বুধবার, ২৫ জুন, ২০১৪

দ্বৈত চেতনা


দ্বৈত চেতনা


দিগন্ত ॥ মানুষের চেতনায় দ্বৈততা আছে। পাষণ্ডের অন্তরেও দয়া আছে আবার দয়ালুর অন্তরেও নিষ্ঠুরতা আছে। মানব অস্তিত্ব প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সমাহার ও দ্বন্দ্ব। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য ইত্যাদির মধ্যেও রয়েছে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির দ্বান্দ্বিক সহাবস্থান। মানুষ সর্বদা সুখ ভোগ করতে চায়, সব রকম জৈবিক কামনা চরিতার্থ করতে চায়। কিন্তু কামনা জাগ্রত হলেই মানুষ বাস্তবে তা চরিতার্থ করে না। কামনা চরিতার্থ করার সম্ভাব্যতা সে বাস্তবতার নিরিখে যাচাই বাছাই করে। যাচাই বাছাইয়ের পরিবেশ অনুকূলে থাকলে কামনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, আর পরিবেশ প্রতিকূল হলে কামনাকে চাপা দিয়ে রাখে ফলে সৃষ্টি হয় দ্বৈত চেতনার।
পরিবেশ সম্পর্কে চেতনা আসে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। প্রত্যক্ষণের সাথে অভিজ্ঞতার সংযোগে পরিবেশের মূল্যায়ন সাধিত হয়। জন্মের পর মানুষের কোন অভিজ্ঞতা থাকে না বলে মূল্যায়নও থাকে না। শিশু আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে, এবং বাপ-মা, আত্মীয় স্বজন, শিক্ষক, শুভাকাঙ্খী এবং বিভিন্ন পরিবেশের সাথে সংযোগের মধ্য দিয়ে তার মধ্যে ক্রমে মূল্যায়নবোধ বিকশিত হয়। এই মূল্যায়নবোধ ক্রমে বিবেক রূপে গঠিত হয়।
জীবন চলার পথে প্রত্যেক মানুষই দ্বৈত চেতনার স্তর অতিক্রম করে। দ্বৈত চেতনার সহাবস্থান ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মানুষের বিকাশ ঘটে। কিন্তু কোনো কোনো পরিস্থিতিতে চেতনায় এমন তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় যে সে কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই অবস্থায় সৃষ্টি হয় অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতার।
দ্বৈত চেতনা প্রবৃত্তির সাথে সম্পৃক্ত। প্রবৃত্তির রয়েছে দুটি দিক একটি প্রেম বা সৃষ্টি বৃত্তি অপরটি ঘৃণা বা ধ্বংস বৃত্তি। প্রথমটির তাড়নায় মানুষ ভালোবাসে, মিলিত হয়, সৃষ্টি করে। আর দ্বিতীয়টির তাড়নায় মানুষ ঘৃণা করে, ধ্বংস করে, শত্রুতা করে, বিচ্ছেদ ঘটায়, বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এ দুটি বৃত্তিই অবিচ্ছেদ্যভাবে পাশাপাশি থাকে। মানুষের মধ্যে যে বৃত্তিটির প্রাধান্য থাকে সে সেরূপ কর্ম করে। মানব জীবন প্রেম ও ঘৃণা এই দুটি বৃত্তির বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ। প্রেম এবং ঘৃণা যেন একটি দোলকেরই দুটি প্রান্ত। মানুষ একটি দোলকের মতো দুলছে - একবার এদিকে, আরেকবার ঐদিকে। তাই মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকেই ঘৃণা করে। ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা কোনটাতেই সাধারণত মানুষ স্থির থাকতে পারে না। জগতে খুব কম মানুষই আছে যারা প্রেম কিংবা ঘৃণার বিন্দুতে স্থির। অধিকাংশ মানুষ কোন দিকেই শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যায় না। অর্ধেক ভালোবাসা এবং অর্ধেক ঘৃণা পর্যন্ত এদের দোলনের  বিস্তৃতি।
কে কিভাবে দুলছে এর উপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয় তার চেতনার স্তর। কিছু মানুষ আছে যারা প্রেমের বিন্দুতে স্থির। মানবীয় গুণাবলীকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করে তাঁরা মহাচেতনার স্তরে উপনীত হয়েছেন। আবার কিছু মানুষ আছে যারা ঘৃণার বিন্দুতে স্থির। ঘৃণা নিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘৃণাকেই তারা একমাত্র কাজ বলে বিবেচনা করে। ফলে তাদের পতন ঘটে অচেতন স্তরে।
মানব প্রকৃতির মধ্যে কাম, লোভ, ক্রোধ, হিংসা, অহংকার, মাৎসর্য, প্রবৃত্তির তাড়না, জৈবিক ক্ষুধা  ইত্যাদি যেমন আছে তেমনি আছে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রেমময় হয়ে উঠার ইচ্ছা। উচ্চতর চেতনার জন্য ইচ্ছার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কখনো পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এই ইচ্ছা জাগ্রত হয় আবার কখনো বা ইচ্ছা দিয়ে সে নিজেই পরিবেশের সৃষ্টি করে নেয়। ইচ্ছাশক্তি দিয়েই মানুষ তার মধ্যে ঘৃণা শক্তির নিয়ন্ত্রণ করে। ইচ্ছাশক্তি সব মানুষের মধ্যেই আছে কিন্তু প্রয়োগ না থাকার কারণে ইচ্ছাশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। আবার সফল প্রয়োগের মাধ্যমে ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় হয়। তাই ইচ্ছাশক্তি অনুযায়ী মানুষকে দৃঢ়চেতা ও দুর্বলচিত্তের হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ তার ইচ্ছাশক্তিকে প্রয়োগ করে কাজ করে না। মানুষ যখন লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সচেতন নির্বাচনের মাধ্যমে কোন কাজ করে তখনই তাতে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করা হয়।
মানুষ অধিকাংশ সময়ই কাজ করে খেয়ালে। মানুষ জানে কি করতে হবে কিন্তু সচেতনভাবে সবসময় সে তার ইচ্ছাকে ধরে রাখতে পারে না। ইচ্ছাকে চেতনার মধ্যে ধরে রাখার জন্যও অনুশীলনের প্রয়োজন। অনুশীলনের মাধ্যমে দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ আসলে তা উচ্চতর চেতনার স্তরে পৌঁছার ক্ষেত্রে দ্রুততম পরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইচ্ছানুযায়ী চিন্তাকে একরৈখিক করতে হলে দরকার পূর্ণ সতর্কতার সাথে চিন্তাকে অবলোকন করা এবং যখনই চিন্তা ইচ্ছাবহির্ভূত বিষয়ে চলে যায় তখনই তাকে সরিয়ে ইচ্ছার বিষয়ে স্থাপন করা। ইচ্ছাশক্তি, চিন্তা, বোধ ও বিবেক এক হলে চেতনার উচ্চতম স্তরে উদ্ধরণ ঘটে।
চেতনার ক্রমবিকাশ শান্তিপূর্ণ যেমন হয়, তেমনি হয়ে থাকে সংঘাতপূর্ণও। স্বার্থও ন্যায়সঙ্গত হতে পারে, ন্যায়বিরোধীও হতে পারে। প্রকৃতি ও সমাজ নিরন্তর বিকশিত হয়ে চলছে। মানুষ যা চায় তা তৈরি অবস্থায় থাকে না। পাওয়ার জন্য তাকে চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি প্রয়োগ করতে হয়। পাওয়ার আকাঙ্খাই মানুষকে কর্মে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। প্রবৃত্তির আকাঙ্খার পরিতৃপ্তির মধ্যে ডুবে থাকাই স্বার্থ। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিরোধ দেখা দেয় এবং সামাজিক ব্যবস্থা অনুযায়ী কোনো না কোনোভাবে বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। এভাবে স্বার্থের সংঘাত ও স্বার্থ সংশ্ল্লিষ্ট সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে মানুষের দ্বৈত চেতনা বিকাশের দিকে অগ্রসর হয়। কখনো দ্রুত, কখনো মন্থর গতিতে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মানুষের চেতনা বিকশিত হয়ে চলছে। মানব চেতনা এক অবস্থায় থাকে না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন