বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

শেকড়ে শান্তি ও সত্যপ্রিয় বাঙালি

শেকড়ে শান্তি ও সত্যপ্রিয় বাঙালি

· তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং মিথ্যাকে ব্যর্থ করেন - যদিও অপরাধীরা ইহা অপছন্দ করুক না কেন। ৮:৮।
· আল্লাহ্ নিজ কালাম সমূহ দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন যদিও অপরাধীগণ ইহাকে অপছন্দ করে। ১০:৮৩।
· আমরা তাহাদিগকে কর্ণ, চক্ষু এবং হৃদয় দান করিয়াছিলাম। কিন্তু তাহাদের কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় কোন কিছুই তাহাদের উপকারে আসিল না; কারণ তাহারা অস্বীকার করিত এবং যে আযাব লইয়া তাহারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিত উহাই তাহাদিগকে পরিবেষ্টন করিয়া ফেলিল। ৪৬:২৭।
·  সত্যকে মিথ্যা বলিয়া প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য দুর্ভোগ। ৮৩:১১।

সংলাপ ॥ একরৈখিকভাবে লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে চিন্তাপ্রবাহের মাঝে ভ্রাম্যমান থাকলে বিবেকের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। আর বিবেক থেকে উদ্ভব হয় চেতনা। চেতনাকে সুদৃঢ় করে যুক্তি। চেতনা স্থান-কাল-পাত্রের উপর নির্ভরশীল। বস্তুবাদী দর্শনের বিষয়বস্তুর মতো ধর্মীয় দর্শনের বিষয়বস্তু সমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল। বস্তু যেমন গতিশীল ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ঠিক তেমনি মানুষের ধর্ম ও ধর্মচিন্তা ছিল-আছে-থাকবে গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ সদা সর্বদাই পুরাতন থেকে নতুনের উত্তরণ এবং উর্দ্ধমুখী। তাই ধর্ম সর্ব সময়ে বর্তমান।
মানব সমাজে ধর্ম কোন বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা নয়। প্রাকৃতিক দেহ সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার, সংস্কার ও সংকীর্ণতার মূল খুঁজতে গেলেই ধর্মের উৎপত্তি পাওয়া সহজ হবে। ধর্ম যখন আধিপত্যবাদীদের (তা সমাজের, রাষ্ট্রের যে অঙ্গনে বা স্তরেই হোক না কেন) হাতিয়ার হয়ে যায় তখন ধর্মের ভয়াবহ রূপ ধরা পড়ে মানবসমাজে উগ্র ধর্মান্ধতা হয়ে।
আধিপত্যবাদীরা সব সময়েই ধর্মকে ছলে-বলে-কলে কৌশলে এমনভাবে মোড়ক দিয়ে রেখে আসছে যাতে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের আসল রূপ ‘শান্তি’ ও ‘সত্য’ না বেরিয়ে পড়ে। তাই ধর্মের প্রগতিশীলতা মেহনতি মানুষের হাতিয়ার হতে পারেনি, এখনও পারছে না, আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে একনিষ্ঠ, শান্তিপ্রিয়, সত্যবাদী, নির্ভীক, দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের দল ও সরকার। শ্রমজীবী মানুষ ধর্মভীরু, পরিশ্রমী বিশেষ করে বাংলাদেশে। সমাজ কাঠামো পরিবর্তন করে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধর্ম যে প্রাকৃতিক, স্ব-ভাব, শান্তি ও সত্যের আধার তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা। শুধু তাই নয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ধর্মের বা জীবন চলার পথে, মানুষের প্রগতির পথে পরিবর্তনের সহায়ক, এটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যারা সত্যকার দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে চায় তাদের প্রথমে শান্তি ধর্মের মূল্যবোধগুলো ধারণ-লালন-পালন করতে হবে। সার্বিক শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে আধিপত্যবাদীদের - এটাই প্রকৃত ধার্মিকের কাজ।
বাংলাদেশের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৌদি ইসলামের ধর্ম-ব্যবসায়ী, ধর্মবেত্তারা এমনভাবে ঢুকে পড়ে মিথ্যাচারের প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে যাতে মনে হয় রাজনীতিকরা আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। শ্রমজীবী মানুষকে তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে, বেহেস্তের প্রলোভন দেখিয়ে, ভবিষ্যতের কথা বলে মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধর্মের নামে ব্যবসার জাল বিছিয়ে শোষণ এবং শাসন করে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে উঠতি রাজনীতিক লুটেরা শ্রেণী। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উপর থেকে আস্থা হারাতে হারাতে এমন এক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, যে কোন সময়ে যে কোন অঙ্গনে কোন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।
তাই মিথ্যাচার ছেড়ে দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনীতিকরা রাজনীতি করুন, ধর্ম-ব্যবসায়ী ধর্মবেত্তারাও ধর্মজীবী না হয়ে ধর্মের সত্যকে তুলে ধরুন, নচেৎ সময় আসছে আপনাদের কথাও কেউ কানে নেবে না।

বাংলাদেশে আপনাদের চেহারা জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আপনারা নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর ধর্ম ইসলাম (শান্তি) প্রতিষ্ঠার জন্য কোন কর্মকা- করছেন না বরং ওহাবী-এজিদি-মওদুদী পন্থা অনুসরণ করে মুখে মুহাম্মদী ইসলামের কথা বলে সম্পদের পাহাড় বানানোয় ব্যস্ত। দেশবাসী আপনাদের সব সম্পদের খবর পেয়ে গেছে। জনগণ রুখে দাঁড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের পোশাক ও সংস্কৃতি আপনাদের জন্য কাজে লাগবে না। অদূর ভবিষ্যতের জন্য রাজনীতিক সহ পেশাজীবীরা সজাগ হোন। সময় ও পরিবেশ কাউকে ছাড় দেয় না। কেহই আল্লাহ্র আইনের বাইরে নয়। এটাই স্মরণ রাখার চেষ্টা করলে জাতির জন্য শ্রেয় এবং দেশের উন্নতির জন্য চলার পথে সহায়ক হবে। 

সময়ের সাফ কথা.... অজ্ঞতার অন্ধকারে

সময়ের সাফকথা....
অজ্ঞতার অন্ধকারে

সংলাপ ॥ মৌলবাদ শব্দটির উৎপত্তি আশির দশকে। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা ফান্ডামেন্টালিজম-এর বাংলা করতে গিয়ে এই ‘মৌলবাদ’ শব্দটি গণমাধ্যমে চালু করে। শেকড়ের সন্ধানে না গিয়ে, এখন এই শব্দটি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর রাজনীতিকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশেও। আমেরিকার রক্ষণশীল প্রোটেষ্ট্যান্টরা খ্রীষ্টান ধর্মের কতগুলো মৌল সত্য ধরে নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলো বলে তাদের বলা হতো ফান্ডামেন্টালিস্ট। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বা ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য ছিল না। এই আন্দোলন পর্যালোচনা করে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী পশ্চিমারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো যে, ধর্মের নামে উগ্রপন্থী তৈরি করে ও তাদের রসদ জুগিয়ে যে কোন দেশে উন্নতিতে বাধা দেয়া এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা সহজ। ফলে সেই দেশ তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে ও চাটুকার হয়ে পড়বে দু’মুঠো ভাতের জন্য। এর প্রভাব পড়ে বিশেষ করে মুসলমান বিশ্বে। তারা প্রতিটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশে ধর্মের নামে উগ্রবাদী তৈরি করে তাদেরকে রসদ জোগাতে লাগল মুসলমান-মুসলমানের মধ্যে লড়াইয়ের জন্য। আজও সেই ধারা বর্তমান। আজও অজ্ঞ মুসলমানরা প্রতিটি দেশে মেতে আছে আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা ও চর্যা না করেধর্মান্ধ হয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে চলছে। ফলে রাষ্ট্রের উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই উগ্রপন্থীরা চিৎকার করে ধর্ম গেল বলে, বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামি শরিয়া প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নাম করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাবার জন্য তারা এতো উন্মাদ হয়ে উঠেছে যে সমাজে যে কোন ধরনের সন্ত্রাস ও মিথ্যা ফতোয়া থেকে আরম্ভ করে যে কোন জঘন্য কাজ, খুন, ডাকাতি, নির্যাতন, অগ্নি-সংযোগ ইত্যাদি সব কিছু তারা করছে। জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের লক্ষ্য নেই। বর্তমানে সন্ত্রাস আর এই ধর্মান্ধতা দেখে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তাদেরকে আখ্যায়িত করছে মৌলবাদী বলে।

অপ্রিয়হলেও সত্য পৃথিবীর কোন মুসলমান রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ মোহাম্মদী ইসলাম আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নাই বা করার প্রচেষ্টাও নেয়া হয় নাই। কারণ হিসেবে পাওয়া যায় - ‘শান্তি ও মানবতার’ ধর্ম রূপান্তরিত হয়ে চলছে ‘ব্যক্তি স্বার্থের’ ধর্মে নবী করীম (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর ওফাতের পর থেকে আজও।

তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব অর্জন করার এখনই সময়

তরুণ প্রজন্মের
নেতৃত্ব অর্জন করার এখনই সময়

* সত্যের জাগরণে * ধর্মীয় সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে * বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি রোধে * সম্পদের সুষম বন্টনে * ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে *ধৈর্যশীল ও স্বনির্ভরশীল হতে * দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে * দেশবাসী চায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তির মহাজোট।

সমস্যাকে জিইয়ে রাখা নয়। কূটনীতিজ্ঞ নেতা তিনিই, যিনি সমস্যার যথাযথ এবং দ্রুত সমাধান করেন। ২০২০ সালে উন্নত দেশে পরিণত হতে গেলে বাংলাদেশে সর্বস্তরে একরৈখিক নিষ্ঠাবান নেতৃত্বের দরকার। নেতা তিনিই, যিনি নিজের বিচার নিজে করে নিজের পথ নিজেইতৈরি করেন। তাঁর মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার গুণ থাকতে হয়। লক্ষ্যভিত্তিক দৃঢ় প্রত্যয়ী হলেই আসল নেতা হওয়া যায়।

সংলাপ ॥ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারও কারও চিন্তায় হাসিনা সরকারের পক্ষে জনসমর্থন বেশ কিছুটা কমে গেছে। যারা এসব চিন্তায় মগ্ন তারা ভুল ভাবছেন। ভেবে যদি ভাল লাগে, ভাবতে পারেন। বাস্তব হলো এই যে, ক্ষমতায় আসার সুবাদে আরও খানিকটা শক্তি বাড়াতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। সুসময়ে অনেক বন্ধু জড়ো হয়েছেন। তাদের প্রভাবও সামান্য নয়। সমালোচনার অনেক জায়গা আছে, কিন্তু হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কমেনি। জাতি ভাবছে দেশের পরিস্থিতি বদলের কথা, ভাবারও কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ এখনও দেখা যাচ্ছে না।
সমাজের নানা স্তরে নানান সমস্যাগুলো বর্তমান সরকারকে বুঝতে সাহায্য করছে, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। অতীতে যে যে ভুল হয়েছিল, চিহ্নিত করা হচ্ছে। সংশোধনের চেষ্টাও আরো দ্রুত করা দরকার।
মতাদর্শগত দলিল তৈরি করার সময় এসেছে। ভোগবাদী জমানায় পোড়খাওয়া কর্মীদের মধ্যেও কেউ কেউ অধঃপতিত হয়েছেন, সেখানে সংগঠন শক্তিশালী করার কাজটা খুবই জরুরি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুবিধা না পেয়ে বা হতাশায় যারা ভুগছেন, তাদের কথা আলাদা। এরকম হয়েই থাকে। যারা আছেন, তারা কীভাবে নতুন পরিস্থিতি বুঝে লড়াই করতে প্রস্তুত, সেটাই আসল কথা।
দল নির্দিষ্ট কারণে কিছু সদস্যকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অনেকে সরে গেছেন হতাশায়, ভয়ে, কেউ কেউ লোভেও। সংবাদ মাধ্যমে বিপরীত ধর্মী সিন্ডিকেট তৈরি করে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। সংগঠনের মূল শক্তি অক্ষত থাকলে কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা থাকে, শুদ্ধির প্রক্রিয়া চালু থাকে এবং দল এগিয়ে চলে।
সমালোচনা হচ্ছে। স্বাভাবিক। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কারণএকটা নয়, অনেক। কিন্তু সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ভুলত্রুটি নিয়ে সমালোচনা হবে না? না হলে আর রাজনীতি কেন? সমালোচনা হবে, বিতর্ক হবে, আবার নতুন করে লড়াই করার দৃঢ় প্রত্যয় উচ্চারিত হবে, রাস্তায় নামা তো সেজন্যই।
স্তরে স্তরে দুর্নীতি, দুর্ব্যবহার ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা হোক, সমালোচনা হোক, কিন্তু অতীত নিয়েই পড়ে থাকলে হয় না। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবেই। আরও বড় কথা, ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে যথাযথ পথ খুঁজে নিতে হবে, শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে একশো ভাগ, বিরোধী দলের ব্যর্থতার জায়গা চিহ্নিত করে দায়িত্বশীল আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে জনগণকে নিয়ে, যেহেতু জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু, তাই বলে ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে নয়। সংগঠনের পুনর্নির্মাণ  জরুরি।  মানুষের আস্থা আরো বাড়াতে হবে। প্রক্রিয়াটা শুরু হওয়া চাই। শক্তি প্রাসঙ্গিক থাকুক, দ্রব্যমূল্য কম হোক, সন্ত্রাসকে সত্য ও কৌশল দিয়ে প্রতিহত হোক, মিথ্যাচার যুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হোক এটাই আসল কথা। সরকারের সাফল্য আসবে সেই পথ ধরে। ভবিষ্যতের কথা আগে ভেবে লাভ নেই বরং বর্তমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমান রাজনীতির প্রবাহমান সত্য বার্তা জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্যও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক (ছোট বা বড়ো) শক্তির জোরদার মহাজোট চায় দেশবাসী।

সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে দেয়া নয়। কূটনীতিজ্ঞ নেতা তিনিই, যিনি সমস্যার যথাযথ এবং দ্রুত সমাধান করেন। ২০২০ সালে উন্নত দেশে পরিণত হতে গেলে বাংলাদেশে সর্বস্তরে একরৈখিক নিষ্ঠাবান নেতৃত্বের দরকার। নেতা তিনিই, যিনি নিজের বিচার নিজে করে নিজের পথ নিজেইতৈরি করেন। তার মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার গুণ থাকতে হয়। দৃঢ় প্রত্যয় থাকলেই আসল নেতা হওয়া যায়। গড় বার্ষিক উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখা গেলে তবেই বাংলাদেশউন্নত দেশ হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণ প্রজন্মকে জেগে স্বপ্ন দেখা ও লক্ষ্যস্থির রেখেসামনে এগিয়ে যাওয়ার ‘শপথ’ করাতে হবে। লক্ষ্য, উপলব্ধি ও বাস্তবতা-বোধ জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারলে তবেই দেশের উন্নতি সম্ভব। রাজনীতিকদের স্মরণ রাখতে হবে, সব কিছুর পরেও দলের থেকে দেশের স্বার্থ দেখা অনেক বেশি জরুরি। তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিয়ে নেতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করার এখনই সময়।লক্ষ্য, বিচার এবং আদর্শ অন্তরে থাকলে, অনুস্মরণকারী এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী মানুষ হলে তবেই দেশের  তরুণরা যোগ্য নেতা হয়ে উঠতে পারবেন। 

দায়ীদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার হোক দেশের হাওর অঞ্চল এখনও পানিতে তলিয়ে আছে

দায়ীদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার হোক
দেশের হাওর অঞ্চল এখনও পানিতে তলিয়ে আছে

সংলাপ ॥ প্রকৃতির ওপর আঘাত করলে প্রকৃতিও আঘাত করে, প্রতিশোধ নেয়। এই প্রতিশোধের ধরণ ও প্রকৃতি হয়তো ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এই সময়ে অধিকাংশ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লিপ্সা, কামনা-বাসনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, সে নিজেও জানে না তার আর কী প্রয়োজন। এই অতিরিক্ত চাওয়ার কারণেই প্রকৃতির ওপর হাত দিচ্ছে মানুষ। পাহাড় কাটছে, বাঁধ দিচ্ছে নদীতে, পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির ব্যবহার মানুষকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মানুষকে নিয়ে গেছে এক জগতে, যার সাথে অনেক সময়ই প্রকৃতির বিস্তর ফারাক। একদিকে প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ-সম্পর্ক কমে গেছে, অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। এর সাথে বড় সমস্যাটি হচ্ছে দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা প্রাকৃতিক অবস্থাকে আরও জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে।          
দেশের হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যায় ৯০ ভাগ ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়া, লাখ লাখ কৃষক পরিবারের  সর্বনাশ এবং এর কারণ হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর জেনে-শুনে আতঙ্কিত হতে হচ্ছে। কিন্তু এই অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে কে কে জড়িত সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট করে কিছু প্রকাশ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি, আর চাটার দল খেয়ে ফেলে’। বঙ্গবন্ধু ওই কথাগুলো এখন আরও বেশি স্মরণ হচ্ছে সচেতন ও বিবেকবান মহলে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হাওর অধ্যুষিত এই সাতটি জেলায় সংঘটিত এই বিপর্যয়ের জন্য শুধুমাত্র প্রকৃতি যে দায়ী নয় সে-কথা সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই আজ অজানা নয়। খোঁজ নিলেই জানা যায়, হাওরাঞ্চলীয় এই জেলাগুলোর ফসল রক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি নেই। প্রকল্প পাস হয়, অর্থ বরাদ্ধ ও উত্তোলন হয়। প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়। কিন্তু কাজে অগ্রগতি হয় না। মাঠ পর্যায়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ দেয়া ও তদারকী না থাকায় মূলত চলমান প্রকল্পগুলো ঝুলে আছে বছরের পর পর। ফলে উজানে সামান্য বৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় কৃষকের ফসল।
সাম্প্রতিক সময়ে হাওরাঞ্চলে বিভিন্ন বাঁধ ভেঙ্গে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, কোন কোন পত্রিকায় দুই হাজার কোটি টাকার শস্য বিনষ্ট হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। আবার কোন কোন পত্রিকায় ৪ হাজার কোটি টাকার ধান নষ্ট হওয়ার খবর বেরিয়েছে। গত ৯ই এপ্রিল রাজধানীর ডিআরইউতে হাওর অ্যাডভোকেসি ফোরাম আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা-এই তিন জেলায় বিপুল পরিমাণ শস্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে হাওরের বাঁধ নির্মাণের সময় পর্যবেক্ষণের জন্য গত ১১-১৩ই মার্চ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করা হয়। এ সময় দেখা যায়, বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর অর্ধেক কাজ অসম্পূর্ণ দেখা গেছে। বাঁধ নির্মাণের শেষ সময় ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেও অনেক বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি। বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে-অনেক জেলায় দেরিতে কাজ শুরু হয়েছে। সময় মতো কাজ শেষ না হওয়ার ফলে অনেক বাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। 
হাওর অ্যাডভোকেসির সংবাদ সম্মেলনে এই ফসলহানির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হাওরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো সঠিক সময়ে এবং টেকসই কায়দায় ফসল রক্ষা বাঁধ তৈরি এবং মেরামত না করা। এ কাজটি না করায় ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় আটবার হাওরের কৃষক তার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। অথচ এই এক ফসলি বোরো ধানের ওপর হাওরবাসী নির্ভরশীল। অন্যদিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বোরো ফসল পালন করে বিরাট ভূমিকা।
দেশের রাজধানী আর বিভিন্ন শহরে-বন্দরে, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে, ক্ষমতাসীন এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের কয়জন হাওরের এই বিপর্যয় ও তার প্রতিকার নিয়ে চিন্তা করেছেন, সময় দিয়েছেন? বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুই ছিল দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল যেহেতু ক্ষমতায়, সে কারণেই এই দলের নেতা-নেত্রীদের দায়ই সবচেয়ে বেশি। ক্ষমতার অংশীদার তো এরশাদের জাতীয় পার্টিও। আর একটি বড় দল বিএনপি, যারা ক্ষমতায় ছিলেন, আবারও যাওয়ার চেষ্টায় আছেন, তাদের কাউকেও হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয় নিয়ে কথা বলতে, দুর্গত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা গেল না। এমনকি বর্তমানে হাওর অঞ্চল থেকে নির্বাচিত প্রায় ২৫ জন সংসদ সদস্যের কাউকেও কোন রা-শব্দ করতে শোনা গেল না। দেশের মানুষের প্রতি, জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য তারা কতটুকু পালন করছেন এ অবস্থা থেকে তা সহজেই বোঝা যায়।
রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ হেলিকপ্টারে করে কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। হাওরাঞ্চলের বর্তমান কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানকার প্রায় দুই কোটি মানুষ সামনের ধান কাটার আগেই নিরন্ন থেকে যাবে। মহাজনের ঋণ, কামলার বেতন পরিশোধ তো দূরের কথা পরিবারের মানুষের খাবারও তারা যোগাড় করতে পারবে না। অন্য দিকে তাদের ঘরের গরুবাছুর লালন-পালনও তারা করতে পারবে না। পশুখাদ্য বা খড় না থাকায় তারা এসব প্রাণীকে বাঁচাতে পারবে না। এখন তারা জমি গরু বাছুর বা জমিও বেঁচতে পারবে না। কেনার মানুষ পাবে না। দূরে নিয়ে গবাদি পশু বেঁচা গেলেও জমি বেঁচা অসম্ভব হয়ে পড়বে। (হাওরের কান্না শুনুন, মোস্তাফা জব্বার, দৈনিক সংবাদ, ১১ই এপ্রিল, ২০১৭)
এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী? খবরে প্রকাশ, ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন অতিরিক্ত প্রকৌশলীসহ (যিনি ২০১০-১১ সালে সুনামগঞ্জে বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন) তিনজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে হাওরের ২৮টি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ৯ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক সভায় জেলার সুধীজন পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী, বিভাগীয় প্রকৌশলী ও সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীকে তুলাধুনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকাশ্যে এই সব প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, দুর্নীতি হয়েছে কি-না তদন্ত করে দেখছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে  বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন।     

হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃত দায়ী যে বা যারাই হোক তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে যেন মানুষ-সৃষ্ট এই বিপর্যয় আর না ঘটে সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ আশা করে জাতির বিবেকবান মহল। এই জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবশ্যই অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী, আমলা বা রাজনৈতিক নেতাকর্মী দেশের সরকার বা দলের সকলের জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনে। অসৎ ও মিথ্যাবাদী দুষ্টচক্র দেশ ও সমাজের জন্য সব সময়ই ক্ষতিকারক। এ প্রসঙ্গে মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর একটি বাণী স্মরণ করা যেতে পারে-‘বিশ্বাসঘাতকেরা নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে’। রাজনীতিকদের কারও কারও মুখে আর ঠোঁটে আদর্শের কথা, সরকারের কর্মচারি হিসেবে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরেও কারও কারও  সীমাহীন অর্থ-বিত্ত উপার্জন ও ভোগ-বিলাসে আসক্ত থাকার কারণে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন যারা না করে থাকেন তারাও নিশ্চয়ই বিশ্বাসঘাতক, নিজের সাথে এবং দেশের সাথে, প্রকৃতির সাথে। এদেরকে ছাড় দিলে দেশ ও সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা আরও ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয়ের সঠিক কারণ বের করে জাতির সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা আজ সময়ের দাবি। 

প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়

প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়

সংলাপ ॥ ধর্মের নামে, দারিদ্র্যের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে, জাতীয়তার নামে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়। বাঙালির প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে খাবলে ছিঁড়ে খাচ্ছে লুন্ঠনকারীরা। সীমাহীন দুর্বৃত্তায়নে বিপন্ন আজ বাংলাদেশ। অসুস্থ রাজনীতির ফলে পঙ্গুত্ব আমজনতার কাঁধে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে এখন প্রতিবাদ জানানোর সময়, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সাধারণ মানুষকেই। বিগত দিনের রাষ্ট্রনায়ক থেকে তৃণমূলের রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার লোকই দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। বর্তমান সরকারের সাহসী ও কঠোর পদক্ষেপে বেরিয়ে আসছে দুর্নীতির খবরগুলো। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠনকারীদের মধ্যে রয়েছে রাজনীতিকদের নাম। যারা দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে, তারাই যখন হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে তখন আর জাতির আশার কিছু থাকে না।
বেরিয়ে আসছে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ভয়াবহ তথ্য। বিগত কোনো সরকারের শাসনামলে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তারা পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ এবং গণতন্ত্র ও দেশের জন্য মায়াকান্না করেই তাদের শাসনকাল পার করেছেন এবং তলে তলে নিজেদের এবং গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক আখের গুছিয়েছেন। দুর্নীতির রেকর্ডে অতীতের জোট সরকার সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বলে গণমাধ্যমে এসেছে। কোনো সরকারই দুর্নীতিমুক্ত নয় বা ছিলো না বলেও বিভিন্ন খবরে জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের আপামর জনগণ চায় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমন এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার। দেশী ও বিদেশী সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের কালো হাতের থাবা থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাবার জন্য দেশবাসীকে বর্তমান সরকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজ তথাকথিত ধর্মের ধ্বজাধারী এবং মুক্তিযুদ্ধের নামাবলী গায়ে জড়ানো রাজনীতিকদের প্রত্যেকটি এলাকায় চিহ্নিত করে একঘরে করে রাখতে হবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সনের মতো আবার দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য সার্বিক সংস্কারে এগিয়ে আসতে হবে যাতে কোনোরকম ষড়যন্ত্র মিথ্যাচারিতার মধ্যে আবার আমাদেরকে ফেলতে না পারে। বর্তমানের সরকারের চলমান অভিযানের পক্ষে সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। একাত্মতা ঘোষণা করার সময় এখন। উচ্চকণ্ঠে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া আওয়াজ তুলতে  হবে - সন্ত্রাস ও দুর্নীতি নির্মূলের আগে নির্বাচন নয়। চাই সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। এরপর নির্বাচন।

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

মা হতেই ভাষা-ভূমি

মা হতেই ভাষা-ভূমি

সে’ই নিজের ধর্ম, রাসুল ও আল্লাহ্কে চিনতে পারবে যে নিজের মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে ভালবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে শিখেছে ॥

সংলাপ ॥ একজন সাধকের এই আপ্তবাক্যের মর্মার্থ উপলব্ধির সময় এসেছে আজ। ধর্মীয় অনুভূতির আবর্তে আমরা সবাই আবর্তিত। আবেগ তাড়িত তথাকথিত ধর্মীয় বিশ্বাসে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না সত্যের দর্শন। নিজের ও অন্যের কল্যাণিক চিন্তা-চেতনায় ধারণ করতে চাই সত্যকে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? এই মাটিতে কোন্ সত্যে প্রতিষ্ঠিত করবো নিজেকে?
‘মা’ শব্দটি স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণের এক অপূর্ব ও অনন্য সুষমা মন্ডিত সমন্বিত রূপ। সঙ্গীতে স্বরগ্রামে মধ্যমের সংক্ষেপাক্ষরও বটে। আভিধানিক অর্থের সীমানা ডিঙিয়ে ‘মা’ এক শাশ্বত চেতনার উৎস। কেবল জন্মের কৃতজ্ঞতায় নয়, অস্তিত্বের প্রগাঢ় বন্ধনে ও মন্থনে ‘মা’ মানেই দুর্বার অঙ্গীকার, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে লালিত এক স্বপ্নগুচ্ছ। ‘মা’ থেকেই অস্তিত্বের প্রকাশ। ‘মা’য়েতেই অস্তিত্বের লালন। ‘মা’য়েই অস্তিত্বের বিকাশ।
আক্ষরিক গঠনে ‘মা’ যত ছোটই হোক না কেন, চেতনায় এর বিস্তৃতি ব্যাপক, বিশাল। তাই ‘মা’ কেবল ঘরের চার দেয়ালে আদর্শ গৃহিনীর আঙ্গিক নিয়েই আবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে কালিক বোধের উত্তরণে মর্মে মর্মে, জীবনে জীবনে একমাত্র ঠিকুজী রূপে। সৃষ্টির মহত্তর আনন্দে অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে যে ‘মা’ আমাদের এনে দেন পৃথিবীর আলোয়। আগলে রাখেন স্নেহের সুশীতল আঁচলে। দেহে দেন পুষ্টি আর মুখে দেন বুলি। বুলি মানে কথা। কথা মানে ভাষা। এ ভাষা মায়ের ভাষা। মাতৃভাষা। মায়ের কোল থেকে আত্মনির্ভর হওয়ার আকাঙ্খায় পা রাখি যে ভূমিতে সেও আমার মায়ের ভূমি। মাতৃভূমি। সুতরাং সূত্রের অবিচ্ছিন্ন ও অনিবার্য সত্যে মা, মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি এক চেতনায় গাঁথা অস্তিত্বের স্তর বিন্যাসমাত্রা।
জীবনের সফল উত্তরণে ‘মা’ এক অবিকল্প সোপান-বেদী। যে সন্তান তার জন্মদাত্রী ‘মা’-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও কর্তব্যপরায়ণ, তার সাফল্য অনিবার্য। কিন্তু যে তার নিজ মায়ের প্রতি অনুরক্ত নয়, যে নিজে শ্রদ্ধা করতে বা ভালবাসতে জানেনি বা শেখেনি, সে কখনো আদর্শ সন্তান হতে পারে না। অনাদর্শিক জীবনের যাত্রায় সে তখন নিজ ভাষা, নিজ জন্মভূমির প্রতি উদাসীন বা বিরাগী হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
দেশ চায় আদর্শ নাগরিক। কিন্তু কোথায় সে আদর্শ নাগরিক? কীভাবেই বা হওয়া যায় আদর্শ নাগরিক? একজন নাগরিক একজন সন্তানও। দেশ ও ‘মা’-তুল্য বা আখ্যায়িত। বলা হয়, ‘জননী, জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী।’ মা, মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের আসনে যিনি আসীন, সেই ‘মা’ কেমন আদর্শের প্রতীক এবং কতটুকু শ্রদ্ধাভাজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘মা’-এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি সুন্দর জাতি দিব।’ সুতরাং একটি সুন্দর দেশ ও একটি সুন্দর জাতি গড়বার ক্ষেত্রে ‘মা’ কতটা গুরুত্ব বহন করে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সেই ‘মা’-কে উপেক্ষা করে কোনভাবেই কি কেউ দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে?
মায়ের কাছে শেখা বুলি তথা মাতৃভাষার প্রতি তখনই শ্রদ্ধা ও প্রীতি জন্মাবে এবং প্রগাঢ় হবে যখন মায়ের প্রতি গভীর ও সুদৃঢ় আন্তরিক বন্ধন থাকে। কেননা মা-বোধ তখন আদর্শিক চেতনায় তাকে অনুপ্রাণিত করবে ‘মা’ তথা ‘আত্ম’ বিকাশে। ভাষাই সেই বিকাশের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। তাই মাতৃভাষার চর্চা ও শ্রীবৃদ্ধিতে তার জাগে আন্তরিকতা। নতুবা ভিন্ন ভাষার প্রতি মোহ দিন দিন বাড়তেই থাকবে। আন্তর্জাতিক বিলাসিতায় রুচির বিকৃত ধারায় সে ছুঁতে উদগ্রীব হবে ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন ভাষীকে। গ্রাস হবে অন্যের। ছিন্ন হবে আপন বলয় থেকে। উপড়ে যাবে মূল শিকড়। টবে রাখা গাছের মতো সে তখন প্রোথিত হবে ভিন্ন ভূমিতে। অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের সীমারেখায় হবে বন্দি ও শোষিত। নিজস্ব ভূবনের অনন্ত আলো-বাতাস এবং মুক্ত দিগন্ত যাবে হারিয়ে। ভয়ংকর সেই পতনের কথা আমরা কি স্মরণে রাখি?
ভিন্ন ভাষা প্রীতি, ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা করে যারা নিজেদের আন্তর্জাতিক করতে চায় তারা কি প্রথমেই তার মা-মাতৃভূমি, মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত ও দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত? ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন সংস্কৃতির আবর্তে নিজেকে চালিত করে কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না জীবনের ভিত্তি। পতিত ব্যক্তির সমষ্টিতে জাতির জীবনেও নেমে আসে বিপর্যয়। এই সত্য - উপলব্ধি কি আমরা হারাতে বসেছি?

নববর্ষের শুভাগমনে আমরা বাঙালি জাগ্রত হই নিজস্ব সত্ত্বা আর চিন্তা চেতনায়। এই চাওয়া সার্থক হবে যখন আমরা ভালোবাসতে শিখব আপন ‘মা’-কে, ভালোবাসতে পারব মাতৃভাষা বাংলা-কে, ভালোবাসতে জানব মাতৃভূমি বাংলাদেশ-কে। ভালোবাসার এই ক্রমধারা অটুট ও অকৃত্রিম রেখে আবার আমরা হই জাগ্রত চিত্ত বাঙালি - দেশ ও জাতিকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করি আদর্শ হিসাবে, এই হোক আমাদের নববর্ষের প্রথম নৈবেদ্য। 

ঐক্যের বার্তা মঙ্গল শোভাযাত্রা

সময়ের সাফকথা....
ঐক্যের বার্তা মঙ্গল শোভাযাত্রা

‘বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক
আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ...।’
সংলাপ ॥ আরশিনগরের পড়শিরা ১৪২৪-এর প্রথম প্রভাত দুশ্চিন্তামুক্ত রাখতে পারল। বাংলার আরও একটা নতুন বছর শুরু হয়ে গেল। ১৪২৪।
এখন অবশ্য পয়লা বৈশাখের মতো হাতে গোনা কয়েকটা দিন ছাড়া বাংলা বছরকে বিশেষ কেউ মনে রাখেন না। রাখবেন কেন? আমাদের আজকের জীবনে বাংলা বছর আর কোথায় লাগে?  পারিবারিক, সামাজিক কিছু অনুষ্ঠান ছাড়া বাঙালির আর কী-ই বা বাংলা সাল তারিখ মেনে হয়? ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন তো সেই কোনকাল থেকেই ইংরেজি সাল তারিখের জিম্মায় চলে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও পয়লা বৈশাখের এখনও একটা আলাদা কদর আছে বাঙালি জীবনে। বাংলা বছর শুরুর ওই দিনটাতে বাঙালি একবারের জন্য হলেও তাদের হারিয়ে যাওয়া সাজগোজ আচারবিচার খানাপিনার দিকে ফিরে তাকায়। আর তাই রাস্তাঘাটে কি শপিংমলে রেস্তরাঁয় পয়লা বৈশাখের দিন বাঙালির স্বাভাবিক সাজে বহু মানুষকে শামিল হতে দেখা যায়। বাঙালির আড্ডায় বাংলা গান, বাংলার সুর শোনা যায়। শাড়ি, পাজামা কুর্তা কি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাঙালি-খানার স্পেশাল মেনুর স্বাদ নিতে ভিড় জমে মহানগর ও শহরতলির রেস্তরাঁয়। হালখাতা মিষ্টিমুখ হয় দোকানে দোকানে।
পয়লা বৈশাখ পালনের এই চিরাচরিত প্রথায় এবারও উৎসাহের অভাব ছিল না। গত শুক্রবার মোটামুটি সাড়ম্বরেই বাংলা বছর শুরুর দিনটা উদ্যাপন করেছে বাঙালি। বৈশাখের প্রথম দিনটা কেটেছে একরকম নির্বিঘ্নেই। কিন্তু, পয়লা একটা দিন বই তো নয়। বছরের বাকি দিনগুলোর কী হবে? পয়লা না হয় কাটল উৎসবের আমেজে। কিন্তু, তারপর? অশান্তির বাড়বাড়ন্তে অস্থির এই বিশ্বে স্বস্তি সম্প্রীতি ফিরবে? নতুন বাংলা বছরে মানুষ কি একটু শান্তি পাবে? একটু চাপমুক্ত হয়ে কাটাতে পারবে তাদের নিত্যদিনের জীবন? আজ এগুলোই সব থেকে বড় প্রশ্ন।
আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সিরিয়া থেকে প্রতিবেশী ভারত সর্বত্র যেভাবে জঙ্গি হিংসা বাড়ছে, নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে তাতে এই প্রশ্নগুলো ওঠাই তো স্বাভাবিক। আমাদের দেশেও তো সাম্প্রতিক জঙ্গিদের ক্রিয়াকলাপ বেশ ভালোই নজরে পড়ছে। কবে যে থামবে, আদৌ কোনওদিন থামবে কি না কে জানে?
এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপদে কারা? সাধারণ মানুষ, দেশের আমজনতা। কিছু একটা ঘটলে সবার আগে বলি হন তারাই। তাদের পরিবার প্রিয়জনেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন সবচেয়ে বেশি। কেবল জঙ্গি সন্ত্রাস কেন কোথাও কোনও গ-গোল কি সমাজবিরোধী ক্রিয়াকলাপেরও প্রথম বলি তো তারাই!  ধর্ম পালনের অধিকার সকলের আছে, হিন্দু-মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন-সকলের। আর আমাদের দেশে সে ধর্ম পালনে কোনও দিন কেউ বাধা দিয়েছে বলে শুনিনি। হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করবেন, মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবেন, খ্রিস্টান যিশুর ভজনা করবেন আপত্তির কোনও জায়গাই নেই।
এই বাংলায় অরাজক পরিস্থিতি তৈরির যে চেষ্টা, চক্রান্ত চলছে তাতে বাড়তি ইন্ধন পাচ্ছে। সমাজবিরোধীরাও যে যার মতো করে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। সব মিলিয়ে সাধারণের বিপদ বাড়ছে বই কমছে না। স্বস্তির মূল কথা হলো-মঙ্গলশোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে দেশে কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সাম্প্রদায়িক প্রীতিতে কোথাও কোনও আঁচড় লাগেনি। মানুষ এমনটাই চান। যে যার ধর্ম যেমন খুশি পালন করুন কিন্তু সম্প্রীতির পরিবেশটি অটুট থাক। তবেই না আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, উন্নয়নে গতি বাড়বে, আমাদের জীবনে শান্তি-স্থিতি আসবে। সেই উন্নয়নের ধারা, শান্তি চেষ্টার সাফল্য যাতে অব্যাহত থাকে তার জন্য আমাদেরও কি দায় নেই? সব দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর ফেলে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলেই হবে!
গত শুক্রবার ঢাকায় জনস্রোতেই পথ হেঁটেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯’ থেকে প্রতিবারের মতো এবারও। ২৮ বছরের মাথায়    সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার হাঁটল পশ্চিম বাংলায়। বারেবারে সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদের রাজনীতির মুখে সর্বস্ব বাজি রেখে রুখে দাঁড়ালো বাঙালি গত শনিবার শহর কলকাতাতেই। বাংলা নববর্ষের প্রথম সকালে বাস্তবিকই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ দেখলো পশ্চিম বাংলার মুখ, এই প্রথম। ‘বাংলার মুখ’ বাংলার নিজস্ব বহুমাত্রিক সংস্কৃতির এক অপরাজেয় পরিচিতিপত্র। বাংলার মুখ আসলে বাংলার সেই চেতনা, যার ভরকেন্দ্র আক্ষরিক অর্থেই এক অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ। গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। তিন কিলোমিটারেরও কম এক যাত্রাপথ-ই গত শনিবার সকালে হয়ে উঠলো যেন বাংলার চিরন্তন লোকজ সংস্কৃতির এক জীবন্ত কর্মশালা। বিষ্ণুপরের ঘোড়া থেকে কালীঘাটের পট, রায়বেশে থেকে পীরের গান, রণপা’র পাশেই চলমান গীতিনাট্য।
সেই আবেগের বিস্ফোরণই এদিন সকালে যাদবপুরে। ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রার আদলেই ওখানে ছিল নানা রঙের মুখোশ, হরেক রকমের কারুকাজ, হাতি, ঘোড়ার রঙিন প্রতিকৃতি। বাংলা অক্ষর মালা দিয়ে সাজানো নানা কারুকাজ। বাংলার একেবারে নিজস্ব সংস্কৃতির অনন্য সেই স্বাক্ষর, সঙ্গে চলমান নৃত্য, গান, রায়বেশে, পীরের গান। আর সব কিছুকে ছাপিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততা।  রাজপথ থমকেছে, নেহাতই দর্শকের তকমা ঘুচিয়ে পথচারীরাও বেমালুম মিশে গিয়েছেন শোভাযাত্রায়। ধর্ম-বর্ণ-রং-জাতের যাবতীয় বিভেদ ভেঙে, ভাঙার বার্তা দিয়েই এগিয়েছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রার আগে গত শুক্রবার রাতভর গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা আল্পপনায় সেজে ওঠার কথা ছিল। বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের তরফেই নেয়া হয়েছিল এই অভূতপূর্ব উদ্যোগ। তাতেও বাধার মুখেই পড়তে হয়েছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। ঢাকা থেকে যাওয়া শিল্পীরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরাও রঙ হাতে নেমে পড়েছেন রাস্তায়। আল্পনায় সাজানো হবে মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রাপথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতির বিরোধী দলের বাহিনী। চলে হুমকি-রাস্তায় আল্পনা দেয়া যাবে না। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চলে হুমকির পালা। অবশ্য তা অতিক্রম করে গভীর রাতে যাদবপুরের রাস্তা আল্পনায় সেজে ওঠে শিল্পীদের হাত ধরেই।
গত শনিবার সকাল আটটায় শুরু হওয়ার কথা ছিল এই শোভাযাত্রা, গাঙ্গুলিবাগান থেকে। তার অনেক আগেই সকাল সাতটা থেকে গোটা চত্বর সেজে ওঠে বাংলার চিরন্তন সংস্কৃতির রঙে। স্কুলের পোশাকেই ছাত্ররা হাজির, হাজির অভিভাবকরা। রাস্তার মাঝেই বিশালাকার হাতি, ঘোড়ার প্রতিকৃতি। রঙবেরঙের মুখোশ-রামধনুর আভা। রামধনুর সাতটি রঙেই তখন সেজে উঠছে ওই বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সংস্কৃতি। শোভাযাত্রার একেবারে সামনে ব্যানারে লেখা ‘এই দেশ মানুষের ভালোবাসায় বাঁচুক’। ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে।’

ঘড়ির কাঁটা ধরেই এরপর শুরু হলো সেই শোভাযাত্রা। কয়েক হাজার মানুষ পথ হেঁটেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন ওপার বাংলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার এই উদ্বোধনকে। গানের ছন্দে, নৃত্যের তালে। সম্প্রীতির বার্তা বারেবারে এসেছে ওই শোভাযাত্রা থেকে। যাদবপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটারেরও কম রাস্তা পেরোতে সময় লেগেছে দু’ঘন্টার বেশি। একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংস্থা শামিল হয়েছে তাতে। নিজেদের মতো করে গান গেয়েছে, চলমান নাটক এগিয়েছে শোভাযাত্রার তালেই। যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতীর ছাত্র-ছাত্রীরাও যোগ দেয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়। মঙ্গল শুধুমাত্র সংগঠকরাই নয়, এই শোভাযাত্রায় শামিল হওয়া মানুষজন, বিশিষ্টজনদের দাবি, মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে উঠুক আগামী বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব, বিষমুক্ত হোক সমাজ। 

স্বদেশ ভূমির প্রতিটি কণায় বৈশাখ বুনো

স্বদেশ ভূমির প্রতিটি কণায় বৈশাখ বুনো

মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঘাতক শক্তিকে রুখে দেবার প্রত্যয় ॥ গগণবিদারী আওয়াজে প্রকম্পিত গোটা দেশ ॥ প্রতিটি রেষ্টুরেন্টে, শপিংমলে, শিশু পার্কগুলোতে বিশেষ প্রণোদনার আহ্বান ॥
মাটির অনেক গভীরে থাকে স্বর্ণদানা
সেখানে যেতে কারোরই তো নেই কো মানা
পেতে চাও যদি স্বর্র্ণদানা তবে কপাট খোলো
স্বদেশ ভূমির প্রতিটি কণায় বৈশাখ বুনো ॥ 
নজরুল ইশতিয়াক ॥  বৈশাখ বাঙালি জীবনে সত্য হয়ে উঠেছে। বৈশাখের উদ্ভাসিত আলোয় পরিষ্কার হয়ে পড়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়। দারুণ জাগরণ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছে গোটা জনপদ। চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে ঘাতকের বিচার। হাজারো রঙের মিশেল দেখেছে গোটা বিশ্ব। ইউনেস্কোর তালিকায় আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। পশ্চিম বাংলায় মঙ্গল শোভাযাত্রা রঙ ছড়িয়েছে। ভারতের বুকে পশ্চিবঙ্গের এই নব আয়োজনের যোগান দিয়েছে আমাদের চারুকলার বন্ধুরা। একই দিনে কিভাবে উভয়স্থানে বৈশাখ উদ্যাপন করা যায় তা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। বাঙালির নববর্ষ উৎসব চলতে শুরু করেছে সরল রেখা ধরে, ফলে বক্ররেখায় যারা রয়েছে তারা ছিটকে পড়ছে। ঘাতকচক্রের সমস্ত ভয়ভীতি হুমকি হালে পানি পাচ্ছে না। চরম অসহায় আর্তনাদে ঘাতকচক্রের আস্ফালন মুহুর্তেই বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায়-রাস্তায়, ঘরে-ঘরে শিশু, বৃদ্ধদেরবৈশাখী সাজ ছিল চোখে পড়ার মতো। লুপ্তপ্রায় মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্প, লোকজ নিত্য ব্যবহার্য্যদ্রব্য, গ্রামে গ্রামে মেলা গান-বাজনায় ছিল বাধভাঙা উচ্ছ্বাস। রাজধানী ঢাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে গেছে গ্রামে নিকট পরিজনের কাছে। ফেলে আসা পথে, চেনা নদীতে নৌকায় ঘুরেছে সন্তান সন্তুতিদের নিয়ে। ছায়ানট পালন করেছে ৫০ তম বর্ষবরণ। এই প্রথম তারা যুক্ত করেছে ফোক গান। বেড়েছে উৎপাদন, বেড়েছে কর্মযজ্ঞ। ১০ হাজার কোটি টাকার বৈশাখী বাজার সমৃদ্ধ করেছে জাতীয় অর্থনীতি। সৃজনশীলতার উৎসধারা প্রচন্ড গতিশীল। জাতি পরিচয়ের বিতর্কে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে ঘাতকচক্র। টেলিভিশনগুলোতে, পত্র পত্রিকায় ছিল নানা বর্ণিল আয়োজন। বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানীগুলো বৈশাখী আয়োজন করেছে। বিদেশের বহু বন্ধু ভীড় করেছে রমনায়, ছায়ানটে। তাদের সবার মুখে ছিল ঘাতক মুখোশধারীদের বিচারের দাবী। তাদের আহ্বান ছিল উগ্র-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশ। তাদের চোখেমুখে ষ্পষ্টতই তীব্র ঘৃনা, দেখা মিলেছে সব পশ্চাৎপদ অপশক্তির বিরুদ্ধে। পরস্পর দারুণ আস্থায় হাতে হাত রেখেছে। সব রাজনৈতিক দলও বৈশাখ উদ্যাপন করেছে। যারা বৈশাখ মানে না, বৈশাখ নিয়ে রাজনীতি করে তারাও বাধ্য হয়ে মিলেছে এ আয়োজনে। যারা গান গাইতে জানে সেই সব অনুৎপাদনশীল রাজনীতিজীবীদেরও দেখা গেছে তাল মেলাতে। দারুণ অবিশ্বাসমুখে অসহায় উদ্বিগ্নতায় মহল্লার ধর্মজীবীরা তাকিয়ে থেকেছে। মানুষের বিপুল বিস্ফোরণের কাছে পরাজিত হয়েছে ঘাতক আস্ফালন। 
নববর্ষ প্রকৃতপক্ষে নববর্ষা। বরিষণ বিনে চাতক বাঁচে না। মরুভূমিতে প্রাণ জন্মে না। সিঞ্চনে, রস সঞ্চারণে কর্ষণে, সেচে প্রাণের বেঁচে থাকা, টিকে থাকা, সমৃদ্ধ হওয়া। চেতনায়, জাগরণে, বিপুল বিস্ফোরণে মহাকরণীক সত্য হয়ে আসে নববর্ষ। যদি তুমি সিক্ত হও, তোমার ধমনীতে শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয় চেতনার দোতনা। যদি তুমি নিজেকে  খুঁজে পাও, হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মেলাও পরম মমতায়, জড়িয়ে ধরো মানবতাকে তবে তুমি নববর্ষ। তুমি প্রতিভাত, উদ্ভাসিত, নবকল্লোলে অভিসিক্ত। স্থান-কাল-ভূগোল সত্য, মাটি সত্য , বায়ু সত্য, সত্য জল ধারা, পরম্পরা, আবহমানকালের ধারায় যোগ-সংযোগের বর্ণময়তা।  ফলে নববর্ষ কেবল একটি বর্ষ নয়। নানা রঙে রাঙানো সুশোভিত কারুকার্যমন্ডিত মহা-উপাখ্যানের বর্ণিল সম্ভার-সম্ভাবনা। কাল-মহাকাল যা-ই বলি না কেন, বর্ষের বুকে কত শত সৌরভ, সুন্দর, অনুভূতির হাজারো মিশেল। বর্ষ গণনার হিসেব-নিকেশের ইতিহাসের পাতায় যা-ই লেখা হোক না কেন, নববর্ষ সব তিথির মহা তিথি হয়ে চলমান, বহমান মহাস্রোতধারা। বর্ষ সঞ্জিবনী সুধা। শেকড়ে নবদ্যূতি নবায়ন। নববর্ষ আত্মপ্রকাশের সুতীব্র অহংকার মথিত দুর্বিনীত উদ্ধত অহংকার । এটি শত সহস্র বছরে লালিত এক মহাবিস্ফোরণের নাম। জাতি চেতনার বিপুল সৌন্দর্যের যোগসূত্র নববর্ষ। নিজেদেরকে শনাক্ত করে নিজেদের সত্যকে উর্দ্ধে তুলে ধরার এ এক দুর্বার, দুর্বিনীত, আপোষহীন আস্ফালন। পিছন ফিরে তাকানোর কোন অবকাশ দেয় না। হারানোর পালানোর কোন সুযোগ নেই। বারবার প্রকাশ্যে বলে যায় ‘এসো নতুনেরে করো আলিঙ্গন’। যা কিছু করতে চেয়েছো পারোনি - তা নিয়ে আফসোস কিসের? দেখ আবার জাগ্রতদ্বারে নিজেকে নির্মাণ করে প্রবল খরতাপে। আমাদের নববর্ষ -নওরোজ নয়, কোন হিমালয় থেকে ছুটে আসা জলধারামাত্র নয়, নয় কেবলই খই-মুড়কীর আবেগী আমেজ। বরং বাঙালির উৎস থেকে মোহনায় ছুটে চলার গভীর অনুসন্ধানী প্রকৃষ্ট গতিময়তা। দেখার অন্তহীন অণুবীক্ষণ। প্রচন্ড খরতাপে দহনের রুদ্র কাঁপন নিয়ে আসে। বাংলা নববর্ষ আমাদেরকে শক্ত হাতে বৈঠা মারার আহ্বান নিয়ে আসে। বাংলা নববর্ষ আসে প্রচন্ড খরাকে জাত্যাভিমানের শক্তি দিয়ে সহনীয় করার তাগিদ নিয়ে। আসে কঠিনকে স্বত:স্ফূর্ততা দিয়ে, সম্মিলন দিয়ে মোকাবেলা করার প্রেরণা নিয়ে।
বাঙালি জাতির চিরায়ত বিকাশে প্রাণ জাগানিয়া জাগরণ আমাদের বৈশাখ। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেখিয়ে দেয় একে অপরের কত চেনা, কত বিপুলায়তন ঐশ্বর্যের আধার বাঙালির প্রাণ সম্পদ। যে বাঙালি জাতি ইতিহাস রচনা করেছে, অবিচল আস্থায় পাড়ি দিয়েছে শত সহস্র বছরের পথ, সেই বাঙালি বাধভাঙা উচ্ছ্বাস আর স্বতঃস্ফূর্ত শিহরণ নিয়ে আনন্দে মাতে। বর্ষার মাদলে মাছেরা যেমন খেলা করে। বর্ষাস্নাত নদীর বক্ষে স্রোতস্বিনী ঢেউ যেমন আছড়ে পড়ে। কি দারুণ সুখে ফুলেরা ঘোর ফাগুনে বাতাসে বাতাসে দোল খায়। ঝিঁঝিঁ পোকারাও বনে বাদাড়ে আলোর মশাল জ্বেলে আনন্দ করে। আর বৈশাখে প্রাণ মন ছুঁয়ে যায় । আহা কত সত্য, কত সুন্দর, কত বর্ণিল আমাদের বৈশাখ। এটি বাঙালির পরম্পরা স্মারক চিহ্ন। এটি সংকেতবাহী জাগ্রতযান। এটি বিচারিক পর্যালোচনার প্রয়োজনকে সামনে আনে। এটি সহজ সত্যকে সহজে প্রতিস্থাপন করে। এটি আবহমান কালের ধারা পরম্পরাকে পুনর্নির্মাণের  মাহেন্দ্রক্ষণে হাজির করে। একটি বুনন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করে। আত্মবিশ্লেষণ, দিন-দুনিয়া, জগৎ, বিশ্লেষণ, সংযোগ, সম্পর্কের বহুমাত্রিক পথরেখার মিলন মোহনা নববর্ষ। স্মরণ করিয়ে দেয় এই তো আমি, এই তো তুমি, আমি-তুমি আমরা সবাই একই ছাতার নিচে, একই বৃক্ষতলায় আত্মপরিচয়ের সুতীব্র অহংকারে মেলে ধরেছি নিজেদের। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, তবু সবকিছু ছাপিয়ে সেই সুরই বেজে উঠে-আজ কোন বিভেদ নেই, নেই কোন জাতপাত, ভেদবুদ্ধির বাছবিচার। আজ কোন বর্ণবৈষম্য নেই, নেই কোন বৈরিতা। সবাই এক সুরে, এক ভাষায়, এক ছন্দে, কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে নিজেদেরকে তুলে ধরেছি বিশ্বসভার স্বর্ণ শিখরে।
বাঙালির বৈশাখ বরণ পথপরিক্রমা কতই না সমৃদ্ধ । শত-সহস্র বছরের সম্প্রীতি, ঔদার্যতা, প্রেম ও ভাব বন্দনার ধারাবাহিকতা বহন করছে আমাদের বৈশাখ। খুব চেনা, খুব জানা এই সম্প্রীতির উত্তরাধিকার আমরা। 
রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের নামে যারা বৈশাখ উদ্যাপনের বিরোধিতা করে তারা জাতি হত্যার ঘাতক। কেবল মুখোশ মিছিলে ঘাতক বিকৃত হায়েনাদের প্রতিচ্ছবি দেখালেই হবে না। আজ সময় এসেছে সব অপশক্তির মূলোৎপাটন করার। সাহসী উচ্চারণে মুখোশধারীদের তালিকা ধরে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেবার। গগণবিদারী আওয়াজে প্রকম্পিত হোক শাহবাগ, রমনা থেকে পুরো বাংলা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে চিকা পোষ্টারে ভরে যাক, উন্মোচিত ঘাতকদের কদর্য চেহারা। দেশের কর্তা ব্যক্তিদের ভবনে ভবনে বসুক নব জাগরণের মিলনমেলা। প্রতিবেশী শৈশবের বন্ধুরা নিমন্ত্রণ পাক। একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়া সেরে  মিলেমিশে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো আওড়িয়ে ক্ষণিক সময়ের জন্য দেখে নিক একে-অপরকে। শিশু পার্কগুলোতে দেয়া হোক বিশেষ প্রণোদনা। প্রতিটি বাঙালি রেষ্টুরেন্টে বিশেষ ছাড় দেয়া হোক।
যারা পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে বৈশাখ উদ্যাপন নিয়ে টালবাহানা করে তাদের ঘাতক পরিচয়ের উৎসমূলে আঘাত হানতে হবে। দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষকে মনুষ্যত্ব বিনাশী এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। ইতিহাস সাক্ষী পৃথিবীর মানুষ আজ যেখানে দাঁড়িয়ে সভ্যতার  স্তুতি গান করছে তা তো নানান পার্বণ, নানান মিলন মেলার হাজারো মেল বন্ধন থেকে উৎসরিত। বিশ্বের প্রতিটি জনপদের মানুষ যখন নিজেদেরকে একত্রিত করে দাঁড় করিয়েছে মুখোমুখি তখনই সম্প্রীতি, দায়বোধ, দেশপ্রেম, মানবতা জাগ্রত হয়েছে। আজকের যে ছোট পৃথিবী তাতো সংযোগ স্থাপনের পথপরিক্রমা মাত্র। দেশ-কাল-ধারণা সব উৎসব থেকেই সৃষ্ট। সাঁইজী বলেছেন - ‘এক চাঁদেতে জগত আলো, এক বীজে সব জন্ম হল’। নিত্যানন্দ পেতে হলে গৌড়ের সাথে করো সম্বন্ধ। বেঁচে থাকা ভালো থাকা, অনিশ্চয়তাকে দূর করার সম্মিলিত, পরিকল্পিত প্রচেষ্টার নামই তো সভ্যতা। এখানে যা হবে, যা করা হবে সবই দূরত্ব ঘুচিয়ে, বৈষম্য কমিয়ে পাশাপাশি থাকার প্রেম থেকে। মানুষকে দিয়েই স্রষ্টা সাজাতে চান এই মহাভূবন। নিরন্তর এই মহাযাত্রায় স্রষ্টা সব সময় মানবময় অস্তিত্বেই ধরা দেয়। তাইতো সাঁইজী বলেছেন - ‘এই মানুষ হবে মাধুর্য ভজন তাইতে মানুষ রূপ গঠলেন নিরঞ্জন’। সমৃদ্ধ বাঙালি জাতিকে তার জাতি সত্ত্বার গভীরে উৎসমূলে ডুব দিয়ে মণিমুক্তা সিঞ্চন করেই এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখপানে। আউল, বাউল, ওলি গাউস কুতুবের এই দেশ, সত্য মানুষের এই দেশ, স্বশিক্ষিত মানুষের এই দেশ জগত সত্যের ধারক বাহক। এই বাংলা বিশ্ব জাগরণের নব অগ্রদূত। এখানে এসেই গোটা বিশ্ব জানবে জীবন ও জগতের সত্য, মানব জন্মের সত্য, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সব সৌন্দর্যকে। এই বাংলায় শান্তির চাষ সমৃদ্ধ করবে নতুন বিশ্বের পীঠ। এখানে আসতেই হবে, বসতেই হবে বিশ্বের সব শান্তিপ্রিয় সৃষ্টিশীল অনুসন্ধিৎসু মানুষকে। কেবল মাত্র বাঙালির সামনেই ভবিষ্যৎ আর তাবৎ দুনিয়া পেরেশান হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে দারুণ খরায়। তবু এই বাংলার জল জমিনে থেকে যারা সেই সুর শোনে না তাদের প্রতি করুণা করা ছাড়া আর কি-ই বা থাকতে পারে। এই বাংলায় বসে বিশ্ব দেখা যায়। বিশ্বের যা কিছু সুন্দর, মহান, কল্যাণকর তা দেখি, মেনে নিই, সংযোগ স্থাপন করি এই বাংলার অন্তর্নিহিত উৎসে বসে- এটিই বাঙালির ধর্ম। বাঙালি মানুষ সহজ মানুষ, সত্য মানুষ। আমি যা দেখতে চাই, যা পেতে চাই, উর্দ্ধরণের মহা আসমানে বসে যে সৌন্দর্য অবলোকন করতে চাই তা বাঙালির বিশাল বক্ষে মহাভাবনায় পাখনা মেলে উড়ে আসে যত্রতত্র। এ এক অভূতপূর্ব দান পরম পিতার। এই বাংলায় ভাব সৌন্দর্য  চাইলেই নিজেকে মেলে ধরে। বৈশাখ আমাদের এক হতে বলে, প্রেম অনুভব করতে শেখায়, মানুষকে ভালবাসতে, প্রকৃতিকে চিনতে শেখায়। একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা সহযোগিতার আহবান জানায়। ফেলে আসা সব সত্য পথের, সব প্রাপ্তির সৌন্দর্য আস্বাদন করতে আহ্বান করে। ‘সবার উপরে সত্য মানুষ সত্য’ - সেই সত্য সামনে নিয়ে আসে। ক্ষুদ্রতা, অজ্ঞতা ব্যক্তিস্বার্থের উর্দ্ধে এসে এই সুন্দর পৃথিবীকে জানতে শেখায়। ফুল ফসল হিসেব নিকেশের মধ্যে বৈশাখের সৌন্দর্য সীমাবদ্ধ নয়।
আমাদের হাল আমলের ধর্মপ্রতারকরা বৈশাখ বরণ করতে ভয় পায় হারিয়ে যাবার ভয়ে। কারণ তাদের পুঁজি পাট্টা নাই। তারা মূর্খ, পরিবর্তন ও আনন্দকে ভয় পায়। রঙ বেরংয়ের পোষাক আর সাজগোছকে তারা ভয় পায়। তারা কোন সৌন্দর্য দেখতে অভ্যস্ত নয়। সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে সব সুন্দর সব আলো দেখার পরিবেশে রাখলেও তারা অন্ধ মুক বধির, কোন কিছুই দেখে না। পবিত্র কুরআন বর্ণিত এরাই তারা যাদেরকে মহান আল্লাহ্ মুক অন্ধ বধির করে রেখেছেন ফলে তারা চাইলেও দেখতে পাবে না। এরা অভিশপ্ত। এরা নিজেদের সাথে নিজেরাই প্রতারণা করে। এ জন্য এরা ধর্ম প্রতারক। স্রষ্টা আমাদেরকে পছন্দ করেন, ভালবাসেন, সিরাতুল মোস্তাকিমের পথে, সত্যের পথে রেখেছেন। এটি স্রষ্টার অপার করুণা। বৈশাখ এখন রীতিমতো শত্রুতে পরিণত হয়েছে উগ্র ভন্ড প্রতারক ধর্মজীবীদের কাছে। তারা এতটাই বেপোরোয়া যে গণমাধ্যমে, প্রকাশ্যে বৈশাখ বিরোধী ফতোয়া দেয়। তাদের ঔদ্ধত্য এতটাই ভয়ংকর যে বৈশাখ বরণ করতে যেয়ে সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। ওয়াজ নসিহতে, মসজিদে প্রকাশ্যে বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অরুচিকর কথা বলে। স্বাধীন বাংলায় বসে পরাধীনতার কিচ্ছা শোনায়। এরা বাঙালির শেকড় উপড়ে ফেলতে চায়। কতটা অকৃতজ্ঞতায় ভরা তাদের জীবন, চিন্তা। এরাই বিপথগামী, এরাই যুগে যুগে, কালে কালে সত্য অস্বীকারকারী। এরাই মানবতা, সভ্যতার ঘাতক। এরাই উদীচী ছায়ানটে হামলা করে। রমনার প্রতিটি কোনায়, প্রান্তিক জনপদের বাঁকে বাঁকে, সরকারি প্রশাসন যন্ত্রে বর্ণচোরা ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরা পান্তা-ইলিশের দাওয়াত দেয়। বাজার থেকে ৫০০-১০০০ ইলিশ কিনে ডিপফ্রিজে ভরে রাখে। কি নিদারুণ কৌতুককর তাদের পান্তা ইলিশ, ভুরিভোজ। ইতিহাস সাক্ষী দূরের গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সহজ- সরল, ধর্মপ্রাণ মানুষ বৈশাখে মিলিত হয়ে আনন্দ করতো এবং আজও করে। বৈশাখের আগমনের জন্য মুখিয়ে থাকতো গ্রামের প্রান্তজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশে প্রায় ১২ শ’র বেশি মেলা বসে; বৈশাখী মেলা সবচেয়ে প্রাচীণ। এটি মানুষে মানুষে ঐক্যের প্রতীক হয়ে রয়েছে।

সম্প্রীতির এই পরম্পরা থেকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় বাঙালিকে তাদের ইতিহাস জ্ঞান নেই । যদিও নষ্ট-ভ্রষ্ট ধর্মজীবি বেনিয়াদের সব আওয়াজ মিলিয়ে যায় বৈশাখের সকালের তারুণ্যের জোয়ারে। তারুণ্যের অদমিত শক্তির কাছে মিথ্যা বারবার পরাজিত হয়, এটিই বাঙালির ধর্ম। সেই প্রাণপ্রাচুর্যে বৈশাখের সত্যের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের, যারা জাতিপ্রেম, দেশপ্রেম, মানবপ্রেমের কথা বলি। প্রতিটি ঘর থেকেই শুরু করতে হবে সেই অভিযাত্রা। আমাদের বৈশাখ বরণ হয়তো রাজনীতির মারপ্যাচে কিছুটা মলিন হয়। বাণিজ্যিক আস্ফালনে নান্দনিকতা, স্বতঃস্ফূর্ততা হারায়। ধর্মের নামে অধর্ম আর ধর্ম প্রতারকদের হুংকারে রুষ্ট হয় তবু প্রাণ হারায় না। প্রতিটি সকালের মতই নতুন আমাদের বৈশাখ। প্রতিটি রাতের মতই গভীর নিস্তব্ধতার সত্য হয়ে ছুঁয়ে যায় সবাইকে। এই নদী, এই মাটি, এই চাঁদ, সূর্য, এই পাহাড়, বন-বনানী, পাখ-পাখালি এই যে হাজার রঙের প্রজাপতি, সুগন্ধি রুমাল সবই তো নববর্ষের উৎস স্বাগত সারথী। যতদিন একতারা থাকবে, বাংলার পথে ঘাটে গান, কবিতা থাকবে ততদিন বৈশাখ থাকবে। যতদিন একজন বাঙালি থাকবে ততদিন বৈশাখের স্রোতধারা বহমান থাকবে।  যততত্র যত জুয়াড়ীর আগমন ঘটুক না কেন বৈশাখ থাকবে। বর্ণচোরা, লুটেরা ঘাতকেরা যতই বিকৃত করতে চাক না কেন বৈশাখ স্ব-মহিমায় বারবার ফিরে ফিরে আসবে। বাঙালির আচরণেই তো বৈশাখ মিশে আছে।  সহজ-সরল মানবিক প্রেমের রাজ্যে বৈশাখ কেবল একটি মাস নয় বরং গভীর পরম্পরা স্রোতস্বিনী নদী। সাগরের ঢেউ, বাতাসের মৃদুমন্দ শিহরণ, অনুভূতি, উপলব্ধির বুকে বৈশাখ বেঁচে থাকে, প্রবাহমান থাকে। প্রেম সত্য - সত্য এই বাংলা। যেমন সত্য বাংলার পরিশ্রমী সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ; তেমন সত্য বৈশাখ। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ স্বাগত হে বৈশাখ ১৪২৪। 

নববর্ষে বাঙালি!

নববর্ষে বাঙালি!

সংলাপ ॥ পাঁচ হাজার বছরের বাঙালি জীবনে পাতা উল্টে আরো একটা বছর চলে গেল বাঙালি জীবন থেকে। যদিও গণনা ও সংখ্যার আবিষ্কার অনেক পরে এবং সেই সংখ্যায় আরো এক যুক্ত হয়ে বাংলা সন দাঁড়ালো ১৪২৪-তে। নতুন বছর এলো। নতুন বছরের কাছে আমরা নিবেদন করি। অনেক অনেক স্বপ্নের আবেদন জানাই। আশার জল তরঙ্গে আমাদের নিত্য ডুব সাঁতার। ১৪২৩ চলে গেছে যেভাবে যাওয়ার। আমাদের স্মৃতি প্রবাহে অনেকেরই এ সালের চূড়ান্ত হিসাবে কিছু গরমিল থেকে গেছে। থাকবেই। এ নিয়ম লঙ্ঘনের নয়। আশা থাকলে আশাহত হতে হবে। কর্মেও হতে পারে ভুল। ভুল তো কর্মীর জীবনে উত্তরণের সিঁড়ি।
নির্মাণে ১৪২৩ বাঙালির হতে পেরেছিল কি? হতে কি পারবে ১৪২৪? বাঙালির ঘরে জন্ম বলেই বাংলা নববর্ষ এলেই আমাদের উৎসব মুখরতা তীব্র হয়ে ওঠে। নিজে কতটা বাঙালি হতে পারলাম - এই শুভ চিন্তার স্থান দিই ক’জনা আমাদের মস্তিষ্কে? বাঙালির ঘরে জন্মালেই বাঙালি হওয়া যায় না। নিজেকে বাঙালি রূপে গড়ে তুলতে হয়। বাঙালি জাতীয়তাবোধ নিজের ভিতরে জাগ্রত রাখতে হবে সর্বক্ষণ। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ থাকতে হবে। স্বদেশ ও স্বভাষার প্রতি মমত্ববোধ অটুট থাকতে হবে। তবেই নিজেকে বাঙালি বলে দাবি করবার অধিকার জন্মে। কার্যত আমরা কি তা পারছি?
বলতে দ্বিধা নেই, প্রবাসী জীবন- যাপন যারা করেন তাদের অনেকেই নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেন। তারা ভাবেন বাঙালি পরিচয় দিলেই তিনি চিহ্নিত হবেন একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একজন এবং ধর্মান্ধ উগ্রবাদী হিসেবে। ভিখিরী জাত হিসেবে। যত দ্রুত সম্ভব তারা সম্পর্ক ছেদ করেন স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বভাষার সাথে। কেন এই সংকীর্ণতা? কোনোভাবেই কি তারা লুকাতে পারবে তাদের বাঙালি আকৃতি ও প্রকৃতি? পোষাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, উৎসবে-আয়োজনে যতই তারা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করুক না কেন, সে কোনোদিনই পাশ্চাত্যের একজন হতে পারবে না। এ দেশে বসবাস করেও অনেকে একই ভাবধারা পোষণ করেন। কথায় কথায় তারা অবজ্ঞার সুরে প্রায় বলে থাকেন - ‘দেখতে হবে না, এ তো বাঙালি জাত’। অথবা ‘বাঙালিরে হাইকোর্ট দেখান’ অথবা ‘এই দেশে কি মানুষ থাকে’? বাঙালি হয়ে জন্মানোটাই যেন তাদের কাছে আজন্মের পাপ বলে মনে হয়। অজ্ঞাতে ছুঁড়ে দেয়া থুথু তারা যে নিজেরাই নিজেদের মুখে লেপ্টে দিচ্ছে এই বোধ কি কোনো কালেই জাগবে না?
বোধ-এর ঘরে যতই তারা মরা থাকুক না কেন, তারা কিন্তু ঠিকই বিচরণ করছে ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতির অন্ধকার রাজত্বে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের হাতে বেজে উঠছে বিভেদের ঘন্টা ধ্বনি। অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্যে অথবা স্বার্থবাদী ধর্মের কলে অথবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বাঙালি বিরোধে জড়ায় বাঙালির সাথে। জাতীয়তাবোধে ফাটল ধরলে মানবিকতা সেখানে অনুপস্থিত থাকবেই। ভৌগলিকভাবে স্বাধীন দেশে বাস করে যেমন আমরা বলতে পারি না ‘আমরা মুক্ত’, তেমনি বাংলাদেশে বাস করে বলতে পারি না ‘আমরা বাঙালি’। ‘আমরা বাঙালি’ না ‘আমরা বাংলাদেশী’ না ‘আমরা মুসলমান’ না ‘বাঙালি মুসলমান’ - এই রাজনৈতিক বিতর্কে আমাদের অমিমাংসিত ঔদ্ধত্য দিন দিন সীমা অতিক্রম করে চলেছে। উত্তপ্ত রাজনীতির কেন্দ্রীয় লক্ষ্য যেহেতু ক্ষমতা দখল, সেহেতু দেশপ্রেমের প্রশ্নটা এখানে অবান্তর। ক্ষমতার গর্ত থেকে চোখ তুলে এরা সময় পায় না জাতির বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকাবার। কর্তা ব্যক্তির পদলেহনে এরা ব্যস্ত। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের স্বীকৃতি পেতেও তাই আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। কিন্তু বাংলা সনের সরকারী ব্যবহার এখনো সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সরকার হয়ে যারা এসেছেন এবং যারা আছেন, তারা কি বাঙালি নন? কোন্ কারণে তবে বাংলা সনের ব্যবহার এতো উপেক্ষিত?

প্রতি বছরই ১লা বৈশাখকে বরণ করে নিচ্ছি বাহারী উৎসবে। এই একদিনে আমরা আপাদমস্তক বাঙালি হয়ে ওঠার দুর্নিবার সাধনায় মত্ত হয়ে উঠি। পোষাকে, খাবারে, গানে, বক্তৃতায় তথা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আমরা এদিন পুরোদস্তুর বাঙালি। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, গ্রামে-গঞ্জে বর্ষবরণ উৎসব জমে ওঠে। বৈশাখী মেলায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলার গ্রাম ও শহরগুলো। সামর্থ বিশেষে সকলেই অন্তরে লুকায়িত বাঙালিত্বে আলোড়িত হই। কিন্তু দিন ফুরোলেই আবার ফিরে যাই পুরাতন বৃত্তে। কোনো বৈশাখী ঝড় আমাদের ভিতর যদি জাতীয়তাবোধকে জাগাতে না পারে, তবে কতটুকু লাভ শুধু বর্ষবরণের উৎসবে মেতে থাকায় এবং কতটুকু লাভ এক দিনের কৃত্রিম বাঙালি সাজায় তা ভেবে দেখার সময় এসেছে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের জন্য।