক অমর অমলিন রক্তাক্ত পোষ্টার। ৮ ফাল্গুন আসে। ৮ ফাল্গুন যায় না। প্রতিনিয়ত ৮ ফাল্গুন আমাদের বন্ধ দরজার কড়া নেড়ে আমাদের জাগায়। ৮ ফাল্গুন তার আলিঙ্গনে আমাদেরও রাঙিয়ে তোলে নিত্য নতুন চেতনায়। তাই তো আমরা পেয়েছি ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস।
প্রতিবারের মতো এবারও ৮ ফাল্গুন ও ২১ ফেব্রুয়ারি আসছে সততঃ নিয়মে। কিন্তু এ যাত্রা বাঙালি জাতির চরম পরীক্ষার। মুখোশধারী বাঙালিদেরকে চিনিয়ে দিয়ে যাবে নীরব অভিমানে। রেখে যাবে এক বিরাট প্রশ্ন। প্রশ্ন হলো – তথাকথিত ধর্মীয় আচার, না-কি জাতীয় চেতনা, কোনটা বড়? এ দুয়ের কোন সরোবরে স্নান করে সত্তাকে পূত সজীব রাখতে হবে? মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের যে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিক কর্মতৎপরতা তা কি একেবারেই মূল্যহীন? ‘সারিবদ্ধ বাঙালি উন্মুক্ত পায়ে ধীর লয়ে হেঁটে চলে। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে হাতে ফুল। মুখে অমর-অমর গান। বিভিন্ন নিবেদিত সংগঠনের বিচিত্র আল্পনা পথে পথে। অসংখ্য বাঙালির সমাবেশ শহীদ মিনার চত্বরে। বক্তৃতা, সেমিনার, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখরিত চতুর্দিক।’ এমনই হয়ে থাকে, হয় প্রতি বছরে। আন্দোলন মুখর বাঙালি ফাল্গুনের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েই একদিন জয় করলো কাক্সিক্ষত মুক্তির সোনালী সূর্য। পরাধীনতার সেই নিগুঢ়ে বাঙালি যে কুঠারাঘাত হেনেছিলো তা ’৫২ র ফাল্গুনেরই শাশ্বত বিদ্রোহী মুক্তিপাগল চেতনারই চরম প্রকাশ।
জাতীয় চেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনার কোনো তফাৎ নেই কিন্তু তফাৎ আছে ধর্মীয় চেতনার নামে আনুষ্ঠানিকতা এবং তথাকথিত মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সঙ্গে। জাতীয় চেতনাকে ছাপিয়ে তথাকথিত ধর্মীয় স্বরচিত অনুশাসন কখনোই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। তাহলে নিঃসন্দেহে সে জাতি সম্মুখীন হয় বিরাট বিপর্যয়ের। আজ সমগ্র বিশ্বের মানচিত্রে একবার চোখ ফিরালেই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। যে জাতির মধ্যে তার জাতীয়তাবাদ প্রবলভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, সে জাতি কখনোই বিভক্ত থাকতে পারে না।
স্বকীয় জাতীয় সত্তাকে অক্ষুন্ন রাখার তাগিদেই অবধারিতভাবে বাঙালি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। এরপরে আর জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মীয় চেতনার মাঝে বিতর্কের অবকাশ থাকে না। তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে অর্থাৎ তার সামগ্রিক সত্তাকে পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও তার স্বজাতীয়তাবোধ তাকে উজ্জীবিত করবেই। পৃথিবীতে কোথাও ধর্মীয় জাততত্ত্বের বন্ধনে কোনো জাতিই সৃষ্টি হয়নি, হবেও না। সবকিছুর উর্দ্ধে অর্থাৎ সর্বপ্রথম জাতীয়তা তারপর অন্য কিছু এই সহজ বোধ কি সর্বসাধারণের মাঝে সুপ্রতিষ্ঠিত? কেন এই কঠিন পরীক্ষায়  আমরা উতরাতে পারিনি? কাদের দায়িত্ব এই বোধ সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলার? নিঃসন্দেহে বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলের, কিন্তু এই বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা যে একই দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাকে আজো আবদ্ধ হয়ে ঘুরছে। অন্যকে পরিত্রাণের পথ তারা কি করে দেখাবে?
নিজেদের উৎসর্গিত করে যারা রেখে গেলেন অমূল্য মানিক বাংলাভাষা, তারা কি চিরস্মরণীয়, চিরপূজনীয় নয়?  মহান ভাষা শহীদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশে যে দ্বিধাগ্রস্থ বা উদাসীন সে কি সত্যিকারভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ? না অন্য কিছু? অকৃতজ্ঞের মতো কি ভুলে যাওয়া যায় আজন্মের ঋণ? তাই ভাষার জন্য শহীদদের চেতনা দীপ্ত মহান দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিকে হয়ে উঠতে হবে যথাযথ বাঙালি সর্বাগ্রে। নতুবা পরিপূর্ণ মূল্যবোধ বিকাশ কোনোদিনই সম্ভব নয়। হানা দিচ্ছে আজ ধর্ম-পণ্যসর্বস্ব সওদাগরের সর্বগ্রাসী দল। সময় থাকতে তাই সতর্ক হতে হবে এবং সক্রিয়ভাবে তৎপর হওয়ার সময় এসেছে জাতীয় মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত এক মহান জাতি গঠনে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন