বুধবার, ২৫ জুন, ২০১৪

ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা এখনো অপেক্ষায় জাতীয় বীরের স্বীকৃতির!



ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার অভিযুক্তরা
এখনো অপেক্ষায় জাতীয় বীরের স্বীকৃতির!

শেখ ফুয়াদ ॥ ১৯শে জুন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এমন একটি দিন যা সেই বীরদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়  যারা তাদের অমূল্য জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানের অক্টোপাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলা মায়ের ওই ৩৫ জন সাহসী সন্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার দায়ের করা রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য মামলার শুনানী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শুরু হয় ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। দেশ মাতৃকার ওই সব সাহসী সন্তানদের সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এই মামলার নাম দেয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু সত্যের এমনই এক শক্তি যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে ওই মামলার আসামীরাই স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পথ প্রদর্শক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। ওই মামলার প্রথম আসামী শেখ মুজিব এদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত। ওই মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৯৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে, বাঙালিরা বীরের জাতি। জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে সব আসামীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী সামরিক জান্তা। তবে ওই মামলার দুই নম্বর আসামী লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে প্রাণ দিতে হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘মুক্তির  মন্দির সোপানতলে কতো প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজল'। বস্তুত পাকিস্তানের ২০ বছরে সর্ব ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের যে বৈষম্য গড়ে উঠে তা যেমনি ছিল বেদনাদায়ক, তেমনি ছিল বিস্ময়কর। পাকিস্তানী সরকারের চাকুরি করতে গিয়ে বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীতে এবং বেসামরিক প্রশাসনে কর্মরত অবস্থায় এদেশের এই সব সন্তানদের উপলব্ধি হয়েছিল যে, সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়েই পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে তারা অনেক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসরও হয়েছিলেন। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীতে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন এই পরিকল্পনাকারীদের নেতা এবং তিনি তার পরিকল্পনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ঢাকায় এবং করাচীতে বেশ কয়েকবার গোপন বৈঠকেও মিলিত হয়েছিলেন। এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আইয়ুব খান তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন। এই মামলার অন্যতম আসামী সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী এমপি'র মতে, বঙ্গবন্ধুই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ক্যান্টনমেন্টে বন্দী থাকা অবস্থায় একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, তিনি মুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। কিন্তু পাকিস্তানীরা তাকে ক্ষমতা দেবে না। তখন তিনি একটি যুদ্ধে অংশ নেবেন। একই ভাবে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বাংলার মানুষকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার  আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর শত্রুরা কি করবে, কিন্তু আমরা তাঁর অযোগ্য উত্তরসূরিরা কেউ এখনও বুঝতেই পারি না কে আমাদের মিত্র, কে শত্রু। পাকিস্তানের প্রচারযন্ত্র আমাদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা মানুষের সামনে আমাদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না, ছিলাম স্বাধীনতাকামী। বঙ্গবন্ধুর ডাকে, তাঁর পরিকল্পনা অনুসারেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। ব্যরিষ্টার আমীরুল ইসলাম বলেন, আগরতলা মামলার রেশ ধরেই মুক্তিযুদ্ধ অর্জিত হয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একবার মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু সেই মামলার আসামীরা করেছেন দুইবার। তারা আমাদের জাতীয় বীর। সংসদে আগরতলা মামলার আসামীদের ‘জাতীয় বীর' হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। তাঁদের উপযুক্ত সম্মান জানাতে হবে। ...আমাদের স্টাডি গ্রুপের সদস্যরা মিলে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আগরতলা মামলার আসামীরাও সে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। পাকিস্তানীদের দুঃসহ বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির আর কোনো পথ ছিল না। এই ৩৫ জন আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের গাঙচিল, তাঁরাই আমাদের পূর্বসূরী। (তথ্যসূত্র:দৈনিক জনকন্ঠ, ২০ জুন, ২০১৩)।
বাংলাদেশে জ্ঞানতাপস হিসেবে খ্যাত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বহুল পরিচিত বাণী -‘যে সমাজে গুণীর সমাদর নেই, সে সমাজে গুণীর জন্ম হতে পারে না'। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, যে জাতি তার বীরদের যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে জানে না সে জাতির মধ্যে বীরের জন্ম হওয়া কঠিন নয় কি? আগরতলা মামলার আসামী হিসেবে খ্যাত ওই সাহসী মানুষগুলোকে আজও জাতি বীরের মর্যাদা দিতে পারেনি। এর জন্য আজো সভা-সমাবেশ করে দাবি জানাতে হয়-এর চাইতে দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের তথা এ জাতির বীরত্ব গাঁথা যথাযথভাবে তুলে ধরতে হলে আগরতলা মামলার সঠিক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি এবং এ মামলায় অভিযুক্তদের যথাযথ মূল্যায়ন আজ তাই সময়ের দাবি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন