বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০১৭

প্রতিরোধে চাই যুবসমাজ নেতৃত্ব

সময়ের সাফকথা....
প্রতিরোধে চাই যুবসমাজ নেতৃত্ব

সংলাপ ॥ সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়েই রুখতে হবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে। মানুষের জীবনধারণের সংগ্রামকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া লাগবে, যাতে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। সেই লড়াই করার জায়গায় কি আছে রাজনীতিকরা? আন্দোলন আছে? এমন আন্দোলন, যা উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী  আগ্রাসনকে রুখে দিতে পারে? রাজনীতিকরা এটুকুও বলে উঠতে পারল না যে, এখন ধর্মের নামে সন্ত্রাস দেশের বড় শত্রু। আমরা বাংলার কথা ভাবি। বাংলায় সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে, অগ্রাধিকার এখানেই।
ধর্মীয় অনুভূতির আওয়াজ নিজেদের গলায় তুলে নিয়ে ভয়ঙ্কর শক্তিকে প্রতিহত করা যাবে না। ধর্মাচরণের অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত। যে যার ধর্মাচরণ করবেন, অন্য ধর্মাবলম্বীদের শত্রু ভাববেন না, ঠিক কথা। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মাচরণ করি না, কিন্তু কেউ হিন্দু বা মুসলমান বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান হিসেবে ধর্মাচরণ করেন সেখানে নাস্তিকতার বড়াই করব না। এটাও এক রকমের সহিষ্ণুতা।
আসছে আগ্রাসন বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই। ধর্মাচরণ ছিল, হিন্দু-মুসলমান ছিলেন, আছেন, কিন্তু হিংস্রতা ছিল না। বাংলার গর্বকে তছনছ করে দেয়ার বক্তব্যও ছিল না। এসে যখন গেছে, প্রতিহত করতে হবে। বাংলার বৈশিষ্ট্য সহজিয়া ধর্মের চলন। প্রথম ও প্রধান পরিচয় ‘বাঙালি’, এই ভাবনায় উদ্ভাসিত আমরা একসঙ্গে থেকেছি, এতটাই মসৃণভাবে মিশেছি যে, খুচরো সঙ্ঘর্ষও ফণা তুলতে পারেনি।
ধর্মীয় সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিতে চাইছে। সাধারণ বাঙালিরা এর মধ্যে থাকছেন না। বিরল ব্যতিক্রম থাকতে পারে। ভয়ঙ্কর ভাবনা ও বিপুল অর্থ ছড়িয়ে ধর্মজীবীরা সন্ত্রাসের শিবির গড়ার চেষ্টা করছে। সাধারণ বাঙালি মুসলমান সাড়া দিচ্ছেনা। মদতদাতা অবাঙালি দেশের বাহিরের শক্তি। বাঙালি রাজনীতিকরা ‘বহিরাগত’ আগ্রাসীদের সহায়ক। তলে তলে রাজনৈতিক ইসলাম অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা প্রসারিত করার চেষ্টা চলছে বহু বছর ধরেই। এখন ব্যাপারটা যে জায়গায় এসেছে, প্রতিরোধের দেয়াল তুলতেই হবে। যে দেয়ালে মাথা ঠুকে পশ্চাদপসরণ করতে হবে ওদের। কোথাকার ওহাবী ইসলামপন্থীরা এসে আমাদের বাংলাকে বিষাক্ত করে দিয়ে যাবেন, বাঙালি তা মানবে না এবং স্রেফ ‘মানব না’ বলে বসেও থাকবে না। বাঙালির হাতে আছে প্রতিরোধের সহিষ্ণু ও শক্তিশালী অস্ত্র।
রাজনৈতিক লড়াই চলছে, চলুক। সাধারণ বাঙালি হিসেবে আমাদের অস্ত্রের নাম বাঙালিয়ানা। বাঙালিত্ব। সহজিয়া ধর্মের চলন আমাদের ঐতিহ্য। সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমায় আন্তরিক সহিষ্ণুতা আমাদের উত্তরাধিকার। বাংলাদেশের  উগ্রবাদী মুসলমানরা হুমকি দিয়েছিল, নববর্ষের মিছিল উৎসব করতে দেবে না। কিন্তু হয়েছে-হবে। নববর্ষ হয়ে উঠুক বড় উৎসব, যেখানে অস্ত্রের আস্ফালন নেই, আছে চিরকালের বাঙালিয়ানার উজ্জ্বল উদ্যাপন। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিস্টান, কিন্তু আমরা বাঙালি। এই বাঙালিয়ানার স্নিগ্ধ অস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ।
এতদিন ছিল গণতন্ত্র ধ্বংসকারী, স্বৈরতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা। এবার তার দোসর হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। রাজনীতিকদের হাতে সত্য যেমন বিপন্ন তেমনি সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার রাস্তাও অবরুদ্ধ। আবার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক মেরুকরণ জোরদার করার ষড়যন্ত্র চলছে।
বিপন্ন হয়ে পড়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য-সম্প্রীতি। বাংলায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এই বিপন্নতা এক ভয়াবহ ধ্বংসের বার্তা দিচ্ছে।
বাংলাকে, বাংলার মানুষকে এবং বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে হলে আর কালক্ষেপনের সুযোগ নেই। যুব সমাজকে এখন ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সর্বশক্তি নিয়ে। সব ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও খেটে খাওয়া মানুষকে জোটবদ্ধ করে নামতে হবে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ময়দানে। একাজ যুবসাজ ছাড়া আর কেউ করবে না। তাই বিপন্ন বাংলার ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে যুবসাজকেই। যুবসমাজই পারবে বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মোকাবিলা করতে। আসন্ন এই লড়াইয়ের মহড়া শুরু হয়ে গেছে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়।
বাংলার রাজনৈতিক পরিসরকে ভাগাভাগি করে নিতে চায় অসাধু রাজনীতিকরা। অর্থাৎ বাংলার মানুষের জীবনে বিপন্নতাকে স্থায়ী রূপ দিতে চায়। তারা চাইছে ধর্মীয়, সম্প্রদায় ও জাত-পাতের ভিত্তিতে সমাজকে ভাগ করে দিতে। তারপর সেই বিদ্বেষ, বিচ্ছিন্নতাকে রাজনৈতিক মেরুকরণে রূপান্তরিত করতে। একাজটাকেই আশ্চর্যজনকভাবে সহজ করে দিচ্ছে আমলারা। তারা সাহায্য করছে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষবিষ ছড়াতে। অপরাধীদের আড়াল করতেই  সাজানো হচ্ছে তদন্তের অভিমুখ। স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে গোপন বোঝাপড়া।
ধর্মীয় উগ্রবাদী শক্তিকে রুখতে না পারলে বাংলার সর্বনাশ অনিবার্য। গণতন্ত্র এমনিতেই ধ্বংসের পথে। সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিত্য জ্বলছে বাংলার মাটি। লড়াই চলবে ধর্ম নিয়ে। রুজির প্রশ্ন উবে যাবে। জীবিকা নির্বাহ করাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। শিক্ষা ব্যবস্থা রসাতলে যাবে। দুর্নীতি ছাড়া চাকরি নেই। শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। দারিদ্র্য আরও বেশি গ্রাস করবে। ক্রমশ বাড়বে  সরকারের ঋণনির্ভরতা। মানুষের মজুরি বাড়বে না। আয় কমবে। অন্যদিকে বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়। বাড়বে সব সাধারণ জিনিসের দাম। মানুষের এই জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে কোথাও নেই রাজনীতিকরা। থাকবেও না। তারা শুধু ক্ষমতা চায়। লুটপাট চায়। এই লড়াই একমাত্র যুবসমাজের কাজ। বাংলাকে, বাংলার মানুষকে রক্ষার লড়াই এখন যুবসমাজের কাজ। তার জন্যই ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে সাংস্কৃতিক অভিযানের ডাক। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে বিপদের কথা। তাদের শামিল করতে হবে এই অভিযানে।
অপরদিকে, যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতির মূল কথা জনসমর্থন। সব ক্ষেত্রেই জনমত অর্থাৎ সংখ্যা গরিষ্ঠের মতই যথার্থ কি না, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু গণতন্ত্রে সংখ্যা গরিষ্ঠের মতই যে চূড়ান্ত, তা নিয়ে কোনও তর্ক চলে না। তাই দখলদারির রাজনীতিতে মেতে জনাদেশকে অস্বীকার করার প্রবণতা গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু তেমনই ঘটছে।
অভিযোগ অস্বীকার করলেই দায়মুক্ত হওয়া যায় না। প্রথমত, দেশের শাসক দল, তাদের দায় অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, সঙ্ঘাত বার বার সেখানেই তীব্র হচ্ছে, যেখানে বিরোধী দলগুলোর প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। তাই শাসক দলের দিকে আঙুল ওঠা খুব স্বাভাবিক নয় কি?   
সব ‘আমাদের’ হবে, ‘আমরা’ সবাই জিতব, ‘আমরা’ সর্বত্র জিতব, সব কিছু ‘আমাদের’ দখলেই থাকবে এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় সঙ্ঘাত। আর এই মানসিকতার জন্ম হয় গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত এক রাজনৈতিক কানাগলি থেকে। এই সব কানাগলির মালিক রাজনীতিকের মুখোশ পরা কিছু দখলদার। এই দখলদাররা শুধু সরকারের দখল নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না, সমগ্র গণতান্ত্রিক পরিসরকেই এরা গ্রাস করতে চায়। সেই কারণেই রাজনীতিকরা আক্রান্ত হন, বিরোধী রাজনীতিকদেরকে পথে নামতে দেখলেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, কোন রাজনীতিক দল বদলে রাজি না হওয়ার পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়।

বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে শাসক দল। এ দেশের প্রতিটি জনাদেশের মর্যাদা রক্ষা করার দায় তাদেরই। সে দায়িত্ব যদি পালন করতে পারেন, তাদেরও মঙ্গল, গণতন্ত্রেরও মঙ্গল। আর জনাদেশের প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা যদি বিস্মৃত হন, তা হলে কিন্তু দলও এক দিন কানাগলির মালিকদের ষড়যন্ত্রে দখল হয়ে যেতে পারে। এটাই বাস্তবতা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন