বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

মনুষ্যত্ব জাগ্রত রাখাই মানুষের ধর্ম

মনুষ্যত্ব জাগ্রত রাখাই মানুষের ধর্ম

·        ‘নিশ্চয় যারা বিশ্বাসী, ইহুদী, সাবেয়ী ও খ্রীষ্টানদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাস করবে, আর সৎকাজ করবে, তার কোন ভয় নেই, আর সে দুঃখও পাবে না’। (আল কুরআন-৫: ৬৯)।
·        ‘আল্লাহ্ তোমাকে যা দিয়েছেন তা দিয়ে পরলোকের কল্যাণ অনুসন্ধান কর। ইহলোকে তোমার বৈধ সম্ভোগকে তুমি উপেক্ষা করো না। তুমি মহানুভব হও, যেমন আল্লাহ্ তোমার ওপর মহানুভব। আর পৃথিবীতে ফ্যাসাদ (সন্ত্রাস) সৃষ্টি করতে চেয়ে যেও না। আল্লাহ্ তো বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালবাসেন না। (আল কুরআন-২৮ : ৭৭)।
·        ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার কাছে’। (আল কুরআন-১০৯:৬)।
·        ‘তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহ্ প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ প্রকৃতির কোন পরিবর্তন নাই। এ-ই সরল ধর্ম; কিন্তু মানুষ অনেকেই তা জানে না’। (আল কুরআন-১০৯ : ৬)।
শাহ্ ফুয়াদ ॥ শব্দের উৎপত্তিগত অর্থে ‘মান’ সম্পর্কে যার হুঁশ আছে সেই মানুষ। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক বলেছেন, ‘মানুষ যদি হতে চাও তবে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত কর’। ইসলাম মানবতা ও সত্যের ধর্ম। এখানে মানবতাবিরোধী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও মিথ্যাচারীদের কোনো স্থান নেই। সাধক কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি কো ইসলাম। সত্যকে যে চায়, আল্লায় মানে মুসলিম তারি নাম’। ‘ইসলাম পৃথিবীতে কাউকে গোলাম করতেও আসিনি, কারও গোলাম হতেও আসেনি’। ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি। সেই অর্থে ইসলামকে শান্তির ধর্ম না বলে শান্তিধর্ম বলাই যুক্তিসঙ্গত। শান্তির পরিপন্থী কোনো কাজ করলে সেখানে আর ধর্ম থাকে না। আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর আগে আরব দেশের মক্কা নগরী যখন অন্যায়, অত্যাচার, হানাহানি, নির্যাতন, বিশেষ করে নারী নির্যাতন, ব্যাভিচারসহ সকল ধরনের অশান্তি ও বর্বরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন সেখানে এই শান্তিধর্মের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ (সা.)। এর জন্য মক্কা নগরীর হেরা গুহায় মহানবী (সা.) কে তাঁর আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা, গবেষণা, অনুসন্ধ্যান ও ধ্যান করে কাটাতে হয়েছিল দীর্ঘ পনেরোটি বছর।
জন্মেছিলেন তিনি তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোরাইশ বংশে। যৌবনে তিনি হিলফুল ফুজুল-এর মতো সংগঠন করে তৎকালীন আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন বাস্তবধর্মী কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছিলেন। পরিণত বয়সে যখন এক আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আহবান জানালেন তখন কোরাইশ বংশের লোকেরা তাঁর প্রচারিত শান্তিধর্মে বিশ্বাস স্থাপন তো দূরের কথা, তাদের অত্যাচারে নবীকে মক্কা ছেড়ে হিজরত (অভিবাসন) করতে হয়েছিল মদিনায়। কারণ, তাঁর প্রচারিত সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে কোরাইশদেরকে প্রভাব-প্রতিপত্তি, আধিপত্য, মোনাফেকী, অত্যাচার, ব্যাভিচারসহ যাবতীয় মিথ্যাচার সব কিছুই ছেড়ে দিতে হয় যা কোরাইশদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। মহানবীর সারাজীবনের অপরিসীম কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল হিসেবে শান্তিধর্মকে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন। জয় করলেন মক্কা । আর এই জয়ের সাথে সাথে কোরাইশসহ তৎকালীন আরবের অনেক বংশের ভণ্ড, প্রতারক, মোনাফেক ও কায়েমী স্বাথবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মুসলমানের দলে ভীড়ে গেলো, যাদের প্রকৃত পরিচয় উন্মোচিত হলো মহানবীর ওফাতের পর। তাঁর উত্তরাধিকার তথা ক্ষমতা নিয়ে শুরু হলো দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, মহানবী (সা.) কিন্তু তাঁর পরিধেয় বস্ত্র (জোব্বা) মক্কা নগরীর কাউকেই দেননি, পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সূদুর ইয়েমেনে তাঁর আশেক ও ভক্ত ওয়াসেস করণী (রা.)-এঁর জন্য, যিনি তাঁর অসুস্থ ও বৃদ্ধা মায়ের সেবা-শুশ্রুষার জন্য নবীজির সাথে জীবনে দেখাই করতে পারেননি। নবীজীর ওফাতের পর চার খলিফার মধ্যে তিনজনই নিহত হয়েছিলেন মুসলমান ঘাতকদের হাতে, পরবর্তীতে নবীজির প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.) ও ইমাম হাসান (রা.) সহ নবীবংশই এজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল তারাও ছিল মুসলমান। তবে তারা কী ধরনের মুসলমান ছিল সেটাই প্রশ্ন। বস্তুতপক্ষে ‘ইসলাম’ শব্দটিকে তারা ব্যবহার করেছিল পার্থিব ক্ষমতা তথা রাজনীতির স্বার্থে। ফলে সেখানে মানবতা, সত্য ও শান্তির পথ তারা জলাঞ্জলি দিয়েছিল। এক আল্লাহ্র ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে সেই বিশ্বাসে তারা কখনো একনিষ্ঠ ছিল না। একনিষ্ঠ শুধু তারাই ছিলেন যারা মুহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত শান্তি ও সত্যের বাণী প্রচারে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বিশ্বময়। তারা ছিলেন সূফী সাধক, অলি-আউলিয়া-দরবেশ, মানবতার মহান ব্রতে তাঁরা তাঁদের জীবনকে করেছিলেন উৎসর্গ। তাঁদের নিদর্শন হিসেবে ভারতবর্ষে খাজা মঈনুদ্দিন হাসান চিশতি (রা.), বাংলাদেশে শাহ্ জালাল (রা.)-এর মতো দরগাহ ও মাজার শরীফ আজও সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষদের মিলনকেন্দ্র, শান্তি-মঙ্গলের নিশানা। এভাবে দেখা যায়, কমপক্ষে বারো শ’ বছর ধরে এদেশের মানুষ মুসলমান, শান্তি (ইসলাম) ধর্মের অনুসারী। অথচ আজ আবার এদেশের মুসলমানকে নতুন করে ধর্ম শেখাতে চায়, নতুন করে মুসলমান বানাতে চায়, এরা কারা? নাকি এরা শান্তি ধর্মের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের বংশধর যারা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এসেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আজ খুঁজছে এদেশের বিবেকবান ও সচেতন মানুষেরা।

ধর্মের নামে, ইসলামের নামে বর্তমানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের নামে আধিপত্য সৃষ্টি করে রাখতে চায়। তারা ধর্মীয় আধিপত্য কায়েম করতে চায়। এসব বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নবীজির ওফাতের পর থেকেই এই চেষ্টা করে আসছে। এটাকে তাই বলা হয় রাজনৈতিক ইসলাম। আর এই রাজনৈতিক ইসলামের বর্তমান পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতা খোদ্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এর আগে ছিল ব্রিটিশ পরাশক্তি। বস্তুত সমগ্র ইউরোপই তাদের মদদদাতা। এই ব্রিটিশ ও মার্কিনীরাই মুহাম্মদ (সা.)-এর আরব দেশে কায়েম করেছে সৌদি রাজবংশ এবং তাদের সহযোগী কাতার, কুয়েত, বাহরাইনে অন্যান্য আরও কয়েকটি রাজবংশ। মুহাম্মদী আরব না হয়ে তাই রাষ্ট্রের নাম হয়েছে সৌদি আরব। ইসলাম কখনো রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। এই রাজতন্ত্রই এখন সমগ্র মুসলিম উম্মার উন্নয়নের পথের কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্র এই সৌদি আরব। বলতে গেলে সৌদি রাজতন্ত্রের এবং সৌদি রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব ও ক্ষমতাও ইসরাইলকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এই সৌদি আরবই আবার ওহাবীবাদের জন্মদাতা, ধারক, বাহক ও প্রচারকারী। ইসলামের নামে এই ওহাবীবাদই এখন সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষদেরকে গ্রাস করে রেখেছে এই ওহাবীবাদ। অথচ এই ওহাবিরা কখনো ধার্মিক হতে পারে না। মওদুদিবাদী জামাত-তাবলিগ-হেফাযত এসবই রাজনৈতিক ইসলামের ধারক-বাহক। এরাই ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করে। আইএস ওহাবীবাদের নতুন সংস্করণ। এভাবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি করে এদের দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত বছরগুলোতে আরবী ভাষাভাষী ও মুসলিম রাষ্ট্র ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় বিভিন্নভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তছনছ করে দিয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের হস্তক্ষেপ না থাকলে সিরিয়া তথা গোটা মধ্যপ্রাচ্যেরই যে কী অবস্থা হতো তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ মার্কিন মদদপুষ্ট ওইসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামাতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এখনো নিশ্চিহ্ন হয়নি। বরং প্রধান প্রধান কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এখন সরকারকে মরণকামড় দিতে চাইছে। আর এক্ষেত্রে এখনো তাদেরকে ব্যবহার করতে হচ্ছে ইসলামকেই। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব জয়জয়কারের মধ্যেও সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার এ কী দুঃখজনক ঘটনাপ্রবাহ! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ধর্মের নামে এমন হাজারো মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। কারণ, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সাধারণ মানুষ চিরকালই শান্তিপ্রিয়। এখানকার জলবায়ু, প্রকৃতি, নদী-নালা, খালবিল, এখানকার ষড়ঋতুর বৈচিত্র ইত্যাদি সবকিছুই ধর্মের নামে সন্ত্রাসকে প্রত্যাখ্যান করেছে যুগে যুগে। এখানকার মানুষ সহজ-সরল, কোমল হৃদয়ের অধিকারী। এখানকার মাটিতে শায়িত রয়েছেন অসংখ্য সূফী-সাধক, মুনি-ঋষি-আউলিয়া-দরবেশ। এখানকার কবি বলেছেন, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’। ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান’। ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ইশ্বর’। তাই এখানকার মানুষ মনুষ্যত্বকে জাগ্রত রাখতেই আনন্দ পায়। মনুষ্যত্বকে জাগ্রত রাখার মধ্যেই নিজেদের আদর্শ ধারণ করার চেষ্টা করে, মনুষ্যত্বকে ধারণ করে। এটাই তাদের ধর্ম। মানুষ হত্যাকারী, খুনী, ধর্মব্যবসায়ী তথা মানবতাবিরোধী শক্তিগুলো এদেশের সমাজে ঘৃণার পাত্র। 

সময়ের সাফ কথা.... বাংলা ও ইসলামের শত্রুরা এক ও অভিন্ন

সময়ের সাফ কথা....

বাংলা ও ইসলামের শত্রুরা এক ও অভিন্ন

নজরুল ইশতিয়াক ॥ দেশকে দেখে দেশপ্রেম। মানুষকে দেখে মানুষের প্রতি প্রেম আসে। যারা দেশ পরিচালনা করতে চান তাদেরকে পুরো দেশ, দেশের মানুষ, মানুষের সক্ষমতা তথা কর্ম ক্ষমতা, চিন্তার ধরন, ঐতিহ্য ইতিহাস দেখে আসতে হবে। না দেখে আসলে দেখা হবে না, প্রেম হবে না, করা হবে না। উপরন্তু কাল্পনিক দেশপ্রেমের বলি হতে হবে। অন্ধকারে সাপ ছোবল মারবেই কারণ অন্ধকার অন্ধকারই। সেখান থেকে বের হবার প্রচেষ্টায় তো জীবনেই ধর্ম।
বিজ্ঞানী উপাত্ত সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। এ পর্যায়ে তিনি উপাত্ত সংগ্রহ ও পরীক্ষার নিরীক্ষার আগের দেখা থেকে ভিন্ন কিছু দেখেন। এটি তাকে বাহ্যিক দেখা থেকে ভিতরের দেখায় নিয়ে যায়। এভাবেই বস্তুর রূপ বা বস্তুর কার্যকারণ সত্য বের হয়ে আসে। বিজ্ঞানী বস্তুর রূপান্তর ঘটান দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। তাকে এই প্রক্রিয়ায় আসতে পরম্পরা গবেষণা তথ্য উপাত্ত জেনে আসতে হয়। জানতে জানতে তিনি নিজেকে সেই জানার পথে স্থিত করেন। তিনি যে বস্তুর বা সূত্রের গবেষণা করতে চান তার মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করেন বা দেখেন। তার এই দেখা তাকে উপর্যুপরি দেখায় আসক্ত করে। এভাবেই দেখা থেকে দেখার রূপান্তর। পুরো পৃথিবী একটি রূপান্তরিত অবস্থা। আমরা রূপান্তরের যাত্রা পথে মানুষ আদি সত্যের আধার। নিজেকে যদি দেখতে পায় রূপান্তরের এই যাত্রায় আমরা কোথায় আছি তবেই কেবল দেখতে পারবো কোথায় যাচ্ছি। বস্তুত মানুষ অন্য সব কিছুর মধ্যে নিজেকেই খুঁজে ফেরে। নিজেকে দেখা তবু ফুরায় না।
রূপান্তরের যাত্রায় কল্পনা মিথস্ক্রিয়া রূপকথা অদৃশ্য ভাবনার কোন স্থান নেই। আমরা যেখানে নিজেদের দেখতে চাই সেখানে যাবার ক্ষেত্র প্রস্তুতি যাত্রা সম্পন্ন করলেই কেবল সেখানে যেতে পারি। প্রেম সৃষ্টি হয় দেখা থেকে। কল্পনায় প্রেম সৃষ্টি হয় না। ফলে দেশপ্রেম সৃষ্টির প্রক্রিয়াও এক ও অভিন্ন। না দেখতে পারলে কোন পরিকল্পনা কোন পদক্ষেপ সফল হয় না। পুরো দেশকে দেখতে না পারার ফল বর্তমানে ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। আমরা দেখতেই পারছি না আমরা কি নিয়ে আছি আর কোথায় কারা কি নিয়ে আছে আর তাদের নেপথ্যে কারা কি কারণে রসদ জোগাচ্ছে? না দেখতে পারার অর্থ হচ্ছে হচ্ছে আমরা দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। বর্তমানে এসে ফলাফল ভোগ করছি মাত্র।
ব্যক্তি যে জনপদে ভুমিষ্ট হয়েছে সেই ভূমি মাতৃতুল্য। গর্ভধারিনী মা যেমন তাকে ধারণ করেছে পরবর্তীতে লালন পালন করেছে তার দেশ মা’ও তা-ই করছে। মা এবং দেশ কে অস্বীকার করা বা অমান্য করা মানে শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। শেকড় বিচ্ছিন্ন গাছ বাঁচে না। মা ও মাতৃভূমির মধ্যেই তার সত্য নিহিত রয়েছে। এটিই যদি না হতো তবে পৃথিবীতে এত জনপদ, এত ভাষা, এত সংস্কৃতির সৃষ্টি হতো না। স্রষ্টার সৃষ্টির এই বিপুল নিকেতন আমরা দেখতাম না। পুরো পৃথিবী একটা বাগান তবে তা বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা ছোট চোট হাজারও বাগানের সমষ্টি। জনপদের দীর্ঘ জীবনাচার ভৌগলিক বৈচিত্র শুধু মাত্র ভাষা চেহারা বর্ণ ও চিন্তন পদ্ধতিকে  একটা আবরণ দিয়েছে মাত্র। এই আবরণ ভেদ করলেই সব কিছু দৃশ্যমান রূপ নেবে। ফলে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছে আমি পৃথিবীর সমস্ত জনপদে স্ব-স্ব ভাষার উপযোগী রাসুল প্রেরণ করেছি। যাতে তারা নিজেদের মত করে বুঝতে পারে।

নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে দেখার শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। এ জন্য নিজেকে বারবার দেখাটা জরুরী। দেশের মানুষের অভাব অভিযোগ সংকট সমস্যাকে বারবার দেখতে হবে। দেশপরিচালনার ক্ষেত্রে যারা পুরো দেশকে দেখার সামর্থ্য অর্জন করবেন কেবল তারা দায়িত্ব পাবার অধিকারী হবেন। কাউকে বঞ্চিত করে লুটেরা পাচারকারী মুনাফেকি যেমন স্রষ্টা পছন্দ করেন না তেমনি যারা আল্লাহ্ দ্বীন প্রতিষ্ঠার নামে খুন হত্যা জখমের তাবেদারী অভিযান শুরু করেছেন তাদেরও বাংলায় স্থান হবে না। নিঃসন্দেহে এরা বিপথগামী। বিদেশী মেহমান যারা এদেশের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আমন্ত্রিত তাদের উপর হামলা প্রমান করছে বাংলা ও ইসলামের শত্রুরা এক ও অভিন্ন। দেশ পরিচালনা হবে লক্ষ্য ভিত্তিক। সেখানে নীতি নৈতিকতার রং রূপ লক্ষ্য পুরোনের সাথে সঙ্গতিপূর্ন। বাংলার শত্রুদের চিহ্নিত করতে পারলেই বাংলায় ইসলামের নামে যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করছেন তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে। সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে সকল কাটা দূর হবে। 

বাংলা ভাষায় খোতবা

বাংলা ভাষায় খোতবা

সংলাপ ॥ খোতবা শব্দের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটা আরবি ‘খুৎবুন’ শব্দ হতে উদ্ভুত, যার আভিধানিক অর্থ হলো বক্তৃতা। ইসলামী পরিভাষায় খোতবা বলতে আল্লাহ্ প্রশংসা, রাসুলের প্রশংসা ও বক্তৃতা বুঝিয়ে থাকে। খোতবার উদ্দেশ্য আল্লাহ্ জিকির বা স্মরণ এবং বক্তৃতা, উপদেশ প্রদান করা। আর এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক সংশোধন সংস্কার। জুম্মার নামাজের পূর্বে মসজিদে কিংবা দুই ঈদের নামাজের পরে ঈদগাহে, আরাফাতের ময়দানে হাজীদের উদ্দেশে, বিবাহ ও জানাজা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে খোতবা প্রদান রীতি প্রচলিত রয়েছে।
শুক্রবার দিনটি অন্য সব দিনের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, কারণ এদিন সারা বিশ্বের সব মসজিদে জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। শহর গ্রামের সব মুসল্লি এ দিন মসজিদে একত্রিত হন। রাসুল সা. এর যুগে তিনি নিজেই খোতবা প্রদান করতেন।  খোত্বার মধ্যে আদর্শ চরিত্র গঠনের দিক নির্দেশনাসহ সামাজিক-পারিবারিক নিয়মরীতি, নাজিলকৃত অহির বাণী, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতিনীতি, কৃষি কাজ, স্বাস্থ্য, সামাজিক সমস্যা, ইবাদত-বন্দেগী, বিচার ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়ের সমাধান তুলে ধরতেন। মুমিন হতে হলে তার করণীয় ও বর্জনীয় বিভিন্ন বিষয়গুলো কি তা বিশদভাবে আলোচনা করতেন।
আমাদের দেশে খতিবগণ সাধারণতঃ বার চান্দের খোতবার কিতাব সংগ্রহ করে তা দেখে দেখে আরবি ভাষায় পাঠ করেন। অথচ এদেশের মানুষের ভাষা বাংলা। বেশির ভাগ মানুষই আরবি ভাষা জানেন না, তাই খতিবের দেয়া খোতবা শ্রবণ করেন বটে কিন্তু এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে খোতবার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। অধিকাংশ খতিবই সাধারণত নিজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতি শুক্রবারের জন্য আলাদাভাবে কোন খোতবা তৈরি করেন না। একজন খতিব যদি প্রতি সপ্তাহের জন্য নিজে খোতবা তৈরি করেন, তবে তার নিয়মিত জ্ঞান চর্চা হয়। আর নির্ধারিত খোতবা পাঠে তার চিন্তা গবেষণা হয় না।  কুরআন সর্বকালের সর্বাধুনিক সমস্যার সমাধান গ্রন্থ। অতএব কুরআনের আলোকে আমাদের জীবন পরিচালনা করতে পারলে, আমরা সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতাম। আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪০ বছর পরও মাতৃভাষায় ইসলামী সাহিত্যচর্চা ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত হতে পারেনি। প্রতি শুক্রবার জুম্মার দিন খোতবাগুলো যদি গঠনমূলকভাবে তৈরি করে দেয়া যেত, তবে এ দেশের অনেক খতিবই যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত লেখক এবং গবেষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারতেন। একটি সুন্দর উপযুক্ত, মানসম্মত ও আদর্শ খোতবা তৈরির জন্য কতগুলো নিয়ম পদ্ধতি এবং কলাকৌশল অনুসরণ করতে হয়। যার মাধ্যমে গোটা বিশ্ব, জাতি সঠিক দিকনির্দেশনা খুঁজে পাবে। বর্তমান বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যেসব ফেৎনা-ফ্যাসাদ (সন্ত্রাস), যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি যেমন ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা, বর্বরতা, নির্যাতন, নিপীড়ন সাম্প্রতিককালে যেভাবে বেড়ে চলেছে ক্ষমতার জন্য - এসব কিছুর প্রতিকার কী? কী উপায়ে এই অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পেতে পারে। এ সম্পর্কেও খোতবার মাধ্যমে জাতিকে দেয়া যায় দিক নির্দেশনা। সমাজের সাধারণ মানুষও খতিবের কাছে দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যই আশা করেন। আমাদের দেশের খতিবগণ প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন খোতবা তৈরি করে দেশ ও জাতির চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবা যেন বিষয়বস্তুর আলোকে দু’ভাগে বিভক্ত হয়। ১. কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খোতবা। যেমন ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ আক্রমণ। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, পহেলা মহররম হিজরি নববর্ষের তাৎপর্য, ১০ মহররম আশুরা শরিফ, আখেরি চাহার শোম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা. ইত্যাদি বিষয়াবলির প্রকৃত ঘটনা ও তাৎপর্য গুরুত্বসহকারে মুসলমানদের সামনে তুলে ধরা। ২. পবিত্র কুরআনের আলোকে মানুষকে শান্তির পথ-নির্দেশনার জন্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা যেমন-মানবীয় চরিত্র গঠন, নৈতিকতা, দুর্নীতিমুক্ত দেশ ও জাতি গঠনে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় করণীয় এবং এ সংক্রান্ত কুরআনের উপদেশ সংবলিত ঘটনাবলি ও আদেশ-নিষেধ বর্ণনা করা। নবী-রাসুল, অলি-আউলিয়া ও সূফী সাধকদের জীবনদর্শন আলোচনা করা। অতএব কোন খতিব যদি এ নিয়মে তার খোতবা সাজাতে পারেন, তবে তার খোতবাটি একটি আদর্শ ও মানসম্মত খোতবায় পরিণত হবে। মুসলমানদের মাঝে খোতবা শোনার আগ্রহ বাড়বে। তাই আমাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রতি শুক্রবার নতুন খোতবা প্রস্তুত করে মুসলমানদের সামনে উপস্থাপন করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ, খোতবার নামে সাম্প্রতিককালে ইহুদি-খ্রীষ্টান ও তাদের মদদপুষ্ট ঘৃণ্য ওহাবীবাদীদের বিকৃত আদর্শে প্ররোচিত হয়ে এক শ্রেণীর বিপথগামী এদেশীয় ধর্মজীবীরা তরুণদের একটি অংশকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এবং পবিত্র শান্তিধর্ম (ইসলাম)কে কলুষিত করছে। যা সমগ্র মুসলিম সমাজকে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।     
স্মর্তব্য, ১৯৬০ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রথমবারের মতো ইমাম প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করেছিল। সে সময় খোতবা সংস্কারেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং তৎকালীন বিশিষ্ট উলামা এবং বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক বাংলা অনুবাদসহ নতুন খোতবাও রচিত হয়েছিল বলে জানা যায়। একযোগে তা অনেক মসজিদে পঠিতও হয়েছিল। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, নব্বই-এর দশকে বাংলাদেশে খোতবা সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে কিছুটা বাস্তব পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের ১৪ জানুয়ারী ইকবাল রোডে ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্প আয়োজিত ১৯৮তম দলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণদানকালে তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী একটি খোতবা প্রণয়ন কমিটি গঠন করার তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দেশে প্রচলিত পুরাতন খোতবার অংশ বিশেষ পরিবর্তন করে মুসল্লীদের মধ্যে প্রচার উপযোগী বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মুদ্রিত একটি নতুন খোতবা শীঘ্রই প্রণয়ন করা হবে।
তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী ঘোষিত খোতবা সংস্কার কমিটি কিছুদিন কাজও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ফলে সেই খোতবা সংস্কার কমিটির আর কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত না হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে খোত্বা সংস্কারের সেটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এরপর খোতবা সংস্কারের আর কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে বলে জানা যায় না।
বর্ণিত পটভূমির আলোকে বলা যায় যে, খোতবা সংস্কারের মহৎ উদ্দেশে অতীতে যেসব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ সরকারী রেকর্ড-পত্রে সংরক্ষিত থাকার কথা। নতুন শতকের নতুন পরিস্থিতিতে খোতবা সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। যেহেতু এ সম্পর্কে অতীতে যথেষ্ট কাজ হয়েছে এবং বেশ অগ্রগতিও সাধিত হয়েছিল। বর্তমানে ধর্ম মন্ত্রণালয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিষয়টি বিবেচনায় এনে সারা দেশের মসজিদের জন্য একই ধরনের একটি খোতবা প্রণয়নের যে উদ্যোগ গ্রহণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে তা প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে ধর্মীয় গোড়ামীর উর্ধ্বে উঠে সত্য ও শান্তির সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে যুগোপযোগী ধর্মীয় দযুগের চাহিদা অনুযায়ী খোতবা সংস্কারের প্রয়োজন নিয়ে সচেতন মহলে বিতর্ক থাকতে পারে না। তাই খোত্বার সংস্কার ও যুগোপযোগী করা নিয়ে সৌদি-ওহাবী-ইহুদিপন্থী কোনো ধর্মব্যবসায়ী, স্বাধীনতাবিরোধী, যেন বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ না নিতে পারে সেদিকেও তীক্ষ্ন সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, ধর্মের কথা জানতে হলে, বুঝতে হলে, মানতে হলে সবাইকে নিজ নিজ ভাষায় কুরআন পড়তে হবে। হিন্দুর ভাষা, খ্রিস্টানের ভাষা, কাফেরের ভাষা বলে কোন ভাষাকে অবমাননার সুযোগ আল্লাহ কাউকে দেননি। রাসুল সা. বলেছেন যে, প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগত ভাবে মুসলিম, অর্থাৎ নিষ্পাপ, ভালো ও শান্ত। তাই মানবশিশু জন্মের পর যে ভাষায় কথা বলে তা-ই মুসলমানদের ভাষা। আল্লাহ তায়ালা জন্মের পর নিষ্পাপ ও পবিত্র মানব-শিশুর মুখে যে ভাষা ফুটিয়েছেন সে ভাষাতেই দিয়েছেন ইবাদত ও কিতাব শিক্ষার পূর্ণ অধিকার। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা যে অধিকার দিয়েছেন কোন মোল্লা তা ছিনিয়ে নিতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে তার সব নবী-রাসুলের কণ্ঠে একমাত্র আরবি ভাষা দেননি এবং নবী-রাসুলদের মাঝে ভাষাগত ঐক্য সৃষ্টি করেননি। বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আরবি ভাষাই যদি কল্যাণকর হতো তবে আল্লাহ এতো ভাষা সৃষ্টি করতেন না এবং তাঁর সব কিতাবই আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করতেন, এবং একমাত্র আরবিকেই ইবাদতের যোগ্য ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করতেন। অনারবি ভাষা আল্লাহর ইবাদতের অযোগ্য হলে বিভিন্ন অনারবি ভাষায় বিভিন্ন কিতাব অবতীর্ণ করতেন না। অথচ আল্লাহ তায়ালা হিব্রু ভাষায় ইনজিল, ইবরানি ভাষায় তাওরাত ও ইউনানি ভাষায় যাবুর অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং কেবল আরবিই আল্লাহ তায়ালার ভাষা নয়। আল্লাহ তায়ালা অন্তর্যামী। সব মানুষের ভাষাই তাঁর ভাষা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাব না বুঝে আবৃত্তি করার জন্য অবতীর্ণ করেননি। যে মানুষ যে ভাষায় তাঁর কিতাব সহজে বুঝতে পারে সে ভাষাই আল্লাহর কাছে প্রিয় ও পছন্দনীয়। আল্লাহর ইবাদতে বান্দার মাতৃভাষার চেয়ে উত্তম কোন ভাষা নেই।

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মসজিদের ইমাম-খতিবগণ সমাজের তৃণমূল থেকে ইসলামের প্রচার-প্রসার, ইসলামি আদর্শ শিক্ষার বিস্তার, বাস্তবায়ন, সামাজিক অপরাধ-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও ধর্মদ্রোহীদের অপপ্রচার-বিভ্রান্তির অবসানে কার্যকর ও বাস্তবমুখী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। রাজনৈতিক ইসলাম ও  বিভ্রান্তদের প্রচারণা এবং অপতৎপরতা রোধে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। এ লক্ষ্যে খোতবা সংস্কারের মাধ্যমে ইমামদের যুগ চাহিদা পূরণে প্রস্তুত ও অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। খোতবা যেন সমাজের অভ্রান্ত দিশারী হিসেবে, আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে তা নির্ণীত ও নিশ্চিত করতে হবে। কেননা ইমাম-খতীবরা মুসলিম সমাজের ধর্ম বিশ্লেষক হিসাবে সবার মধ্যে খোতবার আবেদন সৃষ্টি করতে পারেন। 

সত্যমানুষের বিকল্প নেই

সত্যমানুষের বিকল্প নেই

অ্যাড.এম. মাফতুন আহম্মেদ ॥ বাল্যবন্ধু মিলটন ঘোষ। পেশায় একজন আইনজীবী। কায়েস্থ পরিবারের নির্লোভ, নির্মোহ একজন সৎ জন। সুখে-দু:খে আজও দু’জনে মিশে আছি খুলনা শহরে একাকার হয়ে। আবেগে উচ্ছাসে দু:খ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে সেদিন এসেছিলেন আমার কাছে। বললেন মনের ভেতর জমাটবদ্ধ অজানা অনেক কথা। আসলে মায়ার এই পৃথিবী ফুলশয্যা নয়, সবার জন্যই কন্টকাকীর্ণ। রোগে - শোকে-পাথরে জীবনের এই মধ্যবেলায় অনেককে পোহাতে হয় নানা ঝুট-ঝামেলা। সদালাপী বাল্যবন্ধুর মুখ থেকে ফুটে উঠল হতাশার নানা কথা। যেসব কথার অন্ত নেই। উদ্ভুত এই সমাজ ব্যবস্থায় সমাধানের তেমন কোন পথ খোলা নেই। হাকঢাক না রেখে সাহসের সাথে উচ্চকিত কন্ঠে বললেন,‘এ দেশে সৎ মানুষ নেই’, ‘সৎ মানুষের ভাত নেই’। এ কথাটি কী বন্ধুবর মিলটনের ব্যক্তিগত কথা? নাকি সমাজের করুণ দৃশ্যপট তার ভাবুক মনকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে? তার এতসব কথা কি তার বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের বহি:প্রকাশ মাত্র?
আসলে ঘটনাটি কিন্তু তা নয়। বিষয়টি ভিন্ন। অভিন্ন সুরে আমজনতা হাটে-মাঠে সর্বত্রই বলছে, এদেশে ভাল মানুষের কোন জায়গা নেই। সৎ মানুষের কোন ভাত নেই। সৎ ভাবে জীবন-যাপন করে লাভ কী? সমাজে সৎ মানুষ তেমন একটা চোখে পড়ছে না। সর্বত্রই সৎ মানুষের আকাল দেখা দিয়েছে।
পেশাগত এই জীবনে কাছে-দূরে থেকে কম-বেশি অনেক কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি। অনেক কিছু উপলব্ধিতে আনার চেষ্টা করেছি। উদ্বেগ, উৎকন্ঠার সাথে চলমান ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করেছি। এদেশে যিনি সত্য কথা বলবেন, সমাজের কাছে বিরাগভাজন হবেন, যার জন্য সত্য কথা বললেন শেষ পর্যন্ত তাকে হারাবেন। যার জন্য জীবন উৎসর্গ করবেন তার হাতে খুন হবেন, লাঞ্চিত হবেন, অপমানিত হবেন। ভাল কাজের উপদেশ দিবেন, ভুল বুঝবে, দূর্বল ভাববে; আপনাকে ছেড়ে অসৎদের খোয়াড়ে মিশে যাবে। অত:পর এই ব্যক্তি একদিন আর্থিক, মানুষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবুও সৎ মানুষেরা অসৎদের সাথে মিলে-মিশে থেকে সমাজ ও দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা চালাবেন। অপরদিকে অসৎ মানুষেরা অবৈধ অর্থ রোজগারে অভিন্ন সুরে বড় বড় কথার বয়ান দেবেন। নিজেকে আবার সাধু হিসেবে জাহির করবেন। এ সবই চলছে যুগের হাওয়ায়। ক্ষমতার পালাবদলে। এরা সমাজের কাছে আর এক শ্রেণীর সাধু শয়তান। এদের কবল থেকে আমরা কী বেরিয়ে আসতে পারব না? প্রতিবাদিদের কন্ঠ আজ স্তব্ধ! তারা নীরব, নিথর! অত:পর দেশের গোটা বীভৎস চিত্র দেখে মনে হয় সৎ মানুষের সংখ্যা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। এমনিতে আমরা হুজুগে। যা শুনি তাই বিশ্বাস করি। গূঢ় রহস্য কী, গভীরে বিচার বিশ্লেষণ করি না। মনে যা আসে তাই বলি। কোথাকার পানি কোথায় যেয়ে লাগে তা নিয়ে ভাবি না। বিলক্ষণ চিন্তা করি না। আসলে গোটা সমাজ ব্যবস্থা আজ ক্যান্সারে আক্রান্ত। মাছের মাথায় মড়ক লেগেছে। যারা দেশ-জাতিকে উন্নতির শিখরে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন সমাজে সেই সব সৎ, আদর্শিক বিবেকসম্পন্ন মানুষের মূল্যায়ন নেই বললে চলে। বিশ্বায়নের এই যুগে রক্তের বন্ধন ছিন্ন করে মানুষ শুধু টাকার পেছনে ছুটছে। টাকা রোজগারের প্রতিযোগিতা করছে; বৈধ হোক আর অবৈধভাবে হোক। টাকা আয়ের প্রতিযোগিতায় নামতে যেয়ে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে। বিবেক বর্জিত কাজ করছে। রক্তের বন্ধন ছিন্ন করছে। তাই মানবতা আজ বিবর্জিত,আদর্শ আজ উপেক্ষিত।
যদিও দেখা যাচ্ছে সৎ মানুষের আকাল, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এদেশে সত্য মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে চিরকাল। সত্য মানুষের কাফেলা নিয়ে এদেশে আগমন ঘটেছে বহু সূফী-সাধক-অলি-আওলিয়ার। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে শাটুরিয়া পর্যন্ত তারা সত্যের বাণী প্রচার করেছেন এবং করে চলেছেন। সত্যিকার অর্থে শান্তির বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে চলেছেন। শান্তির সুমহান আদর্শ প্রচার করছেন। বাংলার অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষকে আদর্শ চরিত্র ধারণ করে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্যে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন।
সততার কোন বিকল্প নেই। সততাকে সামনে রেখে একজন ব্যক্তি সামনে এগিয়ে চলে। একটি দেশ, জাতি উন্নতির শিখরে অবস্থান করে। আর এখন! পূঁজিবাদি এই সমাজ ব্যবস্থায় সততা এখন একটি আপেক্ষিক শব্দ। এ প্রসঙ্গে আমার মরহুম পিতার কথা মনে পড়ে। তিনি একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। দার্শনিক পর্যায়ের অতি সাঁধাসিঁধে একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। অবসরে পরিবারের সকলকে নিয়ে বসতেন। প্রসঙ্গত অভিজ্ঞতার আলোকে খোলামেলা আদর্শভিত্তিক অনেক কথা বলতেন। জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রায়ই বলতেন সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। পিতার সেই আদর্শিক চেতনার সাথে আজকের সামাজিক বাস্তবতার কতটুকু মিল আছে? কালো টাকা রোজগারে অনেকে আজ অবৈধ প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কত দ্রুত কালো টাকার মালিক হতে পারে, শিল্পপতি হতে পারে, আলীশান বাড়ি তৈরি করতে পারে, গাড়ি কিনতে পারে সেই সব অসম প্রতিযোগিতার অবিরাম সংগ্রাম করছে। আর এ সব কালো টাকা রোজগার করতে যেয়ে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে শ্রেণি বৈষম্য। ধনী-গরিবের মধ্যে অসম পার্থক্য। সৃষ্টি হচ্ছে গোটা নাগরিক সমাজে মধ্যে অবক্ষয়। আর এই অবক্ষয়ের প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজকে বাঁচাতে সত্য মানুষ হবার কোন বিকল্প নেই।
অসৎদের কদর বেশি কথাটি সত্য নয়। কদর হয় তবে তা সাময়িক ও স্বার্থের লোভে। দুর্নীতি আজ কোথায় না নেই? দেশের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি হচ্ছে। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই দুর্নীতি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সৎ-অসৎ সব মানুষকে এক পাল্লায় মাপা হচ্ছে। সবাইকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে ভাবা হচ্ছে। অসৎ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এমন একটি পঁচনশীল সমাজ ব্যবস্থার মৃত্যু উপত্যকায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি যে, এখানে যে যত অবৈধ কর্মের সাথে জড়িত সমাজে তার কদর যেন তত বেশি। কালো টাকার প্রভাব পড়ছে সর্বত্রই। রাজনীতির নামে পদ-পদবি ব্যবহার করে, চোরাকারবারি করে, ঠিকাদারির নামে অর্থ ফাঁকি দিয়ে, মানব পাচার করে, হিরোইনের ব্যবস্য করে,সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে, সোনা চোরাকারবারির সাথে জড়িত থেকে অনেকে আজ বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন। সমাজের সুধি সেজেছেন। ডবল ভিআইপি সেজেছেন। হালে টাকা হয়েছে। নির্বাচনের একটু খায়েশ জেগেছে। হাটে-মাঠে নেতা-নেত্রীর ছবির সাথে নিজের ছবি দিয়ে ডিজিটাল প্যানা সেটেছে। অহরহ অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। ডিজিটাল প্যানার জোরে সাত খুন মাফ হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন উল্টো অপরাধিকে সালাম দিচ্ছে। ডিজিটাল নেতা এমপি হবার স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে সুখী সুখী মনে করছে। ভোট মৌসুমে হেলিকপ্টার করে কথিত ডিজিটাল নেতা এলাকায় আসছেন। চাটুকাররা নেতাকে ঘিরে ধরছেন। উদ্দেশ্য কিছু নগদ নারায়নের আশা। নেতা দু’হাত দিয়ে দান-দাক্ষিণ্য দিচ্ছেন। লাজ-লজ্জা বিকিয়ে দিয়ে আমজনতা নির্বিধায় কিছু এনাম গ্রহণ করছেন। অনেকে আবার বলে উঠছেন ‘আলহামদুল্লিাহ’। আবার অনেকে নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন ‘আল্লাহ আপনাকে বাঁচাইয়া রাহুক’।
তাহলে সবাই কী দুর্নীতিবাজ? এদেশে সৎ মানুষের কী কোন বালাই নেই? হ্যাঁ আছে। সৎ মানুষের সংখ্যা সব থেকে বেশি। তবে তারা  রণে ভঙ্গ দিয়েছেন বলে মনে হয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্লান্ত। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা অপাংক্তেয়। আর এই সব সৎ মানুষের পাল্লাভারি বিধায় এখনও রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা মোটামুটি চলছে। সমগ্র পৃথিবী টিকে আছে। যেদিন সর্বশেষ একজন ভাল মানুষও পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, গোটা পৃথিবী সে দিন ধ্বংস হয়ে যাবে। টাকায় সব কিছু হয় না।এ কথা সত্য যে, অসৎরা দ্রুত বেড়ে উঠে। আবার রাবনের পুরির মত ধ্বংস হয়। সৎ মানুষেরা মরেও জীবিত থাকে। সমাজের কাছে যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে টিকে থাকে।
সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। সত্যের জয় চিরস্থায়ী। মিথ্যা তুসের আগুনের মত জ্বলে-পুড়ে সব ছারখার হয়ে যায়। সততার বিকল্প কিছুই নেই। সততা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সততা অমৃত। সততা এমনই একটা জিনিস একজন মানুষ মরণের পরেও বেঁচে থাকে। সততাকে সামনে নিয়ে দুর্বার গতিতে আগামির প্রত্যাশায় এগিয়ে চলি। গড়ে তুলি সৎ আদর্শভিত্তিক এক নির্মল বাংলাদেশ। তাই আসুন উচ্চকিত কন্ঠে আবারও ঘোষণা করি সত্য মানুষ হউন, দেশ ও জাতির কল্যাণ হবেই হবে। 

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

কর্মই ধর্মের শ্রেষ্ঠ পরিচিতি

কর্মই ধর্মের শ্রেষ্ঠ পরিচিতি

  • ·      অবশ্যই যারা ধর্ম সন্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো কাজের দায়িত্ব তোমার নেই, তাদের বিষয় আল্লাহ্ এখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সন্বন্ধে তাদের জানাবেন’। (আল কুরআন-৬:১৫৯)।
  • ·        ‘তুমি কি দেখেছ তাকে যে কর্মফল অস্বীকার করে? সে-তো সে-ই যে পিতৃহীনকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয় আর অভাবীকে অন্নদানে উৎসাহ দেয় না’। (আল কুরআন-১০৭: ১-৩)।
  • ·        ‘আল্লাহ্ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মানুযায়ী ফল পেতে পারে, তাদের ওপর অত্যাচার করা হবে না’। (আল কুরআন-৪৫:২২)।
  • ·        ‘প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী’। (আল কুরআন - ৫২:২১)।

শেখউল্লাস ॥ ইসলামের (শান্তির) নবী মুহাম্মদ (সা.)-এঁর উপর আরব দেশে কুরআন নাযিল হয়েছিল চৌদ্দ শ’ পঞ্চাশ বছর আগে। এখন আমরা বাস করছি বাংলাদেশে। কিন্তু কুরআনের নির্দেশনাবলী বাংলাদেশের মানুষ তথা মানবজাতির শান্তি ও মঙ্গলের জন্য আজও সমানভাবেই প্রযোজ্য। মুহাম্মদ (সা.)-এর শান্তি ও সত্যের ধর্মকে তখনো যেমনিভাবে বিধর্মীরা মেনে নিতে পারেনি, আজও পারছে না সেই বিধর্মীদেরই অনুসারীরা যারা মানবতার শত্রু, ধর্মের শত্রু। এই শত্রুরা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী, এরা আজও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে, পার্থিব ভোগ-বিলাসের জন্য সম্পদের পাহাড় সৃষ্টি করে মানুষে-মানুষে বৈষম্য তৈরি করে চলেছে। কিন্তু কর্মই বাংলার সাধারণ মানুষের ধর্ম, এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়-হাজারো বছরের ইতিহাসের  বিভিন্ন পথ-পরিক্রমায় তারা এই পরিচয় দিয়েছে। বিশ্বে বাঙালিদের একমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুকঠিন সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এদেশের মানুষ তাদের কর্ম ও ধর্মের প্রমাণ রেখেছে। ১৯৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ ও ’৭১-এ এদেশের মানুষ শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, রক্ত দিতে কখনো দ্বিধা করেনি। তাই দেখা যায়, সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে বাংলার মানুষ কখনো ভুল করেনি। এভাবে তারা প্রমাণ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, সত্য ও ন্যায়ের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেয়া-এ সবকিছুই তাঁদের কর্ম ও ধর্মেরই অংশবিশেষ। যারা এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছে, মানুষে-মানুষে হানাহানি সৃষ্টি করেছে, অন্যায় করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করেছে, মানবতা ও মনুষত্বের বিরুদ্ধে কাজ করেছে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে এদের কোনো ধর্ম নেই। আবহমান কাল থেকে এদেশের প্রচলিত মূল্যবোধটাই এরকম। অথচ যুগে যুগে এক শ্রেণীর মানুষ লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতাসহ পার্থিব নানা মোহে আচ্ছন্ন হয়ে হত্যা-ব্যভিচারসহ নানা অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতন করে সমাজে অশান্তি ও বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, মনুষ্যত্ব ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিয়েছে। মানুষের ধর্ম যে মানবতা ও মনুষ্যত্ব তাকে তারা অপমান করেছে। সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর একটি বাণী এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য-‘মানুষ যদি হতে চাও, মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করো’।          
এদেশের প্রবাদে ও উপদেশবাণীতে বলা হয়েছে, ‘হও কর্মেতে বীর, আর ধর্মেতে ধীর’। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সাধারণ মুসলমান। আর এ মুসলমান সম্প্রদায় এদেশে হাজার বছর ধরে শান্তি (ইসলাম) ধর্মের অনুসরণ করে আসছে। এখানকার মুসলমানদেরকে নতুন করে ধর্ম শেখাতে চায়-এরা কারা? ‘অলি-আল্লাহ্ বাংলাদেশ, শহীদ-গাজীর বাংলাদেশ, তাঁদের ওয়াস্তে, তাঁদের ওয়াস্তে রহম করো আল্লাহ, রহম করো আল্লাহ’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা,  তোমাদের এ ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না’ ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না’, অথবা ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার’-এ জাতীয় কত শত গান ও কবিতার মধ্যে বিধৃত রয়েছে বাংলাদেশের পরিচয়, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের তথা বাঙালিদের আবেগ-অনুভূতি ও উপলব্ধি। স্বাধীনতার ফসল হিসেবে এদেশের সাধারণ মানুষের এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি ঘটেছে। গ্রাম ও শহরের মধ্যেকার ব্যবধান অনেক ক্ষেত্রেই ঘুচে যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, এই অর্থনৈতিক উন্নতি, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ সুযোগ-সুবিধা মানুষের চিন্তা-চেতনাকে কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই প্রশ্ন। বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নামে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী কর্মকা-, নিরীহ মানুষ হত্যা ও  বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে প্রকৃত ধার্মিক মানুষেরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছে না। মানুষকে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়ে সমাজে অশান্তি ও অস্বস্তি তৈরি করা যাদের কর্ম ও ধর্ম তারা কখনো সফলতা অর্জন করতে পারে না, তাদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বহুবার কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। বস্তুত মানুষের কর্ম ও ধর্ম পরষ্পর হাত ধরাধরি করে চলে। কর্ম ভালো না হলে তার ধর্মও কখনো ভালো হতে পারে না। আদম (আ.)-এর পর থেকে যত নবী-রাসুল-অলি-আউলিয়া-সূফী সাধক-দরবেশ এই পৃথিবীতে এসেছেন, মানুষকে শান্তি ও সত্যের পথে আহবান জানিয়েছেন, তাঁরা সবাই নিজ নিজ কর্ম যথাযথভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষদেরকে সে পথ দেখিয়ে গেছেন। এজন্য তারা জীবনে স্বীকার করেছেন অপরিসীম কষ্ট, ত্যাগ করেছেন পার্থিব ভোগ-বিলাস। কর্ম সম্পাদনের মধ্য দিয়ে তাঁরা জীবনে ধীরতা ও  স্থিরতা অর্জন করেছিলেন। মানবজাতির শান্তি, মঙ্গল ও কল্যাণের পথে তাঁরা আজও রেখে গেছেন নিদর্শন। তাঁদের প্রদর্শিত সরল পথই শান্তি ও সত্যের পথ। অপরদিকে, যারা অশান্ত, পথভ্রষ্ট, যারা বিপথগামী ও অভিশপ্ত তাদের থেকে দূরে থাকার প্রার্থনাই সারাক্ষণ করে থাকে সাধারণ মুসলমানরা।

বর্তমানে ধর্মের নামে যে উগ্রতা, সহিংসতামূলক কর্মকা- বাংলাদেশ তথা বিশ্বের অনেক দেশে বিরাজ করছে, তার পেছনে মদদ দিচ্ছে ইসলাম (শান্তি) ধর্মের শত্রুরা। এই শত্রুরা দেশে-বিদেশে সর্বত্রই তৎপর রয়েছে। এরা এজিদী ইসলামের ধারক ও বাহক। তাদের চক্রান্ত থেকে বাঙালি মুসলমানদের ধর্মকে রক্ষার জন্য সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসার এখনই সময়। 

সময়ের সাফ কথা.... রুগ্ন রাজনীতির কবলে জাতি!

সময়ের সাফ কথা....

রুগ্ন রাজনীতির কবলে জাতি!

নজরুল ইশতিয়াক ॥ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনীতির একটি রুগ্ন অবস্থা বর্তমানে জনগণকে দেখতে হচ্ছে। রাজনীতির নামে যা ইচ্ছা তাই দেখতে দেখতে জনগণের পীঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। রুগ্ন রাজনীতির ভয়ানক অবস্থা সামনে উঠে এসেছে। এটিই হবার কথা। যেমন কর্ম তেমন ফল। সন্ত্রাসী তৈরির প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রযাত্রা রুখতে আদর্শিক ও প্রগতিশীল রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে ও হচ্ছে। দেশি বিদেশি নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশপ্রেমিক জনগণের জাগরণতো দূরের কথা রাজনৈতিক দলগুলো কর্মী তৈরিতেও চরম অদক্ষতা আর অযোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকারও আদর্শ ভিত্তিক জাগরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি। জান-মালের নিরাপত্তা সংকটময় অবস্থায়। গতানুগতিক গুজব ও কাল্পনিক রাজনীতির উত্থান ঘটছে। পাল্টে যাচ্ছে উন্নয়নের সংজ্ঞা, পাল্টে যাচ্ছে সন্ত্রাস ও জঙ্গী রাজনীতির ধারণা। কোন্ মন্ত্রী, কোন্ নেতা ও কোন্ রাজনীতিক কখন কি বলেন তা অনুধাবন করাও দুষ্কর হয়ে পড়ছে। কি করতে হবে, কিভাবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে তার কোন সঠিক দিক্ নির্দেশনা ও রূপরেখা নেই জাতির সামনে।
প্রস্তুতি ও অনুশীলন ছাড়াই খেলার মাঠে গোল দেয়া যাবে এমন একটি ধারণা নিয়ে বসে আছেন সরকারী দলের নেতাকর্মীরা। মাঝেমাঝে কিছু অন্তঃসারশূন্য হাকডাক শোনা যাচ্ছে আবার তা হারিয়ে যাচ্ছে প্রবাহমান বাতাসে। গোলকধাঁধায় পড়ছে জাতি।
দেশে কোন জঙ্গি নেই, কোন জঙ্গিবাদও নেই (সত্য)। সরকারের এমন প্রচারনার সুর পাল্টে গেছে দু’টি ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর। সংঘটিত দু’টি ঘটনার পরক্ষণেই প্রকারান্তরে জঙ্গি আছে কিংবা জঙ্গিবাদ কায়েমের চেষ্টা চলছে এটির সরকারী স্বীকারোক্তি আদায়ে সামর্থ্য হলো এতদিন যারা বলেছিলেন জঙ্গি আছে জঙ্গিবাদ চলছে। বোঝা যায় সরকার বাস্তবতাকে চিহ্নিত করেনি। জঙ্গি কি এবং কাকে জঙ্গিবাদ বলা যাবে সেটি তাদের জানা নেই এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাস জগাখিঁচুড়ি করে ফেলেছে। একই সাথে দেখা গেল সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রস্তুতির ঘাটতি। প্রশ্ন উঠতে পারে কি কারণে সরকার স্বীকার করলেন জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ চলছে! পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় দেশে একটি রাজনৈতিক সন্ত্রাস চলছে। মাঝে মধ্যেই দেশ পরিচালনায় সুষ্পষ্ট দিক্ নির্দেশনার অভাব দেখা যাচ্ছে। দারুন ধোঁয়াশা আর অন্ধকার জেঁকে বসছে। মনে হতে পারে পথ হারিয়ে ফেলেছে রাজনীতি। সরকারের তথ্য বিশ্লেষণ, অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণ গতানুগতিক এবং সব অঙ্গগুলো প্রয়োজন মাফিক কার্যকর নয়। যাদেরকে যে দায়িত্বে রাখা হয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে অনীহা চলছে। পুলিশি ব্যবস্থা সন্ত্রাসী আঘাত মোকাবেলায় যুগোপযোগী পারদর্শী নয়।
গতির পার্থক্য, দেখার দূরত্ব, বাস্তবতা নিরূপণের অযোগ্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে। আরো স্পষ্টভাবে বললে পরিস্থিতি মোকাবেলার উপযোগী দক্ষ পুলিশি ব্যবস্থাপনার অভাব। কোন সংকটকে চিহ্নিত করার মধ্যেই তার সমাধান নিহিত থাকে, সামর্থ প্রস্তুতি পদক্ষেপ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হয়। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ একটি ভুল শব্দ। এটির অন্তর্নিহিত সত্য উদঘাটন করলে দেখা যায় বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদের নামে যা সংঘটিত হচ্ছে তার নেপথ্যে বাণিজ্যে দখলদারিত্ব ও আধিপত্যবাদ জড়িত।
অন্ধ উগ্র বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে ধর্মের নামে বিভাজিত করে লড়াইয়ে অবতীর্ন রাখা প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এমন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করা যাতে করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অস্ত্র ব্যবসা এবং লুটপাটের মহাযজ্ঞ চালানো যায়। যতদিন এটি সম্ভব হবে ততদিন জিইয়ে রাখা। যা কিছু দেখছি ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া কোনটাই ধর্মীয় শাস্ত্রের মধ্যে পড়ে না। কৌশল-অপকৌশলের খেলায় ধরাশায়ী হয়েছে সে সব দেশগুলো। জাতীয়তাবোধের রাজনীতি তথা দেশপ্রেমিক শক্তির উত্থান না হওয়াই সংকটের কারণ। চলমান এসব খেলা বর্তমান সভ্যতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পর্যবেক্ষণে সভ্যতার এই সংকটকে চিহ্নিত করা যায় যা বিশ্ববাস্তবতায় ক্ষত। আধিপত্যবাদের এই খেলা সব সময় চলছে। যেখানে ধর্ম ও দারিদ্রতা কেবলই খেলার হাতিয়ার।
অনুসন্ধানে দেখা যায় দেশের সামনের অগ্রগতি ও হুমকির বিষয়ে মাঝে মধ্যে আলোচনা হলেও সে সব নিয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সরকারে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয় ধর্ম, সংস্কৃতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাংলার মাটি-পানি-বাতাস-মানুষ পর্যালোচনা করে সময়োপযোগী কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেনি।
ফলে উদ্ভূত সংকট ভয়াবহ রূপে সামনে এসে পড়েছে। বিশেষ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে উপেক্ষা করার পরিণতি সরকার হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে। সীমাহীন স্থবিরতা চলছে ধর্মমন্ত্রণালয়ে। এই মন্ত্রণালয়ের কোন প্রতিষ্ঠান ঠিকমত কাজ করছে না। ফলে বুমেরাং হয়ে প্রত্যাঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে গোটা দেশ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় লোক দেখানো কাজের কাজী আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির আখড়া। কোন অর্জন নেই এই মন্ত্রণালয়ের বরং অদূরদর্শীতার ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। কোন নজরদারি নেই, কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কেবলই গলাবাজি সেখানে। উল্লেখিত মন্ত্রণালয়-গুলোর ওয়েব সাইট কোন সময় আপডেট থাকে না। তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোন সমন্বয় নেই। জবাবদিহিতা নেই। 
ধর্মের নামে সব সন্ত্রাসীতৎপরতার মূলে ষড়যন্ত্র রয়েছে। যাকে যখন যে কায়দায়, যে দক্ষিণায়, যে ফাঁদে - লোভে ফেলে লুটপাট করা যায় সে প্রচেষ্টাই শুধু চলে। সেক্ষেত্রে পরিকল্পনাকারীরা এখন পর্যন্ত দারুন সফল, কেননা ইসলামের নামে সন্ত্রাস কায়েমে তারা বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্ট সন্ত্রাসের মূল উদ্দেশ্য সেখানে সৌদী আরব ও আমেরিকার আধিপত্য বজায় রাখা ও বিস্তার করা। বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সম্পূর্ণ পরিকল্পিত  খেলা চলছে সেখানে। সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ষ্পষ্টতই দু’টি বৃহৎ বিভাজন জিইয়ে রাখবে। যা আরো আগে ঘটলে বিশ্বে সন্ত্রাসের জোয়ার দেখা দিতো না। মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু থেকেই রয়েছে। সন্ত্রাসীদের হাতে অর্থ, অস্ত্র, ভূমি, জল-জলাধার, পতাকা, লক্ষ্য, যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ ও শাসন কাঠামো রয়েছে। সেখানে তারা একটি নাজুক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে তাই এটাকে জঙ্গিবাদ (যুদ্ধবাদ) বলা যেতে পারে।কিন্তু আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা জঙ্গিবাদ নয়। এটির পিছনে রাজনীতির ষড়যন্ত্র, বিচার প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়া এবং সরকারকে বাধ্য করার প্রচেষ্টা জড়িত।
গুলশান কিংবা শোলাকিয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কার্যক্রম। মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ এবং রুগ্ন রাজনীতির ষড়যন্ত্র এ হামলার কারণ। পরিকল্পিত সন্ত্রাস সৃষ্টির অবারিত সুযোগ রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে কতটুকু করতে পারবে, কারা ক্রীড়নক হবে, এটি চিহ্নিত করাটাই জরুরী। দৃষ্টান্ত স্থাপনের রাজনীতি, দেশপ্রেমের অভিন্ন আদর্শিক পথ, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি ও শিক্ষার আড়ালে নানামুখি যে বিভাজন বৈষম্য সৃষ্টি করেছে সে সব বিভাজনের ফাঁক দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি একটি সহজ কাজে পরিণত হয়েছে। এটি রাজনীতিকদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। গুলশানে সন্ত্রাসীরা চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়েছে। তারা কিভাবে কোন গাড়িতে সেখানে প্রবেশ করেছে, চেকপোষ্টে কেন তল্লাসীতে এসব ভারি অস্ত্র বোমা ধরা পড়লো না এটি নিরূপণ বেশি জরুরি। আবার তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য কি ছিল, কতটুক ছিল, কাদেরকে হত্যা করে, কখন কিভাবে বের হয়ে যাবে সেসব জানার মধ্য দিয়ে  হামলার স্বরূপ নির্ণয় হতে পারে। এসব নানা দিক  চিহ্নিত করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হওয়ায় গুলশান হত্যাকাণ্ড জনমনে আতংক সৃষ্টি করেছে। এটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়। ভিন্নধর্মী বিদেশী বন্ধু ও নারীদেরকে নির্মমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার বিভৎসতা প্রমাণ করে হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা ও উদ্দেশ্য। যা গুমোট একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সহায়ক।
অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায় পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটানোর মাধ্যমে সরকার উৎখাতের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। সরকারের দুর্বলতার সুযোগে সহজেই একটি রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় সন্ত্রাসীদেরকে দিয়ে এসব করছে। তাদের আশু লক্ষ্য আইন শৃংখলার চরম অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। সরকার অস্থির হলে সৃষ্ট সংকট সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপে অংশগ্রহণ করা যাবে। সেখানে কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা সম্ভব হবে।
নিশ্চিতভাবে দু’টি ঘটনা প্রমাণ করে সরকারের যথাযথ প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। পরিস্থিতি মূল্যায়ণ তথা বাস্তবতা অনুধাবনেও সীমাহীন অদূরদর্শীতার চিত্র ফুটে উঠেছে। একই সাথে পুলিশ-প্রশাসনের প্রশিক্ষণ, কাজে গতি বাড়ানোয় সরকারযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা সামনে এসেছে। সরকার বাস্তবতা অনুধাবনে দূরদর্শীতার প্রমাণ দিতে পারেনি। তারা অনুধাবন করেনি ষড়যন্ত্রের ডালপালা কতটুকু বিস্তৃত এবং তা মোকাবেলায় জনগণকে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বৈদ্যুতিন মাধ্যম যেন বল্গাহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে, পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করছে যা গণমাধ্যম সংস্কৃতির রুগ্ন ও ক্ষত দিকটা জনগণ দেখেছে। 

দেশে জাগরণ সৃষ্টিতে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে এবং সেগুলোর সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা কতটুকু সেটিই এখন দেখার বিষয়। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে ক্ষমতা দখলের খেলায় একটি সরকার কিংবা একটি দল ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। দেশপ্রেমিক জনগণ দেশের জন্য যা করা দরকার তাই করে। সরকারের সফলতা নির্ভর করছে উদ্ভুত ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণকে কতটুকু সম্পৃক্ত করতে পারছে তার উপর। 

প্রজন্মের শিক্ষা ভাবনা

প্রজন্মের শিক্ষা ভাবনা

সুহৃদ মান্নাফি ॥ মানব প্রজাতি এগিয়েছে বহুদূর। বিজ্ঞানের নানামূখী আবিষ্কার মানবপ্রজাতিকে উন্নতির চূঁড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে বলে চারিদিকে রব উঠেছে। বিশেষ করে কম্পিউটার ও মোবাইল প্রযুক্তি মানব প্রজাতিকে উন্নতির এক বিস্ময়কর অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। চারিদিকে উন্নতির ছোঁয়া। স্বপ্ন ছোঁয়ার আনন্দে বিভোর। কিন্তু সে উন্নতি আর আনন্দের চিত্রটিকে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই আমরা তার অন্তসারশুণ্য অবস্থার চিত্রটি দেখতে পাবো। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমাদের এই সোনার বাংলার রুক্ষ ও প্রাণহীন দশা সহজেই ধরা পড়ে। প্রযুক্তির কল্যানে শিক্ষা ব্যবস্থা বহুদূর এগুলেও আমরা বিশেষ করে বাঙালির নতুন প্রজন্ম যে দিশাহীন তা স্পষ্ট। যে প্রজন্ম গত হয়েছে তাদের কথা টেনে এনে লাভ নেই। যে প্রজন্ম আজও দেশ-দেশের মানুষকে গড়ার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে পড়ন্ত বেলার দিকে হেলে পড়েছেন তাদের কথা একটু ধরা যাক। আর যে প্রজন্ম পরিপূর্ণভাবে এই বাংলার সমাজ, বাংলার বাঙালিকে গড়ার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের কথা পূর্ণভাবে ধরতে হবে, কারন বর্তমান প্রজন্মের এই দিশাহীন অবস্থার পেছনে তাদের ব্যর্থতা রয়েছে। আর যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এই দেশ ও এই দেশের মানুষকে গড়বে বলে তাদের নিয়েই হওয়া উচিত আমাদের বিশেষ চিন্তা-ভাবনা।
বর্তমান প্রজন্ম যারা ভবিষ্যতে আমাদের হাল ধরবে তাদের জন্য আমাদের সত্যিই কী কোন পরিকল্পনা রয়েছে? কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা তাদের? নতুন প্রজন্মের জন্য আমাদের ভাবনা কী সঠিক আছে? ভাবনা যদি থাকে তবে তা কতটা বর্তমান সময় উপযোগী? ভাবনা যদি থাকে তবে তা কতটা বাস্তব সম্মত? ভাবনা যদি থাকে তবে  তা কতটা মানবিক-মানবিকতা ও মানবতা সংশ্লিষ্ট ? এই ভাবনা থেকে আমরা আমাদের বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর সু-পরিকল্পিত ও বর্তমান সময় উপযোগী শিক্ষা প্রদান করতে পারছি কী? যদি না পারি তবে দিশাহীন এই প্রজন্ম কোন দিকে নিয়ে যাবে তাদেরকে, এই সোনার বাঙলাকে? আমরা যদি এখনই সজাগ ও সচেতন না হই তবে তার পরিনতি কী হবে? এককথায়, যে মহান উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এই বাঙালি জাতির উত্থান তা ব্যর্থ হবে।

বাঙালির নতুন প্রজন্ম যে ইতোমধ্যেই দিশা হারিয়েছে তা বিগত কয়েকদিনের ঘটনা প্রবাহ দেখলে সহজেই ধরা পড়ে। কি ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক শিক্ষার ফাঁদে পা দিয়েছে এই প্রজন্ম তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষ করে বিকৃত ধর্মীয় শিক্ষা যে নতুন প্রজন্মের মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে তা এদেশের শুধু নয়, সারাবিশ্বের নিকট এখন স্পষ্ট। সারাবিশ্ব নিয়ে আমাদের ভাবনা আপাতত থাক। নিজ দেশের আপন প্রজন্মের ভাবনা যে এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিগত ২/৩ বছর ধরে এদেশে ধর্মের নামে যে চরম উগ্রতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ছবি মানুষ দেখেছে বিশেষ করে কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। বিশেষ করে বিকৃত ধর্মীয় শিক্ষা যেন এই প্রজন্মের আর কাউকে বিপথে ঠেলে দিতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। পরিবারের বাবা-মা-গুরুজন থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দিরসহ ধর্মীয় শিক্ষার যত প্রকার স্থান রয়েছে সে সকল স্থানে শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত সকল মহলকে সচেতন হতে হবে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষায় কি পড়ানো হচ্ছে, কে পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করছে, আদৌ পাঠ্যসূচীতে সন্নিবেশিত বিষয়াবলী প্রকৃত ধর্মীয় বিষয়ভুক্ত- না কি বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক মনগড়া বিষয় সন্নিবেশ করা হয়েছে - সে সব প্রত্যেকটি বিষয়ে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ধর্মমন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একই ধর্মে বহুমত ও পথের ধর্ম শিক্ষা রোধ করতে না পারলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবার সম্ভাবনা শতভাগ এবং এর ফলাফল কি হতে পারে তা বোধ করি কাউকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশনার ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোন প্রকার নিয়ম নীতি রয়েছে বলে মনে হয় না। যে যার মতো করে ইসলামের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ইসলাম ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশ করছে। মনগড়া, যুক্তিহীন, সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করে তথাকথিক ধর্মজীবিরা ধর্মের বারোটা বাজিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছে। পাশাপাশি শান্তির ধর্মের অশান্ত রূপ দেখে আবারো জাহেলিয়াত যুগে প্রবেশ করছি বলে মনে হচ্ছে। এ দেশ, এ মানব সমাজ বিশেষ করে বাঙালির সোনার বাংলাকে উগ্র ধর্মীয় ও সন্ত্রাসী শিক্ষার হাত থেকে এবং আমাদের এই প্রজন্মকে বাঁচাতে সর্বমহলের সম্মিলিত প্রয়াস একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের জন্য সময় উপযোগী শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলে আমাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে যার একটু নমুনা আমরা দেখতে পেলাম। 

এ আবার কোন শান্তি (ইসলাম)!!!!

এ আবার কোন শান্তি (ইসলাম)!!!!

ড. আলাউদ্দিন আলন ॥ কোন একটি শব্দ যখন একটি জাতির ভাষায় যুক্ত হয় তখন নিঃসন্দেহে সে শব্দটির একটি গভীর তাৎপর্যময় অর্থ থাকে। সে অর্থের ব্যাপকতা থাকে। আর থাকে নান্দনিক সৌন্দর্য। শব্দটির আভিধানিক অর্থ, পারিভাষিক অর্থ, ব্যবহারিক অর্থসহ যত ধরনের অর্থ থাকে সে সকল অর্থ সমষ্টির গভীরে প্রবেশ করে অর্থটিকে জেনে ও বুঝে নিতে হয়। বিশেষ করে কোন একটি বিদেশী শব্দ যখন কোন জাতির ভাষায় স্থান করে নেয় তখন সে শব্দটির সার্বিক অর্থ, অর্থের গভীরতা ও ব্যাপকতা ও সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা থাকা একান্ত প্রয়োজন। নয়তো সে শব্দের প্রয়োগিক দিকটি অর্থহীন ও ঠুনকো হয়ে পড়ে। বাংলা ভাষাসহ সারাবিশ্বের সকল ভাষায় ‘ইসলাম’ শব্দটি আরবী ভাষা হতে সরাসরি ব্যবহার হচ্ছে। মূলত একটি ধর্মকে বুঝাতে এ শব্দের বিশ্বময় বহুল ব্যবহার। প্রায় ১৪৫০ বছর পূর্বে নবী মুহাম্মদ (সা.) এঁর নিকট অবতীর্ণ আল কুরআনে আরবী ইসলাম শব্দটির যাত্রা যা একটি ধর্ম হিসেবে মানবজাতির জন্য মহান প্রভুর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। সারাবিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ ‘ইসলাম’ শব্দটিকে ‘ইসলাম’ হিসেবেই গ্রহণ করেছে। কেউই এ শব্দটিকে নিজেদের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে নিজ ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেনি।
বিশেষ করে বাঙালির ভাষা বাংলায়-আরবী ‘ইসলাম’ শব্দ ‘ইসলাম ধর্ম’ নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর বাঙালি জাতি তাদের মহান নবী মোহাম্মদ (সা.) কে স্বীকৃতি, তাঁর প্রচারিত ধর্মের স্বীকৃতি - সর্বোপরি আল কুরআনে আল্লাহ্র নির্দেশ ‘ইসলাম ধর্ম’ কে নিজেদের ধর্ম হিসেবে প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মেনে নিয়েছে। ৯০ ভাগ বাঙালি যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আজ আরেকটি আরবী শব্দ মুসলিম কিংবা মুসলমান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তারাও কখনো নিজ ভাষায় তথা বাংলা ভাষায় এ শব্দ দুটির অনুবাদ করে নিজেদের প্রকাশ ও প্রচার করেন না। ফলে ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলিম’ শব্দের আবির্ভাবের শুরু থেকে আরবীয়রা যেমন হানাহানি ও রক্তপাত থেকে নিজেদের নিভৃত করতে পারেনি, তেমনি বাঙালি জাতি ১২০০ বছর ধরে ইসলাম ও মুসলিম শব্দ ব্যবহার করতে করতে আজ জাহেলিয়ার যুগের ধ্বংসাত্মক হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। আর এর পেছনে একটি অন্যতম কারণ বাংলা ভাষায় ইসলাম ও মুসলিম শব্দের অনুবাদ অর্থের ব্যবহার না থাকা এবং এ ধর্মের প্রকৃত সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়া।
আমরা সবাই জানি আরবী ‘ইসলাম’ শব্দের বাংলা ভাষায় সহজ অর্থ হচ্ছে ‘শান্তি’। আরবী ‘দ্বীন’ শব্দের অর্থ সংস্কৃতিতে ধর্ম আর বাংলা ভাষায় ধর্ম শব্দের সহজ অর্থ ‘ধারণ করা চরিত্র’। আর যিনি ‘দ্বীন ইসলাম’ অর্থাৎ শান্তির ধর্ম বা শান্তির চরিত্র ধারণ করেছেন আরবী ভাষায় তার পরিচয় ‘মুসলিম’ যার বাংলা ভাষায় পরিচিতি ‘শান্তির চরিত্র ধারণকারী’ হিসেবে। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজে শান্তির চরিত্র ধারণ করেছেন তিনিই মুসলিম এবং তার ধর্মের নাম ইসলাম (শান্তি)। আরবী ভাষায় ইসলাম শব্দ বাঙালির চিন্তায় যতটা প্রভাব ফেলেছে তার চেয়ে হাজার লক্ষগুণ বেশি প্রভাব ফেলতে পারতো ‘শান্তি’ শব্দটি। কারণ কোন বাংলা ভাষা-ভাষীকে ‘শান্তি’ কি তা বুঝিয়ে বলার কোন প্রয়োজন পড়ে না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছেলে-বুড়ো সব বাঙালিই বুঝেন শান্তি কি জিনিস। আর এই শান্তির চরিত্র বাঙালি ১২০০ বছরে ধরে লালন-পালন করে আসছে যা তারা শান্তির দূত মুহাম্মদ (সা.) এঁর রেখে যাওয়া ‘মুহাম্মদী ইসলাম’ থেকে পেয়েছেন। আরবী ‘মুহাম্মদী ইসলাম’ শব্দটিরও বাংলা ভাষায় অর্থ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। আর তা হলেই শান্তির দূত (ইসলামের নবী) এঁর রেখে যাওয়া দ্বীন তথা ধর্ম তথা চরিত্রের প্রকৃত অর্থ বুঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। আরবী ‘মুহাম্মদ’ শব্দের বাংলা ভাষায় অর্থ হচ্ছে ‘প্রশংসিত’। আর আরবী ‘ইসলাম অর্থ ‘শান্তি’। সুতরাং ‘মুহাম্মদী ইসলাম’ এর বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘প্রশংসিত শান্তি’। মুহম্মদী ইসলামের ধারক-বাহক মুসলমানের বাংলা ভাষায় পরিচয় হচ্ছে ‘প্রশংসিত শান্তির চরিত্র ধারণকারী ব্যক্তি’। যে ব্যক্তির কর্ম তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রশংসিত হয় সেই ব্যক্তিই মুসলিম। সুতরাং কে মুসলিম আর কে মুসলিম না তা বোধ করি বাংলা ভাষাভাষীদের আর বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন নেই।
যারা বাংলার মানুষকে মুসলমান বানানোর জন্য সন্ত্রাসী হয়েছেন, সন্ত্রাসী বানাচ্ছেন নিজেদের অধর্ম ও কুধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি - পাঁচ হাজার বছরের বাঙালি জাতি, বাংলার সংস্কৃতি, শেকড় অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে, উপড়িয়ে ফেলবেন - সে চেষ্টা বৃথা; অশান্তি তৈরি করতে পারবেন সাময়িক - তবে সফল হবেন না কখনো। বাঙালি প্রায় ১২০০ বছর ধরে শান্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এঁর রেখে যাওয়া প্রশংসিত শান্তির ধর্ম তথা মুহাম্মদী ইসলাম পালন করছে। এক-দুই-তিন করে আজ এদেশের ৯০ ভাগ মানুষ শান্তির চরিত্র ধারণ করে মুসলমান নাম ধারণ করে তাদের মানবজীবন অতিক্রম করে চলেছে।
আপনারা নতুন করে কোন শান্তি (ইসলাম) এ জনপদে প্রতিষ্ঠা করার জন্য গোপনে-প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী হয়ে নিরীহ মানবজাতিকে হত্যা করছেন ঘৃণ্য কায়দায় তা আমরা ভালোই বুঝতে পারছি। আপনাদের কোন পথ নির্দেশ এই শান্তিপ্রিয় (ইসলাম প্রিয়) জাতির প্রয়োজন নেই। আপনারা শান্তির দূতের (ইসলামের নবীর) সুমহান শিক্ষাকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ উদ্ধারের আশায় বিকৃত করে আর ব্যবহার করবেন না। বুঝতেই পারছেন আপনারা এ জাতিকে অশান্তির জাহান্নামে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্র ব্যতিত আর কিছুই দিতে পারছেন না। আপনাদের অসৎ ধর্ম, অসৎ কর্ম, অসৎ উদ্দেশ্য এ পবিত্র জমিনে কখনোই সফল হবে না। সাময়িক অশান্তি আর আতংকের সৃষ্টি করে নিজেদের সন্ত্রাসী-শয়তানী মনোভাবকে শুধু প্রকাশ করতে পারবেন। বিনিময়ে শান্তিপ্রিয় জাতি ও তাদের বন্ধুদের রক্তে আপনাদের হাত রাঙিয়ে পুরো জাতির অন্তরের ঘৃণা চিরকালের জন্য আপনাদের প্রাপ্তি হিসেবে সঙ্গী করতে পারবেন। তাছাড়া আর প্রাপ্তির কিছুই থাকবে না। যে কাল্পনিক স্বর্গের প্রত্যাশায় নষ্ট-ভ্রষ্ট জীবন ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছেন তা থেকে নিজেরা ফিরে আসুন, আমাদের সোনার ছেলেদের ফিরিয়ে আনুন, সোনার বাংলা গঠনের জন্য নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা সুন্দর চরিত্রকে কাজে লাগান। তবেই আপনি বাঁচবেন, আপনার পরিবার বাঁচবে, আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঁচবে। বাঁচবে এ সোনার বাংলা, বাঁচবে সোনার বাংলার সোনার মানুষ।
বিকৃত ইসলাম (শান্তি!!!) এর কথা বলে কোন লাভ নেই। এজিদের চরিত্র সবাই জানে। এজিদ ও তার বাহিনী কোন ইসলাম (শান্তি!) প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল তা সবাই জানে। এজিদ আজ ঘৃণিত। এজিদ বাহিনী আজ ঘৃণিত। ইমাম হোসাইন আজ মুসলমানদের হৃদয়ের মনি। ইমাম হাসান আজ মুসলমানদের
চোখের মনি। কারবালায় শাহাদাৎ লাভকারীগণ সারা মুসলিম জাহানের সকলের প্রিয়মুখ। আর এজিদ ও তার দোসররা আজও ঘৃণিত মুসলমান সমাজে। আপনার যারা গোপনে এজিদের রূপধারণ করেছেন, প্রকাশ্যে এজিদ বাহিনীর মতো নিরীহ মানুষের মাথা কাটছেন ইসলামের! (শান্তির) নামে - তারাও তেমনি ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকবেন পরিবারে, আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবের পরিমণ্ডলে, সমাজে, রাষ্ট্রে - সর্বোপরি সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষদের কাছে।
আমরা শান্তিপ্রিয় (ইসলাম প্রিয়) বাঙালি মুসলিম। আমাদেরকে শান্তির ধর্ম শিখিয়েছেন সূফী সাধক অলি-আল্লাহ্গণ। শান্তির চরিত্র কিভাবে অর্জন ও ধারণ করতে হয়, তা আমরা বিগত ১২টি শতাব্দী ধরে শিখে আসছি, এখনও শিখছি। আমাদের নতুন করে ইসলাম তথা শান্তির বাণী এ রকম সন্ত্রাসী কায়দায় শেখানোর প্রয়োজন নেই। আপনাদের যারা মদদদাতা তাদের আমরা ভালো করেই চিনি। আপনারা কোন ফাঁদে, কিসের লোভে পা দিয়েছেন তাও আমরা জানি। সুতরাং আপনাদের প্রতি আহবান রইলো - ফিরে আসুন শান্তির সুশীতল ছায়াতলে। সন্ত্রাস করে, মানুষ হত্যা করে, বোমা মেরে, গলা কেটে, শান্তি তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না। মানুষকে প্রেম আর ভালোবাসা দিয়ে শান্তির পথে তথা ইসলামের পথে টেনে আনতে হয়। আর এটাই করেছিলেন শান্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর চরিত্রগুনে গুনান্বিত সূফি সাধক অলি-আল্লাহ্গণ। সূফি সাধক অলি- আল্লাহ্গণ-এর সাহচর্যে গিয়ে নিজেদের চরিত্র সুন্দর করে সাধারণ মানুষকে শান্তির পথ দেখান, তবেই ইসলাম প্রতিষ্টা পাবে।