শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নতুন একটা আদর্শ চাই

নতুন একটা আদর্শ চাই


সংলাপ ॥ জাতীয়তাবাদ নিয়ে অনেক কথা, অনেক চর্চা চলে আজকাল আমাদের দেশে। দেশপ্রেম নিয়ে বড়াই হয় বিস্তর। সে সব চর্চায় জাতীয় গৌরব বাড়ে কি না, জানা যায়নি। সে সব বড়াইয়ে দেশের প্রতি প্রেম কী ভাবে প্রতিভাত হয়, তাও স্পষ্ট হয়নি। প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে পারে। কিন্তু শত্রুতা থাকতে পারে না কোনও মতেই। কারণ দিনের শেষে গন্তব্যটা অভিন্নই, জাতীয় পতাকাকে সুউচ্চে ধারণ করার যোগ্যতা অর্জন করা। কিন্তু দেশের মাটিতে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম ‘দেখভাল’ করার দায়িত্ব যাঁদের উপরে, তাঁরা আদৌ কোনও শিক্ষা নিলেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে সব দলই দেশপ্রেমের বিপুল বড়াই করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে দেশের প্রভূত ক্ষতি করার অভিযোগ তোলে। রাজনীতিতে এ ধরনের প্রতিযোগিতা বা সংঘাত নতুন কিছু নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ রাজনীতির ময়দানে এ রকম সংঘাতের সাক্ষী থাকে। কিন্তু কোনও সভ্য রাষ্ট্রে এ সংঘাত এমন কোনও চেহারা নিতে পারে না, যাতে বহির্বিশ্বের কাছে দেশের নাম অনুজ্জ্বল হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডেলের দিকে লক্ষ্য রাখলেই স্পষ্ট হয়, জাতীয় স্বার্থে কী ভাবে কাছাকাছি আসতে পারে দুই যুযুধান শিবির। ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান, মার্কিন রাজনীতিতে দুই দলের সংঘাত বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে গিয়ে ডেমোক্র্যাটরা রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে বা রিপাবলিকানরা ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন, এমনটা দেখা যায় না। এটাই পরিণত গণতন্ত্রের কাঙ্খিত ছবি।
নিজেকে বিশ্বের একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করে বাংলাদেশ কিন্তু এই গণতান্ত্রিক পরিণতমনস্কতা দেখাতে পারেনি। বিদেশ সফরে গিয়ে রাজনীতিকরা বার বার বিরোধী দলকে আক্রমণ করবেন, দেশের পূর্বতন সরকারগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, এমন অভিযোগ তুলবেন এ মোটেই কাম্য নয়। এতে গণতান্ত্রিক রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। গণতান্ত্রিক সৌজন্য বজায় রাখা শুধু নয়, অনেক দেশে জাতীয় স্বার্থে সংসদ সদস্যরা দলীয় নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ভোট দিচ্ছেন, এমন দৃষ্টান্তও বহুবার তৈরি হয়েছে। সে দৃষ্টান্ত থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিকরা যে শিক্ষা নিতে পারেননি, তা বেশ স্পষ্ট।
দেশে একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা আছে যার নানা কাজের মধ্যে একটা হলো আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, আরও মৌলিক স্তরে নাগরিক স্বস্তি ও সুব্যবস্থার কতকগুলো নীতি বা শর্ত রক্ষা করা। এই লক্ষ্য পুরোপুরি পালন হওয়া দূরের কথা, তার উদ্যোগ যে চরম ত্রুটিপূর্ণ ও নীতিভ্রষ্ট হবে, তা আমরা মেনে এসেছি। তবু একটা ছক, একটা বাস্তব প্রত্যাশা আমাদের ছিল, না মিললেও খামতিটা কোথায় ধরতে পারতাম।
তারা বুঝিয়ে বলবেন মনে হয় না, আমাদেরই বুঝে নিতে হবে। সেটাও সহজ নয়, কারণ দৈনন্দিন প্রশাসন তেমন পাল্টায়নি, পাল্টাবেও না। ট্রাফিক আইন ভাঙলে জরিমানা দিয়ে যেতে হবে, পকেটমার বা ছিঁচকে চোর হাজতে যাবে পূর্ববৎ। পরিষেবা-পরিকাঠামোর উন্নয়ন অব্যাহত থাকতে পারে, বাড়তে পারে পর্যন্ত। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার বৃহত্তর গতিবিধি-উদ্দেশ্য কোথায় যেন আমূল পাল্টে যাবে বা গিয়েছে। সেটা নতুন করে জানতে হবে, বুঝতে হবে আমাদের দৈনিক সুখদুঃখ নিরাপত্তা আত্মসম্ভ্রমের উপর তার প্রভাব।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নতুন একটা কাজ জুটলো। ধর্মকে হিংসা-বিদ্বেষে নিমজ্জিত করে কী চরম অধর্মে পর্যবসিত করা যায়, তা আমরা দেখে চলেছি। এবার হয়তো আর একটা বড় আদরের, বড় পবিত্র ভূমির উপর আমাদের দুর্বল স্বত্ব হারাতে চলেছি, সেটা গণতন্ত্র। তাই নতুন একটা গালভরা আদর্শ চাই যা নিয়ে কিছুদিন মাতামাতি করা যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন