শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নিরাময় ঘটাতে হবে মানসিক স্থবিরতার

সময়ের সাফ কথা…. 

নিরাময় ঘটাতে হবে মানসিক স্থবিরতার

সংলাপ ॥ গলদ রোগ রয়ে যাচ্ছে চেতন জগতের শেকড়েই। সমস্যাটা শেকড়ে বলেই রোগমুক্তিটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওপরে ওপরে চিকিৎসা করে লাভ খুব হবে না, গভীরে গিয়ে নিরাময় ঘটাতে হবে এই মানসিক স্থবিরতার। সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবিকতা ইত্যাদি কোনও জাতির বা ভাষার বা ধর্মের বা বর্ণের ঐকান্তিক অধিকার বা পরিচিতি নয়। এই সবই আসলে চলমান সভ্যতার শিক্ষা, প্রতিটি সভ্য মানুষের পরিচিতি, প্রতিটি সভ্য মানুষের আবশ্যিক বৈশিষ্ট। কিন্তু সে কথা আমরা স্মরণে রাখছি না। সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং সভ্যতার দোহাই পেড়ে উন্মত্তদের থামতে বলছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই বার বার বলছেন, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’, অথবা ‘বাংলাদেশে এ সব হয় না’ অথবা ‘বাঙালির সংস্কৃতিতে এ সব নেই’। আমাদের প্রত্যেককে স্মরণ রাখতে হবে, পৃথিবীর সব সভ্য মাটিই দুর্জয় ঘাঁটি, পৃথিবীর কোনও সভ্য প্রান্তেই এ সব হয় না, পৃথিবীর কোনও সভ্য সংস্কৃতিতেই এ সব নেই। শুধু বাংলাদেশ  খুব উদার, সহিষ্ণু এবং মানবিক আর উপ-মহাদেশের অন্য নানা প্রান্ত অনুদার, অসহিষ্ণু এবং অমানবিক এই ধরনের মন্তব্য বা মতামত বা ভাব প্রকাশের মধ্যেও একটা সাংঘাতিক সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে। সেটাকে আমরা চিনতে পারি না অনেকেই। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করা অনেক বাঙালিই এই সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত। যে কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উপড়ে ফেলার সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে আজ। অতএব প্রত্যেককে আত্মবিশ্লে­ষণ করতে হবে। কণামাত্র সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বও থাকলে, তারও বিনাশ ঘটাতে হবে। তা হলেই মৌলিক পরিবর্তনটা আসবে। তা হলেই এই অনর্থক এবং বর্বরোচিত অশান্তি থেকে দূরে থাকতে পারব আমরা। বাংলাদেশে এ সব হয় না, বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায় না এ জাতীয় সারবত্তাহীন মন্তব্য করে লাভ নেই। কারণ তাতে সঙ্কটমুক্তির কোনও পথ নেই। আমরা যে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছি, সেই বার্তাটা চারিয়ে দেয়াই সবচেয়ে জরুরি। একটা বিভাজন যখন রক্তাক্ত করছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে, তখন বাঙালি আর বাংলাদেশী বা বাঙালি মুসলমান আর মুসলমান বাঙালি বা বাংলা আর না-বাংলার মধ্যে বিভাজনের তত্ত্ব সামনে আনা যে বিচক্ষণতার কাজ নয়, সে কথা বোঝা জরুরি খুবই বিশেষ করে রাজনীতিক সম্প্রদায়ের।
দেশের বা পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই সাম্প্রদায়িক হিংসা কাম্য নয়। এই হিংসা মানবতার ঘোরতর অপমান। কোথাও অশান্তি চাই না, দেশের কোনও প্রান্তেই হিংসার আগুন চাই না আমরা। মসজিদ মন্দির গীর্জা মঠ দরবার আস্তানা আশ্রম যাত্রী সবাই শান্তিতেই বাঁচতে চান, সকলেই জীবনে সুস্থিতি চান, পারস্পরিক সম্প্রীতি চান।
তা সত্ত্বেও অশান্তি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার আগুন লেলিহান শিখা সমাজের  মাঝে-মধ্যেই আত্মপ্রকাশ করছে। আগুনের শিখাটা লকলক করে উঠতে পারছে কারণ, সাম্প্রদায়িকতার বীজ নানা রূপে আমাদের অনেকের মধ্যেই কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছে। সেই বীজই আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে। সেই বীজ রয়েছে বলেই ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার কারবারিরা আমাদের অনেককেই আজও ফাঁদে ফেলতে পারছে।
সাম্প্রদায়িকতার বা সঙ্কীর্ণতার প্রতিটি বীজকে চিহ্নিত করতে হবে, ছুঁড়ে ফেলতে হবে অস্তিত্বের অনেক দূরে। তার জন্য শুধু কোন এলাকায় নয়, গোটা দেশে শান্তি বহাল রাখার তাগিদ অনুভব করতে হবে। শুধু দেশকে নিয়ে নয়, গোটা পৃথিবীকে নিয়ে ভাবতে হবে। যে দিন সে ভাবে ভাবতে পারবে সবাই, সে দিন আর হয়তো দেখতে হবে না কোনরকম হিংসার পুনরাবৃত্তি।
সমাজ ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব, সমাজ-পরিবেশের নিজস্ব ঘাত-প্রতিঘাত যে-ভাবে ব্যক্তিকে নাড়া দেয়, তার চিন্তাজগতের পরিবর্তন বা পরিণতি ঘটায়, সেই গতিশীলতা নানা ভাবে ধরা পড়তে পারে কর্মে। ব্যক্তি অনাগত দিনকে কল্পনায় যে-ভাবে আঁকছেন, সেই ছবি বদলে যেতে পারে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু একটা বিশেষ মুহূর্তে ব্যক্তি যে কর্মের জন্ম দিচ্ছেন, তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে ওই ব্যক্তির তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য থাকে। ব্যক্তির যে কোন শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। শিল্প সত্যনিষ্ঠ  তারপরে সৌন্দর্য নিষ্ঠ। ব্যক্তির নীতি আর ব্যক্তির কর্মের নীতি আলাদা হয়ে গেলে সত্যনিষ্ঠার প্রশ্নে বিচ্যুতি আসবেই, আর কোথাও না কোথাও সে ফাঁকি ধরাও পড়বে।
সমাজের অন্যায় বৈষম্য আর কদর্য ভণ্ডামির দিকে আঙুল তুলতে পারলে, শোষিত মানুষের পাশে থাকার উজ্জ্বল অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়া যায়। ব্যক্তির শিল্পগুণকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ না করে তার প্রেরণা-জাগানো কর্মে যে সুস্পষ্ট নৈতিক অভিমুখ নির্দেশ করে, ব্যক্তির নৈতিক চেতনা আর তার কর্ম নীতির একাত্মতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। কোন পরিস্থিতিতে কী কারণে ব্যক্তির নৈতিক অবস্থানে কতটা পরিবর্তন এসেছিল বা আসছে, তা কতটা অভিপ্রেত ছিল বা আছে, এগুলো নিয়ে নিজের সাথে নিজের বা আদর্শিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে জীবন ও কর্ম সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রেখেই চলে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন