বুধবার, ২৫ জুন, ২০১৪

লুটেরা শ্রেণীর নয়, সাধারণ মানুষের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন দেখতে চায় জাতি



লুটেরা শ্রেণীর নয়, সাধারণ মানুষের দল হিসেবে
আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন দেখতে চায় জাতি

শেখ বর্ষা ॥ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন এক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের বাস্তবতার আলোকে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এর আগে শাহবাগে জেগে ওঠা গণজাগরণ  মঞ্চের শক্তি এবং বিজয় মাস ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর করতে গিয়ে সরকারের সাহসী পদক্ষেপসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারার কারণেই বিএনপি-জামাত-হেফাজত শত চেষ্টা করেও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল করতে পারেনি। এদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩ জনের এমপি হওয়ার ঘোষণা সংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন গত ১৯ জুন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত রায়ে বলেছেন, সংবিধানের সঙ্গে কোনো আইন বা বিধি সরাসরি সাংঘর্ষিক হলে আদালত তা বাতিল করতে পারেন। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক নয়। বর্তমান আইন কাঠামোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৩ এমপির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। এদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে বিশ্বসংস্থাটির মহাসচিব বান কি মুনের সাথে এক বৈঠকে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের রায় মেনে নিয়েছে এবং তারা উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলের সাথে সংলাপের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের কোনো আপত্তি নেই, তবে তা হবে সরকারের মেয়াদ শেষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ছাড়া সকল দেশই ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছে। অর্থাৎ, বিএনপি-জামাত-হেফাজত যতই চেষ্টা করুক না কেন যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর, অন্যভাবে বলতে গেলে মিথ্যাচারের পক্ষ নিয়ে এদেশের  রাজনীতিতে টিকে থাকা যে কত কঠিন বা অসম্ভব তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির এখন একূল ওকূল, দুকূলই যাওয়ার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এর নেত্রী খালেদা জিয়া এবার বিরোধী দলের মর্যাদার আসনটিও হারিয়েছেন।
কিন্তু ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে পর পর দুই বার ক্ষমতায় এসে সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ এখনো আবার যেভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে তা থেকে উত্তরণের পথ বের না করলে এই দলের ভাগ্যেও কি হবে তা এদেশের সচেতন ও বিবেকবান মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারের খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড এবং মানবসম্পদ উন্নয়নসূচকে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, তবে এখানে বড় সমস্যা হলো সুশাসনের অভাব। একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিকের জরিপে দেখানো হয়েছে, এর ৭৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ পাঠক অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়েছেন। এদিকে, ২৩ জুন ২০১৪ তারিখে আওয়ামী লীগের ৬৫-বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের প্রবীণতম সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তাঁর ‘কালের আয়নায়' ‘পঁয়ষট্টি বছরের বুড়ো বটগাছে কি নতুন পাতা গজাবে?' শীর্ষক কলামে লিখেছেন, “শেখ হাসিনার একটানা তিন দশকের বেশি সময়ের নেতৃত্ব দলটির ঐক্য রক্ষা করেছে।...কিন্তু শেখ হাসিনা যে কাজটি করতে পারেননি তা হলো, দলটির চরিত্রহীনতা ও ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়া ঠেকাতে। আওয়ামী লীগের নাম থেকে কৃষক শ্রমিক কথাটি বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং রাজনীতির সেক্যুলার কালচার থেকে পিছু হটে হটে দলটি নামে না হলেও কাজকর্মে আবার আওয়ামী মুসলিম লীগের চরিত্রে ফিরে গেছে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অভিভাবক নব্য লুটেরা শ্রেণী বিএনপিকে তো জন্মলগ্নেই গ্রাস করেছে, এখন তারা অওয়ামী লীগেও অনুপ্রবেশ করে শক্ত মাফিয়া ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। এই মাফিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে চলছে লুটের ব্যবসা নিয়ে প্রকাশ্য ও সশস্ত্র যুদ্ধ। ফলে দেশে খুন ও গুমের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বাড়ছে। এই ঘাতকের দল ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে এতই শক্তিশালী যে, তাদের দমনে প্রশাসন অক্ষম এবং আইনের শাসন দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।....আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে এখন মহীরুহের মতো বিরাট হতে পারে। কিন্তু তার গোড়ায় ঘুণে ধরেছে। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে এই ঘুণের চিহ্নটিই তার শরীরে বড় বেশি প্রকট ? পারবে কি শরীরে নতুন রক্তের সঞ্চালন দ্বারা নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে; তার অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামী চরিত্র ফেরত পেতে? পারবে কি অসাধু আমলা ও লুটেরা ধনীদের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে সময়ের দাবি মেনে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে তুলতে?”(২১ জুন, ২০১৪, দৈনিক সমকাল) সারা দেশের প্রতিটি গ্রামে-মফস্বলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আওয়ামী লীগের শত-সহস্র নিবেদিতপ্রাণ, ত্যাগী  কর্মী-সমর্থকরাই দলটিকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে, তারাই বলতে গেলে দলটির প্রাণ ভোমরা। দলটির সভানেত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে তাঁর দেয়া ভাষণ-বক্তৃতায় তাঁর দলের এই বাস্তবতার কথাটি অকপটে স্বীকারও করে থাকেন। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, দলটির নেতৃত্ব বর্তমানে নব্য ধনী, স্বাধীনতা-বিরোধীদের এজেন্ট, অসাধু আমলা ও ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে সেই সাধারণ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের (যাদের প্রাণে নিরন্তর কাজ করে বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা) কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে  না পারলে দলটির জন্য ভবিষ্যতে আরও অন্ধকার অপেক্ষা করছে। তাই সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা পূরণে দলটিকে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত করে তোলাই এখন সময়ের দাবি।

বিষমুক্ত খাদ্য চাই



সময়ের সাফ কথা ....
বিষমুক্ত খাদ্য চাই

আল্লামা সাদেক নূরী ॥ আমি, আপনি এবং আমরা সকলেই বিষমুক্ত খাদ্য চাই; আসলে সব জীবপ্রাণীই তা চায়। এটা সকলের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার হরণ কিংবা অস্বীকার করার অধিকার কারো নেই। কিন্তু কেউই কি আমরা বিষমুক্ত খাদ্য পাই?
দেশময় ফসলের কীটনাশক, অগ্রিম পাকানো, অধিক সময় সংরক্ষণ উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা খরিদ্দার আকর্ষণ ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত অপরিমিত কীটনাশক ও ফর্মালিন প্রভৃতি ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য খাদ্যপণ্যে মিশে ঘাতক বিষ হয়ে সর্বজনীন বিষযুক্ত খাদ্যে পরিণত হচ্ছে; এ বিষের মরণ গ্রাস থেকে উক্ত ক্ষতিকর দ্রব্যাদি ব্যবহারকারী নিজে অথবা তাদের সন্তানাদি সহ কোন আপনজন কি রেহাই পাচ্ছে! তিনি অথবা তারা বা তাদের স্বজনরা কোথাও যখন ফল ফলাদি বা কোন খাদ্যপণ্য গ্রহণ করেন কেউ কি তখন তাৎক্ষণিকভাবে বিষমুক্ত খাদ্য পরখ করে নিতে পারেন! অবশ্যই তা পারেন না। দেশময় যখন খাদ্যপণ্যাদি একই পক্রিয়ায় উৎপাদিত, প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকৃত তখন কারো পক্ষে অনুরূপ চিন্তা ও দাবি করা ডাহা মিথ্যাচার এবং আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছুই নয়।
দেশের জীববৈচিত্রসহ মানবজীবনে আলোচ্য বিষযুক্ত খাদ্যাগ্রাসনের তাৎক্ষনিক স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মারাত্মক এবং জীবনঘাতী পরিণতিসমূহ বাংলাদেশ বিষমুক্ত খাদ্য আন্দোলন এর আনুষ্ঠানিক উদ্যোক্তা লে. কর্ণেল (অবঃ) সেলিম উদ্দিন দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তার বিভিন্ন লেখা এবং টিভি কথোপকথনে বিস্তারিত করার চেষ্টা করছেন; এ জন্য তাকে অশেষ সাধুবাদ।
যা হোক, আমি অত্যন্ত সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে দাবি করি যে, দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারকসহ সবাই কমবেশি আলোচ্য বিষযুক্ত খাদ্যাগ্রাসনের শিকার। তাছাড়া, যে বা যারা এ আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারের দায়িত্বে নিয়োজিত এবং যাদের অচেতন দায়িত্বহীনতা বা সচেতন দায়িত্ব অবহেলার দরুণ বিষযুক্ত খাদ্যাগ্রাসন দেশময় সংক্রমিত, তারাও যদি মনে করেন যে, তারা কোন ভাবেই এ সংক্রমনের গ্রাস থেকে সম্পূর্ণমুক্ত তা হলে তারাও আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার।
এমতাবস্থায়, সকলকে বিষমুক্ত খাদ্য পেতে হলে তথা বিষমুক্ত খাদ্য খেতে হলে, এ বিষয়ে সকলকে সক্রিয় প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনই বিকল্প নেই। এতো হলো একটা সস্তা ধর্মোপদেশ। তবে, স্মরণীয় যে, ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী'। অপরদিকে স্বার্থান্ধকে হিতোপদেশ আরো ক্রোধান্ধ করে । অতএব এ মড়ক প্রতিরোধে কঠোর সরকারি আইনি নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কিছু ভাবা বাতুলতা বই নয়। বলা বাহুল্য যে, এ ব্যাপারে সরকার যতো কঠোর হবে জনগণপ্রতিরোধও ততই শক্তিশালী এবং সফল হবে।
উল্লেখ্য যে, এ বিষয়ে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপাদি উক্ত দ্রব্যাদি আমদানি লাইসেন্স পর্যায় থেকে শুরু করে আমদানিকারকদের তা বাজারজাত করার তদারকি পর্যন্ত সততা এবং স্বজ্ঞতার সঙ্গে ক্ষমাহীন দৃঢ়তায় কার্যকর করতে হবে।
এ পর্যায়ে আইন লঙ্ঘনের অপরাধে সর্বোচ্চ মেয়াদে জেল জরিমানা ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও অযৌক্তিক হবে না; কারণ আলোচ্য অপরাধটি চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সার্বজনীন প্রাণঘাতীই বটে।
মোদ্দাকথা, উক্ত দ্রব্যাদি কঠোরভাবে আমদানি, বাজারজাত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি এবং প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা না করে সরকারের তরফ থেকে বাজার বা মাঠ পর্যায়ে যাই করা হোক, সবই হবে জাতীয় অর্থ, সম্পদ ও সময়ের অপচয় এবং জনগণের জন্য ধাপ্পা এবং ধোঁকা। তবে, ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার দরুণ বাজারে ছড়িয়ে পরা উক্ত শ্রেণীর দ্রব্যাদি নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঠ পর্যায়ের সরকারি কার্যক্রম অবশ্যই চালু থাকতে হবে।
এ পর্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সরকারের যে কোন বিভাগ বা দপ্তরের দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে গণমাধ্যমে বিরূপ কথাবার্তা শুরু হলে একটি সস্তা এবং বাজে অজুহাত দেখিয়ে কর্তাব্যক্তিরা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করে থাকেন এবং এড়িয়ে যানও বটে। সে অজুহাতটি হলো, আইনের অপ্রতুলতা এবং লোকবলের অভাব। এটা শুনে শুনে জনগণ বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ।
জনবলের প্রয়োজন বা আইনের অপ্রতুলতা থাকতেই পারে। তাই বলে যারা আছেন এবং যে আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, তার প্রাপ্য কার্যকারিত জনগণ দেখতে চায়। এ পর্যায়ে জনগণ জানতে চায় এবং জনগণের সে অধিকারও অবশ্যই রয়েছে - সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগ বা দপ্তরে যারা রয়েছেন তারা এ পর্যন্ত আমদানি পর্যায়ে আইন ভঙ্গকারী ক'জনকে আইনের আওতায় সোপর্দ করেছেন? আইন কি করেছে, তা নিয়ে পরবর্তীতে কথা বলার ইচ্ছা রইল। সাধু সাবধান।

ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা এখনো অপেক্ষায় জাতীয় বীরের স্বীকৃতির!



ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা
এখনো অপেক্ষায় জাতীয় বীরের স্বীকৃতির!

শেখ ফুয়াদ ॥ ১৯শে জুন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এমন একটি দিন যা সেই বীরদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়  যারা তাদের অমূল্য জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানের অক্টোপাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলা মায়ের ওই ৩৫ জন সাহসী সন্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার দায়ের করা রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য মামলার শুনানী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। দেশ মাতৃকার ওই সব সাহসী সন্তানদের সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এই মামলার নাম দেয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু সত্যের এমনই এক শক্তি যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে ওই মামলার আসামীরাই স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পথ প্রদর্শক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। ওই মামলার প্রথম আসামী শেখ মুজিব এদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত। ওই মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, বাঙালিরা বীরের জাতি। জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে সব আসামীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী সামরিক জান্তা। তবে ওই মামলার দুই নম্বর আসামী লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে প্রাণ দিতে হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘মুক্তির  মন্দির সোপানতলে কতো প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজল'। বস্তুত পাকিস্তানের ২০ বছরে সর্ব ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্য গড়ে উঠে তা যেমনি ছিল বেদনাদায়ক, তেমনি ছিল বিস্ময়কর। পাকিস্তানী সরকারের চাকুরি করতে গিয়ে বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীতে এবং বেসামরিক প্রশাসনে কর্মরত অবস্থায় এদেশের এই সব সন্তানদের উপলব্ধি হয়েছিল যে, সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়েই পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে তারা অনেক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসরও হয়েছিলেন। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীতে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন এই পরিকল্পনাকারীদের নেতা এবং তিনি তার পরিকল্পনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ঢাকায় এবং করাচীতে বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠকেও মিলিত হয়েছিলেন। এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আইয়ুব খান তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন। এই মামলার অন্যতম আসামী সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী এমপি'র মতে, বঙ্গবন্ধুই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টে বন্দী থাকা অবস্থায় একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, তিনি মুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। কিন্তু পাকিস্তানীরা তাকে ক্ষমতা দেবে না। তখন তিনি একটি যুদ্ধে অংশ নেবেন। একই ভাবে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বাংলার মানুষকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার  আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর শত্রুরা কি করবে, কিন্তু আমরা তাঁর অযোগ্য উত্তরসূরিরা কেউ এখনও বুঝতেই পারি না কে আমাদের মিত্র, কে শত্রু। পাকিস্তানের প্রচারযন্ত্র আমাদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা মানুষের সামনে আমাদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না, ছিলাম স্বাধীনতাকামী। বঙ্গবন্ধুর ডাকে, তাঁর পরিকল্পনা অনুসারেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। ব্যরিষ্টার আমীরুল ইসলাম বলেন, আগরতলা মামলার রেশ ধরেই মুক্তিযুদ্ধ অর্জিত হয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একবার মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু সেই মামলার আসামীরা করেছেন দুইবার। তারা আমাদের জাতীয় বীর। সংসদে আগরতলা মামলার আসামীদের ‘জাতীয় বীর' হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। তাঁদের উপযুক্ত সম্মান জানাতে হবে। ...আমাদের স্টাডি গ্রুপের সদস্যরা মিলে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আগরতলা মামলার আসামীরাও সে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানীদের দুঃসহ বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির আর কোনো পথ ছিল না। এই ৩৫ জন আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের গাঙচিল, তাঁরাই আমাদের পূর্বসূরী। (তথ্যসূত্র:দৈনিক জনকন্ঠ, ২০ জুন, ২০১৩)।
বাংলাদেশে জ্ঞানতাপস হিসেবে খ্যাত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহুল পরিচিত বাণী -‘যে সমাজে গুণীর সমাদর নেই, সে সমাজে গুণীর জন্ম হতে পারে না'। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, যে জাতি তার বীরদের যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে জানে না সে জাতির মধ্যে বীরের জন্ম হওয়া কঠিন নয় কি? আগরতলা মামলার আসামী হিসেবে খ্যাত ওই সাহসী মানুষগুলোকে আজও জাতি বীরের মর্যাদা দিতে পারেনি। এর জন্য আজো সভা-সমাবেশ করে দাবি জানাতে হয়-এর চাইতে দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের তথা এ জাতির বীরত্ব গাঁথা যথাযথভাবে তুলে ধরতে হলে আগরতলা মামলার সঠিক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি এবং এ মামলায় অভিযুক্তদের যথাযথ মূল্যায়ন আজ তাই সময়ের দাবি।

সুখ সুখ করি আমি সুখ কি আমার রবে চিরদিন কালে কালে সুখ হবে কালেতে বিলীন



সুখ সুখ করি আমি সুখ কি আমার রবে চিরদিন
কালে কালে সুখ হবে কালেতে বিলীন

দিগন্ত ॥ সুখ অর্জনের প্রচেষ্টা সবাই করে। মানুষ জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুঃখ মুক্তির আন্দোলনে ব্যস্ত থাকে। দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে মানুষ দুঃখের কারণ অনুসন্ধান করে এবং দুঃখ অপনোদনের প্রয়াস করে। মানুষ দুঃখ কিছুতেই চায় না, চায় সুখ, সুখের অনুভূতি। প্রতিদিন পাগলের মতো আমরা সুখের পশ্চাতে ধাবিত হই। সুখের নাগাল পাওয়ার পূর্বেই দেখি সুখ কালেতে বিলীন হয়েছে। সুখ ধরে রাখা যায় না। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে যেমন পানি পড়ে যায় তেমনি হারিয়ে যায় সুখ। তবুও আমরা উন্মত্তভাবে সুখ সুখ করি। কত মোহান্ধ ও নির্বোধ আমরা!
ক্ষুধার্ত মানুষ সুখ চায় না। ক্ষুধার্ত মানুষ চায় খাদ্যবস্তু। খাদ্য গ্রহণ করার সময় মানুষ যে তৃপ্তি পায় তাকে সুখ বলা চলে। অর্থাৎ সুখ হলো কাম্য বস্তু ভোগের অনুভূতি। অর্থাৎ বাস্তবে মানুষ কামনা করে বস্তু। কারণ কোনরূপ বিচার বিবেচনা ব্যতীত যে কর্ম অধিকতর সুখ প্রদান করে তা-ই যদি মানুষ করতে থাকে তবে পরিণামে মানুষ দুঃখই প্রাপ্ত হবে। যেমন, ভোজনে যে সুখ আমরা পাই তা যদি বিচার বিবেচনা না করে বাড়াতে থাকি তবে অচিরেই তা অসুখ সৃষ্টি করবে। তাই সুখের ঊর্ধ্বে বিচার বিবেচনার স্থান।
সুখ বা দুঃখ আমরা অনুভব করি। ইন্দ্রিয় অনুভূতি তীব্র তাই ইন্দ্রিয় সুখও তীব্র। কবিতা পাঠের চেয়ে সুস্বাদু ভোজন তীব্র ইন্দ্রিয় সুখানুভূতি দেয়। আমরা সুখ সুখ করি কিন্তু সুখই যদি লক্ষ্য হয় তবে তুলনামূলকভাবে যে সুখ তীব্র তা-ই কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে মানুষ যদি ইন্দ্রিয় সুখকেই সর্বদা প্রাধান্য দেয় তবে তা অতি দুঃখের কারণ হবে। অন্যদিকে, ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তিতে যে সুখ হয় তার প্রবলতা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়। যে জীবনে কোনদিন আপেল খায় নাই সে প্রথম আপেলটির জন্য যে মূল্য দিতে প্রস্তুত দ্বিতীয় আপেলের জন্য তার চেয়ে কম মূল্য দেবে। অর্থনীতিতে একে বলা হয় ক্রমহ্রাসমান উপযোগ বিধি। বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় সুখে অভ্যস্থ হয়ে গেলে তা শিথিল হয়ে যায়।
দৈনন্দিন জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই হয় যখন একা কোন সুখ ভোগ করলে অনেকের দুঃখ হয়। সে ক্ষেত্রে কেবল নিজের সুখ ভোগ করলে পরিণামে দুঃখের অনুভূতি হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে এক ব্যক্তিকে কষ্ট দিলে অনেক লোকের সুখের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে সুখই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে বিত্তবানের বিত্ত বলপূর্বক অধিগ্রহণ করে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা ন্যায় বিবেচিত হবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটি করা অপরাধ। এসব ত্রুটির কারণে সুখ জীবনের লক্ষ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। সুখ-দুঃখ, ভালো লাগা-খারাপ লাগা এসব আবেগাত্মক বিষয়কে ধর্ম অধর্মের মানদণ্ড করা যায় না।
ধর্মীয় বিবেচনায় সুখের অনুভূতিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া যায় না। কারণ সুখের পরিমাণগত এবং গুণগত পার্থক্য আছে। কবিতা পাঠের সুখ আর ভোজনের সুখ এক নয়। জ্ঞানীর সুখ আর মূর্খের সুখ এক নয়। কখন কোন্‌ বস্তু কাকে কতটা সুখ দেবে তা পরিমাপ করা যায় না। চিন্তার বিকৃতিও মানুষের মধ্যে সুখ উৎপন্ন করতে পারে। অন্যকে কষ্ট দিয়ে, অন্যের উপর অত্যাচার করেও অনেকে সুখ পায়। হিংসা, ঈর্ষা, পরনিন্দাও মানুষকে সুখ দেয়। এ জাতীয় সুখ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অকল্যাণকর। কোন বস্তুর স্বাদ যেমন নির্ণয় করে না যে বস্তুটি স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ভালো ঠিক তেমনি সুখের অনুভূতিও প্রমাণ করে না যে কাজটি বিচার-বিবেচনায় ভালো।
এ জগতে সুখী মানুষের সংখ্যা খুব কম। প্রত্যেকেরই কোন না কোন দুঃখ রয়েছে। কোন ব্যক্তি হয়তো খুব বিত্তবান, প্রচুর সুস্বাদু খাদ্য তার কাছে মজুদ আছে কিন্তু সে খেতে পারে না, ডায়াবেটিস কিংবা পরিপাক যন্ত্রের ত্রুটির কারণে। অন্যজন সম্পূর্ণ সুস্থ, পরিপাক যন্ত্রও উত্তম কার্য করে কিন্তু তার হয়তো মুখে দেয়ার মতো খাবার জোটে না। কারো অনেক সন্তান। সন্তানদের কি খাওয়াবে, কি পড়াবে, এ নিয়ে তার দুঃখের শেষ নেই। অন্যজনের অনেক বিত্ত কিন্তু নিঃসন্তান।
সুখ-দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দুঃখ ব্যতীত সুখ এবং সুখ ব্যতীত দুঃখকে গ্রহণ করা যায় না। দুঃখ চাওয়া যেমন মর্যাদার নয় তেমনি সুখ চাওয়াতে কোন মর্যাদা নেই। যাদের সম্যক বিচারবুদ্ধি আছে তারা সুখের পশ্চাতে যেমন ছুটবে না তেমনি ছুটবে না দুঃখের পশ্চাতেও। যে সত্যকে নিয়ে আছে সে তো কেবল সত্যকে নিয়েই থাকবে। সুখ কিংবা দুঃখ যে কোন পরিস্থিতিতে সে সাম্যে স্থিত, পরিতৃপ্ত শুধু এই কারণেই যে সে সত্যের সঙ্গে আছে। যে সত্যের সঙ্গে আছে, সত্যও যার সঙ্গে আছে তার চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোন কারণই নেই। তাই সুখ বা দুঃখ নয়, সত্যকে নিয়ে থাকাই হলো মানুষের জীবনে মূল কাজ।
যে মানুষ সত্য নিয়ে কাজ করে তার মধ্যে স্থূল সুখ প্রাপ্তির তাগিদ থাকে না, থাকে আনন্দ সমপ্রাপ্তির এষণা। সুখ ও আনন্দ এক নয়। কুকুর হাড় চিবোতে থাকে, তাতেই তার সুখ, কিন্তু মানুষ হাড় চিবোবার আগে ভাববে, চিবোনোটা উচিত কিনা; সে ভেবে দেখে ওটা তার ক্ষুধা নিবারণ করবে কি-না। মানুষ বিচার করে কাজ করবে, কারণ মানুষের লক্ষ্য আনন্দ প্রাপ্তি, সুখ প্রাপ্তি নয়। মানুষ যদি সুখের পেছনে দৌড়োতে থাকে তাহলে ধীরে ধীরে সে পশুর দশা প্রাপ্ত হবে। পশুর জীবন নিছক ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের জন্য আর মানুষের জীবন আধ্যাত্মিক আনন্দানুভূতির জন্য।
সুখ একটি অনুভূতি।  অনুভূতি চেতনার একটি অবস্থা মাত্র। চেতনার রূপান্তর মানুষের আয়ত্বে। ইন্দ্রিয় সুখের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যই শ্রেয়। বিলোপে ও সংযমে অনেক প্রভেদ। ইন্দ্রিয়ের বিলোপ ধর্ম নয়। ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রের সামঞ্জস্যই ধর্ম।

সালাতের তাৎপর্য



সালাতের তাৎপর্য

শামস্‌ ॥ সালাত একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। আরবি ভাষায় একটি শব্দ গড়ে দশটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। সালাত শব্দটিরও অনেক অর্থ থাকতে পারে। একজন সব অর্থ বুঝতে সক্ষম হবে এমন কোন কথাও নেই। পরম করুণাময় যাকে যতটুকু জ্ঞান দান করেছেন তিনি ততটুকুই বুঝতে পারেন।
পারিভাষিক অর্থে সালাত শব্দের অর্থ কোনো কিছু সোজা করার জন্য পোড়ানো।  বাঁকা বাঁশের কঞ্চি সোজা করার জন্য প্রথমে আগুনের তাপে একে উত্তপ্ত করা হয়। তারপর ধীরে ধীরে একে কাঙ্খিত আকৃতিতে রূপায়িত করা হয়। মানুষ বাঁকা কঞ্চির মতো। না পুড়িয়ে তাকে সোজা করা যায় না। মানুষের বক্রতাকে সোজা করার প্রচেষ্টাকে সালাত বলে। সোনা পুড়লে খাঁটি হয়। আগুনের উত্তাপে সোনার খাদগুলো সোনাকে ত্যাগ করে তাদের উৎসে ফিরে যায়। মানুষের মধ্যে যেসব ভেজাল আছে সেসব ভেজাল বিষয়গুলোকে দূর করার আগুন হচ্ছে সালাত।  কর্মকার ধাতব পদার্থকে তপ্ত ও গলিত করে হাতুড়ির আঘাতে কিংবা নিজের তৈরি ছাঁচে ঢেলে আপন চিন্তার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটান। সালাতকারীও কর্মের আঘাতে উত্তপ্ত হয়ে বিকশিত করেন নিজেকে।
সালাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের পদ্ধতি, আল্লাহর সাথে বান্দার তথা প্রেমাস্পদের সাথে প্রেমিকের সংযোগ। সালাত মানব দেহে সুপ্ত পরমাত্মাকে উপলব্ধির সাধনা, ভক্তের সাথে ভগবানের, গুরুর সাথে শিষ্যের সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা। এক কথায় ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে যে কোন প্রচেষ্টাই সালাত। ধর্মজীবনের সকল দিক এবং দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সালাত ব্যাপ্ত।  স্ব-রূপ অন্বেষণও সালাত। মানুষ স্ব-রূপত আল্লাহ। নিজেকে যত সুক্ষাতিসুক্ষ্ণভাবে বিশ্ল্লেষণ করা যাবে সালাতের গভীরতা ততই বৃদ্ধি পাবে। সালাত জীবনের রহস্যকে উন্মোচন করার সাধনা। আল্লাহর প্রেমে তন্ময়তার একটা অবস্থায় উন্নীত হবার অনুশীলন। সালাতের উদ্দেশ্য হলো নফস্‌কে সকল আবিলতা হতে নিষ্কলুষ করা। নিজেকে নিরাসক্ত করা। তাই সালাত রিপুর তাড়না থেকে, কাম-লোভ-মদ-মাৎসর্য ইত্যাদি রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করার যুদ্ধ। ইমাম জাফর সাদেকের সংজ্ঞায় - ‘সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে সম্যকভাবে সম্পাদনের নাম সালাত'।
কুরআনে সালাতকারীকে মুসল্লি বলা হয়েছে। সালাত মুসল্লির বিরামহীন কর্ম। কুরআন, যারা পাঁচবার নামাজ পড়ে তাদেরকে মুসল্লি বলে না। মুসল্ল্লি তারাই - ‘যারা তাদের সালাতের উপর সর্বক্ষণ অধিষ্ঠিত থাকে। যাদের ধন সম্পদে যারা চায় এবং যারা চাইতে পারে না তাদের হক নির্ধারিত রয়েছে।  যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে। যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। যারা সাক্ষ্যদানে অটল।' (৭০:২৩-৩৫)। কুরআন মুসল্লির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আবার বলছে -‘মানুষ অতিশয় অস্থিরচিত্ত, বিপদে তারা হা-হুতাশকারী, আবার কল্যাণে তারা কৃপণ; শুধুমাত্র মুসল্লি ব্যতীত যারা তাদের সালাতে নিষ্ঠাবান।' (৭০: ১৯-২৩ ও ৩৪)। উক্ত আয়াতগুলোতে মুসল্লির যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে - তার মূলে রয়েছে - স্থিরতা, বিপদে ধৈর্য ধরা ও মানবতার সেবায় উদারতা প্রকাশ করা। সুতরাং, ব্যক্তি যতক্ষণ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে তাঁর দিকে স্থির থাকে, বিপদে ধৈর্য ধরে এবং মানবতার সেবায় কর্ম করে ততক্ষণ সে সালাতে থাকে।
সালাত আল্লাহর সাথে বান্দার সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা। সংযোগ স্থায়ী হলে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্পর্ক একটা অবিচ্ছিন্ন সংযোগ। সত্যের সাথে একাত্ম হয়ে গেলে সত্য থেকে  ব্যক্তির পৃথক কোন অস্তিত্ব থাকে না। আল্লাহ বলছেন - ‘তোমাকে একীন না দেয়া পর্যন্ত তোমার রবের এবাদত কর।' (১৫:৯৯)। একীন এমন একটা উচ্চস্তরের বিশ্বাস যা উপলব্ধির মাধ্যমে সৃষ্ট আত্মপ্রত্যয়। যাদের একীন হয়েছে তাঁরা দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছেন। তাদের চোখ থেকে বস্তুমোহের পর্দা অপসারিত হয়েছে। তাই উন্মোচিত হয়েছে সত্য। তাঁরা সালাতের উপর দণ্ডায়মান বা সালাতে প্রতিষ্ঠিত।
সালাতের মূল উপাদান ধৈর্য, বিনয় ও সাবধানতা।  বিনয়ের সাথে আল্লাহকে স্মরণও সালাত।  আল্লাহ্‌ বলেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে বিশ্বাসীরা, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়-নম্র।' (২৩: ১-২)। বিপদ আল্লাহ থেকেই আসে। তাই বিপদে ধৈর্য ধরাও সালাত। আল্লাহ বলেন - ‘তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।' (২:১৫৩)। অর্থাৎ, ধৈর্য ও সালাত একই পর্যায়ভুক্ত। তোমার দেহ খণ্ড-বিখণ্ড হোক, তোমার শরীর থেকে মাংস খসে যাক্‌ কিন্তু তুমি সালাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। ধৈর্য ধরবে। সালাতের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে কিন্তু কোন কিছুর জন্য সালাত ত্যাগ করবে না। ভয়, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, সম্পদহানি, প্রাণহানি, ফসলের ক্ষয়ক্ষতি কোনকিছুতেই যেন ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে। ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, আর ধনে-প্রাণে বা ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করব।' যারা সমস্ত বিপদ আপদকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ধৈর্যের সাথে পরীক্ষা দিতে থাকেন তাদের জন্যই সুখবর দিতে বলা হয়েছে (২:১৫৭)। একইভাবে সাবধনতাও সালাত। তাই আল্লাহ কুরআনে বারবার বলেছেন - ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সাবধানিদেরকে ভালোবাসেন।' (৯:৪,৭)। ‘আল্লাহ সাবধানিদের সঙ্গে আছেন্তু (৯:৩৬ ও ১২৩)। সাবধানিদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে জান্নাতুন নঈম। (৬৮:৩৪)। তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান যে সাবধানি।' (৪৯:১৩)। সুতরাং, সাবধানতাও সালাত।
পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাদির সমাধান করার প্রচেষ্টাও সালাত। এইক্ষেত্রে সালাত শব্দের অর্থ মিটিং বা সভা। সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য যখনই সভা আহ্বান করা হবে তখনই যেন সবাই তার ব্যক্তিগত কাজ থেকে সামাজিক কাজকে অধিক গুরুত্ব দেয় এবং সভায় উপস্থিত হয়। আলোচনার বিষয় পূর্বেই জানা থাকলে এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে যেন সভায় যোগদান করে। আলোচ্য বিষয় নিয়ে নিজস্ব প্রস্তাব গঠন সালাতের প্রস্তুতি। সভায় আদব রক্ষা করা সালাতের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই কুরআন যথার্থ আদব রক্ষার নির্দেশ দিয়ে বলছে -‘সালাতে (সভায়) স্বর উচ্চ করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না; এ দুয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করো।' (১৭: ১১০)।  ‘প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক পড়বে।' (৭:৩১) ।  সভায় শান্তভাব বজায় রেখে যেন সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করা হয়। এরকম সভার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে শান্তি স্থাপন। শান্তি স্থাপনের উদ্দেশে আহুত সভায় যেন কোন রকমের অশান্তির সৃষ্টি না হয়। এইভাবে সমাজে শান্তি স্থাপনের জন্য সমবেত হলে পৃথিবীতে ইসলাম বা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যথায় পৃথিবী জাহান্নাম বা নরকে পরিণত হবে। তাই সালাতে অংশগ্রহণ না করলে জাহান্নামের বাসিন্দা হতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘সালাত কর দিবা ভাগের দু'প্রান্তে ও রাতের প্রথমাংশে। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়।' (১১: ১১৪)। আয়াতটির তিনটি তাৎপর্য আছে এবং তিনটি তাৎপর্যই গুরুত্বপূর্ণ। ১. সকাল সন্ধ্যার এমনভাবে সালাত করতে হবে যেন সৎকর্ম অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়। সকালের সালাতে সারাদিনের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। দিনের শুরুতে আজ কি কি কাজ করতে হবে তার তালিকা প্রস্তুত করা দিবাভাগের প্রথম প্রান্তের সালাত। এই সালাত একাকি করলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পরিকল্পনা থাকবে। সকালের সালাত প্রয়োজনে জামাতে করলে সামাজিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। কর্মপরিকল্পনা (সালাত) শেষে সালাতকারীগণ তা বাস্তবায়নে লেগে যাবেন। সন্ধ্যার সালাত হবে পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তার মূল্যায়ন। রাতের প্রথমাংশে নিজের বিচার নিজে করার কাজ শেষ করতে হবে। এভাবে সালাত করলে নিঃসন্দেহে সালাত মন্দ কাজ থেকে সালাতকারীকে বিরত রাখবে। যারা এভাবে সালাত  করেন নিশ্চয়ই তারা সফলকাম।  ২. দ্বিতীয় তাৎপর্যটি আধ্যাত্মিক। সকালে সূর্য উঠে, সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত যায়। আলোর আগমন এবং প্রস্থানের সাথে সমগ্র প্রকৃতিতে, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে পরিবর্তন ঘটে। তাই এই বিশেষ দু'টি সময় সম্পর্কে বিশেষভাবে সাবধান থাকতে হয়। আলোর আগমন ও প্রস্থানে নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটে এই পরিবর্তন সম্পর্কে সাবধানতাকে সকাল সন্ধ্যার সালাত বলা হয়েছে। ৩. আলো জ্ঞানের প্রতীক আর অন্ধকার অজ্ঞানতার প্রতীক। তাই সকাল সন্ধ্যার সালাতের অপর তাৎপর্য হলো, অজ্ঞানতাকে দূর করে আলোর জগতে প্রবেশ চেষ্টা। সকালের সালাতে জ্ঞান রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা এবং সন্ধ্যার সালাতে অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত থাকার প্রচেষ্টা এই দুটি প্রচেষ্টা ক্রিয়াশীল থাকলেই সৎকর্ম অসৎকর্মকে মিটিয়ে দেয়। জ্ঞানী কখনও কোন মন্দ কাজ করতে পারেন না।
কুরআনের নির্দেশ হলো ‘সালাতকে দাঁড় করাও' অর্থাৎ সালাতের পতন হতে দিও না। দাঁড়িয়ে থাকা শুয়ে থাকার  বিপরীত। তাই সালাতে দাঁড়াও অর্থ সজাগ থাক। ঘুমিয়ে পড়ো না। যেখানে যে অবস্থায় আছো সর্বত্র সতর্ক থাকো। যখন যেখানে থাকবে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে। পক্ষান্তরে, সালাত থেকে পতিত হওয়া মানে কুরআনিক আদর্শ ও নীতি থেকে পতিত হওয়া। সালাতে অর্থাৎ তোমার নীতি ও আদর্শে তুমি এতটাই অবিচল থাকবে যেন মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন কিছু তোমাকে টলাতে না পারে।