বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পূরণে দরকার সার্বিক অঙ্গনে সচেতনতা

মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পূরণে দরকার সার্বিক অঙ্গনে সচেতনতা


শাহ্ ফুয়াদ ॥ জাতি গত শনিবার ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী পালন করলো। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে জন্ম নিয়েছিল একটি নতুন দেশ-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম একাত্তর’ এর প্রশ্ন - ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ এর সঠিক জবাব এখনো কেউ দিতে পারছে না। এর কারণ অবশ্যই জাতিকে খুঁজে বের করতে হবে। ৪৬ বছর একটি জাতির জন্য নিশ্চয়ই কম সময় নয়। 
বিজয় দিবসের দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সোহরায়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও লাখো শহীদের ত্যাগের মহিমায় নিজেদের গড়ে তুলতে তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এক মূহুর্তের জন্যও এটা ভোলা যাবে না, আমরা বিজয়ী জাতি, বীরের জাতি। আমরা মাথা নত করে চলি না। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা’।
এদিকে দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বাংলা একাডেমির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধের আদর্শিক লক্ষ্য পূরণ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমির নজরুল মঞ্চে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল, তা এখন পর্যন্ত পূরণ করা যায়নি। তিনি বলেছেন, ‘একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা যে বিজয় লাভ করেছিলাম, তা শুধু মাটি ও পতাকার জন্য ছিল না। আমাদের যে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল, তা শুধু মাটি ও পতাকার বিজয় ছিল না। আমাদের যে আদর্শিক লক্ষ্য ছিল, তা আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি। আমাদের কর্তব্য হবে, আগামী দিনগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক লক্ষ্যগুলো পূরণ করা। এটা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখি, তা সম্পূর্ণ হবে।  
এর আগে রাজধানীতে ‘৭ই মার্চ মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক বাংলার ঘরে ঘরে, ৭ই মার্চ সম্পদ আজ বিশ্বমানবের তরে’ শ্লোগানে আয়োজিত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি; কিন্তু পরাধীনতা ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হইনি। অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেও মুক্ত হইনি। অসম্পূর্ণ যে কাজগুলো আছে, তা আমাদের পূর্ণ করতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন পূরণ করবে। এটা তোমাদের দায়িত্ব। নতুন প্রজন্মকে দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার শপথ করতে হবে।’   

এবার দেশ ও জাতি আনন্দের সঙ্গে পালন করেছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ৪৬ বছর। রাষ্ট্র, সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালনের ধুমধামের কোন ঘাটতি হচ্ছে না। কিন্তু বিবেকবান সকলের মুখে একটি কথা এখনো ঘুরে-ফিরে আসে তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক লক্ষ্য আজও পূরণ হয়নি। এই ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব এই জাতির সকলকেই নিতে হবে। শুধুমাত্র সরকার বা রাষ্ট্রকে দোষ দিলে হবে না, কারণ, এদেশের প্রতিটি নাগরিকই সরকার ও রাষ্ট্রের অংশ। প্রতিটি নাগরিক সচেতন হলে তাদের সরকারও সচেতন হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে কেবল আদর্শিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই। যে অপার সম্ভাবনার দুয়ার আজ তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর, তারই প্রেক্ষাপটে বিবেকবান জাতি সেই আদর্শিক রাজনীতিই আশা করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের কাছ থেকে। 

দেশ ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতা

সময়ের সাফকথা....
দেশ ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতা

সংলাপ ॥ দেশ ও দশের প্রতি কতোটা দায়বদ্ধ থাকার কথা রাজনীতিকদের, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে কোন স্তরে উন্নীত করা রাজনীতিকদের কর্তব্য। সে প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা, বিতর্ক এবং বিতন্ডা আছে। ইতিবাচক কোনও ফল টের পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে  ‘দায়বদ্ধতা’ বা ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’র মতো শব্দ অধিকাংশ রাজনীতিকদের কাছেই এ যুগে এখন কেতাবি কথা। বাস্তবে ওই ‘কেতাবিআনা’র প্রয়োগকে অপ্রয়োজনীয় বা অসম্ভব বলেই হেসে উড়িয়ে দেন এখনকার সিংহভাগ রাজনীতিক।
দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং সে ব্যর্থতা ঢেকে রাখার নিরন্তর অপপ্রয়াস ইতোমধ্যেই শোরগোল আরম্ভ হয়েছে। সমালোচনার মুখে পড়ে প্রশাসন থমকে দাঁড়ালেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অদম্য।
মোকাবিলার পথ খোঁজা সর্বাগ্রে জরুরি। কিন্তু প্রশাসন খুঁজে চাপা দেয়ার উপায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক কারণেই জটিলতর হচ্ছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি যে একটুও উন্নীত হচ্ছে না, সে কথা শীর্ষ মহলের বোঝার সময় এসেছে। এখনও  ভুলগুলো বুঝতে না পারলে প্রশাসন, এখনও সংশোধনের কথা না ভাবলে  বিপদ আরও বাড়বে।
মানুষের বেঁচে থাকার প্রাথমিক এবং ন্যূনতম প্রয়োজনের মধ্যে স্বাস্থ্য হলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য। সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে এই পরিষেবাটুকু পৌঁছে দেয়া যে কোনও সরকারের প্রধান কাজ। সেজন্যই মানুষ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক একটি ভোট সরকার গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তাদের উচিত মানুষের চাহিদাগুলোকে যথাসাধ্য মেটানো। ক্ষমতায় আসার পর সরকার প্রত্যেকটি মানুষের সুখ সুবিধার প্রতি নজর দেবে, এটাই কাম্য। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে যে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছেন, তার কিছু কিছু প্রমাণ দেশবাসীর কাছেই অবশ্য মিলেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সমস্যার সুরাহা করার ক্ষেত্রে তাঁর আন্তরিকতা অনেকটাই নজরে পড়েছে। সবক্ষেত্রেই যে তিনি পুরোপুরি সফল হতে পেরেছেন তা নয়, তবে তাঁর শুভ ইচ্ছাটুকু সাধারণ মানুষের নজরে পড়ছে।

শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে সলতে পাকানোর কাজটুকু শুরু হয়েছিল। স্বপ্ন দেখানোর কাজ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে খোলনলচে বদলে দিয়ে আরও উন্নততর পরিষেবা দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। চেষ্টা করছেন চিকিৎসা পরিষেবার উন্নতির পাশাপাশি সেখানকার পরিসর বৃদ্ধি, আধুনিক যন্ত্রপাতি এনে চিকিৎসা করানো, ভবন নির্মাণ, বেডের সংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদির। আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে, সে তুলনায় হাসপাতালের সংখ্যা খুবই কম। যেটুকু আছে, সেখানেও সবাইকে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ থাকে না। হাসপাতালের বাইরে কত মানুষ যে যন্ত্রণায় কাতরায়, হয়তো বা তারা ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। আবার দেখা যায়, হাসপাতালগুলোর একই বেডে একাধিক রোগী শুয়ে থাকেন। এই অবস্থায় রোগীর পক্ষে সুস্থ হয়ে ওঠা কতটা অনুকূল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এই উদ্যোগ সব হাসপাতালের ক্ষেত্রেই নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে থানার হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে। রোগীর চাপ সামাল দিতে যে পরিকাঠামো দরকার, তা অবশ্য রাতারাতি গড়ে উঠবে না। কিন্তু এদিকে নজর দিলে দিনে দিনে হাল ফিরবেই। মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করছে। এতো আমাদের দীর্ঘদিনের লড়াই। মন্বন্তরে মরিনা আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি। সুতরাং লড়াইটা আমাদের মজ্জাগত। তা বলে কেউ চিকিৎসা পাবে না তা তো হতে পারে না। সরকারকে দেখতে হবে বিনা চিকিৎসায় যাতে কেউ মারা না যায়। অনেক আর্থিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বর্তমান সরকার যে পদক্ষেপটুকু নিয়েছে, তার প্রশংসা করেও আক্ষেপটুকু স্বীকার করতেই হয়। বলতেই হয়, প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প হলো। এই আক্ষেপ দূর করতে পারে কেবলমাত্র সরকারই। উন্নত পরিষেবা একটি জাতিকে সুস্থ এবং পরিশ্রমী করে তুলতে পারে। 

’৭২-এর সংবিধান বিরোধী কারা?

’৭২-এর সংবিধান বিরোধীকারা?

সংলাপ ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের এক বছর পার হওয়ার আগেই একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন জাতীয় সংসদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সেজন্য দিনটি সংবিধান দিবস হিসেবে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে ওই সংবিধানটিতে (যা ’৭২-এর সংবিধান হিসেবে পরিচিত) ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের চলার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা। বিশেষ করে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশটির উঠে দাঁড়ানোর মতো নীতি ও আদর্শ যেমন - গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে করা হয় রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি। স্বাধীনতাবিরোধী দেশী-বিদেশী অপশক্তি এবং তাদের দোসররা যেহেতু তখন গর্তের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল এবং দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে কোনো কথা বলার শক্তি সামর্থ্য তাদের ছিল না সেহেতু ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কথাও তখন শোনা যায়নি। দেশের মানুষ যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল সর্বাত্মকভাবে, যাবতীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিল নয় মাস স্বপ্নের একটি দেশ গড়ে উঠার প্রত্যাশায় - ’৭২-এর সংবিধানের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল অকুন্ঠ।
বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান এবং তারই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন পর পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা বিরোধীরা গর্ত থেকে বের হয়ে আসতে থাকে এবং এদেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে লিপ্ত হয় চক্রান্তে-ষড়যন্ত্রে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে এদেশকে আবারো পাকিস্তান বানাবার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিগুলোকে ধুয়ে মুছে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন নিশ্চিহ্ন করতে এবং বাঙালি জাতিকে দারিদ্র্য, দুর্নীতিগ্রস্ত ও ধর্মান্ধ করে তুলতে ’৭২-এর সংবিধানকে মুছে দেয়ার চাইতে মোক্ষম কোন উপায় তাদের কাছে বুঝি আর একটিও ছিল না! এক্ষেত্রে এই ৭২’-এর সংবিধানের বিরোধীরা যথেষ্ট সফলই হয়েছে বলা যায়। সামরিক শাসন,স্বৈরাচারি শাসন ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করে রাখতে ধর্মের নামে যাবতীয় অধর্মের কাজ  করেছে ’৭২-এর সংবিধান বিরোধীরা। ২০০৯ এর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সংসদ নেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ’৭২-এর সংবিধান আজ পর্যন্ত দেশে কায়েম থাকলে স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরে এসে দেশের অবস্থা অন্যরকম হতো। দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো।

কিন্তু সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, বিএনপি মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনসহ স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ’৭২-এর সংবিধানের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন। অবশ্য তাদের কাছ থেকে উল্টোটা আশা করাও বৃথা। কারণ, ’৭২-এর সংবিধান বলবৎ থাকলে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে এদের অস্তিত্ব ও বিকাশতো দূরের কথা, উদ্ভবই হতো না। যেমন থাকে না আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকারের অস্তিত্ব। ’৭২-এর সংবিধান তাই ওদের কাছে আতংক। এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা ওদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের যবনিকা। কিন্তু ’৭২-এর সংবিধানের নাম যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। কেননা, ঐতিহাসিক ৬ দফা আর ১১ দফার মৌল চেতনার আলোয় ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধান যাতে প্রতিফলন ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদদের স্বপ্ন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণ আকাক্সক্ষার। তাই ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার এই দুর্লভ সুযোগে একথা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলার সময় এসেছে যে, ’৭২-এর সংবিধান মানে মুক্তিযুদ্ধ - মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর বিরোধিতা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা (যা ওরা করেও ছিল একাত্তরে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে)। ’৭২-এর সংবিধানের বিরোধিতা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আজকের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকারকে অবশ্যই এই কঠিন সত্যকে বিবেচনায় নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে রাষ্ট্রদ্রোহীদের এবং যে কোন  মূল্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে  হবে ঐতিহাসিক গণতান্ত্রিক ’৭২-এর সংবিধানকে। 

মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের নিয়ে বাণিজ্য - রাজনীতি কবে অবসান হবে!!


সংলাপ ॥ স্বাধীনতা অর্জনের ৪৬ বছরের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় স্বপ্নের শোষণমুক্ত সমাজ বা দেশ প্রতিষ্ঠিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য কখনোই বন্ধ ছিল না। রাজধানী ঢাকার সর্বশেষ দৃশ্যপটঃ গুরুত্বপূর্ণ ছোট-বড় সকল সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে খেতাব অর্জনকারী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নামে, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের বিভিন্ন নেতৃত্ব ও সংগঠকদের নামে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিবর্গের নাম ও কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখা একটি জাতীয় দায়িত্ব স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদর ও তাদের আদর্শের ধারক-বাহকরা ছাড়া এ কথা অস্বীকার করতে পারে না কেউই। কিন্তু বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের অনেক নামফলকে যেভাবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নাম প্রায় সমান আকারের টাইপে ফলাও করে লেখা হয়েছে তাতে স্পষ্টই বোঝা গেছে সংশ্লিষ্ট মেয়র তার নামকে জনসমক্ষে তুলে ধরার একটি মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগানোর যথাসাধ্য চেষ্টা-তদ্বির করেছেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক তৈরি ও সড়কের নামকরণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ কতটুকু  বাস্তবায়ন হবে এ আশংকা রয়েই গেল। অবশ্য যেসব ফলকে কেবল বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যক্তিত্বের নামের পাশাপাশি তাদের কর্ম ও অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোতে নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রয়েছে।
সূফী সাধক আনোয়ারুল হক এর একটি স্মরণীয় বাণী হচ্ছে - ‘যে ব্যক্তি চিন্তা ও কর্মে এক নয় তার ইবাদত শুদ্ধ নয়।’ আর হাজার বছর আগেকার এক সাধক-ইমাম জাফর সাদিক ইবাদতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে সুসম্পন্ন করার নাম ইবাদত।’ ৪৬ বছর বয়সী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকালের আশা-আকাংক্ষা ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়েও আজ দেখা যাচ্ছে, যারা স্বাধীন দেশের সকল সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা ভোগ করেছে তাদের অনেকেই চিন্তা ও কর্মের মধ্যে কোন সমন্বয় ছিল না, পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আজও স্বপ্নেই থেকে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালি বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ম ও অবদানের ফসল হিসেবে যে সাফল্য তার সুফল ভোগ করছে অতি নগণ্য সংখ্যক মানুষ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের যে মেয়রের সময় সড়কগুলোর নামকরণ মুক্তিযুদ্ধের নামে করা হলো তিনিও একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জানবাজ গেরিলা হিসেবে ঢাকায় অনেক দুঃসাহসী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি তার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে যে ভূমিকা পালন করেছেন তাতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ব্যক্তিবর্গ ও দলই বেশি উপকৃত হয়েছে, ভূলুন্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। রাজাকারদের তালিকা না করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করতে গিয়েই সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। কেননা, ’৭১-এর নয় মাসে কয়েক লক্ষ রাজাকার-আলবদর-মুসলিম লীগ-শান্তি কমিটির লোক ছাড়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিবাহিনীর লোক ও সৈনিকদেরকে যুগিয়েছিল খাদ্য আশ্রয়সহ যাবতীয় সহযোগিতা। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয় একটি সর্বাত্মক জনযুদ্ধ-বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জনতার কাছে যার আবেদন চিরভাস্বর হয়ে আছে। আর এ যুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটিতে ছিল সমগ্র মুক্তিকামী বাঙালির সকল বিজয় ও আশা-ভরসার প্রাণস্পন্দন। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এর আবেদনকে সংকীর্ণ করে তোলার পেছনে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে আজও বিদ্যমান। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার আড়ালে তৎকালীন সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোনাফেক ও ভন্ড রাজনীতিকদের যোগসাজশে বিলি করা হয়েছিল হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট যার সুবিধা নিয়ে সুযোগ-সন্ধানী কথিত শিক্ষিত শ্রেণী এমনকি অনেক রাজাকারও সরকারি চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে এবং এ শ্রেণীটিই পরবর্তী ৪৬ বছর ধরে দেশের সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিয়ন্তা সাজতে গিয়ে আবহমান বাংলা বাঙালির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে করেছে কলুষিত। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জনগোষ্ঠীকে আবারো পাকিস্তানী ভাবধারার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ (যার সর্বশেষ পরিণতি জঙ্গিবাদ) বানানোর এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর ক্ষমতা ভোগকারী জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ কেউই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি ও বাণিজ্য করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। জিয়া সারা দেশে ‘ইয়ুথ কমপ্লেক্স’ গঠন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর কার্যক্রমকে নিজেদের কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করে এদেশের ছাত্র, যুব সমাজ ও মুক্তিবাহিনীর বেকার সৈনিকদের পদস্খলন ঘটানোর পেছনে মারাত্মক ভূমিকা পালন করে গেছেন। জেনারেল এরশাদ, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’-এ ঘোষণা দিয়ে আরও বড় রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতা মেয়াদ নয় বছর পর্যন্ত বাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন।
তারপর ১৯৯১ সালে এদেশের জনগণ তথা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের অবসান ঘটেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহনের পর মৃত্যুর পরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। যে দেশে ’৭১-এর বীর সেনানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েছে, অন্যদিকে রাজাকার, আলবদর চক্র বিভিন্ন ছলচাতুরি ও দেশি-বিদেশী অশুভ শক্তির সহযোগিতায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সেখানে শুধুমাত্র মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থায় তুষ্ট থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে  ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তুমি দিতে এলে ফুল’?-এই গানের কথাগুলোই মনে পড়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে বলেই স্বপ্নের সোনার বাংলা আজো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শুধুমাত্র নগণ্য সংখ্যক লোকের হাতে দেশের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গেছে। দারিদ্র্য অশিক্ষা-কুশিক্ষা, শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন-নির্যাতনের’ নির্মম শিকার হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। তবু আশার কথা, বহু পরে হলেও দেশবাসী আজ যুদ্ধাপরাধীদের চিনতে পেরেছে, তাদের বিচারের দাবি জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং এত বিজয়ের ঘটনা যে বাঙালি জাতির পাঁচ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা তা সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক একটি অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এখন সবার আগে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতিকদের রাজনীতি ও বাণিজ্যের অবসান ঘটানো। তবেই সুগম হতে পারে স্বপ্নের দেশ গড়ার, মুক্তি পাবে এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবিদার সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব এ বিষয়টি যত শীঘ্রই উপলব্ধি করতে পারবে ততোই মঙ্গল। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে আর সুযোগ দেয়ার অবকাশ নেই। তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। এখন পর্যন্ত কপটতাই তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম।

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

প্রকৃতির প্রতিঘাত নাকি আমাদের কর্মফল?

পাহাড়ে মৃত্যুর মিছিল
প্রকৃতির প্রতিঘাত নাকি আমাদের কর্মফল?

·        ‘তিনিই জমিনের বুকে সুদৃঢ় পাহাড় সমূহ স্থাপন করেছেন, যাতে করে জমিন তোমাদের নিয়ে স্থির থাকতে পারে’। (সূরা আন-নাহল:আয়াত-১৫)।
·        ‘তিনিই নভোমন্ডলকে নির্মাণ করেছেন কোনো খুঁটি ছাড়া, যা তোমরা নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছ। তিনিই পৃথিবীতে পাহাড় সমূহ স্থাপন করেছেন ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যে। তাতে সকল প্রকারের বিচরণশীল প্রাণীকুলের বিস্তারের ব্যবস্থা করেছেন’। (সূরা লুকমান: আয়াত-১০)।
·        ‘আমি জমিনকে বিছিয়ে দিয়েছি, আমি তার মধ্যে স্থাপন করেছি মজবুত পাহাড়সমূহ, আবার এ জমিনে আমি উদ্গত করেছি নানা ধরনের গাছপালা’। (সূরা ক্বাফ: আয়াত-৭)।
·        ‘তিনিই জমিনের ওপর থেকে পাহাড় সমুহ স্থাপন করেছেন ও তাতে বহুমূখী কল্যাণ রেখে দিয়েছেন এবং তাতে সকলের আহারের পরিমান নির্ধারণ করে দিয়েছেন’। (সূরা হামীম আস-সাজদাহ : আয়াত-১০)।

সংলাপ ॥ প্রকৃতি জগতের সবকিছুই সুমহান আল্লাহর নির্ধারিত বিধানে পরিচালিত হয়। প্রকৃতি জগতের স্বাভাবিক নিয়মে বাধা আসলে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব দেখা যায়। মানুষ প্রকৃতির উপর নিজেদের অস্বাভাবিক প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে প্রকৃতির যে ক্ষতি সাধন করে চলেছে তা পরিনামে নিজের দিকেই ফিরে আসছে। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে - ‘প্রত্যেকেই তার কর্মফল ভোগ করবে’। এটাই স্রষ্টার বিধান। প্রকৃতির উপর আঘাত করার কারণে প্রকৃতি প্রতিঘাত করবে এটাই স্বাভাবিক। সারাবিশ্ব জুড়েই প্রকৃতির এই প্রতিঘাত লক্ষণীয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে এই চিত্র যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পার্বত্য এলাকার মহা বিপর্যয় মানবসৃষ্ট অপকর্মের এক নিদারুন প্রতিঘাত। বাংলাদেশে পাহাড় ধ্বসের কারণে নানা সময়ে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য জেলা চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও বান্দরবানে প্রতি বছরই বর্ষার শুরুতে পাহাড় ধ্বস ও মাটি চাপায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে এবং মূল্যবান সম্পদ বিনষ্ট হয়। সতর্কতামূলক প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও পাহাড় ধ্বসে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে টানা দু’দিনের অবিরাম বৃষ্টির পর গত কয়েকদিনে তিন পার্বত্য জেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে রাঙামাটি জেলায়। এর আগেও ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ধ্বসে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে। সে ঘটনায় সরকারী হিসেবে মারা গিয়েছিল ১২৭ মানব প্রাণ। ২০০৮ সালে ১৪ জন, ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ৩ জন, ২০১১ সালে ১৭ জন, ২০১২ সালে ৯৪ জন, ২০১৩ সালে ২ জন, ২০১৪ সালে ৩ জন, ২০১৫ সালে ১৯ জনের প্রাণহানি হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে গত ১০ বছরে ৪০১ জনেরও বেশি মানুষ পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রতিবছরই এভাবে লাশের ভারে পাহাড় কাঁদে। থরে থরে সাজানো লাশ দেখে স্বজনের কান্না আর অবিরাম বৃষ্টি যেন মিলেমিশে বেদনার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে পাহাড়ি এলাকায়। এবারের দুর্ঘটনায় অনেকে হারিয়েছেন স্ত্রী-সন্তান, কেউ হারিয়েছেন মা, কেউ বাবা, কেউবা ভাই-বোন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর দুই কর্মকর্তা ও দুই সৈনিক। কোনো কোনো পরিবারের এখন আর কেউই বেঁচে নেই। পাহাড় ধ্বসের পর উদ্ধার কাজের সময় মাটিচাপা পড়ে প্রাণ হারান তারা। কিন্তু কেন এখানে বার বার পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটে? প্রাণহানিও কেন এত বেশি? খোঁজা যাক তার উত্তর।
জানা গেছে, বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার পরিবার, রাঙামাটি জেলার ১০টি উপজেলায় প্রায় ৮০ হাজার পরিবার এবং খাগড়াছড়ি জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার পরিবারের বসতি রয়েছে। এরা উঁচু-নিচু পাহাড়, পাহাড় ঘেঁষে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে থাকেন। এসব পরিবার যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। কিন্তু জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বর্ষায় মাইকিং করে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা ছাড়া বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ নেয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রায় ২৫ বছর ধরে তিন পার্বত্য জেলায় ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বন্ধ থাকায় ভূমিহারা বা ভূমিহীন হাজার হাজার পরিবার অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছে। এসব জেলায় একদিকে ভূমি বন্দোবস্ত বন্ধ রয়েছে, অপরদিকে পার্বত্য শান্তি চুক্তির বিশেষ বিধিমতে ‘যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং জায়গা-জমি আছে, কেবল তারাই পার্বত্য অঞ্চলের জায়গা-জমি কিনতে পারবেন বা স্থায়ী বাসিন্দার অধিকার রাখেন’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এ কারণেই বাঙালি জনগোষ্ঠী ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। এক খন্ড ভূমি কিনতে পারছে না বা ব্যবহারের সুযোগও নেই সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। ফলে বাধ্য হয়ে বৈধ-অবৈধ উপায়ে যে যার মতো পাহাড়ে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে। এসব পরিবার খুবই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে এলেও তাদেরকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। তাছাড়া ইউনিয়ন, উপজেলা বা পৌরসভাভিত্তিক পাহাড়ে ঝূঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসন করার কোনো সরকারি পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি। গত কয়েক বছরে পার্বত্য জেলাগুলোয় পাহাড়ের নিচে দখল আর বসতি এত বেড়েছে, এ নিয়ে আর শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। যৎসামান্য তৎপরতা ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবারো উদাসীন। কানে তুলা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমে বিভোর প্রশাসন। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দেশবাসীকে পাহাড় চাপাপড়া লাশের স্তুপ দেখতে হচ্ছে বারবার। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? চাইলেই ঠেকানো যায়; কিন্তু ঠেকানো হচ্ছে না। আর মানুষও অতি লোভে তা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে- বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ের মাটি অপেক্ষাকৃত নরম এবং মাটির ধরন হচ্ছে বেলে। তাই টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটিতে ব্যাপক ধ্বস নামে। এবার বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামে পাহাড়ের মাটি ধ্বসে যে পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছে, তা শুধু পাহাড়         কাটার কারণ নয়, অবাধে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে সৃজিত গাছপালা কর্তন এবং পাহাড় খোদাই করে নিষিদ্ধ বারুদ ব্যবহার করে বোল্ডার পাথর ভাঙন ও উত্তোলন করা। পাহাড়ের ওপর অত্যাচার হলে পাহাড় প্রতিঘাত করবেই।
পাহাড় ধ্বসের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের উপরের দিকের মাটিতে কঠিন শিলার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তাই বৃষ্টির কারণে এ ধরনের মাটি পানি শুষে ফুলতে থাকে। তাছাড়া কঠিন শিলা না থাকায় মাটিগুলো নরম ও পিচ্ছিল হয়ে যায়। ফলে ভারি বর্ষণের সাথে সাথে মাটি ভেঙ্গে পড়ে। তাছাড়া যারা পাহাড়ে থাকেন তারা ঘর নির্মাণের জন্য পাহাড়ের সবচেয়ে শক্ত মাটির স্তরও কেটে ফেলেন। এতে পাহাড় ধ্বসের শঙ্কা আরও তীব্র হয়।
জিও সায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড় ধ্বসের পেছনে প্রাকৃতিক কারণ এবং মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিক কারণ হলো পাহাড়ের ঢাল যদি এমন হয় যে ঢালের কোনো অংশে বেশি গর্ত থাকে, তখন অতিবৃষ্টিতে ভূমি ধ্বস হতে পারে। এছাড়া ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং পাহাড়ের পাদদেশের নদী ও সাগরের ঢেউ থেকেও পাহাড় ধ্বস হতে পারে। আর মনুষ্য সৃষ্ট কারণ হিসেবে গবেষণায় বলা হয়েছে, পাহাড়ের গাছ পালা কেটে ফেলা, মাটি কেটে ফেলা, পাহাড়ে প্রাকৃতিক খাল বা ঝর্ণার গতি পরিবর্তন, পাহাড়ের ঢালুতে অতিরিক্ত ভার দেয়া এবং খনি খননের কারণে পাহাড় ধ্বস হতে পারে। তবে আমাদের ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, বাংলাদেশে মূলত পাহাড়ের উপরের দিকে কঠিন শিলার অভাব, পাহাড়ের মাটি কেটে ফেলা এবং বড় গাছপালা কেটে ফেলার কারণেই পাহাড় ধ্বস হয়ে থাকে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড় ধ্বসের মূল কারণ হলো পাহাড় থেকে মাটি কাটা। পাহাড়গুলো ৩০ ডিগ্রির বেশি ঢালু হলে সে পাহাড়ের পাদদেশে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়। পার্বত্য জেলাগুলোয় রয়েছে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত অসংখ্য ঢালু পাহাড়। মাটির জমাট বাঁধা পাহাড় যখন কাটার মহোৎসব চলে তখন প্রবল বর্ষণ হলে মাটির ওপরের আবরণ না থাকায় যে প্রবল জলধারা নিচে ধাবিত হয় তার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মাটি এসে পাহাড়ের পাদদেশে আছড়ে পড়ে। আর তখনই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা।
২০০৭ সালে যখন পাহাড় ধ্বসে ব্যাপক প্রাণহানি হয় তখন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পাহাড়ি ভূমি ধ্বসের সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখসহ সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পেশও করেছিল কমিটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এর অধিকাংশই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি জরিপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে চিহ্নিত করার সুপারিশ ছিল, যা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তেমনিভাবে বাস্তবায়িত হয়নি পাহাড়ের পাদদেশে বিপদসঙ্কুল অবস্থায় বসবাসকারী বস্তিবাসীকে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের কর্মসূচি। বাস্তবায়িত হয়নি পাহাড় কাটার আশঙ্কা কিংবা বন উজাড়ের ঘটনা। পাহাড় হন্তারকদের পাহাড় কাটা থেকে বিরত করা যায়নি। অন্যদিকে প্রশাসন, সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর লোভাতুর হাত গুটিয়ে না নেয়ায় অশিক্ষিত এ জনগোষ্ঠী টুপাইস দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশেই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস অব্যাহত রাখে। এক শ্রেণীর তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা জোরপূর্বক এসব পাহাড় দখল করে সেখানে টিনশেড ঘর তুলে তা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় ভাড়া দিচ্ছে। চট্টগ্রামের খুলশী ও রেলওয়ে সংলগ্ন একাধিক এলাকার পাহাড়ে এখন রমরমা পাহাড় বাণিজ্য চলছে। যেভাবে বসতি গড়া হচ্ছে তাতে আর পাহাড় থাকবে না। আগের ঘটনা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়নি বলেই তাদের এ করুণ পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। পাহাড়ে এখন যারা বসবাস করছেন তারা দ্রুত অন্যত্র আশ্রয় না নিলে পাহাড়ের আক্রোশ থেকে রেহাই পাবে না।
একের পর এক পাহাড় চাপা পড়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় পাহাড় ব্যবস্থাপনায় আমাদের অক্ষমতাকেই প্রকাশ করছে। আপাতত এই দেড়শ’ প্রাণের চালানকে ‘নিয়তি’র পরিহাস বলে সবাই মেনে নিলেও মৃত্যুর এই অস্বাভাবিক মিছিলটির দীর্ঘায়ণের জন্য কেবলমাত্র ‘সৃষ্টিকর্তা’র উপর ছেড়ে দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। এগুলো এক প্রকারের হত্যাকান্ড। প্রতিদিন পত্রিকায় পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় কাটার খবর আসে। স্থানীয় প্রভাবশালীর দোহাই দিয়ে পাহাড় কেটে শিল্প-কলকারখানা তৈরি হচ্ছে, ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে। অপরিকল্পিত গর্ভধারণের মতো পাহাড়ের বুকে রাতারাতি বাড়ি তুলছে। এতো অরাজকতা চলার পরও এই দেশের সরকার চুপ মেরে বসে আছে। কারণ একটাই, যারা পাহাড় কাটছে কিংবা অবৈধ কারখানা পাহাড়ে বুকে তুলছে, তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক মেরুদন্ড শক্তপোক্ত। শুধুমাত্র সদিচ্ছা থাকলেই পাহাড়ে ভূমিধ্বস রোধ করা সম্ভব। সরকারের উচিত পাহাড়ে পরিকল্পিত বসতি কিংবা বসতির জন্য আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর হওয়া। জাপানের মতো দেশে যেখানে বছরে সাড়ে চার হাজার ভূমিকম্প হয়েও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর হার এক শতাংশে নিয়ে এসেছে, সেখানে আমরা কেন পারি না? তারা তো প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পাহাড়কে শাসন করছে, আমরা কেন পাহাড়িদের দুঃখ লাঘবে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ  করছি না?

সময়ের দাবি সরকার শুধুমাত্র পাহাড়ের সুরক্ষায় বাস্তবমূখী পদক্ষেপ গ্রহন করুক। পাহাড়ে বসবাসরতদের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে টেকশই বাড়ি-রাস্তাঘাট করে দিক। পাহাড়ি ভূমি-খেকোদের শাস্তির বিধান করে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করুক। অন্যরা পারলে আমরাও পারবো। আমরা মনে প্রাণে চাই, আর যেন পাহাড় ধসে কারো নির্মম মৃত্যু না হয়। আল্লাহর বিধান মেনে আমরা সবাই যেন পাহাড় রক্ষায় সচেতন হই। নয়তো আমাদের কর্মফল আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে। 

সময়ের সাফ কথা.... যাকাত-ছদকা-ফিতরা’র কথা


 অধ্যাপক মো. আক্তার হোসাইন ॥ মানবীয় আমিত্বের পরিপূর্ণ উৎসর্গের নাম যাকাত। মনের মধ্যে স্রষ্টার জন্য মহাশূন্য ভাব জেগে ওঠাই যাকাত। কোন দানকে কুরআনে যাকাত বলা হয়নি। ইসলাম এবং কুরআন নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা বলছেন যে যাকাত মালের সাথে সম্পর্কিত। অথচ কুরআন মাজিদ ঘোষণা করেছে যে, হযরত লুত, হযরত আদম, হযরত ইব্রাহীম এবং প্রত্যেক নবীই যাকাত দিয়েছেন। বিনিময় প্রথা চালু হলো সেদিনের কথা। শতকরা আড়াই টাকা তখনকার দিনে (১৪৫০ বছর আগে) কিভাবে যে দেয়া হতো তা তো সমাজকে বুঝানো যাবেনা। শতকরা আড়াই টাকাকে কুরআনে এমনকি হাদিসেও কোথাও যাকাত না বলে ছদকা বলা হয়েছে। যেখানেই সম্পদের উপর কর দানের প্রশ্ন সেখানেই ‘সাদকা’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। তাছাড়া প্রত্যেক নবীই যদি যাকাত দিয়ে থাকেন তবে হযরত আদম (আ.) কাকে যাকাত দিয়েছিলেন এ প্রশ্নটি এসে যায়? কুরআনে বলা হয়েছে ‘আল্লাজি নাহুম লিজ যাকাতে ফায়েলুন’ অর্থাৎ ‘তারা সদা সর্বদা যাকাতের জন্য কর্মতৎপর থাকেন।’ যাকাত যদি কর হতো তবে তার জন্য বিশ্বাসীরা এটা পরিশোধের জন্য সদা তৎপর না হয়ে বছরে একবার দিয়ে অন্য সময়টা এবাদতসহ নানাবিধ কর্মে নিয়োজিত থাকতেন। তাছাড়া সালাতের সাথে যাকাতের প্রসঙ্গ এসেছে। তাহলে সালাত আর যাকাত একসাথে। সমাজের কথামতো কি ধরে নিতে হবে যে সালাত সবার জন্য আর যাকাত বিত্তবানদের জন্য? অবশ্যই না। সালাতের সাথে যাকাতের কথা বারবার এসেছে এবং একটু তলিয়ে দেখতে গেলে মানুষ দেখতে পারবে যে স্রষ্টার সাথে সংযোগ সাধন ও আমিত্বের উৎসর্গের  বিষয় নানাভাবে নানা মহিমায় স্থান কাল পাত্রভেদে বিভিন্ন রকম দৃষ্টান্তে বলা হয়েছে। প্রশ্ন, তাহলে যাকাত কি? উত্তরটি হলো, মানুষ আল্লাহ্র নিকট থেকে যা কিছু যেমন ধন-সম্পদ, বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদি (চিত্তবৃত্তির সব ধরনের গুণাবলী সবই আল্লাহর দান), আল্লাহর এই দানকে নিজের নিকট না রেখে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করার নামই হলো যাকাত। মানবীয় আমিত্বের আবরণ ক্ষতিকর। মানুষের আমিত্বের আবরণ উন্মোচিত না হলে স্রষ্টার সাথে সংযোগ হবে না। কুরআনে বলা হয়েছে, সালাত কায়েম (সালাত পড়তে বলেনি) কর এবং যাকাত দাও। সালাতের মূল কাজ হলো স্রষ্টার সাথে সংযোগ প্রচেষ্টা। মানবীয় আমিত্বের আবরণ থাকলে সংযোগ হবে না। এগুলো বিসর্জন দিতে হয়। এ কারণে সালাত এবং যাকাত একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রের দরবারী আলেমগণ একে কর হিসাবে আদায়ে ফতোয়া দেয়াতেই বিষয়টি মূল বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারা বোঝাতে চাচ্ছেন যে সম্পদ থেকে আড়াই ভাগ দান করলে সম্পদ বৈধ হয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি যে মৃত কিংবা জীবিত সকল লোকের সম্পদে গরীব, অভাবী, এতিম, ফকির, মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের হক রয়েছে তখন তা দেবেন কি করে? এরা তখন বলে গরীব মিছকিনকে আত্মীয়স্বজনসহ ডেকে কিছু খাইয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। কোথায় মালের ব্যাপার-অর্থের ব্যাপার আর কোথায় রুহানী তথা আধ্যাত্মিক ব্যাপার। কুরআনে বলা আছে, যে ব্যক্তি সম্পদ জমা করে রাখে তাকে হুতামা তথা জ্বলন্ত আগুনে চিরদিনই জ্বলতে হবে। ধন সম্পদ জমা করে রাখাটাই যেখানে অপরাধ সেখানে ধনের জন্য যাকাতের বিধান আসে কি করে? তাছাড়া এখানে একটা বিষয় কুরআনের আয়াত দ্বারা বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। কুরআনে বলা আছে, ‘আমি কাউকে বেহিসেবী তথা অফুরন্ত রেজেক দেই এবং কাউকে তার রিজিক নির্দিষ্ট করে রেখে দেই।’ এই বেহিসাবী রিজিক পার্থিব মাল বা ধন সম্পদ নয়। আল্লাহ্ যেখানে প্রত্যেকের ধনের পাই পাই করে হিসাব নেবেন বলে জানিয়েছেন সেখানে বেহিসাবী ধন সম্পদ দিয়ে আবার তার হিসাব চাওয়ার প্রশ্ন কেন? যদি বেহিসাবী সম্পদই ধরে নেয়া হয় তবে কেন বলা হলো যে যারা মাল জমা করে এবং গুণে গুণে রাখে তাদেরকে ওয়াইল নামক নরকে জ্বলতে হবে?
সমাজ আসলে কুরআনের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোকে একত্রে সমাবেশ করে দেখেনা এবং জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে পূর্বে যারা যা বলে গেছেন তাই মেনে নিয়ে কেবল অন্ধকারেই ডুবে আছে। দুনিয়ার সকল ধনীরই সম্পদের নিশ্চয়ই একটা হিসাব আছে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। তাহলে বেহিসাব কথাটা কাদের বেলায়,  কার জন্য প্রযোজ্য? আল্লাহর রিজিকের অর্থ যদি দুনিয়ার ধন সম্পদই হবে তাহলে আল্লাহ্ তার প্রিয়জনকে এই রিজিক নিশ্চয়ই প্রচুর দান করবেন কিন্তু আসলে তা হয়নি বরং আল্লাহ্ তার খাস বান্দাদেরকে এসব সম্পদ হতে এক রকম প্রায় বঞ্চিত করেই রেখেছেন। কোন্ নবী ধনে ধনী ছিলেন? নবীর কোন্ সঙ্গী সাথী ধনী ছিলেন? যারাও ছিলেন তারা তাদের ধন সম্পদ নবীর কাছে নিয়ে এসে আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে কি বিলিয়ে দেননি? সুরা মরিয়মের ১৩ নং আয়াতটিকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তবে এটা স্পষ্ট হবে যে, যাকাত বলতে কি বোঝায়। এ আয়াতে দু’টো শব্দ আছে একটি হলো ‘হানানান’ এবং অন্যটি হলো ‘জাকাতান’। হযরত ইয়াহিয়া (আ:) এর এমন কি সম্পদ ছিল যে, তাঁর প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যাকাতের প্রশ্ন উঠবে? ‘হানানান’ আসলে মনের গোলযোগ শুন্য একটি শান্ত ভাব। বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে কার্যকারণের কোন গোলযোগ নেই। সৃষ্টির প্রত্যেক স্থানে সবাই ঠিকভাবেই আছে। মনের এই গুণময় ভাবটির নাম হানানান। অতএব যার মাঝে এই হানানান চলে আসে তার মধ্যে কোমলতা প্রকাশ পায়। এই রূপে পরিপূর্ণ প্রশান্তির একটি মানসিক অবস্থার নাম হানানান।  হযরত ইয়াহিয়া (আ.) ছিলেন বৃদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন বন্ধ্যা। এসময় তাঁকে আল্লাহর তরফ থেকে একটি পুত্র সন্তানের খবর দেয়া হয় বলে হযরত ইয়াহিয়ার মন একরাশ প্রশান্তিতে, কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিলো।  হানানান অবস্থাপ্রাপ্ত হলে বিশ্ব প্রকৃতির স্বাভাবিক বিধানের সঙ্গে মনের পূর্ণ সমন্বয় সাধন ঘটে, আমিত্বের আবরণের পরিপূর্ণ একটি উৎসর্গ হয় অর্থাৎ যাকাত হয়ে যায়। সে ব্যক্তি তখন নিজেই তাকওয়ার মূর্ত প্রতীক। এস্থানে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-এঁর কেবল শোকরানার ভাব, কৃতজ্ঞতার ভাব আল্লাহর রহমতে সিক্ত হবার ভাব। তার মাঝে কোন গর্ব নেই, আমিত্ব নেই আছে কেবল সেজদা আর কৃতজ্ঞতা। তাই, কুরআনের যাকাতকে যারা আয়কর বলেন তারা কিসের ভিত্তিতে বলেন তা বোধগম্য নয়। মানসিকভাবে জীবনের সামগ্রিক উৎসর্গই হলো যাকাত। এটা সাধকের জন্য সালাতের মতোই অবশ্য পালনীয় দেহ ও মনের একটি সার্বিক উৎসর্গ। পরিপূর্ণভাবে যাকাত দেয়া ব্যক্তি জান্নাতবাসী। সূরা তওবার ৬০ নং আয়াতে যে আট জনকে ছদকা দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা ভালো করে খেয়াল করলেই সব রহস্য বের হয়ে যাবে। এখানে হুবহু বাংলা অনুবাদ তুলে দেয়া হলো : ‘ছদকাসমূহ গরীব, মিসছিন, ছদকা আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মচারী এবং অনুরাগী অন্তর বিশিষ্টদিগের জন্য এবং যারা গোলাম তাদেরকে মুক্ত করবে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্ত করা, আল্লাহর পথ ও পথিকের মধ্যে - এ হচ্ছে আল্লাহর বিধান। আল্লাহ্ বিজ্ঞানময় জ্ঞানী।’ বর্তমান মুসলমান সমাজের শতকরা আড়াই টাকা যদি যাকাত হিসেবে আদায় করা হয় তা খাবে কে?
যে আটজনের কথা বলা হলো তারা ছাড়া অন্য কেউ আছে কি যে অপরের সম্পদের হকদার? ছদকাকে আমরা কেন যাকাত বলে ধরে নিচ্ছি? যাকাত বলতে আমিত্বের আবরণ উন্মোচন, আত্মোৎসর্গ ব্যতীত অন্য আর কোন অর্থেই শব্দটি কুরআনে ব্যবহার হয় নাই। সুরা তওবায় ‘ছদকা’ শব্দটিই আছে যাকাত নেই। কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ছদকা নির্দিষ্ট আটটি খাতে ব্যয় করতে হবে। খাতগুলো হলো ১। অভাবগ্রস্ত প্রার্থীদের জন্য যারা অভাবের কারণে প্রার্থনা করে থাকেন, ২। অভাবীদের জন্য যারা কোন অবস্থাতেই প্রার্থনা করলো, ৩। যারা ছদকা আদায় এবং তা উপযুক্ত স্থানে বন্টন বিষয়ে কর্মচারীরূপে নিয়োজিত থাকবে, ৪। যারা বন্টন বিষয়ে কর্মচারীরূপে নিয়োজিত থাকবে। যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি প্রেমের অতিশয্যে অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থাপ্রাপ্ত হয়ে উপার্জনের কর্তব্য পালনে বিকল হয়ে পড়ে - তাদের জন্য, ৫। বন্দিকে মুক্ত করার জন্য, ৬। ঋণে আবদ্ধ সৎ কর্মশীল কোন ব্যক্তিকেও আর্থিক মুক্তি দেয়া যেতে পারে যদি তা কর্তৃপক্ষ দ্বারা ন্যায়সংগত হয়, ৭। ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রচার কাজে, ৮। পথিকের মধ্যে অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত পথিককে এ ছদকা দেয়া যাবে। এমতাবস্থায় যাকাত শব্দটিকে আমরা কখনো মালের মধ্যে বা অর্থের সাথে মিলাতে পারি না।

আমাদের দেশে ঈদের আগে ফেতরা ধরা হয়। এটা যে কোথা হতে কে আমদানি করলো তা এক বিস্ময়। প্রতিটি মানুষকে পৌনে দুই সের গমের সমপরিমাণ দামে ফেৎরা দিতে হয়। যাকাতও মাল, ছদকাও মাল, ফেতরাও মাল আর সবই যদি মাল আর কর হয় তবে তা তিন নামে আসার যে কোন যৌক্তিকতা থাকে না সেটা সাধারণ পাঠকও বুঝে যাবেন। মাল-অর্থ কামানোর এটা একটা শুভঙ্করের ফাঁকি। তাছাড়া এমনও দেখেছি  যে অনেক লোক স্বর্ণের যাকাত দিতে দিতে মূল স্বর্ণের দামের তিনগুণ বেশিও যাকাত দিয়েছেন।  পবিত্র কুরআন না বুঝে পড়ার খেসারত কতো কাল দিয়ে যাবে এই মুসলিম সমাজ? কুরবানীর মাংস কেন তিনভাগে ভাগ করা হয়? একভাগ নিজের, একভাগ আত্মীয়দের এবং একভাগ প্রার্থীদের জন্য? সম্পদের বেলায় এমনটি হলে অর্থাৎ যা কামাই করবো তার এক ভাগ আমার, একভাগ আত্মীয়দের এবং একভাগ প্রার্থীদের? কারণ, কুরআনে তো বলাই আছে  যে, তোমাদের সম্পদে রয়েছে আত্মীয়, গরীব, ফকির, মিসকিন ও এতিমদের হক। যার যার হক আদায় করে দিলেই তো হয়। সূরা আহ্যাবের ৩৩ নং আয়াতে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে মনের কালিমা দূর করতে বলা হয়েছে। এভাবে যদি মানুষ চলতো আর কুরআন নির্দেশিত পথে ব্যবস্থা করতো তবে দুনিয়ার কোন মানুষ অনাহারে থাকতো না। কেউ দশ তলায় আবার কেউ গাছ তলায় থাকতো না। সূরা মুমিনে যাকাতের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করার চেষ্টা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা করছি কি তা? আমাদের ভেবে দেখা দরকার। 

অর্থপাচার বন্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে



*শপথ তাদের যারা ছুটে যায় হাঁপাতে হাঁপাতে-আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে, সকালে হামলায়, ধূলো উড়িয়ে ঢুকে পড়ে একসাথে। মানুষ তো তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। আর সে তো নিজেই তার স্বাক্ষী। আর ধন-সম্পদের প্রতি তার কি কঠিন প্রেম! সে কি জানে না যা কবরে আছে তা উঠানো হবে, আর অন্তরে যা আছে তা প্রকাশ করা হবে। আর সেদিন তাদের খবর তাদের প্রতিপালকের ভাল করেই জানা থাকবে। (আল কুরআন, সূরা আদিয়াত-আয়াত ১-১১)

শেখ উল্লাস ॥ যখন এ দেশের মানুষের এত অর্থ-সম্পদ, টাকা-পয়সা ছিল না তখন সমাজ-সচেতন মানুষদের পক্ষ থেকে বলা হতো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। এখন অনেক মানুষের হাতে, রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে অর্থ-সম্পদ হয়েছে। দেশের অর্থ-সম্পদ আজকাল ব্যাপকহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে নানা পন্থায়, যা দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, অন্য সকল দুর্নীতির টাকা দেশের ভেতরে খরচ হলে, বিনিয়োগ হলে এর কিছু না কিছু অংশ কোন না কোন ভাবে দেশের মানুষের কাজে আসার সুযোগ থাকে, কিন্তু যে অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়, তা দেশের আর কোন কাজে আসে না। বিগত দুই তিন দশক ধরে এই অর্থপাচারই দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। বর্তমান সময়ের দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতি হচ্ছে, এদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবী ও রাজনীতিজীবীদের একটি বিরাট অংশই এদেশের সকল সুবিধা-সুবিধা ভোগ করে তাদের আখের গোছাচ্ছে বিদেশে, বাড়ি করছে মালয়েশিয়া, আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ায়; ছেলেমেয়েদেরকেও প্রতিষ্ঠিত করছে বিদেশে, টাকা জমাচ্ছে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে। নিজের জন্মভূমি, গ্রাম কিংবা মফস্বলের ছোট্ট শহরে তাদের আর ফিরে যাওয়া হচ্ছে না। দেশের প্রতি তাদের অনীহা, বিস্মৃতিপ্রবণতা ও অকৃতজ্ঞতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নিজের জন্মভূমিকে তাদের এবং তাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিতে পারছে না। ফলে নানা কৌশলে তারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে এবং সেখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলছে। পরিণামে জীবনের শেষ দিনগুলো বিদেশের মাটিতে তারা কাটিয়ে দিচ্ছে ওইসব দেশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। এই অবস্থায় একজন মানুষের নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলার অবস্থা তৈরি হয়েছে।
গত ১৩ জুন, ২০১৭, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪, তারিখ মঙ্গলবার দৈনিক কালের কন্ঠ লিখেছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫১ কোটি টাকা পাচারকারী ৯ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অর্থ পাচারকারী এই ৯ জনের আটজনই ব্যবসায়ী, অন্যজন সাবেক আমলা। তারা দেশের ব্যাংকিং চ্যানেল এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এই অর্থ পাচার করেছেন। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা পেতে যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি ’ল ফার্ম নিয়োগ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা এই ৪৫১ কোটি টাকাসহ দেশ থেকে পাচার হওয়া যেকোন অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে এই তিনটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এই চুক্তি সম্পাদনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হওয়া যেকোন অর্থ ফেরত পেতে সব ধরনের আইনী কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করবে এই তিন মার্কিন প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে এনবিআর। প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নেবে।
পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে আমদানী-রপ্তানীতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কোন কর্মকর্তা সহযোগিতা করেছেন কি-না তাও যাচাই করা হচ্ছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ সময়োচিত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলে এদেশকে শোষণ করে ঔপনিবেশিক শাসকরা এদেশকে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দরিদ্র বানিয়ে এদেশেরই অর্থ লুন্ঠন ও পাচার করে নিজ দেশে নিয়ে গিয়েছিল। আজ আমাদেরই দেশের একশ্রেণীর প্রতারক, দুর্ণীতিবাজ ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিজীবি এদেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ব্রিটিশ-পাকিস্তানীদের লুটপাটের কারণে দরিদ্র হয়ে পড়া জনগণের আর্থিক স্বচ্ছলতা বর্তমানে বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার কমে আসলেও বিদেশে অর্থপাচারের মতো দুর্নীতি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী নাগরিকদের পাচার ও জমা করা বিশাল অঙ্কের অর্থের খবর মাঝে মাঝেই প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে। তবে এর প্রতিকার কিংবা অর্থ পাচাররোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপের খবর খুব কমই সাধারণ জনগণ জানতে পারে, যদিও এ সম্পদ দেশের সকল মানুষের। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। নিজের জন্মভূমিকে বসবাসের অযোগ্য আখ্যায়িত করে যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে তারা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই তাদের সকলকে চিহ্নিত করে                   তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ও সর্বাত্মক  ব্যবস্থা গ্রহণ আজ সময়ের দাবি। 

বৈষম্যহীন মিলনোৎসব ঈদ-উল-ফিতর


ফিরোজ আহমাদ ॥ আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্তির খুশি উদযাপনই হলো ঈদ। সিয়াম পালন করতে পারার বড় আনন্দে রোজাদার মাতোয়ারা হবেন এটিই স্বাভাবিক। যে প্রভুর সন্তুষ্টির জন্যে এতো আরাধনা, উপবাস, সেহরী, ইফতার, তাহাজ্জুদ, ইতেক্বাফ,  সে প্রভুর দেয়া পুরস্কার গ্রহণ করার সৌভাগ্যেই বা ক’জনের হয়। সেই পুরস্কার হলো ঈদ। এক মাস সিয়াম সাধনার পর পশ্চিমের আকাশে শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজাদারের ঘরে আনন্দের বন্যা বইতে থাকে। এছাড়া ঈদ-উল ফিতরের রাত দোয়া কবুলের রাত। সুনানে বায়হাকী শরীফের ৩/৩১৯ নং হাদিসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে পাঁচটি বিশেষ রাতের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। পাঁচটি রাতের প্রথমটি হলো জুমার রাত, ২য় হলো ঈদুল ফিতরের রাত, ৩য় হলো ঈদুল আযহার রাত, ৪র্থ হলো রজব মাসের চাঁদ উদয়ের প্রথম রাত, ৫ম হলো মাহে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত।
আইয়্যামে জাহেলীয়াতের যুগে আজকের মদীনায় তৎকালিন সময়ের ইয়াসরিবে কাফের মুশরেকরা ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে দু’টো আনন্দ উৎসব পালন করতো। ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ উৎসব দু’টো বিভিন্ন নাচ, গান, কৃষ্টি-আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপিত হতো। আল্লাহ্ তায়ালা ঈমানদারদের খুশি উদ্যাপনের জন্য বরকতময় উপহার হিসেবে দিলেন ঈদ। ঈদ-উল ফিতর এর মধ্যে ইসলামের সুমহান আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা, সহনশীলতা,  সহানুভূতি ও বিশেষ মূল্যবোধ রয়েছে। ঈদ-উল ফিতর উদ্যাপিত হয় ঈদের নামাজ আদায় করা, দোয়া দুরূদ পড়া, তাসবিহ তাহলীল পাঠ করা ও মিষ্টান্ন ও নানাবিধ রুচিসম্মত খাদ্য ও পানাহারের মাধ্যমে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা ঈদ-উল ফিতরের দিন এতিম অসহায় দু:স্থদের ভালো খাবার ও নতুন জামা-কাপড় উপহার দেন। দেশের সকল এতিমখানা ও কারাগারগুলোতে বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। অসহায় দু:স্থদের মধ্যে ফিতরার টাকা বাড়তি আনন্দ প্রদান করে।
ঈদ-উল ফিতর মুসলমানদের বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক। সেদিন ধনী দরিদ্ররা ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর পরস্পরের সাথে  ভাব ও মত বিনিময় করার সুযোগ পান। করেন। ঈদের দিন মুসলমান অধ্যুষিত দেশের রাষ্ট্র প্রধানগণ তার দেশের সাধারণ জনতা ও  উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশেবিষয়গুলো এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। দেশের সবক’টি শিশু পার্ক, সমুদ্র সৈকত, চিড়িয়াখানা ও দর্শনীয় স্থান গুলোতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণী, পেশার মানুষের ঢল নামে। ঈদ উপলক্ষে সরকারী বেরসকারী অফিস আদালত শিল্প কারখানা গুলোতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। শহরে বসবাসরত চাকুরীজীবিরা বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ির দিকে ছুটে যান। রেল বাস, নৌ পথে বাড়তি ভোগান্তি উপেক্ষা করে যথা সময়ে প্রিয়জনের নিকট পৌঁছানোর লক্ষ্য থাকে। ঈদের দিন নতুন টাকা ছোটদের বাড়তি আনন্দ প্রদান করে।

ঈদ-উল ফিতরের আনন্দকে অর্থবহ করতে অশ্লীল নাচ গানের আসর বসানো, তাস খেলা, মদ জুয়ার আসর বসানো, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, ব্যাভিচার ও পরনিন্দার মতো অশ্লীল মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মিসওয়াক করা, ফজরের সালাত আদায় করা, বাবা-মাকে সালাম করা, আতর ব্যবহার করা, নীরবে তাকবীর বলতে বলতে ঈদ গাঁহে প্রবেশ করা উত্তম। ঈদের   নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধকে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ জীবনে কাজে লাগতে পারলে বাংলাদেশ একটি সুখী সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। 

বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০১৭

বাস্তবতার নিরিখে কর্মই ধর্ম হোক

বাস্তবতার নিরিখে
কর্মই ধর্ম হোক

একবিংশের পুনর্জাগরণ। জীবন চলার পথ যখন কণ্টকাকীর্ন তখন সংস্কারের প্রয়োজন। দেশবাসীর জীবনাভিমুখ এখন সেদিকেই অগ্রসরমান। একবিংশে লক্ষ্যবিমুখ রাজনীতির ঢালাও সংস্কার সময়ের দাবী, আদর্শহীন রাজনীতিকদের বহিষ্কার এবং দলকে তরুণ উদীয়মান নেতাদের দিয়ে ঢেলে সাজানো। পারবেন কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ পথে হাঁটতে? মানুষকে হাঁটাতে? পারলে ইতিহাসও তাঁর পাশাপাশি হাঁটবে এবং  সেইসঙ্গে মানুষও।
সংলাপ ॥ বাংলার মানুষ থাকতে চায় চিন্তাজগতে মুক্ত। মিথ্যাচারের বাঁধন থেকে মুক্তি। সবধরনের বন্ধন অবসান। রাজনীতিতে দুর্বত্তের - দুশ্চরিত্রের-দুঃশাসনের - দুর্নীতির কালো মেঘের অবরোধ দূর হোক - এই হচ্ছে বাংলার মানুষের প্রত্যাশা।
একপ্রকার প্রবল অনিশ্চয়তা, ব্যাখ্যাতীত ভীতির ছায়া ক্রমশই  গ্রাস করে চলেছে সমাজজীবন, নাগরিক, এমনকী ব্যক্তি-জীবনকেও। এখন বাংলাদেশের চল-চ্চিত্রায়ণে এমনই এক ইঙ্গিত। ইশারায় নয়, স্পষ্ট অভিব্যক্তিতে। হয়তো এ ভাবনার সমীচীনতা সকলে স্বীকার না করতেও পারেন, তবুও সন্দেহ নেই যে, বিপন্নতা বাড়ছে। না; এ কোনও বিষাদের বিলাপ নয়, বরং রাজনৈতিক সংকটের পূর্বাভাসে আগাম সতর্কতা।
সরকার আছে। শুধু তাকে দুষে কোন লাভ নেই। কারণ অনেক কিছুরই যে অভাব সেখানে। প্রাজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা, অধ্যবসায়, সাংগঠনিক পরম্পরা-দলীয় এবং প্রশাসনিক সব প্রয়োজনীয় উপাদানে পুষ্ট হওয়ার পূর্বেই ভূমিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ আজ ৪৬ বছরের কীর্তিমান। কারও চেষ্টায় নয়, পরিকল্পিত পন্থাতেও নয়, কেবল পূর্বতন অজ্ঞ শাসকদের ভুলের ফলে ঘটেছে পরিবর্তন। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব চেপেছে মহাজোট সরকারের কাঁধে। কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই। কারণ মানুষ এমনটাই চেয়েছিলেন। পরিবর্তনের হাওয়া দিন বদলের পালা।
এখন কর্মই ধর্ম হোক। অক্ষমতা স্বাভাবিক, তাকে দূর করে স্ব-নির্ভর হতে হবে। নিছক আবেগের বশে           একটি অনৈতিহাসিক ঘটনাকে ঐতিহাসিক বলে চালানো নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারের পরিবর্তন বিরাট কিছু নয়। এমনকী ওই পরিবর্তনের পিছনে যন্ত্রণার বিস্তৃত বিবরণ থাকলেও নয়। অতীতে এ দেশেও তো এমন ঘটনা কম ঘটেনি! দুর্ঘটনা, লোভ বা অজ্ঞাত এমন একটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে হইহই করাটা বিরোধী রাজনীতিকদের নেহাত বাড়াবাড়ি। সংবাদমাধ্যমের একটি অংশের অতিশয়োক্তির প্রতি অতিবিশ্বাসও শাসকদলের বা বিরোধীদলের পক্ষে বাস্তবতার নিরিখে হচ্ছে না। যতটা বিবৃত হলো ততটা রূপায়িত হলো না। এ সুযোগ চতুরেরা ছাড়ে না। কোমরে গামছা বেঁধে তারাও এখন আসছে। বিতর্ক-বিবাদে ক্রমশ অশান্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গন। মন্ত্রিসভা, কিংবা সরকারি বা বিরোধীদলের কাজের পক্ষে এমন পরিবেশ মোটেই শুভ নয়! দুষ্টজনের মুখেও মিষ্ট কথা আরম্ভ হয়েছে। শাসক-নেতৃত্বকেই এটা প্রাধান্য দিয়ে ভাবতে হবে।
কেবলবৈষয়িক উন্নতিই নয়, উন্মুক্ত হোক মুক্তির চেতনার আকাশ। শহরে-গ্রামে-গঞ্জে, গণমানুষ গণতন্ত্র ফিরে পাক। পথঘাট-কলকারখানা-চাষবাস-বিদ্যালয়-শুশ্রুষাকেন্দ্র; এ-সব তো থাকছেই, তবে তার চেয়েও যা জরুরি তা হল অধিকার-যা কিনা ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল চারদলীয় জোটের হাতে। তাই শান্তি-শৃঙ্খলা-সন্তোষ-স্নিগ্ধতা জীবনে; এগুলোই চায় মানুষ। এ চাওয়ার বোধ সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় চাহিদা। অথচ এ চাওয়া, এ প্রাপ্তি এখনও অধরা। যত ছোটই হোক, অশান্তির চরিত্র যে অশনির দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে তা সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে।
বাংলাদেশে মানুষের কাছে উন্নয়ন মানে দু’বেলার দু’মুঠো ভাত। আর এরই সঙ্গে অন্যসব প্রয়োজনের কিছুটাও মেটে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। উন্নয়নের বান ডাকালেই যে সার্থকনামা, এ সিদ্ধান্তও সঠিক নয়। যেটুকু যা, তার সবটুকুই তো বড়লোকের ভাগে। গরিবের ভরসা কী?
গোলমালটা মূলেই রয়েছে। একদিকে বিশ্বায়ন এবং আর্থিক সংস্কারের জেরে সাধারণ মানুষ জেরবার। অন্যদিকে ধনবৈষম্যের বাড়বাড়ন্তে ঈর্ষার বৃদ্ধি। সমাজে আর্থিকভাবে ভারাক্রান্ত শ্রীহীন অংশটি ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, সংখ্যাগুরু মানুষের মরিয়াভাব বাড়ছে। ফলে সামাজিক ভারসাম্যের স্তরচ্যুতি, মূল্যবোধের ক্রম-অবলুপ্তি, শৃঙ্খল ভাঙার আওয়াজ তুলে শৃঙ্খলাতেই আঘাত। সমাজের প্রায় সব ঘটনাতেই এই প্রবণতার প্রাদুর্ভাব। আপাতদৃষ্টে একেই এখন আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলা হচ্ছে। কিন্তু তা নয়। আসলে এটি সর্বনাশা ঝোঁক, ক্রোধের অনর্থ, ভাঙনের ভীষন্নতা। এ প্রবণতার প্রাবল্য গোটা দেশ জুড়ে। বিশ্বায়নের হাত ধরে পুঁজিবাদী উন্নয়নই আর্থিক অগ্রগতির একমাত্র পথ, এতেই অশান্তির অবসান, সব সমস্যার সমাধান; এই বিশ্বাসই অনর্থের জন্য দায়ী। সবই অনৈতিক রাজনীতির কুফল। প্রশাসনিকভাবে কোনও সরকারের পক্ষেই এ অঘটনের স্থায়ী নিরসন করা অসম্ভব। এমনকী আয়ত্তে রাখাও আয়াসসাধ্য ব্যাপার। আবার প্রথাগত পুঁজিবাদী উন্নয়নও এর সমাধান নয়।
বৈষম্যের সঙ্গে বিরতিহীন বিরোধ এবং দুই সমাজের শিক্ষাগত সংস্কার-ভাবনায়-ভাষণে-লেখনীতে-শিল্পে-সাহিত্যে সর্বত্র, অশান্তির মূল কারণ পর্যবেক্ষণের, বিশ্লেষণে। আদর্শহীন রাজনীতিকদের বহিষ্কার। দলকে ঢেলে সাজানো। পারবেন কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ পথে হাঁটতে? মানুষকে হাঁটাতে? পারলে ইতিহাসও তাঁর পাশাপাশি হাঁটবে এবং সেই সঙ্গে মানুষও।

সম্মানিত প্রধানমন্ত্রী! মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করেছে। এখনও সে বিশ্বাস অটুট। তাই ডাক দিন। ঘরে ঘরে ডাক পাঠান। দলতন্ত্র নিকেশ হোক, দলবাজি নিপাত যাক, ধর্মের নামে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি দূর হোক, ধর্মান্ধতা দূর হোক প্রশাসন নিরপেক্ষ হোক-কঠোরতম নিরপেক্ষতা শাসনের ধর্ম হোক, স্বচ্ছতা সর্বাঙ্গের ভূষণ হোক। প্রমাণ করুন কেবল একটি দেশের-একটি দলের মামুলি প্রধানমন্ত্রীই নন, আপনি তার চেয়ে অনেক বড়; মহৎ কোনও উদ্দেশ্যের অভিযাত্রী! দল আছে, থাকবেও; কিন্তু প্রমাণ করুন দলের চেয়ে দেশ বড়, মা হিসাবে মানুষের প্রতি দায় আরও বড়। সময়ও লাগবে অনেক। তা লাগে তো লাগুক। কত সময়ই তো নষ্ট করেছি আমরা। আমাদের মতো সাধারণ যারা তারা তো অপেক্ষাতেই আছে। সেই কতকাল, কতযুগ ধরে। 

প্রতিরোধে চাই যুবসমাজ নেতৃত্ব

সময়ের সাফকথা....
প্রতিরোধে চাই যুবসমাজ নেতৃত্ব

সংলাপ ॥ সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়েই রুখতে হবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে। মানুষের জীবনধারণের সংগ্রামকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া লাগবে, যাতে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। সেই লড়াই করার জায়গায় কি আছে রাজনীতিকরা? আন্দোলন আছে? এমন আন্দোলন, যা উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী  আগ্রাসনকে রুখে দিতে পারে? রাজনীতিকরা এটুকুও বলে উঠতে পারল না যে, এখন ধর্মের নামে সন্ত্রাস দেশের বড় শত্রু। আমরা বাংলার কথা ভাবি। বাংলায় সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে, অগ্রাধিকার এখানেই।
ধর্মীয় অনুভূতির আওয়াজ নিজেদের গলায় তুলে নিয়ে ভয়ঙ্কর শক্তিকে প্রতিহত করা যাবে না। ধর্মাচরণের অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত। যে যার ধর্মাচরণ করবেন, অন্য ধর্মাবলম্বীদের শত্রু ভাববেন না, ঠিক কথা। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মাচরণ করি না, কিন্তু কেউ হিন্দু বা মুসলমান বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান হিসেবে ধর্মাচরণ করেন সেখানে নাস্তিকতার বড়াই করব না। এটাও এক রকমের সহিষ্ণুতা।
আসছে আগ্রাসন বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই। ধর্মাচরণ ছিল, হিন্দু-মুসলমান ছিলেন, আছেন, কিন্তু হিংস্রতা ছিল না। বাংলার গর্বকে তছনছ করে দেয়ার বক্তব্যও ছিল না। এসে যখন গেছে, প্রতিহত করতে হবে। বাংলার বৈশিষ্ট্য সহজিয়া ধর্মের চলন। প্রথম ও প্রধান পরিচয় ‘বাঙালি’, এই ভাবনায় উদ্ভাসিত আমরা একসঙ্গে থেকেছি, এতটাই মসৃণভাবে মিশেছি যে, খুচরো সঙ্ঘর্ষও ফণা তুলতে পারেনি।
ধর্মীয় সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিতে চাইছে। সাধারণ বাঙালিরা এর মধ্যে থাকছেন না। বিরল ব্যতিক্রম থাকতে পারে। ভয়ঙ্কর ভাবনা ও বিপুল অর্থ ছড়িয়ে ধর্মজীবীরা সন্ত্রাসের শিবির গড়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ বাঙালি মুসলমান সাড়া দিচ্ছেনা। মদতদাতা অবাঙালি দেশের বাহিরের শক্তি। বাঙালি রাজনীতিকরা ‘বহিরাগত’ আগ্রাসীদের সহায়ক। তলে তলে রাজনৈতিক ইসলাম অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা প্রসারিত করার চেষ্টা চলছে বহু বছর ধরেই। এখন ব্যাপারটা যে জায়গায় এসেছে, প্রতিরোধের দেয়াল তুলতেই হবে। যে দেয়ালে মাথা ঠুকে পশ্চাদপসরণ করতে হবে ওদের। কোথাকার ওহাবী ইসলামপন্থীরা এসে আমাদের বাংলাকে বিষাক্ত করে দিয়ে যাবেন, বাঙালি তা মানবে না এবং স্রেফ ‘মানব না’ বলে বসেও থাকবে না। বাঙালির হাতে আছে প্রতিরোধের সহিষ্ণু ও শক্তিশালী অস্ত্র।
রাজনৈতিক লড়াই চলছে, চলুক। সাধারণ বাঙালি হিসেবে আমাদের অস্ত্রের নাম বাঙালিয়ানা। বাঙালিত্ব। সহজিয়া ধর্মের চলন আমাদের ঐতিহ্য। সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমায় আন্তরিক সহিষ্ণুতা আমাদের উত্তরাধিকার। বাংলাদেশের  উগ্রবাদী মুসলমানরা হুমকি দিয়েছিল, নববর্ষের মিছিল উৎসব করতে দেবে না। কিন্তু হয়েছে-হবে। নববর্ষ হয়ে উঠুক বড় উৎসব, যেখানে অস্ত্রের আস্ফালন নেই, আছে চিরকালের বাঙালিয়ানার উজ্জ্বল উদ্যাপন। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান, কিন্তু আমরা বাঙালি। এই বাঙালিয়ানার স্নিগ্ধ অস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ।
এতদিন ছিল গণতন্ত্র ধ্বংসকারী, স্বৈরতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা। এবার তার দোসর হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। রাজনীতিকদের হাতে সত্য যেমন বিপন্ন তেমনি সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার রাস্তাও অবরুদ্ধ। আবার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক মেরুকরণ জোরদার করার ষড়যন্ত্র চলছে।
বিপন্ন হয়ে পড়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য-সম্প্রীতি। বাংলায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এই বিপন্নতা এক ভয়াবহ ধ্বংসের বার্তা দিচ্ছে।
বাংলাকে, বাংলার মানুষকে এবং বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে হলে আর কালক্ষেপনের সুযোগ নেই। যুব সমাজকে এখন ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সর্বশক্তি নিয়ে। সব ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও খেটে খাওয়া মানুষকে জোটবদ্ধ করে নামতে হবে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ময়দানে। একাজ যুবসাজ ছাড়া আর কেউ করবে না। তাই বিপন্ন বাংলার ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে যুবসাজকেই। যুবসমাজই পারবে বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মোকাবিলা করতে। আসন্ন এই লড়াইয়ের মহড়া শুরু হয়ে গেছে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়।
বাংলার রাজনৈতিক পরিসরকে ভাগাভাগি করে নিতে চায় অসাধু রাজনীতিকরা। অর্থাৎ বাংলার মানুষের জীবনে বিপন্নতাকে স্থায়ী রূপ দিতে চায়। তারা চাইছে ধর্মীয়, সম্প্রদায় ও জাত-পাতের ভিত্তিতে সমাজকে ভাগ করে দিতে। তারপর সেই বিদ্বেষ, বিচ্ছিন্নতাকে রাজনৈতিক মেরুকরণে রূপান্তরিত করতে। একাজটাকেই আশ্চর্যজনকভাবে সহজ করে দিচ্ছে আমলারা। তারা সাহায্য করছে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবিষ ছড়াতে। অপরাধীদের আড়াল করতেই  সাজানো হচ্ছে তদন্তের অভিমুখ। স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে গোপন বোঝাপড়া।
ধর্মীয় উগ্রবাদী শক্তিকে রুখতে না পারলে বাংলার সর্বনাশ অনিবার্য। গণতন্ত্র এমনিতেই ধ্বংসের পথে। সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিত্য জ্বলছে বাংলার মাটি। লড়াই চলবে ধর্ম নিয়ে। রুজির প্রশ্ন উবে যাবে। জীবিকা নির্বাহ করাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। শিক্ষা ব্যবস্থা রসাতলে যাবে। দুর্নীতি ছাড়া চাকরি নেই। শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। দারিদ্র্য আরও বেশি গ্রাস করবে। ক্রমশ বাড়বে  সরকারের ঋণনির্ভরতা। মানুষের মজুরি বাড়বে না। আয় কমবে। অন্যদিকে বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়। বাড়বে সব সাধারণ জিনিসের দাম। মানুষের এই জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে কোথাও নেই রাজনীতিকরা। থাকবেও না। তারা শুধু ক্ষমতা চায়। লুটপাট চায়। এই লড়াই একমাত্র যুবসমাজের কাজ। বাংলাকে, বাংলার মানুষকে রক্ষার লড়াই এখন যুবসমাজের কাজ। তার জন্যই ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে সাংস্কৃতিক অভিযানের ডাক। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে বিপদের কথা। তাদের শামিল করতে হবে এই অভিযানে।
অপরদিকে, যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতির মূল কথা জনসমর্থন। সব ক্ষেত্রেই জনমত অর্থাৎ সংখ্যা গরিষ্ঠের মতই যথার্থ কি না, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু গণতন্ত্রে সংখ্যা গরিষ্ঠের মতই যে চূড়ান্ত, তা নিয়ে কোনও তর্ক চলে না। তাই দখলদারির রাজনীতিতে মেতে জনাদেশকে অস্বীকার করার প্রবণতা গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু তেমনই ঘটছে।
অভিযোগ অস্বীকার করলেই দায়মুক্ত হওয়া যায় না। প্রথমত, দেশের শাসক দল, তাদের দায় অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, সঙ্ঘাত বার বার সেখানেই তীব্র হচ্ছে, যেখানে বিরোধী দলগুলোর প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। তাই শাসক দলের দিকে আঙুল ওঠা খুব স্বাভাবিক নয় কি?   
সব ‘আমাদের’ হবে, ‘আমরা’ সবাই জিতব, ‘আমরা’ সর্বত্র জিতব, সব কিছু ‘আমাদের’ দখলেই থাকবে এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় সঙ্ঘাত। আর এই মানসিকতার জন্ম হয় গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত এক রাজনৈতিক কানাগলি থেকে। এই সব কানাগলির মালিক রাজনীতিকের মুখোশ পরা কিছু দখলদার। এই দখলদাররা শুধু সরকারের দখল নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না, সমগ্র গণতান্ত্রিক পরিসরকেই এরা গ্রাস করতে চায়। সেই কারণেই রাজনীতিকরা আক্রান্ত হন, বিরোধী রাজনীতিকদেরকে পথে নামতে দেখলেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, কোন রাজনীতিক দল বদলে রাজি না হওয়ার পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়।

বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে শাসক দল। এ দেশের প্রতিটি জনাদেশের মর্যাদা রক্ষা করার দায় তাদেরই। সে দায়িত্ব যদি পালন করতে পারেন, তাদেরও মঙ্গল, গণতন্ত্রেরও মঙ্গল। আর জনাদেশের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা যদি বিস্মৃত হন, তা হলে কিন্তু দলও এক দিন কানাগলির মালিকদের ষড়যন্ত্রে দখল হয়ে যেতে পারে। এটাই বাস্তবতা। 

শ্রমিক সমাজে আদর্শিক নেতৃত্বের অভাব!

শ্রমিক সমাজে
আদর্শিক নেতৃত্বের অভাব!

সংলাপ ॥ প্রতিবছরই পালিত হচ্ছে মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিজীবীরা সোচ্চার বক্তব্যও দিচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া কি কখনই সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হচ্ছে?
আদর্শহীন শ্রমিক রাজনীতিক শ্রেণীর হাতে শ্রমিকেরা চিরকালই নিগৃহীত। অথচ এদের শ্রমের বিনিময়েই আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের ডানা মেলেছে। বর্তমানে দেশের উন্নতিতে অংশীদারিত্ব থাকলেও শ্রমিক শ্রেণী আজ আর তাদের শ্রেণী স্বার্থে সোচ্চার হতে পারছে না। জোরদার কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না মালিক তথা রাজনীতিক শোষকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন? কেন আজ তারা বিচ্ছিন্ন? নিজেদের দাবি তো নিজেদেরই আদায় করে নিতে হবে। রাজনীতিকরা বা আদর্শহীন শ্রমিক নেতারা কখনই স্বেচ্ছায় চাইবে না তাদের একচ্ছত্র প্রভুত্বকে বিসর্জন দিতে।
এ দেশে শ্রমিক শ্রেণী কখনই শ্রেণী স্বার্থ চেতনায় ঘটাতে পারেনি যথার্থ পরিবর্তন। শ্রমিকদের স্বার্থে গঠিত ট্রেড ইউনিয়ন পরিণত হয়েছে শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখার যাঁতাকলে। নেতৃবৃন্দের কোন্দল, দলীয় ও ব্যক্তিক স্বার্থ, শ্রমিকদের কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। দেশ স্বাধীনের পর যখন রাজনীতির ভূত চেপে বসল শ্রমিকদের ঘাড়ে তখন তারা হারিয়ে ফেললো স্বাধীন সত্তা। রাজনৈতিক ক্ষমতার দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে চললো তারা। রাজনৈতিক স্বার্থই তখন তাদের কাছে প্রধান হয়ে গেল। সাধারণ শ্রমিকেরা তাদের আদর্শহীন রাজনীতির খেলার পুতুলে পরিণত হলো। নিত্যদিন যাদের শ্রম ব্যবহার হচ্ছে তাদের মূল্যায়ন নেই, নেই ন্যায্য পারিশ্রমিক। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার চরম অভিশাপ। বর্তমান নিরক্ষরতার হার প্রায় ৬০.৯%। আর শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এই নিরক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন না হওয়ায় সত্য ও আদর্শের পথে তারা সচেতন হতে পারছে না নিজের অধিকার সম্পর্কে। ফলে খুব সহজেই তারা প্রতারিত হচ্ছে রাজনৈতিক দলের দালাল শ্রেণীর হাতে।
দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজ শ্রমিকেরা নিষ্পেষিত। দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং প্রধান ক্ষেত্র কৃষিতে কর্মরত শ্রমিক শ্রেণী চরম অবহেলিত। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৩% লোক এই কৃষি কর্মের সাথে জড়িত। কিন্তু কোন সরকারই এই কৃষিকে উন্নত করতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও সার ব্যবহারকে নিশ্চিত করেনি। বরঞ্চ প্রাকৃতিকভাবে এবং মহাজন, ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের দ্বারা তারা বঞ্চিত হচ্ছে ফসলের ন্যায্য পাওনা ও দাম থেকে। কৃষিখাত থেকে বঞ্চিত শ্রমিকেরাই একদিন পা বাড়ায় শহরে। কাজ নেয় বিভিন্ন শিল্প, কল-কারখানায়। কিন্তু সেখানেও তারা শোষণের শিকার। শিল্প-কারখানার মালিকেরা ধার ধারে না শ্রম আইনের। অধিক শ্রম খাটিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন থাকে তাদের একমাত্র লক্ষ্য। তারা কখনই শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় না।
দেশের বর্তমান সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হচ্ছে পোশাক শিল্প। প্রায় ৬০% বৈদেশিক মুদ্রা আসে এই খাত থেকে। এই খাতে দেশের প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে। এইসব শ্রমিকদেরও নানাভাবে বঞ্চিত করা হয় ন্যায্য মজুরি থেকে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার নির্ধারিত মজুরি ব্যবস্থা কোথাও মেনে চলা হয় না। অথচ দেশে রয়েছে শ্রম অধিদপ্তর। শ্রমঅধিদপ্তর দেশ ও শ্রমিকশ্রেণীরনৈতিক স্বার্থে কাজ করে না। টাকার লোভে মুনাফাখোর মালিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থেই তারা নিবেদিত। শ্রমআইন ও আদালত থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ আজ উপেক্ষিত।

সবক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের দ্বারা শ্রমিকেরা প্রতারিত হয়েও প্রতিকারের কোন পথ তারা আজও সৃষ্টি করতে পারেনি। রাজনৈতিক স্বার্থেই তারা বন্দি। মে দিবসে শ্রমিকদের নিজস্ব শ্রেণীগত অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তা প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার একান্ত প্রয়োজন থাকলেও তারা তা করতে পারছে না কারণ ওই দিনটাতেও দারিদ্র্যের কষাঘাতে ও সাময়িক লাভের জন্য নিজেদের বিক্রি করে দিয়ে আদর্শহীন রাজনীতিকদের সভায় হাজির হয়ে স্লোগান দিচ্ছে - ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। মে দিবস উদযাপন সভায় হাজির হওয়ার জন্য তারা ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। তাদের ভয় দেখানো হয় যদি হাজির না হয় তাহলে রাজনৈতিক চক্রের হাত থেকে মুক্তির সনদ তারা কোনদিনই অর্জন করতে পারবে না। রাজনৈতিক স্বার্থের তল্পিবাহক মিথ্যাচারের ট্রেড ইউনিয়নের কবল থেকে এখনই বের করে আনতে হবে শ্রমিক শ্রেণীকে এবং তার জন্য চাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আদর্শিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব। 

দিন বদলে শ্রমিক আন্দোলন

দিন বদলে শ্রমিক আন্দোলন

সংলাপ ॥ সঙ্কটের আবর্তে নিমজ্জমান বিশ্ব আধিপত্যবাদের ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া প্রয়াসে ক্রমাগত প্রান্তসীমার দিকে অপসারিত শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের জ্বলন্ত বাস্তবতার মধ্যে উদ্যাপিত হলো এবারের মে দিবস। পুঁজিবাদ তার সর্বগ্রাসী থাবা নিয়ে গোটা বিশ্বকে যত শুষে খেতে চাইছে ততোই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক ক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে প্রচলিত অসাম্যের ও বিভেদের সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ফলে সামাজিক অসন্তোষ বাড়ছে। উদ্ভব হচ্ছে বিস্ফোরক পরিস্থিতি। প্রতিনিয়ত বিশ্বের কোনা না কোনো দেশে ঘটছে তার তেজোদীপ্ত বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক পুঁজিবাদীদের উচ্চমার্গীয় কলাকৌশল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত হবার ক্ষেত্রে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শ্রম দিতে দিতে নিঃস্বপ্রায় শ্রমিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিবাদী মানসিকতাকে ওই বাধা-প্রতিবন্ধকতা আটকে রাখতে পারছে না। তাই যেখানে যেমন বাস্তব অবস্থা সেখানে তেমনভাবেই শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষোভের, প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। আর সেই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলনের গর্ভ থেকে জেগে উঠছে নতুন চেতনা যা তাদের সংগঠিত হবার এবং ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা জোগাচ্ছে। এটাই শ্রমিকশ্রেণীর বৈশিষ্ট্য। তারা সৃষ্টি করে, উৎপাদন করে, শ্রমদান করে কিন্তু তাদের তৈরি সম্পদে তাদের অধিকার থাকে না। এই ব্যবস্থাকে বদলিয়ে নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখা শ্রমিকশ্রেণীর সহজাত।
শ্রমিকশ্রেণীর এই সহজাত প্রত্যাশারই বাস্তব রূপ সাংস্কৃতিক বিপ্লব দিন বদলের পালায়। শ্রমিকশ্রেণীর স্বাভাবিক প্রবণতাই হলো সামাজিক ন্যায়, সম্পদের সুষম বণ্টন। শ্রমের উপযুক্ত মূল্যদান ও মর্যাদা, সংখ্যাগরিষ্ঠের শ্রম শোষণের ওপর দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘুর মুনাফা সৃষ্টির ব্যবস্থাকে বদলানো। এই প্রবণতাই শ্রমিকশ্রেণীর ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে। শ্রমিকশ্রেণীর আশু দাবির মধ্যে সাধারণভাবে ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকলেও এই আন্দোলনের বিকাশের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়। তারা রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে চিনতে শুরু করেন। আধিপাত্যবাদীরা এটা জানে, তাই তারা পদে পদে শ্রমিকদের সংগঠিত হবার আন্দোলন করার চেষ্টাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। মালিকশ্রেণীর এইসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শ্রমিকদের সচেতন থেকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হবার বার্তা দেয় মে দিবস। বিশ্বে শোষিত মানুষের সৌভাতৃত্ববোধ এবং সংহতির চেতনাই পারে শ্রমিকশ্রেণীর প্রত্যাশা পূরণের পথ সুগম করতে। শ্রমিকশ্রেণীর জীবনসংগ্রামে মে দিবস প্রতিবছরই জোট বাঁধার নতুন প্রেরণা জুগিয়ে যায়। আজ দেশজুড়ে উদারনীতির নামে পুঁজিবাদ মেহনতী মানুষের প্রান্তিকীকরণ দ্রুততর করছে। বিচ্ছিন্নতাবাদ,নৈরাজ্যবাদ, ধর্মীয় উগ্রতা ও হিংস্রতার শক্তি খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করছে। সমাজ বদলের দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আশু সংগ্রামও জরুরি হয়ে পড়েছে। এবারের মে দিবস শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংহত করার পথ কি প্রশস্ত করতে পারবে? 

বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

শেকড়ে শান্তি ও সত্যপ্রিয় বাঙালি

শেকড়ে শান্তি ও সত্যপ্রিয় বাঙালি

· তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং মিথ্যাকে ব্যর্থ করেন - যদিও অপরাধীরা ইহা অপছন্দ করুক না কেন। ৮:৮।
· আল্লাহ্ নিজ কালাম সমূহ দ্বারা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন যদিও অপরাধীগণ ইহাকে অপছন্দ করে। ১০:৮৩।
· আমরা তাহাদিগকে কর্ণ, চক্ষু এবং হৃদয় দান করিয়াছিলাম। কিন্তু তাহাদের কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় কোন কিছুই তাহাদের উপকারে আসিল না; কারণ তাহারা অস্বীকার করিত এবং যে আযাব লইয়া তাহারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করিত উহাই তাহাদিগকে পরিবেষ্টন করিয়া ফেলিল। ৪৬:২৭।
·  সত্যকে মিথ্যা বলিয়া প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য দুর্ভোগ। ৮৩:১১।

সংলাপ ॥ একরৈখিকভাবে লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে চিন্তাপ্রবাহের মাঝে ভ্রাম্যমান থাকলে বিবেকের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। আর বিবেক থেকে উদ্ভব হয় চেতনা। চেতনাকে সুদৃঢ় করে যুক্তি। চেতনা স্থান-কাল-পাত্রের উপর নির্ভরশীল। বস্তুবাদী দর্শনের বিষয়বস্তুর মতো ধর্মীয় দর্শনের বিষয়বস্তু সমূহ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল। বস্তু যেমন গতিশীল ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ঠিক তেমনি মানুষের ধর্ম ও ধর্মচিন্তা ছিল-আছে-থাকবে গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ সদা সর্বদাই পুরাতন থেকে নতুনের উত্তরণ এবং উর্দ্ধমুখী। তাই ধর্ম সর্ব সময়ে বর্তমান।
মানব সমাজে ধর্ম কোন বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা নয়। প্রাকৃতিক দেহ সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার, সংস্কার ও সংকীর্ণতার মূল খুঁজতে গেলেই ধর্মের উৎপত্তি পাওয়া সহজ হবে। ধর্ম যখন আধিপত্যবাদীদের (তা সমাজের, রাষ্ট্রের যে অঙ্গনে বা স্তরেই হোক না কেন) হাতিয়ার হয়ে যায় তখন ধর্মের ভয়াবহ রূপ ধরা পড়ে মানবসমাজে উগ্র ধর্মান্ধতা হয়ে।
আধিপত্যবাদীরা সব সময়েই ধর্মকে ছলে-বলে-কলে কৌশলে এমনভাবে মোড়ক দিয়ে রেখে আসছে যাতে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের আসল রূপ ‘শান্তি’ ও ‘সত্য’ না বেরিয়ে পড়ে। তাই ধর্মের প্রগতিশীলতা মেহনতি মানুষের হাতিয়ার হতে পারেনি, এখনও পারছে না, আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে একনিষ্ঠ, শান্তিপ্রিয়, সত্যবাদী, নির্ভীক, দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের দল ও সরকার। শ্রমজীবী মানুষ ধর্মভীরু, পরিশ্রমী বিশেষ করে বাংলাদেশে। সমাজ কাঠামো পরিবর্তন করে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধর্ম যে প্রাকৃতিক, স্ব-ভাব, শান্তি ও সত্যের আধার তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা। শুধু তাই নয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ধর্মের বা জীবন চলার পথে, মানুষের প্রগতির পথে পরিবর্তনের সহায়ক, এটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যারা সত্যকার দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত প্রাণ হতে চায় তাদের প্রথমে শান্তি ধর্মের মূল্যবোধগুলো ধারণ-লালন-পালন করতে হবে। সার্বিক শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে আধিপত্যবাদীদের - এটাই প্রকৃত ধার্মিকের কাজ।
বাংলাদেশের বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৌদি ইসলামের ধর্ম-ব্যবসায়ী, ধর্মবেত্তারা এমনভাবে ঢুকে পড়ে মিথ্যাচারের প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে যাতে মনে হয় রাজনীতিকরা আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। শ্রমজীবী মানুষকে তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে, বেহেস্তের প্রলোভন দেখিয়ে, ভবিষ্যতের কথা বলে মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধর্মের নামে ব্যবসার জাল বিছিয়ে শোষণ এবং শাসন করে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে উঠতি রাজনীতিক লুটেরা শ্রেণী। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিকদের উপর থেকে আস্থা হারাতে হারাতে এমন এক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, যে কোন সময়ে যে কোন অঙ্গনে কোন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।
তাই মিথ্যাচার ছেড়ে দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনীতিকরা রাজনীতি করুন, ধর্ম-ব্যবসায়ী ধর্মবেত্তারাও ধর্মজীবী না হয়ে ধর্মের সত্যকে তুলে ধরুন, নচেৎ সময় আসছে আপনাদের কথাও কেউ কানে নেবে না।

বাংলাদেশে আপনাদের চেহারা জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আপনারা নবী মুহাম্মদ (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর ধর্ম ইসলাম (শান্তি) প্রতিষ্ঠার জন্য কোন কর্মকা- করছেন না বরং ওহাবী-এজিদি-মওদুদী পন্থা অনুসরণ করে মুখে মুহাম্মদী ইসলামের কথা বলে সম্পদের পাহাড় বানানোয় ব্যস্ত। দেশবাসী আপনাদের সব সম্পদের খবর পেয়ে গেছে। জনগণ রুখে দাঁড়ালে মধ্যপ্রাচ্যের পোশাক ও সংস্কৃতি আপনাদের জন্য কাজে লাগবে না। অদূর ভবিষ্যতের জন্য রাজনীতিক সহ পেশাজীবীরা সজাগ হোন। সময় ও পরিবেশ কাউকে ছাড় দেয় না। কেহই আল্লাহ্র আইনের বাইরে নয়। এটাই স্মরণ রাখার চেষ্টা করলে জাতির জন্য শ্রেয় এবং দেশের উন্নতির জন্য চলার পথে সহায়ক হবে। 

সময়ের সাফ কথা.... অজ্ঞতার অন্ধকারে

সময়ের সাফকথা....
অজ্ঞতার অন্ধকারে

সংলাপ ॥ মৌলবাদ শব্দটির উৎপত্তি আশির দশকে। পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা ফান্ডামেন্টালিজম-এর বাংলা করতে গিয়ে এই ‘মৌলবাদ’ শব্দটি গণমাধ্যমে চালু করে। শেকড়ের সন্ধানে না গিয়ে, এখন এই শব্দটি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর রাজনীতিকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশেও। আমেরিকার রক্ষণশীল প্রোটেষ্ট্যান্টরা খ্রীষ্টান ধর্মের কতগুলো মৌল সত্য ধরে নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলো বলে তাদের বলা হতো ফান্ডামেন্টালিস্ট। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বা ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য ছিল না। এই আন্দোলন পর্যালোচনা করে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী পশ্চিমারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো যে, ধর্মের নামে উগ্রপন্থী তৈরি করে ও তাদের রসদ জুগিয়ে যে কোন দেশে উন্নতিতে বাধা দেয়া এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা সহজ। ফলে সেই দেশ তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে ও চাটুকার হয়ে পড়বে দু’মুঠো ভাতের জন্য। এর প্রভাব পড়ে বিশেষ করে মুসলমান বিশ্বে। তারা প্রতিটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশে ধর্মের নামে উগ্রবাদী তৈরি করে তাদেরকে রসদ জোগাতে লাগল মুসলমান-মুসলমানের মধ্যে লড়াইয়ের জন্য। আজও সেই ধারা বর্তমান। আজও অজ্ঞ মুসলমানরা প্রতিটি দেশে মেতে আছে আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা ও চর্যা না করেধর্মান্ধ হয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে চলছে। ফলে রাষ্ট্রের উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই উগ্রপন্থীরা চিৎকার করে ধর্ম গেল বলে, বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামি শরিয়া প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নাম করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাবার জন্য তারা এতো উন্মাদ হয়ে উঠেছে যে সমাজে যে কোন ধরনের সন্ত্রাস ও মিথ্যা ফতোয়া থেকে আরম্ভ করে যে কোন জঘন্য কাজ, খুন, ডাকাতি, নির্যাতন, অগ্নি-সংযোগ ইত্যাদি সব কিছু তারা করছে। জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের লক্ষ্য নেই। বর্তমানে সন্ত্রাস আর এই ধর্মান্ধতা দেখে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তাদেরকে আখ্যায়িত করছে মৌলবাদী বলে।

অপ্রিয়হলেও সত্য পৃথিবীর কোন মুসলমান রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ মোহাম্মদী ইসলাম আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় নাই বা করার প্রচেষ্টাও নেয়া হয় নাই। কারণ হিসেবে পাওয়া যায় - ‘শান্তি ও মানবতার’ ধর্ম রূপান্তরিত হয়ে চলছে ‘ব্যক্তি স্বার্থের’ ধর্মে নবী করীম (যাঁর কৃপা আমাদের উপর বর্ষিত হোক)-এঁর ওফাতের পর থেকে আজও।

তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব অর্জন করার এখনই সময়

তরুণ প্রজন্মের
নেতৃত্ব অর্জন করার এখনই সময়

* সত্যের জাগরণে * ধর্মীয় সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে * বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি রোধে * সম্পদের সুষম বন্টনে * ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে *ধৈর্যশীল ও স্বনির্ভরশীল হতে * দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে * দেশবাসী চায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তির মহাজোট।

সমস্যাকে জিইয়ে রাখা নয়। কূটনীতিজ্ঞ নেতা তিনিই, যিনি সমস্যার যথাযথ এবং দ্রুত সমাধান করেন। ২০২০ সালে উন্নত দেশে পরিণত হতে গেলে বাংলাদেশে সর্বস্তরে একরৈখিক নিষ্ঠাবান নেতৃত্বের দরকার। নেতা তিনিই, যিনি নিজের বিচার নিজে করে নিজের পথ নিজেইতৈরি করেন। তাঁর মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার গুণ থাকতে হয়। লক্ষ্যভিত্তিক দৃঢ় প্রত্যয়ী হলেই আসল নেতা হওয়া যায়।

সংলাপ ॥ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারও কারও চিন্তায় হাসিনা সরকারের পক্ষে জনসমর্থন বেশ কিছুটা কমে গেছে। যারা এসব চিন্তায় মগ্ন তারা ভুল ভাবছেন। ভেবে যদি ভাল লাগে, ভাবতে পারেন। বাস্তব হলো এই যে, ক্ষমতায় আসার সুবাদে আরও খানিকটা শক্তি বাড়াতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। সুসময়ে অনেক বন্ধু জড়ো হয়েছেন। তাদের প্রভাবও সামান্য নয়। সমালোচনার অনেক জায়গা আছে, কিন্তু হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কমেনি। জাতি ভাবছে দেশের পরিস্থিতি বদলের কথা, ভাবারও কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ এখনও দেখা যাচ্ছে না।
সমাজের নানা স্তরে নানান সমস্যাগুলো বর্তমান সরকারকে বুঝতে সাহায্য করছে, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। অতীতে যে যে ভুল হয়েছিল, চিহ্নিত করা হচ্ছে। সংশোধনের চেষ্টাও আরো দ্রুত করা দরকার।
মতাদর্শগত দলিল তৈরি করার সময় এসেছে। ভোগবাদী জমানায় পোড়খাওয়া কর্মীদের মধ্যেও কেউ কেউ অধঃপতিত হয়েছেন, সেখানে সংগঠন শক্তিশালী করার কাজটা খুবই জরুরি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুবিধা না পেয়ে বা হতাশায় যারা ভুগছেন, তাদের কথা আলাদা। এরকম হয়েই থাকে। যারা আছেন, তারা কীভাবে নতুন পরিস্থিতি বুঝে লড়াই করতে প্রস্তুত, সেটাই আসল কথা।
দল নির্দিষ্ট কারণে কিছু সদস্যকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অনেকে সরে গেছেন হতাশায়, ভয়ে, কেউ কেউ লোভেও। সংবাদ মাধ্যমে বিপরীত ধর্মী সিন্ডিকেট তৈরি করে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। সংগঠনের মূল শক্তি অক্ষত থাকলে কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা থাকে, শুদ্ধির প্রক্রিয়া চালু থাকে এবং দল এগিয়ে চলে।
সমালোচনা হচ্ছে। স্বাভাবিক। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কারণএকটা নয়, অনেক। কিন্তু সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ভুলত্রুটি নিয়ে সমালোচনা হবে না? না হলে আর রাজনীতি কেন? সমালোচনা হবে, বিতর্ক হবে, আবার নতুন করে লড়াই করার দৃঢ় প্রত্যয় উচ্চারিত হবে, রাস্তায় নামা তো সেজন্যই।
স্তরে স্তরে দুর্নীতি, দুর্ব্যবহার ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ভুলত্রুটি নিয়ে আলোচনা হোক, সমালোচনা হোক, কিন্তু অতীত নিয়েই পড়ে থাকলে হয় না। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবেই। আরও বড় কথা, ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে যথাযথ পথ খুঁজে নিতে হবে, শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে একশো ভাগ, বিরোধী দলের ব্যর্থতার জায়গা চিহ্নিত করে দায়িত্বশীল আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে জনগণকে নিয়ে, যেহেতু জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। কিন্তু, তাই বলে ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে নয়। সংগঠনের পুনর্নির্মাণ  জরুরি।  মানুষের আস্থা আরো বাড়াতে হবে। প্রক্রিয়াটা শুরু হওয়া চাই। শক্তি প্রাসঙ্গিক থাকুক, দ্রব্যমূল্য কম হোক, সন্ত্রাসকে সত্য ও কৌশল দিয়ে প্রতিহত হোক, মিথ্যাচার যুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হোক এটাই আসল কথা। সরকারের সাফল্য আসবে সেই পথ ধরে। ভবিষ্যতের কথা আগে ভেবে লাভ নেই বরং বর্তমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমান রাজনীতির প্রবাহমান সত্য বার্তা জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্যও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক (ছোট বা বড়ো) শক্তির জোরদার মহাজোট চায় দেশবাসী।

সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে দেয়া নয়। কূটনীতিজ্ঞ নেতা তিনিই, যিনি সমস্যার যথাযথ এবং দ্রুত সমাধান করেন। ২০২০ সালে উন্নত দেশে পরিণত হতে গেলে বাংলাদেশে সর্বস্তরে একরৈখিক নিষ্ঠাবান নেতৃত্বের দরকার। নেতা তিনিই, যিনি নিজের বিচার নিজে করে নিজের পথ নিজেইতৈরি করেন। তার মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার গুণ থাকতে হয়। দৃঢ় প্রত্যয় থাকলেই আসল নেতা হওয়া যায়। গড় বার্ষিক উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখা গেলে তবেই বাংলাদেশউন্নত দেশ হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তরুণ প্রজন্মকে জেগে স্বপ্ন দেখা ও লক্ষ্যস্থির রেখেসামনে এগিয়ে যাওয়ার ‘শপথ’ করাতে হবে। লক্ষ্য, উপলব্ধি ও বাস্তবতা-বোধ জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারলে তবেই দেশের উন্নতি সম্ভব। রাজনীতিকদের স্মরণ রাখতে হবে, সব কিছুর পরেও দলের থেকে দেশের স্বার্থ দেখা অনেক বেশি জরুরি। তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিয়ে নেতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করার এখনই সময়।লক্ষ্য, বিচার এবং আদর্শ অন্তরে থাকলে, অনুস্মরণকারী এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী মানুষ হলে তবেই দেশের  তরুণরা যোগ্য নেতা হয়ে উঠতে পারবেন। 

দায়ীদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার হোক দেশের হাওর অঞ্চল এখনও পানিতে তলিয়ে আছে

দায়ীদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার হোক
দেশের হাওর অঞ্চল এখনও পানিতে তলিয়ে আছে

সংলাপ ॥ প্রকৃতির ওপর আঘাত করলে প্রকৃতিও আঘাত করে, প্রতিশোধ নেয়। এই প্রতিশোধের ধরণ ও প্রকৃতি হয়তো ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন হয়। তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এই সময়ে অধিকাংশ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লিপ্সা, কামনা-বাসনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, সে নিজেও জানে না তার আর কী প্রয়োজন। এই অতিরিক্ত চাওয়ার কারণেই প্রকৃতির ওপর হাত দিচ্ছে মানুষ। পাহাড় কাটছে, বাঁধ দিচ্ছে নদীতে, পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির ব্যবহার মানুষকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মানুষকে নিয়ে গেছে এক জগতে, যার সাথে অনেক সময়ই প্রকৃতির বিস্তর ফারাক। একদিকে প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ-সম্পর্ক কমে গেছে, অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। এর সাথে বড় সমস্যাটি হচ্ছে দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা প্রাকৃতিক অবস্থাকে আরও জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে।          
দেশের হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যায় ৯০ ভাগ ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়া, লাখ লাখ কৃষক পরিবারের  সর্বনাশ এবং এর কারণ হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির খবর জেনে-শুনে আতঙ্কিত হতে হচ্ছে। কিন্তু এই অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে কে কে জড়িত সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট করে কিছু প্রকাশ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে নিয়ে আসি, আর চাটার দল খেয়ে ফেলে’। বঙ্গবন্ধু ওই কথাগুলো এখন আরও বেশি স্মরণ হচ্ছে সচেতন ও বিবেকবান মহলে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হাওর অধ্যুষিত এই সাতটি জেলায় সংঘটিত এই বিপর্যয়ের জন্য শুধুমাত্র প্রকৃতি যে দায়ী নয় সে-কথা সংশ্লিষ্ট কারো কাছেই আজ অজানা নয়। খোঁজ নিলেই জানা যায়, হাওরাঞ্চলীয় এই জেলাগুলোর ফসল রক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি নেই। প্রকল্প পাস হয়, অর্থ বরাদ্ধ ও উত্তোলন হয়। প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়। কিন্তু কাজে অগ্রগতি হয় না। মাঠ পর্যায়ের অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ দেয়া ও তদারকী না থাকায় মূলত চলমান প্রকল্পগুলো ঝুলে আছে বছরের পর পর। ফলে উজানে সামান্য বৃষ্টিতে বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যায় কৃষকের ফসল।
সাম্প্রতিক সময়ে হাওরাঞ্চলে বিভিন্ন বাঁধ ভেঙ্গে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, কোন কোন পত্রিকায় দুই হাজার কোটি টাকার শস্য বিনষ্ট হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। আবার কোন কোন পত্রিকায় ৪ হাজার কোটি টাকার ধান নষ্ট হওয়ার খবর বেরিয়েছে। গত ৯ই এপ্রিল রাজধানীর ডিআরইউতে হাওর অ্যাডভোকেসি ফোরাম আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা-এই তিন জেলায় বিপুল পরিমাণ শস্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে হাওরের বাঁধ নির্মাণের সময় পর্যবেক্ষণের জন্য গত ১১-১৩ই মার্চ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর পরিদর্শন করা হয়। এ সময় দেখা যায়, বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর অর্ধেক কাজ অসম্পূর্ণ দেখা গেছে। বাঁধ নির্মাণের শেষ সময় ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেও অনেক বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি। বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে-অনেক জেলায় দেরিতে কাজ শুরু হয়েছে। সময় মতো কাজ শেষ না হওয়ার ফলে অনেক বাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। 
হাওর অ্যাডভোকেসির সংবাদ সম্মেলনে এই ফসলহানির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হাওরের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো সঠিক সময়ে এবং টেকসই কায়দায় ফসল রক্ষা বাঁধ তৈরি এবং মেরামত না করা। এ কাজটি না করায় ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় আটবার হাওরের কৃষক তার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। অথচ এই এক ফসলি বোরো ধানের ওপর হাওরবাসী নির্ভরশীল। অন্যদিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বোরো ফসল পালন করে বিরাট ভূমিকা।
দেশের রাজধানী আর বিভিন্ন শহরে-বন্দরে, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে, ক্ষমতাসীন এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের কয়জন হাওরের এই বিপর্যয় ও তার প্রতিকার নিয়ে চিন্তা করেছেন, সময় দিয়েছেন? বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুই ছিল দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল যেহেতু ক্ষমতায়, সে কারণেই এই দলের নেতা-নেত্রীদের দায়ই সবচেয়ে বেশি। ক্ষমতার অংশীদার তো এরশাদের জাতীয় পার্টিও। আর একটি বড় দল বিএনপি, যারা ক্ষমতায় ছিলেন, আবারও যাওয়ার চেষ্টায় আছেন, তাদের কাউকেও হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয় নিয়ে কথা বলতে, দুর্গত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা গেল না। এমনকি বর্তমানে হাওর অঞ্চল থেকে নির্বাচিত প্রায় ২৫ জন সংসদ সদস্যের কাউকেও কোন রা-শব্দ করতে শোনা গেল না। দেশের মানুষের প্রতি, জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য তারা কতটুকু পালন করছেন এ অবস্থা থেকে তা সহজেই বোঝা যায়।
রাষ্ট্রপতি মো.আবদুল হামিদ হেলিকপ্টারে করে কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। হাওরাঞ্চলের বর্তমান কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, সেখানকার প্রায় দুই কোটি মানুষ সামনের ধান কাটার আগেই নিরন্ন থেকে যাবে। মহাজনের ঋণ, কামলার বেতন পরিশোধ তো দূরের কথা পরিবারের মানুষের খাবারও তারা যোগাড় করতে পারবে না। অন্য দিকে তাদের ঘরের গরুবাছুর লালন-পালনও তারা করতে পারবে না। পশুখাদ্য বা খড় না থাকায় তারা এসব প্রাণীকে বাঁচাতে পারবে না। এখন তারা জমি গরু বাছুর বা জমিও বেঁচতে পারবে না। কেনার মানুষ পাবে না। দূরে নিয়ে গবাদি পশু বেঁচা গেলেও জমি বেঁচা অসম্ভব হয়ে পড়বে। (হাওরের কান্না শুনুন, মোস্তাফা জব্বার, দৈনিক সংবাদ, ১১ই এপ্রিল, ২০১৭)
এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী? খবরে প্রকাশ, ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন অতিরিক্ত প্রকৌশলীসহ (যিনি ২০১০-১১ সালে সুনামগঞ্জে বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন) তিনজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে হাওরের ২৮টি ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ৯ এপ্রিল সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক সভায় জেলার সুধীজন পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী, বিভাগীয় প্রকৌশলী ও সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীকে তুলাধুনা করে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকাশ্যে এই সব প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, দুর্নীতি হয়েছে কি-না তদন্ত করে দেখছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে  বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন।     

হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃত দায়ী যে বা যারাই হোক তাদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে যেন মানুষ-সৃষ্ট এই বিপর্যয় আর না ঘটে সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ আশা করে জাতির বিবেকবান মহল। এই জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবশ্যই অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী, আমলা বা রাজনৈতিক নেতাকর্মী দেশের সরকার বা দলের সকলের জন্যই অকল্যাণ বয়ে আনে। অসৎ ও মিথ্যাবাদী দুষ্টচক্র দেশ ও সমাজের জন্য সব সময়ই ক্ষতিকারক। এ প্রসঙ্গে মহান সূফী সাধক আনোয়ারুল হক-এঁর একটি বাণী স্মরণ করা যেতে পারে-‘বিশ্বাসঘাতকেরা নিজ নিজ কামনায় ধরা পড়ে’। রাজনীতিকদের কারও কারও মুখে আর ঠোঁটে আদর্শের কথা, সরকারের কর্মচারি হিসেবে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরেও কারও কারও  সীমাহীন অর্থ-বিত্ত উপার্জন ও ভোগ-বিলাসে আসক্ত থাকার কারণে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন যারা না করে থাকেন তারাও নিশ্চয়ই বিশ্বাসঘাতক, নিজের সাথে এবং দেশের সাথে, প্রকৃতির সাথে। এদেরকে ছাড় দিলে দেশ ও সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা আরও ভয়াবহ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই হাওরাঞ্চলের এই বিপর্যয়ের সঠিক কারণ বের করে জাতির সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা আজ সময়ের দাবি।